Riwayahbd

Personal Blog

বাংলাদেশে  গণবিরোধি বুদ্ধিজীবিতার বিকার!-মুসা আল হাফিজ

by সাবের চৌধুরী
October 14, 2020
1 min read
0
বাংলাদেশে  গণবিরোধি বুদ্ধিজীবিতার বিকার!-মুসা আল হাফিজ
76
SHARES
587
VIEWS
Share on FacebookShare on Twitter

 

একজন বুদ্ধিজীবীর চিন্তার জগত মানেই আপেক্ষিক সত্যের জগত; ধ্রুব সত্য নয়। অতএব কেউ যদি সত্যি সত্যিই বুদ্ধিজীবী হন, তাহলে নিজের ঝোঁকপ্রবণতা ও দলাদর্শগত পক্ষপাতিত্বের দ্বারা ইতিহাসকে প্রভাবিত করার জেদ ধরবেন  না। এই করা আর না করার মাধ্যমে চিহ্নিত হবে কে প্রকৃত বুদ্ধিজীবী আর কে দলাদর্শের গোলাম। গোলাম প্রকৃতির বুদ্ধিজীবী কখনো ইতিহাসে নিজের সম্ভাব্য ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন থাকতে পারে না। এজন্য সে ইতিহাসের প্রতি নিজের দায়বদ্ধতাকে অবজ্ঞা করে এবং অবজ্ঞা করে সত্যের প্রতি বিশ্বস্ততাকে। সে বুদ্ধির সাগরে ডুব দিয়ে তাজা মাছের বদলে ডাঙ্গায় তুলে আনে রক্তহীন কাঁকড়া।

 

যেহেতু সে গণমানুষের নিজস্ব ইতিহাস চর্চার অধিকার, নিজস্ব ধর্মীয় সংস্কৃতি চর্চার অধিকার এবং নিজের আত্মপরিচয় সন্ধানের অধিকার অর্জনকে স্বীয় দাস্যবৃত্তির জন্যে বিপদজনক হিসেবে জ্ঞান করেন, অতএব জনগণের আত্মআবিষ্কারের পথকে বিভ্রান্তির আবর্জনা দিয়ে কীভাবে আকীর্ণ করে রাখা যায়– এটাই হয়ে দাঁড়ায় তার বুদ্ধিবৃত্তির সারাrসার ও তপস্যার লক্ষ্যবস্তু!

 

গোলাম বুদ্ধিজীবী নিজস্ব  অন্ধত্ব কিংবা  লেনদেনের স্বার্থে গণমানুষের নিজস্ব পরিচয়, ইতিহাস ও ধর্মীয় সংস্কৃতির পরম্পরা ভিত্তিক জাতিসত্তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তাদের উপর আগ্রাসী সংস্কৃতি ও প্রভুত্বকামী জাতিসত্তার দাসত্ব চাপিয়ে দিতে চায়। তাদেরকে ভুলিয়ে দিতে চায় আপন মাটি, আপন ঘর ও আপন উৎসস্থলের ঠিকানা। এক্ষেত্রে উদ্দেশ্য সাধারণভাবে যাতে পরিষ্কার না হয়, এজন্যে ভান করা দরদ নিয়ে কৃত্রিম উপায়ে ডিম ফোটানোর মত ক্রমে ক্রমে জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব সংস্কৃতিকে বদলে দিতে প্রয়াস চালায়। তাকে অপাংক্তেয় সাব্যস্ত করতে চায়। তাকে বিকৃত করে দেয় এবং তার ধারকদের বিরুদ্ধে বেধড়ক প্রোপাগান্ডা চালায়। স্বার্থের প্রতিষ্ঠা এবং প্রভুর সুদৃষ্টির লক্ষ্যে জনগোষ্ঠীকে অন্তঃসারশূন্য করে দিতে গিয়ে তারা জাতির ঐতিহ্য ও শেকড়ের মর্মমূলকে কবরস্থ করতে চায়। জাতি যখন  শেকড়চ্যুত হবে, তখন আগ্রাসী সংস্কৃতির বানের পানিতে এমনিতেই ভেসে যাবে!

