নারীবাদের শুরুর কথাঃ-
কোন পাঠক প্রশ্ন করতে পারেন,”আসলে নারীবাদের কোন জায়গাটা আপত্তিকর? নারীবাদের কোন শাখা, কোন প্রকার কিংবা কোন সংজ্ঞাটা সমস্যাজনক?” বাস্তবতা হলো, খোদ ‘নারীবাদ’ই আসলে সমস্যা। একেবারে এর শেকড় থেকে। ভালভাবে বোঝার জন্যে একটা তুলনা দেয়া যাক। আমাদের মাঝে অধিকাংশই এটা মেনে নেবেন যে, বর্ণবাদ একটা জটিল সমস্যা এবং নির্দিষ্ট কোনো বর্ণ বা জাতির মানুষদের বিরুদ্ধে এটা বিষের মতন। পরিস্থিতির দিকে তাকালে দেখা যাবে, KKK এর মতাদর্শের ভিতরকার বর্ণবাদ আর নব্য নাৎসি বা Alt-Right জাতীয় দলগুলোর মতাদর্শের অভ্যন্তরে যে বর্ণবাদ লুকিয়ে আছে তা এক নয়। তাদের মধ্যে সূক্ষ্ম তফাৎ আছে। কিন্তু সকল গ্রুপের মধ্যেই যখন বর্ণবাদের বীজ বিদ্যমান, তখন তার মধ্যকার সামান্য টুকটাক পার্থক্য নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোন মানে হয়? বা এতোটুকু পার্থক্য থাকায় কি আদৌ কিছু আসে যায়?
বিষয়টি আরও পরিষ্কার করার জন্য বলি,নারীবাদের ব্যাপারে আমার অবস্থান মেটেও এটা নয় যে,নারীবাদের সমস্যা হলো এটি একটি বর্ণবাদি মতাদর্শ, বরং এর অনেকগুলো বড় সমস্যার একটা হল, এর বাতাস কিছুটা গায়ে লাগলে আস্তে আস্তে মুসলমানদের ঈমান সঙ্কটের মাঝে পড়ে যায়; শেষমেষ তা ইসলাম ত্যাগের দিকে টেনে নিয়ে যায়। আর এটা কোন কাকতালীয় ঘটনা বা সাধারণ পরিসংখ্যানের ব্যত্যয় নয়। আগের আলোচনায় মুসলিমদের প্রথম থেকে পঞ্চম ধাপ পর্যন্ত আগানোর ব্যাপারটা অনুধাবন করে থাকলে এই প্রক্রিয়া কিভাবে কাজ করে তা বোঝা টা আরো সহজ হবেI তারপরও যদি বুঝতে সমস্যা হয়, তাহলে আসুন, ইতিহাসের কিছু সুপ্রসিদ্ধ নারীবাদীর কাছ থেকে পাওয়া মতামতের ভিত্তিতেই নারীবাদের শেকড়ের দিকে তাকানো যাক।
একথা তো সর্বজন বিদিত যে, নারীবাদ তার সূচনা বিন্দু থেকেই ধর্মবিদ্বেষী। নারীবাদী আন্দোলনের প্রতিটি পর্যায়ের এর সকল উল্লেখযোগ্য নারীবাদী তাত্ত্বিকরা ভয়ঙ্করভাবে ধর্ম বিরোধী ছিলেন।
উনিশ শতকের গোড়ায় নারীদের ভোটাধিকার লাভের জন্য একটি সামাজিক আন্দোলন হিসেবে নারীবাদের ‘প্রথম পর্যায়’ যাত্রা শুরু করে। এ আন্দোলনে চিরাচরিত ধর্মসমূহ কে নারীদের দাসী বানানোর অভিযোগে কাঠগড়ায় তোলা হয়। সূচনাপর্বের নারীবাদীরা মনে করত, এইসব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান শুধুমাত্র নারীদের অধিকার ভেঙে টুকরো টুকরো করেই ক্ষান্ত হয়নি, বরং নারীর প্রতি বিদ্বেষ চর্চায় এগুলো সক্রিয় উৎস হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে। নারীদের ভোটাধিকার আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্র সুসান