মানুষকে ইহকাল-পরকালের সমস্ত গুরুভার ও শৃংখল থেকে মুক্ত করা ইসলামী শরীয়ার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। (সূরা আরাফ:১৫৭) ন্যায় ও সদাচার প্রতিষ্ঠা করা শরীয়ার অন্যতম লক্ষ্য। (সূরা নাহল:৯০) এবং এই শরীয়তের বাহক হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সৃষ্টিকূলের জন্য রহমত ও অনুগ্রহ স্বরূপ প্রেরণ করা হয়েছে। (সূরা আম্বিয়া:১০৭)
ফলে শরীয়ার কোন বিধান হেকমত-প্রজ্ঞা ও কল্যাণ (مصلحة) বর্জিত বা বিরোধী হবে, এটা অসম্ভব ব্যপার। এজন্য আমরা যখন পৃথিবীর অন্যান্য ধর্ম-মতবাদ ও ইসলামের মাঝে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করি, তখন ইসলামী শরীয়ার প্রজ্ঞা ও কল্যাণ বারবার আমাদের হৃদয়কে নাড়া দেয়। ঈমানকে করে সতেজ ও মজবুত।
বস্তুতঃ শরীয়ার এই রুচি ও মেজাজ সম্পর্কে সে সকল আয়াত থেকে ধারণা পাওয়া যায়, যেখানে ঐশী বিধানাবলী বর্ণনা করার পর এর হেকমত ও কল্যাণের দিকগুলোও আলোচিত হয়েছে। যেমন, কিসাসের বিধান দেয়ার পর একথাও স্পষ্ট করে বর্ণনা করা হয়েছে—বাহ্যত যদিও এটি দ্বিতীয় আরেকটি হত্যাকাণ্ড, কিন্তু এর মধ্যে মানবজাতির জীবন ও বেঁচে থাকা নিহিত রয়েছে। (সূরা বাকারা:১৭৯) মদ ও জোয়ার নিষিদ্ধতা যেখানে আলোচিত হয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে, একদিকে এসব তোমাদের নিজেদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করে, অপরদিকে নামাজ ও আল্লাহ পাকের স্মরণ থেকে তোমাদেরকে উদাসীন করে রাখে। (সূরা মায়েদা:৯১) এমনিভাবে যদি কারো পক্ষে অজু বা গোসল করা কষ্টকর হয়, সে ক্ষেত্রে তাকে তায়াম্মুমের অনুমতি দেয়া হয়েছে। কেননা মূল উদ্দেশ্য হলো পবিত্রতা অর্জন করা; অসুবিধা ও কষ্টে ফেলা কাম্য নয়। “আল্লাহ তোমাদের উপর অসুবিধা আরোপ করতে চান না। তিনি চান তোমাদের পবিত্র করতে এবং তোমাদের উপর তার অনুগ্রহ পূর্ণ করতে”। (সূরা মায়েদা:৬৫)
কল্যাণ (مصلحة) নির্ধারণ: ইসলামী ও বস্তুবাদী মানদণ্ড
তবে এক্ষেত্রে আমাদের একটি মৌলিক বিষয় যত্নের সাথে স্মরণ রাখতে হবে—মানুষের জন্য কোন বিধান ও কাজটি কল্যাণকর, এটা নির্ধারণ করার মানদণ্ড কী হবে? এ ব্যাপারে ইসলাম এবং নিছক বস্তুবাদী ধারণাগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ ভিন্ন।
