إِنَّ هَذَا العِلْمَ دِيْنٌ؛ فَانْظُرُواْ عَمَّنْ تَأخُذُوْنَ دِيْنَكُمْ
প্রখ্যাত তাবেঈ মুহাম্মদ ইবন সিরীনের একটি মহামূল্যবান বাণী দিয়ে শুরু করা যাক- ‘নিশ্চয়ই এই জ্ঞানই (যাবতীয় ইসলামই জ্ঞান) দ্বীন। সুতরাং কার কাছ থেক তা গ্রহণ করছ সে ব্যাপারে সতর্ক থাকো।’
হার্ভার্ডে আমার পড়াশোনার শেষদিকে আমি ইসলামি পড়াশোনার দিকে বেশ ভাল ভাবে মনোনিবেশ করি। এ বিষয়ে ডিগ্রি পাওয়ার মত প্রায় পর্যাপ্ত সংখ্যক কোর্স আমার করা হয়ে যায়। বাবর জোহানসনের মত প্রাচ্যবাদী থেকে লায়লা আহমেদের মত এডওয়ার্ড সাইদপন্থি বি-উপনিবেশবাদী তাত্ত্বিক ও অধ্যাপক,যারা সেসময় হার্ভার্ডে ছিলেন, তাদের বেশিরভাগের সাথেই মতবিনিময় করা বা তাদের ক্লাস করার সুযোগ আমার হয়েছিল।
সমস্যাটা হয়েছিলো যে, আমার তা ভাল লাগতোনা। অধ্যাপক হোক বা সেখানকার ছাত্র, কারও সাথেই আমার খাপ খাচ্ছিলোনা। অবস্থাটা কেমন দাঁড়িয়েছিলো তা বোঝার জন্যে একটা ঘটনা বলাই যথেষ্ট-আমি একবার লায়লা আহমেদের মুখের উপর বলে দিয়েছিলাম যে, ইসলাম সম্পর্কে তার ধ্যান ধারণা আদৌ মুসলিমদের কোন উপকারে আসছেনা যেমনটা তিনি মনে করছিলেন। বরং সেগুলো স্রেফ পাশ্চাত্য উগ্র জাতীয়তাবাদের মত করে মুসলিম সমাজে প্রভাব ফেলছিল। স্বভাবতই এ ধরণের কথা মোটেও তার মনঃপুত হয়নি।
ভয়ংকর অবস্থার ভেতরেঃ
আমার এ মতবিরোধের মূল কারণ ছিল যে, আমি একই সময়ে বোস্টনে বেশ কয়েকজন আলেমের কাছে প্রথাগত পদ্ধতিতেও দীন বিষয়ে পড়াশোনা করছিলাম। আর দুটো পদ্ধতিতে,তথা ইসলামের ঐতিহ্যবাহি শিক্ষা পদ্ধতী এবং পশ্চিমা শিক্ষাপদ্ধতির মাঝে পার্থক্য ছিল দিবালোকের মত পরিষ্কার।
পশ্চিমা একাডেমিয়ায় ইসলাম নিয়ে পড়াশোনা বেশ কিছু মৌলিক ধারণা উপর প্রতিষ্ঠিত। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটা হলো :
এক- পাশ্চাত্য পুঁথিগত বিদ্যার শাখা হিসেবে ইসলামি পড়াশোনা একেবারেই বস্তুগত ধরনের। অথবা বলা যায় (যদি এখানে বস্তুগত শব্দটাকে একেবারেই সংক্ষেপিত বলে মনে হয়) এখানে ইসলামি পড়াশোনা আসলে ইসলামি রীতিনীতিকে ছাপিয়ে যায়। কারণ একে স্রেফ পড়াশোনার একটা বিষয় হিসেবে দেখলে তাকে ব্যবচ্ছেদ করা যায়, পর্যবেক্ষণ করা যায়, এমনকি এর ব্যাপারে আপত্তিও তোলা যায়। আর প্রথাগত, প্রচলিত দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে তা একটা জ্ঞানতাত্ত্বিক ভিত্তি থেকে আসে।