 

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গোলাম বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা বুঝতে হলে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের ধারাবাহিক ইতিহাসের প্রতি নজর বুলালেই চলবে। আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস মূলত হাজার বছরের ইতিহাস। এ ইতিহাস যেমন ব্রাহ্মণ্যবাদ ও শ্রেণীবৈষম্যের বিরুদ্ধে গৌরবময় লড়াইয়ে উজ্জ্বল, তেমনি উপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে অবিরল প্রত্যক্ষ সংগ্রামের অভিজ্ঞতায় বলিষ্ঠ। এ জাতি মুক্ত হয়েছে ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে এবং ততোধিক সংগ্রাম করতে হয়েছে ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে। কেননা তারা আমাদের সবকিছু কেড়ে নিয়েছিল। প্রাপ্য অধিকারকে বাজেয়াপ্ত করেছিল। আমাদেরকে পরিণত করেছিল নিরোদ বাবু কথিত ‘হালের বলদে’।

 

এমন কোনো অপরাধ নেই, যা তারা আমাদের বিরুদ্ধে করেনি। তারা আমাদের দেশকে শুধু উপনিবেশ বানিয়ে থামেনি, আমাদের মন-মানসে, পারস্পরিক সম্পর্কে, সাম্প্রদায়িক সহাবস্থানে তৈরী করেছে অমোচনীয় কলঙ্কদাগ। যার ধ্বংসকারিতা আমাদের রাজনীতি, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও উপমহাদেশের গোটা বাস্তবতাকে অব্যাহত প্রচণ্ডতায় ঝুঁকিগ্রস্ত করে চলেছে ।

 

কিন্তু সেই দুষণে অবক্ষয়িত বুদ্ধিবৃত্তি ঔপনিবেশিকতার বিনাশযজ্ঞকে চোখে দেখে না।সে তার সংহারী স্মৃতিকে ভুলিয়ে দিতে চায় এবং কায়দা করে বুঝাতে চায় যে ইংরেজ শাসন এক ভয়ঙ্কর ভালো জিনিস! তারা আমাদেরকে সভ্য করেছে, আমাদেরকে আধুনিক হতে শিখিয়েছে, শিল্পায়নের পথ দেখিয়েছে, সুতরাং তারা জনগণের মনঅধিনায়ক। অতএব` জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!’

কিন্তু আমাদের ভালোটাকে লুট করে নিলো, আমাদের সম্পদ নিয়ে তারা উন্নত হলো, আমাদের মোট জনগোষ্ঠীর বৃহৎ অংশকে হত্যা করলো এবং বিনিময়ে দু‘টো রেলগাড়ি আর শতকরা ১ ভাগ লোক  ইংরেজি শিখলো -কিসের সাথে কিসের তুলনা!

ইংরেজ শাসনের পূর্বে দেশের জনগণ স্বাবলম্বী ছিল। জীবনোপকরণ ছিল তাদের হাতের নাগালে। ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও নিরাপত্তা ছিল।গোলাভরা ছিলো ধান,  গোয়াল ভরা ছিলো গরু । পুকুর ভরা ছিলো মাছ। এটা কিভাবে ইংরেজ আমলে নাই হয়ে গেলো,  এটা তারা এড়িয়ে যান। এটা একটা বুদ্ধিবৃত্তিক দৌরাত্ম্য। কিন্তু এই দৌরাত্ম্যের শেষ  সেখানেই নয়।

ব্রিটিশ উৎপীড়ন ও প্রতিবেশী সমাজের জমিদার-মহাজনদের হাতে  ১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত অকথ্য নির্মমতা, শোষণ, ও বিরামহীন জুলুমের ইতিহাসকে আড়াল করে এরা এমন এক ইতিহাস প্রবর্তন করতে চান,  যার মর্মাথ হলো বাঙালির উপর হাজার বছরের সব শোষণ-বঞ্চনা হয়েছে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত বাংলাভাষী নন, এমন সব মুসলমানের হাতে। এটাকে নিছক বাস্তবতাবর্জিত ও অনৈতিহাসিক অবস্থানের দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখলেই চলবে না, বরং এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয় ব্যাপার হলো,  এদেশের মানুষকে উৎপীড়নের ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা , ইংরেজরা, বর্গীরা, মারাঠারা  শত শত বছর বছর পেশির কসরত চালিয়েছে। বাঙালির উপর উৎপীড়ক হিসেবে যদি ঘৃণার প্রকাশ ঘটাতে হয়, তাহলে এদের দৌরাত্ম্য ও নৃশংসতার  তথ্যটাও আসা দরকার। আলোচিত হওয়া দরকার।