অ্যান্থনি ঘোষণা করেন, সবচেয়ে বিপদজনক শত্রু হল যাজক সম্প্রদায়। এন্থনি প্রায়ই ঐতিহাসিক ধর্মগুলোকে নোংরা ভাষায় গালি দিতেন। ব্যক্তিগতভাবে তার পরিচিতজনরা তাকে সংশয়বাদী হিসেবে জানতো। ধর্ম সম্পর্কে তার একটি বক্তব্য এমন:’ কত জঘন্য তাদের ঈশ্বর, যে কিনা জীবিকা ভান্ডার নিজের কাছে আটকে রেখে ক্ষুধার্থ মুখগুলোর সংখ্যা বাড়িয়ে তুলছেI’ প্রচলিত ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে তিনি মন্তব্য করেন,’ একজন জগদীশ্বর আমার নতজানু হওয়া এবং তাকে মহৎ বলার দ্বারা খুশি হবেন এরকম চরিত্র কোনমতেই আমার কল্পনায় আসে না।’
উনিশ শতকের নারীবাদের প্রথম পর্যায়ের আরেকজন নারীবাদী, হেলেন এইচ গার্ডেনার, বাইবেল এবং খ্রিস্টধর্মে নারীদের ব্যাপারে যেসব ‘অপরাধ’ ও ‘অবমাননা’ করা হয়েছে সে সম্পর্কে বড় পরিসরে কাজ করেছেন। তিনি লিখেছেন,
এই ধর্ম এবং এই বাইবেল নারীর কাছ থেকে নিয়ে নেয় সবই, কিন্তু দেয়না কোনো কিছুই। নারীর কাছ থেকে সমর্থন ও প্রেম কামনা করা হয়; কিন্তু বিনিময়ে সে পায় অবজ্ঞা ও উৎপীড়ন। খ্রিস্টান দুনিয়ায় নারীর উপর নেমে আসা প্রতিটি অন্যায়, অবিচার বাইবেলের মাধ্যমে অনুমোদিত হয়। এবং যাজক মন্ডলী এটাকে আরো যৌক্তিক প্রতিপন্ন করেন এবং এর স্থায়িত্ব নিশ্চিত করেন।’
গার্ডেনারের ধর্মের প্রতি ক্ষোভ শুধু খ্রিস্টান ধর্মেই থেমে থাকেনি। ‘পুরুষ, নারী এবং ঈশ্বর গণ’ নামক গ্রন্থে তিনি বলেন-
” যে কোন ধর্মই তার অতিমানবিক উৎপত্তি দাবী করুক না কেন–আমার মতে সব ধর্মই এই দাবি করে– মানুষের যুক্তির নিরিখে তার যাচাই হতে হবে। এবং আমাদের নৈতিক চেতনার সাথে যদি ধর্মের কোন একটি নির্দেশনার বিরোধ ঘটে তাহলে সেই ধর্মীয় নির্দেশনাকে অবশ্যই ছুড়ে ফেলতে হবে। কোন ধর্মের ভালো কোন দিক যদি থেকে থাকে সেটা হচ্ছে নৈতিকতা। আর নৈতিকতার সাথে বিশ্বাসের কোন সম্পর্ক নেই। তুলনামূলক ভাবে এ দুয়ের একটি হলো, ইহকালেই সঠিক কাজ করা; আর অন্যটি পরকালের অগণিত জিনিসের হিসাব করা। একটি সময়ের নিগড়ে আবদ্ধ হতে বলে, অন্যটি অনন্তের স্বপ্ন দেখায়। নৈতিকতার ভিত্তি হলো বিশ্বজনীন বিবর্তন; আর বিশ্বাসের ক্ষেত্রে তা দৈববাণী। অথচ নারীদের দৈববাণী গ্রহণের যোগ্যতা নেই। এখনো পৃথিবীতে এই বয়ান জারি আছে।
“মুসা, কনফুসিয়াস, মোহাম্মদ, ইব্রাহিম, ব্রাইহাম ইয়ং- এরা সবাই ঈশ্বর থেকে বিশেষ কোন ধর্ম দর্শন লাভ করার দাবি জানান। ঈশ্বরের সাথে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ হওয়ার কথা ও বলেন এই মনোনীত ব্যক্তিত্বরা। কিন্তু কথা হলো,যতক্ষণ না তাদের শিক্ষাগুলো আমাদের উন্নত চিন্তা, অভিজাত অভিরুচি এবং বিশুদ্ধ জীবন দর্শনের সঙ্গে না মিলবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের ওপর তাদের কর্তৃত্ব করার কোন অধিকার নেই।