বস্তুবাদী ধারণা মতে, যে বস্তুই সাময়িক প্রশান্তি ও আনন্দ সৃষ্টি করবে, সেটি “কল্যাণ” (مصلحة) হিসেবে গৃহীত হবে; পরিণাম ও ফলাফলের বিচারে তাতে যত অকল্যাণ ও ক্ষতিই থাকুক। উদাহরণ হিসেবে নর-নারীর বিবাহবহির্ভুত সম্পর্কের কথা বলা যায়। এটি মানুষকে আত্মিক আনন্দ ও দৈহিক প্রশান্তি দেয়; কিন্তু ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজে এর অনিষ্টতা প্রকাশিত হয় বহুমাত্রিকভাবে; তবু, বস্তুবাদী ধারণায় একে “কল্যাণ” বিরোধী বা অকল্যাণ (مفسدة) হিসেবে আখ্যায়িত করা হবে না। কেননা সবকিছুর পরেও এটি ভোগ, আনন্দ ও প্রশান্তির উপকরন। বস্তুবাদী ধারণায় ধর্ম ও পরকাল চিন্তা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। অপরদিকে ইসলামি শরীয়া মতে কল্যাণের বিষয়টি আল্লাহপাক ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস এবং প্রতিপালকের সন্তুষ্টি লাভের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
ফলে, ইসলামী শরীয়ায় অনেক বিধানের ক্ষেত্রে যেমন পার্থিব কল্যাণের দিকটিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, অপরদিকে এমন অনেক বিধানও রয়েছে, যেগুলোতে ধর্মীয় ও নৈতিক কল্যাণ রক্ষার্থে পার্থিব ও বস্তুবাদী কল্যাণকে সাময়িকভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে। যেমন হজ্ব ফরজ করা হয়েছে। এটি পালন করতে সফরের ক্লান্তি সহ্য করতে হয়, বিপুল টাকা-পয়সা ব্যয় হয়। আবার কনকনে শীতের রাতেও অজু এবং গোসলের বিধান দেয়া হয়েছে। বড় বড় কিছু অপরাধের জন্য দৃষ্টান্তমূলক কঠোর শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে। সন্দেহ নেই এই প্রতিটি কাজেই ব্যক্তির সামান্য হলেও বস্তুগত ক্ষতি ও অকল্যাণ রয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি হল, এসবের আত্মিক এবং নৈতিক-চারিত্রিক কল্যাণ ও উপকারিতা অকল্যাণ ও ক্ষতি থেকে বহুগুণ বেশি।
মাকাসিদে শরীয়াহ (مقاصد الشريعة)
মূলতঃ এ কারণে ইসলামের মহান ফকীহ, ইমাম ও মুজতাহিদগণ শরীয়তের সমস্ত বিধান পূর্ণরূপে পর্যালোচনা ও অনুসন্ধান (استقراء) এর মাধ্যমে উদঘাটন করেছেন, শরীয়তের মাকাসিদ (مقاصد الشريعة) বা মূল উদ্দেশ্যসমূহ মোট পাঁচটি।
১. দীন সংরক্ষণ (حفظ الدين)
২. প্রাণ সংরক্ষন (حفظ النفس)
৩. মস্তিষ্ক সংরক্ষণ (حفظ العقل)
৪. বংশধারা সংরক্ষণ (حفظ النسل)
৫. সম্পদ সংরক্ষণ (حفظ المال)
শরীয়তের প্রত্যেকটি বিধান এই পাঁচ মাকাসিদ বা উদ্দেশ্যের কোন একটির অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ, সমস্ত বিধান দ্বারা এই পাঁচটি জিনিসের সংরক্ষণ করতে চাওয়া হয়।
এই পর্যায়ে এসে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হলো, কল্যাণ (مصلحة) ও অকল্যাণ (مفسدة) নির্ধারণের মাপকাঠি কী হবে? উপরের বিশ্লেষণের সূত্র ধরে ফকীহ ও ইমামগণ বলেছেন, শরয়ী দৃষ্টিকোন থেকে প্রত্যেক এমন বস্তু, যা উল্লেখিত পাঁচটি বিষয়কে সংরক্ষন করে বা এসবকে পূর্ণতা দেয়, শরীয়তের দৃষ্টিতে সেটাই কল্যাণ (مصلحة) হিসেবে বিবেচিত হবে। অপরদিকে যে বস্তু উক্ত পাঁচটি বা এর কোন একটিকে ব্যহত করবে, শরীয়তের দৃষ্টিতে সেটাই মাফসাদাহ(مفسدة) বা অকল্যাণ বলে গৃহীত হবে।
