অনুবাদ : হুজাইফা মাহমুদ
প্রফেসর সালমান সায়্যিদ যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব লিডসের সোশালজি ও সোশ্যাল পলিসির প্রধান হিসাব দ্বায়িত্বরত আছেন। এর আগে অস্ট্রেলিয়ার internatioonal cenntre for muslim and nonmuslim understanding-এর উদ্বোধনী ডাইরেক্টর ছিলেন। পলিটিকাল ইসলাম, ইসলামিজম, ইসলামফোবিয়া, ডিকলোনিয়াল রেভ্যুলোশন, রেসিজম এবং ওরিয়েন্টালিজম বিষয়ে লেখালেখি করেন তিনি। তাঁর বহু গ্রন্থ পৃথিবীর বিভীন্ন ভাষায় অনূদদিত হয়েছে। তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থ recalling the caliphate ইতিমধ্যেই জ্ঞানীমহলে সাড়া জাগিয়েছে। সেক্যুলারি মুখোশের আড়ালে চলমান ভারতের উগ্র হিন্দুবাদিত্ব, মুসলিম নির্যাতন, পাক-ভারত দ্বন্দ্বে ভারতের সফলতা ও পাকিস্তানের ব্যর্থতা, ভারতে মুসলমানদের ভবিষ্যৎ ইত্যাদি বিষয়ে সারগর্ভ আলাপ করেছেন তিনি এ আলাপচারিতায়। বিশেষভাবে উঠে এসেছে কাশ্মীরে ভারতের দখলদারিত্ব এবং কাশ্মীরি মুসলমানদের দুঃখ-দুর্দশার বিষয়টিও।
রিয়াজুল খালিক : আপনার কি মনে হয়, একটি সেক্যুলার রাষ্ট্র ও ‘পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতন্ত্র’ হিসেবে ভারতের যে ভাবমূর্তি রয়েছে, সেটি তাকে ইসলামোফোবিয়া প্রশ্নে যেকোনো তদন্ত থেকে নিরাপত্তা দিয়েছে?
সালমান সায়্যিদ : এখন ১৯৪৭-এর যে কাহিনি বর্ণনা করা হয় তা মূলত একজন ‘ভালো ভাই’ এবং আরেকজন ‘খারাপ ভাই’-য়ের উপাখ্যান; যেখানে ব্যর্থ একটি রাষ্ট্র আছে, যা সবসময়ই পাকিস্তান, এবং সফল আরেকটি রাষ্ট্র আছে, যা সবসময়ই ভারত। কিন্তু বর্তমানে দুই রাষ্ট্রে চলমান অবস্থার প্রেক্ষিতের সাথে এই কেসসার কোনো বাস্তবতা নেই। ভারতের এহেন ভাবমূর্তি শুধু তার এলিট একটি শ্রেণীর কাছেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং অনেক ইউরোপীয় এলিটের জন্যও এটি জরুরী; কারণ, আংশিকভাবে হলেও এটি ইসলামোফোবিয়া কর্তৃক রূপ পেয়েছে। এই ইসলামোফোবিয়া বয়ানের বক্তব্য হলো : একজন সফল মুসলিম হওয়ার একমাত্র সম্ভাবনা আছে ভারতেই, যেখানে সবকিছু সর্বসংহত ও সর্বসুন্দর।
এখানে দুটো বিষয় লক্ষ্যণীয়। এক হলো, জনসংখ্যা নিয়ে কসরত। ভারতের মুসলিম জনসংখ্যার পরিমাণকে প্রায়শই উঠিয়ে আনা হয় দ্বিজাতিতত্ত্ব ও দেশভাগকে অবৈধ প্রমাণ করতে। আসল ব্যাপার মূলত এটিই; কাশ্মীরের সংগ্রাম এযাবৎ জাতীয় মুক্তির কোনো আন্দোলন হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি এ কারণেই। কেননা, এটাকে এই বিবেচনায় দেখা হয়নি যে, কাশ্মীর হলো পৃথিবীর সবচেয়ে ঘন সেনাবসতিপূর্ণ এলাকা। সত্যি বলতে পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ দখলদারিত্বের শিকার হয়ে আসছে কাশ্মীর।
