কমিউনিস্ট শাসনামলে মধ্যএশিয়ার মুসলিমদের ভাগ্যে কী ঘটেছিল, বিশেষত জোসেফ স্ট্যালিনের আমলে? খুব ভয়ঙ্কর কিছুই ঘটেছিলো। এমন ভয়ঙ্কর,যা এর আগে কোনো চর্মচক্ষু কখনো দেখেনি, কোনো কান কখনও শোনেনি এবং কোনো মানুষের কল্পনাতেও আসেনি এর ভয়াবহতার চিত্র। অন্য কোনো জাতির বিপর্যয়ের সাথে এর তুলনা চলেনা। তবে,আল্লাহ রক্ষা করুন, সাম্প্রতিক সময়ে বর্বর কমিউনিস্ট চৈনিকরা পূর্ব তুর্কিস্তানে (উইঘুর) যা ঘটিয়ে চলেছে তার কথা ভিন্ন। কেননা, সেখানেও আমরা মধ্য এশিয়ার জুলুমের ছায়া পূর্ণভাবে বিদ্যমান দেখতে পাচ্ছি।
এই বিস্তৃত অঞ্চলে মুসলিমদের বিপর্যয় ও ট্র্যাজেডির সূচনা কমিউনিস্ট শাসনামল থেকে শুরু হয়নি, বরং তারও বহু আগে, উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকেই জারতান্ত্রিক রাশিয়া এই অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা ও গুরুত্ত্বপূর্ণ শহর নগরগুলো দখল করা শুরু করে। ১৮৬৫ সালে তাশখন্দ, ১৮৬৮ সালে সমরকন্দ, ১৮৭৩ সালে বুখারা, ১৮৭৪ সালে খাওয়ারেজম, ১৮৭৩ সালে মার্ভ এবং ১৮৭৬ সালে খোক্বান্দ শহর তারা দখল করে ফেলে। মধ্য এশিয়াবাসির তীব্র প্রতিরোধের মোকাবেলায় বীভৎস গণহত্যার মধ্য দিয়ে তারা এই অঞ্চলে প্রবেশ করে। সাথে করে নিয়ে আসে হিংস্র খৃষ্টবাদী মিশনারি এবং সংগঠিত আকারে রুশ নাগরিকদের বড় একটি অংশকে, যেন উর্বর কৃষি প্রধান এলাকাগুলোতে তাদের বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দেয়ার মাধ্যমে কৃষির নেতৃত্ব তাদের হাতে আসে এবং এই অঞ্চলের মুসলিম জনমিতি ও সংখ্যা গরিষ্ঠতায় পরিবর্তন (Demographical Change) আসে।
মধ্য এশিয়ায় মুসলিমগণ এবং বলশেভিক বিপ্লবঃ
১৯১৭ সালে রাশিয়ায় যখন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হলো, যা বলশেভিক বিপ্লব নামে প্রসিদ্ধ, তখনও মধ্য এশিয়ার মুসলিমগন জারতান্ত্রিক শাষণের যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছিলেন এবং অর্থোডক্স গীর্জার অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে আর্তনাদ করছিলেন। লেনিন, স্ট্যালিন সহ অন্যান্য কমিউনিস্ট নেতারা মুসলিমদের এই করুণ বাস্তবতা খুব ভালো করেই অনুধাবন করতে পারলেন। ফলে তারা তাদের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পক্ষে মুসলিমদের সমর্থন আদায় করতে চাইলেন। মুসলিমদের এই সমর্থন আদায়কেই তাদের বিপ্লবের চূড়ান্ত সফলতা হিসেবে বিবেচনা করলেন। কেননা, মুসলিমদের সংখ্যাধিক্য এবং যেকোন মূল্যে খৃষ্টবাদী জারের জুলুম থেকে নিষ্পত্তি লাভের আকাঙ্খা তাদের কে পূর্ব থেকেই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য হুমকিস্বরূপ বানিয়ে রেখেছিলো। সুতরাং যদি এই মুসলিমদের সমর্থন আদায় করা যায়, তাহলে অনেক বড় একটি হুমকি দূর হবে। এর প্রমাণ পাওয়া যায় লেনিনের বক্তব্য থেকে। ২৪/১১/১৯১৭ তারিখে তার ভাষণে তিনি বলেন-
হে রাশিয়ার মুসলিমগণ, তোমাদের মসজিদ ও ইবাদতখানাগুলোকে ধ্বংস করা হয়েছে, তোমাদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও রীতিনীতি কে বিলুপ্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে, এবং জারতান্ত্রিক শাসনের তলে তোমাদের ব্যাক্তি ও ধর্মীয় স্বাধীনতাকে লুণ্ঠন করা হয়েছে। আমরা তোমাদের স্বাধীনতা কে রক্ষা করবো, তোমাদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও নিদর্শনাবলীর (মসজিদ, মাদ্রাসা) সংরক্ষন করবো চিরকাল। আমি চাই তোমরা তোমাদের মনে এই বিশ্বাস কে দৃঢ় করো যে, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পতাকাতলে তোমাদের সকল অধিকার ঠিক সেভাবেই রক্ষা করা হবে, যেভাবে রাশিয়ার অন্য যেকোন সমাজের অধিকার রক্ষা করা হবে।
১৫/১২/১৯১৭ তারিখের ভাষণে লেনিন এবং স্ট্যালিন উভয়েই বলেন-
হে মুসলিমগণ, তোমাদের মসজিদ, তোমাদের নামায, উপাসনা, ঈদ উৎসব এবং এবং ধর্মের সকল বিশ্বাসের সর্বোচ্চ সুরক্ষা দেয়া হবে। তোমরা জেগে ওঠো, ঘুরে দাঁড়াও এবং জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিপ্লবের সহায়তা করো। জুলুম ও নিপীড়ন থেকে তোমাদের মুক্তির দিন সমাগত।
