২০০০ ঈসায়ীর ৫–৯ জুন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের আহবানে একটি বিশেষ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। অধিবেশনটিকে “বেইজিং+৫” হিসেবেও উল্লেখ করা হয়। কারণ ৪–১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৯৫ সালে বেইজিং এ অনুষ্ঠিত ৪র্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনে যে কর্মপরিকল্পনা নেয়া হয়, তা পর্যালোচনা করা ছিল এর অন্যতম উদ্দেশ্য।
বেইজিং সম্মেলনের সবগুলো সিদ্ধান্ত ছিল নারী সম্পর্কিত। এর মধ্যে অনেক ভালো ও উপকারী সিদ্ধান্তও ছিল। যেমন, পৃথিবীর বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠী বিশেষত নারীদের দুর্ভোগ ও সমস্যা দূরীকরণে ভূমিকা রাখা, অর্থনীতির ক্ষেত্রে বিশ্বায়নের নেতিবাচক প্রভাব ইত্যাদি। তবে এর সাথে বেশ কিছু উদ্ভট বিষয়ও যোগ করা হয়েছে। নারী-পুরুষের মধ্যে অবাধ ও লাগামহীন যৌনতা এবং সমকামিতাকে বৈধতা দেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। মেয়েদেরকে যে কারো সাথে মিশতে ও যেতে পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়ার জন্য বলা হয়েছে। মেয়েদের বিয়ে সম্পর্কে তাদের নির্দেশনা হচ্ছে, তারা নিজেদের ইচ্ছা অনুযায়ী যে কোন ধর্মের ধর্মের যে কাউকে বিয়ে করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে তার পরিবারের মতামতের কোনও মূল্য নেই।
আমি বিশেষ অধিবেশন “বেইজিং+৫” এ উপস্থিত ছিলাম। যে সকল বেসরকারি সংস্থা ও সংগঠন (N.G.O) সেখানে হাজির ছিল, এদের অধিকাংশই অবাধ যৌনতার জোরালো প্রবক্তা ও প্রচারক। অধিবেশন জুড়ে তাদের আওয়াজই সর্বত্র শোনা যাচ্ছিল। ইতিমধ্যে এই এনজিওগুলো বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদল— যারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকেন— তাদেরকে প্রভাবিত করার জন্য সঙ্ঘবদ্ধ ও পরিকল্পিত চেষ্টা-তদবির চালিয়েছে। যদি আল্লাহ পাক অনুগ্রহ না করতেন, অতঃপর কিছু ইসলামী সংস্থা (রাবেতায়ে আলাম আল ইসলামী যাদের অন্যতম) এবং মুসলিম দেশগুলো আপত্তি উত্থাপন না করত, তাহলে নিঃসন্দেহে অবাধ ও উশৃংখল যৌনতার সুপারিশমালা জাতিসংঘের সেই অধিবেশনে পাশ হয়ে যেত।
তবে জাতিসংঘের অধিবেশনে এ ধরনের বিষয় উপস্থাপন থেকে আমার মাথায় একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন জন্ম নিয়েছে। আমি এই বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন ইসলামী সংগঠনের সাথে আলোচনা করেছি এবং রাবেতার সাময়িকীতেও লিখেছি। প্রশ্নটি হচ্ছে, জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্র ও কর্মপরিধি কী? সংস্থাটির ক্ষমতা প্রয়োগের সীমা কতটুকু হওয়া উচিত?
