ইসলামের দৃষ্টিতে তাজিয়া কী?
আরবী ভাষায় ‘তাজিয়া’ শব্দের অর্থ- সান্ত্বনা দেয়া, সমবেদনা জানানো, ধৈর্যধারণ করতে বলা। হাদীস ও ফিকহের কিতাবে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। ‘তাজিয়া’র মূলকথা হল, মৃত ব্যক্তির শোকাতুর আত্মীয়দেরকে সবরের ফজিলত ও সওয়াব বর্ণনা করে সান্ত্বনা দেয় এবং মৃতের জন্য নাজাতের আর তার আত্মীয়-স্বজনের জন্য সবর ও সওয়াবের দোয়া করা। (বেহেশতী জেওর ২/২৩০, কুয়েত ফিকহি ইনসাইক্লুপেডিয়া)
হাদীস শরীফে মৃতব্যক্তির ‘তাজিয়া’ করার বিপুল সওয়াব ও মর্যাদার কথা বর্ণিত হয়েছে। এক হাদীসে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন যে,মুমিন ব্যক্তি কোন বিপদে তার ভাইকে সান্ত্বনা দিবে, আল্লাহ পাক কেয়ামতের দিন তাকে সম্মানের পোশাক পরাবেন। (ইবনে মাজাহ-১৬০১) অপর হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, কেউ যদি কোন বিপদগ্রস্ত লোককে সান্ত্বনা দেয় তাহলে সে বিপদগ্রস্ত ব্যক্তির অনুরূপ প্রতিদান পাবে। (তিরমিজি-১০৭৩,ইবনে মাজাহ-১৬০২)
নবীজির মেয়ে হজরত যাইনাব রাদিয়াল্লাহু আনহার সন্তান যখন মারা গেলেন, তিনি তাঁকে তাজিয়া বা সান্তনা জানিয়েছিলেন (বোখারী-৭৩৭৭)
এছাড়া অন্যান্য সাহাবীদের বিপদ-আপদে নবীজির পক্ষ থেকে তাজিয়া করার বর্ণনা পাওয়া যায়।
তাজিয়া করার হুকুম কী?
ইসলামের মহান ফকীহগণ তাজিয়ার বিধানাবলী ফিকহেরর কিতাবে বিশদভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন। সংক্ষেপে এ সম্পর্কিত কয়েকটি বিধান হচ্ছে–
১. মৃত ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজনকে তাজিয়া করা মুস্তাহাব।
২. তাজিয়ার সময় হল মৃত্যুর পর থেকে তিন দিন পর্যন্ত। তিন দিনের পরে তাজিয়া করা মাকরুহ। এর কারণ ব্যাখ্যা করে আল্লামা তাহতাবী (মৃত্যু:১২০২ হি.) লিখেছেন, তিন দিনের পর তাজিয়া করা দুঃখ ও শোক নতুন করে বাড়িয়ে দেয় যা তাজিয়ার উদ্দেশ্য পরিপন্থী। কেননা তাজিয়া করার উদ্দেশ্য হচ্ছে, মৃত ব্যক্তির আত্মীয়দেরকে সান্ত্বনা দেয়া, তাদের দুঃখ লাঘব করা এবং ধৈর্যধারণে উৎসাহিত করা। (হাশিয়া তাহতাবী-৬১৮) কুয়েত ফিকহী ইনসাইক্লোপিডিয়া অধিকাংশ ফকিহের উদ্ধৃতিতে লিখেছে, তিনদিন পর তাজিয়া করা মাকরুহ। কেননা তাজিয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে, বিপদ আক্রান্ত ব্যক্তির অন্তর প্রশান্ত করা। সাধারণত তিনদিন পর মানুষের অন্তর প্রশান্ত হয়ে থাকে। তাই এর পরে তাজিয়া করে শোককে আবার তাজা করবে না। তবে শোকগ্রস্ত ব্যক্তি কিংবা তাজিয়াকারী যদি অনুপস্থিত থাকে তাহলে তিনদিনের পরেও তাজিয়া করতে পারবে।
৩. একবারের পর দ্বিতীয় বার তাজিয়া করা উচিত নয়। (মারাকিল ফালাহ-৬১৯)
শিয়া সম্প্রদায়ের নিকট তাজিয়ার ধারণা:
