(নেত্রী পর্যায়ের এক “মুসলিম নারীবাদী” কোন একসময় লিখেছিলেন যে, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মুসলমানদের জন্য আজ কুরআনকে না বলার সময় এসেছে৷ কিন্তু তার কথাটাই উল্টো করে বলতে চাই, এখন বরং মুসলমানদের সময় এসেছে প্রসন্ন চিত্তে নারীবাদকে না বলবার।)
আমার স্ত্রীর সাথে প্রথম দেখা হয় যখন আমরা উভয়েই হারভার্ড কলেজের ছাত্র ছিলাম। তথাকথিত উদ্যমী তরুণদের মত আমরাও নিজেদের নারীবাদী মনে করতাম। এর কারণটা ছিল— পারিবারিকভাবে নারীদের গৃহ নির্যাতনের ভয়াবহতার কথা আমরা হরহামেশাই দেখতাম, শুনতাম। আমরা দুজনেই উপলব্ধি করেছিলাম, যে করেই হোক নারীদের প্রতি এ ধরনের জঘন্য অত্যাচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে; এ ধরনের নিপীড়ন থেকে তাদের রক্ষা করতে হবে—নির্যাতনের প্রকার মানসিক বা শারীরিক যাই হোক না কেন। এমন একটা পৃথিবীর স্বপ্ন আমরা খুব করে দেখতাম, যেখানে নারীরা তাদের সবটুকু সম্মান, আত্মমর্যাদা, ভালোবাসার অবলম্বন এবং প্রতিটি অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকবে অন্য সবার মতই।
আগে যেমনটা চাইতাম; অনুভব করতাম, এখনও ঠিক তেমনটাই চাই, অনুভব করি। সেই শক্ত অনুভূতি এখনও বিন্দুমাত্র টলেনি।
আমাদের তখনকার মানসচিন্তার দিক থেকে নারীবাদকেই সবচাইতে মোক্ষম পন্থা মনে হতো সেই সাম্যবাদী পৃথিবী বিনির্মাণের জন্য। কিন্তু একটা করে বছর পার হতে লাগল, আমরাও টের পেতে শুরু করলাম যে, নারীবাদ আদৌ কোন সমাধান নয়। এটা বরং নিজেই বিশাল বিশাল সমস্যাগুলোর একটি।
.
নারীবাদের দার্শনিক ত্রুটিগুলো ভয়াবহ রকমের। জন্ম থেকেই এটি একটি ধর্মবিদ্বেষী ও পরিবার বিরোধী আন্দোলন হিসেবে যাত্রা শুরু করে। বিষয়টা এমন নয় যে, নারীবাদ এর কিছু অংশ মুসলিম বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক; বরং, কোন মুসলমানের কাছে শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই সত্য যে, নারীবাদ তার আপাদমস্তক সবটাই বিপদজনক একটা মতবাদ। এটা দেখতে হলে আপনাকে ইতিহাসের দিকে তাকাতে হবে। নারীবাদ এর প্রথম ঢেউ (first wave feminism) থেকে নিয়ে একেবারে তৃতীয় ঢেউ (third wave) পর্যন্ত স্মরণীয় নারীবাদী তাত্ত্বিকদের লেখাজোখা পড়লেই বুঝা যাবে কেন আমি ওরকম আপাত কঠিন উপসংহার টানলাম।
.
নারীবাদকে ঘিরে যে জটিল প্রশ্নগুলি রয়েছে, তা চোখ-কান খোলা রেখে খুব ভালোভাবে মুসলিমদের বুঝতে হবে। এগুলো ঠিকঠাক না বুঝার কারণেই অধিকাংশ মুসলিম নারীবাদী রূপ ধারণ করেন, যেমনটা আমি ও আমার স্ত্রী করেছিলাম। এর ভেতর ভীতি উদ্রেককারী রকমের এত পরিমান ইসলামবিরোধী উপাদান রয়েছে, যেটা মুসলিম বিশ্বাসকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়। বহু ঘাটাঘাটি করে আমি ও আমার স্ত্রী এর অন্যথা পাইনি। ইসলাম ও নারীবাদ—এ দুটির সম্পর্কের মাঝে দুই রকমের সমস্যা বিদ্যমান। কিছু আছে বাহ্যিক সংঘাত; আর কিছু অন্তর্গত অসঙ্গতি। সূক্ষভাবে পর্যালোচনা করলে এই সমস্যাগুলি অনিবার্য। কিন্তু মুসলিমরা যেহেতু এর সাথে জড়িত, তাই ফল দিয়ে গাছ বিচার করার নীতি মেনে আমরা প্রশ্নটা নিজেদের দিকে ছড়িয়ে দিতে চাই—কেন বেশির ভাগ মুসলিম নারীবাদীরা ইসলামের সাথে সম্পর্কের ইতি টানে?