কোন জনের নিকট (তার সত্যতার) প্রমাণ আছে? উনিশ শতকে এসে আমাদের পরিচিত কোন ধর্মই তো বলতে পারবে না যে,’ আমি তোমাদের সমৃদ্ধ ক্রমবিকাশের সমান্তরালে আছি; আমি এখনো তোমাদের মহত্তম চিন্তা চর্চায় নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছি; আমার কোন শিক্ষাই তোমাদের ন্যায়বিচারের চেতনায় বিঘ্ন ঘটাবে নাI’’
ধর্মের প্রতি এমন বৈরিতা খুঁজে পাওয়া যাবে প্রথম পর্যায়ের অধিকাংশ নারীবাদের লেখায়, বক্তৃতায়,যার মাঝে রয়েছে এলিজাবেথ কেডি স্ট্যান্টন, যে কিনা প্রবল বিতর্কিত ‘নারীর জন্যে বাইবেল’ লেখায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেনI এখন ১০০ বছর আগের প্রথম পর্যায়ের নারীবাদীদের অনুসরণ করে যদি মুসলিম নারীবাদীরা ‘নারীর জন্যে কুরআন’ লিখে,তাহলে সেটা অন্যান্য নারীবাদী পর্যায়গুলোর তুলনায় সম্ভবত সবচাইতে কম ভয়ঙ্কর এবং কম আপত্তিকর হবে।
ধর্মবিরোধী চিন্তাধারা কিন্তু এখানে এসেই থেমে থাকেনি। তথাকথিত দ্বিতীয় পর্যায়ের কথা একটু চিন্তা করুন! যে দার্শনিক কে এই পর্যায়ের অগ্র-পথিক গণ্য করা হয়, সিমোন দ্য বোভোয়ার, তার ধর্ম বিরোধী অবস্থান বর্ণনা করেন এভাবে,
”পুরুষরা তাদের ঈশ্বরের লিখিত সংহিতা থেকে বিরাট সুবিধা ভোগ করে। এবং যেহেতু পুরুষ নারীর উপর তার সার্বভৌম ক্ষমতা চর্চা করে, তাই এটাকে বিশেষ ভাগ্যের ব্যাপার বলা যায়। কারণ, সর্বোচ্চ সত্তা তাদের এই ক্ষমতা চর্চার অধিকার দান করেছেন। অন্যান্যদের মধ্যে ইহুদী ইসলাম ও খ্রিস্টান ধর্মে পুরুষ ঐশী অধিকার বলেই একজন কর্তৃত্বকারী চরিত্রI কাজেই একমাত্র ঈশ্বরের ভয়ই অবলা, নির্যাতিতা নারীর বিদ্রোহী হওয়ার পথকে রুদ্ধ করে রাখে।’’
দ্বিতীয় পর্যায়ের বিশিষ্ট নারীবাদী Gloria Steinem ধর্ম সম্পর্কে বলেন, ’বর্তমানের কোনো কিছুর বিনিময় পরকালে রয়েছে তা চিন্তা করা অবিশ্বাস্য রকমের ধোঁকা। এমনকি প্রতিষ্ঠানগুলোও তাদের সব পুরস্কার ব্যবস্থা দিয়ে একে মরণোত্তর করার চেষ্টা করেনা।’ সাম্প্রতিক দেয়া সাক্ষাৎকারে একবার তাকে প্রশ্ন করা হয়,’ আজকের নারীবাদের সবচাইতে বড় সমস্যা বলে আপনি কি মনে করেন?’ জবাবে তিনি বলেন,’ ধর্ম নিয়ে আসলে আমরা খুব একটা সরব না। আমি মনে করি আধ্যাত্মিকতা সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস৷ কিন্তু ধর্ম হল পুরোটাই একটা ধোঁকাবাজি রাজনীতি। আমাদের এটা নিয়ে সরব হওয়া উচিত। কারণ ধর্ম নির্বাকের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেয়I’