এক্ষেত্রে আমার বক্তব্য হচ্ছে, বিশ্বাস ও মূল্যবোধ সম্পর্কিত বিষয়— যেখানে মানুষের মধ্যে বিস্তর মতপার্থক্য হয়ে থাকে, এসকল ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও প্রজ্ঞাপন জারী করার অধিকার জাতিসংঘের নেই। এর কয়েকটি কারণ রয়েছে।
যেমন—
এক. যে সকল রাষ্ট্র নিয়ে জাতিসংঘ গঠিত হয়েছে, এর অধিকাংশের মধ্যে বিশ্বাস ও মূল্যবোধের ক্ষেত্রে বিস্তর ব্যবধান রয়েছে। ফলে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর পক্ষে বৈশ্বিক সমস্যা মোকাবেলার জন্য পরস্পর সহযোগিতা ও একসাথে কাজ করা তখনই সম্ভব হবে যখন প্রত্যেকেই এই মতপার্থক্য সত্ত্বেও অন্যকে সহ্য করতে প্রস্তুত থাকবে। কিন্তু বর্তমানে আমরা যা প্রত্যক্ষ করছি তা হল, পশ্চিমা কিছু সংগঠন নিজেদের বিশ্বাস ও মূল্যবোধ পৃথিবীর অন্যান্য মানব সমাজের উপর আরোপিত করতে বৈশ্বিক সংস্থাগুলোকে ব্যবহার করছে।
আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, কিছু রাষ্ট্র– যার মধ্যে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোও রয়েছে– জাতিসংঘের এই সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন করবে না। এভাবে একপর্যায়ে এই সংস্থাটি দুর্বল হবে এবং তার কার্যক্ষমতা হারাবে।
যেমন আমরা মুসলিম হিসেবে আমাদের বিশ্বাস ও মূল্যবোধগুলো জাতিসংঘ বা অন্য কোন সংস্থা থেকে গ্রহণ করি না। এবং একে একাজের জন্য বৈধ কোনো উৎসও মনে করিনা। আমরা আমাদের বিশ্বাস ও মূল্যবোধগুলো কেবলই আল্লাহ পাকের কিতাব ও তাঁর প্রেরিত রাসূল হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ থেকে গ্রহণ করি।
বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, যা (হয়তো) অনেকের জানা নেই, আমেরিকার সরকারি অবস্থান আমাদের এই অবস্থানের মতই। আমেরিকানদের কাছে তাদের সংবিধান ও আইনের স্থান হচ্ছে সমস্ত প্রজ্ঞাপন ও চুক্তির উপরে। ফলে এই চুক্তিসমূহের কোন কিছুই তাদের জন্য আইনতঃ পালনীয় হয় না যতক্ষণ পর্যন্ত সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পরিষদ (American Congress) তা অনুমোদন করে। আর সংবিধান বিরোধী কোন আইন পাস করতে কংগ্রেস সক্ষম নয়। এজন্য আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাতিসংঘে প্রদত্ত ভাষণে উজর পেশ করে বলেছেন, তার দেশ কিছু সেনেটরের বিরোধিতার কারণে বেইজিংয় সম্মেলনের সিদ্ধান্তগুলো কার্যকর করতে পারেনি।
আমরা আমাদের প্রতিপালকের কিতাব কোরআন মাজীদ ও আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহকে সমস্ত আইন, সমস্ত প্রজ্ঞাপন ও সকল চুক্তির উপরে স্থান দেই। এই চুক্তিসমুহের মধ্যে কোনটির সাথে একমত হলে একে আমরা এই সর্বোচ্চ বিধানের ভেতর থেকে ব্যখ্যা করি— “হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অগ্রগতি হয়ো না। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। (সূরা হুজুরাত:১) “আর রাসূল তোমাদের যা প্রদান করেন তোমরা তা গ্রহণ কর এবং যা থেকে বারণ করেন তোমরা তা থেকে বিরত থাকো। (সূরা হাশর:৭)
দুই.
দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত ও স্বীকৃত ‘মানবাধিকার’ প্রত্যেক মানুষকে ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান করেছে। এখন মানুষ তাদের ধর্মকে কিভাবে বুঝবে, ধর্মের কোন বিধান গ্রহণ করবে আর কোন বিধান বর্জন করবে— এটা যদি জাতিসংঘ নির্ধারণ করে দেয় এবং জাতিসংঘের এই নির্ধারণ কেউ অমান্য করলে তাকে শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়, তাহলে মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতার কী বাকি থাকল?