এই জাতীয় বক্তব্য কমিউনিস্ট নেতৃবন্দের পক্ষ থেকে ক্রমাগত আসতে লাগলো। তাদের সেসব বক্তব্য কাগজে ছাপিয়ে মানুষের হাতে হাতে বিলি করা হতো এবং প্রত্যেকের ঘরে ঘরেও পৌঁছে দেয়া হতো। এসব আশাপূর্ণ বাগাড়ম্বরিতামূলক বক্তব্যের কারণে মধ্য এশিয়ার মানুষ দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এর মাঝে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাগটি, যারা সমাজের সবচেয়ে বেশি জুলুম ও নিষ্পেষণের শিকার হয়েছে, তারা কমিউনিস্টদের এসব মনভুলানো কথায় সম্মত হয়ে গেলো। তারা ভাবলো জুলুম থেকে মুক্তির সময় সত্যই বুঝি এসে গেছে। তারা কমিউনিস্টদের পক্ষে চলে গেলো, জারের নিপীড়ন থেকে মুক্তি লাভ ও তাকে ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করার আশায়। মুসলিমদের অপর দলটি কমিউনিস্টদের পক্ষে সায় দেননি। তারা ১৯১৬ সাল থেকেই স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু করেছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে রাশিয়া কিছুটা দূর্বল হয়ে পড়ে এবং অন্যান্য দেশে তাদের দখলদারিটা কিছুটা শিথিল হয়ে আসে। সে সুযোগে মুসলিমরা পুরোদমে প্রতিরোধ জিহাদ চালিয়ে যান এবং সুবিস্তৃত ফারগানা উপত্যকা মুক্ত করে সেখানে নিজেদের স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠা করেন। এর রাজধানী ছিলো খোকান্দ। স্বাভাবিকভাবেই তারা লেনিন স্ট্যালিনের এসব মনভোলানো প্রতারনামূলক আশ্বাসবাণীতে মোটেও কর্ণপাত করেননি। রুশদের দ্বারা অত্যাচার সয়ে যাওয়ার সুদীর্ঘ সংগ্রামের স্মৃতিই তাদেরকে পুনরায় রুশদের ফাঁদে পা দিতে দেয়নি। এজন্য ১৯১৮ সালে বলশেভিক সৈনিকরা খোকান্দে ভয়াবহ আক্রমন শুরু করে। শুরু হয় মুসলিম গণহত্যা। পঁচিশ হাজার মুসলিম নারী পুরুষ ও শিশু কে নির্বিচারে শহীদ করা হয় প্রথম আক্রমনেই। এই জঘন্য গনহত্যার পর মুসলিমদের মনে ক্ষোভের আগুন আরও দ্বিগুন হয়ে জ্বলতে লাগলো। জার বিরোধী আন্দোলনের চেয়েও বলশেভিক কমিউনিস্ট বিরোধী আন্দোলন তীব্র গতিতে ছড়িয়ে পড়লো মুসলিমদের মাঝে। ফলে বৃহত্তর ফারগানা উপত্যকা এবং তুর্কিস্তানের বেশিরভাগ অঞ্চলই তাদের হাত থেকে মুক্ত করে মুসলিমদের জন্য একটি রাজ্য গড়ে তুলতে সক্ষম হয় তারা। কিন্তু দুঃখজনকভাবে তা পাঁচবছরের বেশি টেকেনি। ১৯২২ সালেই সেটি আবার কমিউনিস্ট রেড আর্মিদের দখলে চলে যায়। কেননা মুসলিমদের মাঝে তখন জাতীয়তাবাদী চেতনা জেগে উঠেছিলো। বৃহত্তর তুর্কিস্তানের ভেতর কিরগিজ, তাজিক, উজবেক, কাজাক জাতির মানুষ সকলেই সম্মিলিতভাবে ছিলো। কিন্তু কমিউনিস্টরা তাদের আঞ্চলিক সহযোগি ও কর্মকর্তাদের মাধ্যমে দরিদ্র শ্রেণীর মুসলিমদের কে ক্রমাগত প্ররোচনা দিয়ে, সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীনে তাদেরকে স্বর্গে রাখা হবে জাতীয় মধুর প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভুলিয়ে ভালিয়ে এবং তাদের পত্রিকাগুলোতে কমিউনিস্টদের মিথ্যা প্রোপাগান্ডার স্রোত চালিয়ে সাধারণ মুসলিমদের জাতীয়তাবাদী অনুভূতিতে সুড়সুড়ি দিয়ে তাদের মাঝে বিশাল ফাটল তৈরী করা হয়। তারা এসব মধুর কথা ও প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করে এবং আসন্ন সুদিনের স্বপ্ন দেখে কমিউনিস্টদের পক্ষে চলে যায় এবং সেসব অঞ্চলে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পালে হাওয়া দিতে থাকেন। এতে আর আশ্চর্যের কী আছে! অনেকেই এই কমিউনিস্ট দর্শনের দ্বারা প্রতারিত হয়েছেন। পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ চলে গিয়েছিলো এর দখলে। একেবারে চীন থেকে নিয়ে মধ্য ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা সহ আরও অনেক অঞ্চলেই পৌঁছে গিয়েছিলো এই দর্শন। তখন সেটা মুসলিম অমুসলিম সহ কোটি মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতার বাণী শুনিয়েছিলো। তাদের আশা ও আকাঙ্খার প্রতিভু ছিলো কমিউনিজম।
স্ট্যালিন ও লোহার প্রাচীরঃ