কিন্তু দেখা গেল বাংলাভাষী নন, এমন একশ্রেণীর মুসলিমের কয়েক দশকের  অন্যায় নিয়েই তারা ভয়ানকভাবে ব্যস্ত। এটাকে তারা হুংকারসহ প্রতিনিয়ত উচ্চারণ করেছেন। বুঝাতে চাচ্ছেন,  এটাই আমাদের বিরুদ্ধে বৈরিতার আসল ইতিহাস। এর মানে দাঁড়াচ্ছে,  তাদের ক্রোধটা মুলত এদেশের জনগণের প্রতি উৎপীড়নের ঐতিহাসিক প্রতিশোধের চেতনা থেকে নয়। যদি তা হতো,  তাহলে পাকিস্তানিদের চেয়ে বহু দীর্ঘ্কাল ধরে বহুগুণ অধিক নির্যাতন যারা করেছে, তাদের ক্ষেত্রেও হতো।

 

কিন্তু বাংলাভাষী নন,  এমন পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর অপকর্মের  বেলায় ব্যাপারটা নিয়েই আর সবকিছু বাদ দিয়ে লিপ্ত থাকাটা এজন্যই হচ্ছে, যাতে ইতিহাসচেতনাকে বিস্মৃত করা  যায় এবং এদেশের জনগণের শত্রু-মিত্র ভেদজ্ঞানের স্বাভাবিক প্রবণতাকে বিশেষ একটি জায়গায় বন্দি করা যায়। অর্থাৎ এদেশের গরিষ্টসংখ্যক মানুষ মুসলিম,  পাকিস্তানীরাও মুসলিম। মুসলিম হিসাবে সিংহভাগ বাঙালির সাথে তাদের একটা ঐকসূত্র আছে। এই ঐকসূত্র দান করেছে ইসলাম । এর ফলে  মুসলমানদের মধ্যে বিশ্বব্যাপী সৌভ্রাতৃত্ব সৃষ্টি হয়।  ভাগ করে শাসনের এই যুগে মুসলিম বিশ্বঐক্যের এই সূত্রটা, হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদের শোষণমূলক নীতি বাস্তবায়নের পথে বড় চ্যালেঞ্জ। অতএব  এক মুসলমানকে অন্য মুসলমানের প্রতি বিদ্বেষী করে তোলো। বাংলাদেশী জনগণের শত্রু করে তোলো পাকিস্তানের জনগণের। তাদেরকে শিখাও যে,  এরাই হচ্ছে হত্যাকারী।

 

অথচ,প্রকৃত হত্যাকারী কারা? বাঙালির উপর নৃশংসতা চালিয়েছে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী । যারা মূলত সাম্রাজ্যবাদের লাঠিয়াল ও বহুরূপী  বুদ্ধিজীবীদের সমগোত্রীয়। মজার ব্যাপার হলো, এই  বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই তাদের সাথে ঘনিষ্ঠ সখ্যতা গড়ে তুলেছিলেন। একদিকে যখন পাকিস্তানী শাসকরা বাঙালিদের শোষণ করছে, বঞ্চিত করছে, ভাষার অধিকার কেড়ে নিচ্ছে,  নিরীহ বাংলাদেশী  হত্যা করছে, তখন  অনেকের সাথে    সুফিয়া কামাল, শামসুর রাহমান এর মতো বরেণ্য কবিও কবিতার পর কবিতা আর  কলামের পর কলাম উৎসর্গ করেছেন পাকিস্তানের খেদমতে, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহের পদতলে।  একাত্তর পরবর্তী  যে     কবির চৌধুরী ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার  অন্যতম লেখক, তিনিও একসময় অনুবাদ করেছেন ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের ফ্রেন্ড নট মাস্টার।