তৃতীয় পর্যায়ে এসে ধর্মবিদ্বেষের মাত্রা আরো প্রবল হয়। কিন্তু এই বিদ্বেষভাব বিভিন্ন চেহারায় হাজির হয়। তন্মধ্যে,’ বিকল্প ধর্ম’ এবং’ অসাম্প্রদায়িক আধ্যাত্মিকতা’ এর ধারণার প্রতি একটা আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। নারী, লিঙ্গ ও যৌনতা বিষয়ক অধ্যাপক সুসান শ বলেন, গীর্জা,মসজিদ এবং সিনাগোগের মতন ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর আলোকে বলা যায়, পিতৃতন্ত্র বর্তমান দুনিয়ায় সবচাইতে প্রভাবশালী ধর্ম। এবং বর্তমান দুনিয়ায় লিঙ্গ সম্পর্কে যথেষ্ট ধর্মভিত্তিক জটিলতা বিদ্যমান। একটা আমূল সংস্কারের বড় প্রয়োজন আমাদের। আসলে ঠিক সংস্কারও নয়, বিপ্লবের প্রয়োজন আমাদের, যা একটি সার্বজনীন বৈশ্বিক অভয়ারণ্য পুনর্নির্মাণ করবে, যেখানে থাকবে সাম্য, ন্যায় বিচার এবং প্রেম ভালোবাসা’’
মৌলবাদী সমকামী নারীবাদী দার্শনিক Marry Daly বিশ্বাস করতেন, ধর্ম জন্মগতভাবেই নারী নিপীড়ক। তিনি একটি উদাহরণ টেনে বলেন, ‘গীর্জার নিকট নারীর সমতা দাবি মানে Ku Klux Klan(KKK) এর কাছে একজন কৃষ্ণাঙ্গের সমান অধিকার চাওয়া।’’
‘Sin Big’ নামে চাঞ্চল্যকর এক প্রবন্ধে তিনি লেখেন,
’পাপ(Sin) শব্দটা এসেছে ইন্দো-ইউরোপীয় ধাতুমূল “es-” থেকেI যার অর্থ ‘হওয়া’I শব্দ তত্ত্ব টি আবিষ্কার করার সাথে সাথেই আমি ধরে ফেললাম, যে ব্যক্তি বর্তমান জগতের ধর্ম ‘পিতৃতন্ত্রের’ ফাঁদে পড়েছে তার জন্য ‘হওয়া’ এর যুতসই অর্থ হ লো ‘পাপ করা’I
প্রবন্ধটিতে তিনি নারীদের বেশি বেশি ‘পাপ’ করতে উৎসাহিত করেন। এটিকেই পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিবাদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেনI ধর্মীয় চর্চাকে বিলীন করার অর্থই পিতৃতন্ত্রকে বিলীন করা। এই দুইটার মধ্যে আদতে কোন ভেদ রেখা টানা হযনি। যেহেতু ধর্ম মানেই পিতৃতন্ত্র, আর পিতৃতন্ত্র মানেই ধর্ম, তাই একটাকে ধ্বংস করলে অপরটি আপনাআপনিই ধ্বসে পড়বে।
নারীবাদী মূলতত্ত্ব সর্বাংশে এরকম ধ্বংসাত্মক মতামত দিয়ে পরিপূর্ণ। বিস্তারিত লিখতে গেলে অনেকগুলো Volume দরকার। আর মুসলিম নারীবাদীদের দ্বারা ইসলাম ধর্মের প্রতি আক্রমণ ও নিন্দাসূচক বক্তব্য আমরা প্রতিনিয়তই দেখে থাকি (বিশেষ করে পঞ্চম ধাপে)।
যেখানে নারীবাদের গোটা ইতিহাস জুড়েই এর রন্ধ্রে রন্ধ্রে ধর্মবিরোধিতা এবং ধর্মের প্রতি ক্ষোভ ও বিদ্বেষ চিন্তা বিদ্যমান, সে সব জেনেশুনেও কিভাবে এরকম একটি মতাদর্শ ধারণ করার চিন্তা আমাদের মাথায় আসে? যে পন্থায়, ছাঁচে বা ধরনেই একে গ্রহণ করা হোক না কেন, এতে মুসলিম বিশ্বাসের ক্ষয়প্রাপ্তি ছাড়া আর কি আশা করা যায়?