এভাবে মুসলিমদের জুলুম ও নিষ্পেষণ থেকে মুক্তির শেষ সুযোগটিও হাতছাড়া হয়ে গেলো। বর্বর স্ট্যালিনের শাষণের (১৯২৪-১৯৫৩) শুরুর দিকেই রেড আর্মির দখলে চলে যায় পুরো তুর্কিস্তান। স্ট্যালিনই ছিলেন প্রকৃত সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা। মধ্য এশিয়ার (পশ্চিম তুর্কিস্তান) পুরো অঞ্চল সোভিয়েত রাশিয়ার দখলে চলে যায়, যার আয়তন হলো ৪১০৬০০ বর্গ কিলোমিটার। অপরদিকে পূর্ব তুর্কিস্তান চলে যায় চীনের দখলে। যার আয়তন হলো ১৮০০০০ বর্গ কিলোমিটার। স্ট্যালিন সেখানে জারি করেন কর্তৃত্ত্ববাদী শাসন ব্যাবস্থা, লোহা ও আগুনের মাধ্যমে। তৈরী করেন এক লৌহ প্রাকার। পুরো দুনিয়া থেকে এই অঞ্চল কে বিচ্ছিন্ন করে দেন। শুরু হয় রক্তাক্ত সংঘাতের নতুন পর্ব। খুন, হত্যা লুন্ঠন, অবমাননা, জাতিগত নিধন, গণহত্যা, ধর্মীয় ও সামাজিক পরিচয় বিকৃতি এবং ধর্ম ও মূল্যবোধের বিরুদ্ধে প্রবল আক্রমণ। সমাজ নির্মাণের ভিত্তিমূলগুলোকেও ধ্বংস করে ফেলা হয়েছিল। তখনকার প্রতারিত মুসলিমগণ তাদের কী সর্বনাশ হয়ে গেছে সেটা অনুধাবন করলেন ঠিকই, কিন্তু তখন আর কোন লাভ ছিলোনা। সময় ও সুযোগ উভয়ই হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে। তুর্কিস্তানি ঐক্যের যে স্বপ্ন তারা দেখেছিলেন তাকে সমূলে বিনাশ করেছে এই অঞ্চলে স্ট্যালিনের রাজনীতি। যখনই কোন ইসলামি প্রতিরোধ বিপ্লব উঠে দাঁড়াতো কমিউনিস্টরা তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তো এবং বর্বর উপায়ে এই বিপ্লবের আগুন নিভিয়ে দিতো। মধ্য এশিয়ায় ব্যাপকভাবে কমিউনিস্ট শাষণ এবং বিশেষভাবে স্ট্যালিনের শাসনের কিছু বৈশিষ্ট্য নিম্নে আলোচনা করা হলো-
ইসলাম, উন্নত গুনাবলী ও সৎকর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধঃ
বলশেভিক কমিউনিস্ট শাসনের শুরুই হয়েছিলো ইসলামকে বর্জন করার মাধ্যমে। তারা শাসন কর্তৃত্ত্ব হাতে পাওয়ার পরপরই ইসলামের বিরুদ্ধে এক নিষ্ঠুর যুদ্ধের ঘোষণা দেয়। ধর্মের ব্যপারে তাদের মতামত হলো, ধর্ম নিছক পুরানো গল্প কাহিনী, মূর্খতা এবং মানুষের জন্য আফিম স্বরূপ। বিশেষত ইসলাম সামাজিক বৈষম্য ও জুলুম কে সমর্থন করে, শ্রেণী শোষণ কে চিরস্থায়ী করে, অর্থনৈতিক মুক্তি ও শ্রেণী সংগ্রামের বিপ্লবের পথে বাধা দান করে এবং মানুষকে বোকা বানিয়ে পরকালের অলীক স্বপ্নে বিভোর করে রাখে। এজন্য খুব শীঘ্রই তারা মানুষকে ধর্ম থেকে বিরত রাখার পদক্ষেপ গ্রহন করে। নামায, রোযা, হজ, যাকাত, কুরআন তেলাওয়াত সবকিছু নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। মসজিদ মাদ্রাসা বন্ধ করা হয়। মসজিদগুলো কে গুদামঘর আর গরু ও ঘোড়ার আস্তাবলে পরিণত করা হয়। ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বন্ধ করে সেগুলোতে সেনা ছাউনি ও সরাইখানা বানানো হয়। ইসলামি ওয়াক্বফকৃত সকল প্রতিষ্ঠান এবং শরঈ বিচারালায়গুলোকে বাতিল করে দেয়া হয়। ধর্মীয় কুসংস্কার ও কিচ্ছা কাহিনীর নামে সমস্ত কুরআন শরিফ পুড়িয়ে ফেলা হয়। খতনা ও একাধিক বিবাহ, মোটকথা সব ধরনের ধর্মীয় রীতিনীতি, চিহ্ন ও আলামতের উপর নিষিধাজ্ঞা জারী করা হয়। যাকেই রোজাদার অবস্থায় পাওয়া যেতো জোর জবরদস্তি করে তার রোজা ভাঙ্গানো হতো। পরিবার, বিবাহ ও যৌনতা বিষয়ে মুসলিম সমাজে যেসব ধর্মীয় বিধিবিধান প্রচলিত ছিলো সেগুলোর উপর জোরালো আক্রমন করা হলো। এসব ক্ষেত্রে ইসলামী বিধি বিধান কে বিলুপ্ত করে নব্য সমাজতান্ত্রিক বেলেল্লাপনা কে চাপিয়ে দেয়া হলো। এর জন্য মুসলিম নারীদেরকেই লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হলো। তাদের দলের মহিলা শাখার কর্মীরা সমাজের এই আমূল পরিবর্তন আনাকেই নিজেদের প্রধান দায়িত্ত্ব হিসেবে গ্রহন করলো। এর শুরু হলো কতিপয় নারী সংগঠন তৈরীর মাধ্যমে। ৮/৩/১৯২৮ তারিখ কে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা দিয়ে এক বিশাল নারী সমাবেশের আয়োজন করা হলো এবং সেখান থেকে সবাই কে বলা হলো তাদের হিজাব পুড়িয়ে ফেলতে এবং নিজেদের জীবন থেকে হিজাব কে চিরতরে দূরে সরিয়ে ফেলতে। এ ছাড়াও আরও অনেক অশ্লীল, বিকৃত ও জঘন্য কাজের প্রতি আহবান জানানো হলো মুসলিম নারীদের কে। তাদের এই নিকৃষ্ট প্রকল্পের প্রতিবাদে মুসলিমদের মাঝে প্রচণ্ড ক্ষোভ দেখা দিলো। তারা শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চাইলেন। কিন্তু স্ট্যালিনের হিংস্র রাজনীতি ও বর্বর অস্ত্রের মুখে সে প্রতিরোধ বেশিদিন টেকেনি।