এই পাঁচটি মাকসাদ যেন সঠিকভাবে সংরক্ষিত হয়, সে লক্ষ্যে শরীয়তে যে সকল বিধান দেওয়া হয়েছে, চরিত্রের বিচারে সেগুলো আবার তিনভাগে বিন্যস্ত।
১. জরুরিয়াত (الضروريات)
২. হাজিয়াত (الحاجيات)
৩. তাহসীনিয়াত (التحسينيات)
এই তিন প্রকারের সবগুলোই পাঁচ মাকসাদের সাথে সম্পর্ক রাখে; তবে, সমান শক্তিতে নয়; ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায়। সামনে এই তিন প্রকারের পরিচয় ও মাকাসেদের সাথে সম্পর্কের ধরণ নিয়ে কিছুটা বিস্তারিত আলোচনা করছি।
জরুরিয়াত (الضروريات)
জরুরিয়াত হচ্ছে এমন বিষয়াবলী, যেগুলোর ওপর দীন, প্রাণ, মস্তিষ্ক, বংশধারা ও সম্পদ সংরক্ষণ সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল। এসব ছাড়া এই পাঁচটি জিনিস সংরক্ষণ করা অসম্ভব। জরুরিয়াতের কাজ হচ্ছে, এই পাঁচ জিনিসের রোকন ও ভিত্তিসমূহকে প্রতিষ্ঠিত করা এবং এগুলোর উপর আরোপিত বা ভবিষ্যতে আসতে পারে এমন সমস্যাগুলো দূর করা।
এখন আমরা উদাহরণ হিসেবে জরুরিয়্যাতের পর্যায়ভুক্ত কিছু বিধানের মাধ্যমে দেখাব কীভাবে এসবের মা্ধ্যমে পাঁচটি মাকসাদকে পূর্ণ করা হচ্ছে। যেমন,
দীন সংরক্ষণ (حفظ الدين) :
দীন সংরক্ষণ করার উদ্দেশ্যে প্রথমে এর রুকনের প্রতি জোর দেয়া হয়েছে। ঈমান আনা এবং মুখে দুই শাহাদাহ উচ্চারণ করাকে আবশ্যক করা হয়েছে। এর পাশাপাশি দীনের অন্যান্য রুকন প্রণয়ন করা হয়েছে। দীনের উপর আরোপিত বা ভবিষ্যতে আরোপ হতে পারে, এমন ক্ষতি থেকে রক্ষা করার জন্য জিহাদের বিধান দেয়া হয়েছে। মুসলিম সমাজে বিদআত প্রচারকারী ব্যক্তির জন্য শাস্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
প্রাণ সংরক্ষণ (حفظ النفس) :
এই উদ্দেশ্যে পানাহার বৈধ করা হয়েছে। কাউকে হত্যা করার অপরাধে কিসাস ও দিয়তের বিধান প্রণয়ন করা হয়েছে।
বংশধারা সংরক্ষণ (حفظ النسل) :
এজন্য প্রণয়ন করা হয়েছে বিবাহ, সন্তান প্রতিপালন ও খোরপোষের বিধান। অপরদিকে যিনাকে অবৈধ করা হয়েছে। তাছাড়া এই অপরাধের জন্য দেয়া হয়েছে নানারূপ শাস্তির বিধান।
মস্তিষ্ক সংরক্ষণ (حفظ العقل) :
মস্তিষ্ক সুস্থ ও সচল রাখার জন্য খাবার গ্রহণের বিধান দেয়া হয়েছে। আবার নেশাজাত দ্রব্য গ্রহণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কেউ গ্রহণ করলে তাকে শাস্তি ভোগ করতে হবে।
সম্পদ সংরক্ষণ (حفظ المال) :
