মানুষ তার নানাবিধ সীমানার মধ্যে বাস করে। এই সীমানা বস্তুগত পরিধি প্রকাশক নয়, ব্যক্তিত্বের গভীরতা প্রকাশক অনুভবজাত। ধরা যাক, আমি রাগ হজম করতে পারি, কিন্তু কতটুকু? একটা পর্যায়ে গিয়ে আমি বিক্ষুব্ধ হই এবং তা প্রকাশ করি। যেখানে গিয়ে আমি আমার বিক্ষুব্ধতাসহ প্রকাশিত হলাম, সেটি হলো আমার সহ্য ও নিরবতার সমাপ্তি। আমার চরিত্র ও আচরণের সকল পঙ্কিলতা ও সুকুমারবৃত্তির এমন একটি করে সীমানা রয়েছে, যার পরে আমি আর যেতে পারি না।
.
আমার ব্যক্তিগত উপলব্ধি : একটা মানুষের চরিত্র ও ব্যক্তিত্বের সৌন্দর্য হলো এই সীমানগুলোকে লোকচক্ষুর অন্তরালে লুকিয়ে অজ্ঞাত করে রাখা। তখন আমার ব্যক্তিত্ব গভীরতর হবে এবং আমাকে ভালোবেসে কুলিয়ে উঠতে না পারার অতৃপ্তিতে মানুষ দিশেহারা বোধ করবে। কারণ, ভালোবাসা মূলত এমনই–এটা হৃদয়ের ভেতরে অতৃপ্তির যাতনা তৈরী করে এবং বুকের ভিতরে এমন এক তৃষ্ণাকে জাগিয়ে তোলে, যা কখনো নিবারিত হবার নয়। ফলে, একজন প্রেমিক সর্বদাই একজন অস্থির অনুসন্ধানি। হৃদয় দিয়ে সে এমন একটা কিছুর অনুসন্ধান করে, যার মাধ্যমে সে নিজের অসীম তৃষ্ণাটিকে নিবারণ করতে পারে।
কিন্তু সত্য এই যে, তা কখনোই লাভ করবার নয়; যেমনটি কাব্যে ও শিল্পে আমরা চূড়ান্ত একটি সৌন্দর্যকে তালাশ করে ফিরি, জীবনভর এবং মধুর এক ব্যর্থতাকে উপলব্ধি করি নানা শব্দ ও রেখায়। ফলে, সত্যিকারের কবি ও প্রেমিক মানেই উন্মত্ত ও অস্থির, অতৃপ্ত ও যন্ত্রণাবিদ্ধ।
কারো প্রতি অনুরক্ত হবার পর আমার এই যন্ত্রণার উপলব্ধিটিই হলো আমার অনিঃশেষ আনন্দ, যাকে আমরা পাত্র ও পরিস্থিতিভেদে প্রেম, ভালোবাসা, স্নেহ, মমতা, ভক্তি ইত্যাদি শব্দ দিয়ে ব্যক্ত করি।
.
আমি যদি আমার চরিত্র, আচরণ ও ব্যক্তিত্বের এই সীমানাগুলোকে লুকিয়ে ফেলতে পারি, তাহলে চারপাশের মানুষ আমার প্রতি স্নেহ, ভক্তি ও ভালোবাসায় অস্থির হয়ে উঠবে, এবং বলবে : লোকটা অসম্ভব ভালো মানুষ। তারা ‘অসম্ভব’ বলছে, কারণ, তারা আমার সীমানাগুলোকে খুঁজে পাচ্ছে না।
এই যে সীমানুগলোকে লুকিয়ে রাখা, এটা মানুষ আমাকে ভালোবাসুক–এই উদ্দেশ্যে নয়; বরং এই উদ্দেশ্যে যে, আমি যেন সুন্দর একটি জীবন-অনুশীলনে ব্যপৃত হই এবং আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি লাভ করতে পারি।
.
আমরা যখন কারো সাথে সামান্যরূপে সংযুক্ত থাকি এবং দূর থেকে তাকে একটু করে অবলোকন করি, তখন তার সীমানাসমূহ আমাদের সামনে প্রকাশিত হওয়ার সুযোগগুলো কমে আসে। এ জন্য স্বল্পপরিচিত কারো ব্যাপারে ভালোমন্দ মন্তব্য করা মুশকিল এবং বিশেষত এই ভার্চুয়াল যোগাযোগে কারো ব্যপারে সিদ্ধান্তে আসা অসংগত।
কারণ, আমরা তাকে ততটুকুই দেখি, যতটুকু সে আমার সামনে নিজেকে প্রকাশ করে। একদমই কোনরূপ ধারণা লাভ করা যায় না, তা বলছি না; বলছি যে, তা সম্পূর্ণ নয়। কাউকে আমি কতটুকু চিনতে পারলাম, তা নির্ভর করে তার সাথে আমি কতটুকু সময় যাপন করলাম তার উপর। এ জন্য সহবাস ও সহযাত্রা হলো কাউকে অপেক্ষাকৃত যথার্থরূপে চেনার অবিকল্প মাধ্যম, সর্বকালেই।
.