হাদিস ও ফিকহের আলোকে আমরা তাজিয়ার হাকিকত তুলে ধরেছি। কিন্তু পাক-বাংলা-ভারতের শিয়া সম্প্রদায়ের নিকট তাজিয়ার মর্ম ও ধারণা এর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাদের নিকট তাজিয়া কী? সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান লিখেছেন- শিয়া সম্প্রদায় মহররম মাসের প্রথম দশ দিন কারবালার ঘটনা উপলক্ষে শোক পালন করে এবং আশুরা বা দশম দিনে যেদিন ইমাম হোসেন রাদিয়াল্লাহু আনহু শাহাদাত বরণ করেন, তার কবরের প্রতিকৃতি নিয়ে মিছিল করে। ইমাম হোসেনের প্রতিকৃতির নামই হলো হলো তাজিয়া। (যার যা ধর্ম-১৮০) তাজিয়ার উক্ত অর্থ বর্ণনা করার পর বাংলাপিডিয়া লিখেছে, বিশেষ অর্থে শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে শোকাবেগ সঞ্চারী অনুষ্ঠানকেও তাজিয়া বলা হয় হয়। এবং ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু এর শাহাদাত লাভের বিষাদময় স্মৃতির উদ্দেশ্যে তা পালিত হয়।
তাজিয়ার সূচনা:
হযরত হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর কবরের প্রতিকৃতি তৈরি এবং এটি বহন করে মিছিল করার প্রচলন উপমহাদেশের শিয়াদের আবিষ্কার। অতীতে ইরাক-ইরান বা অন্য কোথাও এই আচারটি শিয়াদের মধ্যে দেখা যায়নি। (ইবতালে আযারাদারী-মুহাদ্দিসে কাবীর হাবীবুর রহমান আজমী-১২, বাংলাপেডিয়া, সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ)
উপমহাদেশে কবে থেকে তাজিয়ার সূচনা হয়, এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। কোন কোন শিয়া লেখক দাবি করেছেন, “সম্ভবত” তৈমুর লং এর শাসনকালে কিছু শিয়া মন্ত্রী ও সৈনিক, যারা হিন্দুস্তানে অবস্থান করার কারণে কারবালায় যেতে পারত না, তাদের জন্য হযরত হুসাইন রা: এর কবরের প্রতিকৃতি তৈরি করা হয়েছিল। তারা সেই প্রতিকৃতি যেয়ারত করত। (ملخص مرقع كربلا شيعي এর সূত্রে হুরমতে তাজিয়া-মাও: মেহেরুদ্দিন-১৩)
কিন্তু এ দাবির পক্ষে তারা ঐতিহাসিক কোন দলীল পেশ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে অনেক শিয়া লেখকও দাবীটি প্রত্যাখ্যান করেছেন। (ইবতালে আযারাদারী-১২)
বরেণ্য মুহাদ্দিস আল্লামা হাবিবুর রহমান আজমী লিখেছেন, বাদশা আলমগীরের শাসনকালের(১৬৫৮-১৭০৭ খ্রি.)পূর্বে তাজিয়ার উল্লেখ কোথাও পাওয়া যায় না। তার সময়কালে শুধু একটি শব-প্রতিকৃতি (তাবুত) তৈরীর কথা পাওয়া যায়। একজন কট্টর শিয়া লেখক এটি উদ্ধৃত করেছেন। তবে তিনি শিয়া হয়েও এ কাজের কঠোর সমালোচনা করেছেন। তার ভাষ্যমতে, এটি নিম্নশ্রেণীর মানুষদের কাজ। তিনি আরো লিখেছেন, বাদশা আলমগীর এ অনর্থক কর্মটি বন্ধ করে দিয়েছিলেন। (প্রাগুক্ত-১৩)
যেসকল পর্যটক বিভিন্ন দেশ থেকে উপমহাদেশে আগমন করেছিলেন, তাদের সফরনামায় তাজিয়ার কোন প্রসংগ উল্লেখ করেননি। মুঘল আমলে অনেক ইউরোপীয় পর্যটক এখানে এসেছিলেন। তাদের সফরনামাগুলোও এ বিষয়ে সম্পূর্ণ নীরব। অনেক শিয়া লেখকও এটি স্বীকার করে থাকেন। (প্রাগুক্ত-১১)
এক্ষেত্রে সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ ও বাংলাপেডিয়ার বক্তব্যও অনুরূপ।
তাজিয়ার বিস্তার ও এতে সুন্নিদের অংশগ্রহণ:
একথা স্পষ্ট যে শিয়া সম্প্রদায়ের উৎপত্তির শত শত বছর পর তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোর সাথে ‘তাজিয়া’ সংযুক্ত হয়েছে। এবং তাদের মধ্যে এটি শুধু উপমহাদেশেই পালিত হয়। শুরুর দিকে শিয়াদের অনেকেই এতে অংশ গ্রহণ করত না। তারপরও উপমহাদেশে কিভাবে এই আচারটি বিস্তৃত ও প্রতিষ্ঠিত হল? যেখানে মুসলিমদের তুলনায় শিয়াদের সংখ্যা একেবারেই নগণ্য!