সংখ্যার আলাপ
যেসব নারীরা নিজেদের নারীবাদী বলে পরিচয় দেন, তারা সাধারন নারীদের তুলনায় ধর্ম-কর্ম কিছুটা কম করেন। সাধারণ জনমিতিতে প্রতি ১০ জন নারীর মধ্যে সাতজনই ইহুদী-খ্রিস্টান ইসলাম বা অন্যান্য ধর্মের সাথে নিজেদের সংঘবদ্ধতা স্বীকার করেন। পক্ষান্তরে, সাধারণ নারীবাদীদের মধ্যে প্রতি ১০ জনে একজন সেরকমটা পাওয়া যায়। কিন্তু এটা কি ইঙ্গিত করে যে, শুধুমাত্র নারীবাদের কারণেই নারীদের মাঝে ধর্মত্যাগের প্রবণতা দেখা দিচ্ছে? অন্যান্য পরিসংখ্যান কিন্তু সেরকমটাই বলে।
উদাহরণস্বরূপ, ১৯৯৩ থেকে নিয়ে ২০১৩ সাল পর্যন্ত খোদ আমেরিকাতেই ধর্মত্যাগী নারীদের সংখ্যা তিনগুণ বেড়েছে। সাধারণত ধর্ম না-মানা মানুষদের সংখ্যা বর্তমান সময় তো বেড়েছেই; কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, জনসংখ্যার বিচারে ধর্ম না-মানা নারীদের ক্রমবিকাশ সামগ্রিক দিক থেকে ছাড়িয়ে গেছে। ১৯৯৩ সালে ১৬ শতাংশ নারীরা ছিল নাস্তিক ও সংশয়বাদী; কিন্তু ২০ বছরের মাথায় ওই সংখ্যা হড়হড় করে তিনগুণ বেড়ে গিয়ে ৪৩ শতাংশ হয়। বিশ্লেষকরা মনে করেন, নারীবাদ এবং দুনিয়াবাদি (সেকুলারিজম) মতাদর্শের বিস্তারই ক্রমবর্ধমান গণমাধ্যম ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর ভর করে অধার্মিকতার স্রোতকে আরও বেগবান ও গতিশীল করে তুলেছে।
এই পরিসংখ্যানের কথা বাদ দিলেও আমরা অনেকেই দেখেছি এই প্রবণতা আমাদের মুসলিম সমাজে কিরূপ প্রভাব ফেলছে। এর প্রভাব এত বেশি যে, এই প্রসঙ্গ এখন ক্লান্তিকর বোধ হয়I ইদানীংকালে যেসব ভাই-বোন ইসলাম ছেড়ে দিয়েছেন, তারা তাদের ইসলাম ত্যাগের নেপথ্যের গল্পগুলো হরদম লিখে চলেছেনI সুতরাং তাদের ধর্মত্যাগের কারণগুলো কাল্পনিক কোন গবেষণার ব্যাপার নয়; বরং তারা নিজেরাই তা জানাচ্ছেন আমাদেরকে। তারা খুব খোলাখুলিভাবেই বলেন যে, ইসলাম, কুরআন ও নবী মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হলেন পিতৃতন্ত্র ও নিগ্রহের প্রণোদনা দানকারীI আরেক কথা, ইসলাম তো নারীবাদী না, তাহলে একজন মুসলিম কি করে নারীবাদী হয়?