সম্পদ সংরক্ষণের লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রকার লেনদেন বৈধ করা হয়েছে। অপরদিকে চুরিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং এর জন্য হাত কাটার মতো কঠোর বিধান জারি করা হয়েছে।
হাজিয়াত (الحاجيات)
হাজিয়াত হচ্ছে সে সকল বিধান, যেগুলোর উপর উক্ত পাঁচ মাকাসিদ যদিও নির্ভরশীল নয়, কিন্তু এই বিধানগুলো না থাকলে মাকাসিদ পাঁচটি অর্জন করতে অসুবিধা ও সংকীর্ণতা দেখা দিবে। ফলে, অসুবিধা দূর করা এবং সহজতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে যে সকল বিধান দেয়া হয়েছে, সেগুলোকে বলা হয় হাজিয়াত।
দীন সংরক্ষণের জন্য নানা জায়গায় গিয়ে শরীয়ত আমাদেরকে কিছু রুখসত বা ছাড় দিয়েছে। যেমন কোনো ঘাতকের হাত থেকে বাঁচার জন্য কুফরি বাক্য মুখে উচ্চারণ করা, সফর বা অসুস্থতার কারণে রোজা না রাখা ইত্যাদি। মানুষের মৌলিক খাদ্যের বাইরে উত্তম ও সুস্বাদু খাবার গ্রহণ ও শিকার করা বৈধ হওয়ার বিধান হলো প্রাণ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে হাজিয়াতের উদাহরণ। এমনিভাবে বংশধারা সংরক্ষণের ক্ষেত্রে মোহর ও তালাকের বিধান হাজিয়াতের দৃষ্টান্ত। সম্পদ সংরক্ষণে হাজিয়াতের দৃষ্টান্ত হচ্ছে, বিভিন্ন প্রকার লেনদেন যেমন—কিরাজ (قراض), সালাম (سلم), ও বর্গাচুক্তি (مزارعة ومساقاة)-এর বৈধতা। শরীয়তের সাধারণ মূলনীতির আলোকে এসব লেনদেন বৈধ না হওয়ার কথা; কিন্তু মানুষের অসুবিধা ও সমস্যার দিকটি বিবেচনা করে শরীয়ত এগুলোকে বৈধথা দিয়েছে।
তাহসীনিয়াত (التحسينيات)
তাহসীনিয়াত হচ্ছে সে সকল বিধান— শরীয়ত যদি এগুলোর অনুমোদন না দিত তাহলে মানুষের জীবনে উল্লেখযোগ্য কোনো অসুবিধা (حرج) ও সংকট তৈরি হতো না; তবে এ বিষয়গুলো উত্তম আখলাক (مكارم الأخلاق), সুন্দর ও প্রশংসনীয় অভ্যাসাবলীর (محاسن العادات) অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কারণে গুরুত্বপূর্ণ ও কাঙ্খিত। পাক-নাপাকির বিধান, সতর ঢেকে রাখা এবং এ শ্রেণির অন্যান্য বিধানগুলো দীন সংরক্ষণের ক্ষেত্রে তাহসীনিয়াতের উদাহরণ। প্রাণ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে এর দৃষ্টান্ত হল, পানাহারের আদব-কায়দা এবং খাবার গ্রহণে সীমালংঘন ও অতি সংকীর্ণতার পথ থেকে বেঁচে থাকা।
সম্পদ সংরক্ষণে তাহসীনিয়াতের উদাহরণ হচ্ছে নাপাক বস্তু, উদ্ধৃত পানি ও ঘাস বিক্রি নিষিদ্ধ হওয়ার বিধান। বিবাহের ক্ষেত্রে কুফু বা সমতার বিধান এবং তাদের বৈবাহিক জীবনে শিষ্টাচারগুলো (آداب المعاشرة) হচ্ছে বংশধারা সংরক্ষনের তাহসীনিয়াত।