মূলত মুঘল বাদশাহ হুমায়ুনের (জন্ম ১৫০৮- মৃত্যু ১৫৫৬) আমলে ইরান থেকে শিয়া সম্প্রদায়ের অনেক লোক ভারতে আগমন করেছিল। তারা সে সময় রাষ্ট্রীয় অনেক সুযোগ সুবিধা ভোগ করতো। এমনকি বাদশা শাহজাহানের স্ত্রী নুরজাহানও ছিলেন শিয়া সম্প্রদায় ভুক্ত। একটা সময় এমন আসল, যখন দেখা গেল ভারতের অধিকাংশ রাজ্য শিয়াদের অধীনে। দাক্ষিণাত্য, গোলকুণ্ডা, বিজাপুর, আহমদনগর, মইসুর, সিন্ধ, অযোধ্যা। এবং বাংলার অনেক শাসকও শিয়া মতাবলম্বী ছিলেন। তারা মহররমের তাজিয়া সংস্কৃতি প্রচার ও প্রতিষ্ঠিত করার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। ফল স্বরুপ অনেক সুন্নি মুসলিমগণ, যারা ইতিপূর্বে কখনোই তাজিয়াতে অংশগ্রহণ করেননি, বরং একে শিয়াদের নিজস্ব অনুষ্ঠান হিসেবে গণ্য করতেন, কালের পরিবর্তনে একসময় তারাও এতে অংশগ্রহণ করা শুরু করেন। এর পেছনে শিয়া মতাবলম্বী শাসকদের পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ চাপ প্রয়োগ ক্রিয়াশীল ছিল। ঐতিহাসিক এ সত্যটি শিয়াদের অনেকে স্বীকার করেছেন। (ইবতালে আযারাদারী-১১-১২)
বাংলাদেশের তাজিয়ার সূচনা ও বিস্তার:
বাংলাদেশে শিয়াদের সংখ্যা সবসময়ই অতি সামান্য ছিল। কিন্তু উপমহাদেশের অন্যান্য রাজ্যের মত এ অঞ্চলেও দীর্ঘদিন পর্যন্ত শিয়া মতাবলম্বী ব্যক্তিগণ শাসন করেছেন। ফলে এদেশের মুসলিম সমাজে লক্ষণীয়ভাবে তাজিয়ার বিস্তার ও প্রচলন ঘটেছে। বাংলাপিডিয়া বলছে, “বাংলাদেশে মুগল আমলে বিশেষত শাহ সুজা (১৬৩৯-১৬৫৯) বাংলার সুবেদার থাকাকালে শিয়াদের প্রভাব বৃদ্ধি পায়। সম্ভবত তখনই এখানে তাজিয়া মিছিলের প্রচলন হয়। শাহ সুজার সময়ে সৈয়দ মীর মুরাদ ১০৫২ হিজরি সনে (১৬৪২ খ্রি.) ঢাকার ঐতিহাসিক হোসেনী দালান নির্মাণ করেন। ঢাকার নায়েব-নাজিমদের অধিকাংশ ছিলেন শিয়া। তাদের দ্বারা দেশের বিভিন্ন স্থানে ইমামবারা নির্মিত হয়। ঢাকা, মানিকগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, অষ্টগ্রাম, সৈয়দপুর, সিলেট ইত্যাদি স্থানে ইমামবারা আছে।”
কি কি থাকে তাজিয়া মিছিলে?
