[ রাসুল সাঃ এর পবিত্র জীবন প্রতিটি মুমিনের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ। আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাঁর প্রিয় রাসুলের সমগ্র জীবনকে সব ধরণের অপবিত্রতা,কু-প্রবৃত্তি,চারিত্রিক দূর্বলতা ইত্যাদী থেকে রক্ষা করেছেন। তাঁর সমগ্র জীবন একটি স্বচ্ছ আয়নার মতো দৃশ্যমান। যে কেউ চাইলেই তা দেখে নিতে পারবে। সকলের অনুসরণের জন্য উন্মুক্ত। এখানে কোন কালিমা নেই,গোপনীয়তা নেই,অস্পষ্টতা নেই। এমনই সুউচ্চ অতুলনীয় চারিত্রিক মহিমা তাঁকে দান করেছেন আল্লাহ। তাঁর এই পবিত্র জীবনের শা’ন,মান ও মর্যাদার পবিত্রতা রক্ষা করা প্রত্যেক মুমিনের জন্য আবশ্যক। সুতরাং রাসুল সাঃ এর মান ও মর্যাদার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এমন কোন বিভ্রান্তিকর বক্তব্য যদি কেউ প্রকাশ করে,তাহলে এর প্রতিরোধ করাকেও নিজেদের ঈমানি দায়িত্ব হিসেবেই দেখা উচিৎ।
ডক্টর ইয়াসির কায্বী নিঃসন্দেহে বড় মাপের একজন ইসলামিক স্কলার। কেবল যুক্তরাষ্ট্রই নয়,তার জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়েছে প্রায় পুরো পৃথিবীতেই। তার ইলম ও প্রচেষ্টা দ্বারা অনেকেই উপকৃত হয়েছেন। তথাপি তিনি দীনের অনেক বিষয়ে ঘোরতর বিভ্রান্তির শিকার হয়েছেন। এরমাঝে উল্লেখযোগ্য হলো উম্মুল মু’মিনিন যাইনাব রাযিঃ এর সাথে রাসুল সাঃ এর বিবাহ বিষয়ে তার বক্তব্য। এ ব্যাপারে তিনি যে মতামত গ্রহণ করেছেন,এবং এই মতামতকেই ” দলীল প্রমাণের আলোকে অথেন্টিক” বলে প্রচার করেছেন,সেটা কোন বিচারেই গ্রহণযোগ্য নয়। তার এমন বক্তব্য আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের উলামাদের মতে রাসুল সাঃ এর পবিত্র মর্যাদার পরিপন্থী।
সে বিবেচনায় আমরা তার এই বক্তব্যের একটি একাডেমিক ও দালিলিক পর্যালোচনা প্রকাশ করেছি। যেহেতু তার এই বক্তব্য বর্তমানে বাংলাভাষায় অনূদিত হয়ে এদেশের পাঠক সাধারণ পর্যন্তও পৌঁছে গেছে। অনেক পাঠক-শ্রোতাই এ বিষয়ে সন্দেহে নিপতিত হবেন। তাদের এবং সকলের উপকারের জন্যই এই লেখাটি।
আল্লাহ আমাদেরকে তার উপকারী কাজগুলো থেকে উপকৃত হওয়ার এবং মন্দ কাজগুলো থেকে দূরে থাকার তৌফিক দিন। — রিওয়ায়াহ সম্পাদকমণ্ডলী ]
ইতিহাসে যে মানুষটির বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি বই লেখা হয়েছে তিনি হচ্ছেন মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ ﷺ। ভাবতে অবাক লাগে, সেই তিনিই ইতিহাসে একমাত্র ব্যক্তি যিনি একটা জাতির ব্যবসা-বাণিজ্য,রীতি-নীতি থেকে শুরু করে সবকিছুর মাঝে প্রায় রাতা-রাতি সময়ের ব্যবধানে আমূল পরিবর্তন এনেছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধচারীরা যখন তাঁর দেখানো অনুপম আদর্শের চেয়ে ভালো কিছু প্রবর্তন করতে ব্যর্থ হয়েছে, তখন অভিযোগের আঙ্গুল তুলেছে তাঁর পবিত্র ব্যক্তিগত জীবনের দিকে। যাদের নিজেদের ভালো-খারাপের কোন ষ্ট্যাণ্ডার্ড নেই, তারাই বলতে গেলে তাঁর জীবনের প্রায় সবকিছুরই সমালোচনা করেছে। এই সমালোচনার তালিকায় তাদের খুব প্রিয় একটা প্রসঙ্গ হলো “রাসূল ﷺ ও যায়নাব(রা) এর বিয়ে।”
অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার হলো সেই প্রসঙ্গেই ইসলামবিদ্বেষী,প্রাচ্যবিদ,ও বিভ্রান্ত লোকদের তৈরি বয়ান মুসলিম সমাজে ছড়িয়ে পড়ার রাস্তা তৈরি হয়েছে একজন মুসলিম স্কলার,ডক্টর ইয়াসির ক্বাযীর লেকচারের মাধ্যমে,এবং বাংলাদেশি দুটি প্রকাশনীর (প্রচ্ছদ প্রকাশন ও গার্ডিয়ান পাবলিকেশন্স) বাংলা ভাষায় সেই লেকচারকে অনুবাদ করে বই আকারে প্রকাশ করার মাধ্যমে।
যাইনাব রাযিঃ এর সাথে রাসুল সাঃ এর বিবাহ নবী জীবনে অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা। বিভিন্ন দিক দিয়ে এটি তাৎপর্যপূর্ণ। আল্লাহ স্বয়ং এই বিয়ে ঠিক করেছেন আরশে আযীমে। এই বিয়ের কথা আলাদাভাবে কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে অতীব গুরুত্বের সাথে। উম্মুল মু’মিনিন যাইনাব রাযিঃ গর্ব করে বলতেন,তোমাদের বিয়ে তো দুনিয়াতে হয়েছে,আর আমার বিয়ে আসমানে হয়েছে।
তথাপি বিচ্ছিন্ন ও বিভ্রান্ত কিছু বর্ণনাকে উপজীব্য করে এই পবিত্র বিয়ে অনেকে বিতর্ক তৈরী করার চেষ্টা করেন। যা রাসুল সাঃ এর শা’ন ও মর্যাদার সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক। সম্প্রতি ডক্টর ইয়াসির কাজীও তার লেকচার সিরিজে একই কাজ করেছেন। তিনি সেসব সূত্রহীন বর্ণনা ও কাহিনীকে সামনে রেখে সেই অনির্ভরযোগ্য ও বাতিল মতটিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। যা রীতিমতো বিস্ময়কর একটি ব্যাপার।
ইয়াসির ক্বাযী তার বিখ্যাত লেকচার সিরিজ ” mothers of the believers” এ প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে মুসনাদে ইমাম আহমাদের একটি বর্ণনা উল্লেখ করে বলেন,
“Musnad Imam Ahmad mentions that [from Anas Ibn Malik] The Prophet (SAW) visited the house of Zaid when Zaid and Zainab were married and he saw Zainab and something entered his heart (دخل شيئ في قلبه). Zaid then came to the Prophet (SAW) complaining about his wife that she is sharp-tongued and ‘I can’t stand her and this marriage is not working’. The Prophet (SAW) could have said, ‘Divorce her’ but he didn’t. He said ‘أمسك عليك زوجك، واتق الله’ (‘Keep your wife with you and fear Allah’) and there was something in his heart that he didn’t reveal. Okay, that’s the story in Musnad Imam Ahmad”[*]
প্রচ্ছদ প্রকাশন এ অংশটুকুর অনুবাদ এভাবে করেছে,
“মুসনাদে আহমাদের হাদিস থেকে জানা যায়, আনাস ইবনে মালিক রা. বর্ণনা করেন, যায়েদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে যায়েদ ও যয়নবের সংসার দেখার জন্য নবি সা. তাদের বাড়িতে গিয়েছিলেন। যখন তিনি যয়নবকে দেখতে পান, তারপরই তাঁর মনে কিছু একটা অনুভূত হয়। তিনি আল্লাহর কাছে পানাহ চেয়ে দ্রুত সেই স্থান ত্যাগ করেন। যায়েদ রা. নবি সা.-এর কাছে গিয়ে যয়নবের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেশ করে বলেন, যয়নব রুক্ষ মেজাজের, তাঁরা দুইজনই অসুখী, সংসার কোনোভাবেই স্বস্তিকর হচ্ছে না ইত্যাদি। এ কথা শুনে রাসূল সা. যায়েদ রা.-কে বলে দিতে পারতেন যে, ঠিক আছে, তোমরা যখন পরস্পরকে নিয়ে সুখী নও, তাহলে তোমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাও। কিন্তু তিনি তা বলেননি। বরং তিনি বললেন, ‘এরপরও তুমি তোমার স্ত্রীকে রাখো, তাকে ছেড়ে দিয়ো না। আর আল্লাহর উপর ভরসা করো।’”[i]
এবার আমরা মুসনাদে আহমাদ থেকে সরাসরি বর্ণনাটা দেখিঃ
حدثنا مؤمل بن إسماعيل، حدثنا حماد بن زيد، حدثنا ثابت، عن أنس قال: أتى رسول الله صلى الله عليه وسلم منزل زيد بن حارثة، فرأى امرأته زينب فكأنه دخله – لا أدري من قول حماد، أو في الحديث – فجاء زيد يشكوها إليه، فقال له النبي صلى الله عليه وسلم: ” أمسك عليك زوجك، واتق الله ” قال: فنزلت: {واتق الله وتخفي في نفسك ما الله مبديه} [الأحزاب: 37] ، إلى قوله {زوجناكها} [الأحزاب: 37] يعني زينب
মু’আম্মাল ইবন ইসমাঈল হাম্মাদ থেকে, হাম্মাদ ছাবিত থেকে, ছাবিত আনাস ইবন মালিক (রা) থেকে বর্ণনা করেন, আনাস ইবন মালিক (রা) বলেছেন,
“আল্লাহর রাসূল (স) যায়েদ ইবুন হারিসার বাড়িতে এসেছিলেন এবং তার স্ত্রী যায়নাবকে দেখেছিলেন। হয়তো তিনি তাদের বাড়িতে প্রবেশ করেছিলেন।–>[মু’আম্মাল বলেন, “আমি নিশ্চিত নই, এ অংশটুকু কি হাম্মাদের নিজের বক্তব্য নাকি হাদিসেরই অংশ”]
যায়েদ রাসূল (স) এর কাছে আসেন যায়নাবের ব্যাপারে অভিযোগ জানাতে, কিন্তু রাসূল (স) তাকে বলেন, “তোমার স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক বজায় রাখো এবং আল্লাহকে ভয় করো”। এ আয়াতটি, “আপনি অন্তরে এমন বিষয় গোপন করেছিলেন, যা আল্লাহ প্রকাশ করে দিবেন” থেকে “আমি তাকে আপনার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করলাম” যায়নাবের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়।” [১]
এ হাদিসের সনদের দিকে আমরা লক্ষ্য করি। এ হাদিসটি আনাস ইবন মালিক (রা) থেকে ছাবিত, ছাবিত থেকে হাম্মাদ, এবং হাম্মাদ থেকে মু’আম্মাল ইবন ইসমাঈল বর্ণনা করেন।
হাম্মাদ থেকে মু’আম্মাল ইবন ইসমাঈল ছাড়াও আরো ৮ জন এই হাদিসটি বর্ণনা করেন। তারা হলেনঃ
১। মুহাম্মাদ ইবন আবু বকর আল মুক্বাদ্দিমি [২]
২। মু’আল্লা ইবন মানসুর [৩]
৩। আফফান ইবন মুসলিম [৪]
৪। মুহাম্মাদ ইবন আল-ফাদল [৫]
৫। আব্দুল্লাহ ইবন আব্দুল ওয়াহহাব আল-হাজবি
৬। আহমাদ ইবন আবদাহ আল-যাব্বী [৭]
৭। মুহাম্মাদ ইবন সুলাইমান আল-আসাদি [৮]
৮। মুহাম্মাদ ইবন মুসা [৯]
প্রথমত, মু’আম্মাল ইবন ইসমাঈল ব্যতীত বাকি ৮ জনের কেউই “আল্লাহর রাসূল (স) যায়েদ ইবুন হারিসার বাড়িতে এসেছিলেন এবং তার স্ত্রী যায়নাবকে দেখেছিলেন। হয়তো তিনি তাদের বাড়িতে প্রবেশ করেছিলেন।” – এই অংশটুকু বর্ণনা করেন নি। আবার, মু’মাল নিজেই বলেছেন, “আমি নিশ্চিত নই, এ অংশটুকু কি হাম্মাদের নিজের বক্তব্য নাকি হাদিসেরই অংশ”।
মু’আম্মাল সম্পর্কে মুহাম্মাদ ইবন নাসর আল-মারওয়াযী বলেছেন,
“সে যদি কোনো বর্ণনার একমাত্র বর্ণনাকারী হয়, তাহলে সেই বর্ণনার বিস্তারিতভাবে সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন। কারণ, তার স্মৃতিশক্তি শক্তিশালী ছিল না এবং সে প্রায়ই ভুল করতো।” [১০]
শায়খ শু’আইব আল-আরনাউত (রহ) ও মু’আম্মালের এই বর্ণনাকে যঈফ বলেছেন। [১১]
দ্বিতীয়ত, ইয়াসির ক্বাযী বর্ণনাটা উল্লেখ করতে গিয়ে বলেছেন, “he saw Zainab and something entered his heart (دخل شيئ في قلبه)”। অথচ, বর্ণনাটিতে دخل شيئ في قلبه (something entered his heart/তাঁর মনে কিছু একটা অনুভূত হয়) – এ অংশটুকুর অস্তিত্বই নেই। ইয়াসির ক্বাযী কি তাহলে নিজের বক্তব্য প্রমাণ করার জন্য বর্ণনার মাঝে এ অংশটুকু নিজেই প্রবেশ করিয়েছেন?