ঝড়ঝাপটা
স্বঘোষিত ‘মুসলিম নারীবাদীরা’ কোনমতেই এটা স্বীকার করবে না যে, নারীবাদই তাদেরকে ধর্মত্যাগের দরোজা খুলে দিয়েছে। স্পষ্ট করে বলছি, আমি কিন্তু দাবী করছি না, যে মুসলিমই নিজেকে নারীবাদী বলে শেষতক সেই মুরতাদ হয়ে যায়। আবারো বলছি, প্রত্যেক স্বঘোষিত মুসলিম নারীবাদী এক পর্যায়ে মুরতাদ হয়ে যায়—এমন দাবি আমি করছি নাI কারণ, হাঙ্গর ভর্তি পানিতে কিছু মানুষকে ছেড়ে দিলে তাদের সবাই যে হাঙ্গরের শিকারে পরিণত হবে তা নয়। আবার ব্যাতিক্রমভাবে কেউ বেঁচে গেলেও তার অবস্থা যে খুব সুবিধাজনক হবে, তাও নয়। তাদের মধ্য থেকে খুব দক্ষ ও চৌকস সাঁতারু কেউ যদি কোনরকম সাঁতরে পারে উঠেও যায়, তার অবস্থাও হবে থেঁতলানো ও রক্তাক্ত। বাকি অন্যদের হাঙ্গরের পেটে যাওয়া ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই।
ঠিক একইভাবে নারীবাদও মুসলিম সমাজের অখণ্ডতাকে তিলে তিলে গ্রাস করে চলেছেI যদি আমাদের ঈমানের প্রতি দরদ থেকে থাকে, বিশেষ করে পরবর্তী প্রজন্মের ঈমানের প্রতি, তাহলে কোনভাবেই এই গতিশীল প্রবণতাকে আর হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নাই। কোন সমস্যাকে চিহ্নিত করতে হলে সর্বপ্রথম যে কাজটি করতে হবে, তা হলো—সমস্যাটির অস্তিত্বের কথা স্বীকার করা। এই জায়গাটা রীতিমতো চরম নৈরাশ্য ও হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে আমি ও আমার মত যারা আছে তাদের জন্যI বিশেষ করে আমেরিকান মুসলিম সমাজ কোনভাবেই মানতে চান না যে, নারীবাদ একটি বিধ্বংসী প্রপঞ্চI শুধু তাই নয়; ঈমানের জন্য সরাসরি হুমকিওI এটার কারণে এমন হতে পারে, যদি রাজনৈতিকভাবে কেউ এর বিরোধিতা করে, তাহলে বিভ্রান্ত সক্রিয় গোষ্ঠী তার দিকে উদ্ভ্রান্তের মতো তেড়ে আসবেI এই ক্ষোভের কারণ একটাই—তারা পার্টি লাইনকে সন্তোষ চিত্তে মেনে নিচ্ছে নাI
কিন্তু যত অস্বস্তিকরই হোক, অবশ্যই আমাদেরকে এই তথাকথিত তর্জনগর্জন মোকাবেলা করতে হবেI নিরবতার দেয়াল ভাঙতে হবেI ধর্মীয় নেতা ইমাম ও আলেমদের দায়িত্ব হলো স্পষ্টভাবে এর মুখোশ উন্মোচন করাI এটা যেমন গভীর, তেমনিভাবে বর্তমান নারীবাদী অস্বস্তির ফলাফলটাও দীর্ঘমেয়াদী। ৫ বা ১০ বছর পর যখন পেছন ফিরে তাকাবেন, তখন কপাল চাপড়ালেও খুব দেরি হয়ে যাবেI এ জন্য কাজে নামবার সময় এখনইI
নারীবাদ কিভাবে ধর্মত্যাগের রাস্তা খুলে দেয় সেটাই ভেঙে-ভেঙে দেখানো আমার এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য। আশাকরি মুসলিম ভাইবোনেরা যদি এই পথ চিনতে পারেন, তাহলে খুব সহজেই তারা এর রহস্য ধরে ফেলতে পারবেন, যেখানেই এই বিরোধ দেখা যাক না কেন (এমনকি ইতিমধ্যে নিজেদের ওপর আছর করে থাকলেও) এবং আমি এটাও চাইছি যে, তারা এর বিরুদ্ধে কথা বলুন। অথবা নিজেদের রাস্তা বুঝে নিন, যেমনটা আমি ও আমার স্ত্রী করেছিলাম বহু বছর আগে।