তাই এখানে একধরনের উপেক্ষা আছে এ ব্যাপারে। যখন মুসলিমরা স্রেফ গো-মাংস খাওয়া কিংবা অন্য যেকোনো মামুলি কারণে হত্যার শিকার হয়, তখন সেগুলো এড়িয়ে যাওয়া হয় বা নাকচ করা হয়। ব্যাপারটা এমন না যে, নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই এসব ঘটছে, বরং সাতচল্লিশের পর থেকেই এটা হয়ে আসছে। এবং এসব অপরাধীরা কখনো কখনো দখলকারী ক্ষমতার এজেন্সিগুলোর বিভিন্ন সহায়তা ও সমর্থন উপভোগ করে থাকে। ভারত প্রতিষ্ঠাকাল হতে পরিচিত হয়ে এসেছে সেক্যুলার ও গণতান্ত্রিক হওয়ার দাবীর উপর ভিত্তি করে, যদিও তারা মুসলিমদের উপর পরিকল্পনামাফিক নৃতত্ত্ব-নিধন যজ্ঞ চালিয়ে আসছে। ভারতের মুসলিম জনসংখ্যা ক্রমেই আরও বেশি নগরকেন্দ্রিক হয়ে পড়ার পেছনে এধরনের হামলার আংশিক ভূমিকা আছে। তবু এখন পর্যন্ত মুসলিম নিধনের প্রসঙ্গটি অনুপস্থিত থাকে ভারত-শীর্ষক বক্তব্য ও আলাপ-আলোচনায়। সাহসী ভারতীয় বুদ্ধিজীবীরাও কেমন নিশ্চুপ থাকেন এ ব্যাপারে। মজার ব্যাপার হলো, আমরা যদি বিগত কয়েক বছরের লৈঙ্গিক অনুপাতের তথ্যের দিকে তাকাই, তাহলে দেখি পাকিস্তানে এটি বেশ উন্নতি লাভ করেছে, এবং ভারতে ধ্বসে পড়েছে। কিন্তু কেউ যখন জিজ্ঞাসা করে, কোন দেশ নারী ইস্যুতে বেশি অগ্রগতি দেখিয়েছে? লোকজন এর উত্তরে বলবে, ‘ভারত’। এসব ব্যাপার এতোটা ব্যাপকভাবে পরিচিতও হতে পারেনি।
খোলাসা হলো, ভারত বৃহত্তর সেক্যুলার ও গণতান্ত্রিক দেশ হয়ে ওঠার ধারণাটি এর প্রাতিষ্ঠানিক ইসলামভীতি ও প্রাতিষ্ঠানিক মুসলিম নির্যাতনকে সম্পূর্ণরূপে মুখোশাবৃত করে ফেলতে পারছে সেই সাতচল্লিশ থেকেই।
রিয়াজুল খালিক : ‘হিন্দু ভারত’ ধারণাটিকে কিভাবে দেখেন?
সালমান সায়্যিদ : একটি হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের চিত্রটি পরস্পরবিরোধিতার। ‘ইন্ডিয়া’ নামটি, যা ভারতীয় জাতীয়তাবাদীরা ব্যবহার করে থাকেন, সেটি সংস্কৃত থেকে আসেনি। ‘ইন্ডিয়া’ বলতে যা বুঝায় তার সমগ্র ধারণাটি অনেকাংশেই নির্মিত হয়েছে ইউরোপীয় নৃকুলবিজ্ঞান বিশারদদের দ্বারা, যাঁরা মনে করতেন ‘ইন্ডিয়া’ প্রথমত এবং মৌলিকভাবেই হিন্দুদের দেশ। কাজেই এদেশে কোনো অ-হিন্দু, অর্থাৎ ‘মুসলিম’-উপস্থিতিকে ধরে নেয়া হয়েছে বহিরাক্রমণের ফসল হিসেবে। এই ধারণার মদদদাতা হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিল ইংরেজরা, এবং পরবর্তীতে ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস’ একে সামনে বয়ে নিয়ে গেছে। অর্থাৎ ভারতকে আবশ্যিকরূপে হিন্দু ধরে নেয়া হয়, এবং এভাবেই তাকে সংজ্ঞায়িত করা হয়। কিন্তু এটা কোনো পরীক্ষালব্ধ বা গবেষণালব্ধ ভূগোলবিদ্যা নয়, বরং এগুলো মানুষের কল্পনাপ্রসূত ভূগোলবাসনা।
রিয়াজুল খালিক : ভারতে ক্রমবর্ধমান ইসলামভীতির সম্ভাব্য পরিণাম কী কী হতে পারে?