ইয়াসির ক্বাযী এর পরে ইবনে সাদ এর তাবাকাত গ্রন্থের একটি বর্ণনা উল্লেখ করে বলেন,
“ইবনে সাদের বর্ণনাটি এমন- নবি সা. যায়েদের খোঁজে তাঁর বাড়িতে গেলেন। কিন্তু যায়েদ তখন বাড়িতে ছিলেন না। নবিজি সা. দরজায় কড়া নাড়ছিলেন, আর যয়নব নিজেই এসে দরজা খুলছিলেন। এখানে উল্লেখ্য, এ ঘটনাটি ঘটে হিজাবের বাধ্যবাধকতা জারি হওয়ার আগেই। তাই মহিলারা তখনও হিজাব পরিধান করতে বাধ্য ছিলেন না। তারপরও বাইরে বের হওয়ার সময় প্রথাগতভাবে কোনো কোনো মহিলা হিজাব পরিধান করলেও ঘরের ভেতর সাধারণত তারা হিজাব পরে থাকত না। সেদিনও তা-ই ঘটেছিল। ফলে যয়নব যখন এসে রাসূল সা.-এর ডাকে সাড়া দিচ্ছিলেন, তখন তাঁর চেহারা ও চুল অনাবৃত ছিল। আরবিতে যয়নব রা. – এর সেই সময়ের পরিধেয় পোশাককে বলা হয় ‘হাসেরা’। পরবর্তী সময়ে প্রাচ্যের অনেক ইতিহাসবিদ এমনকি অনারব মুসলিম ইতিহাসবিদদের কেউ কেউ আরবি না জানার কারণে হাসেরা শব্দটিকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আরবিতে হাসেরা মানে হলো নারীর সেই ভূষণ, যাতে চুল অনাবৃত থাকে এবং যে কিনা ঘরোয়া পোশাক পরে থাকে। যয়নব রা. এভাবে চলে আসায় রাসূল সা. তাকে এ অবস্থাতেই দেখলেন এবং সাথে সাথেই নিজের দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলেন। এরপর রাসূল সা. পড়লেন, “সুবহানাল্লাহিল আজিম, সুবহানা মুকাললিবাল কুলুব (সেই রবের প্রশংসা, যিনি মানুষের অন্তরকে পালটে দিতে পারেন)।‘ এ কথা বলে রাসূল সা. সেখান থেকে প্রস্থান করলেন।
রাসূল সা. মূলত সেদিন গিয়েছিলেন যায়েদের সাথে যয়নবের সম্পর্ক ঝালাই করার জন্য। কিছু সময় পরে যখন যায়েদ রা. বাড়িতে ফিরলেন, তখন তার স্ত্রী যয়নব তাকে জানালেন, নবিজি বাড়িতে এসেছিলেন। যায়েদ বললেন, ‘বলো কী! তুমি কেন তাকে ভেতরে এনে বসালে না?’ যয়নব বলেলেন, ‘আমি তাকে বসতে বলেছিলাম; ভেতরে আসতেও বলেছিলাম, কিন্তু তিনি চলে গেলেন। যাওয়ার সময় তিনি কেবল বিড়বিড় শব্দে কী যেন পড়ছিলেন।‘ যায়েদ আবার প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি কি শুনেছ তিনি কী পড়ছিলেন? যয়নব বললেন, ‘তিনি জিকির করছিলেন, সুবহানাল্লাহিল আজিম, সুবহানা মুকাললিবাল কুলুব।‘
এই জিকির নবিজি কেন করেছিলেন নারী হওয়ায় যয়নব তা বুঝতে পারেননি। তিনি হয়তো সরল মনেই বিষয়টিকে নিয়েছিলেন। কিন্তু বিষয়টির তাৎপর্য বুঝতে পেরেছিলেন যায়েব বিন হারিসা.। কারণ, তিনি নিজেও একজন পুরুষ। তাই তিনি সঙ্গে সঙ্গে চলে গেলেন নবিজির কাছে এবং বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমার কি উচিত নয় যয়নবকে তালাক দিয়ে দেওয়া?’ এখন পরস্থিতি বেশ জটিল হয়ে গেল। কারণ, একটু আগে যা ঘটে গেছে, তারপর পরিস্থিতি বা মানসিকতা উভয়ই পরিবর্তিত হয়ে গেছে। তারপরও নবি সা. মৌখিকভাবে বললেন, ‘তুমি ওকে ছেড়ো না; বরং ধরে রাখো।‘ কিন্তু বাস্তবে তাঁর মনে হয়তো অন্য কোনো চিন্তা ছিল, যা তিনি প্রকাশ করেননি, কিন্তু আল্লাহ পরবর্তী সময়ে কুরআনে তা খোলাসা করে দিয়েছেন।” [*][ii]
যে বর্ণনার আলোকে ইয়াসির ক্বাযী উপরিউক্ত অংশটুকু তার লেকচারে বলেছেন সে বর্ণনাটা মূলত ইবন সা’দ এর তাবাকাত আল কুবরা (৮/৮০-৮১) তে উল্লেখিত হয়েছে।
প্রথমে আমরা দেখি এ বর্ণনার সনদে কোন সমস্যা আছে কিনাঃ
প্রথম সমস্যাঃ মুহাম্মাদ ইবনে উমার আল ওয়াকেদীকে মিথ্যাবাদী বলা হয়। ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বাল (রহ) বলেছেন, ‘সে একজন মিথ্যাবাদী, যে কিনা হাদীস বানাত।’ মুরা বলেছেন, ‘তার হাদীস লিখা উচিৎ না।’ দারকান্দী বলেছেন, ‘তার মধ্যে দুর্বলতা আছে। [১২]
তথাপি, রিজাল শাস্ত্রবিদের অনেকেই বলেছেন,ইতিহাস সংশ্লিষ্ট বিষয় আশয়ে তার বর্ণনা শর্ত সাপেক্ষে কখনও গ্রহণযোগ্য হলেও তার বর্ণিত হাদিস গ্রহণযোগ্য নয়। আমাদের আলোচ্য বিষয়টি যেহেতু হাদিস,এবং রাসুল সাঃ এর সীরাতের স্পর্শকাতর একটি বিষয়ের সাথে সম্পৃক্, সে ক্ষেত্রে তার বক্তব্য গ্রহণযোগ্য হওয়ার প্রশ্নই উঠেনা।
দ্বিতীয় সমস্যাঃ আবদুল্লাহ ইবন আমীর আল আসলামীকে সর্বসম্মতিক্রমে দুর্বল রাবী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ইবনে হাজার আল আসকালানী এবং আমীর আল মাদানি তাকে দুর্বল বলেছেন। [১৩]
তৃতীয় সমস্যাঃ এই সনদের রাবী মুহাম্মাদ ইবনে ইয়াহিয়া ইবনে হাব্বান ৭৪ বছর বয়সে ১২১ হিজরিতে মৃত্যুবরণ করেন। অর্থাৎ, তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন রাসূল(স) এর সাথে যায়নাব (রা) এর বিয়ের প্রায় অর্ধশতাব্দী পর এবং যায়নাব (রা) এর মৃত্যুর ৩০+ বছর পর। যায়নাব (রা) ই উক্ত ঘটনায় উল্লেখিত মানুষদের মধ্যে সবার শেষে মৃত্যুবরণ করেন। অর্থাৎ, এই ঘটনায় উল্লেখিত মানুষদের কারো সাথেই তার সরাসরি সাক্ষাৎ ও হয় নি, উক্ত ঘটনাও তিনি নিজে প্রত্যক্ষও করেন নি। এই বর্ণনা তিনি কার কাছ থেকে গ্রহণ করেছেন, সেটাও উল্লেখ করেন নি। [১৪]
এ ছাড়াও ইয়াসির ক্বাযী বলেছেন উক্ত ঘটনার বিবরণ মুকাতিল ইবন সুলাইমান ও তাবারিতে পাওয়া যায়।
মুকাতিল ইবন সুলাইমান উক্ত ঘটনার বিবরণ উল্লেখ করেছেন কোনোরূপ সনদের উল্লেখ ছাড়াই। [১৫] এছাড়াও, মুকাতিল ইবন সুলাইমানের বিরুদ্ধে বর্ণনা জাল করার অভিযোগ পাওয়া যায়। [১৬]
ইমাম যাহাবী তার সম্পর্কে বলেছেন, “আলেমরা তার বর্ণনাগুলো প্রত্যাখ্যান করার ব্যাপারে একমত।” [১৭]
ইবনে জারীর আত-তাবারী(রহ) তার বই আল তারিখে (৭/১৪৪) ঘটনাটি এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ
ইউনুস বিন আব্দ আল-আ’লা ইবন ওয়াহাব থেকে, ইবন ওয়াহাব ইবন যায়েদ থেকে বর্ণনা করেন,
ইবন যায়েদ বলেছেন, “আমাকে বলেছেন,নবী ﷺ যায়েদ বিন হারিছাকে তার ফুফাতো বোন যয়নব বিনতে জাহশের সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন,একদিন নবী ﷺ তাকে খুঁজতে তার বাসায় গেলেন, তার বাসায় দরজা বলতে ছিল কেবল একটুকরো কাপড়, বাতাসে কাপড়টি উড়ে গেল এবং যায়নাবকে প্রকাশ করে দিল। তাঁর পা অনাবৃত ছিল। তিনি নবীর হৃদয়ে জায়গা করে নিলেন এবং তারপর থেকে তিনি অপরজনকে(যায়েদকে) ঘৃণা করতেন। একদিন যায়েদ নবী ﷺ এর কাছে এসে বললেন, ‘হে আল্লাহর নবী! আমি আমার স্ত্রীকে ত্যাগ করতে চাই।’ তিনি [নবী ﷺ] বললেন, ‘কেন? তার কোনো কিছু কি তোমাকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে?’ তিনি(যায়েদ) উত্তর দিলেন, “ না! আল্লাহর শপথ! আমাকে চিন্তায় ফেলার করার মত কিছুই সে করেনি। আমি তো তার মাঝে কেবল ভালোই দেখেছি।’ তারপর নবী ﷺ বললেন, ‘তোমার স্ত্রীর সাথে থাক এবং তার ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো! এই কারণেই আল্লাহ বলেছেন, ‘তাকে যখন আপনি বলেছিলেন, তোমার স্ত্রীকে তোমার কাছেই থাকতে দাও এবং আল্লাহকে ভয় কর। আপনি অন্তরে এমন বিষয় গোপন করেছিলেন, যা আল্লাহ প্রকাশ করে দিবেন। আপনি লোকনিন্দার ভয় করেছিলেন অথচ আল্লাহকেই অধিক ভয় করা উচিত।’”
এই হাদীসটি মু’দাল। অর্থাৎ, কমপক্ষে দুইজন রাবী এখানে অনুপস্থিত । কারণ এই বর্ণনার সনদের সর্বশেষ রাবি আব্দুর রহমান ইবন যায়েদ ইবন আসলাম সাহাবী কিংবা তাবেয়ী কোনটাই ছিলেন না। তিনি কার কাছ থেকে এই ঘটনা শুনেছেন এর কোন তথ্য পাওয়া যায়না। তাছাড়া, মুহাদ্দিসে কেরামের সর্বসস্মতিক্রমে আব্দুর রহমান ইবন যায়েদ ইবন আসলামকে দুর্বল রাবী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। [১৮]
সুতরাং, আমরা বুঝতে পারলাম যে উক্ত ঘটনা সম্পর্কিত প্রত্যেকটি হাদিসেরই সনদে বড়-সড় সমস্যা আছে। এবার যদি আমরা হাদিসগুলোর মতন বা বর্ণনাগুলোর দিকে তাকাই, তাহলে অনেক অসামঞ্জস্যতা দেখতে পাব। ইবন সা’দ এর বর্ণনায় বলা আছে, যায়নাব(রা) ঘরোয়া পোশাক পরে বের হন, তাবারীর বর্ণনায় বলা আছে, বাতাসে পর্দা উড়ে যাওয়াতে যায়নাব(রা) এর পা দেখা গিয়েছিল।
আবার মুসনাদে আহমাদের বর্ণনা অনুসারে যায়েদ (রা) রাসূল (স) এর কাছে গিয়েছিলেন যায়নাব (রা) এর প্রতি অভিযোগ জানাতে, কিন্তু তাবারীর বর্ণনা অনুসারে যায়নাব (রা) এর প্রতি যায়েদ (রা) এর কোনো অভিযোগ ই ছিল না। আবার ইবন সা’দ এর বর্ণনা অনুসারে যায়েদ(রা) যায়নাব(রা)কে কেবল রাসূল (স) এর জন্যই তালাক দিতে চাচ্ছিলেন যা তিরমিযীতে বর্ণিত সহীহ হাদিসের পরিপন্থী, যেখানে বলা হয়েছে, যায়েদ (রা) যায়নাব (রা) এর প্রতি অভিযোগ জানাতে রাসূল (স) এর কাছে এসেছিলেন এবং তিনি তাকে তালাক দিতে চাচ্ছিলেনঃ
حَدَّثَنَا أَحْمَدُ بْنُ عَبْدَةَ الضَّبِّيُّ، حَدَّثَنَا حَمَّادُ بْنُ زَيْدٍ، عَنْ ثَابِتٍ، عَنْ أَنَسٍ، قَالَ نَزَلَتْ هَذِهِ الآيَةُ : (وتُخْفِي فِي نَفْسِكَ مَا اللَّهُ مُبْدِيهِ وَتَخْشَى النَّاسَ ) فِي شَأْنِ زَيْنَبَ بِنْتِ جَحْشٍ جَاءَ زَيْدٌ يَشْكُو فَهَمَّ بِطَلاَقِهَا فَاسْتَأْمَرَ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم ” أَمْسِكْ عَلَيْكَ زَوْجَكَ وَاتَّقِ اللَّهَ ” .