খু্ন, নির্যাতন, উৎখাত এবং জাতিগত নিধনঃ-
কমিউনিস্ট নিরাপত্তা বাহিনী হাজার হাজার ইমাম, মুয়াজ্জিন, খতিব, বক্তা এবং আলেম উলামাকে গ্রেফতার করে,তাদের বিরুদ্ধে পাওয়া “গোপন অভিযোগের” ভিত্তিতে। তখন প্রায় প্রতি ঘরেই গোপন সংবাদ-দাতা নিযুক্ত করা ছিলো কমিউনিস্টদের পক্ষ থেকে। এমন কি কোন অভিযোগ না থাকলেও স্রেফ ইমাম-মুয়াজ্জিন বা ধর্মীয় ব্যক্তিত্ত্ব হওয়াটাই তাদের কে বন্দি করার জন্য যথেষ্ট ছিলো। অগত্যা কোন ক্ষেত্রে যদি অভিযোগ দেখানোটা জরুরী হয়ে পড়তো, তাহলে তাদের বানানো অভিযোগ সমূহ প্রস্তুত করাই থাকতো। মোটকথা কাউকে গ্রেফতার করার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে তার কাছে কোন ধর্মীয় বই পুস্তক, অথবা আরবি হরফে কোন লেখা কিংবা কা’বা ঘরের চিহ্ন আছে এমন কোন বস্তু তার কাছে পাওয়া গেছে। একজন মুসলিমের জীবন ধ্বংস করে দেয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট ছিলো। গ্রেফতার করার পর হয় তাদের কে দুনিয়ার বুক থেকে মিটিয়ে দেয়া হতো,কিংবা কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে নিক্ষেপ করা হতো। সেখানের হরেক রকমের শাস্তির বীভৎসতা যুবক তরুণদেরকে পর্যন্ত বৃদ্ধে পরিণত করতো। কাউকে আবার পাঠিয়ে দেয়া হতো সাইবেরিয়ার বরফভর্তি জঙ্গলে। সেখানে তারা ক্ষুৎ পিপাসায় ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুবরণ করতেন। স্ট্যালিনের কুখ্যাত গোলাগ শ্রম শিবিরেও পাঠানো হয়েছিলো হাজারো মুসলিম কে। একই সময়ে গ্রেফতার কিংবা অন্য কোথাও না পাঠিয়ে ঠান্ডা মাথায় লাখো মুসলিম কে হত্যা ও নিজ ভূমি থেকে উৎখাত করা হয়েছিলো স্রেফ এই অভিযোগে যে, তারা সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরোধিতা করে। স্ট্যালিন তার রাজনৈতিক বিরোধী পক্ষের উপর যখন নির্মূল অভিযান চালনা শুরু করলেন তখন লাখো মুসলিম কে হত্যা করা হয়, তাদের মাঝে পাঁচ লক্ষেরও বেশি ছিলেন কাজাখ( কাজাখিস্তানের অধিবাসি), তাদের সাথে বুদ্ধিজীবি, চিন্তক, কবি, সাহিত্যিক, ইতিহাসবিদ, শিক্ষক এবং আলেম উলামাদের বড় একটি অংশকেও হত্যা করা হয়। বেদুইন বা গ্রাম্য আদিবাসীদের জবরদস্তিমূলক সভ্য করে তুলতে গিয়েও নির্বিচারে হাজারো মানুষ কে ফাঁসি তে ঝুলানো হয়। শুধুমাত্র স্ট্যালিনের শাসনামলে যে পরিমাণ মুসলিম কে হত্যা,নির্মূল ও উৎখাত করা হয়েছে আগ্নেয়াস্ত্র, বীভৎস শাস্তি ও পরিকল্পিত দুর্ভিক্ষ তৈরীর মাধ্যমে, সে সংখ্যাটা মারাত্মক ভীতিকর এবং রীতিমতো অবিশ্ব্যাস্য।
জাতিগত বিভক্তি তৈরী এবং ইসলামি ঐক্য বিচ্ছিন্ন করা
তুর্কিস্তান সে সময় প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদের দিক দিয়ে পৃথিবীর সমৃদ্ধতম দেশ ছিলো । সেই ইসলাম অধ্যুষিত অঞ্চল কে দখল করার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ কে স্রেফ বাহানা হিসেবে গ্রহন করেছিলো। প্রকৃতপক্ষে সোভিয়েত রাশিয়া সেখানে লুটপাট করতেই গিয়েছিলো। এই লুটপাটের সুবিধার জন্যই রুশ সাম্রাজ্যবাদীরা পুরো অঞ্চলটিকে পাঁচ ভাগে বিভক্ত করেছে।
১। উজবেকিস্তান।রাজধানী-তাশকন্দ। আয়তন-৪৪৭৭০০ বর্গ কিলমিটার। মুসলিম জনসংখ্যা ৮৮%।
২। তুর্কমেনিস্তান। রাজধানী-আশকাবাদ। আয়তন-৪৯০০০০ বর্গ কিলোমিটার। মুসলিম জনসংখ্যা-৮৬%।
৩। তাজিকিস্তান। রাজধানী-দুশাম্বে। আয়তন-১৪৩০০০ বর্গ কিলোমিটার। মুসলিম জনসংখ্যা-৮০%।
৪। কাজাখাস্তান। রাজধানী-আলমাআতা (বর্তমানে নূর সুলতান)। আয়তন-২৫০০০০০ বর্গ কিলোমিটার। মুসলিম জনসংখ্যা-৫২%
৫। কিরগিজিস্তান। রাজধানী-বিশকেক। আয়তন-২০০০০০ বর্গ কিলোমিটার। মুসলিম জনসংখ্যা-৭৩%।
জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে অঞ্চলগুলো কে বিভক্ত করা হয়েছে। যদিও তাজিক ব্যাতিত তাদের সকলের জাতিগত পরিচয় ছিলো একটাই, তুর্কি। তাজিকদের অধিকাংশই ছিলো পারসিক বা পারস্য জাতির মানুষ। তাজিকিস্তানে তাদের জনসংখ্যা ছিলো ৫৬%। কিন্তু এই পাঁচটি রাষ্ট্রে তাদের একক জাতিসত্ত্বা কে পাঁচটি ভাগে ভাগ করে ফেলা হয়। রাষ্ট্রগুলোর মাঝে সীমান্ত টানা হয় নিছক শুন্যের উপর। এর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিলো এই বিস্তৃত ঐক্যবদ্ধ অঞ্চলটিকে টুকরো টুকরো করে এর একক সত্ত্বাগত পরিচয় কে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করা এবং নব্য জাতি রাষ্ট্রের ভিত্তিতে তাদের মাঝে বিভাজন তৈরী করা, যেনো তাদের উপর কর্তৃত্ত্ব স্থাপন মজবুত হয়, প্রাকৃতিক সম্পদ লুট করা যায় এবং রাশিয়া থেকে আগত অমুসলিম সংখ্যালঘুদের ক্ষমতা ও দাপট বৃদ্ধি পায় স্থানীয় মুসলিমদের উপর। এই কাজ স্বয়ং স্ট্যালিন করেছেন, তুর্কিস্তানের মানচিত্রে কাঁটাছেড়া করে একে বহুধা বিভক্ত করেছেন, যেনো ইসলামী ঐক্যের ভরকেন্দ্র কেন্দ্রীভূত হতে না পারে। উদাহরণস্বরূপ, এক ফারগানা উপত্যকাকেই তিনটি রাষ্ট্রের মাঝে ভাগ করে দেয়া হয়েছে, উজবেকিস্তান, কিরগিজিস্তান এবং তাজিকিস্তান। রাষ্ট্রগুলোর মাঝে যে সীমান্ত টানা হয়েছে, সেগুলো একেকটা যেনো টাইম বোমার ন্যায়, যেকোন সময় বিস্ফোরিত হতে পারে। ফলে এই রাষ্ট্রগুলোর পক্ষে এই বিপদজনক সীমান্ত অতিক্রম করে পরস্পরে মিলিত হয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করা যেমন অসম্ভব, তেমনি কোনো রাষ্ট্রের পক্ষে একাকী রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করাও অসম্ভব। মোটকথা, প্রতিরোধের সকল সম্ভাবনাই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কমিউনিস্ট রাশিয়া তাদের কে এমন এক ভঙ্গুর ও নড়বড়ে রাষ্ট্র কাঠামো দিয়েছে যা মস্কোর সহায়তা ব্যতীত আদৌ চলতে সক্ষম নয়। এমনকি বর্তমানেও,তথাকথিত স্বাধীনতা লাভের পরও তাদের এই অবস্থা চলমান। মস্কো নির্ভরতা মোটেও কমেনি।
নাস্তিক্যবাদের বিস্তার এবং ছাত্র, শ্রমিক, কৃষকদের কে তা বাধ্যতামূলকভাবে শিক্ষা দেয়াঃ
১৯২১ সালে গৃহীত সোভিয়েত ইউনিয়নের সংবিধানের ৫২ নাম্বার ধারায় বলা হয় যে, ইউনিয়নের ভেতর প্রত্যেক বাসিন্দা ধর্মীয় স্বাধীনতা পাবে। যার যে ধর্ম খুশি সে তা পালন করতে পারবে এবং ধর্মীয় রীতিনীতি ও আচার অনুষ্ঠান পালনেও কোন প্রকার বাধা থাকবেনা। আবার কেউ চাইলে কোন ধর্ম না মেনেও নাস্তিক হয়ে থাকতে পারবে। কিন্তু সংবিধানের এই বিশেষ ধারা মুসলমানদেরকে তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়ার বদলে উল্টো তাদের ঘাড়েই চেপে বসলো, তাদের ধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার শ্বাস রুদ্ধ করে মারার অজুহাত হয়ে দাঁড়ালো। একই সাথে মুসলিম সমাজে নাস্তিক্যবাদের প্রচার প্রসার ঘটানোর ক্ষেত্রেও এই সাংবিধানিক ধারাটি তাদের প্রধান হাতিয়ার হয়ে উঠলো। কারণ নাস্তিক্যবাদই হলো কমিউনিজমের মৌল উপাদান। নাস্তিক্যবাদ ব্যতীত কমিউনিজম দাঁড়াতে পারবেনা। মূলত শিক্ষাব্যবস্থা ও পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমেই নাস্তিকতার বীজ বোনা শুরু হয়। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সকল শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদেরকে মার্ক্সীয় চিন্তার সাথে পরিচিত করিয়ে দেয়া হয় এবং তাদের চিন্তা চেতনা কে গড়ে তোলা হয় কমিউনিস্ট মতাদর্শ অনুযায়ী। ইসলামের ইতিহাস, ঐতিহ্য, আকিদা-বিশ্বাস এবং নবী রাসুলদের ব্যাপারে মিথ্যা বানোয়াট প্রোপাগান্ডা দিয়ে ভরিয়ে ফেলা হয়। ১৯২৯ সালের ১৫তম কমিউনিস্ট সম্মেলনে স্ট্যালিনের নেতৃত্ত্বে কমিউনিস্ট কমরেডগণ সকল ধর্মের বিরুদ্ধে বর্বর আক্রমণের ঘোষণা দেন এবং নাস্তিক্যবাদ কে সকলের উপর চাপিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তাদের এই হিংস্র উগ্র ধর্ম বিরোধী আক্রমণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু, তথা ১৯৩৯ পর্যন্ত জারি থাকে। নাস্তিক্যবাদের এই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা একেবারে শিশু শ্রেণি থেকে শুরু হতো এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ শ্রেণি পর্যন্ত শেখানো হতো। ধাপে ধাপে শিক্ষার্থীদের মগজধোলাই করা হতো। তাদের এই শিক্ষা প্রকল্প থেকে বাদ ছিলোনা কারখানার শ্রমিক মজদুর ক্ষেত খামারের কৃষকরাও। তাদের মাঝে নাস্তিক্যবাদের শিক্ষা ও দীক্ষা ছড়িয়ে দেয়ার জন্য প্রতিষ্ঠা