দুই- আবার, ইসলাম ও তার চর্চাকে এখানে দেখা হয় মানবসৃষ্ট কিছু নিয়মের সমষ্টি হিসেবে। তবে এর জন্য ”আল্লাহ আসলে কুরআন নাযিল করেননি” ধরনের শক্ত ও নজরকাড়া দাবি করার প্রয়োজন নেই। প্রাতিষ্ঠানিক ইসলাম শিক্ষা আসলে এ ব্যাপারে অজ্ঞেয়বাদী ধারণা পোষণ করে। পড়াশোনার এ শাখাতে বিশ্বাসী মুসলিমই শুধু নয়, অনেক খ্রিস্টান, ইহুদি, নাস্তিকেরাও আছে। তাদের মাঝে যা নিয়ে সংশয় নেই,বরং বিনা বাক্যব্যয়ে, আপোসহীনতার সাথে সকলে যে বিষয়টি মেনে নিয়েছে তা হচ্ছে-প্রথাগত ইসলাম হিসেবে যা আগে সর্বজনবিদিত ছিল এবং এখনও আছে মূলত স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে বানানো কুরআনের ব্যাখ্যা নিয়ে পুরুষজাতির নিজেদের মাঝে করা রেষারেষি মাত্র। অন্যভাবে বলা যায়, ইসলাম আসলে অসম্ভব রকমের দলান্ধতাপূর্ণ। অর্থাৎ চিরাচরিত মূলধারার ইসলাম আসলে গোঁড়া ও দলান্ধ কিছু দলের নিজেদের মাঝে বিবাদ বৈ কিছু নয়।
পশ্চিমা প্রাতিষ্ঠানিক ইসলামি পড়াশোনার একদম গভীরে মূলত এই দুইটি ধারণা একদম গেঁথে আছে। আর এ ধারণা দুটো যে বিশ্বসাসের জন্ম দেয় তা হলো, এই একাডেমিক পদ্ধতিতে চিন্তা করা, বা প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানতত্ত্বই আসলে তুলনামূলকভাবে ভালো,এবং শ্রেষ্ঠ। তাই যদি না হয় তাহলে একজন কেনই বা মসজিদ বা মাদ্রাসা বাদ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলাম নিয়ে পড়াশোনা করতে যাবে? প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিকোণ থেকে, মসজিদ বা মাদ্রাসায় যে ইসলাম শেখা যাবে তা হলো স্রেফ মানবরচিত, দলান্ধ আর সাম্প্রদায়িকতাপূর্ণ ইসলাম যা কিনা শিক্ষার্থীর জ্ঞানতৃষ্ণা আর প্রাতিষ্ঠানিক বুঝাপড়া কে থোড়াই কেয়ার করে। শিক্ষার্থীকে এসব দলান্ধতাকে সরিয়ে রেখে মুক্তভাবে চিন্তা করতে হবে।
করালগ্রাস
ইদানিং আমরা দেখতে পাই যে এসব প্রাতিষ্ঠানিক মৌলিক ধারণা গুলো বেশ কিছু “তথাকথিত মূলধারা”র ঝান্ডাধারী ইসলামি ব্যক্তিত্বে আর প্রতিষ্ঠান দ্বারা বেশ ভাল ভাবেই চর্চিত হয়। আমি নিশ্চিত আপনারাও তা লক্ষ্য করেছেন।
উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, কিছু নামধারী মূলধারার ইসলাম চর্চাকারী নিচের কথা গুলো প্রায়ই আওড়ান :
-ফিকহ আসলে আল্লাহ প্রদত্ত অবোধগম্য শরীয়তের একটা মানবরচিত, মনগড়া ব্যাখ্যা, যা কিনা ভ্রমযোগ্য মানবচিন্তাধারা দিয়ে শুধু অনুমান করা সম্ভব।
-আকিদার চিন্তাধারা গুলো আসলে ধর্মান্ধ কিছু দলের একের অপরের উপর নিজেদের মনগড়া ব্যাখ্যা চাপিয়ে দেয়ার প্রয়াস ছাড়া কিছু নয়।