চলুন কথা না বাড়িয়ে আমরা বরং দেখি, নারীবাদ কিভাবে ধাপে ধাপে ধর্মত্যাগের দিকে নিয়ে যায়।
প্রথম ধাপ
নারীবাদের এই ধাপ শুরু হওয়ার পেছনে দাঁড় করানো যে যুক্তি, নিঃসন্দেহে তা বৈধ। আমাদের সমাজে বিভিন্ন পন্থায় নারীদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। কিছু মুসলিমও এই নিধনযজ্ঞের অংশীদার। এমন কিছু মসজিদ ও মুসলিম প্রতিষ্ঠানও আছে, যারা মুসলিম নারীদের প্রয়োজন নিয়ে কোন ভাবনা চিন্তা করেন না। আমাদের কিছু কিছু সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে খুবই জঘন্যভাবে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের প্রতি বৈষম্য করা হয়। এবং ক্ষোভের ব্যাপার হলো, কখনো কখনো এইসব দুস্কৃতিকারী স্বার্থপরের মত পাহাড়সম অজ্ঞতা নিয়ে তাদের কুকির্তীকে জায়েজ করবার জন্য পরিস্থিতি বহির্ভূত কুরআন-হাদিসের উদ্ধৃতি নিয়ে হাজির হয়।
কিন্তু এসব সমস্যার সমাধান তো নারীবাদ নয়। সমাধান হলো সঠিক ইসলামী জ্ঞানের মাধ্যমে অজ্ঞতা ও মূর্খতা দূর করা, (ও সে আলোকে আইনসমূহ সাজিয়ে তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা) এবং এই জ্ঞানের বিতরণ করবেন সত্যিকারের আলেমগণ, যারা আধুনিকতা, উদার নৈতিকতা এবং নারীবাদ এর শ্বাসরুদ্ধকর প্রভাব থেকে পুরোপুরি মুক্ত।
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সত্য জ্ঞান লাভ করা যেহেতু দুর্লভ হয়ে গেছে, তাই মুসলিম নারীরা (এবং পুরুষরাও) তাদের নৈরাশ্য এবং মানসিক ধাক্কা সামলানোর মাধ্যম হিসেবে নারীবাদ এর ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এভাবেই তারা নারীবাদ এর পথে পা বাড়ান এবং এর পরিণতিও এক অপ্রতিরোধ্য বিপর্যয়ের রূপ লাভ করে।
যদি নারী নির্যাতন একটি ব্যাধি হয়ে থাকে, তাহলে ইসলামিক বিধি ও নৈতিক উপাদানসমূহ হচ্ছে এর প্রাকৃতিক সুসংবদ্ধ ও স্বাস্থ্যকর প্রতিকার – যেখানে নারীবাদ কেবল এক প্রকার বিষাক্ত রাসায়নিক চিকিৎসা – যেটা হয়তো রোগমুক্তি আনতে পারে, তবে সেটাকে রোগী হত্যা করার নামান্তর বললেই জুতসই হয়। কারণ, রোগীর ক্ষতস্থান সারাতে গিয়ে আরো দশটা রোগ বাধিয়ে ফেলতে তার জুড়ি নেইI
নারীবাদ কিভাবে গৃহ নির্যাতন ও কিছু মসজিদের উদাসীনতা ইত্যাদি সম্পর্কে তার আইডিয়া গঠন করে? তা হলো, সবক্ষেত্রে পিতৃতন্ত্রের ঝংকার তোলে এবং পুরুষদেরকে একটি বর্গে নিক্ষেপ করে বলা হয়—‘তারাই যত সমস্যার মূল।( এবং সেইসব নারীরাও সমস্যা, যারা পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে না দাঁড়িয়ে তাকে আপন করে নিয়েছে)I এই পুরুষরাই এমন একটা শ্রেণী, যারা মজ্জাগতভাবেই নারীদের উপর আধিপত্য বিস্তার ও নিপীড়ন করতে চায়, এবং নারীদের কাছ থেকে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করে চলেছে দিনের পর দিন’।
