নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর যুগের কবি-সাহিত্যিকদের ব্যাপারে বিভিন্ন সময় যে সমালোচনামূলক মন্তব্য করেছেন, সাহিত্যের ইসলামি ও অনৈসলামি সীমারেখা তৈরিতে তা আজও আমাদের পূর্ণাঙ্গ দিকনির্দেশনা দেয়। বিশেষত দুই জায়গায় সাহিত্য বিষয়ে নবীজি এমন আলোচনা করেছেন, যেগুলোর আলোকে মুসলিম সমাজে প্রচলিত সাহিত্য পুনর্বিবেচনা করা এখন সময়ের দাবী। কারণ, সমাজে প্রচলিত সংস্কৃতি তো মোটাদাগে লেখক-সাহিত্যিকদের কলমেই তৈরি হয়। একটি আর্দশ জাতির শিল্প-সাহিত্য কেমন হওয়া উচিত এবং কেমন না হওয়া উচিত তার মৌলিক নীতিমালা রয়েছে নবীজির আলোচনায়।
ইসলামের চল্লিশ বছর আগে ইমরাউল কায়েস মারা যায়। তার ব্যাপারে নবিজি বলেন–
أَشْعَرُ الشُّعَرَاى وَقَائِدُهُمْ إُلَى النَّارِ
অর্থাৎ, ‘সে কবিদের কবি এবং জাহান্নামেও সে হবে তাদের সকলের সরদার’।
প্রশ্ন হচ্ছে ইমরাউল কায়েসের কাব্যে এমন কী রয়েছে, যার জন্য নবীজি এমন মন্তব্য করলেন? ইমরাউল কায়েসের কাব্যে দৃষ্টিপাত করলে– মদের নেশায় মাতোয়ারা একটি সময়কাল, প্রেম ও সৌন্দর্যের আক্কেলগুড়ুম করা কাহিনী, আধাঁর রাতের তীব্র ঝড়ে উড়ে যাওয়া বস্তির নির্জনতার শোক গাঁথা, সুনসান বালুকাময় মরুভূমির নীরবতার শব্দ, মোটকথা ফুল-পাখি লতা-পাতা ও যৌনতাপূর্ণ ইতিবাচক বার্তাশূন্য একটি কাব্যসম্ভার– আমরা দেখতে পাই। জাহিলি যুগে মোটাদাগে এ-ই ছিলো আরবের শিল্প-জগত। ইমরাউল কায়েস মানুষের শিল্পসত্তায় ইতিবাচকতা তৈরির বিপরীতে শিল্পের সম্মোহনী শক্তির অপপ্রয়োগ করে তাদের মন-মননে এক অন্তঃসারশূন্য মাদকতা তৈরি করত।
নবীজি তার দূরদর্শী আলোচানায় এই মৌলিক নীতির প্রতিও ইঙ্গিত করেছেন যে, শিল্প-সাহিত্যের সৌন্দর্যবোধ আর গণমানুষের সৌন্দর্য চেতনা এক ও অভিন্ন হওয়াও জরুরি নয়। কবিতা আদতে ভালো হলেও পাঠক অনেক সময় তার মন্দ অর্থও নিয়ে নিতে পারে। সেখানে খোদ কবিই যদি সেচ্ছায় ভুল বার্তা দেওয়া শুরু করে। তাহলে অনিবার্য ধ্বংস থেকে তাদের রুখবে কে?
কাব্য-সাহিত্যের প্রভাব অনেকটা জাদুর মতো নাজুক। এই জন্য অভিশাপ সেই সকল কবি-সাহিত্যিকের জন্য যারা মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের দুঃখ-কষ্ট লাঘবের পরিবর্তে দুর্গতি ও অবক্ষয়কে প্রগতি ও আধুনিকতা হিসেবে প্রচার করে সাহিত্যের অপব্যবহার করে। এভাবে তারা মূলত স্বজাতির ধ্বংসের পালেই হাওয়া দেয়।
সাহিত্য সমাজের দর্পণ। তাই কবি-সাহিত্যিকদের উচিত– প্রকৃতির যে বিপুল ঐশ্বর্য্য এবং যাপন ও শক্তির যে তুমুল রহস্য উপলব্ধির সু্যোগ তাদের হয়েছে, অন্যদেরও সেসব দেখার সুযোগ করে দেয়া। অথচ তারা সাধারণ মানুষের আশা-ভরসাকে হতাশায় বদলে দেয়ার জন্য উঠে-পড়ে লেগে আছে।
একবার বনু আইস গোত্রের বিখ্যাত কবি আনতারার এই কবিতা নবীজিকে শুনানো হয়—
وَلَقَدْ أَبِیْتُ عَلَی الطُّوَی وَأَظِلُّهُ
حَتّٰى أَنَالُ بِهٖ کَرِیْمَ الْمَأکَلِ
অর্থাৎ, ‘অক্লান্ত পরিশ্রমে আমি সহস্র রজনী বিনিদ্র কাটিয়েছি। হালাল রিজিকের যোগ্যতা অর্জনের জন্য’।
নবিজি – যার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ছিলো, মানুষের জীবনের যাবতীয় যাতনাকে সহজ-সুন্দর-কোমল করে দুঃখ-কষ্টগুলোকে আরও জীবন-ঘনিষ্ঠ করে তোলা- এই কবিতা শুনে যারপরনাই আনন্দিত হন। এবং সাহাবায়ে কেরামকে লক্ষ্য করে বলেন, ‘কোন আরবের পরিচিতি আমাকে তার সাক্ষাতে আগ্রহী করেনি। কিন্তু আমি সত্য বলছি, এই কবিতা শুনার পর এই আরবি কবির সাথে দেখা করার জন্য আমার হৃদয় ব্যাকুল হয়ে আছে’।
আল্লাহু আকবার! যার দিকে একবার মাত্র তাকালে দুনিয়ার বরকত ও আখেরাতের নাজাতের দ্বিগুণ মর্যাদা হাসিলের সু্যোগ তৈরি হয়ে যায়। সেই মহামানব এক মূর্তিপুজারি কবির সাক্ষাতের আকাঙ্খা লালন করছেন। কেন? কী এমন ছিলো তার কাব্যে?