-শরীয়ত নিয়ে সালাফদের ব্যাখ্যা আসলে তাদের সীমাবদ্ধ জ্ঞান ও দৃষ্টিভঙ্গির উপর ভিত্তি করে দেওয়া ছিল। এখন যেহেতু আমাদের কাছে শরীয়তের নুসুসের উপর আরো বড় পরিসরে গবেষণার সুযোগ আছে তাই আমরা সালাফদের করা সেসব ব্যখ্যা পরিমার্জনা করতে পারি।
এসব বক্তব্য থেকে সূক্ষ কিন্তু মারাত্মক প্রাতিষ্ঠানিক আধুনিকতার স্বরূপ বোঝা যাচ্ছে।
আশা করি পরের কথাগুলো আরো পরিষ্কার ধারণা তুলে ধরবে।
ইসলামি চিন্তাধারা বা মাযহাব গুলো কখনোই নিজেদেরকে ব্যক্তিগত মনগড়া শারঈ বা আকিদার ব্যাখ্যাদাতা হিসেবে গণ্য করেনি। ইমাম আবু হানিফা কখনই ভাবেননি যে তিনি হানাফি মাযহাব তৈরীর জন্যে কাজ করছেন। ইমাম আহমাদ কখনোই ভাবেননি যে তিনি হানবালি আকিদা তৈরীর জন্যে কাজ করছেন। ইমাম আত-ত্বহাবী কখনই ভাবেননি যে তিনি আকিদার বিষয়ে তার ব্যক্তিগত ধারণা লিখছেন বা অন্যদের তা শেখাচ্ছেন।
তারা সবাই নিজেদেরকে আসল শরীয়াহর প্রকাশকারী হিসেবে ভেবেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আকিদার প্রকাশক হিসেবে ভেবেছেন। তারা নিজেদের কাজকে সত্যের প্রকাশকারী হিসেবে দেখেছেন।
তারা অবশ্যই নিজেদেরকে ভুলভ্রান্তির ঊর্ধে মনে করতেন না! এখানেই গুঢ় তত্ত্বটা লুকিয়ে আছে। তারা জানতেন যে তারা ভুলও হতে পারেন। তবে তারা বিশ্বাস করতেন যে তারা ঠিক।
অন্যকথায় বললে, নিচের দুটো ধারণার মাঝে পার্থক্য সুস্পষ্ট :
এক- এটা মেনে নেওয়া যে, আকিদা ও ফিকহের ব্যাপারে তাদের অবস্থান ভুল হতে পারে। কিন্তু অবশ্যই একটা চরম সত্য কোথাও নিহিত আছে, সালাফরা যার দিকে ধাবিত হয়ে তাকে বুঝে তা প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন।
দুই- এটা মনে করা যে, ফিকহ ও আকিদা আসলে মনগড়া ব্যাখ্যা। আর এ বিষয়ক যেকোনো একটি মতামতকে অন্যগুলোর উপর প্রাধান্য দেওয়া আসলে দলান্ধতা।
অযৌক্তিক চিন্তাধারা
যদিও প্রাতিষ্ঠানিক আর “তথাকথিত মূলধারা”র চিন্তাধারা আসলে দুটো ভিন্ন রাস্তায় হাঁটে, কিন্তু আপনি এখন দেখবেন তারা আসলে কিভাবে একই বিন্দুতে এসে মিলে যায়।
পশ্চিমা প্রাতিষ্ঠানিকদের সব বক্তব্যের শেষকথা হচ্ছে, ইসলামকে বুঝতে হলে আমাদেরকে সালাফদের চিন্তাধারার বাইরে গিয়ে চিন্তা করতে হবে। কারণ, এই ধারাটি আসলে কিছু মধ্যযুগীয় গোঁড়া পুরুষের তাদের সপ্তম ঈসায়ী শতাব্দীর ধর্মীয় পুস্তকের পেছনে পড়ে থাকা বৈ কিছু নয়।