পাকিস্তান আমলে বাঙালির অধিকারপ্রয়াসের বিপরীতে ক্ষমতার তোষণে সচেষ্ট বুদ্ধিজীবীদের মাথার উপর ছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর আনুকূল্য এবং তারা প্রতিনিয়ত সিক্ত হচ্ছিলেন আটলান্টিকের ওপার থেকে বড়শীধারী বাঙালি হত্যার বিশ্ববিশ্রুত সহযোগী সাম্রাজ্যবাদে আপত্য স্নেহে। কিন্তু যখন মুক্তিযুদ্ধে এ দেশের মানুষ লক্ষ লক্ষ প্রাণদানের বিনিময়ে বিজয় অর্জন করলো, তারা তখন পোশাক পাল্টে ফেললো।  রাতারাতি সেজে গেলেন মুক্তিযুদ্ধের মহান দিশারী, হিরো। স্বাধীন বাংলাদেশে তারা আবির্ভূত হলেন নতুন ভূমিকায়।

 

পাকিস্তান আমলে যেখানে তাদের ভূমিকা ছিলো নির্বিচার পাকিস্তানপ্রেম,  স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে তাদের রাজনৈতিক  ভূমিকা হয়ে দাঁড়ালো প্রশ্নহীন পাকিস্তানবিরোধিতার।জনগণের স্বার্থ ও জাতীয় উন্নয়নের প্রতি লক্ষ্য করবে, এ সময়টুকু তাদের ছিলো না। তারা ব্যস্ত হয়ে উঠলেন জনগোষ্ঠীর ঈমান-আকিদার উপর ছুরিকাঘাতের মাধ্যমে সামাজিক অসহিষ্ণুতা সৃষ্টি ও জাতীয় জীবনে বিভক্তি সৃষ্টির মাধ্যমে জাতিরাষ্ট্রের অগ্রগতিকে নানাবিধ সমস্যার কাদাজলে নিক্ষেপ করতে।

 

প্রতিবেশী ভারত আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে পাকিস্তান ভাঙ্গার অভিযান হিসেবে গ্রহণ করে মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ের সম্ভাব্যতার মধ্যে  সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিলো। রণাঙ্গণে অংশ নিয়েছিলো আমাদের বিজয়ের প্রায় নিকটবর্তী সময়ে।   সেই এগিয়ে  আসাটা ছিলো অবশ্যই সহায়তা। যার জন্য বাংলাদেশ ঋণ স্বীকার করে। কিন্তু এই ঋণ পরিশোধকে অন্তহীন পর্যায়ে নিয়ে যেতে এবং একেই মুক্তিযুদ্ধের প্রধান অনুঘটক হিসেবে  প্রদর্শন করতে এই শ্রেণীর  বুদ্ধিজীবীরা অন্তহীন উৎসাহী হয়ে উঠলেন।

 

সেই ঋণ শোধের নামে জাতিগোষ্ঠীর নীতিনির্ধারণী ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে সংস্কৃতি, রাজনীতি, বাণিজ্যসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি বিষয়কে আধিপত্যবাদের  কাছে জিম্মি করে তুলতে প্রয়াস চললো। জনগণের মানসিকতার উপর কীভাবে বিজাতীয় চিন্তা-চেতনার শাসন জারি করা যায়, এটাই পরিণত হল তাদের প্রধান কুশেশ। কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে, নাটকে  ছড়াতে থাকলো এমন সব সময়  জীবানু,  যার সাথে জনগণের কোনো পূর্ব পরিচয় ছিল না। প্রতিবেশী সম্প্রদায়ের ধর্মীয় সংস্কৃতিকে বাঙালির সর্বজনীন সংস্কৃতি হিসেবে মুসলিম-খ্রিস্টান নির্বিশেষে সবার উপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা চললো। অপরদিকে মুসলিম সংস্কৃতির চিরায়ত উপাদনসমূহকে সাম্প্রদায়িক চর্চা হিসেবে অপাঙক্তেয় করার চেষ্টা চললো। কিংবা তার মুসলিমচরিত্র বদলে দেয়ার প্রয়াস চললো। মহাভারতীয়  মনুবাদের অভিপ্রায়সমূহের পাহারা এবং এর প্রতিষ্ঠায় অনেকের উদ্যম ও প্রচেষ্টা বিশেষ মাত্রায় প্রকাশিত হলো।

 

  অশ্লীলতার বাণিজ্যিকীকরণ কামনা করা হলো এবং নৈতিক অবক্ষয়ের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মকে পোকায় খাওয়া কাষ্টে পরিণত করার তোড়জোড় বেড়ে চললো।

 