তাজিয়া মিছিলের বর্তমান চিত্র টি শুরু থেকে এমন ছিল না। প্রথমে হযরত হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর কবরের প্রতিকৃতি তৈরি করা হয়েছে। তারপর সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন সংস্কৃতি ও ধর্মের নানা অনুষঙ্গ। ফলে দেশী ও সংস্কৃতির ভিন্নতার কারণে তাজিয়ার চিত্রটি বিভিন্ন রূপ ধারণ করেছে। বাংলাদেশ তাজিয়া ও তাজিয়া মিছিলের বর্ণনা দিতে গিয়ে বাংলাপেডিয়া লিখেছে, “কাঠ, কাগজ, সোনা, রূপা, মারবেল পাথর ইত্যাদি দিয়ে তৈরি করা হযরত হুসায়ন (রা.)-এর সমাধির প্রতিকৃতি বহন করা হয়। মাতম, বুক চাপড়ানো ও জিঞ্জির দিয়ে পিঠের ওপর আঘাত করে রক্তাক্ত করা হয়। তাজিয়া মিছিলের অগ্রভাগে আলম বহনকারী বাহিনীর পেছনে থাকে বাদ্যকর; তৎপশ্চাতে কয়েকজন লোক লাঠি ঘোরাতে ঘোরাতে ও তরবারি চালাতে চালাতে অগ্রসর হয়। এ সময় দুটি শিবিকাসহ অশ্বারোহী সৈন্যের সাজে কয়েকজন লোক শোক প্রকাশ করতে করতে অগ্রসর হয় এবং তার পেছনে একদল গায়ক শোকগান গাইতে থাকে; পরে থাকে হুসায়ন (রা.)-এর সমাধির প্রতিকৃতি। এভাবে মিছিলটি নিয়ে লোকজন সম্মুখে অগ্রসর হয় এবং একটি পূর্ব নির্ধারিত স্থানে গিয়ে তা শেষ হয়।”
মিছিলে অংশগ্রহণকারী অধিকাংশ লোক কালো পোশাক পরিধান করেন। বুকে হাত চাপড়ে “হায় হোসেন! হায় হোসেন!!” বলে আহাজারি করেন। কেউ কেউ ধারালো অস্ত্র দ্বারা নিজের শরীরকে অস্ত্র ধারালো অস্ত্র দ্বারা নিজের শরীরকে রক্তাক্ত করে থাকেন। অনেকে কবরের প্রতিকৃতির উদ্দেশ্যে মানত করেন। কেউ আবার এর কাছে মনোবাসনা পূরণের প্রার্থনা করে থাকেন। কোন কোন অঞ্চলে তাজিয়া মিছিলে ঘোড়ার প্রতিকৃতি তৈরি করে মাজার বা কবরের নিকট রেখে দেয়ার প্রচলন রয়েছে। অনেক অঞ্চলে মিছিল শেষে কবরের প্রতিকৃতিটি পানিতে ভাসিয়ে দেয়া হয়।
তাজিয়া মিছিলে হিন্দুয়ানী সংস্কৃতির প্রভাব:
তাজিয়া মিছিলে বিভিন্ন সংস্কৃতি ও ধর্মের স্পষ্ট প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ অনুযায়ী, তাজিয়া মিছিলে যে পতাকা ও ক্ষমতাসূলভ দন্ড বহন করা হয়, যদিও এখন একে হযরত হুসাইন রা: এর কর্তিত হাতের প্রতীকরূপে ব্যাখ্যা করা হয়, বস্তুত এটি পৌরাণিক কাহিনীর চিহ্ন বা নমুনা বহন করে চলেছে। সমাধি প্রতিকৃতি পানিতে বিসর্জন প্রথাটি খুব সম্ভব শিয়া সম্প্রদায় হিন্দুদের দুর্গা দেবীর বিসর্জন রীতি থেকে গ্রহণ করেছে। এমনকি শোক প্রকাশের জন্য কালো পোশাক পরিধান আংশিকভাবে পুরাতন আচার দ্বারা প্রভাবিত।
শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে তাজিয়ার আপত্তিকর দিক:
বস্তুত তাজিয়া ও তাজিয়াকে কেন্দ্র করে আয়োজিত প্রায় প্রতিটি কর্ম ও আচরণ শরীয়তের দৃষ্টিতে আপত্তিজনক। কবরের প্রতিকৃতি বানানো, মাতম করা, শোক প্রকাশের জন্য কালো পোশাক পরিধান, শরীরে আঘাত করা, বাঁশি ও বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার, বিধর্মীদের সংস্কৃতি গ্রহণ, কবরের প্রতিকৃতির উদ্দেশ্যে মানত প্রভৃতি শরীয়তের সাথে চরম সাংঘর্ষিক। তাজিয়ার সূচনা লগ্ন থেকে বিজ্ঞ আলেমগণ মানুষকে এসব বিষয়ে সতর্ক করেছেন। এতে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ হওয়ার ফতোয়া দিয়েছেন।
তাজিয়া মিছিলে শরীয়তবিরোধী কিছু বিষয় আমরা পরবর্তী রচনায় বিশদভাবে আলোচনা করব, ইনশাআল্লাহ। সংক্ষেপে কয়েকটি দিক এখানে পত্রস্থ করা হচ্ছে।
১. তাজিয়া তৈরি করা এবং এর প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন:
- সিন্ধের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা হায়াত সিন্ধী আল মাদানী (১১৬৩ হি) লিখিত الركضة في ظهرالرافضة এ লিখেছেন, রাফেজীদের (শিয়া) একটি মন্দ কাজ হচ্ছে, তারা হযরত হুসাইন রা: এর কবরের প্রতিকৃতি তৈরি করে। অতঃপর একে সজ্জিত করে রাস্তায় রাস্তায় প্রদক্ষিণ করায়। এ সময় সবাই বলতে থাকে, ইয়া হুসাইন! ইয়া হুসাইন!! এ অনুষ্ঠানে তারা হারামভাবে অনেক সম্পদ অপচয় করে। এসব কিছুই বিদআত। (ইবতালে আযারাদারী-২৯)
– উপমহাদেশের প্রায় সকল শ্রেণির আলেমদের হাদিসের সনদ যে দুজন মহান মুহাদ্দিসের সাথে সংযুক্ত তারা হলেন, ইমাম শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী ও তাঁর ছেলে বিশিষ্ট ফকীহ ও মুহাদ্দিস আব্দুল আজিজ দেহলবী রহ:। শুধু উপমহাদেশই নয়, বর্তমান সময়ে পুরো পৃথিবীর বেশিরভাগ মুহাদ্দিসদের সনদে এ দুই মহান আলিমের স্থান রয়েছে শীর্ষে।
শাহ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিসে দেহলবী রহ; (১২৩৯ হি.) তাজিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত ফতোয়া প্রকাশ করেছেন। ফতোয়ায়ে আজিজিয়ায় তিনি লিখেছেন, “মহররমের তাজিয়া অনুষ্ঠান ও কবরের প্রতিকৃতি তৈরি করা নাজায়েজ।” “এমনিভাবে তাজিয়া কবরের প্রতিকৃতি ও পতাকা-নিশান বানানোও বিদাত।” (ইবাতালে আযারাদারী-৬৯) অপর ফতোয়ায় তিনি বলেন, কাঠ দিয়ে তারা যা তৈরী করে (অর্থাৎ কবরের প্রতিকৃতি), এটি জিয়ারত করার উপযুক্ত নয়। বরং একে ভেঙে ফেলা উচিত। যেমনটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, তোমাদের কেউ যখন শরীয়ত বিরোধী কোনো কাজ হতে দেখে কাজ হতে দেখে কোনো কাজ হতে দেখে কাজ হতে দেখে তাহলে সে যেন হাত দ্বারা তা রোধ করে। যদি এ সামর্থ্য তার না থাকে তাহলে কথার মাধ্যমে একে পরিবর্তন করবে। এক্ষেত্রে কেউ ব্যর্থ হলে অন্তর দিয়ে সে কাজকে ঘৃণা করা জরুরি। এবং এটি ঈমানের সর্বনিম্ন স্তর। সহি মুসলিম-৪৯। (প্রাগুক্ত ৭২)