একটা ব্যাপার মনে রাখি—আমাদের মনে হতে পারে, তাহসিনিয়্যাতের অন্তর্ভুক্ত সকল বিধানই বুঝি মুস্তাহাব পর্যায়ের। বিষয় কিন্তু এমন নয়। এর ভিতরে অনেক মুস্তাহাব বিধান যেমন রয়েছে, তেমনি অনেক ফরজ বিধানও রয়েছে। যেমন, সতর ঢাকা, পবিত্রতা অর্জন করা। তো, ফরজ হওয়া সত্তেও এগুলোকে তাহসিনিয়্যাতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে উদ্দেশ্যের বিবেচনায়। একে আমরা বিধানাবলির ক্ষেত্রে দার্শনিক বিবেচনাও বলতে পারি। অর্থাৎ, কোন বিধান তাহসীনিয়াতের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার অর্থ হচ্ছে, এ বিধান বর্জন করলে পার্থিব জীবনে মানুষ বিশেষ কোন অসুবিধার সম্মুখীন হবে না; কিন্তু আদাব-শিষ্টাচার ও আত্মিক অনেক বিবেচনার কারণে এই তাহসীনি বিধানকে শরীয়তে মানুষের জন্য আবশ্যক ও জরুরী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
মাকাসিদে শরীয়ার স্তর বিন্যাস
পূর্বে আমরা যে পাঁচটি মাকসাদের আলোচনা করেছি, এগুলোর মধ্যে গুরুত্বের বিচারে একটি স্তর বিন্যাস (مراتب) রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাকসাদ হচ্ছে দীন সংরক্ষণ (حفظ الدين)। তারপর প্রাণ সংরক্ষণ (حفظ النفس)। অতঃপর মস্তিষ্ক সংরক্ষন (حفظ العقل)। গুরুত্বের বিচারে এর পরের স্থান হল বংশধারা সংরক্ষনের (حفظ النسل). এবং সবার শেষে আসে সম্পদ সংরক্ষণ (حفظ المال) এর বিষয়টি।
আবার, বিধানগুলোকে চরিত্রের বিচারে যে তিন ভাগে ভাগ করা হলো, এর মধ্যেও নির্দিষ্ট ধারাক্রম রয়েছে। সবার উপরে হলো জরুরিয়্যাত, এরপর হাজিয়্যাত, এবং তিন নাম্বারে হলো তাহসিনিয়্যাত।
শরীয়তের বিধানাবলী পর্যালোচনা ও অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, কোন ক্ষেত্রে এই মাকাসিদগুলোর মধ্যে যদি পরস্পর সংঘর্ষ দেখা দেয়, তাহলে প্রথমেই দেখতে হবে চরিত্রের বিচারে বিধান দুটো একই স্তরের কি না। একই স্তরের না হলে একে সংঘর্ষ বলে স্বীকার করা হবে না; বরং, তুলনামূলক শক্তিশালি স্তরটিকে প্রাধান্য দেওয়া হবে।
একটি উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি আমরা বুঝতে পারি। যেমন, শরীয়তে সতর ঢাকা ফরজ। কিন্তু চিকিৎসার প্রয়োজনে জরুরত পরিমাণ সতর উন্মোচন করার বৈধতা রয়েছে। কেননা সতর ঢাকার বিধান তাহসীনি পর্যায়ের। অপরদিকে প্রাণ রক্ষার জন্য চিকিৎসা করা জরুরিয়াত পর্যায়ের বিধান। তাই শরীয়ত জরুরি (ضروري) কে তাহসীনি (تحسيني) বিধানের উপর প্রাধান্য দিয়েছে। আবার বিভিন্ন ইবাদত সম্পাদন করতে মানুষের কম বেশি কষ্ট হয়। কষ্টের কারণে যদি ছাড় দেওয়া হতো, তাহলে ছাড়েরর বিধানটি হাজিয়াতের পর্যায়ভুক্ত হতো। কিন্তু তা সত্ত্বেও শরীয়ত ইবাদতের বিধান দিয়েছে। কেননা দীন সংরক্ষণের জন্য ইবাদত সম্পাদন করা জরুরি পর্যায়ের বিধান।