আনাস ইবন মালিক (রা) থেকে বর্ণিত, ““আপনি অন্তরে এমন বিষয় গোপন করেছিলেন, যা আল্লাহ প্রকাশ করে দিবেন”— এ আয়াত তখন অবতীর্ণ হয় যখন যায়েদ যায়নাব বিনতু জাহশ প্রসঙ্গে অভিযোগ করতে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এলেন। তিনি যায়নাবকে তালাক দেয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন এবং নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট অনুমতি চান।
নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ “তোমার স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক বজায় রাখো এবং আল্লাহকে ভয় করো করো।”” [১৯]
তাহলে দেখা যাচ্ছে, সনদ ও মতন উভয়ের বিচারেই উক্ত ঘটনা সম্পর্কিত বর্ণনাগুলো অগ্রহণযোগ্য।
এ ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট বর্ণনাগুলোর সনদ ও মতনের সমস্যা আরো বিস্তারিতভাবে জানতে আগ্রহী পাঠক এই গবেষণাপত্রটিও পড়ে দেখতে পারেন।
ইয়াসির ক্বাযী তার লেকচারে বারবার ইঙ্গিত করেছেন যে, সূরাহ আহযাবের ৩৭ নং আয়াতের “আপনি অন্তরে এমন বিষয় গোপন করেছিলেন, যা আল্লাহ প্রকাশ করে দিবেন” অংশটুকুতে উল্লেখিত গোপন বিষয় হল যায়নাব (রা) এর প্রতি রাসূল সা. এর সুপ্ত অনুভূতি। আমরা ইতিমধ্যে দেখেছি, যে ঘটনার আলোকে ইয়াসির ক্বাযী এ মত ব্যক্ত করার চেষ্টা করেছেন, সে ঘটনা যেসব বর্ণনায় এসেছে, তার প্রত্যেকটি অপ্রমাণিত ও অগ্রহণযোগ্য। এবার আমরা দেখি সূরাহ আহযাবের ৩৭ নং আয়াতে আসলে কী বলা হয়েছে, সে সম্পর্কে ইসলামের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ মুফাসসিররা কী বলেছেন এবং ইয়াসির ক্বাযী উল্লেখিত অগ্রহণযোগ্য, অপ্রমাণিত ঘটনাটি সম্পর্কে এই উম্মাহর আলেমরা কী বলেছেনঃ
সূরাহ আহযাবের ৩৭ নং আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
“আল্লাহ যাকে অনুগ্রহ করেছেন; আপনিও যাকে অনুগ্রহ করেছেন; তাকে যখন আপনি বলেছিলেন, তোমার স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক বজায় রাখো এবং আল্লাহকে ভয় কর। আপনি অন্তরে এমন বিষয় গোপন করেছিলেন, যা আল্লাহ প্রকাশ করে দিবেন। আপনি লোকনিন্দার ভয় করেছিলেন অথচ আল্লাহকেই অধিক ভয় করা উচিত। অতঃপর যায়েদ যখন যায়নাবের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করল, তখন আমি তাকে আপনার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করলাম যাতে মুমিনদের পোষ্যপুত্ররা তাদের স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলে সেসব স্ত্রীকে বিবাহ করার ব্যাপারে মুমিনদের কোন অসুবিধা না থাকে। আল্লাহর নির্দেশ কার্যে পরিণত হয়েই থাকে।” – (৩৩ : ৩৭)
রাসূল (স) এর প্রদৌহিত্র আলী ইবন হুসাইন (রহ) বলেছেন,
حدثنا خلاد بن أسلم، قال: ثنا سفيان بن عيينة، عن علي بن زيد بن جدعان، عن علي بن حسين قال: كان الله تبارك وتعالى أعلم نبيه صلى الله عليه وسلم أن زينب ستكون من أزواجه، فلما أتاه زيد يشكوها، قال: اتق الله وأمسك عليك زوجك، قال الله: (وتخفي في نفسك ما الله مبديه)
“সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাঁর নবী (স) কে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, যায়নাব নবী (স) এর স্ত্রীদের মধ্যে শামিল হবেন। তারপরও যখন যায়েদ নবী (স) এর কাছে এসে যায়নাবের সম্পর্কে নিজের অসন্তুষ্ট মনোভাব প্রকাশ করলেন তখন নবী (স) যায়েদকে বলেছিলেন “আল্লাহকে ভয় করো করো এবং তোমার স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক বজায় রাখো”। এ ব্যাপারেই আল্লাহ ক্বুর’আনে বলেছেন, “আপনি লোকনিন্দার ভয় করেছিলেন অথচ আল্লাহকেই অধিক ভয় করা উচিত”। [২০]
এ বর্ণনাটি উল্লেখ করে ইমাম আহমাদ ইবন মুহাম্মাদ আস-সালাবী (রহ) তাঁর তাফসীরে বলেন,
وهذا التأويل مطابق للتلاوة وذلك أن الله عز وجل حكم واعلم إبداء ما أخفى، والله لا يخلف الميعاد، ثم لم نجده عز وجل أظهر من شأنه غير التزويج بقوله: زوجناكها. فلو كان أضمر رسول الله صلى الله عليه محبتها، أو أراد طلاقها، لكان لا يجوز على الله تعالى كتمانه مع وعده أن يظهره، فدل ذلك على أنه (عليه السلام) إنما عوتب على قوله: أمسك عليك زوجك مع علمه بأنها ستكون زوجته، وكتمانه ما أخبره الله سبحانه به حيث استحيا أن يقول لزيد: إن التي تحتك ستكون امرأتي والله أعلم.