– বরেণ্য ফকীহ ও মুহাদ্দিস আল্লামা আব্দুল হাই লাখনোভী রহ: (১৩০৪ হি.), বিভিন্ন শাস্ত্রে যার লিখিত কিতাবগুলো পুরো পৃথিবীতে সমানভাবে সমাদৃত, তাজিয়া সম্পর্কে বেশ কয়েকটি ফতোয়া দিয়েছেন। একটি ফতোয়ায় তিনি লিখেছেন, তাজিয়া অনুষ্ঠান, চাই মহররমের প্রথম দশকে হোক বা অন্য কোন সময়, কবরের প্রতিকৃতি নির্মান করা, নিশানা বানানো, দুলদুল বের করা এবং এ জাতীয় অন্যান্য সমস্ত কিছু বিদআত। ইসলামের প্রথম শতাব্দীতে এসবের অস্তিত্ব ছিল না। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতাব্দীতেও ছিলনা। এবং এই কাজের এমন কোন (শরয়ী) মূল ভিত্তি বা ‘আসল’ও নেই যে কারণে এগুলো গুনাহ-মুক্ত হবে। (প্রাগুক্ত-৭৮)
তাজিয়াকে হজরত হুসাইন রা: এর স্মৃতি স্মারক মনে করে অনেক মানুষ এর প্রতি বিশেষ ভক্তি, শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করে থাকেন। অথচ শরীয়তের বাইরে গিয়ে নিজের মন মত কিছু বানিয়ে তারপর এর প্রতি ভক্তি ও সম্মান দেখানো জঘন্য কাজ। (প্রাগুক্ত-৬৭) আরো স্পষ্ট করে আল্লামা লাখনোভী বিষয়টি এভাবে ব্যখ্যা করেছেন, “মনগড়া ও নিজের হাতের তৈরি কোন বস্তুকে সম্মান ও শ্রদ্ধার উপযুক্ত মনে করা মূর্তি পূজারীদের বৈশিষ্ট্য। এই কাজ দ্বীনের মধ্যে নতুন সংযোজন হিসেবে গণ্য হবে। উপরন্তু এটাকে গর্ব ও ও সওয়াবের কাজ মনে করা বড়ই অদ্ভুত ব্যাপার। কোন কাজে সওয়াব হয় আর কোন কাজের কারণে শাস্তি হয়, এটি মানুষের যুক্তি নির্ভর নয় বরং এবিষয়ে ফায়সালা করবে একমাত্র শরীয়ত। নিজ হাতে কাঠ দিয়ে গড়া প্রতিকৃতি ধ্বংস করার উপযুক্ত। (ফতোয়ায়ে লাখনোভী-৯০)
২. তাজিয়ায় ঘোড়ার প্রতিকৃতি:
তাজিয়া মিছিলে ঘোড়া গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুষঙ্গ। বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলে ঘোড়ার পরিবর্তে ঘোড়ার প্রতিকৃতি ব্যবহার করা হয়। তারপর মিছিল শেষে এই প্রতিকৃতিটি স্থানীয় কোন মাজারে রেখে দেয়া হয়।
অথচ কোন প্রাণীর প্রতিকৃতি তৈরি করা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। যারা এ কাজ করবে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘোষণা মাফিক তারা কেয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট সবচেয়ে নিকৃষ্ট সৃষ্টি হিসেবে গণ্য হবে। (বুখারী-৪১৭) এক হাদীসে নবীজি বলেছেন, কেয়ামতের দিন সবচেয়ে বেশি শাস্তি ভোগ করবে প্রতিকৃতি নির্মানকারীগণ। (মুসলিম-২১০৯) এমনকি যে ঘরে প্রতিকৃতি থাকে সেখানে রহমতের ফেরেশতা প্রবেশ করেন না। (বুখারী-৩০৮৮)
তাহলে যারা নিজেরা ঘোড়ার প্রতিকৃতি তৈরি করে, তারপর আবার সেটি মাজারে বা কবরের কাছে রাখে, তাদের এহেন কাজটি কতটা জঘন্য ও ও ধৃষ্টতাপূর্ণ, নবীজির হাদিস থেকে বিষয়টি খুবই স্পষ্ট। আল্লাহ পাক আমাদের রক্ষা করুন।