সালমান সায়্যিদ : পশ্চিমা দেশগুলোতে ইসলামভীতি এই ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, মুসলিমরা হলো তাদের দেশের সাম্প্রতিক অভিবাসী। কিন্তু ভারত, চীন, থাইল্যান্ড এবং রাশিয়ার মতো দেশগুলোর ক্ষেত্রে আপনি এ কথা বলতে পারবেন না যে, মুসলিমরা সেখানে সাম্প্রতিক সময়ে স্থানান্তরিত হয়েছে; কেননা এসব রাষ্ট্র তাদেরকে সহই গঠিত হয়েছে। এর মানে হলো, এগুলো আধুনিক জাতি রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার বহু আগ থেকেই সেখানে মুসলিম অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিল। সুতরাং ভারতের একথা বলার সুযোগ নেই যে, মুসলিমরা সাম্প্রতিক সময়ের অভিবাসী; কারণ আজকের ‘ভারত’ তার বর্তমান রূপে (জাতিরাষ্ট্র) অস্তিত্বে আসার বহু পূর্ব থেকেই মুসলিমরা সেখানে ছিল। এক্ষেত্রে, ভারতে ইসলামভীতি পশ্চিমের চেয়ে কিছুটা ব্যতিক্রমভাবে বিকশিত হয়েছে। কিন্তু তার মানে এই না যে, পশ্চিমে ইসলামভীতির যেসব ধারণা প্রচলিত আছে ভারতও সেগুলোর কিছু গ্রহণ করবে না বা করে না। মূলত ভারতের মতো জাতিরাষ্ট্রগুলোতে ইসলামভীতি কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে জাতীয় পরিচয়ের ক্ষেত্রে সংখ্যালঘু মুসলিমদের অবস্থান বিষয়ক আলোচনায়।
এখানে এসে নেহেরুর ধর্মনিরপেক্ষ প্রকল্প আর মোদির সাম্প্রদায়িক প্রকল্পের মাঝে মৌলিক কোনো পার্থক্য থাকে না। উভয়েই সংখ্যালঘুর উপর জাতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠের সাথে ‘একীভূত’ হয়ে যাওয়ার দাবীকে চাপিয়ে দেন, যার অর্থ হলো, তাদের নিজস্ব সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনপদ্ধতিকে বিসর্জন দিতে বলা। একটার কর্মপন্থা হলো, ‘সকলেই হিন্দু’ এটা বলার মাধ্যমে সব সংখ্যালঘুকে সমগোত্রের পর্যায়ে নামিয়ে আনা–সুতরাং তাদেরকে এখন হিন্দু ব্যতীত অন্যকিছু হওয়া বন্ধ করতে হবে। অপরটির কর্মপন্থা হলো, একটা ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামো দাঁড় করানো যার নিয়ামক মানদণ্ড (template) হচ্ছে কর্তৃত্বপ্রধাণ ধর্ম হিন্দুবাদ; এটি সকলের জন্য উন্মুক্ত। এবং বর্তমান ভারতে সেক্যুলারিজমকে ব্যবহার করাই হয় শুধু মুসলিমদেরকে পুলিশিং করার জন্য।
রিয়াজুল খালিক : ভারতে ইদানীং হিন্দু ফ্যসিবাদীরা নিজেদেরকে ক্রমবর্ধমানভাবে দ্রুতই প্রকাশ করছে; এ ক্ষেত্রে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ভবিষ্যত কেমন হতে পারে, বিশেষ করে মুসলমানদের?