কিন্তু যদি সংঘর্ষটি যদি একই স্তরের হয়, তাহলে ধারাবাহিকতা অনুসারে তুলনামূলক গুরুত্বপূর্ণ মাকসাদ কে প্রাধান্য দেয়া হবে। যেমন, কাফেরদের বিরুদ্ধে জিহাদ করলে মানুষের প্রাণহানি হতে পারে। অপরদিকে জিহাদ না করলে দীনের হেফাজত সম্ভব নয়। তাই এখানে দীন রক্ষার (حفظ الدين) মাকসাদকে প্রাণ রক্ষার (حفظ النفس) মাকসাদের উপর প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। আবার কেউ যদি তীব্র ক্ষুধার সম্মুখীন হয় এবং মদ ব্যতীত খাবার মত অন্য কিছু না পায়, তাহলে শরীয়ত তাকে প্রয়োজন পরিমাণ মদ গ্রহণ করার অনুমতি দিয়েছে। যদিও মদপান মানুষের মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা নষ্ট করে, তবুও প্রাণ রক্ষার (حفظ النفس) স্বার্থে মস্তিষ্ক সংরক্ষণের (حفظ العقل) মাকসাদকে এখানে বর্জন করা হয়েছে।
মাকাসিদে শরীয়ার চূড়ান্ত লক্ষ্য কী?
পূর্বে যে পাঁচটি মাকসাদ এবং এগুলো অর্জনের তিনটি স্তর সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে, মূলতঃ এসব কিছুই সর্বোচ্চ একটি মৌলিক ও কেন্দ্রিয় লক্ষ্য অর্জনের মাধ্যম ও উপকরণ। সেই সর্বোচ্চ লক্ষ্যটি হচ্ছে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পরিচয় লাভ করা, একনিষ্ঠ মনে তাঁর গোলামি ও বন্দেগীতে নিয়োজিত থাকা। এর মাধ্যমে বান্দা তাঁর সন্তুষ্টি লাভ করবে এবং জান্নাতের চিরস্থায়ী বাসিন্দা হবে। বস্তুতঃ এটি দুনিয়ার সাথে পরকালীন জীবনের যোগসুত্র ও বন্ধন।
এ ব্যাপারে কোরআন ও হাদিসে প্রচুর পরিমাণে সুস্পষ্ট বক্তব্য রয়েছে। কোরআনুল কারীমে আল্লাহপাক বলেন, আমি জিন ও মানুষকে সৃষ্টি করেছি এইজন্য যে, তারা আমারই ইবাদত করবে। (সূরা যারিয়াত:৫৬)
হাদীস শরীফে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, বান্দাদের উপর আল্লাহ পাকের হক হচ্ছে, তারা একমাত্র তাঁর ইবাদত করবে এবং তাঁর সাথে অন্য কাউকে অংশীদার করবে না। (সহি মুসলিম ) তিনি আরেকটি হাদিসে বলেছেন, দুনিয়া হল নিন্দিত, নিন্দিত দুনিয়াতে যা কিছু রয়েছে; তবে ব্যতিক্রম হল, আল্লাহ পাকের জিকির ও এর মত অন্যান্য বিষয় এবং আলেম ও জ্ঞান অন্বেষী ব্যক্তি। (তারা নিন্দিত নয়,বরং উত্তম ও প্রশংসনীয়) —সুনানে তিরমিজি।