করা হলো অসংখ্য শিক্ষাকেন্দ্র। এবং বিভিন্ন উপলক্ষ্যে অথবা উপলক্ষ্য ছাড়াই এ বিষয়ে সভা সেমিনার আয়োজন করা হতে লাগলো। এই কাজকে যথাযথভাবে পরিচালনা ও দেখাশোনার জন্য “বিজ্ঞানভিত্তিক নাস্তিক্যবাদ” নামে একটি বিশেষ সংগঠন তৈরী করা হলো। এদের সাথে ধর্ম বিদ্বেষী নাস্তিক্যবাদের আরও যত শাখা প্রশাখা ও সংগঠন ছিলো সব একযুগে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলো। তারা ক্ষমতাবলে হাজার হাজার মসজিদ মাদ্রাসা কে ধ্বংস করে সেগুলোর কোনটাকে হোটেল, ঘোড়ার আস্তাবল, নাচ গানের ক্লাব, কফিশপ কিংবা শুকরের খোঁয়াড় ইত্যাদি বানাতে লাগলো। মার্ক্স, লেনিন ও এঙ্গেলসের বইগুলো ছাপিয়ে সবার মাঝে বিলি করে দেয়া হতো এবং এগুলো পড়া সবার জন্য বাধ্যতামূলক করে দেয়া হলো। ধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রকাশ্য ঘোষণা স্ট্যালিনই দিয়েছিলেন, সে হিসাবে তার সেই কুখ্যাত বাণী – আমাদের অবশ্যই একথা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে হবে যে,সকল ধর্ম হলো বানোয়াট কিচ্ছা কাহিনী, স্রষ্টা ও পরকালের ধারণাও একটি কাল্পনিক গল্প, মানুষকে শোষণের জন্য এগুলোর সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং নাস্তিক্যবাদই হলো আমাদের একমাত্র ধর্ম” শহরের সব দেয়ালে ও ভাস্কর্যের নিচে সোনালী অক্ষরে লেখা থাকতো।
রুশ ভাষা চাপিয়ে দেয়া, আরবি নিষিদ্ধ করা এবং আরবি হরফ বিলুপ্ত করে দেয়াঃ
রাশিয়ায় কমিউনিস্ট বিপ্লবের আগে তুর্কিস্তানের বড় একটি অংশের মানুষ আরবি ভাষায় কথা বলতো। বিশেষত আলেম উলামা ও শিক্ষিত শ্রেণীর মানুষগণ। এমনকি আরবি ভাষায় কবিতা ও সাহিত্য চর্চার রেওয়াজও ভালোরকমেই ছিলো। কিন্তু কমিউনিস্টরা সেখানে গিয়ে প্রথমেই আরবি ভাষার উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলো এবং রুশ ভাষা কে চাপিয়ে দেয়া হলো। এমনিতে ব্যাপকভাবে এই অঞ্চলের ভাষা ছিলো তুর্কি, লেখা হতো আরবি হরফে। ১৯২৫ সালে কমিউনিস্টরা আরবির পরিবর্তে রুশ অক্ষরে তূর্কি লেখার বিধান জারি করলো এবং রুশ ভাষা কে জাতীয় ভাষা ও একমাত্র দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ঘোষণা করলো।এর উদ্দ্যেশ্য ছিলো মুসলিমদের সত্ত্বাগত পরিচয়ের শেকড় ছিন্ন করা এবং তাদের ইসলামি সভ্যতার অতিত ও ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা। আরবি ভাষা ব্যবহার এবং এ ভাষার কোনো বইপত্র সংরক্ষনে রাখা ছিলো গর্হিত অপরাধ। এমনই গর্হিত অপরাধ যা তাদেরকে সর্বোচ্চ শাস্তির মুখোমুখি পর্যন্ত করে ফেলতো। ১৯৩৭-৩৮ সালের সময়কালে কমিউনিস্টরা মুসলিমদের উপর যখন নৃশংস ভাবে ব্যপক আকারে তল্লাশি ও ধর পাকড় শুরু করলো, তখন যার কাছেই কুরআন শরিফ পাওয়া যেতো অথবা যেকোন আরবি ভাষার বই, তার বিষয়বস্তু যাই হোক, তাকেই হত্যা করে ফেলা হতো। মানুষ তখন বাধ্য হয়ে সমস্ত ধর্মীয় বই পুস্তক আগুনে পুড়িয়ে ফেলে কিংবা নদীতে ফেলে দেয়। কেউ আবার এগুলোকে সংরক্ষণের জন্য সযতনে মাটির নিচে পুঁতে রাখেন অথবা দেয়ালের কোঠরে লুকিয়ে রাখেন। যাদের কাছে বেশি কিতাবাদি পাওয়া যেতো তাদেরকে শহরের বাইরের একটি জায়গায় নিয়ে যাওয়া হতো।সেখানে তার জন্য একটি গর্ত ও কিতাব পত্রের জন্য একটি গর্ত খোঁড়া হতো। তারপর তাকে এবং তার কিতাবগুলো কে গর্তে ফেলে দিয়ে মাটিচাপা দেয়া হতো। এভাবে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এবং যে পরিমাণ ইসলামী কিতাবপত্র ও প্রাচীন পাণ্ডুলিপি ধ্বংস করা হয়েছে তার পরিমাণ অবিশ্বাস্য। আরবি ভাষার প্রতি এই যুদ্ধ চালানোর পাশাপাশি তারা দেশের সব যায়গায় ভাষা শিক্ষার বিদ্যালয় চালু করলো। সেখানে ছোট বড় সকল ছাত্র ছাত্রীদের রুশ ভাষা শিখানো হতো, যেনো তারা কমিউনিজমের দীক্ষা সরাসরি মূল ভাষা থেকে গ্রহণ করতে পারে।
সম্পদ লুট ও পরিবেশ ধ্বংস করাঃ