সালমান সায়্যিদ : ভারতে এখন যেটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, সেটা প্রায় অনেকটাই আমেরিকার ‘জিম ক্রো সিস্টেমের’ মতো। আফ্রো-আমেরিকানরা যখন দাসত্ব থেকে মুক্তি পেলো, তখন তাদের আর্থ-সামাজিক অধিকারগুলোকে অস্বীকার করার জন্য ধীরে ধীরে একটি বিস্তারিত ও পরিকল্পিত নিয়ন্ত্রণী কানুন কাঠামো গড়ে উঠেছিল। ভারত খুবই স্তরিত একটি সমাজ। আপনি যখন শুনবেন সমাজের সাথে সুসম্পৃক্ত একজন মানুষ বলছে যে, সে দিল্লীর কোনো রেস্টুরেন্টে বসে খাবার খেতে আতঙ্কিত বোধ করে, কেননা, লোকজন হয়তো ভাববে সে গরুর মাংস খাচ্ছে, তখন এটা অবশ্যই মুসলমানদের কাজ-কর্ম, নিজেদের ব্যাপারে চিন্তা, এবং জন পরিবেশে তাদের অংশগ্রহণের উপর প্রভাব ফেলবে। এখন এই পরিস্থিতিতে একটাই পথ খোলা থাকে, তা হলো, দলিত ও অন্যান্য প্রগতিশীল শক্তিগুলোর মতো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সাথে ঐক্য গড়ে তোলা।
মুসলিম ও অপরাপর সংখ্যালঘুদের ভবিষ্যত কী, তা আসলে নির্ভর করে কী ধরনের ভারতের জন্ম নিবে এবং কোন ধরনের জাতীয় প্রকল্পে তাদেরকে অংশগ্রহণ করতে হবে। এ ছাড়াও, কেউ দাবীর মুখে ক্ষমতা ত্যাগ করলেও, তার জন্য লড়াই করতে হবে। হাজির কর্তৃত্ববান দলগুলো দাঁত-নখ খিঁচে লড়াই চালিয়ে যাবে ক্ষমতা জিইয়ে রাখার জন্য। এর পরিবর্তন কেবল তখনই সম্ভব হবে, দৈব শক্তিবলে হলেও, যদি চলমান সাবল্টার্ন সংগ্রামগুলো ভারতের ভবিষ্যৎত পুননির্মাণের স্বপ্নে একটি বৃহত্তর সংগ্রামে পরিণত হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলগুলো সবসময়ই এ ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখে যেন ক্ষুদ্র সংগ্রামগুলো কখনোই পরস্পরের সাথে সংযুক্ত হতে না পারে বা জোট বাঁধতে না পারে।
রিয়াজুল খালিক : আচ্ছা, কাশ্মীরের স্বাধীনতা সংগ্রাম কী কারণে কখনোই এর আঞ্চলিকতাকে অতিক্রম করে যেতে পারেনি?