৩. তাজিয়ার উদ্দেশ্যে মানত করা, মনোবাসনা পূরণের প্রার্থনা করা ও শিরনি দেয়া:
তাজিয়ায় চর্চিত এই কাজগুলো শরীয়তের দৃষ্টিতে কতটা মারাত্মক ও ভয়ানক, বিষয়টি কোরআন ও হাদিস সম্পর্কে সামান্য জ্ঞান রাখেন এমন ব্যক্তিদের কাছে অস্পষ্ট নয়। বিষয়টি সহজে অনুধাবন করার জন্য নিম্নে আমরা বরেণ্য কয়েকজন ফকীহের ফতোয়া তুলে ধরছি।
– ১২৯৩ হিজরী সনে বিহারের প্রখ্যাত আলেম মাওলানা শহুদুল হক বিহারীর কাছে ফতোয়া জানতে চাওয়া হয়েছিল– “হযরত হুসাইন রাঃ এর নৈকট্য অর্জন ও তার প্রার্থনার জন্য তাজিয়ার উপর যে খাবার ছড়িয়ে দেয়া হয় তার বিধান কী?” উত্তরে তিনি লিখেছেন, “এই খাবার গ্রহণ করা হারাম। কেননা এটি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো জন্য মানত করা হয়েছে। আর এমন খাবার হারাম। এবং এ কাজটিও হারাম। বরং এটি শিরক ও কুফুরি।”
সে কালের বরেণ্য মুফতী ও আলেমগণ এই ফতোয়ায় দস্তখত করেছেন। যাদের মধ্যে মুফতি সাদ উল্লাহ উল্লাহ ও মাওলানা ইরশাদ হোসেন রামপুরীর নাম উল্লেখযোগ্য। এ ফতোয়াটি ১৩০১ সনে আজিমাবাদের মাকতাবায়ে কায়সারি থেকে প্রকাশিত হয়েছিল।
– এ বিষয়ে আল্লামা আব্দুল হাই লাখনোভী রহমতুল্লাহি আলাইহির ফতোয়াও অনুরূপ। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি লিখেছেন, সদকার নিয়ত না করে নৈকট্য ও খোশামোদ-তোষামোদের উদ্দেশ্যে যদি খাবার রাখা হয়, তাহলে খাবারটি হারাম হবে। আর সদকার নিয়তে রাখলেও এটি মাকরুহ মুক্ত হবে না। (ইবতালে আযারাদারী-৭৯)
তাজিয়ার নিকট মনোবাসনা পূরণের জন্য প্রার্থনা করা প্রসঙ্গে তিনি ফতোয়া দিয়েছেন, এভাবে প্রার্থনা করা বৈধ নয়। কেননা এটি না শুনতে পারে, না দেখতে পারে, এটি তোমাদের কোন উপকারও করতে সক্ষম নয়। বরং কেউ যদি তাজিয়াকে স্বতন্ত্র প্রয়োজন পূরণকারী বলে বিশ্বাস করে তাহলে কাফের হয়ে যাবে। (ফাতাওয়ায়ে লাখনোভী-৯২)
শুধু দেখার জন্য তাজিয়ায় যাওয়ার হুকুম:
আল্লামা লাখনোভীকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ভক্তি ও বিশ্বাস না রেখে শুধু মানুষের কর্মকাণ্ড দেখার উদ্দেশ্যে তাজিয়ায় যাওয়া কি জায়েয?
উত্তরে তিনি লিখেছেন, তাজিয়ায় দেখার কিছু নেই। কোন বেদাত কাজ না দেখা কর্তব্য। বরং প্রতিটি বেদাতকে প্রথমে হাত দ্বারা, সম্ভব না হলে জবান দ্বারা রোধ করা জরুরী। তৃতীয় স্তর হল, অন্তর দিয়ে কর্মটিকে ঘৃণা করা। এটি ঈমানের সবচে ক্ষুদ্র ফলাফল। (ফতোয়ায়ে লাখনোভী-৯২)
হজরত আব্দুল আজীজ মুহাদ্দিসে দেহলভী রহ:ও একই ফতোয়া দিয়েছেন। (ইবতালে আযারাদারী-৭০)
তাজিয়া বিষয়ে বেরলভী রেজভী আলেমদের কী বক্তব্য?