কিন্তু, একটা সমস্যার সমাধানে যে ভাষা ও ভঙ্গি ব্যাবহার করা হচ্ছে, এবং যে চেতনা জাগ্রত করা হচ্ছে, তা নিতান্তই অন্যায্য। এবং এই অন্যায্য ভাষাই ধীরে ধীরে তাদেরকে আচ্ছন্ন করে ফেলে।
দ্বিতীয় ধাপ
প্রথম ধাপে আমরা দেখলাম কীভাবে শ্রেণীবদ্ধ করে পুরুষদের এবং( নারীদের ওপরও) অনাচার করা হয়I এই ধাপে আমরা দেখবো উক্ত সমস্যাগুলি কিরূপে আরো তাত্ত্বিক ও বদ্ধমূল ধারণায় রূপান্তরিত হয়।
ইসলামিক সম্মেলন হলে কেন তার প্যানেলে কোন নারীকে অন্তর্ভুক্ত করে না? কেন ইভেন্ট-পোস্টারে শুধু পুরুষ বক্তাদের ছবি থাকে, আর মহিলাদের বেলায় কিছু প্রতীক? পুরুষ ইমাম কেন মেয়েদেরকে উদ্দেশ্য করে হিজাব গ্রহণ করা এবং কোন্ পোশাক পরবে বা পরবে না—তা নিয়ে কথা বলে? নারীদের পোশাক কেমন হওয়া উচিত সেই ব্যাপারে মুসলিম পুরুষদেরইবা কেন এত মাথাব্যথা? কেন নারী-পুরুষের আলাদা জায়গা থাকবে? এই যুগে এসেও কেন লিঙ্গবৈষম্য (যা লিঙ্গ বিদ্বেষবাদ নামেও পরিচিত) এর মহড়া দেখতে হবে? পুরুষরা যে নারীদের তুলনায় বিশেষ ধরনের সুবিধাভোগী সেটা স্বীকার করতে চায় না কেন? আচ্ছা, শালীনতা এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল কবে থেকে? পুরুষের এত স্পর্ধা আসে কোত্থেকে নারীদের বিষয়ে নাক গলাবার? কত বড় সাহস পুরুষের যে, নারীবাদ নিয়ে মত দেয়?(নারীবাদ যখন পদ্ধতিগতভাবে জনসংখ্যার অর্ধেক পুরুষ জাতির প্রতি নিষ্পেষণ চালিয়ে আসছে, তখন অভিযুক্তদের তো সেই ঢালাও অভিযোগের পাহাড় পর্যালোচনার সুযোগ থাকা দরকার। কিন্তু না, সেটাও করা যাবে না; করলে তা হয়ে যাবে ‘পুরুষতান্ত্রিক ব্যাখ্যা’) ইত্যাদি।
এসকল প্রশ্নের মোকাবেলায় তাদের সয়ংক্রিয় উত্তর ওই একটাই—পিতৃতন্ত্র, যেটা প্রথম ধাপে ও বলা হয়েছে।
প্রথম ধাপ ও দ্বিতীয় ধাপের জটিল প্রশ্নগুলো ইসলামের সুষম বোঝাপড়া এবং সুশৃংখল ঐতিহ্যের মানদণ্ডের ভিত্তিতে বিচার করা হয়নি; বরং পশ্চিমা নারীবাদী ও উদারনৈতিক একপেশে ব্যাকরণে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এটা খুবই স্পষ্ট যে, প্রথম ধাপে মুসলিম নারীবাদীরা যে বিষয়গুলি নিয়ে তাদের ক্ষোভ ঝেড়েছেন, তার প্রত্যেকটির সুন্দর, যোক্তিক, জোরালো বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা রয়েছে ইসলামী আইন এবং জ্ঞানকাণ্ডে। যেমন, ক্ষেত্র বিশেষে লিঙ্গভিত্তিক পৃথক ব্যবস্থাপনা, শালীনতা বোধ, পোশাকনীতি, চলাচলে পর্দা-যোগ্য পুরুষদের সাথে মেলামেশায় সীমাবদ্ধতা ইত্যাদি। কিন্তু সাধারণত দ্বিতীয় ধাপের নারীবাদীরা এগুলোর ধর্মতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ। আর যখন তাদেরকে জানানো হয় এসব নোংরা চর্চাগুলির সুস্পষ্ট জবাব ও বিশ্লেষণ রয়েছে ইসলামি জ্ঞানকাণ্ডের গভীরে, এবং সে সকল তাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়, তখনই তারা তল্পিতল্পা নিয়ে…