আল্লাহ পাক যে জিনিসকে হারাম করেছেন কোনো মুসলিম যদি সেটাকে হালাল জ্ঞান করে তাহলে সে কিছুতেই মুসলিম থাকবে না। আল্লাহ পাক প্রদত্ত দীনে সবচেয়ে জঘন্য হারাম কাজগুলোর অন্যতম হচ্ছে, যিনা ও সমকামিতার অপরাধ। জাতিসংঘ এই অপরাধগুলোর বৈধতার দাবী উঠিয়ে যেন মুসলিমদের বলছে, আপনারা নিজেদের ধর্ম থেকে সরে আসুন!
জাতিসংঘ একদিকে ধর্মীয় স্বাধীনতাকে মানুষের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকার করে এবং এর পক্ষে কাজ করে। অপরদিকে এই মৌলিক অধিকারকে খর্ব করে এমন এজেন্ডা ও নীতিমালা ধর্মে বিশ্বাসী মানুষদের উপর চাপিয়ে দেয়! এ কেমন সাংঘর্ষিক ও পরস্পর বিরোধী কর্মপদ্ধতি!?
ইসলামী দর্শন মতে, ধর্ম হচ্ছে মানুষের ”জীবন-পদ্ধতি”, যা মানুষ নিজেদের জন্য নির্বাচন করে থাকে। চাই এই জীবন পদ্ধতিটি আল্লাহ পাক প্রদত্ত দীনের মূলনীতিগুলোর উপর প্রতিষ্ঠিত হোক কিংবা সামাজিক চুক্তির ভিত্তিতে মানুষ নিজেরা তৈরী করে নিক।
এই বিশ্লেষণের আলোকে “ধর্মনিরপেক্ষতা” (Secularism) একটি ধর্ম। বেইজিং সম্মেলনের সিদ্ধান্তগুলোও ধর্ম। জাতিসংঘ যদি এগুলোকে পৃথিবীর জাতিগোষ্ঠীর উপর আরোপ করে দেয়, তাহলে সংস্থাটি তাদেরকে এমন একটি ধর্ম পালন করতে বাধ্য করবে—যে ধর্মে তারা বিশ্বাস করে না। তাহলে ধর্মীয় স্বাধীনতা রইল কোথায়?
তিন.
তৃতীয়ত, জাতিসংঘের সিদ্ধান্তাবলীর মর্যাদা পৃথিবীর জাতিগোষ্ঠী নিজেদের দেশের জন্য যা নির্ধারণ করে, এমনকি তাদের সর্বোচ্চ আইন পরিষদ যা অনুমোদন করে তারও উপরে হয়ে থাকে, তাহলে রাষ্ট্রগুলোর জাতীয় সার্বভৌমত্বের কী বাকি থাকবে? রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের সাথে সাংঘর্ষিক জাতিসংঘের এই নীতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে যদিও পৃথিবীর সমস্ত দেশ সমান হওয়ার কথা, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এটি শুধু দরিদ্র ও দুর্বল জাতিগোষ্ঠীর উপর প্রয়োগ করা হয়। অপরদিকে ধনী ও প্রভাবশালী জাতিগুলোকে জবাবদিহি ও জেরা করা বা শাস্তির সম্মুখীন করার সাহস কারো নেই।
এটা এ কথাই প্রমাণ করে— প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলো যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে বা পছন্দ করে থাকে, সেটাই বৈশ্বিক সংস্থাগুলোর মাধ্যমে বিভিন্ন উপায়ে দরিদ্র জাতিগোষ্ঠীর উপর আরোপ করা হয়।
প্রাদেশিক সরকার যদি ফেডারেল সরকার বা কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা ও কর্মপরিধি সীমিত করে দিতে পারে, যাতে এক সরকার অপর সরকারের সাথে অন্যায় ও অযাচিত আচরণ না করে, তাহলে জাতিসংঘের ক্ষমতা ও কর্মপরিধি সীমিত করা ন্যায় ও ইনসাফের দাবী নয় কি?