নবীজি আনতারাকে যে সম্মান প্রদর্শন করেছেন, তার কারণ স্পষ্ট। কারণ আনতারার কাব্য সুন্দর সমাজ, পরিশুদ্ধ সংস্কৃতি ও অমলিন জীবন-যাপনের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বৈধ উপার্জনে ধৈর্যের সাথে যেসব কষ্টকর পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয়, সেসবের জন্য মানুষের মননে-মগজে যে ইতিবাচক প্রবাহ তৈরি করা দরকার, আনতারার কাব্যে তার সবর উপস্থিতি বিদ্যমান।
নবিজির এই প্রশংসাপত্র থেকে এও অনুমিত হয় যে, সাহিত্য জীবনের উর্ধ্বে নয়। তাই সুস্থ জীবনের প্রতিনিধিত্ব করে যে সাহিত্য, আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে সে সাহিত্যই দরকার।
আল্লাহ তাআলা মানুষকে যে সকল সহজাত যোগ্যতা এবং হৃদয়-মননে যে সকল সক্ষমতা আমানত হিসেবে দান করেছেন। সেসব কেবল একটি মাত্র লক্ষ-উদ্দেশ্যেই ব্যয়িত হওয়া উচিত। আর তা হল– আদর্শ সমাজ বিনির্মাণ। যাতে জাতীয় জীবন সূর্যের মতো প্রোজ্জ্বল, শক্তিসমৃদ্ধ ও সুনিয়ন্ত্রিত হতে পারে। মানুষের সকল যোগ্যতা এই কাজেই ব্যয়িত হওয়া উচিত। এবং প্রত্যেক জিনিসের মান নির্ণয়ের পূর্বে দেখা উচিত, মানুষের জীবন-মানে তা কতটুকু কার্যকর ভূমিকা রাখছে।
যে শিল্প-সাহিত্যের কারণে আমরা জেগে জেগে ঘুমিয়ে পড়ি, ফলে আমাদের চোখের সামনে ঘটে যাওয়া জ্বলজ্যান্ত সত্যের ( অথচ এই সত্য জেনে তার মোকাবেলা করার নামই জীবন) মোড় ঘুরিয়ে তা দৃষ্টির অন্তরালে রাখা হয়, তা জাতীয় জীবনের জন্য মৃত্যুর নামান্তর।
কবি-সাহিত্যিকদের উচিত– নর-নারীর দেহকেন্দ্রিক ক্ষণভঙ্গুর প্রেম-ভালোবাসার আফিম মুক্ত সাহিত্য রচনা করা এবং প্রতিটি বিষয়কে নিজের চিন্তার ফিলটারে ওয়াশ করে সাহিত্যের মাধুরিমা দিয়ে আম জনতার মধ্যে ভুল মাদকতা তৈরি থেকে বিরত থাকা। কারণ, সাহিত্যে তথ্য ও সত্যের বিক্রীত এবং বিকৃত প্রয়োগের ফলে ব্যক্তি ও সমাজে নৈতিক অবক্ষয় দেখা দিলে, তখন আবার আর্ট ফর আর্টের সো কল্ড স্লোগান তুলে বলা হবে, সাহিত্যের কাজ তো ব্যক্তি ও সমাজ শুধরানো নয়। এই তুমুল প্যারাডক্সে আমাদের সামাজিক জীবন থেকে ‘প্রাণ’ গায়েব হয়ে পড়বে।
মোট কথা, নবীজি কর্তৃক ইমরাউল কায়েস ও আনতারার আলোচনা থেকে এই মূলনীতি সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, একটি আদর্শ জাতির শিল্প-সাহিত্যাঙ্গণ আসলে কীরকম হওয়া উচিত।
মূল লেখার লিঙ্ক: http://daanish.pk/25506