সুতরাং, সৃষ্টির মূল লক্ষ্য হল, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পরিচয় লাভ এবং একমাত্র তাঁর ইবাদত বন্দেগী করা। অপরদিকে এই পাঁচ মাকাসিদের কাজ হলো মানুষের জীবনকে সুবিন্যস্ত করা, সুখ ও সৌভাগ্য নিশ্চিত করা। ফলে যে ব্যক্তি এই মাকসাদগুলো ব্যবহার করবে যে উদ্দেশ্য ও দায়িত্বের জন্য তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে তা সম্পাদন করার জন্য, সে হবে আল্লাহ পাকের কৃতজ্ঞ বান্দা; কিন্তু কেউ যদি এগুলোকে অন্য উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে তাহলে কেয়ামতের দিন সে লজ্জিত হবে। পরিতাপ করে বলবে, “আফসোস! আমার এ জীবনের জন্য আমি যদি কিছু অগ্রিম পাঠাতাম?!” (সূরা ফাজর:২৪)
এ কথাটি বলার প্রয়োজন পড়ছে এ কারণে যে, লক্ষ্য করলে দেখব, মাকসাদগুলো যে শব্দ দিয়ে ব্যক্ত করা হয়েছে, তা খুবই সাদামাটা ও সরল প্রকৃতির। এখন, একটি বিষয় আমাদের সামনে এলে আমরা আমাদের সাধারণ বিবেচনা দিয়ে বিষয়টিকে এই পাঁচটি শব্দের কোন একটির মাধ্যমে খুব দ্রুত ব্যাখ্যা করে ফেলতে পারব। এই জায়গাটি খুবই স্পর্শকাতর এবং এখানে এসেই সমকালের অনেক চিন্তকের পদস্খলন ঘটে। মনে রাখি, বিষয়টি এতো সহজ নয়। শব্দ যেন আমাদেরকে ধোঁকায় না ফেলে, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকা আমাদের একাডেমিক নৈতিকতা ও বিশেষ দায়িত্ব। সরল অর্থের এই শব্দগুলো সৃষ্টি হয়েছে শরীয়তের সমস্ত বিধানের ব্যাপাক পর্যালোচনা ও অনুসন্ধানের ভিতর দিয়ে। ফলে, এই সরলতার নেপথ্যে রয়েছে গভীর ও জটিল ইস্তেকরা ও পর্যালোচনা। এর সামর্থ না থাকলে শুধু বিন্যস্ত সহজ শব্দ দিয়ে কোন বিধানকে ব্যাখ্যা করতে গেলে পদস্খলন হবে নিশ্চিত। বর্তমানে মাকাসিদ দিয়ে উদ্ভুত নানা কিছুকে অপূর্ণাঙ্গভাবে ও অতি সরল বিবেচনা দিয়ে ব্যাখ্যা করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যেখানে শরয়ী অন্য অনেক বিবেচনা দলিত হচ্ছে। নিঃসন্দেহে এটি খুবই দুঃখজনক পরিবেশ।
তথ্যসূত্র :
১. আল মুওয়াফাকাত, ইমাম শাতেবি।
২. আল ওয়াজিয, আবদুল কারীম যাইদান।
৩. আল মাদখালুল ফিকহিয়্যুল আম, মুস্তাফা আহমদ যারকা।
৪. কামূসুল ফিকহ, খালিদ সাইফুল্লাহ রাহমানি।
৫. দাওয়াবিতুল মাসলাহাহ ফিশশারিআহ আল ইসলামিয়াহ, সাঈদ রামাদান আল বুতি।
0 Comments
Sort by
মাশাআল্লাহ, লেখাটা অনেক সুন্দর ও দরকারী।
লেখক কে আল্লাহ উত্তম বদলা দান করুক। আমীন।
ওয়েবসাইটের জন্য একটা পরামর্শঃ প্রশ্নোত্তর বিভাগটা আপনাদের ওয়েবসাইটে রাখতে পারেন। এতে সবাই উপকৃত হবে।
আপনার গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শটির জন্য শুকরিয়া। আমরা আরো সুন্দর করার চেষ্টা করব।
মাশাআল্লাহ। পুরোটা পড়লাম। ভালো লাগলো। বাস্তবধর্মী ও জীবনঘনিষ্ঠ মনে হয়েছে। এই আলোচনাগুলো ব্যাপক হওয়া দরকার।
জাযাকাল্লাহ খায়রান। উত্তম পরামর্শের জন্য শুকরিয়া।