“এই ব্যাখ্যাটিই ক্বুর’আনের তিলাওয়াতকৃত শব্দাবলির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কারণ আল্লাহ বলেছেন তিনি তা প্রকাশ করে দিবেন যা গোপন করা হয়েছিল। আল্লাহ তাঁর প্রতিশ্রুতির ব্যতিক্রম করেন না এবং আমরা দেখতে পাই যে, আল্লাহ রাসূল (স) সম্পর্কে যায়নাব এর সাথে তাঁর বিয়ে ব্যতীত অন্য কিছুই প্রকাশ করেন নি। আল্লাহ বলেছেন, “আমি তাকে আপনার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করলাম”। যদি রাসূল (স) যায়নাব এর প্রতি তাঁর ভালবাসা লুকিয়ে রাখতেন এবং যায়েদের সাথে যায়নাবের তালাকের আকাঙ্খা পোষণ করতেন, তাহলে আল্লাহ রাসূল (স) এর অন্তরে যা ছিল তা প্রকাশ করার প্রতিশ্রুতি দেয়ার পর এটি লুকিয়ে রাখতেন না। এ থেকে এটিই প্রমাণিত হয় যে, রাসূল (স) কে তিরস্কার করা হয়েছিল কারণ যায়নাব রাসূল (স) এর স্ত্রী হবেন এটা জানার পরও রাসূল (স) যায়েদকে বলেছিলেন, “তোমার স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক বজায় রাখো”। এভাবে, রাসূল (স) আল্লাহ তাঁকে যা জানিয়েছিলেন, তা লুকিয়েছিলেন কারণ তিনি যায়েদকে এটা বলতে লজ্জা পাচ্ছিলেন যে, “তোমার স্ত্রী শীঘ্রই আমার স্ত্রী হবে।” [২১]
আরো বহুসংখ্যক আলেমও একইভাবে এটাকেই সূরা আহযাবের ৩৭ নং আয়াতের সঠিক ব্যাখ্যা বলেছেন। তাঁরা হলেনঃ
১/ ইবন শিহাব আয যুহরী (রহ) [২২]
২/ বাকর বিন আলা আল কুশাইরি (রহ) [২২]
৩/ হাকিম আল তিরমিযী (রহ) [২৩]
৪/ ক্বাযী ইবন আল আরাবী (রহ) [২৪]
৫/ আবু হাইয়্যান আল আন্দালুসি (রহ) [২৫]
৬/ ইবনুল কায়্যিম (রহ) [২৬]
৭/ ইবন কাসীর (রহ) [২৭]
৮/ ইবনে হাজার আল আসকালানি (রহ) [২৮]
৯/ আল বাক্বাঈ (রহ) [২৯]
১০/ আল-আলুসী (রহ)। [৩০]
ইমাম বাগাভী (রহ) ও তাঁর তাফসীরে বলেন,
وَهَذَا هُوَ الْأَوْلَى وَالْأَلْيَقُ بِحَالِ الْأَنْبِيَاءِ وَهُوَ مُطَابِقٌ لِلتِّلَاوَةِ لِأَنَّ اللَّهَ عَلِمَ أَنَّهُ يُبْدِي وَيُظْهِرُ مَا أَخْفَاهُ وَلَمْ يُظْهِرْ غَيْرَ تَزْوِيجِهَا مِنْهُ فَقَالَ: “زَوَّجْنَاكَهَا” فَلَوْ كَانَ الَّذِي أَضْمَرَهُ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ مَحَبَّتَهَا أَوْ إِرَادَةَ طَلَاقِهَا لَكَانَ يُظْهِرُ ذَلِكَ لِأَنَّهُ لَا يَجُوزُ أَنْ يُخْبِرَ أَنَّهُ يُظْهِرُهُ ثُمَّ يَكْتُمُهُ فَلَا يَظْهِرُهُ، فَدَلَّ عَلَى أَنَّهُ إِنَّمَا عُوتِبَ عَلَى إِخْفَاءِ مَا أَعْلَمَهُ اللَّهُ أَنَّهَا سَتَكُونُ زَوْجَةً لَهُ
“আর এটাই রাসূল (স) এর মর্যাদার সাথে মানানসই এবং ক্বুর’আনের তিলাওয়াতের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। কারণ, আল্লাহ জানতেন যে, রাসূল (স) যা গোপন করেছিলেন, তা তিনি প্রকাশ করে দিবেন এবং তিনি যায়নাবকে রাসূল (স) এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করার বিষয়টি ব্যতীত কিছুই প্রকাশ করেন নি। তিনি বলেছেন, “আমি তাকে আপনার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করলাম”। যদি রাসূল (স) যায়ানাবের প্রতি তাঁর ভালবাসা লুকিয়ে রাখতেন অথবা যায়েদ কর্তৃক যায়নাবকে তালাক দেয়ার আকাঙ্খা লুকিয়ে রাখতেন তাহলে তা ই প্রকাশ করা হতো। কারণ, এটা হতে পারে না যে, আল্লাহ প্রকাশ করবেন বলার পর প্রকাশ না করে লুকিয়ে রাখবেন। অতএব, এ থেকে এটিই প্রমাণিত হয় যে, রাসূল (স) কে তিরস্কার করা হয়েছিল কারণ যায়নাব তাঁর স্ত্রী হবেন – এটি আল্লাহ রাসূল (স) কে জানানোর পরও তিনি তা লুকিয়ে রেখেছিলেন। [৩১]
উল্লেখ্য, ইয়াসির ক্বাযী আবারও অ্যাকাডেমিক সততার আশ্রয় না নিয়ে ইমাম বাগাভীর সম্পূর্ণ উক্তি উল্লেখ না করে অর্ধেক উক্তি উল্লেখ করে নিজের মত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন এভাবে,
“And then he (Imam Baghawi) says, this interpretation is more befitting and appropriate for the ahwal and the maqamat of the anbiya. And that’s why it’s a good interpretation. Notice, why is it a good interpretation? Because, it fits with my understanding of how the Prophet (SAW) should act (this is what we call the ‘sanitization’), not because it fits with the Quranic context……” [*]
অর্থাৎ, ইয়াসির ক্বাযী বলেছেন, ইমাম বাগাভী এই ব্যখ্যাকে ভাল ব্যাখ্যা বলেছেন কারণ এটা রাসূল (স) এর মর্যাদার সাথে মানানসই, এই কারণে না যে এটা ক্বু’রানের কনটেক্সটের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। অথচ উপরে আমরা সরাসরি দেখলাম যে, ইমাম বাগাভী নিজেই অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বলেছেন, কীভাবে ক্বুর’আনের কনটেক্সটের সাথে এই ব্যাখ্যাটিই সঙ্গতিপূর্ণ। এটা ইয়াসির ক্বাযীর অ্যাকাডেমিক অসততা নয় কি?
এছাড়াও তিনি বলেন, তাফসীরে বাগাভীতে উল্লেখ করা আছে যে, ইবনে আব্বাস (রা) বলেছেন, রাসূল (স) তাঁর অন্তরে যা লুকিয়েছিলেন, তা হল যায়নাব (রা) এর প্রতি তাঁর ভালবাসা।
কিন্তু, যেটা ইয়াসির ক্বাযী বলেন নি, সেটা হল, ইবনে আব্বাস (রা) থেকে এ সম্পর্কিত বর্ণনার কোনো সনদই পাওয়া যায় না। ইমাম বাগাভীও এটা সনদ ছাড়াই উল্লেখ করেছেন এবং এর প্রতি যে ইমাম বাগাভী কোনো গুরুত্বই দেন নি এবং এটাকে যে কোনোভাবে সঠিক ই মনে করেন নি, তার প্রমাণ হলো, এই বর্ণনা উল্লেখ করার পরই ইমাম বাগাভী ক্বুর’আনের কনটেক্সটের আলোকে ব্যাখ্যা করেছেন রাসূল (স) অন্তরে যা লুকিয়েছিলেন তা হল আল্লাহপ্রদত্ত এই জ্ঞান যে, যায়নাব (রা) রাসূল (স) এর স্ত্রী হবেন। [উপরে আগেই উল্লেখ করা হয়েছে]
হাফেয ইবন হাজার আল-আসকালানী (রহ) তার বিখ্যাত কিতাব ‘ফাতহুল বারী’তে বলেনঃ
আলী ইবন হুসাইন (রহ) বলেছেন,
যায়নাব এর সাথে বিয়ের আগেই আল্লাহ তাঁর নবী (স) কে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে যায়নাব তাঁর স্ত্রীগণের মধ্যে শামিল হবেন। তারপরও যখন যায়েদ নবী (স) এর কাছে এসে যায়নাবের সম্পর্কে নিজের অসন্তুষ্ট মনোভাব প্রকাশ করলেন তখন নবী (স) যায়েদকে বলেছিলেন “আল্লাহকে ভয় করো করো এবং তোমার স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক বজায় রাখো”। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ আমি আপনাকে জানিয়েছিলাম যে আপনি যায়নাবের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবেন তারপরও আপনি তা নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলেন লুকিয়ে, অথচ আল্লাহ যা এরাদা করেছেন তা তো সম্পাদিত হবেই।
এরপর ইবনে হাজার (রহ) যেসব বর্ণনায় একথা রয়েছে যে,রাসূল (স) এর মনে যায়নাব (রা) এর প্রতি আকর্ষণ তৈরি হয়েছিলো,এবং তিনি তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছিলেন, সেইসব বর্ণনার দুর্বলতার কারণগুলো উল্লেখ করেছেন এভাবেঃ
১/ এই কাহিনী সম্বলিত বর্ণনাগুলো সনদের বিচারে নিতান্তই দূর্বল।
২/ ঘটনাটি রাসূল ﷺ এর নিষ্পাপ হওয়া এবং তাঁর উঁচু মাকামের পরিপন্থী।
৩/ যদি তিনি তাঁর মুহব্বতের ব্যাপারটিকেই লুকাতেন তাহলে আল্লাহ তা প্রকাশ করে দিতেন। কিন্তু আল্লাহ প্রকাশ করেছেন তাদের মধ্যে বিবাহ বন্ধনের কথা, যেমনটি ইমাম বাগাওয়ী নিজ তাফসিরে বলেছেন।
৪/ রাসূল ﷺ নিজেই যায়েদ বিন হারেছা (রা) এর সাথে যায়নাব (রা) এর বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে নিজ ফুপুর কাছে গিয়েছিলেন। এবং তিনি যায়নাব (রা) কে ছোটকাল থেকেই বড় হতে দেখছেন, তাহলে তখনই কেন উনার অন্তরে তাঁর প্রতি মুহব্বত পয়দা হলো না? কেন নিজ পালকপুত্রের সাথে বিবাহের পরেই উনার অন্তরে মুহব্বত পয়দা হবে? (ফাতহুল বারী ৮/৫২৪)
ইমাম কুরতুবি (রহ) বলেনঃ
আলি বিন আল হুসাইন থেকে বর্ণিত হয়েছে আল্লাহ তায়ালা ওহির মাধ্যমে রাসূল (সা) কে জানিয়ে দেন যায়েদ (রা) যায়নাব (রা) কে তালাক দিতে যাচ্ছেন। এবং তাঁর যায়নাব (রা) কে বিয়ে করা উচিত এই ভিত্তিতে যে আল্লাহ তাঁর বিয়ে যায়নাব (রা) এর সাথে দিচ্ছেন।
যখন যায়েদ (রা), যায়নাব (রা) এর আচরণের ব্যাপারে রাসূল (সা) এর কাছে অভিযোগ জানান এবং তাঁকে বলেন যে যায়নাব (রা) তাঁকে (যায়েদ রা কে) মান্য করছেন না, তাই তিনি তাঁকে তালাক দিতে চান, রাসূল (সা) যায়েদ (রা) কে ভালোভাবে বুঝিয়ে উপদেশ দেন, “তুমি যা বলছো, তার ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো কর এবং তোমার স্ত্রীকে রাখো”। কিন্তু তিনি জানতেন যায়েদ (রা), যায়নাব (রা) কে তালাক দিবেন এবং তিনি তাঁকে বিয়ে করবেন, এবং এটা তিনি গোপন রাখতে চাচ্ছিলেন। রাসূল (সা), যায়েদ (রা) কে তালাক দিতে বলতে চান নি। কারণ তিনি জানতেন তিনিই যায়নাব (রা) কে বিয়ে করতে যাচ্ছেন।
যায়েদ (রা) ছিলেন রাসূল (সা) এর আযাদকৃত দাস। রাসূল (সা) এর কথায় যায়েদ (রা), যায়নাব (রা) তালাক দেয়ার পর, তাঁকে রাসূল (সা) বিয়ে করলে মানুষ কি বলবে, এটা নিয়ে তিনি চিন্তিত ছিলেন। কিন্তু আল্লাহ অনুমতি দিয়েছেন এরকম কোনো জিনিস নিয়ে লোকে কি ভাববে এই ভয় করার জন্য এবং যায়েদ(রা), যায়নাব (রা) কে তালাক দিবেন এটা জানার পরও তাঁকে তাঁর স্ত্রীকে রাখতে বলার জন্য আল্লাহ রাসূল (সা) কে তিরস্কার করলেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন, আল্লাহই ভয়ের অধিক হকদার।
আমাদের আলেমরা (রহ) বলেন, এটাই এই আয়াতের সর্বোত্তম ব্যাখ্যা এবং প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিসিনগণ ও আলেমরা এই ব্যাখ্যাকেই গ্রহণ করেছেন। তাঁদের মধ্যে আছেন আল-যুহরি, আল কাদি বকর ইবন আল আলা আল কুশাইরি, আল কাদি আবু বকর ইবন আল আরাবি এবং আরো অনেকে।
“আপনি মানুষকে ভয় করেছেন” এই আয়াত দ্বারা মুনাফিকদের ষড়যন্ত্র নিয়ে রাসূল (সা) এর চিন্তার কথা বোঝানো হয়েছে। যেখানে তারা হয়তো বলতে পারতো, তিনি পুত্রবধু বিয়ে করা হারাম করেছেন কিন্তু নিজেই আবার নিজ পুত্রবধুকে বিয়ে করেছেন।
