অনেক মুসলমানকেই আমরা ‘ইসলাম শান্তির ধর্ম’ কথাটি বলতে শুনি। বিশেষ করে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোয় বসবাসরত মুসলমানগণ অমুসলিমদের সামনে ইসলামবিরুদ্ধ কোনো বিষয় প্রতিহত করতে গিয়ে প্রায়ই বলেন— الإسلام دين السلام : ‘ইসলাম শান্তির ধর্ম’। তবে অমুসলিমরা এই কথা নাকচ করে দিয়ে বলে—তোমরা এই কথা কোন মুখে বলো? অথচ তোমরা কোরআনের এই আয়াতেও বিশ্বাস রাখো—….وقاتلوهم অর্থাৎ, ‘তোমরা (অমুসলিমদের বিরুদ্ধে) লড়াই করতে থাকো….’। তখন মুসলমানদের বাহ্যিক অবস্থা এমন দাঁড়ায়—তারা যেন অন্যদেরকে ধোঁকা দিচ্ছে, এবং ইসলামের কিছু বিষয় লুকানোর অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এখানে আবার অনেক মুসলমানকে আপনি দেখবেন—অমুসলিমদের সঙ্গে তারা বিতর্কে জড়াচ্ছে এবং প্রত্যুত্তরে বলছে—তোমাদের ধর্মেও তো এমন হত্যা ও লড়াইয়ের কথা রয়েছে।
অথচ, আমাদের ধর্মে এমন কোনো অসংগতি নেই—যার কারণে আমাদেরকে লজ্জায় পড়তে হবে।
বরং প্রথমত, এখানে আমাদের করণীয় হবে— নিজেরা সুস্পষ্টভাবে দীনের হাকিকত বুঝা ও একে গর্বের সাথে গ্রহণ করা। তাহলে আমরা বিশ্ববাসীর সামনে প্রত্যয়ের সাথে ইসলামকে তুলে ধরতে পারব, কোন ধরণের দ্বিধা ও সংকোচ ছাড়াই।
আপনি যখন বলতে চাইবেন—ইসলাম হলো অমুক মূল্যবোধের ধর্ম, তখন সেই মূল্যবোধটি ধর্মের প্রতিটি শিক্ষা ও নির্দেশনায় এমনভাবে উপস্থিত থাকতে হবে—একটি আয়াত কিংবা একটি হাদিসও যার বিরোধী হবে না। আর তাই আমরা যদি এক কথায় ইসলামের সারকথা তুলে ধরতে চাই তবে ‘ইসলাম শান্তির ধর্ম’ কথাটি বলা শুদ্ধ হবে না। কেননা ইসলাম অনেক ক্ষেত্রেই কার্যত যুদ্ধের নির্দেশ দেয়। আর তাই শুদ্ধ হলো—মানুষের সামনে একথা বলা ও প্রচার করা : ইসলাম ন্যায় ও ইনসাফের ধর্ম।
এই মূল্যবান বিষয়দুটো ইসলামের সকল নির্দেশনা তথা সকল আয়াত, হাদিস এবং বিধানাবলীতে প্রযোজ্য হয়। আপনি কখনোই এমন একটি আয়াত পাবেন না—যা ন্যায়ের বিপক্ষে অন্যায়ের নির্দেশ করে। এমনিভাবে ইনসাফের বিপরীতে গিয়ে অবিচারের আদেশ করে এমন একটি আয়াতও আপনি খুঁজে পাবেন না। এটা কখনোই সম্ভব নয়।
এই ন্যায় ও ইনসাফ এমন দুটি মূল্যবোধ—ইসলাম তার সকল বিধানাবলীতে কোনো ব্যতিক্রম ছাড়াই যাকে পরিপূর্ণভাবে রক্ষা করে। আল্লাহ তায়ালা বলেন—اللَّهُ الَّذِي أَنْزَلَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ وَالْمِيزَانَ ‘তিনিই আল্লাহ—যিনি সত্য সম্বলিত কিতাব ও ন্যায়ের তুলাদন্ড অবতীর্ণ করেছেন’। [শূরা-১৭] আয়াতে বর্ণিত ‘মিজান’ দ্বারা ইনসাফই