ভূমিকা :
আপনি যদি সাধারণভাবে লেখাটি পড়ে যান, একদমই সাদামাটা কিছু মনে হবে। এ জন্য রচনাটির প্রেক্ষাপট জানা খুবই জরুরী।
আমাদের দেশে ‘মাকাসিদে শরীয়াহ’ শব্দ দুটো জনসাধারণের কাছে মোটামুটি নতুন। এর কারণ হলো, এটি নিরেট একাডেমিক একটি বিষয়; উলামায়ে কেরাম ও মুফতিগণ ইলমি গবেষণায় একে নিয়ে কাজ করেন; জনসাধারণের সামনে আলোচনা করার মত কিছু নয় এটি। কিন্তু, ইদানিং বিভিন্নজনের সাধারণ লেখাজোকায় বিষয়টি প্রায়শ আলোচিত হতে দেখা যাচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সকলের সামনে এর সাধারণ পরিচিতি ও সংশ্লিষ্ট কিছু বিষয় যথাসম্ভব বোধগম্য ভাষায় আলোচনা করার প্রয়োজনিয়তা দেখা দিয়েছে।
.
‘মাকসাদ’ মানে উদ্দেশ্য। এর বহুবচন হলো মাকাসিদ। ফলে, ‘মাকাসিদে শরীয়াহ’ মানে—শরীয়াহ এর মাধ্যমে শরীয়াহপ্রণেতার মূল উদ্দেশ্যসমূহ। কুরআন ও হাদীসে দুইটি পন্থায় বিধান বর্ণনা করা হয়েছে—মূলনীতি আকারে এবং শাখাগত সুনির্দিষ্ট বিধান আকারে। এবং সাথে এসবের মাধ্যমে বিধানপ্রণেতার উদ্দেশ্য কি তা-ও ব্যক্ত করা হয়েছে—কোথাও স্পষ্টভাবে, কোথাও আকারে-ইঙ্গিতে। এবং অনেক সময় মূল উদ্দেশ্য বুঝা যায় বিধানাবলির সামগ্রিক প্রবণতা, লক্ষণ ও পর্যালোচনার ভিত্তিতে।
মাকাসিদে শরীয়াহ এর কাজ কী? এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এর কাজ হলো মূলনীতি ও শাখাগত বিষয়গুলোর উপর আলো ফেলা, এর প্রবণতা, কারণ, চরিত্র, ধরণ ইত্যাদি নির্ণয়ে সাহায্য করা এবং এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে দিকনির্দেশনা প্রদান করা। এ দিক থেকে ‘মাকাসিদ’ শাস্ত্রটি শরীয়াহ পর্যালোচনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একেবারে শুরুর সময় থেকে নিয়ে সকল কালেই ইমামগণ ফিকহি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে গিয়ে মাকাসিদের আলোচনাটিকে গুরুত্বের সাথে সামনে রেখেছেন।
.
কিন্তু দুঃখজনক হলো, অনেক অসম্পূর্ণ চিন্তক ‘মাকাসিদ’ শাস্ত্রটিকে অস্ত্রের মত ব্যবহার করে নৈরাজ্য করতে চান। বিষয়টির জন্য আমি একটি উদাহরণ দিব। ধরা যাক, একটা প্রতিষ্ঠানে মাকসাদ বা একটা মূল উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হলো —‘আমরা সামগ্রিক কর্মপ্রচেষ্টার মাধ্যমে বিশৃঙ্খলা দূর করতে চাই’। অর্থাৎ, সুশৃঙ্খল থাকা একটি মূল উদ্দেশ্য। আবার শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য আইন করা হলো—‘কেউ যদি চুরি করে, তাহলে তার নামে শালিস বসবে’। এরপর একজন চুরি করলো। তখন একজন চিন্তক এসে বললেন—‘শালিস বসালে তর্ক-বিতর্ক হবে, বিশৃঙ্খলা হবে। এটা আমাদের মূল উদ্দেশ্যের পরিপন্থি।’ শালিস বসলে বিশৃঙ্খলা হতেই পারে, এ দিক থেকে তার যুক্তি কিন্তু সঠিক। তার ভুলটা কোথায় হচ্ছে? হচ্ছে এ জায়াগায় যে, তিনি বিশ্লেষণ করছেন না এবং মাকসাদ ও শাখাগত আইন এর মধ্যে সমন্বয় করছেন না। যে মাকসাদকে প্রয়োগ করে তিনি শাখাগত আইনগুলোকে আরো সুসংহত করতে পারতেন এবং সুবিন্যস্তভাবে প্রয়োগ করতে পারতেন, তা না করে শাখাগত আইনটিকেই বাতিল করে দিচ্ছেন। তার অবস্থানটি পরিস্কার ভুল, তা সত্তেও তিনি নিজের মতের পক্ষে অনিঃশেষ তর্ক করতে পারবেন, এবং ‘বিশৃঙ্খলা করা যাবে না’—এই ‘মাকসাদ’ প্রয়োগ করে তিনি কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির অসংখ্য আইনকে নিস্ক্রিয় করে ফেলবেন।
শরীয়াহ এর ব্যাখ্যা করতে গিয়েও কেউ কেউ ঠিক এমনটিই করছেন। মনে রাখি, শরীয়াহ এর কোন বিধান একা একা সম্পূর্ণ নয়। একটি আরেকটির সাথে বহুমাত্রিকভাবে জড়িত এবং সবগুলোর সমন্বয়ে এর একটি সামগ্রিক অভিব্যক্তি তৈরী হয়। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের কথাগুলোও কিন্তু এমন। কোন একটি কথাকে আমার জীবন থেকে বের করে নিয়ে আলাদাভাবে ব্যাখ্যা করলে মিথ্যা সংবাদ তৈরী হবে, যা দেখতে হবে সত্যের মত। ফলে, ফিকহি পর্যালোচনা হলো একটি জটিল পাকের মত। উসূল ও মানহাজ মেনে এই পাককে খুলতে হয়। সেই জায়গায় আমি যদি ব্যাপকতর একটি মাকসাদ দিয়ে সোজা সিদ্ধান্ত টানি, তাহলে আমি মূলত জটিল সেই পাকটিকে না খুলে হীরের একটি ছুরি দিয়ে কেটে ফেললাম। একে আমরা সমকালের ভাষায় বলি জেনারালাইজেশন বা সরলীকরণ। সুযোগসন্ধানীগণ এই সরলীকরণটিই করে যাচ্ছেন, নিদ্বিধভাবে।
তো, মূল কথা যেটি, অর্থাৎ, মূলনীতি, শাখাগত বিধান ও মাকাসিদ—সবগুলোর মধ্যে সমন্বয় করতে হবে এবং কোনভাবেই মাকসাদের দোহাই দিয়ে কুরআন-হাদীসে বর্ণিত শাখাগত কোন বিধানকে বাতিল করা , বা বিকৃত করা, বা অগ্রহণযোগ্যরূপে সংকুচিত করা যাবে না। ইমাম শাতেবির ‘মুওয়াফাকাত’ গ্রন্থটির দোহাই দিয়ে যারা এই কাজটি করার অপচেষ্টা করেন, লেখক ফাহাদ আজলান তাদেরকে সরাসরি ইমাম শাতেবির ‘আল মুওয়াফাকাত’ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে দিয়ে দেখিয়েছেন, ইমাম শাতেবি নিজে কীভাবে এই তিনটির মধ্যে সমন্বয় সাধন করেছেন, এবং শাখাগত বিষয়গুলোর উপর তিনি কীরকম জোর দিয়েছেন। সুতরাং, শাতেবিকে এমন ভুলভাবে ব্যবহার করাটা একাডেমিক ডিজ-অনেস্টি বা জ্ঞানগত বাটপারি।
এবার লেখাটি পড়ুন।
— সম্পাদক
এক.