আর যে বর্ণনায় বলা হয়েছে রাসূল (সা) যায়নাব (রা) কে পছন্দ করতেন (কিছু কিছু নৈতিকতা বিবর্জিত মানুষ “প্রেমে পড়া” বা “ভালবাসা” শব্দ পর্যন্ত ব্যাবহার করে), এই ধরনের বর্ণনা তাদের কাছ থেকে আসে, যারা রাসূল (সা) মাসুম হবার ব্যাপারে অজ্ঞ, যারা জানে না যে আল্লাহ তায়ালা রাসূল (সা) কে এসব থেকে হিফাজত করেছেন অথবা যারা রাসূল (সা) কে সম্মান করে না।
(তাফসির আল কুরতুবি ১৪/১৯০-১৯১)
শায়েখ আল শানকিতি (রহ) বলেনঃ
এই ব্যাপারে সঠিক মত ইনশা আল্লাহ এটাই এবং যার দিকে পবিত্র কুরআনেও ইঙ্গিত করা হয়েছে, যায়নাব (রা) যায়েদ (রা) এর স্ত্রী থাকা অবস্থায় আল্লাহ তায়ালা রাসূল (সা) কে বলেন যে, যায়েদ (রা) যায়নাব (রা) কে তালাক দিবেন এবং তারপর আল্লাহ তাঁর সাথে রাসূল (সা) এর বিয়ে দিবেন।
যখন যায়েদ (রা) তাঁর নিকট অভিযোগ জানালেন, তখন তিনি তাঁকে বলেন, “তোমার স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক বজায় রাখো এবং আল্লাহকে ভয় করো করো”।
যায়নাব (রা) তাঁর স্ত্রী হবেন, এটা জানার পরও যায়েদ (রা) কে “তোমার স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক বজায় রাখো” বলার কারণে আল্লাহ তাঁকে তিরস্কৃত করেন। তিনি এরুপ করেছিলেন এই চিন্তা থেকে যে, যদি তিনি যা জানেন তা প্রকাশ করে দেন, তাহলে মানুষ বলতে পারে যে তিনি তাঁর পুত্রের বিবাহিত স্ত্রী কে বিয়ে করতে চাচ্ছেন।
এই ক্ষেত্রে দুটো বিষয় লক্ষণীয়-
প্রথমটা হলো, যা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন, “আপনি তা নিজের মধ্যে রেখেছিলেন, যা আল্লাহ প্রকাশ করে দিবেন”। আল্লাহ তাঁর কাছে এটাই প্রকাশ করেন যে, তিনি তাঁর বিবাহ যায়নাব (রা) এর সাথে দিবেন, যখন আল্লাহ বলেন, “ যখন যায়েদের তার প্রতি সকল আকর্ষণ শেষ হয়ে গেলো, তখন আমরা তার সাথে আপনার বিয়ে দিয়ে দিলাম”। তারা যা বলে থাকে (তিনি তাঁকে ভালোবাসতেন নাউজুবিল্লাহ), সেরকম কিছুই আল্লাহ প্রকাশ করেননি। যদি সেরকম কিছু হতো, তাহলে আল্লাহ তাই প্রকাশ করতেন।
দ্বিতীয়টা হলো, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা পরিষ্কার বলেছেন, যে তিনিই যায়নাব (রা) এর সাথে রাসূল (সা) এর বিয়ে দিয়েছেন। এবং এই বিয়ের পেছনে হিকমাহ হলো, পালকপুত্রের স্ত্রীদের বিয়ের ব্যাপারে আরব সমাজে যে নিষেধাজ্ঞা আছে, তার পরিসমাপ্তি ঘটানো। আল্লাহ বলেন, “যখন যায়েদের তাঁর প্রতি সকল আকর্ষণ শেষ হয়ে গেলো, তখন আমরা তাঁর সাথে আপনার বিয়ে দিয়ে দিলাম, যাতে করে (ভবিষ্যতে) মুমিনদের মধ্যে পালকপুত্রদের স্ত্রীদের ব্যাপারে (বিয়ের ক্ষেত্রে) কোনো অসুবিধা না থাকে”। এখানে “যাতে করে (ভবিষ্যতে) মুমিনদের মধ্যে কোনো অসুবিধা না থাকে” এই অংশটুকু থেকে এই বিয়ের কারণ পরিষ্কার বুঝা যায়। আল্লাহ তায়ালা এই গুরুত্বপূর্ণ কারণে স্বয়ং যায়নাব (রা) এর সাথে তাঁর বিয়ে দিয়েছেন।
এখান থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, তারা যে দাবী করে থাকে, যে রাসূল (সা) যায়নাব (রা) কে বিয়ে করেন কারণ তিনি তাঁকে ভালবাসতেন (নাউজুবিল্লাহ) এবং এই কারণে যায়েদ (রা) তাঁকে তালাক দেন, তা সম্পূর্ণ ভুল।
রাসূল (সা) এই কারণে যায়নাব (রা) কে বিয়ে করেননি। এটার ব্যাখ্যা আল্লাহ রব্বুল আলামিন কুরআনে স্পষ্ট বলেন “যখন যায়েদের তাঁর প্রতি সকল আকর্ষণ শেষ হয়ে গেলো”। অর্থাৎ যায়েদ (রা) এর সকল আকর্ষণ শেষ হয়ে গিয়েছিল যায়নাব (রা) এর প্রতি, এবং তিনি তাঁর প্রতি একেবারেই আগ্রহী ছিলেন না। তাই তিনি তাঁকে তালাক দিয়ে দেন। ওয়াল্লাহু আ’লাম।
আদওয়া আল-বয়ান (৬/৫৮২,৫৮৩)
হাফেয ইবনে কাসীর (রহ) বলেন,
এই জায়গায় ইবনে আবি হাতিম (রহ) এবং ইমাম তাবারী (রহ) সঠিক নয় এরুপ বহু ‘আসার’ বর্ণনা করেছেন, যেগুলো বর্ণনা করা উচিত নয় মনে করে আমরা ছেড়ে দিলাম। কেননা ওগুলোর মধ্যে একটিও প্রমাণিত ও সঠিক নয়। মুসনাদে আহমাদেও হযরত আনাস (রা) হতে একটি বর্ণনা রয়েছে। কিন্তু তাতেও বড়ই অস্বাভাবিকতা পরিলক্ষিত হয়। এ জন্যে আমরা সেটাও বর্ণনা করলাম না।
তাফসীরে ইবনে কাসীর (১৫/৮০৫)
অর্থাৎ, উপরিউক্ত আলোচনা থেকে কোনো সন্দেহ ছাড়াই এটি স্পষ্ট যে, এই উম্মাতের মাঝে এ ব্যাপারে কোনো মতবিরোধই নেই যে, উক্ত ঘটনা সম্পর্কে বর্ণিত প্রত্যেকটা বর্ণনাই অগ্রহণযোগ্য এবং আদতে এরকম কোনো ঘটনা কোনোদিন ঘটেই নি।
বরং, রাসূল (সা) যায়নাব (রা) কে বিয়ে করেছিলেন কেবলই আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক, যাতে পালকপুত্রের স্ত্রীকে বিয়ে করার মাধ্যমে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় যে, শরীয়তের দৃষ্টিতে পালকপুত্র আপন পুত্রের মত নয়।
ক্বাতাদাহ (রহ) এর বর্ণনার অপব্যাখ্যাঃ
ইয়াসির ক্বাযী ক্বাতাদাহ (রহ) থেকে একটি বর্ণনা উল্লেখ করে বলেন,
“Abdul Razzaq al-San‘ani mentions an authentic narration back to Qatadah and Qatadah has, ‘what the Prophet (SAW) hid in his heart was the desire that Zaid divorce Zainab in order that eventually he can marry and he feared what people might say if he commanded Zaid to divorce her.’ This is from Qatadah”[*]
অনুবাদঃ “আব্দুর রাযযাক আস-সানানি ক্বাতাদাহ থেকে সহীহ সনদে বর্ণনা করেন, ‘রাসূল (স) তাঁর অন্তরে এই ইচ্ছা গোপন করেছিলেন যে, যায়েদ যেন যায়নাবকে তালাক দেন, যেন পরবর্তীতে তিনি বিয়ে করতে পারেন এবং তিনি ভয় করেছিলেন যে, লোকে কী বলবে যদি তিনি যায়েদকে বলেন যায়নাবকে তালাক দিতে।
এবার আমরা দেখি আব্দুর রাযযাক আস-সানানি উল্লেখিত, ক্বাতাদাহ (রহ) থেকে বর্ণিত বর্ণনাটা আসলে কীঃ
عن معمر , عن قتادة … قال قتادة: جاء زيد النبي صلى الله عليه وسلم فقال: إن زينب اشتد علي لسانها , وأنا أريد أن أطلقها , قال له النبي صلى الله عليه وسلم: {أمسك عليك زوجك واتق الله} [الأحزاب: 37] , والنبي يحب أن يطلقها ويخشى قالة الناس إن أمره أن يطلقها , فأنزل الله تعالى: {وتخفي في نفسك ما الله مبديه وتخشى الناس والله أحق أن تخشاه فلما قضى زيد منها وطرا} [الأحزاب: 37] قال قتادة: لما طلقها زيد {زوجناكها} [الأحزاب: 37]
অনুবাদঃ
মা’মার ক্বাতাদাহ থেকে বর্ণনা করেন, ক্বাতাদাহ বলেছেন- যায়েদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট এসে বলে্নঃ “যায়নাব তার ভাষার মাধ্যমে আমার উপর কঠিন হয়েছে, আমি তাকে তালাক দিতে চাই। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “তোমার স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক বজায় রাখো এবং আল্লাহকে ভয় করো।” তবে রাসূলুল্লাহ (সা) চেয়েছিলেন তিনি তাকে তালাক দিয়ে দেন, কিন্তু ভয় পেয়েছিলেন যে, তিনি যায়েদকে তালাক দিতে বললে মানুষ কী বলবে। আল্লাহ নাযিল করেন, “আপনি অন্তরে এমন বিষয় গোপন করেছিলেন, যা আল্লাহ প্রকাশ করে দিবেন। আপনি লোকনিন্দার ভয় করেছিলেন অথচ আল্লাহকেই অধিক ভয় করা উচিত। অতঃপর যখন যায়েদের তার প্রতি সকল আকর্ষণ শেষ হয়ে গেলো, ক্বাতাদাহ বলেছেন, অর্থাৎ যখন যায়েদ যায়নাবকে তালাক দিল, তখন আমি তাকে আপনার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করলাম” [৩২]
লক্ষ্যণীয় বিষয়ঃ
(১) এই বর্ণনার সনদ মুরসাল। তথা এর সনদ রাসুল সাঃ পর্যন্ত যাওয়ার আগেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। কারণ, ক্বাতাদাহ (রহ) একজন তাবেঈ, তিনি কোন সাহাবীর কাছ থেকে এ বর্ণনা শুনেছেন তা উল্লেখ করা হয় নি।
(২) মুহাদ্দিসে কেরাম ক্বাতাদাহ (রহ) এর মুরসাল বর্ণনা তেমন একটা গ্রহণ করেন নি। ইবনে হাজার আসকালানি (রহ) এর বিখ্যাত কিতাব তাহযীব আল-তাহযীব এ ক্বাতাদাহ (রহ) এর সমালোচনা উল্লেখিত হয়েছে।
আবু ‘আমর ইবন আল-’আলা তার সম্পর্কে বলেনঃ ক্বাতাদাহ এবং ‘আমর ইবন শুয়াইব সবার থেকেই বর্ণনা নিতেন, তারা কোন বর্ণনাকেই মিথ্যা ভাবতেন না। [৩৩]
শা’বি তার সম্পর্কে বলেছেন,
“তিনি হলেন এমন একজন যিনি অন্ধকারে লাকড়ি কুড়াতে গিয়ে বুঝতে পারেন না কোনটা লাকড়ি আর কোনটা সাপ, তারপর সাপের কামড়ে মারা পড়েন।” [৩৪]
মুরসাল বা তাবেঈদের সূত্র বিচ্ছিন্ন বর্ণনা শর্তসাপেক্ষে বিভিন্ন সময় গ্রহণযোগ্য হলেও,ক্বাতাদার মাঝে সেসব শর্তের কোনটাই ছিলোনা যার ভিত্তিতে তার এরকম বর্ণনা গ্রহণ করা যায়। রিজাল শাস্ত্রবিদগণ প্রায় সকলেই এব্যাপারে একমত যে, ক্বাতাদাহ যদি মুরসাল বা সূত্র বিচ্ছিন্ন কোন হাদীস বর্ণনা করেন,তাহলে তা গ্রহন করা যাবে না। এ ব্যাপারে ক্বাতাদার অন্যতম ছাত্র শু’বা ইবনে হাজ্জাজের কথাটি স্মর্তব্য। তিনি বলেন, ক্বাতাদাহ হাদীস বলতেন তখন আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। যখন দেখতাম তিনি সূত্র সহ হাদীস বলছেন,তখন সেটা লিখে নিতাম,আর যখন সূত্র ছাড়া বলতেন,তখন সেটা এড়িয়ে যেতাম,লিখতাম না।
(৩) তথাপি, তর্কের খাতিরে ক্বাতাদাহ (রহ) এর এই মুরসাল বর্ণনাটি মেনে নিলেও এর মাধ্যমে ইয়াসির ক্বাযী যা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন, তা কোনোভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয় না।
ইয়াসির ক্বাযী এক্ষেত্রেও নিজের মতামত প্রতিষ্ঠা করার জন্য বর্ণনাতে নেই এমন অংশ উল্লেখ করেছেন। এই বর্ণনার কোথাও “in order that eventually he can marry”/“যেন পরবর্তীতে তিনি বিয়ে করতে পারেন” অংশটির কোনো অস্তিত্বই নেই।