উপমহাদেশের নিকট অতীতের ইতিহাস সম্পর্কে অবগত ব্যক্তি মাত্রই জানেন, ধুরন্ধর বৃটিশরা “ওহাবী” শব্দটি নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য আমদানি করেছিল। পরবর্তীতে যে আলেমগণই কোরআন ও হাদিসের বিশুদ্ধ শিক্ষার প্রতি মানুষকে আহ্বান করেছেন, সাধারণ মানুষকে তাদের থেকে দূরে রাখার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন মহল তাদের উপর “ওহাবী” শব্দটি আরোপ করতে থাকে। শিয়া সম্প্রদায়ও নিজেদের স্বার্থে শব্দটি ব্যবহার করেছে। আহলে হক উলামায়ে কেরাম কোরআন ও হাদিসের আলোকে যখন তাজিয়া মিছিল ও মাতমের অসারতা মানুষকে বুঝাচ্ছেন, তখন শিয়ারা সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য সেই আলেমদেরকে “ওহাবী” বলে অপপ্রচার শুরু করেছিল। দূর্ভাগ্যবশত সরলমনা মুসলিমদের একটি বিরাট অংশ তাদের প্রোপাগান্ডার শিকার হয়েছেন। ফলে শিয়া না হয়েও তাজিয়া ও মাতমকে তারা পরমভাবে গ্রহণ করেছেন এবং এখনও আঁকড়ে আছেন। আর তাদের অধিকাংশই হচ্ছেন এমন যারা নিজেদেরকে বেরলবী বা রেজভী হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন। এবং মাওলানা আহমদ রেজা খান বেরেলবী সাহেবকে নিজেদের “আলা হযরত” মানেন।
তাজিয়ার ক্ষেত্রে তাদের শান্তভাবে চিন্তা করা উচিত, এক্ষেত্রে তারা তাদের বরেণ্য আলেমদের সিদ্ধান্তকে গ্রহণ করবেন, নাকি শিয়াদের বিভ্রান্তির পেছনে ছুটে চলবেন!
তাজিয়া ও মাতম সম্পর্কে মাওলানা আহমদ রেজা খান বেরলবী সাহেবের বক্তব্য ও ফতোয়া হচ্ছে, শিয়াদের প্রচলিত তাজিয়া ও মাতম বেদাত, নাজায়েয, হারাম। এবিষয়ে অন্যান্য রেজভী আলেমদের ফতোয়াও অনুরূপ। তাজিয়া ও মাতম করা অবৈধ প্রমাণ করে তারা বহু পুস্তক ও রিসালা রচনা করেছেন। খোদ বেরলবী সাহেবও এসম্পর্কে ‘রিসালা তাযিয়াদারী’ নামে স্বতন্ত্র একটি পুস্তিকা লিখেছেন।
ইরফানে শরীয়ত কিতাবে তিনি লিখেছেন, তাজিয়া আসতে দেখলে সেদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে। তাজিয়ার দিকে না তাকানোই কর্তব্য। (১/১৫)
রিসালা তাযিয়াদারীতে তাজিয়া ও তাজিয়া সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কর্ম সম্পর্কে তিনি লিখেন, উল্লেখিত কাজগুলো যেভাবে সাধারণ মানুষের মাঝে প্রচলিত রয়েছে,সেগুলো নিন্দনীয় বিদাত, ও নাজায়েয। এসব কাজকে সওয়াব মনে করা বা শরীয়ত ও আহলে সুন্নতের মাজহাবের সাথে সংগতিপূর্ণ জ্ঞান করা এরচেও ভয়াবহ। এসব হল ভুল আকীদা এবং ভয়ংকর মূর্খতা। (তাযিয়াদারী-১৫)
প্রসিদ্ধ বেরলবী আলিম মুহাম্মদ ইরফান সাহেব রেজভীর ফতোয়া হল, তাজিয়া তৈরী করা, এতে ফুল ছিটানো সহ অন্যান্য কাজগুলো নাজায়েয ও হারাম। (ইরফানে হেদায়েত-৯)
মৌলবী মুহাম্মদ মুস্তফা রেজাখানী বেরেলবী সাহেবের বক্তব্যও অনুরূপ। দেখুন রিসালা মুহররম ও তাযিয়াদারী, পৃষ্ঠা ৬০।