বিকল্প পথ:
আবারো বলছি, আমি ও আমার স্ত্রী একসময় নিজেদের নারীবাদী হিসেবে গণ্য করতাম। কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ খুব দ্রুততার সাথেই আমরা নারীবাদী প্রকল্পের গতিপথ অনুধাবন করতে পেরেছি। নারীবাদের পথ পরিত্যাগ করা আমাদের জন্য ছোটখাটো সান্তনা হলেও মৌলিক কিছু ভাবনার বিষয় রয়েই যায়। কেননা বাস্তবতা হলো, কিছু নারী এখন পর্যন্ত তাদের জীবনে চরম জুলুম, অনাচার সয়ে যাচ্ছেন। তাছাড়া, ইসলামিক আইনে লিঙ্গ ভেদে ভিন্ন ভিন্ন বিধান থাকা সত্ত্বেও কিভাবে তার(ইসলাম) কাছ থেকে একটি পূর্ণাঙ্গ ও সাম্যবাদের ব্যবস্থাপনা আশা করা যায়?
এই প্রশ্নগুলো আমাদেরকে ভাবিয়েছে। কিন্তু উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমাদের মনে হল, ন্যায় বিচার ও সাম্যবাদ নিয়ে যে ধারণা ও বিশ্বাস আমাদেরকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে তাকে তো আমরা পুনরায় যাচাই-বাছাই করতেই পারি। যে আল্লাহ সকল ন্যায্যতা ও অনুকম্পার উৎস, তার চাইতে সুন্দর করে যথার্থরূপে আর কে বলতে পারে:
”হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা এক ঘোষককে ঈমানের দিকে ডাক দিতে শুনেছি যে, ‘তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের প্রতি ঈমান আন।’ সুতরাং আমরা ঈমান এনেছি। কাজেই হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের গুনাহ সমূহ ক্ষমা করে দিন, আমাদের মন্দসমূহ আমাদের থেকে মিটিয়ে দিন এবং আমাদেরকে পুণ্যবানদের মধ্যে শামিল করে নিজের কাছে ডেকে নিন। হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে সেই সবকিছু দান করুন, যার প্রতিশ্রুতি আপনি নিজ রাসূলগণের মাধ্যমে আমাদেরকে দিয়েছেন। আমাদেরকে কিয়ামতের দিন লাঞ্ছিত করবেননা। নিশ্চয়ই আপনি কখনো প্রতিশ্রুতির বিপরীত করেননা। সুতরাং তাদের প্রতিপালক তাদের দুয়া কবুল করলেন এবং (বললেন) আমি তোমাদের মধ্যে কারো কর্মফল নষ্ট করবোনা, তাতে সে পুরুষ হোক বা নারী। তোমরা পরস্পরে একই রকম। সুতরাং যারা হিজরত করেছে এবং তাদেরকে নিজেদের ঘর বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে, আমার পথে উৎপীড়ন করা হয়েছে এবং(দ্বীনের জন্যে) তারা যুদ্ধ করেছে ও নিহত হয়েছে, আমি অবশ্যই তাদের সকল দোহ ত্রুটি মিটিয়ে দেবো এবং তাদেরকে অবশ্যই এমন সব উদ্যানে দাখিল করবো, যার তলদেশে নহর প্রবাহিত থাকবে। এসব কিছু আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরষ্কারস্বরূপ হবে। বস্তুত আল্লাহর কাছেই আছে উৎকৃষ্ট পুরষ্কার। যারা কুফর অবলম্বন করেছে, দেশে দেশে তাদের (স্বাচ্ছন্দপূর্ণ) বিচরণ যেন তোমাকে কিছুতেই ধোঁকায় না ফেলে। এটা সামান্য ভোগ (যা তারা লুটছে)। অতঃপর তাদের ঠিকানা জাহান্নাম, যা নিকৃষ্টতম বিছানা।” [মাকতাবাতুল আশরাফ থেকে প্রকাশিত তাফসীরে তাওযীহুল কুরআন থেকে অনুবাদ সংগৃহীত]