মধ্য এশিয়া এবং আজারবাইজাইন ছিলো সোভিয়েত রাশিয়ার প্রাকৃতিক সম্পদের সবচে বড় উৎস। যেমন ৫০% পেট্রোল, ৯৫% ফসফেট, ৯০% ইউরোনিয়াম, ৯০% ক্রোমিয়াম, ৮৬% তামা, ৭৬% পিতল, ৯৬% তুলা, ৯৬% রেশম, ৭৬% পশম এবং স্বর্ণ-রূপা সহ প্রায় সবধরণের প্রাকৃতিক সম্পদই রাশিয়ায় পাচার হতো। উজবেকিস্তানে ছিলো সবচে বড় বিমান তৈরীর কারখানা এবং সবচেয়ে বেশী তুলা উৎপাদনও ওই অঞ্চলেই হতো। সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখার জন্য স্ট্যালিন ফারগানা উপত্যকার খোকান্দ এলাকার কৃষকদেরকে গমের পরিবর্তে তুলা চাষে বাধ্য করেন। যারা তুলা চাষ করতে চাইতনা অথবা করতে বিলম্ব করতো তাদের কে প্রকাশ্যে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হতো। কাজাখিস্তানে ছিলো সবচেয়ে বড় পারমানবিক অস্ত্রের কারখানা। সে অঞ্চলের বিশ ভাগ জমিতে চাষ বাস করা হতো। কিন্তু সেসব জমি থেকে উৎপাদিত শস্য ও ফল ফলাদি সবকিছু কেন্দ্রে,অর্থাত মস্কোতে পাঠিয়ে দেয়া হতো। তুলা চাষ সোভিয়েত রাশিয়ার অর্থনীতির জন্য অতীব লাভ জনক হলেও উজবেকিস্তানের কৃষক ও তার পরিবেশ প্রকৃতির জন্য ছিলো অভিশাপ স্বরূপ।তুলা গাছ জমিনের সমস্ত পানি শুষে নিতো এবং এবং রাসায়নিক সারের কারণে জমিনের উর্বরতা মারাত্মকভাবে হ্রাস পেতো। স্পষটতই ব্যাপকভাবে তুলা চাষ তাদেরকে এক বড়সড় পরিবেশ ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলো। সে অঞ্চলের সবচে বড় যে দুই নদী, জাইহুন ও সাইহুন নদীর পানি ভয়ঙ্করভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কাজাখাস্তানে পারমানবিক অস্ত্রের পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়ে সেখানকার পরিবেশ কে ভয়াবহ রকমের বিষাক্ত করে তোলা হয়েছিলো, বর্তমানেও একই অবস্থা চলমান। কমিউনিস্টদের কৃষি ব্যাবস্থাপনার জন্য ১৯৩১-১৯৩৩ সাল সময়ে কাজাখাস্তানে প্রচন্ড দূর্ভিক্ষ দেখা দেয়, এতে হাজার হাজার মানুষ অনাহারে মৃত্যুবরণ করে এবং আরও হাজারো মানুষকে এই অঞ্চল ছেড়ে যেতে বাধ্য করে। এই দূর্ভিক্ষের কারণে ১৯২৬ সালের ৫৭% কাজাখ জনসংখ্যা ১৯৩৭ সালে ৩৮% এ নেমে আসে। এর বিপরিতে একই সময়ে সেখানে বসবাস করা ২০% রুশ অধিবাসির সংখ্যা ৪০% এ গিয়ে দাঁড়ায়। ১৯৪১ সালে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে স্ট্যালিন পশ্চিম রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে ১৫০০ কল কারখানা পূর্বাঞ্চলে স্থানান্তরিত করেন, এর বেশিরভাগই মধ্য এশিয়ায় স্থাপন করেন। শুধু কাজাখিস্তানেই একশত কারখানা স্থাপন করা হয়।
রুশ অভিবাসীদের সংখ্যা বৃদ্ধি করা এবং তাদের আধিপত্য বিস্তার করা-
রুশদেরকে গণহারে এ অঞ্চলে স্থানান্তরিত করার রাজনীতি শুরু হয়েছিলো জারের শাসনামল থেকেই। ‘কিন্তু এই পলিসি ষোলকলায় পূর্ণ হয় কমিউনিস্ট শাসনামলে, বিশেষত অত্যাচারী স্ট্যালিনের আমলে। সোভিয়েত প্রশাসন এই অঞ্চলটিকে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠির জন্য অভিবাসনের স্বর্গ বানিয়ে ফেলে। বিশেষত ইউক্রেনিয়ান, তাতার, কোজাক, পোলিশ জাতির মানুষে পূর্ণ করে ফেলা হয়, জার আমলে তাদেরকে পাঠানো হতো জবরদস্তিমূলক নির্বাসনে, সোভিয়েত আমলে সেটাই পরিণত হলো পরিকল্পিত আবাদিকরণ প্রকল্পে। ফলে তুর্কিস্তানে রুশ অভিবাসিদের সংখ্যার হার অবিশ্বাস্যরকম ভাবে বেড়ে গিয়েছিলো। ১৯২৯ সালে যা ছিলো ২০%, ১৯৩৯ গিয়ে সেটা দাঁড়ালো ৪০% এ। এই সময়ে কিরগিজিস্তানে ১২% থেকে ২১%, তাজিকিস্তানে ১% থেকে ৯%, তুর্কমেনিস্তানে ৮% থেকে ১৯% পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধু উজবেকিস্তান ব্যাতিক্রম ছিলো, সেখানে এই দশ বছরে বহিরাগত অভিবাসির সংখ্যার হার ২৫% থেকে ১২% এ নেমে এসেছিলো। সোভিয়েত রাশিয়া এই সংখ্যালঘু অভিবাসিদের উপরই সামগ্রিকভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে এ অঞ্চলের সকল প্রশাসনিক কাজের ক্ষেত্রে। বিশেষত কাজাখাস্তান, যা ছিলো মস্কোর খুবই প্রিয়ভাজন এবং বিশেষ কারণবশত তারা একে মধ্য এশিয়ার মাঝে গণ্য করতোনা। পাঁচ মিলিয়ন রুশ শ্রমিক নিয়োগ দেয়া হয়েছিলো এসব দেশের খনিগুলোতে। আর এরকম পরিকল্পিত ও জবরদস্তিমূলক অভিবাসনের ফলে স্রেফ কাজাখিস্তানেই আশিটিরও বেশি জাতিগুষ্ঠির অবস্থান ছিলো।
সমাজতন্ত্রের পতন, টিকে গেলো ইসলাম। কিন্তু…