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রেতাত্মা এন,জি,ওদের পদলেহন ও কামলাগিরিতে এই বুদ্ধিজীবীদের কোনো কুন্ঠা ছিল না। পূঁজিপতি ও বহুজাতিক কোম্পানি সমূহের স্বার্থের নির্দেশে গণস্বার্থ্ বিনাশী  প্রচেষ্টার বৈধতা তারা দিয়েছেন। এরই মধ্যে  স্বাধীনতার মাটিতে নতুন নতুন খাল খনন হতে থাকলো;  যেন বিপদজনক কুমীরের জন্যে দেশ  পরিণত হয় লোভনীয় খাদ্যে। এটা এ জন্যই যে, আধিপত্যবাদের পেটের ভিতর বাংলাদেশ নামক জাতিরাষ্ট্রটা যদি স্থিতিশীল হয়ে যায়, বলিষ্ট পায়ে এগিয়ে যায়, আত্মপরিচয়ে এবং স্বাধীকারচেতনায় সুদৃঢ় হয়ে যায়,  তাহলে দেশটাকে আর স্ত্রী ভাবা  যাবে না।  দেশে যদি সৃজনশীল রাজনৈতিক পরিবেশ গড়ে ওঠে, তাহলে আধিপত্যবাদের জন্য এদেশটা হয়ে উঠতে পারে, এশিয়ার কিউবা। অতএব জাতীয় ঐক্য যেন কোনোভাবেই গড়ে না উঠে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। এদেশের জনগণ যাতে ঐক্যবদ্ধ জনগোষ্ঠীরূপে সমবেত ইচ্ছা ও প্রচেষ্টায় সহগামী না হয়, সে জন্য বিচ্ছিন্নতার উপাদানসমূহকে পরিপুষ্ট করা হলো।

 

বাংলাদেশ যেহেতু মুসলিম প্রধান রাষ্ট্র, তাই  অনিবার্যভাবেই সাম্রাজ্যবাদের কথিত সভ্যতার সংঘাতের এবং ওয়ার অন টেররের  বড় এক   যুদ্ধক্ষেত্র। অতএব এদেশের জনগণকে লক্ষ্য করে সাম্রাজ্যবাদী  এজেন্ডা বাস্তবায়নে দালাল বুদ্ধিজীবীরা অগ্রবর্তী বাহিনী হিসেবে নিয়োজিত হলেন।  তারা জনগণকে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের সংকীর্ণ বৃত্তের ভিতরে এমনভাবে আটকাতে চাইলেন,  যাতে তাদের সামগ্রিক আত্মপরিচয় বিলুপ্ত হতে থাকে এবং সামগ্রিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষা তাদের মধ্যে অবশিষ্ট না থাকে। ঔপনিবেশিক মগজগঠন প্রকল্পের সন্তান হিসেবে তারা জাতীয় মনন এবং চিন্তায় ঔপনিবেশিক দাসমানসিকতাকে জারি রাখার চেষ্টা করলেন। তারা প্রগতি ও আধুনিকতার নামে শ্লোগানে কমতি করেননি। কিন্তু পশ্চিমা অগ্রগতির প্রাণরস যে বিজ্ঞান ও দক্ষতা, যে সামর্থ্য ও জাতীয় উত্থান,  তারা তাকে আমন্ত্রণ করতে পারেননি। তারা বরং পশ্চিমা জীবনের  নিজস্ব অসুখ সমূহকে এখানে টেনে এনেছেন এবং আমাদের নিজস্বতার বিরুদ্ধে অবিরত গোলা নিক্ষেপ করে গেছেন। আমরা কীভাবে পাশ্চাত্যায়িত হই, সে জন্য লড়ে গেছেন।

 

 