আমার ভেতরেও এইমত নানাবিধ সীমানা রয়েছে–বোধ করি একে সীমাবদ্ধতা শব্দ দিয়ে ব্যক্ত করাই ভালো, এবং মাঝে মাঝে এগুলোর দিকে নিরব তাকিয়ে থাকি। জীবনপথে চলতে গিয়ে কখনো যখন নিজের কাছে নিজের একটি সীমানা উন্মোচিত হয়ে পড়ে, তখন প্রবল এক যন্ত্রবোধে আক্রান্ত হই। শুধু মনে হয়–আমার চরিত্রের এই দিকটির এই হলো সমাপ্তি – এরপরে আর যেতে পারছি না এবং আমি এতটুকু ক্ষুদ্র!
কিন্তু দুঃখজনক সত্য হলো এই যে, নীরবতার মাধ্যমে এবং নানাবিধ কৌশলে নিজের জ্ঞানের সীমানাটিকে মানুষ থেকে আড়াল করে নিজেকে একটা জ্ঞান-সম্ভব অনিশ্চয়তায় উপস্থিত করা সহজ হলেও, চরিত্র ও আচরণের সীমানগুলোকে তা করা অনেক কঠিন।
.
উদাহরণ হিসেবে একটা ঘটনা বলি। সেদিন রাতে আমি শহরে যাচ্ছিলাম। অটোরিকসার পেছনে একা বসে সানাউল্লাহ ভায়ের সাথে গল্প করছি। ঠিক গল্প না আসলে; গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় নিয়ে পরামর্শমূলক আলোচনা। একটু পর মধ্যবয়স্ক এক ভদ্রলোক উঠে আমার পাশটিতে বসলেন। আমি একপাশে চেপে গুছিয়ে বসেছিলাম, ফলে তার দিকটিতে প্রচুর জায়গা খালি রয়েছে। কিন্তু আমার অজান্তে আমার কোলে থাকা কাপড়ের ব্যগটির একটু অংশ তার শরীরে লেগে রয়েছিলো। সামান্য সময় পরে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে ধমক দিয়ে বললেন : ‘আরে, এটা সরান না! দেশের পরিস্থিতি এখন ভালো না’। আমি অন্য দিকে তাকিয়ে কথা বলছিলাম। তার রাগত কন্ঠ শুনে ভীত হয়ে তাকালাম, এরপর মাফ চেয়ে নিয়ে ব্যাগটা সরিয়ে আনলাম।
কিন্তু ওই যে সীমানার কথা বলেছি! আমার এমন একটি সীমানা হলো, আমি মানুষের অভদ্র ব্যবহার ও অহংকারের কোনরূপ প্রদর্শন মেনে নিতে পারি না, যদিও আমার নিজের মধ্যে এ দুটো আছে। ফলে, তার এই অভদ্র আচরণের কারণে ক্ষোভে ও দুঃখে আমার চিত্ত উতলা হয়ে উঠেছিল। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল বলি : ব্যাগ শরীরে লেগে থাকাটা অস্বাভবিক নয়। পাশাপাশি বসলে লাগতেই পারে। আপনি তো ব্যথা পাননি। সহজ করে বলতে পারতেন।
আবার মনে হচ্ছিল, এটা এমন একটি ঘটনা, যা অতিক্রান্ত হয়ে গেছে এবং নতুন করে এ নিয়ে কথা বলার মত বৃহৎ কিছু নয়। কিন্তু আমি ভুলতে পারছিলাম না। এক পর্যায়ে ড্রাইভারকে বললাম : ভাই, গাড়িটা একটু থামান তো! এরপর লোকটার পাশ থেকে উঠে সামনে ড্রাইভারেরর পাশে এসে বসলাম। এতে আমার খুব আনন্দ হলো। মনে হলো, লোকটাকে যথেষ্ট অপমান করা গেল এবং খুবই ভালো একটা প্রতুত্তর হলো। সামনে এসে বসার পরও বেশ কিছু সময় পর্যন্ত এটা আমার ভেতরে দাগ কেটে যাচ্ছিল। এক সময় মনে হলো, আমি কত ক্ষুদ্র! কত সামান্য একটি বিষয় আমাকে বিচলিত ও ব্যস্ত করে ফেলেছে, এবং একজন মানুষকে শত্রুর মত জ্ঞান করতে শুরু করেছি। এখন এটা নিয়ে ভাবছি ও এর পেছনে সময় খরচ করছি। মনে হলো, পথে চলতে গিয়ে ছোট্ট একটি পাথরে হোঁচট খেলাম, এরপর যাত্রা থামিয়ে দিয়ে এর পেছনে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। কি বোকা!
সহনশীলতা সংক্রান্ত নিজের ভেতরের এই সীমানা অবলোকনে তখন আমি খুবই দুঃখিত হলাম এবং সাথে সাথে পুরো বিষয়টি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললাম। এরপর মনে হলো, আমি কত ভালো! কী সুন্দর একটা উপলব্ধি মাথায় এলো, আর সাথে সাথে তা বাস্তবায়ন করে ফেললাম। তখন মনে এলো, এই দ্বিতীয় চিন্তাটি হলো আরেকটা সীমানা, যাকে আমি এইমাত্র দেখে ফেললাম!
মুগ্ধ আলোচন।
আপনার এ লেখা পড়ে সমরেশ মজুমদারের একটা কথা মনে পড়ে গেল।
রাস্তায় হাঁটতে গিতে শুধু সবুজ ঘাস পাবে এমন কথা নেই। পাথরের টুকরো কাচের কুচিও পড়ে।
সেগুলো কে অবহেলায় এড়িয়ে যেতে হয়।
~ সমরেশ মজুমদার