উদ্দেশ্য। অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন—وَبِالْحَقِّ أَنْزَلْنَاهُ وَبِالْحَقِّ نَزَلَ ‘আমি এই কুরআনকে সত্যসহই নাযিল করেছি এবং সত্যসহই এটা অবতীর্ণ হয়েছে’। [বনী ইসরাঈল-১০৫] অপর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন—لَقَدْ أَرْسَلْنَا رُسُلَنَا بِالْبَيِّنَاتِ وَأَنْزَلْنَا مَعَهُمُ الْكِتَابَ وَالْمِيزَانَ لِيَقُومَ النَّاسُ بِالْقِسْطِ ‘বস্তুত আমি আমার রাসূলগণকে সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলীসহ পাঠিয়েছি এবং তাদের সঙ্গে কিতাবও নাযিল করেছি এবং তুলাদন্ডও—যাতে মানুষ ইনসাফের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকে’। [হাদীদ-২৫]
সুতরাং ইসলাম হলো ন্যায় ও ইনসাফের ধর্ম। আর এই মূল্যবোধদুটো ইসলামের সকল শাখায় প্রযোজ্য হয়। আর যদি শুধু শান্তির কথা বলতে যাই, তাহলে দেখা যাবে—কাফেরদের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করা অনেক ক্ষেত্রেই অন্যায় ও অবিচারের বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। এসব ক্ষেত্রে বরং তাদের সঙ্গে লড়াই করাটাই হবে ন্যায় ও ইনসাফ, যদিও তাতে সাময়িক শান্তি বিঘ্নিত হয়।
স্বাধীনতার বিষয়টিও এমন। কোন বন্ধনি ছাড়া সরাসরি একথা বলা কখনও শুদ্ধ হবে না—ইসলাম স্বাধীনতার ধর্ম। কারণ, তখন স্বভাবতই এই প্রশ্ন উঠবে—ইসলাম যদি স্বাধীনচেতা ধর্ম হয়, তাহলে, উদাহরণত, ব্যক্তিস্বাধীনতার বিষয়টি তোমরা মানো না কেন? এক্ষেত্রে আমাদের বক্তব্য হলো—এখানে এমন কিছু স্বাধীনতা রয়েছে—যা অন্যায় ও অবৈধ; ইসলাম তা স্বীকার করে না।
এমনিভাবে নিঃশর্তভাবে এটাও বলা যাবে না—ইসলাম সমতার ধর্ম। কারণ, তখন এই প্রশ্ন দাঁড়াবে—ইসলাম যদি সমতার ধর্মই হয়, তাহলে নারী-পুরুষের মাঝে সকল ধরণের সামাজিক ভূমিকা, অধিকার ও দায়িত্বসমূহের ক্ষেত্রে তোমরা সমান অধিকারের কথা বলো না কেন? আমরা বলবো—এমন অনেক সমতা রয়েছে—যা অন্যায় ও অবিচার।
যাইহোক—এখন প্রশ্ন হলো, সমস্ত বিষয়ে আমরা ন্যায় ও ইনসাফ কিভাবে পালন করবো? এর উত্তর হলো—আল্লাহ তায়ালার নিঃশর্ত আনুগত্য এবং এবাদতের মাধ্যমেই এটা সম্ভব। কারণ, ইসলাম হলো আল্লাহ তায়ালার এবাদত করার ধর্ম। প্রবৃত্তি, কার্যকরী সরকার, সম্পদ ও তথ্যশালী—যারা ডেমোক্রেটিক ও সংখ্যাগরিষ্ট ছদ্মনামে ঘুরে বেড়ায়—তাদের আনুগত্য করার ধর্ম নয়।