ইমাম আবু ইসহাক ইবরাহীম ইবনে মুসা আশ-শাতেবী (মৃত্যু ৭৯০ হি.) -কে যতটা ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, সম্ভবত পূর্ববর্তী অন্য কোন ইমামের ক্ষেত্রে এমনটি ঘটেনি। শরীয়তের ভুল ব্যাখ্যাকারদের অনেকে শরীয়তের বিধান ও কোরআন-হাদিসের ক্ষেত্রে নিজেদের করা বিকৃত ব্যাখ্যাকে গ্রহণযোগ্য করার জন্য জোরালোভাবে ইমাম শাতেবীর নাম ব্যবহার করে।
শাখাগত বিষয়ে কোরআন-হাদিসের স্পষ্ট বক্তব্যগুলোকে হালকা ও ক্ষুদ্র করে দেখানোর জন্য ইমাম শাতেবীর সুপ্রসিদ্ধ কিতাব ‘আল মুওয়াফাকাত’কে তারা বিশেষ হাতিয়ার বানিয়ে নিয়েছে। এক্ষেত্রে কখনো কল্যাণ (مصلحة) ও উপযোগিতার দাবী করা হয়, কখনো বা যুক্তি ও বুদ্ধির (عقل) কথা বলা হয়। কখনো মূলনীতি (أصول) ও মৌলিক বিষয় (كليات) মান্য করার দাবি করা হয়।
ইমাম শাতেবী সম্পর্কে বলা হচ্ছে, তিনি তার ‘মাকাসিদ দর্শন’-এর মাধ্যমে মূল ধারার ইমাম ফকীহ ও আলেমদের থেকে পৃথক একটি পথ অবলম্বন করেছেন। ইমাম শাফেঈ থেকে শুরু করে করে উসূলে ফিকহের পরবর্তী ইমামগণ শরীয়তের মূলনীতিমালা (أصول) ও বিধানাবলী কোরআন ও হাদিসের (বাহ্যিক) শব্দ থেকে গ্রহণ করেছেন। অপরদিকে ইমাম শাতেবী শরীয়তের মূলনীতিগুলোকে শরীয়ত প্রণেতার মাকাসিদ বা মূল উদ্দেশ্যের আলোকে নির্মাণ করার প্রয়োজনীয়তার দাবি করেছেন। (বিনয়াতুল আকল আল আরাবি, মুহাম্মদ আবেদ আল জাবেরি। পৃ. ৫৪০)
কিন্তু আপনি যখন মূল শাতেবীকে পাঠ করবেন, তখন দেখতে পাবেন বিষয়টি সম্পূর্ণ উল্টো। তার সম্পর্কে যে মূল্যায়ন পেশ করা হয়েছে এর সাথে তাঁর দূরতম সম্পর্কও নেই। ‘আল মুওয়াফাকাত’-এ এই মূল্যায়নের প্রতি এতোটুকু সমর্থন পাওয়া যায় না। মূলত ইমাম শাতেবীকে এভাবে পেশ করা হয়েছে যেন শরীয়তের প্রতিষ্ঠিত বিধানগুলোকে হালকাভাবে দেখানোর পথে তার থেকে সাহায্য লাভ করা যায়।
দুই.
‘আল মুওয়াফাকাত’-এ কেউ যদি উড়ন্ত দৃষ্টিও চালান, তাহলেই এই প্রতারণার হাকিকত বুঝতে পারবেন এবং মহান এই ইমাম সম্পর্কে যে জঘন্য মিথ্যাচার করা হয়েছে, এটা তার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠবে। তিনি দেখতে পাবেন শরীয়তের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা পোষণ, কোরআন-হাদিসের সুস্পষ্ট বক্তব্য (نصوص) এবং শরীয়তের শাখাগত বিধানাবলীর (جزئيات) প্রতি যত্নবান থাকা, এবং নিছক যুক্তি ও বুদ্ধির উপর শরীয়তের দলিলকে অগ্রগণ্য ও প্রাধান্য দেয়া ইমাম শাতেবীর নিকট সুপ্রতিষ্ঠিত ও অকাট্য মূলনীতি। আল-মুওয়াফাকাত কিতাবে তিনি যা কিছু লিখেছেন এই মূলনীতির আলোকেই লিখেছেন।