এই অংশটুকু বাদ দিলে এই বর্ণনা থেকে কোনোভাবেই প্রকাশ পায় না যে রাসূল (স) এর আকাঙ্খা ছিল যায়নাব (রা) কে বিয়ে করার। আবার এই বর্ণনায় রাসূল (স) যায়েদ (রা) এর বাড়িতে গিয়ে যায়নাব (রা) কে দেখে তাঁর প্রতি রাসূল (স) এর মনে অনুভূতি সৃষ্টি হওয়ার ঘটনাটির কোনো উল্লেখ নেই। বরং, এই বর্ণনা থেকে এটা পরিষ্কার যে, যায়েদ (রা) রাসূল (স) এর কাছে যায়নাব (রা) এর ব্যাপারে অভিযোগ জানাতে এসেছিলেন এবং বলেছিলেন তিনি যায়নাব (রা) কে তালাক দিতে চান। আবার আলী ইবন হুসাইন (রহ) থেকে বর্ণিত সহীহ বর্ণণা, পবিত্র কুর’আনের সূরা আহযাবের ৩৭ নং আয়াতের শব্দাবলি এবং উম্মাহর শ্রেষ্ঠ মুফাসসিরদের সেই আয়াতের তাফসীরের আলোকে এটা পরিষ্কার যে, আল্লাহ তা’আলা রাসূল (স) কে আগেই জানিয়েছিলেন, তিনি যায়নাব (রা) কে রাসূল (স) এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করবেন। [উপরে আগেই এ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে]
কিন্তু যায়েদ (রা) রাসূল (স) এর কাছে যায়নাব (রা) এর প্রতি অভিযোগ জানানো ও যায়নাব (রা) কে তালাক দেয়ার ইচ্ছা পোষণ করার পরও রাসূল (স) নিজে থেকে যায়েদ (রা) কে তালাক দেয়ার নির্দেশ দেন নি কারণ তিনি ভয় করেছিলেন যে, তিনি যদি তার পালকপুত্রকে নিজের স্ত্রীকে তালাক দেয়ার নির্দেশ দিয়ে এরপর পালকপুত্রের পূর্বের স্ত্রীকে বিয়ে করেন তাহলে লোকেরা কী বলাবলি শুরু করবে। এ ব্যাপারেই সূরাহ আহযাবের ৩৭ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন,
“আপনি লোকনিন্দার ভয় করেছিলেন অথচ আল্লাহকেই অধিক ভয় করা উচিত”।
অতএব, ক্বাতাদাহ (রহ) এর এই মুরসাল বর্ণনাটি গ্রহণ করলেও, এই বর্ণনা থেকে এটাই বুঝা যায় যে,
রাসূল (স) যেহেতু আগে থেকেই জানতেন, তাঁর সাথে যায়নাব (রা) এর বিয়ে হবে, তাই রাসূল (স) চাচ্ছিলেন, যায়েদ (রা) যদি যায়নাব (রা)কে তালাক দেন, নিজে থেকেই যেন দেন, তাঁর যেন নির্দেশ দেয়া না লাগে।
ইবনুল কায়্যিম (রহ) এর বক্তব্যের ভুল উপস্থাপন:
ইয়াসির ক্বাযী তার লেকচারে ইবনুল কায়্যিম (রহ) কে তার মতের পক্ষে উপস্থাপন করতে গিয়ে বলেছেন,
“…that’s why you have always some intellectual giants Ibn Taymīyyah Ibn ul-Qayyim are always those who are willing to go against the flow – go back to the original – and be very clear, and Ibn ul-Qayyim is one of those who has no problems going back to the original and telling it like it is. Ibn ul-Qayyim is obviously Ibn Taymīyyah’s main student, and died 758 [Hijrī], has his famous book “Ad Dau Wad Dawa” (The Disease and the Cure), and this is a book all about love and the problems of love and the cure for Ḥarām love, the whole book is about love between – so love – it’s like the lustful love.
Ibn ul-Qayyim mentions – he has a long chapter regarding the dangers of Ḥarām love and then he follows this by mentioning the blessings and permissibility of other types of love. Then he mentions that the Prophet (PBUH) saw Zainab and said ‘subhanaka muqallibal qulub’. So, he’s going back to “Version A” which now has not been mentioned by Ibn Kathīr, but of course Ibn ul-Qayyim is going back, and that after Zaid divorced her Allāh himself married her to the Prophet (PBUH). So in the chapter of ‘Halal and permissible love’ he mentions the story that we just mentioned, okay, this is Ibn ul-Qayyim. This is Ibn ul-Qayyim doing this.” [*]
অর্থাৎ, ইয়াসির ক্বাযী বলেছেন, ইবনুল কায়্যিম (রহ) তার বই الداء و الدواء (রোগ ও প্রতিকার) এ ‘হালাল ভালবাসা’ অধ্যায়ে উক্ত ঘটনা এনেছেন এবং এটা থেকে ইয়াসির ক্বাযী বলেছেন, ইবনুল কায়্যিম (রহ) স্রোতের বিপরীতে গিয়ে ‘আসল ঘটনা’ বর্ণনা করেছেন।
এবার আমরা দেখি আসলে ইবনুল কায়্যিম (রহ) এ ঘটনার ব্যাপারে কী বলেছেনঃ
(১) ইয়াসির ক্বাযী বলেছেন, ইবনুল কায়্যিম (রহ) তার বই الداء و الدواء (রোগ ও প্রতিকার) এ ‘হালাল ভালবাসা’ অধ্যায়ে উক্ত ঘটনা এনেছেন।
প্রকৃতপক্ষে, ইবনুল কায়্যিম (রহ) তার বই الداء و الدواء (রোগ ও প্রতিকার) এ
اعتراض علي المصنف بذكر فوائد العشق (প্রেমের গুণাগুণ উল্লেখের মাধ্যমে লেখকের উপর আপত্তি) শিরোনামের অধীনে তাদের বক্তব্য ও যুক্তি তুলে ধরেছেন যারা প্রেমের গুণাগুণ উল্লেখ করে ইবনুল কায়্যিম (রহ) এর প্রতি আপত্তি তোলে এবং এর পক্ষে তারা যে কাহিনীগুলো উল্লেখ করে থাকে, সেগুলো তিনি এনেছেন من قصص العشا ق (প্রেমিকদের কাহিনী) শিরোনামের অধীনে। এই শিরোনামের অধীনেই ইয়াসির ক্বাযী যেই ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন সেই ঘটনাটি ইবনুল কায়্যিম (রহ) তার বইতে উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ, এই ঘটনা তিনি উল্লেখ করেছেন এর সত্যতা দাবি করে নয়,বরং বিরোধী মত হিসেবে এবং এর খণ্ডন করার জন্য। এজন্যই, এরপরই ঐ বইতেই
الر د علي المعترض (আপত্তিকারীর খণ্ডন) শিরোনামের অধীনে ইবনুল কায়্যিম (রহ) তাদেরকে খণ্ডন করা শুরু করেন। অতঃপর ঐ বইতেই
قصة زينب بنت جحش علي الو جه الصحيح ( যাইনাব বিনতে জাহশের ঘটনার বিশুদ্ধ বিবরণ) শিরোনামের অধীনে তিনি রাসূল (স) এর সাথে যায়নাব (রা) এর বিয়ে সম্পর্কে নিজের মত ব্যক্ত করেন এভাবেঃ
وأما قصة زينب بنت جحش، فزيد كان فد عزم على طلاقها ولم توفته، وكان يستشير النبي صلى الله عليه وسلم في فراقها ، وهو يأمره بإمسكها، فعلم رسول الله صلى الله عليه وسلم أنّه مفارقها ولا بدّ، فأخفى في نفسه أن يتزوجها إذا فارقها زيد، وحشي مقالة الناس أنّ رسول الله صلى الله عليه وسلم تزوج زوجة ابنه، فإنّه كان قد تبني زيدًا قبل النبوة، والربُّ تعالى يريد أن يشرع شرعًا عامًّا فيه مصالح عباده.
“আর যাইনাব বিনতে জাহশের কাহিনী হলো- যায়েদ তাকে তালাক দেয়ার সিদ্ধান্ত স্থির করে ফেলেছিলেন,যেহেতু তাদের বনিবনা হয়নি। সেজন্য তিনি রাসূল (স) এর পরামর্শ চাইলেন। রাসূল (স) তাকে তালাক না দিতে আদেশ করছিলেন। যদিও রাসূল (স) নিশ্চিতভাবেই জানতেন যে,যায়েদ তাকে তালাক দিবেনই। যায়েদ তাকে তালাক দেয়ার পর রাসূল (স) তাকে বিবাহ করবেন, এ ব্যাপারটি তিনি মনেমনে গোপন রাখেন,মানুষের সমালোচনার আশঙ্কায়- লোকেরা বলাবলি করবে যে, রাসূল (স) তার সন্তানের স্ত্রী কে বিবাহ করে ফেলেছেন। কেননা তিনি নবুওয়তের পূর্বে যায়েদকে পালকপুত্র হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু আল্লাহ চেয়েছেন এর মাধ্যমে একটি ব্যাপক বিধানকে প্রতিষ্ঠিত করতে, সকলের সুবিধার্থে।” [৩৫]
(২) ইবনুল কায়্যিম (রহ) তার বিখ্যাত কিতাব ‘যাদুল মা’আদ’ এ আরো শক্ত ভাষায় উক্ত ঘটনার প্রতিবাদ করে লিখেন,
وأما ما زعمه بعض من لم يقدر رسول الله – صلى الله عليه وسلم – حق قدره أنه ابتلي به في شأن زينب بنت جحش، وأنه رآها فقال: ( «سبحان مقلب القلوب» ) . وأخذت بقلبه، وجعل يقول لزيد بن حارثة: أمسكها حتى أنزل الله عليه: {وإذ تقول للذي أنعم الله عليه وأنعمت عليه أمسك عليك زوجك واتق الله وتخفي في نفسك ما الله مبديه وتخشى الناس والله أحق أن تخشاه} [الأحزاب: 37] ، فظن هذا الزاعم أن ذلك في شأن العشق، وصنف بعضهم كتابا في العشق، وذكر فيه عشق الأنبياء، وذكر هذه الواقعة، وهذا من جهل هذا القائل بالقرآن وبالرسل، وتحميله كلام الله ما لا يحتمله، ونسبته رسول الله – صلى الله عليه وسلم – إلى ما برأه الله منه
অনুবাদঃ নবী (স) কে তাঁর মাকাম অনুযায়ী সম্মান করে না এমন কিছু মানুষ একটি মিথ্যা দাবি ছড়িয়েছে যে, নবী (স) নাকি একবার যায়নাব বিনতে জাহশকে দেখে বলেছিলেন, ‘সকল প্রশংসা তাঁর যিনি অন্তরসমূহের পরিবর্তনকারী!’ তারা আরও দাবি করে থাকে, নবী (স) কে তখন এই ইশক নামক ব্যধিটি আক্রান্ত করেছিল আর তিনি যায়নাবকে পছন্দ করেছিলেন। কিন্তু তবুও তিনি যায়েদকে বলেছিলেন যায়নাবকে তালাক না দিতে। তারপর এই আয়াতটি নাযিল হয়ঃ
“আল্লাহ যাকে অনুগ্রহ করেছেন; আপনিও যাকে অনুগ্রহ করেছেন; তাকে যখন আপনি বলেছিলেন, তোমার স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক বজায় রাখো এবং আল্লাহকে ভয় কর। আপনি অন্তরে এমন বিষয় গোপন করেছিলেন, যা আল্লাহ প্রকাশ করে দিবেন। আপনি লোকনিন্দার ভয় করেছিলেন অথচ আল্লাহকেই অধিক ভয় করা উচিত। অতঃপর যায়েদ যখন যায়নাবের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করল, তখন আমি তাকে আপনার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করলাম যাতে মুমিনদের পোষ্যপুত্ররা তাদের স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলে সেসব স্ত্রীকে বিবাহ করার ব্যাপারে মুমিনদের কোন অসুবিধা না থাকে। আল্লাহর নির্দেশ কার্যে পরিণত হয়েই থাকে।” (সূরা আল-আহযাবঃ ৩৭)
যারা এই মিথ্যা দাবিটি করে ,তারা আরও বলে যে, এই আয়াতটিতে ইশক এর কথা বলা হয়েছে। এভাবে তাদের অনেকে ইশক নিয়ে একটি বইও লিখেছে, যেখানে তারা অনেক নবীর এই ইশক এর ব্যধিতে আক্রান্ত হবার ঘটনা এনেছে,এমনকি মুহাম্মাদ (স) এর ও! আসলে এরা অকাট মূর্খ, এরা না বুঝে কুর’আন আর না জানে নবীদের সম্পর্কে; তাদের মতো করে বুঝতে গেলে তো আল্লাহর কালামের অর্থই বদলে দিতে হবে। আর তারা নবী (স) এর উপর এমন অভিযোগ আনে,যা থেকে তিনি পবিত্র। [৩৬]
অর্থাৎ, ইয়াসির ক্বাযী ইবনুল কায়্যিম (রহ) এর বই থেকে তাঁর খন্ডিত বক্তব্য উল্লেখ করে এ কথা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছেন যে, ইবনুল কায়্যিম (রহ) এই ঘটনার পক্ষে। অথচ প্রকৃতপক্ষে, ইবনুল কায়্যিম (রহ) সম্পূর্ণরুপে এই ঘটনার বিপক্ষে। যারা এই ঘটনাকে সমর্থন করে, ইবনুল কায়্যিম (রহ) তাদেরকে অকাট মূর্খ বলেছেন, অথচ ইয়াসির ক্বাযী বলেছেন, ইবনুল কায়্যিম (রহ) নিজেই এই ঘটনার পক্ষে!