আমরা যখন আমাদের ইসলামটাকে এই চেহারায় চিনতে পারবো এবং মানুষের সামনে ইসলামের মূল আবেদনটা তুলে ধরতে পারবো, তখন কেউ যদি আমাদের মোকাবেলা করতে আসে, আমরা কোনো আয়াত কিংবা ইসলামের কোনো বিধান নিয়ে জটিলতায় পড়বো না। আর এই বার্তাটি আমাদের মুসলমান ভাই—বিশেষ করে যারা পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোতে অমুসলিমদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত মেলামেশা করছেন—তাদের উদ্দেশ্যে মূল্যবান একটি নসিহত। তারা যেন এই বিষয়টিতে স্পষ্ট ধারণা রাখেন। অমুসলিমদের উদ্দেশ্যে তাদের শ্লোগান যেন এটা হয়—ইসলাম ন্যায় ও ইনসাফের ধর্ম।
আল্লাহ তায়ালা মানুষের অন্তরে তথা তাদের প্রকৃতিতেই ন্যায় ও ইনসাফের প্রতি একটা আকর্ষণ সৃষ্টি করে রেখেছেন। এই আকর্ষণটাকে যথাযথভাবে যে গ্রহণ করে তার জন্য মোবারকবাদ। আর যে তা প্রত্যাখ্যান করে সে মূলত তার প্রকৃতির অবনতি এবং প্রবৃত্তির অনুসরণের কারণেই প্রত্যাখ্যান করে। আয়াতে এই দিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ তায়ালা বলেন—إِنَّكَ لَا تَهْدِي مَنْ أَحْبَبْتَ وَلَكِنَّ اللَّهَ يَهْدِي مَنْ يَشَاءُ ‘(হে নবী) আপনি যাকে পছন্দ করেন তাকে সরল পথ দেখাতে পারবেন না; বরং আল্লাহ তায়ালা যাকে চান তাকে সরল পথ দেখান’। [ক্বাসাস-৫৬]
আমাদের ইসলামের ক্ষেত্রে এটা সমীচিন নয়—আমরা তাকে কোনো এক কালে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে প্রচারিত কিছু শ্লোগানের অনুগামী বানিয়ে ফেলব। মূলত, যারাই এর প্রচার চালায়, তারাই সবচেয়ে বেশি এর বিরোধীতা করে। সেই শ্লোগানগুলো হলো—শান্তি, স্বাধীনতা আর সমতা—আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠন, এসবের খুব প্রচার চালায়; অন্যদিকে বৈশ্বিক রাজনীতিতে নির্লজ্জভাবে তারা এসবের বিরোধিতা করে।
আপনি ইসলাম ছাড়া অন্য আর কোনো ধর্মকে প্রকৃত শান্তি, প্রকৃত স্বাধীনতা এবং প্রকৃত সমতা প্রতিষ্ঠা করতে দেখবেন না। আহমাদ শাওকী অত্যন্ত চমৎকার বলেছেন—এমন কতো যুদ্ধ হয়েছে—যা ছিলো নবীর জন্য মর্যাদাকর। তাতে ছিলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অথবা মর্যাদাবৃদ্ধি। তাতে আল্লাহর সৈন্যদের জন্য ছিলো চরম ভোগান্তি; কিন্তু তার পিঠেই ছিলো বিশ্ববাসীর জন্য স্বাচ্ছন্দ্য। তাঁরা ভ্রষ্টতাকে এমন এক আঘাত করেছেন—যা তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। ফলে সকল অজ্ঞতা আর ভ্রষ্টতা হয়েছে নিশ্চিহ্ন। কতবার তাঁরা যুদ্ধকে শান্তি দিয়ে সমর্থন করেছেন। রক্তপাত নিবৃত্ত করেছেন—অথচ সেই কালটাই ছিলো রক্তপাতের।
- লেখাটি ড. ইয়াদ কুনাইবির নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেল থেকে নেওয়া একটি ভিডিও আলোচনার অনুলেখন ও অনুবাদ।