তৃতীয় ধাপ
দ্বিতীয় ধাপে আমরা দেখেছি সব ক্ষোভ ও বিদ্বেষ ছিল ওইসব প্রথাসমূহ এবং সমসাময়িক মুসলিমদের মনোভঙ্গি নিয়ে; এই ধাপে দেখব খোদ ইসলামিক জ্ঞান ব্যবস্থাকে কিভাবে আক্রমণ করা হয় এবং সেই ক্রোধ কিভাবে ইতিহাসের দোহাই দিয়ে মুসলিমদের দিকে তীব্র গতিতে তেড়ে আসে, বিশেষ করে আলেমদের দিকে। নারীবাদী চিন্তাকল্প অনুযায়ী, যেহেতু পিতৃশাসিত সমাজ ব্যবস্থাই এত এত নারী নিপীড়নের উৎসভূমি, তাহলে এটা ভাবা অযৌক্তিক নয় যে, সেই ব্যবস্থা অতীতেও বিদ্যমান ছিল; কিন্তু মুসলিম নারীবাদীরা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে প্রশ্ন তুলে—তাহলে কেন ইসলামী পণ্ডিত মহল পুরো ইতিহাসজুড়ে নারীদের বিষয়ে সেইসব উদ্ভট ধ্যান ধারণা ও নারী বিদ্বেষী চিন্তা ও ভঙ্গি পোষণ করল না, যেমনটা আমরা দেখি বর্তমান আলেমদের ক্ষেত্রে?(প্রমাণ করতে চায় অতীতে নারীবিদ্বেষী হাবিজাবি ওসব ছিল না। বর্তমানের ইসলামি পণ্ডিত মহল ইসলামকে সঠিকভাবে না বুঝে এগুলো আবিষ্কার ও প্রতিষ্ঠিত করেছে।)
অথচ ইসলামি জ্ঞানকাণ্ডের দিকে দৃষ্টিপাত করলে এত প্রচুর পরিমাণে উপাদান পাওয়া যাবে, যেগুলোকে নারীবাদীরা ঘৃণ্য পিতৃতন্ত্র ও নারীবিদ্বেষের প্রধান নিয়ামক বলে মনে করেI এই কারণেই তৃতীয় ধাপে বর্ণিত প্রচুর মুসলিম নারীকে দেখা যায়, পরম আগ্রহের সাথে তথাকথিত আলেমদের সহযোগিতা নিয়ে বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ ডিপার্টমেন্টে পবিত্র জ্ঞান(এলেম) অর্জন করতে উঠে পড়ে লেগে যায়। কিন্তু যখনই তারা ইসলামিক সূত্র-সমষ্টির সংস্পর্শে আসেন, তখন তাদের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে এবং চেহারা কালো হয়ে যায়। এক পর্যায়ে ইসলামিক জ্ঞান দুনিয়ার ব্যাপারে তাদের ‘মোহমুক্তি’ ঘটে এবং ‘ ইসলামের নারীসংক্রান্ত বিষয়গুলো যতসব জঘন্য পিতৃতন্ত্রের ফলাফল’ ভেবে তারা ক্ষোভে ফেটে পড়েন।
এই ধাপের মুসলিম নারীবাদীরা এই ভেবে সুখ পান যে, শুধুমাত্র কুরআন আর নবীর হাদিসই যথেষ্ট, আর বাকি সব পুরুষতান্ত্রিক নোংরা বিকৃত ব্যাখ্যার আবর্জনাI এভাবে তৃতীয় ধাপে এসে তরা ইসলামি জ্ঞানকাণ্ডের সবকিছু থেকে বিযুক্ত হয়ে এই যথেষ্টটুকুকে মেনে নিতে চান, কিন্তু এই ‘যথেষ্ট’টুকু ও একসময়…
চতুর্থ ধাপ
কুরআনের ৪:৩৪; ২:২৮৮ নাম্বারের আয়াতগুলো; সাক্ষ্যের বেলায় পুরুষ একজন হলেই হয়, কিন্তু নারী হলে দুইজন লাগে; নারী কম বুদ্ধি-কম দীন; অধিকাংশ নারী জাহান্নামী; আমি যদি আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে সিজদা করতে আদেশ করতাম তাহলে স্ত্রীকে আদেশ করতাম যেন স্বামীকে সিজদা করে, এবং এরকম আরও অনেক আয়াত ও হাদীস আছে। মুসলিম নারীরা কিভাবে এই প্রশ্নগুলো মোকাবেলা করবে?