এই লড়াইয়ে জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক মুক্তির সংগ্রামকে তারা প্রতিক্রিয়াশীলতা আখ্যা দিয়েছেন। জাতীয় সার্বভৌমত্বের  অঙ্গীকার ও জাতিসত্তাভিত্তিক আত্মানুসন্ধানকে তারা সাম্প্রদায়িকতা সাব্যস্ত করেছেন। রাজনীতিকে দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে প্রচার চালিয়ে বাংলাদেশের উপর চাপাতে চেয়েছেন ব্যর্থ রাষ্ট্রের অভিধা। অপরদিকে ক্ষমতার পালাবদল হলে দুর্নীতির মচ্ছবে তারা হয়েছেন ভোগী, সহযোগী বা নিরব দর্শ্ক।  গণবিচ্ছিন্ন স্বৈরিতাকে তারা দিয়েছেন বৈধতা। গণলগ্ন রাজনীতি এবং গণঅধিকারের কণ্ঠসমূহকে নাই করার পরিপ্রেক্ষিত তৈরী করেছেন তারা।ভূমির হৃদয় থেকে জাগ্রত ভিন্নমত ও প্রতিবাদী আওয়াজসমূহকে তারা দিতে লাগলেন খারাপ অভিধা এবং তারুণ্যের রাজনৈতিক চেতনাবোধকে জাগ্রত ও শিক্ষিত হবার পথে তারা তৈরী করলেন ভয়ানক বৈরিতা।

 

যেখানে একজন বুদ্ধিজীবী সত্য ও সততাকে অবলম্বন করবেন এবং হবেন নি:সঙ্গ,  পূঁজি ও প্রতিপত্তির স্তনের দুধ পান করবেন না, থাকবেন   কায়েমী শক্তি ও ক্ষমতাকেন্দ্রের বাইরে, সেখানে তারা ক্ষমতার খেলোয়াড় হওয়া এবং ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক এজেন্ডার  চাকর হওয়ার হওয়ার মধ্যে সিদ্ধি তালাশ করলেন। ফলে গণক্ষমতায়ন ও গণবুদ্ধিজীবিতার প্রতিটি বন্ধনসূত্রে তারা তৈরী করেছেন ফাটল। গণস্তরে যাতে অধিকারসচেতনতা নতুন শক্তিতে জেগে না উঠে, সে জন্য সেতু-কালভার্ট্ কিংবা জিডিপির উন্নতির সরকারী গল্পসমূহের প্রচারে এবং একধরণের সুখ সুখ আবহ বিস্তারে তারা সচেষ্ট থেকেছেন। দলীয় ও সরকারী পরিচয় বহন ও ধারণে তারা সুখ খোঁজেছেন।

 

 

 

তারা ভুলে গেলেন বুদ্ধিজীবীর দায় ও চরিত্র। সেই যে   বার্ট্রান্ড রাসেল     ট্রাফাল্গার স্কয়ারে লক্ষ মানুষের সমাবেশে লেবার পার্টির অ্যাসোসিয়েট মেম্বারশিপের কার্ডটি ছিঁড়ে ফেলেছিলেন। সেটা তিনি করেছিলেন জনগণের হয়ে, নিজের সরকারের অন্যায্য সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে। এই একটি ঘটনা  অন্য অনেক বুদ্ধিজীবী থেকে তাকে আলাদা করেছে। কারণ রাসেল বলেছেন এবং  দেখিয়েছেন,  অন্যায়ের বিরুদ্ধে কীভাবে রুখে দাঁড়াতে হয়?

 

এদেশের বিশেষ শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীরা হেঁটেছেন উল্টো পথে। অন্যায়ের সাথে বসে গলফ খেলেছেন, ঘর করেছেন কারা।  তারুণ্যকে নিমগ্ন রেখেছেন কৃত্রিম আমোদ ও জীবনবিমুখতার চর্চায়। জীবনকে হাজির করেছেন একটি ভোগের বাজার কিংবা খেলাধুলার মাঠ হিসেবে। কোনো মহr মানবীয় লক্ষ্য, কর্তব্যবোধ এবং সংগ্রামী মানসিকতা থেকে তাদের পলায়ন নিশ্চিত করার চেষ্টায় কমতি করেননি তারা।

 

মূল্যবোধের অবক্ষয়কে এ ধারায় দেয়া হয়েছে বিস্তার। ভোগ ও কামান্ধতার উস্কানী ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে সকল উপায়ে। অপরাধপ্রবণতা এবং দুর্বৃত্তায়নের দরোজাসমূহ প্রসারিত হয়েছে এর প্রশ্রয়ে। শিক্ষাকে টেকসই ও জাতিগঠনে কার্য্কর  করার প্রচেষ্টা এবং সংস্কৃতিকে স্বকীয় পথে বিকশিত করার সাধনা তাদের মধ্যে ছিলো দুর্লক্ষ্য। উল্টো বরং বিরাজনীতিকীকরণের যা যা দাবি, তা পূরণের পথে সচেষ্ট থেকেছেন তারা।