“তথাকথিত মূলধারার ঝান্ডাধারী”দের সব বক্তব্যের শেষকথা হচ্ছে, ইসলামকে বুঝতে হলে আমাদেরকে সালাফদের চিন্তাধারা থেকে সরে আসতে হবে কারণ সে চিন্তাধারা ছিল দলান্ধতাপূর্ণ। সে ধারায় প্রত্যেকেই ভাবতো তার কর্মই আসলে চিরন্তন চরম সত্যের ধারক ও বাহক। (কিছু “তথাকথিত মূলধারা”র লোক তো এ ব্যাপারে আরো সরাসরি বলে বসেন যে, তারা সালাফগণের চিন্তাধারাকে কানাকড়ি মূল্য দিতেও রাজি নন কারণ সকল সালাফগণ ক, খ, গ বিষয়ে ভুল ছিলেন। যেমন দাসত্ব বা নারী বিষয়ক দিকগুলোতে।)
প্রকৃতপক্ষে প্রাতিষ্ঠানিক ঝান্ডাধারী আর তথাকথিত ট্রেডিশনালিস্টরা আসলে বুদ্ধিগতভাবে একই ভুলের মধ্যে নিমজ্জিত আছেন। তারা নিজেদেরকে সকল সমালোচনার ঊর্ধ্ব তুলে এমন উচ্চপর্যায়ে ভাবা শুরু করে যা তাদেরকে সালাফদের “গোঁড়া, দলান্ধ, মনগড়া” ব্যাখ্যার মূল্যায়ন করার সার্টিফিকেট দিয়ে দেয়।
কিন্তু সত্য কথা হলো, বাস্তবে তাদের অবস্থান বস্তুনিরপেক্ষ তো নয়ই, স্রেফ এর উল্টো। এরা আসলে প্রচন্ডরকম পক্ষপাতদুষ্ট, আর সালাফগণের চিন্তাধারা নিয়ে তাদের গবেষণা খুবই ভাসা ভাসা, যাকে মূল্যহীনও বলা চলে। এরা সালাফগণকে পক্ষপাতদুষ্ট আর দলান্ধ বলে মনে করে অথচ তাঁরা কিনা সূক্ষাতিসূক্ষ জ্ঞানভিত্তিক পক্ষপাতিত্ব থেকেও যথাসম্ভব দূরে থাকার চেষ্টা করতেন। কিভাবে? একেবারে ক্ষুদ্র পর্যায় পর্যন্ত নিজেদের অবস্থানের নিরপেক্ষতা যাচাই করে। এমনকি একেবারে ব্যকরণগত পর্যায় পর্যন্ত। যে যুক্তি দিয়ে ক বিষয়ে অবস্থান নেওয়া হয়েছে সেই একই যুক্তির নিরিখে খ বিষয়ে অবস্থান কি সামঞ্জস্যপূর্ণ? ফিকহের বিষয়ে যেন এ ধরনের যুক্তিসিদ্ধ অবস্থান বজায় থাকে আর স্ববিরোধীতার লেশমাত্র যেন না থাকে তাই এই সম্পূর্ণ পন্থাটি আলাদা একটি পাঠ্য বিষয় হিসেবেই রূপ দেওয়া হয় যার নাম হয় উসুলে ফিকহ। উসুলের প্রয়োগ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে সহায়তা করে।
অন্যদিকে প্রাতিষ্ঠানিক ঝান্ডাধারীই বলি আর “তথাকথিত মূলধারা”র ঝান্ডাধারীই বলা হোক না কেন, তাদের কোন উসুল অথবা কাজের স্বচ্ছতা একেবারেই নেই। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কিছু “তথাকথিত মূলধারা”র ঝান্ডাধারী একটি বিষয়ে সকল মাযহাবের সকল মতকে সামনে রেখে তারপর দলিলাদির দিকে লক্ষ্য রেখে সবচেয়ে শক্তিশালী মতটি গ্রহণ করেন বলে দাবি করে থাকেন। এই তারজিহ বা প্রাধান্য আসলে কিসের ভিত্তিতে তারা করে থাকেন? শক্তিশালী মত গ্রহণের জন্যে তাদের কি কি মূলনীতি কাজ করে থাকে যা তাদেরকে এক হুকুম থেকে অন্য হুকুমের দিকে ধাবিত করে?