এছাড়া আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,” নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদিগকে নির্দেশ দেন যে, তোমরা যেন প্রাপ্ত আমানত সমূহ প্রাপকদের নিকট পৌঁছে দাওI আর যখন তোমরা মানুষের কোন বিচার-মীমাংসা করতে আরম্ভ করো, তখন মীমাংসা কর ন্যায়ভিত্তিকI আল্লাহ তোমাদেরকে সদুপদেশ দান করুনI নিশ্চয়ই আল্লাহ শ্রবণকারী,দর্শনকারিI (মহিউদ্দিন খান এর অনুবাদ)
আল্লাহ কারো কর্মকেই নিষ্ফল করবেন না হোক সে নারী বা পুরুষI তিনি আমাদের যে পরীক্ষার মাঝে ফেলেছেন তার ভিত্তিতেই আমাদের বিচার করবেন; কোনরকম বৈষম্য করবেন নাI পুরুষকে যা দান করা হয়েছে তার অনুপাতে নারীর বিচার হবে নাI এবং নারীকে যা দেওয়া হয়েছে তার অনুসারে পুরুষের বিচার হবে নাI এটাই কুরআনে উলিখিত আল্লাহপাকের লিঙ্গ বিচারের মাপকাঠিI ব্যাপারটা এমন না যে, নারী ও পুরুষের উভয়ের জন্যই একই রকম নির্দেশিত বিধি-বিধানI তাদের ওপর আরোপিত দায়িত্বভার এরমধ্যেও তফাৎ রয়েছেI এবং বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় তাদের মাঝে পার্থক্য বিদ্যমানI ঠিক যেমনিভাবে আল্লাহতালা বিচিত্র রকমের অস্তিত্ব সৃষ্টি করেছেন- ফেরেশতা, জিন, মেঘ, পাহাড়, প্রাণী ইত্যাদI তার সৃষ্টি জগতে প্রতিটি শ্রেণী সত্তাকে তিনি স্বতন্ত্র পদমর্যাদা এবং ভূমিকা দিয়ে দিয়েছেনI একইভাবে তিনি পার্থক্যের সাথে পুরুষ ও নারীকে সৃষ্টি করেছেI তা সত্ত্বেও তারা একে অপরের থেকে(Ba’dukum min ba’d)Iএই কঠিন ও গোলেমেলে সময়ে মুসলিম পুরুষ ও নারীদের অবশ্যই একে অপরের পাশে দাঁড়াতে হবেI এছাড়া যতসব নিপীড়ন, অবমাননা ও দুর্ব্যবহারের অভিযোগ প্রথম ধাপে তোলা হয়েছিল- তার সবটাকেই কুরআন-সুন্নাহ প্রতিষ্ঠিত দিকনির্দেশনা ও প্রায়োগিক চর্চার আওতায় এনে বিচার করতে হবেI নবীজি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসব নির্দেশাবলী কত অল্প কথায় বলে দিয়েছেন: ”তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি সর্বোত্তম যে তার স্ত্রীর কাছে সেরাI এবং আমি তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম, কারন আমি আমার স্ত্রীর কাছে ও সেরাI” শারীরিক নির্যাতন সম্পর্কে নবীজী সাল্লাল্লাজি আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশেষভাবে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন,” মোহাম্মদের পরিবারের নিকট অনেক নারী তাদের স্বামীদের সম্পর্কে নালিশ নিয়ে এসেছেI যারা এরকম আচরণ করে, প্রহার করে, মনে রেখো, তারা কখনোই তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম নয়I”