ফলে, বলাই বাহুল্য, কোরআন হাদিসের বক্তব্যের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা পোষণ, এর নির্দেশনার আনুগত্য এবং কোরআন-হাদীস থেকে বিধানাবলী আহরণ— উভয় ক্ষেত্রেই ইমাম শাতেবী পূর্ববর্তী মূল ধারার মহান ইমামদের পথ ও পদ্ধতির একনিষ্ঠ অনুসারী।
এজন্য আমরা দেখি, ইমাম শাতেবীর মতে, মানুষের বুদ্ধি ও যুক্তি অহির অগ্রবর্তী হতে পারে না; বরং বিবেক বুদ্ধির কর্মক্ষেত্র শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত সীমারেখার ভেতরেই অবস্থান করতে হবে (১)। অর্থাৎ, মানুষের বিবেক-বুদ্ধি স্বয়ং বিচারক নয়; শরীয়তের অধীন ও অনুগামী। শরীয়তের যে সকল বিধানে কোরআন হাদীসের দলীলের শুদ্ধতার পক্ষে বুদ্ধিজাত যুক্তি দিয়ে প্রমাণ পেশ করা হয়, সেক্ষেত্রেও তাঁর সিদ্ধান্ত হল, কোরআন-হাদীসের দলীলটি অবশ্যই অগ্রবর্তী ও অনুসৃত হতে হবে, এবং যুক্তিনির্ভর দলীল শরয়ী দলীলের অনুগামী ও পেছনে থাকবে। (২)
তিন.
শাখাগত বিষয়ে কোরআন-হাদীসের বক্তব্যগুলোর প্রতি তিনি পূর্ণ যত্নবান ও সতর্ক ছিলেন। এ সম্পর্কে আল মুওয়াফাকাতে দীর্ঘ ও পর্যাপ্ত আলোচনা করেছেন। কারণ শরীয়তের এদিকটির প্রতি সামান্য অবহেলা কতটা ভয়ানক হতে পারে–এ বিষয়ে তিনি পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিলেন। এক্ষেত্রে তাঁর মূলনীতি হচ্ছে—যে বিষয়টি শরীয়তের কোন মূলনীতি বা বিধানকে রহিত করে বা আঘাত করে, সত্ত্বাগতভাবেই তা মিথ্যা ও বাতিল।(৩)
তাঁর মাকাসিদ বিষয়ক বিশ্লেষণকে ভুলভাবে কেউ ব্যবহার করবে, এ পথ তিনি গোড়াতেই বন্ধ করে দিয়েছেন। তিনি পরিষ্কার শব্দে বলেছেন—যে ব্যাক্তি শরীয়তের কোন মৌলিক বিষয়কে উপেক্ষা করে শুধু শাখাগত বিষয়েকে গ্রহণ করে, তার কাজটি সম্পূর্ণ ভুল। ঠিক একইভাবে যে ব্যক্তি শরীয়তের শাখাগত কোন বিধান উপেক্ষা করে শুধু মৌলিক বিষয় কে অবলম্বন করে, সেটাও মারাত্মক গলদ।(৪)
ফলে এ কথা বলা বাহুল্য যে, যারা মাকাসিদ আঁকড়ে ধরার নামে শরিয়তের প্রতিষ্ঠিত ও প্রমাণিত শাখাগত বিধানাবলী বর্জন করে থাকেন, তাদের এই কর্মপদ্ধতির সাথে ইমাম শাতেবীর দূরতম সংযোগ নেই।
চার.