বিপরীতদিকে, যখন ফুকাহায়ে কেরাম কোনো বিষয়ে একটা অবস্থানে পৌঁছাতেন তখন তাঁরা শুধু সেই বিষয়টিকে মোটেও আলাদা করে নিয়ে বিবেচনা করতেন না। সে বিষয়ে তাঁদের “অবস্থানের” সাথে সাথে কি কি যুক্তি দিয়ে সেই অবস্থানে পৌঁছলেন তাও তাঁদের কাছে সমান গুরুত্ব পেতো। পশ্চিমা আইনি লড়াইতে আপিলের ক্ষেত্রে এরকম নজিরের, পূর্বের নানা কেইসের বিচারের দিকে তাকানো হয়। পূর্বের কেইসগুলো হয়তো বাহ্যিকভাবে নতুন কেইসের সাথে সম্পর্কযুক্ত নয় কিন্তু যেসব যুক্তি ব্যবহার করে রায় দেওয়া হয়েছিলো সেগুলো প্রাসঙ্গিক এবং সেসব যৌক্তিক পন্থা বিবেচনায় আনাটা রায়গুলোর মাঝে সামঞ্জস্যতা বজায় রাখে। এ সামঞ্জস্যতা যদি না বজায় থাকে তাহলে পুরো ব্যবস্থাটিই অসংলগ্ন, পক্ষপাতদুষ্ট একটা অবস্থায় পড়ে যাবে। কার্যত এই কারণেই আধুনিক ফিকহের বেশিরভাগ তারজিহগুলো মাযহাবগুলোর বিপরীতে চলে যায়।
মাযহাবগুলো বড় পরিসরেও একেবারে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়ের মাঝে সামঞ্জস্যের দিকে সর্বদা লক্ষ্য রেখে এসেছে। এ সামঞ্জস্যতা তাঁদের জ্ঞানগত এবং আধ্যাত্মিক দিকের বড়ত্বই প্রকাশ করে। কারণ তাঁরা সর্বদা এই চিন্তায় নিমগ্ন থাকতেন যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রকাশিত একটা ছোট্ট আদেশ যদি থাকে যা কোনো বিষয়ের সাথে দূরতম সম্পর্কও রাখে, তবে সেটিকেও যেন মানা হয়। তা যেন না ছুটে যায়। (এখানে বলে রাখা যায় যে, একাডেমিক ইসলামি পড়াশোনায় স্বল্প সময়ে একজন তারকা বনে যাওয়ার একটা সহজ পন্থা হলো প্রথাগত আলেমগণের কাজ আর মাযহাব থেকে আপাতদৃষ্টিতে মনে হওয়া অসামঞ্জস্যপূর্ণতা বা যুক্তির ফাঁক খুঁজে বের করা। এর দ্বারা প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে গেঁথে থাকা অনুচ্চারিত, তবে অবশ্য পালনীয় মৌলিক নীতিগুলো পালন হয়। “তথাকথিত মূলধারা”র ঝান্ডাধারীরা প্রায়ই সালাফগণের কাজ নিয়ে তাদের ভাসা ভাসা গবেষণার সাথে সাথে বৈচিত্র্য আনার জন্যে এ ভুল ধরার কাজটিও করে থাকেন।)
প্রকৃত সত্য
আলেমগণের ‘একটি মাত্র সত্য ইসলাম আছে আর তার দিকে আমাদের ধাবিত হতে হবে’- ধারণার পেছনে রয়েছে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি হাদিস- কোনো বিচারক যদি ইজতিহাদের দ্বারা কোন ফাতওয়া দেয় আর সে সঠিক হয় তাহলে তার জন্যে দুইটি পুরষ্কার আর কোনো বিচারক যদি ইজতিহাদের দ্বারা কোন ফাতওয়া দেয় আর সে ভুল হয় তাহলে তার জন্যে একটি পুরষ্কার।
তার মানে দাঁড়ায় কোথাও অবশ্যই ‘একটি’ মাত্র ঠিক অবস্থান রয়েছে। তার মানে এই নয় যে, ”সব আলেমেরই নিজস্ব ব্যখ্যা আছে আর সব ফিকহ আর আকিদাই মানবরচিত। আর যেহেতু কোনটা ঠিক তা নিশ্চিত করে বলার কোনো উপায় নেই তাই সবগুলো মতকেই সঠিক এবং যুক্তিসিদ্ধ বলে ধরে নিয়ে তার মধ্যে থেকে আমার কাছে যেটা ঠিক বলে মনে হয় তা মানবো আর যেটা ভুল বলে মনে হয় তা ঠিক করার চেষ্টা করবো।”
এ ব্যাপারটি একটা আধুনিক গোমরাহি আর উদ্ভাবন মাত্র। আপনি দেখবেন, এই ধারনাটি আধুনিক সংস্কারপন্থিদের দ্বারা প্রবলভাবে চর্চিত (“তথাকথিত মূলধারা”র ঝান্ডাধারীরা বাস্তবিকপক্ষে সংস্কারপন্থিই বটে)। যদি প্রথাগত ফিকহ আর আকিদাকে মানবরচিত বলে ধরে নেওয়া হয় তাহলে যা আমাদের আধুনিক ধ্যানধারণার সাথে খাপ খায়না তাকেই আমরা নির্দ্বিধায় বাতিলের খাতায় ফেলে দিতে পারি। অমুক অমুক বিষয়ে হানাফি মাযহাবের অবস্থান লিবারেল হিউম্যান রাইটসের সাথে সাংঘর্ষিক? ওসব বাতিল। অমুক অমুক বিষয়ে মালিকি মাযহাবের অবস্থান সোশাল জাস্টিস ওয়ারিয়রদের বিতৃষ্ণার উদ্রেক করে? ছুঁড়ে ফেলো তা। অমুক অমুক বিষয়ে শাফেই মাযহাবের অবস্থান জাগ্রত হিজাবীদের মন খারাপ করে দিচ্ছে? আস্তাকুড়ে ছুঁড়ে ফেলো তা। এগুলো তো সব মানুষের বানানো ব্যখ্যা, তাই না!