এভাবে একজন বিখ্যাত মুসলিম স্কলারের বক্তব্য কে ভুলভাবে উপস্থাপন করার মাধ্যমে ইয়াসির ক্বাযি তার একাডেমিক সততাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন।
ইয়াসির ক্বাযীর আরো কিছু বক্তব্য ও তার খণ্ডনঃ
(১) ইয়াসির ক্বাযী তার লেকচারে বলেছেন,
“আমাদের এই আলাপ-আলোচনায় বেশ কিছু বাস্তবতা উঠে আসবে। একজন অ্যাকাডেমিক মানুষ হিসেবে আমি অহেতুক কোনো বিষয়কে রং দিয়ে রঙিন করে রাখতে চাই না। বরং যা প্রকৃত বাস্তবতা তা নিয়েই নির্মোহভাবে পর্যালোচনা করতে আগ্রহী” [*][iii]
কিন্তু, অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় হলো,তিনি তার লেকচারে এত সময় ধরে এত কথা বলার মাঝে একটিবারের জন্যও উক্ত ঘটনা যেসব বর্ণনায় উল্লেখিত হয়েছে, সে বর্ণনাগুলোর একটিরও সনদ বা মতন একবারের জন্যও যাচাই করেন নি। তাহলে কীভাবে এটি একজন অ্যাকাডেমিকের অ্যাপ্রোচ হতে পারে? একটি ঘটনা আসলেই ঘটেছে না কি ঘটে নি, তা যাচাই করার সর্বপ্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ণ মাধ্যম হলো এর সনদ যাচাই করা। এটা করা ছাড়া কীভাবে একজন মানুষ সে বিষয়ে নিজের মতামত দিতে পারেন, আবার নিজের অ্যাপ্রোচকে অ্যাকডেমিক অ্যাপ্রোচ বলতে পারেন?
(২) ইয়াসির ক্বাযী খুব জোরালোভাবে উল্লেখ করেছেন যে উক্ত ঘটনার বর্ণনা ক্লাসিক যুগের বিভিন্ন গ্রন্থ যেমনঃ মুকাতিল বিন সুলাইমান, তাবারি, তাফসিরে সালাবী ইত্যাদি গ্রন্থে পাওয়া যায়।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, ক্লাসিক যুগের কোনো গ্রন্থে কোনো ঘটনা উল্লেখ থাকা বা না থাকা দিয়ে কী আসে যায়? কোনো একটি বর্ণনা ক্লাসিক যুগের কোনো গ্রন্থে উল্লেখ থাকার মানেই কি সেই বর্ণনা সঠিক ও প্রমাণিত?
তাহলে ইসলামের ইলমি জগতে রিজাল শাস্ত্র, হাদিস শাস্ত্রের অস্তিত্বের প্রয়োজনীয়তাই কি ছিল?
বরং, এ কথা তো ইলমি জগতের শিশুও জানে যে, ক্লাসিক যুগের এসব গ্রন্থে লেখকগণ যত বর্ণনা সংগ্রহ করেছেন, তার প্রত্যেকটিই লেখকের নিজের বক্তব্য নয়। যেমনঃ ইয়াসির ক্বাযী বলেছেন, তাফসীরে সা’লাবীতে উক্ত ঘটনার উল্লেখ আছে। অথচ, ইমাম আহমাদ ইবন মুহাম্মাদ আস-সালাবী (রহ) তাঁর তাফসীরে সূরা আহযাবের ৩৭ নং আয়াতের তাফসীর যে উক্ত ঘটনা ও ইয়াসির ক্বাযীর মতের সম্পূর্ণ বিপরীতভাবে করেছেন, তা আমরা উপরের আলোচনাতেই দেখেছি। আবার ইয়াসির ক্বাযী বলেছেন, ইবনুল কায়্যিম (রহ) তার কিতাব الداء و الدواء (রোগ ও প্রতিকার) এ উক্ত ঘটনা উল্লেখ করেছেন। অথচ ইবনুল কায়্যিম (রহ) যে তার কিতাব الداء و الدواء (রোগ ও প্রতিকার) এ উক্ত ঘটনা উল্লেখ করে নিজেই সেটাকে খণ্ডন করেছেন এবং তার আরো বিখ্যাত কিতাব ‘যাদুল মা’আদ’-এ ও যে কঠোর ভাষায় উক্ত ঘটনাকে খণ্ডন করেছেন, সেটাও আমরা উপরের আলোচনাতে দেখেছি। এছাড়া মুকাতিল ইবন সুলাইমান ও তাবারির বর্ণনার সমস্যা ও অগ্রহণযোগ্যতার কারণও আমরা উপরে আলোচনা করেছি।
কোনো একটি বর্ণনায় সত্য বলা হয়েছে না মিথ্যা বলা হয়েছে, তা যাচাইয়ের জন্যই তো আলেমগণ যুগের পর যুগ ধরে অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে পরিশ্রম করে গড়ে তুলেছিলেন “হাদীস শাস্ত্র” ও “রিজাল শাস্ত্র”। তাঁরা দেখিয়েছিলেন কীভাবে একটি বর্ণনা সঠিক, দুর্বল কিংবা মিথ্যা কিনা তা নির্ণয় করা যায়। একটি হাদীসের মূলত দুটি ভাগ থাকে। একটি হচ্ছে সনদ বা বর্ণনাকারীদের পরম্পরাসূত্র, এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে মতন বা টেক্সট। একটি হাদীস বেশ কয়েকজন রাবী (হাদীস বর্ণনাকারী) বর্ণনা করে থাকেন; যদি প্রত্যেক রাবী বিশ্বস্ত এবং ধারাবাহিক না হয়ে থাকেন, তবে সে হাদীস গ্রহণযোগ্য হয় না। ইবনে জারীর আত-তাবারী(রহ) তার গ্রন্থে হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে এ নীতির প্রয়োগ করেননি। তিনি ভালো-খারাপ সকল ব্যক্তির কাছ থেকেই বর্ণনা গ্রহণ করেছেন। তার আল তারিখ গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি লিখেন,
“আমি পাঠকদের সতর্ক করতে চাই যে, এই বইয়ে আমি কিছু মানুষ আমার নিকট যে খবর বর্ণনা করেছে তার উপর নির্ভর করে সবকিছু লিখেছি। আমি কোন যাচাই-বাছাই ছাড়াই গল্পগুলোর উৎস হিসেবে বর্ণনাকারীদেরকে (ধরে) নিয়েছি………। যদি কেউ আমার বইয়ে বর্ণিত কোন ঘটনা পড়ে ভয় পেয়ে যান, তাহলে তার জানা উচিৎ যে, এই ঘটনা আমাদের কাছ থেকে আসেনি। আমরা শুধুমাত্র তাইই লিখেছি যা বর্ণনাকারীদের কাছ থেকে পেয়েছি।”
ইবনে কাসীর(রহ), ইবনে জারীর আত-তাবারী(রহ) এর এই নীতির সমালোচনা করে লিখেন, “ইমাম ইবনে জারীর(রহ) সঠিক নয় এরূপ বহু অসার বর্ণনা করেছেন, যেগুলো বর্ণনা করা উচিৎ নয় বলে আমরা তা ছেড়ে দিলাম। কেননা, এগুলোর মধ্যে একটিও প্রমাণিত ও সঠিক নয়।” [৩৭]
ইবনে হাজার(রহ) এ ব্যাপারে বলেন, “এটি তাবারীর একক বিষয় নয় এবং এই বিষয়ে তাকে পৃথকভাবে দোষ দেয়ার কিছু নেই। দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দী থেকে পরবর্তী যুগের অধিকাংশ মুহাদ্দিসগণ মনে করতেন যে, সনদসহ সহীহ হাদীস উল্লেখ করলেই দায়িত্ব পালিত হয়ে গেল এবং তারা যিম্মাদারী থেকে মুক্ত হয়ে গেলেন।” [৩৮]
(৩) নিজে একটি বারও সনদ বা মতন যাচাই না করার পাশাপাশি ইয়াসির ক্বাযী উল্টো যেসব আলেম এই ঘটনাকে অগ্রহণযোগ্য বলেছেন, তাঁদের ব্যাপারে বলেছেন,
“যারা এ কাজ করেছেন, তারা সবাই ভালো মানের স্কলার। তাদের হয়তো কোনো অভিসন্ধিও নেই। কিন্তু মানুষের স্বাভাবিক যে ফিতরাত, তার আলোকেই এ কাজগুলোকে মূল্যায়ন করা দরকার। আমরা যাকে পছন্দ করি, তাকে নিয়ে বিব্রতকর বিষয় এড়িয়ে যাই বা অন্য কোনোভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি। এ ধরনের আচরণ অস্বাভাবিক নয়।”[*][iv]
আমরা জোরালোভাবে বলতে চাই, নিঃসন্দেহে, ইয়াসির ক্বাযী এক্ষেত্রে ইসলামের ইতিহাসের নিষ্ঠাবান আলেমদের সম্পর্কে একটি মারাত্মক ভুল কথা বলেছেন। আমরা উপরের আলোচনায় আগেই দেখেছি, ইবনে হাজার, ইবনে কাসীরের মতো এই উম্মাতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেমরা এই ঘটনাকে অগ্রহণযোগ্য বলেছেন সনদ যাচাইয়ের মাধ্যমেই, নিজের ব্যক্তিগত বিব্রতবোধের জন্য নয়।
(৪) ইবনে হাজার আল-আসকালানি (রহ) বলেছেন,
“রাসূল ﷺ নিজেই যায়েদ বিন হারেছা রাঃ এর সাথে যায়নাব রাঃ এর বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে নিজ ফুপুর কাছে গিয়েছিলেন। এবং তিনি যায়নাব রাঃ কে ছোটকাল থেকেই বড় হতে দেখছেন তাহলে তখনই কেন উনার অন্তরে তাঁর প্রতি মুহব্বত পয়দা হলো না? কেন নিজ পালকপুত্রের সাথে বিবাহের পরেই উনার অন্তরে মুহব্বত পয়দা হবে?” [৩৯]
একজন স্বাভাবিক জ্ঞান-বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের মনেই হাফেয ইবনে হাজার (রহ) যে যুক্তিটি দিয়েছেন, সে যুক্তিটির উদয় হওয়া উচিত- যে যায়নাব (রা) কে রাসূল (স) নিজে প্রস্তাব দিয়েছিলেন যায়েদ (রা) কে বিয়ে করার জন্য, যেখানে যায়নাব (রা) চেয়েছিলেন তাঁর বিয়ে যায়েদ (রা) এর সাথে না হয়ে রাসূল (সা) এর সাথে হোক; যে যায়নাব (রা) কে রাসূল (সা) হিজাবের বিধান প্রবর্তিত হওয়ার আগেই ছোটকাল থেকে বড় হতে দেখেছেন, সে যায়নাব (রা) এর প্রতি রাসূল (সা) এর হঠাৎ করেই কেন ভালবাসা সৃষ্টি হবে, তাও আবার তাঁর পালকপুত্রের সাথে বিয়ের পরই?