ইমাম শাতেবী এ সিদ্ধান্ত দিয়েই ক্ষ্যান্ত হননি; তিনি শাখাগত দলিলকে(الدليل الجزئي) সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন। এ বিষয়ে তিনি এতটাই সতর্ক ছিলেন যে, তিনি বলেছেন, কোন বিষয়ে শরীয়তের কোন দলিল শুদ্ধ বলে প্রমাণিত হলে এটি নিজেই একটি মূলনীতি হওয়ার জন্য যথেষ্ট। (অর্থাৎ, অন্য কোন ‘মাকসাদ’ এর দোহাই দিয়ে একে অতিক্রম করার সুযোগ নেই)। তিনি লিখেছেন—‘শরীয়তের প্রত্যেকটি দলীলকেই মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা সম্ভব, চাই দলিলটি শাখাগত হোক কিংবা মৌলিক; তবে অন্যান্য দলীলের আলোকে যদি তাকে বিশেষায়িত করা হয়, তাহলে সেটা হবে ব্যতিক্রম।’(৫)
ইমাম শাতেবীর মতে, প্রবৃত্তির অনুসরণ এমন একটি ভয়ঙ্কর ও বিপদসংকুল পিচ্ছিল পথ, যা শরীয়তকে তার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত করে দেয়। শাতেবী বলেন—শরীয়ত প্রণয়ন করা দ্বারা আল্লাহ পাকের উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানুষকে প্রবৃত্তির তাড়না থেকে বের করে মুক্ত করা, যেন সে স্বেচ্ছায় আল্লাহর গোলাম হয়ে যায়, বাধ্য হয়ে যেমন শুরু থেকেই আল্লাহ পাকের গোলাম ও আজ্ঞাধীন রয়েছে।’(৬)
এই মূলনীতির আলোকে শাতেবী মজবুতভাবে প্রমান করেছেন যে, ফিকহের ক্ষেত্রে খুঁজে খুঁজে ফুকাহায়ে কেরামের রুখসত তথা ছাড়গুলোর অনুসরণ করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তিনি বলেছেন—‘রুখসত খুঁজে বেড়ানোর মানে হচ্ছে, সে ব্যক্তি প্রবৃত্তির অনুসরণ করছে। অথচ, শরীয়তের আগমনই ঘটেছে প্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে মানুষকে বিরত রাখার জন্য। তাহলে এই প্রবণতাটি সর্বসম্মত মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক হচ্ছে। (সুতরাং তা বর্জনীয়)(৭)
পাশাপাশি তিনি এটাও স্পষ্ট করেছেন— কোন মাসআলায় দুই মতামত থাকলে, এর মধ্যে কোনটি অগ্রগণ্য মত, সেটি নির্ধারণ করে দেয়া মুফতির উপর ওয়াজিব। এক্ষেত্রে তিনি প্রশ্নকারীর নিকট একই সাথে দুই মতামত বর্ণনা করবেন না। কেননা এর ফলে শরয়ী বিধানে প্রবৃত্তির অনুসরণের পথ খুলে যাবে। শাতেবী বলেন, কোন মুফতি যখন একই সময়ে দুই মতামত অনুযায়ী ফতোয়া দিবেন, এর অর্থ দাঁড়াবে— তিনি এই মাসআলায় পরিপূর্ণ বৈধতার ফতোয়া দিচ্ছেন, যা প্রথম দুই মতামতের বাইরে তৃতীয় আরেকটি মত। (৮)
কারণ, এভাবে ফতোয়া দিলে শরীয়ত যে উদ্দেশ্যে প্রণয়ন করা হয়েছে তা ব্যহত হবে। এজন্য শাতেবী বলেছেন, আমরা যদি ইমামদের মতামত ও মাযহাবের ক্ষেত্রে মুকাল্লিদেরকে (সাধারণ মানুষ) ইখতিয়ার দিয়ে দিই যে, এসব মতামত থেকে তাদের পছন্দনীয় মতটি নিজেরা বাছাই করে নিবে। তাহলে এই বাছাই প্রক্রিয়ায় প্রবৃত্তির অনুসরণ করা ব্যতীত তাদের কাছে আর কোন ভিত্তি বা মানদন্ড থাকবে না। অথচ প্রবৃত্তির অনুসরণ করা শরীয়ত প্রণয়নের মূল উদ্দেশ্য পরিপন্থী কাজ। ফলে কোনো মাসআলায় দুই বা ততোধিক মতামত থেকে কোন একটি গ্রহণ করার এখতিয়ার দেয়া কিছুতেই বৈধ নয়। (৯)
পাঁচ.