একটা দুইটা না, এরকম আপাত নারীবিদ্বেষ সংক্রান্ত(?) আরো অনেক আল্লাহ প্রদত্ত প্রত্যাদেশের দেখা মিলবেI এই মায়াময় বিভ্রমে জর্জরিত হয়ে তৃতীয় ধাপের নারীবাদীরা সমাধানের জন্য চতুর্থ ধাপের দিকে পা বাড়ায় এবং মনে করে—হয়তো এসব কিছুর ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছে এতোদিন। হয়তোবা যদি আমরা চাই তাহলে জোড়াতালি দিয়ে একটা সমাধান বা স্বস্তিকর ব্যাখ্যায় আসতে পারবো। কিংবা এই একুশ শতকের জেন্ডার স্টাডিজ এর সেক্যুলার অধ্যাপকদের ঘোরানো প্যাঁচানো অসংলগ্ন বক্তব্যের সাথে মিলিয়ে আমরা সেই সপ্তম শতকের খোদাপ্রদত্ত ওহি কে কাটছাঁট করে একটা সামঞ্জস্য বিধান করতে পারি যে, ওহিকে তৎকালীন(সপ্তম অষ্টম নবম দশম..ইত্যাদি শতকের)মনীষীগণ সর্বোচ্চ যথার্থতা, বাগ্মিতা, প্রজ্ঞা ও হকের সাথে বুঝেছিলেন, (বর্তমানের আলিমগণ তা বুঝতে পারছেননা)। এভাবে ‘হয়তো হয়তো’ করে যেকোনো কিছুই সম্ভব!
আধুনিক নারীবাদ এর সামনে উড়াউড়ি করা এই কয়েকটা কোরআনের আয়াত ও হাদিস সম্পর্কে পর্যাপ্ত অজ্ঞতাই তাদের বাচ্চাসুলভ প্রবণতাকে টিকিয়ে রাখে। তারা যত বেশি এসব আয়াত ও হাদীসের কথা শুনে, ততবেশি চতুর্থ ধাপের দিকে ধাবিত হয়I এই ধাপের মুসলিম নারীবাদীরা ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পারে যে, ইসলামের সামগ্রিকতার সাথে নারীবাদ এর পূর্ণাঙ্গ মেলবন্ধন ঘটানোর অর্থ হলো কুরআনের ঐশি মর্যাদা আর নববী সুন্নাহের প্রযোজ্যতা অস্বীকার করা।
এই পর্বে আপনি এমন কিছু ‘মুসলিম সংস্কারকের’ দেখা পাবেন, যারা সরাসরি কুরআনকে ‘না’ বলার দাওয়াত দেয়। তাদের স্পর্ধা এতদূর পর্যন্ত গড়িয়েছে যে, তারা নবীদেরকেও পিতৃতান্ত্রিক বলে নিন্দামন্দ করতে ছাড়ে না।
চতুর্থ ধাপে এসে হুট-হাট করে ধর্ম নিন্দা করা একটা অভ্যাসে পরিণত হয়। নারী-পুরুষের সম্মিলিত নামাজে নারীর ইমামতি থেকে নিয়ে অমুসলিম পুরুষের সাথে বিবাহ, সমকামিতা, লিঙ্গ পরিবর্তন, যিনা-ব্যভিচার পর্যন্ত আরো অনেক কিছু সম্পর্কে দাওয়াতের আয়োজন শুরু হয়ে যায়I এই স্তরে এসে মুসলিম নারীবাদীরা শুধু যে পূর্ববর্তী আলেমদের রায়কে অস্বীকার করে বসে তাই না; বরং এটাও অবিশ্বাস করে যে, শরিয়া বা সুন্নাহ তার স্বতন্ত্র কর্তৃত্ব বলে মুসলমানদের আচরণ-উচ্চারণকে নিয়ন্ত্রণ করে। এমনকি কেউ যদি আল্লাহর আদেশ জোর দিয়ে বলে, সঙ্গে সঙ্গে তার ওপর স্বৈরাচার পিতৃতান্ত্রিকতার তকমা লাগিয়ে দেয়া হয় I তাদের মতে, ‘কর্তৃত্ব’ মানেই চোখ বন্ধ করে পিতৃতান্ত্রিকতা।
কিন্তু বর্তমানে এত বেশি পরিমাণে চতুর্থ ধাপে বর্ণিত মুসলিম নারীবাদী নেই। কারণ, উপরোক্ত সব শর্ত মেনে নিজেকে মুসলিম দাবি করা অসম্ভব। আর সজ্ঞানে ঐসব মেনে নিয়ে নিজের পরিচয় মেইনটেইন করাটাও একটা দুঃসাধ্য ব্যাপার। তাছাড়া বেশিরভাগ মুসলিম কমিউনিটি ব্লাসফেমি ও ইসলামের অবমাননা কে খুবই খারাপ চোখে দেখে৷ বিশেষ করে কমিউনিটির ভেতর ধীরে ধীরে ইসলাম সম্পর্কে অনেকের ভেতর এক ধরনের তিক্ততা তৈরি হয়I যেটার কারণে আমাদের…
পঞ্চম ধাপ
এই পর্যায়ে এসে নিদারুন মানসিক যন্ত্রণা ও পীড়ণ সহ্য করা অসম্ভব হয়ে পড়ে তাদের জন্য। কাউকে বিভ্রান্তির প্রান্তসীমায় পৌঁছে দিতে এর চাইতে উপযুক্ত সময় আর নেই।
আল্লাহ যদি লিঙ্গ-সাম্যবাদী হয়ে থাকেন, তাহলে কুরআনে কেন তিনি নিজেকে স্ত্রী বা উভয় লিঙ্গ রূপে ব্যবহার না করে পুরুষবাচক সর্বনামে ডাকেন? কেন আদি মানব নারী না হয়ে একজন পুরুষ? কুরআনে বর্ণিত ঐতিহাসিক ঘটনাবলী কেন শুধু পুরুষদের সম্পর্কে; নারীদের সম্পর্কে নয়? আল্লাহর শেষ নবী কেন নারী না হয়ে একজন পুরুষ? কেন আল্লাহর ওহী একজন পুরুষের কাছে আসে; নারীর কাছে নয়?