 

এইসব বুদ্ধিজীবীর অধিকাংশ তথাকথিত বামপন্থার অনুগামী হিসেবে পরিচিত।যদিও  বামপন্থা বলতে কী বুঝায়,  মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে এখন পর্যন্ত তারা স্পষ্ট করতে পারেনি। তারা স্পষ্ট করতে পারেনি বামপন্থা বলতে এনজিওর গোলামী, সাম্রাজ্যবাদের দালালি, আধিপত্যবাদের প্রতিধ্বণি, ক্ষমতাসীন ও পূজিঁপতিদের জুতাসেলাই না মেহনতী মানুষের মুক্তির আন্দোলন। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জীবন সংগ্রামের প্রতি  ন্যূনতম ভ্রুক্ষেপ না করলেও এই লোকগুলো প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে দুর্বোধ্য সব তত্ত্ব বর্ণনা ,ঈমানদার জনগোষ্ঠীকে গালাগালি এবং সাম্রাজ্যবাদ-আধিপত্যবাদের পক্ষে গলাবাজি করে চলছেন প্রতিনিয়ত।

 

রাজনৈতিক কোনো সুনির্দিষ্ট সৃজনশীল  কর্মসূচি না থাকলেও শ্রুতাশুন্য অনুষ্ঠানে এরা নিয়মিতই ধর্মনিরপেক্ষতা ,সাম্প্রদায়িকতা প্রশ্নে কথা বলেন। এই শব্দগুলো দিয়ে আসলে কি বুঝাতে করতে চান, স্পষ্ট না হলেও বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা বেশি লক্ষ্য করা যায় এবং বোঝা যায় যে তারা প্রচন্ড রকমে  ক্ষুব্ধ ।  ক্রোধটা যদি ঠিক ঠিকই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে হয়ে  থাকতো, মন্দ ছিলো না। কিন্তু দেখা যায় এদেশের মানচিত্রে ফণা তোলা সবচেয়ে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীসমূহের  সাথে গলায়  গলা জড়িয়ে  এরা দিব্যি নিজেদের অসাম্প্রদায়িক হিসেবে প্রচার করেছেন।

 

হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের মঞ্চে এরা মুসলমানদের রক্তে বেধি ধুয়ে দেয়ার শপথ করেন। আবার পরক্ষণেই সাম্প্রদায়িকতায় আচ্ছন্ন হয়ে গেছে বলে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডায় মেতে উঠেন। অথচ এ দেশের হাজার বছরের ইতিহাস হচ্ছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ইতিহাস।এ ঐতিহ্যকে এখনো বুকে আগলে রেখেছে এই ভূমির সন্তানরা।

 

অপরদিকে  বাংলাদেশের উদার জমিনে সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে রীতিমতো বাণিজ্য চালিয়ে কারা হাড়-গোড় পরিপুষ্ট করে চলছে, এটা বুঝার জন্য এখন আর গবেষণা করতে হয় না। দরিদ্র রিকশা চালকও অঙ্গুলি  উঁচিয়ে একদল চাপাবাগীশ বর্ণচোরা আঁতেলের ঠিকানা দেখিয়ে দেবেন । এরা কিন্তু জনগণকে বোকা ভেবে বসে আছে, এবং স্থির করেছে যে তাদের ভণ্ডামি কখনো প্রকাশ হবে না।

 

এই ধারায়  যুক্ত আছেন প্রতিষ্ঠিত বহু মিডিয়াজীবী।অধিপতি বুদ্ধিজীবী শ্রেণী। তাদের কাণ্ডকীর্তি ও মিথ্যাচার লক্ষ্য করলে মনে হবে জাতিসত্তার চেতনাবাহী  জনতার বিশ্বাস ও মূল্যবোধের  সাথে এরা যেন যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। কিন্তু এরা যেহেতু নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে জাহির করে, তাই প্রশ্ন উঠেছে ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে এত আক্রোশ হম্বি-তম্বি কেন? এর উত্তর জনগণের কাছে অজানা নয়। জনগণ জানে,  এরা ধর্মনিরপেক্ষ নয় এদের ধর্ম হল সাম্রাজ্যবাদ-আধিপত্যবাদের পূজা-অর্চনা।

 