কিন্তু, অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার হলো, নিজের মতকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ইয়াসির ক্বাযী এর খণ্ডনে বলেছেন, “মূলত হাদিসের বর্ণনাতেই এ প্রশ্নের উত্তর আছে। রাসূল (সা) এর মন যে ঐদিন হঠাৎ পরিবর্তন হয়েছে তার প্রমাণ হলো, যায়নাবকে দেখেই তিনি ‘সুবহানাকা মুকাল্লিবাতিল কুলুব’ পড়েছিলেন। আল্লাহ যেন তারঁ মনকে না পালটে দেন, মনকে যেন সঠিক জায়গায় রাখেন, সে জন্যই তিনি এই দুআ করেছিলেন।”[*][v]
ইয়াসির ক্বাযী আবারও তার মত প্রতিষ্ঠা করতে সেই ভিত্তিহীন, অপ্রমাণিত, অগ্রহণযোগ্য ঘটনাটিরই উল্লেখ করেছেন। ইতিপূর্বে আলোচনায় আমরা দেখেছি, কেন উম্মাতের নিষ্ঠাবান আলেমদের মতে, সনদ ও মতন উভয়ের আলোকেই, সেই ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট প্রতিটা বর্ণনাই অপ্রমাণিত, অগ্রহণযোগ্য। তাই এরকম স্বাভাবিক একটি যুক্তিকে খণ্ডন করতে গিয়ে আবারও তাহকীক ব্যতীত, সনদ যাচাই করা ব্যতীত ইয়াসির ক্বাযীর করা এই উক্তি সম্পূর্ণরুপে হাস্যকর এবং কোনোভাবেই অ্যাকাডেমিক অ্যাপ্রোচের মধ্যে পড়ে না।
(৫) যেসব আলেম ইয়াসির ক্বাযীর মতের বিপরীত মত প্রকাশ করেছেন, তাদের ব্যাপারে ইয়াসির ক্বাযী বলেছেন, “এটা সংখ্যালঘু স্কলারদের মত” [*][vi]
এটা কোন পর্যায়ের ভ্রান্ত কথা তা পাঠকই যাচাই করে দেখবেন। রাসূল (স) এর প্রদৌহিত্র ইমাম আলি ইবন হুসাইন (রহ), ইমাম ইবেন হাজার আল-আসকালানি(রহ), ইমাম ইবনে কাসীর (রহ), ইমাম কুরতুবি (রহ), ইমাম ইবনে শিহাব আল-জুহরি (রহ), আল কাদি বকর ইবন আল আলা আল কুশাইরি (রহ), আল কাদি আবু বকর ইবন আল আরাবি (রহ), হাকিম আল তিরমিযী (রহ) আবু হাইয়্যান আল আন্দালুসি (রহ), ইবনুল কায়্যিম (রহ),আল বাক্বাঈ (রহ), আল-আলুসী (রহ), শায়খ আল শানকিতি (রহ)দের মতো উম্মাহর ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেমদের মত যদি সংখ্যালঘু স্কলারদের মত হয়, তাহলে সংখ্যাগুরু স্কলারদের মত কোনটা? ইয়াসির ক্বাযীর নিজের মতটা? ইসলামের ইতিহাসে কয়জন আলেম এই বিষয়ে ইয়াসির ক্বাযীর অনুরূপ মত রেখেছেন? নিজের মতের পক্ষে কোনো আলেমের সরাসরি মত উল্লেখ করতে না পেরে ইয়াসির ক্বাযী যে ইমাম ইবনুল কায়্যিম (রহ) এর ব্যাপারে কী জঘন্য ধরনের অ্যাকাডেমিক অসততার পরিচয় দিয়েছেন সেটাও আমরা দেখেছি।
উপরের দীর্ঘ আলোচনার সারকথা এটাই যে, ক্বুর’আনের শব্দাবলির আলোকে, হাদিস শাস্ত্র ও রিজাল শাস্ত্রের আলোকে, উম্মাহর সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেমদের মতের আলোকে, কোনো সন্দেহ ছাড়াই আমরা বলতে পারি, যায়নাব (রা) কে হঠাৎ একদিন যায়েদ (রা) এর ঘরে দেখে রাসূল (সা) এর তাঁর প্রতি ভালবাসা জন্মানো, রাসূল (সা) এর এই ভালবাসা লুকিয়ে রাখা – এই ধরনের কোনো কিছুই কোনোদিনই ঘটে নি। বরং, রাসূল (সা) যায়নাব (রা) কে বিয়ে করেছিলেন কেবলই আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক, যাতে পালকপুত্রের স্ত্রীকে বিয়ে করার মাধ্যমে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় যে, শরীয়তের দৃষ্টিতে পালকপুত্র আপন পুত্রের মত নয়।
ধৈর্য সহকারে এই সম্পূর্ণ লেখাটি পড়ার জন্য পাঠক আপনাকে ধন্যবাদ। এত কসরত আমাদেরকে এজন্যই করতে হয়েছে, কারণ আমরা চাই না আমাদের প্রিয় রাসূল (সা) এর শানে যে ধরনের অপবাদ, যে ধরনের অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ বয়ান ইসলামবিদ্বেষীরা প্রচার করে থাকে, সে বয়ান ই কোনো মুসলিমের মাধ্যমেই মুসলিম সমাজে ছড়িয়ে পড়ুক। বাংলা ভাষায় ইতিমধ্যে বাংদেশের সনামধন্য দুটি প্রকাশনী ইয়াসির ক্বাযীর লেকচারটির বাংলা অনুবাদ করে তা বই আকারে প্রকাশ করেছে। তারা কোন আলেমদের সাথে পরামর্শ না করে, সচেতনতা অবলম্বন না করে এরকম মারাত্মক একটি ভুল মুসলিম সমাজে প্রচারের রাস্তা খুলে দিয়েছে আমরা জানি না। আমরা এ দুই প্রকাশনীর সাথে জড়িত এবং এই বইয়ের অনুবাদের সাথে জড়িত সকলকে বিনীতভাবে অনুরোধ করছি, এরকম মারাত্মক ভুলটি যেন তারা একমাত্র ইসলামের স্বার্থেই সংশোধন করে নেয় এবং ভবিষ্যতে যেন এরকম কোনো কিছু না ঘটে, তার জন্য যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়।
পাঠসূত্র-
[i] প্রচ্ছদ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ‘উম্মুল মুমিনিন’ – পৃষ্ঠা ২৬৪
[ii] প্রচ্ছদ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ‘উম্মুল মুমিনিন’ – পৃষ্ঠা ২৬৪,২৬৫
[iii] প্রচ্ছদ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ‘উম্মুল মুমিনিন’ – পৃষ্ঠা ২৬১
[iv] প্রচ্ছদ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ‘উম্মুল মুমিনিন’ – পৃষ্ঠা ২৭১
[v] প্রচ্ছদ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ‘উম্মুল মুমিনিন’ – পৃষ্ঠা ২৭৪
[vi] প্রচ্ছদ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ‘উম্মুল মুমিনিন’ – পৃষ্ঠা ২৭৪
[১] মুসনাদ আহমাদ – ১২৫১১
[২] সহীহ বুখারী – ৭৪২০
[৩] সহীহ বুখারী – ৪৭৮৭
[৪] আল-মুসনাদ আল-মুস্তাখরাজ – ৪১৭৭, মুস্তাদরাক আল-হাকিম – ৩৫৬৩
[৫] আল-মুসনাদ আল-মুস্তাখরাজ – ৪১৮, সুনান তিরমিযী – ৩২১৩
[৬] সুনান আল-কুবরা আল-বায়হাকী – ১৩৯১৫
[৭] সুনান তিরমিযী – ৩২১২
[৮] সুনান আল-কুবরা আল-নাসাঈ – ১১৩৪৩
[৯] মুসনাদ আল-বাযযার (১৩, ২৮৭ – ৬৮৬০)
[১০] তাহযিব আত-তাহযিব (১০/৩৮১)
[১১] শায়খ শু’আইব আল-আরনাউত (রহ) কর্তৃক তাহকীককৃত, আর-রিসালাহ পাব্লিশার্স থেকে প্রকাশিত মুসনাদ আহমাদ – ১২৫১১
[১২] মিযান আল-আতিদাল ফি নকদির রিজাল- ইমাম শামসুদ্দিন – খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা-২৭৩
[১৩] তাকরিব আত-তাহযিব – ইবনে হাজার আসকালানী – পৃষ্ঠা ২৫১
[১৪] তাহযিব আত-তাহযিব (৯/৫০৭-৫০৮)
[১৫] মুকাতিল ইবন সুলাইমানের তাফসির (৩/৪৯২-৪৯৪)
[১৬] আত-তাহযিব (১০/২৭৪-২৭৫)
[১৭] সিয়ারু আলামিন নুবালা (৭/২০২)
[১৮] তাহযিব আত-তাহযিব (৬/১৭৭-১৭৯)
[১৯] সুনান তিরমিযী – ৩২১২
[২০] তাফসীরে তাবারী (২০/২৭৪), দালাঈল আল নবুওয়্যাহ – ইমাম বায়হাকী (৩/৪৬৬)
[২১] তাফসীরে সালাবী (৮/৪৮)
[২২] তাফসীরে কুরতুবি (১৪/১৯০-১৯১)
[২৩] নাওদির আ-উসুল ফি আহাদিস আল-রাসূল (১/৫৯৭)
[২৪] আহকাম আল-ক্বুর’আন – ইবন আল-আরাবী (৩/৫৭৮)
[২৫] আল-বাহর আল-মুহিত ফি আল-তাফসির (৮/৪৮২)
[২৬] যাদুল মা’আদ (৪/২৬৬-২৬৭)
[২৭] তাফসীরে ইবনে কাসীর (৬/৪২৫)
[২৮] ফাতহুল বারী (৮/৫২৩-৫২৪)
[২৯] নাযাম আল-দুরার ফি তানাসুব আল-আয়াত ওয়া আল-সুওয়ার (১৫/৩৫৮)
[৩০] রুহ আল-মা’আনী তাফসীর আল-ক্বুর’আন আল-’আযীম ওয়া সাব’আ আল-মাসানী (১১/২০৪)
[৩১] তাফসীরে বাগাওয়ী (৬/৩৫৬)
[৩২] তাফসীরে আব্দুর রাযযাক আস-সানানি (৩, ৪০ – ২৩৪৬)
[৩৩] তাহযীব আত-তাহযীব (৮/৩০১-৩০৫)
[৩৪] তাহযীব আল-কামাল (২৩/৫১০)
[৩৫] আদ-দাউ ওয়াদ-দাওয়া – পৃষ্ঠা ৫৫৪-৫৫৫
[৩৬] যাদুল মা’আদ (৪/২৬৬)
[৩৭] তাফসীর ইবনে কাসীর-১৫ নং খণ্ড, পৃষ্ঠা-৮০৫
[৩৮] লিসানুল মিযান ৩/৭৪
[৩৯] ফাতহুল বারী (৫২৪/৮)
কৃতজ্ঞতাঃ
Wasim Ismail, Waqar Akbar Cheema , শিহাব আহমেদ তুহিন, রায়হান মাহমুদ, আশিক-ই-ইলাহী, সাইফুল্লাহ বিন ইউসুফ, ফারশিদ খান।
“ডক্টর ইয়াসির কায্বী নিঃসন্দেহে বড় মাপের একজন ইসলামিক স্কলার।”
Please remove this line. He is not an Islamic scholar at all.