সালমান সায়্যিদ : কাশ্মীরের এই প্রতিরোধ আন্দোলন যে আমাদেরকে ভারতীয় পলিসিগুলোর ব্যার্থতাকে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দেয়, এতে কোনো সন্দেহ নাই। ভারত দাবী করে যে, কাশ্মীরের এই প্রতিরোধ সংগ্রামের পেছনে একমাত্র কারণ হলো ‘বহিরাগত প্রণোদনাকারীরা’। কিন্তু কথা হলো, কাশ্মীরে বাস্তবেই যদি উদ্বেগজনক অশান্তিকর পরিস্থিতি না হতো, তাহলে সেখানে তথাকথিত ‘বহিরাগত বিশৃঙ্খলাকারীদের’-ও কোনো সুযোগ থাকত না। এবং আপনারও সেখানে আট লক্ষ নিরাপত্তাকর্মী মোতায়েনের প্রয়োজন পড়ত না কেবল ‘বহিরাগত বিশৃঙ্খলাকারীদের’ মোকাবেলা করার জন্য। একমাত্র কারণ তাহলে দাঁড়ায় যে, স্বয়ং কাশ্মীরের জনগণই এই ‘বহিরাগত’ সমস্যা।
অনেকগুলো কারণেই কাশ্মীরের সংগ্রাম তার আঞ্চলিকতাকে অতিক্রম করতে পারেনি। প্রথম হচ্ছে, পাকিস্তান যখনই কাশ্মীর ইস্যুটিকে উত্থাপন করেছে, তখন সেটা দেখা গিয়েছে ভারত-পাকিস্তানের নিজস্ব বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি মনে করি, এটি প্রকারান্তরে পাকিস্তানি পলিসির ব্যর্থতাও। কিন্তু এর পাশাপাশি এ কথাও বাস্তব যে, পাকিস্তান যদি কিছুই না করত, তাহলে কাশ্মীরের অবস্থা বর্তমানের চেয়ে আরও শোচনীয় হতো। কাশ্মীর সমস্যার এই হলো একটি দিক।
আরেকটি সমস্যা হলো, ভারত সবসময়ই কাশ্মীরকে নিজেদের ঘরোয়া নিরাপত্তা ইস্যু বলে চালিয়েছে। এবং এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ভারত অপরাপর মহা শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর সংহতি পেয়ে আসছে, যাদের নিজেদেরও এমন মুসলিম সংখ্যালঘু সমস্যা আছে।
কাশ্মীর বিষয়ে আরেকটি বোধ শক্তি পেয়েছে যে, আইন এখানে কোনো ধরনের সুবিচার প্রদানের পরিবর্তে নিপীড়নের একটি মাধ্যম হিসেবেই দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক যেমনটি ঘটেছিল বৃটিশ শাসনামলে। এক অর্থে, দখলদারিত্বের অভিজ্ঞতা কেবল এর নিপীড়নই নয়, বরং সেটি প্রতিদিনকার প্রতিনিয়ত বাস্তবতা। যুবকেরাই যার সম্মুখে থাকে সবসময়; কমবেশি এটি একটি বৈশ্বিক প্রপঞ্চ। সংখ্যালঘু কিংবা অরক্ষিত দলগুলোর উপর নির্যাতন ভারতে অস্বাভাবিক কোনো বিষয় বলে মনে করা হয় না। এটিই স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে। আরেকটু বাড়িয়ে বললে, এই সহিংস দখলদারিত্বও সেখানকার জন্য স্বাভাবিক বিষয়ই বটে।
রিয়াজুল খালিক : যদি কখনো গণভোট (plebiscite) অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে আপনার কী মনে হয়, কাশ্মীরিরা কোন দিকে যাবে?
সালমান সায়্যিদ : যদি ভারত নিশ্চিত হতো যে, গণভোট অনুষ্ঠিত হলে তারা জয়লাভ করবে, তাহলে সেটা আরও বহু আগেই অনুষ্ঠিত হতো। তারা জানে এতে তাদের পক্ষে জয়লাভ করা সম্ভব নয়। যদি কাশ্মীর স্বাধীন হয়ে যায়, তাহলে না ভারত না পাকিস্তান, কারো জন্যই সেটি ক্ষতিকর হবে না। তবে, ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে তার আচরণের অতীত অভিজ্ঞতা অবশ্যই পাকিস্তানকে প্রত্যয়ী করা উচিত, কেননা ভারত তার সকল প্রতিবেশীদের সাথেই সুসম্পর্ক নষ্ট করে ফেলেছে। সুতরাং, এখানে এটা ভাবার কারণ নেই যে, স্বাধীন কাশ্মীরের পাশেও ভারত একটি আদর্শ প্রতিবেশী হিসেবে আচরণ করবে। অপরদিকে, কাশ্মীর পাকিস্তানের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন থাকবে, এটা কল্পনা করা প্রায় অসম্ভব।
ফিলিস্তিনের মতো (উদাহরণস্বরূপ) কাশ্মীরের সংগ্রামের নকশাটা এতো পরিষ্কার নয়। কেননা, এর মাধ্যমে ভারতকে একটি ঔপনিবেশিক শক্তি হিসাবে পুনর্মূল্যায়ন করা জরুরী হয়ে পড়বে। সমস্যাটা মূলত এই পয়েন্টেই জট পাকিয়ে আছে।
রিয়াজুল খালিক : কাশ্মীরিদের জন্য সামনের পথচলা কেমন হবে?