এই অবর্ণনীয় জুলুম, নির্যাতন, হত্যা, খুন, গণহত্যা, দেশান্তর, পরাধীনতা সহ জুলুমের এমন কোন প্রকার বাকি নেই যা তাদের উপর চালানো হয়নি। এসবকিছু সত্ত্বেও তুর্কিস্তানের মুসলিমগণ তাদের ঈমান কে ছেড়ে দেননি। যদি বলি তাদের এই প্রতিরোধ সংগ্রাম ককেশাশ ও ক্রিমিয়ার প্রতিরোধের মতই শক্তিশালী ছিলো, তাহলে মোটেও বাড়িয়ে বলা হবেনা। যে প্রতিরোধ জারের শাসন এবং সমাজতন্ত্রের সুদীর্ঘ ও নিষ্ঠুর শাসনের পতন ঘটা পর্যন্ত থেমে যায়নি। এর ভেতর ছিলো স্ট্যালিনের মতো কুখ্যাত বর্বর শাসকের সময়,যা সবচে বেশি ভয়ঙ্কর এবং দীর্ঘ ছিলো। তার সময়েই নাস্তিক্যবাদের প্রচার চুড়ান্ত পর্যায়ে ছিল এবং ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ভয়াবহতাও সীমা ছাড়িয়েছিলো অস্ত্র, কলম ও মুখের মাধ্যমে। সকল প্রতিরোধের প্রাণকেন্দ্র ছিলো উজবেকিস্তান। যা একসময় ইসলামি সভ্যতারও নয়নমণি ছিলো। এখানেই বুখারা, সমরকন্দ, তাশকন্দ, খাওয়ারিযম এর মতো শহরগুলোর অবস্থান।ইসলামি সভ্যতার এই প্রাণকেন্দ্রগুলোই কমিউনিস্টদের তাড়িয়ে বেড়িয়েছে শেষ দিন পর্যন্ত। কেননা এই শহরগুলোতে এই পরিমাণ মসজিদ-মাদ্রাসা ও ইসলামি সভ্যতার নিদর্শনাবলী রয়েছে যা তাদের জন্য ভয়াবহরকমের অস্বস্তিকর ছিলো। তারা অবিরাম শত চেষ্টা করেও এগুলোকে মিটিয়ে ফেলতে পারেনি। এই মসজিদ মাদ্রাসা ও ইসলামি নিদর্শনাবলীর উপস্থিতি, যদিও তা নিছকই কিছু প্রতীকি স্থাপনা, কিন্তু এগুলোই ইসলামের সুদীর্ঘ গৌরবময় ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মর্যাদার সাক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিলো তেরোশত বছর যাবত। আর এসব মসজিদ মাদ্রাসা থেকে যেসব আলেম উলামা ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে অগাধ পান্ডিত্য অর্জন করে বেরিয়েছিলেন, তারাই ইসলাম কে আঁকড়ে ধরেছেন এবং সমাজতান্ত্রিক নাস্তিকতার বিরুদ্ধে ইসলাম ও মুসলমানদের ঈমান আমল কে রক্ষা করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। এ অঞ্চলের মানুষেরা ইসলাম কে দাঁতে চেপে রক্ষা করেছিলেন এবং তাদের এই অবিশ্বাস্য ইসলাম প্রিয়তাই সোভিয়েত রাশিয়াকে পদে পদে সমস্যার সম্মুখীন করেছে এবং তাদের শক্তিকে খর্ব করেছে। তারা বিভিন্ন উপলক্ষ্যে সেটা স্বীকার করেছে এবং স্ট্যালিনের কাছে এবং পরবর্তীতে গর্ভাচেভের কাছে বিশেষ সাহায্য চেয়েছে এই ইসলামি চ্যলেঞ্জ কে মোকাবেলার জন্য। গর্ভাচেভ ১৯৮৫ সালে ক্ষমতায় আসার পর ধর্মীয় কিছু ক্ষেত্রে স্বাধীনতা দেন তিনি। গির্জা ও মসজিদ খোলার অনুমতি দেন। যেহেতু তিনি আগেভাগেই টের পাচ্ছিলেন পরিস্থিতি ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে এবং যেকোন সময় বিস্ফোরন ঘটতে পারে, যা সোভিয়েত ইউনিয়নের ভিত্তিমূল কে ধ্বসিয়ে দিবে। সমাজতন্ত্রের পতনের কিছুদিন আগে তিনি উজবেকিস্তানের রাজধানী তাশকন্দ যান, যা মধ্য এশিয়ায় ইসলামের সবচেয়ে বড় এবং গুরুত্বপূর্ন সভ্যতার নগরী ছিলো। সেখানে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সমাবেশের ভাষণে সদস্যদের কে সতর্ক করে বলেন, এই দেশের অনেকেই মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করছে, যা আমাদের পার্টির নিয়মের পরিপন্থী, এবং আমাদের জন্য বিপদজনক।
এছাড়াও কমিউনিস্ট নেতাকর্মীরা তার কাছে উজবেকিস্তানে মুসলিমদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার ব্যাপারে আশঙ্কা প্রকাশ করেন এবং ইসলামী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার উপায় খোঁজেন। কিন্তু তার আগেই, ১৯৯১ সালে খোদ সোভিয়েত ইউনিয়নই ধ্বসে পড়ে, পতন ঘটে সমাজতান্ত্রিক জুলুমের, হেলায় পড়ে থাকে এর দুর্গন্ধযুক্ত মৃতদেহ এবং তা হয়ে পড়ে অতীতের যেকোন সংবাদের একটি অংশ। এর বিপরীতে টিকে থাকে ইসলাম, পর্বতসম উচ্চতা ও দৃঢ়তা নিয়ে। কিন্তু তার মানে এইনা যে, সোভিয়েত পতনের সাথে সাথে ইসলামের বিরুদ্ধে সকল যুদ্ধ আর ষড়যন্ত্রও থেমে গিয়েছে! এমনটা কখনও না! বরং সেই সংগ্রাম ও প্রতিরধ এখনও চলমান। এতিম সমাজতন্ত্রের মানস সন্তানেরা সেখানে আজও রয়ে গেছে, তারাই সেই যুদ্ধ চালিয়ে নিচ্ছে। এবং সেই “সভ্য এলিট” নাগরিকেরা, যাদের শেকড় বিচ্ছিন্ন করতে, সত্ত্বাগত পরিচয় বিকৃত করতে এবং মগজ ধোলাই করতে সফল হয়েছিলো কমিউনিস্টগণ।