ইমাম শাতেবীর নিকট সালাফে সালেহীন তথা সাহাবী তাবেয়ী ও পূর্ববর্তী ইমামগণের পথ ও মানহাজের সর্বোচ্চ গুরুত্ব রয়েছে। এই পথ ও পদ্ধতি অনুসরণ করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি ‘আল মুওয়াফাকাত’ পাঠকের কাছে বিষয়টি তিনি খুবই যত্নের সাথে বর্ণনা করেছেন। একজন দরদী. বিশ্বস্ত ও কল্যাণকামী আলেমের ভাষায় তিনি পাঠককে সম্বোধন করে বলেছেন—পূর্ববর্তীদের বিরোধিতা করা থেকে সবসময় দূরে থাকবে, সতর্ক থাকবে। কারণ, তাদের মত-পথের বাইরে যদি কোন প্রকার কল্যাণ থাকতো, তাহলে সবার পূর্বে তারাই সেটা অর্জন করতেন। (১০)
ইমাম শাতেবীর মতে, সালাফের পথ ও পদ্ধতির অনুসরণ করা এমন একটি মূলনীতি ও মানদণ্ড, যার সাহায্যে একজন মুসলিম নিজের পথ ও পদ্ধতির শুদ্ধতা যাচাই করতে সক্ষম হয়। সালাফের পথ-পদ্ধতির বাইরে যারা কোরআনের আয়াত ও হাদীসকে ব্যাখ্যা করে, তিনি তাদের কঠোর সমালোচনা করে সংশয় ও সন্দেহের বিস্তৃত জবাব দিয়েছেন। (১১)
মহান আল্লাহ তায়ালার বন্দেগী ও দাসত্ব করা এবং তাঁর আনুগত্যের হক যথাযথভাবে আদায় করা— শাতেবির কাছে নিতান্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এদিক বিবেচনা করে জ্ঞান ও শাস্ত্রের যে সকল বিষয়বস্তু ও অধ্যায় ইবাদাত বা শরয়ী কোন কাজে ব্যবহৃত হয় না, তিনি সেগুলোকে বাদ দেয়ার দাবি জানিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, যে সকল বিষয় ‘উসূলে ফিকহ’-এ আলোচিত হয়, অথচ এগুলোর উপর ফিকহী কোন বিধান বা শরয়ী কোন আমল নির্ভরশীল নয়, অথবা এক্ষেত্রে এগুলো কোন ধরনের সাহায্যও করে না— এ শ্রেণির বিষয় ‘উসূলে ফিকহ’ শাস্ত্রে রাখা অনর্থক কাজ। (১২)
একথা তিনি এজন্য বলেছেন, যেন “শরীয়া শিক্ষার্থীদের” মূল মনোযোগ ও আগ্রহ ইবাদত ও আমলের প্রতি ঝুঁকে থাকে। তাঁর ভাষায়, শরীয়তপ্রণেতা শরয়ী জ্ঞান অর্জনের আদেশ দিয়েছেন কেবল এজন্যই যে, এর সাহায্যে আল্লাহ পাকের বন্দেগি ও দাসত্ব করা যাবে।
ছয়.
মানুষ পবিত্র কোরআনকে যেন এর বাহ্যিক শব্দমালার আলোকেই অনুধাবন করে এবং এক্ষেত্রে বাতিল ও প্রত্যাখ্যাত ব্যাখ্যা থেকে দূরে থাকে— ইমাম শাতেবী এ ব্যপারে বরাবর সতর্ক ছিলেন। এমনকি তিনি মুতাকাল্লিমীনের (ধর্মতত্ত্ববিদ) মধ্যে যারা তাবিলের (ব্যখ্যা) পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন, তাদেরকেও কঠোর নিন্দা করেছেন। (১৩)
কোরআন-হাদিসের শব্দের বাহ্যিক অর্থ বর্জন করে ভিন্ন অর্থ গ্রহণ করার পদ্ধতি শেষ পর্যন্ত পুরো শরীয়তকেই অকার্যকর করে দিতে পারে। ইমাম শাতেবী এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন—যারা এ দাবি করছেন যে, বাহ্যিক শব্দাবলী এবং এগুলো থেকে যা বোঝা যায়, এসব আল্লাহ পাকের মূল উদ্দেশ্য নয়; বরং এই শব্দসমূহ দ্বারা তাঁর মূল উদ্দেশ্য এসবের বাইরে ভিন্ন কিছু, তাদের এই দাবি তো শরীয়তের প্রতিটি অংশেই প্রযোজ্য হতে পারে, এবং এ প্রক্রিয়ায় কোরআন-হাদীসের বাহ্যিক শব্দ থেকে আল্লাহ পাকের মূল উদ্দেশ্য জানার কোনো সুযোগই থাকবে না। বস্তুত যারা শরীয়তকে অকার্যকর করে ফেলতে চায়, তারাই এসব কথা বলে, যেন নিজেদের উদ্দেশ্যটি হাসিল হয়।(১৪)
সাত.