ইসলাম যেহেতু সাম্রাজ্যবাদকে চ্যালেঞ্জ করে, আধিপত্যবাদকে প্রতিরোধ করে, এজন্য ইসলামের আপোষহীন ভূমিকায় পথভ্রষ্ট ধর্মনিরপেক্ষ বিবেক যন্ত্রণাদগ্ধ  না হয়ে পারে না। এই যন্ত্রণার ফলে তাদের পত্রিকাগুলো হয়ে উঠে ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশন এবং ওয়ার অন টেররের ফাঁকা বুলির লিফলেট,  কলামগুলো হয়ে উঠে  গোয়েবলসের বিবৃতি।

 

 

Facebook Comments

Previous Post

আমরা আমাদের সন্তানদের কী হওয়ার শিক্ষা দিচ্ছি,মুসলিম নাকি নপুংসক? আলি ইযযেতবেগোভিচ

Next Post

রাসুলের সাঃ এর জন্মদিবসঃ একটি দালিলিক পর্যালোচনা।

সাবের চৌধুরী

সাবের চৌধুরী

Related Posts

তত্ত্ব ও পর্যালোচনা

তাসাউফ সম্পর্কে অপপ্রচার ও ভ্রান্তি : একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা ।। মাওলানা আনাস চৌধুরী

December 16, 2022
জাতীয়তাবাদ: জাহিলিয়্যাতের নতুন রূপ || আব্দুল্লাহ বিন বশির
আকীদা

জাতীয়তাবাদ: জাহিলিয়্যাতের নতুন রূপ || আব্দুল্লাহ বিন বশির

April 22, 2022
Next Post
রাসুলের সাঃ এর জন্মদিবসঃ একটি দালিলিক পর্যালোচনা।

রাসুলের সাঃ এর জন্মদিবসঃ একটি দালিলিক পর্যালোচনা।

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

No Result
View All Result

Recent.

তাসাউফ সম্পর্কে অপপ্রচার ও ভ্রান্তি : একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা ।। মাওলানা আনাস চৌধুরী

December 16, 2022
এই পৃথিবী একবার পায় তারে। সাবের চৌধুরী।

এই পৃথিবী একবার পায় তারে। সাবের চৌধুরী।

November 28, 2022

গামেদি চিন্তার মৌলিক ভ্রান্তি | শেষ পর্ব | মূল: মাওলানা ইয়াহয়া নোমানি | তরজমা: হুজাইফা মাহমুদ

November 16, 2022

গামেদি চিন্তার মৌলিক ভ্রান্তি—প্রথম পর্ব | মূল: মাওলানা ইয়াহয়া নোমানি | ভাষান্তর: হুজাইফা মাহমুদ

November 12, 2022
বাংলাদেশে ইসলামি নারীবাদের সাতকাহন | হুজাইফা মাহমুদ

বাংলাদেশে ইসলামি নারীবাদের সাতকাহন | হুজাইফা মাহমুদ

October 29, 2022

  • আমাদের সম্পর্কে
  • যোগাযোগ

সোশ্যাল নেটওয়ার্ক

No Result
View All Result
  • মূল পাতা
  • কুরআন
  • হাদীস
  • আকীদা
  • ফিকহ
  • ইবাদাত
  • সীরাত
  • তত্ত্ব ও পর্যালোচনা
  • চিন্তা ও মতবাদ
  • দেশ, সমাজ, সংস্কৃতি
  • বিশ্ব
  • বিজ্ঞান ও আধুনিকতা
  • অন্যান্য
    • নারী, শিশু, পরিবার
    • সুন্নত ও বিদআত
    • জিহাদ
    • রাজনীতি
    • আইন ও সংবিধান
    • শিক্ষা
    • প্রাচ্যবাদ
    • ইতিহাস
    • বিয়ে ও দাম্পত্য
    • ব্যক্তিত্ব ও সাক্ষাৎকার
    • শিল্প-সাহিত্য
    • গ্রন্থ-আলোচনা
    • আরবি ব্যাকরণ
    • উর্দু ব্যাকরণ
    • বিবিধ
    • পিডিএফ
    • নির্বাচিত লেখক-পরিচিতি
    • গুরুত্বপূর্ণ লিংক ও সাইটসমূহ

© 2020 রিওয়ায়াহ - Developed by Tijarah IT Limited.