সালমান সায়্যিদ : চলমান যেসব চ্যালেঞ্জকে তাদের মোকাবেলা করতে হচ্ছে, সেগুলোকে অবমূল্যায়ন না করেই তাদেরকে সামনের পথে চলতে হবে, এবং আরও সংঘবদ্ধ ও রাজনৈতিকভাবে সচেতন হওয়ার প্রচেষ্টা চালাতে হবে–যেন এটি তাদের দৈনন্দিন লড়াইয়ের অংশে পরিণত হয়। এটা হয়তো তাদেরকে দ্রুত কোনো ফল দেবে না, কিন্তু স্বাধীনতার সম্ভাবনা এই শর্তের মাঝেই বিদ্যমান। আপনি যদি দখলদারিত্বের অবসান ঘটাতে চান, তাহলে সর্বপ্রথম চিন্তা ও মানসিকতার দখলদারিত্ব আগে দূর করুন।
আরেকটি উল্ল্যেখযোগ্য প্রসঙ্গ এখানে অনুপস্থিত থাকছে। তা হলো, ভবিষ্যৎ স্বাধীন কাশ্মীরের উপাখ্যান বা রূপরেখা কেমন দেখাবে? আমরা সকলেই জানি, দখলদারিত্ব, জুলুম-নির্যাতন–এগুলো নিতান্তই অন্যায়। কিন্তু এর পাশাপাশি এটাও ভাবতে হবে যে, আসলে কোন ধরনের সমাজে আমরা বসবাস করতে চাই? আমি মনে করি এই বিষয়গুলো আলাপ-আলোচনায় উঠে আসা দরকার, কারণ, এর মাধ্যমে মানুষের মনে ভবিষ্যত নিয়ে আশার সঞ্চার ঘটবে।
রিয়াজুল খালিক : ইদানীং কিছু লোক কাশ্মীরের এই রাজনৈতিক আন্দোলনকে আইসিস বা আল-কায়েদার সাথে সম্পৃক্ত করে ফেলতে চাইছে। আপনার কি মনে হয় কাশ্মীরীরা এ-জাতীয় ধারণার সাথে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারবে?
সালমান সায়্যিদ : সুস্থ মস্তিষ্কের কোনো মানুষ নিজেকে আইসিসের সাথে জড়াতে পারে না। কেননা, মুসলিম আজাদির মূল অর্থবাচকতা কখনোই সম্প্রদায়গত রক্তপাতে পর্যবসিত হতে পারে না। ‘আজাদি’ নিশ্চয়ই তাকফিরবাদিতা ও বাথবাদিতার সংমিশ্রণের ঊর্ধ্বে গিয়ে আরও সুন্দর ও তাৎপর্যময় কিছুর নমুনা পেশ করবে। যেখানে তাকফিরবাদিতা আছে, সেখানে সুন্দর ও উন্নত কোনো ভবিষ্যতের সম্ভাবনা থাকবে না। তাকফিরবাদিতার সাথে সম্পৃক্ত সবকিছুই সমস্যার সৃষ্টি করবে। আপনি চিন্তা করলেই এটা বুঝবেন যখন দেখবেন মুসলিম সমাজকে অস্থিতিশীল ও ভেঙে টুকরো করে ফেলার জন্য তাকফিরি মতবাদকে কিভাবে ব্যবহার করা হয়েছে।
সুতরাং, কাশ্মীরের সংগ্রামকে আইসিসের সাথে সম্পৃক্ত করা কেবল কাশ্মীরের অধিকার আদায়ের রাজনৈতিক আন্দোলনের জন্যই ক্ষতিকর না, বরং পুরো মুসলিম উম্মার ভবিষ্যতের জন্যই ক্ষতিকর!