শরীয়ত বিষয়ে কথা বলা অনেক কঠিন কাজ। ইমাম শাতেবির মধ্যে এই উপলব্ধি সর্বদা জাগ্রত ছিল। শরীয়ত বিষয়ে কোন কথা বলার ব্যাপারে তিনি সতর্ক করেছেন। কারণ, এ বিষয়ে যিনি কথা বলবেন, তিনি মূলত মহান আল্লাহ পাকের কথার ‘উদ্দেশ্য ও সঠিক অর্থ’ নির্ধারণ করে দিচ্ছেন। সেজন্য শাতেবী তাদেরকে সেদিনের কথা বিশেষভাবে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, যেদিন তাদেরকে জগতসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহর দরবারে দাঁড়াতে হবে। তিনি বলেছেন—গবেষক মুফাসসির ও ধর্মতত্ত্ববিদকে একথা গুরুত্বের সাথে স্মরণ রাখতে হবে যে, তিনি যা বলছেন, এর দ্বারা মূল কথক (আল্লাহর) উদ্দেশ্য নির্ধারণ করে দিচ্ছেন। কোরআনে কারীম মহান আল্লাহ পাকের বাণী। ফলে শরীয়া নিয়ে যিনি আলোচনা করছেন, তিনি যেন এই সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন যে, ‘আল্লাহ তাআলার এই কথা দ্বারা এই উদ্দেশ্য’। কেয়ামতের দিন আল্লাহ পাক যদি তাকে জিজ্ঞেস করেন, তুমি আমার সম্পর্কে এ কথা কোত্থেকে বলেছ? তখন তার কী জবাব হবে! এজন্য এ জায়গাটিতে অত্যন্ত সর্তকতা অবলম্বন করা আবশ্যক।
দুনিয়াবী কল্যাণ (মাসলাহাহ) এবং দীনি কল্যাণ— এ দুটির মধ্যে কোনটিকে প্রাধান্য দেয়া হবে? এ বিষয়ে ইমাম শাতেবী র.-এর অবস্থান অত্যন্ত পরিষ্কার। তিনি বলেছেন, দীনি কল্যাণ সর্বাবস্থায় দুনিয়াবী কল্যাণের উপর অগ্রগণ্য হবে। (১৫)
এখানে আমরা সংক্ষিপ্তাকারে কয়েকটি দিক আলোচনা করলাম। আশা করি, এ থেকে ইমাম শাতেবীর অনুসৃত পদ্ধতি এবং তাঁর কালজয়ী গ্রন্থ ‘আল মুয়াফাকাত’ এর আসল রূপটি পাঠকের কাছে স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হবে।
ইমাম শাতিবি রহ. এর কালজয়ী গ্রন্থ ‘আল-মুওয়াফাকাত’।
সূত্রাবলী :
১/ আল মুয়াফাকাত ১/৩৬
২/ প্রাগুক্ত ১/৭৮
৩/ প্রাগুক্ত ২/৫৫৬
৪/ প্রাগুক্ত ৩/৮
৫/ প্রাগুক্ত ৩/৪৫
৬/ প্রাগুক্ত ২/৪৬৯
৭/ প্রাগুক্ত ৪/৫১১
৮/ প্রাগুক্ত ৪/৫০৯
৯/ প্রাগুক্ত ৪/৪৯৯
১০/ প্রাগুক্ত ৩/৬৩
১১/ প্রাগুক্ত ৩/৬৬
১২/ প্রাগুক্ত ১/৪০
১৩/ প্রাগুক্ত ৩/৩৫৭
১৪/ প্রাগুক্ত ২/৬৬৭
১৫/ প্রাগুক্ত ৩/৩৮৫