কিন্তু যে নির্যাতন নারী সহ্য করে তার শারীরিক পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নয়I মানসিক নিপীড়ন আর অবহেলা শারীরিক আঘাত থেকেও অনেক বেশি বিপর্যয়কর হতে পারেI বহু মুসলিম নারী স্বামীদের থেকে প্রয়োজনীয় যত্ন ও সম্মান টুকু পর্যন্ত পায় নাI কেউ কেউ তো নিজেদেরকে ঘরের কাজের লোকের চাইতে বেশি কিছু ভাবতে পারেন নাI অথচ পবিত্র কুরআনে সূরা আল মুজাদিলাহ তে আল্লাহ স্বয়ং বলছেন,
”যে নারী তার স্বামীর বিষয়ে আপনার সাথে বাদানুবাদ করছে এবং অভিযোগ পেশ করছে আল্লাহর দরবারে, আল্লাহ তার কথা শুনেছেনI আল্লাহ আপনাদের উভয়ের কথাবার্তা শুনেনI নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছু শুনেন, সবকিছু দেখেনI”
সকল কিছুর পরিচালক মহান আল্লাহপাক নির্যাতিত নারীর অভিযোগ শোনা কত গুরুত্ব ও করুণার প্রকাশ ঘটিয়েছেনI তারপরও কিভাবে একজন মুসলিম স্বামী এত নির্মম নির্দয় হতে পারে! কিভাবে তার স্ত্রীর অনুভূতির মর্ম না বুঝে থাকতে পারে! এছাড়াও বিশদভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীগণের জীবনের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে, কখনই তারা তাদের স্ত্রী, বোন বা কন্যাদের প্রতি তাচ্ছিল্য ভাব, অপমান বা অমর্যাদা প্রকাশ করতেন নাI প্রচুর বর্ণনার সন্ধান মেলে, যেখানে দেখা যায় এইসব বরকতপূর্ণ মনীষীগণ তাদের স্ত্রীদের প্রতি আবেগ মমতার সাথে অতিরিক্ত সংবেদনশীল আচরণ করতেন, যাতে করে ইহসান এর( চরম উৎকর্ষতা) সাথে তাদের অধিকার গুলি সম্পন্ন করতে পারেনI( একটা লম্বা হাদিস আছে বুখারী শরীফে যেখানে ওমর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু নবীজী ল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর স্ত্রীদের প্রতি তার আচরণের বর্ণনা করেছেনI মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর স্ত্রীগণ সরাসরি তার সঙ্গে তর্ক করতেনI অথচ তাদের ধমকও দিতেন নাI বরং খুবই যত্ন ও গুরুত্বের সাথে আচরণ করতেনI হাদিস নং:648)