এই ধরনের সিম্পল কিন্তু উন্মাদনাপূর্ণ প্রশ্নগুলি তাদেরকে কুফর ও ধর্ম ত্যাগের একেবারে প্রান্তসীমায় নিয়ে যায়। যে চিন্তাধারা প্রাথমিক পর্যায়ে তাদের এ পথে এনেছিল, সেই চিন্তারূপটি তাদেরকে রসাতলের গর্তে শেষ ধাক্কাটি মেরে দেয়।
কেনই বা আল্লাহ পিতৃতন্ত্রের অস্তিত্বকে জারি রাখলেন? কেন তিনি যুগ যুগ ধরে কোটি কোটি নিষ্পাপ অধীনতা ও ‘ধর্ষিতা’ হওয়াকে নির্দ্বিধায় মেনে নিলেন? এখানে এসে নারীবাদ শুধুমাত্র একটা উত্তরই দেয়। তা হল—এ যাবৎ যা কিছু বলা হয়েছে, তার সবটাই হচ্ছে নারীদের নিয়ন্ত্রণ করার পুরুষতান্ত্রিক মিথ্যা কলাকৌশল।
.
নারীবাদের বিপদ হলো আলখেল্লা পরিহিত মুখোশধারীর মত। একটা মানুষ যখন সবকিছুই পিতৃতন্ত্রের দাড়িপাল্লায় মাপা শুরু করে, তখন ধর্মত্যাগের বাকিটা পথ পাড়ি দেয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। কারণ প্রতিটি জুলুমকে পিতৃতন্ত্রের যুক্তিতে বিচার করাই তাদের সর্বগ্রাসী ব্যাখ্যা পদ্ধতি। তবে পঞ্চম ধাপের নারীবাদীরা অন্যান্য নারীদের তুলনায় অনেক বেশি বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সচেতন। এই পর্বের নারীবাদীরা খুব ভালোভাবেই নারীবাদের রূপ ও বৈশিষ্ট্যকে এর চূড়ান্ত সীমায় নিয়ে গেছেI
(এই আলোচনার বাকিটুকু আমরা দ্বিতীয় পর্বে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।)
==================
লেখক ড্যানিয়েল হাকীকাতজু ইরানিয়ান বংশদ্ভূত আমেরিকান মুসলিম। পড়াশোনা করেছে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে, রসায়ন ও দর্শন বিষয়ে। দর্শনে মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করেছেন। এর পাশাপাশি ইসলামের ট্র্যাডিশনাল ইলম চর্চার ধারায়ও শিক্ষা লাভ করেছেন আলেম উলামাদের কাছ থেকে। সাম্প্রতিক সময়ে ইসলাম ও আধুনিকতার নানান বিষয়ে লেকচার,বিতর্ক ও লেখালেখি করে যাচ্ছেন। নারীবাদ,বিবর্তনবাদ ও সমকামিতা বিষয়ে তার কাজগুলো বহুল সমাদৃত। muslim skeptic নামে একটি ওয়েব সাইট পরিচালনা করেন,যা খুবই জনপ্রিয় এবং সমৃদ্ধ।
Comments 1