এই ধুর্ত কৌশলের উপর ভিত্তি করে তথাকথিত ট্রেডিশনালিস্টরা সহজেই ‘যুক্তিসঙ্গত’ ভাবে ফাতওয়া বর্জনের লাইসেন্স পেয়ে যান। তারা জোর দিয়ে বলেন, আমরা তো শরীয়াহর বিপক্ষে না। আমরা স্রেফ মানবরচিত ফিকহের বিপক্ষে।
এটাই কিন্তু আধুনিকতাবাদের একদম সারকথা।
প্রসঙ্গক্রমে, এখান থেকে যেকোনো একটা মাযহাবের আদ্যোপান্ত পড়ালেখা করার, নিজেকে তার সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়ানোর অন্তর্নিহিত প্রজ্ঞাটা বোঝা যায়। প্রথাগত শিক্ষার মাধ্যমে একটা মাযহাবের উপর পাণ্ডিত্য অর্জন করে কিন্তু কেউ ভাবেনা যে আমি হানাফি মাযহাব শিখছি, বা আছারি আকিদা শিখছি। যে কেউ এই শিক্ষা কার্যক্রমের মধ্যে বেড়ে উঠে নিজেকে ইসলামের শিক্ষার্থী, সত্যের শিক্ষার্থী হিসেবেই দেখে।
কিন্তু তা কি নিন্দনীয় আন্ত-সুন্নী দলাদলির মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে ? মোতেও না! প্রথাগত আলেমরা এ ব্যাপারে বিশদ আলোচনা করে গিয়েছেন। শাখাগত বিষয়ে (ফুরু’ঈ) একজনের বিশ্বাস থাকবে যে, সে ঠিক তবে তার ভুলও হতে পারে। আর বিপরীত মত গুলো ভুল তবে সেগুলো ঠিকও হতে পারে। আর দ্বীনের মৌলিক বিষয় গুলোতে (উসুল) একজনের বিশ্বাস থাকবে যে, সেই সঠিক আর বিপরীতে যা আছে তা ভুল।
সত্যান্বেষী প্রত্যেক বুদ্ধিবৃত্তিক ধারা একই ধারাতে কাজ করে। তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে আমার পড়াশোনা থেকে একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। পদার্থবিজ্ঞানে কয়েকটি ধারা আছে। যারা স্ট্রিং থিয়োরিস্ট তারা মনে করে কোয়ান্টাম লুপ গ্রাভিটি দিয়ে সব চিন্তা করা মানুষগুলো ভুল করছে। বিপরীত পক্ষও অপর দলকে ভুলই মনে করছে । কিন্তু তারা কেউই ভাবেনা যে, এগুলো সবই মানবরচিত ব্যাখ্যা আর তাই বিশ্ব ব্রক্ষ্মন্ডের রহস্যোদ্ঘাটন কখনোই সম্ভব নয়। যদি তারা ভেবেই নিতো যে, এ রহস্য কখনো উন্মোচিত হবার নয়, তাহলে আর তারা পদার্থবিজ্ঞানী হতোনা, দার্শনিক হতো। অথচ এই পদার্থবিজ্ঞানীরা কিন্তু একই ডিপার্টমেন্টে একই সাথে কাজ করে যাচ্ছে। তার মানে কি এই দাঁড়ায় যে যেকোনো পদার্থবিজ্ঞানের কোনো বিষয়ে যেকোনো মতামত বা অবস্থানই গ্রহণযোগ্য? অবশ্যই তা না! পদার্থবিজ্ঞানীদের তৈরী করা একটা বিভাজনরেখা আছে, যা তাদেরকে তাদের গবেষণা ক্ষেত্রে কি গ্রহণযোগ্য আর কি গ্রহণযোগ্য না