এই বিষয়গুলো নিয়ে আরও বিশদ ব্যাখ্যার দিকে যাওয়া যাবেI ইসলামের শক্তি সম্পর্কে অবশ্যই আমাদের বিশ্বাসকে আরও পোক্ত করতে হবেI অন্যায়-অনাচার কে মোকাবেলা করতে ”নারীবাদী ইসলাম” এর কোনো প্রয়োজন নেইI নবীর সুন্নতই আমাদের জন্য লিঙ্গ সমতার একমাত্র আদর্শ ও নির্ণায়ক, সুশান বি. অ্যান্থনি, সিমোন দ্য বোভোয়ার, বেটি ফ্রেদান, Gloria Steinem, কিংবা বেল হুক্স এরকম যারা আছে তাদের চিন্তন পন্থা নয়( যারা কিনা প্রায়শই ধর্মবিরোধী)।
সমাপ্তি:
নারীবাদ বিষয়টাকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা জন্য ইমাম ,আলেম এবং ধর্মীয় নেতাদের কাছে হাত জোড় করে মিনতি করছিIযদিও এই অস্বস্তিকর ব্যাপারটা অনেক দিন ধরেই অবহেলিত হয়ে আসছেI ইন্টারনেট আর গণযোগাযোগ মাধ্যমের আগের সময়টাতে হয়তো এরকম বিষয় উপেক্ষা করা যেত, যখন মুসলিমরা ইসলাম বিরোধী প্রপাগান্ডার ছাড়াই স্বার্থ জীবন-যাপন করতে পারতI আর এখন চুপ থাকার অর্থ হলো, ইসলাম ও ইসলামিক জ্ঞান বিজ্ঞান নিয়ে ক্রমাগত বেড়ে চলা অসন্তোষ ও অস্বস্তির আগুনে ঘি ঢেলে দেয়াI
এখন আর কেউ “ বিতর্কিত” আয়াত, হাদিস, তুরাছ ইত্যাদি গণ মানুষের কাছ থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য লুকিয়ে রাখতে পারছে নাI মানুষজনের ওগুলো খুঁজে পেতে আর বেগ পেতে হয় নাI কারণ নাস্তিক আর Liberal সক্রিয় কর্মী বাহিনী ইসলামের “মুখোশ উন্মোচন” করার মিশনে নেমেছে;তার ঐতিহ্য প্রদর্শনের জন্য দৌড়ঝাঁপ করছে, মুসলিম জনতা যখনই এইসব তথ্য জানতে পারে, তাদের মধ্যে তৈরি হয় গভীর অস্বস্তি ও অনিশ্চয়তাI নিজেদেরকে আস্তে আস্তে প্রতারিত মনে হতে থাকেI এক পর্যায়ে ইসলাম ত্যাগের হিড়িক পড়ে যায়I এই প্রক্রিয়া এখন ভালোভাবে ই চলমানI সুপ্রতিষ্ঠিত ইসলামের প্রতি এই ঊর্ধ্বগামী বৈরিতা ও উন্মাদনা অবলম্বন করতে আর দূরে যাওয়ার দরকার নেইI শুধুমাত্র মুসলিম নারীবাদীদের মিডিয়া আউটলেট আর ওয়েবসাইটে গিয়ে একটু ঢুঁ মেরে আসেনI
অনেকদিন হলো নারীবাদ কোনোরূপ নাটাই ছাড়াই আকাশে উড়াউড়ি করছেI তার বদৌলতে উম্মাহর যে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার খেসারত দিতে আমাদেরকে অবশ্যই পূর্ণ সক্ষমতা সাথে নারীবাদ এর বিনির্মাণ ভাবনা ও সমালোচনা চিন্তাকে বুদ্ধিবৃত্তিক এবং একাডেমিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে হবেI এ ধরনের সমালোচনা বর্তমান সংক্ষিপ্ত রচনা আওতার বাইরেI তবে কাজ অচিরেই আসছে ইনশাল্লাহI আশাকরি নারীবাদ এর কলকব্জাগুলো খুলে ফেলার মাধ্যমে মুসলিমরা বুদ্ধিবৃত্তি ও উদ্দীপনার সাথে যথার্থরূপে ইসলাম এবং এর লিঙ্গ ভাবনা সম্পর্কে জানতে পারবেI এবং এটাও স্পষ্ট হবে, নারীবাদ যে প্রস্তাবনা দিয়েছে- ইসলাম তার চাইতে ন্যায় বিচার ও অনুকম্পায় কত উন্নত এবং সমৃদ্ধI
প্রথম পর্ব পড়ার জন্য এখানে ক্লিক করুন