তা নিরূপণে সাহায্য করে। যদি পদার্থবিজ্ঞানের ‘উসুল’ এর ক্ষেত্রে এতো বৈচিত্র্য থাকতে পারে তাহলে ‘তাবদি’, এমনকি ‘তাকফির’ ও আছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একজন জ্যোতিষী কোনো পদার্থবিজ্ঞানী ‘নন’। এসব কোন কিছুই কিন্তু এ বিশ্বাসকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেনা যে, একটিমাত্র সত্য আছে, আর তা খুঁজে বের করা সম্ভব। (অবশ্য, পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে আমার ধারণা-বিশ্বাস এরকম নয়, তবে তা অন্য গল্প)
মোদ্দাকথা এই যে, আমরা আসলে ইসলাম শিক্ষা কে ‘প্রাতিষ্ঠানিকরণ’ করতে পারিনা। কারণ তা আসলে ধোঁয়াশারই জন্ম দেবে। আমরা দেখেছি, এসব “তথাকথিত মূলধারা”র ঝান্ডাধারীরা সহ, অনেক মুসলিম রাও প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে ইসলামি পড়াশোনা করতে গিয়ে ইসলাম নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বের মাঝে পড়ে যাচ্ছে। যদিও তারা সবাই স্বীকার করেনা, তবে, নানারকম সংশয়ে পড়ে প্রথাগত রীতিনীতিগুলোকে তারা একটা বৈষয়িক খেল তামাশার বস্তু বলে মনে করা শুরু করছে। (স্বীকার না করলেও তা প্রকাশ পেয়ে যায় কারণ প্রথাগত আলেম আর তালবে ইলমদেরকে নিয়ে হাসি তামশা করতে তারা বেশ পছন্দ করে।)
এখন অনেকে বলতে পারে, ‘প্রাতিষ্ঠানিক ইসলামি পড়াশোনা থেকেও তো কিছু ভাল জানাশোনা মানুষ বেরিয়ে আসছে।’ তাদের জন্যে বলবো, ইসলামের যারা শত্রু, চাই সে ইসলামোফোব হোক বা অউপনিবেশবাদী সংস্কারকই হোক, তাদেরও কিন্তু ইসলাম নিয়ে অনেক জ্ঞান আছে। একজন ইসলাম নিয়ে তাদের কাছ থেকে অনেক ইসলাম নিয়ে বিশদভাবে জানতেও পারবে। কিন্তু এই জ্ঞান স্রেফ ধ্বংসের জন্যে, ক্ষতি করার জন্যে। সবচেয়ে ভয়ানক মিথ্যা সেগুলো, যেগুলো সত্যের সাথে মিশ্রিত থাকে।
প্রবন্ধটি লিখতে গিয়ে আমি “তথাকথিত মূলধারা”র ঝান্ডাধারীদের ব্যাপারটাতে খুবই মনোযোগ দিয়েছি যেন আমরা তাদেরকে ভালভাবে চিনতে পারি, প্রতিরোধ করতে পারি আর অবশ্যই সবার সামনে তাদের মুখোশ উন্মোচন করতে পারি। দিন দিন এটা একটা বড় ফিতনা হিসেবে দেখা দিচ্ছে কারণ হাল আমলে অনেক অনুকরণীয় ব্যক্তিবর্গই মূলধারার প্রচলিত ইসলামের মোড়কে এই বিষের প্রচার-প্রসার করছেন। আল্লাহ আমাদেরকে হিফাজত করুন। আমিন।
লেখাটি লেখকের ওয়েবসাইট থেকে নেয়া। মূল লেখার লিঙ্ক