- লেখক : আব্দুল হালীম ওয়াইস
- অনুবাদ : যায়েদ মোহাম্মদ
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, খন্দক যুদ্ধের পর মদিনায় এসে কাফেররা আর আক্রমণ করবে না । হিজরতের পর মুসলিমরা, বিশেষত মুহাজিররা পবিত্র ভূমি মক্কা জিয়ারতের জন্য উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছিলেন । নিজেদের মাতৃভূমি ছেড়ে আসার কষ্ট মুহাজিরদের তীব্রতর হচ্ছিল । শৈশবের জন্মভূমির প্রতি তারা প্রবল মায়া অনুভব করলেন । দীর্ঘ ছয় বছর ধরে তারা মক্কা জিয়ারতের আশা বুকে লালন করে আসছেন । কেউ কেউ তো আবিসিনিয়া থেকে সরাসরি মদীনায় চলে এসেছেন, এরমধ্যে নিজের মাতৃভূমি মক্কা জিয়ারতের সৌভাগ্য হয় নি । ফলে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে আশাবাদী করে তুলছিলেন এবং খুব শীঘ্রই মক্কা জিয়ারতের উদ্দেশ্যে বের হবেন বলেও জানালেন । ততদিনে কুরাইশদের সমস্ত প্রতাপ ফুরিয়ে গেছে , মুসলিমদের নিশ্চিহ্ন করার যাবতীয় চেষ্টা প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে , তাদের সব স্বপ্ন আকাঙ্খা মাঠে মারা গেছে । অল্পসংখ্যক মজলুম মুমিনদের বিজয় নিশ্চিত হয়েছে এই পৃথিবীতে।
ইবনে ইসহাক থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ষষ্ঠ হিজরীতে তাঁর সাহাবীদেরকে উমরার প্রস্তুতি নিতে বলেন । চোদ্দশো সাহাবী নিয়ে নবীজী মক্কার উদ্দেশে রওনা দেন । এই সফর ছিল শান্তিপূর্ণ । কোন যুদ্ধ বা লড়াইয়ের নিয়ত ছিল না মুসলিমদের । ফলে তাঁদের তরবারিগুলো ছিল খাপবদ্ধ । মক্কা থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে এসে রাসুল সফরের বিরতি দিলেন এবং মক্কাবাসীদের প্রাণপণ বুঝানোর চেষ্টা করলেন, তারা কেবল শান্তিপূর্ণভাবে উমরা করার জন্য এসেছেন; কোন ধরনের যুদ্ধ-বিগ্রহের ইচ্ছা মুসলিমদের নেই । মক্কাবাসীরা কোনভাবেই আশ্বস্ত হলো না । তারা মুসলিমদের উমরাতে সরাসরি বাধা প্রদান করলো । মসজিদুল হারামেও ঢুকতে দিল না । এতকিছুর পরও নবীজি ধৈর্যধারণ করে শান্তিপূর্ণভাবে সমাধানের চেষ্টা করতে লাগলেন । এক পর্যায়ে তিনি সাহাবীদের নিয়ে হুদায়বিয়ায় অবস্থান করতে বাধ্য হলেন। অথচ মুসলিমদের সাহস ও বীরত্ব নিয়ে নবীজীর কোন সন্দেহ ছিল না । তিনি ভালভাবেই জানতেন, যদি আল্লাহর উপর ভরসা করে মুসলিমরা মুশরিকদের বিরুদ্ধে লড়াই করে তাহলে মুসলিমরাই বিজয়ী হবে । এরপরও তিনি লড়াইয়ের প্রতি অগ্রসর হননি; বরং অপেক্ষার প্রহর গুণছিলেন ।
মুশরিকদের বাধা ও প্রতিবন্ধকতা যখন গুরুতর অবস্থায় পৌঁছে গেল, তখন তিনি সাহাবীদের থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ইসলামের পথে লড়াই করার বাইয়াত নিলেন এবং দৃঢ় সংকল্পের উপর সংঘবদ্ধ করলেন। এই পবিত্র বাইয়াত মহান আল্লাহ সাত আসমানের উপর থেকে পরিচালনা করেছেন । সুরা ফাতহে আল্লাহ ইরশাদ করেন, “মুমিনদের প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট হলেন যখন তারা (হুদাইবিয়ায়) গাছের তলে আপনার কাছে বাইয়াত গ্রহণ করল । আল্লাহ জানতেন তাদের অন্তরে কী আছে, এজন্য তিনি তাদের উপর প্রশান্তি অবতীর্ণ করলেন এবং পুরষ্কার হিসেবে তাদেরকে দান করলেন এক আসন্ন বিজয় ”
কুরাইশরা যখন কাবার উপর নিজেদের কর্তৃত্ব প্রমাণ করতে চাচ্ছিল, তখন পরিস্থিতি দেখে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের সঙ্গে সন্ধিচুক্তি করতে বাধ্য হলেন । এ চুক্তির মধ্যে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলা হলো, আপনি এ বছর মক্কায় প্রবেশ করতে পারবেন না। সাথী-সঙ্গীকে নিয়ে মদীনায় ফিরে যাবেন । আগামী বছর মক্কায় এসে তিনদিন অবস্থান করতে পারবেন; তবে তরবারি থাকবে খাপবদ্ধ অবস্থায় । এই চুক্তি থেকে বোঝা যায়, মুসলিমরাও কাবার মালিকানার অংশীদার । যদিও বাহ্যত তখনও পর্যন্ত মক্কা ও কাবার মালিকানা মুশরিকদের হাতেই ছিল । বিশেষ করে কুরাইশরাই যাবতীয় প্রতাপ বিস্তার করে যাচ্ছিল । মক্কার সকল গোত্র ও গোষ্ঠিকে এই কর্তৃত্ব মেনে নিতে মুশরিকরা বাধ্য করেছিল । কাবায় মুশরিকদের স্থাপিত মূর্তি ও ধর্মীয় নিদর্শনের প্রতি সবার সমর্থন বাধ্যতামূলক ছিল । অন্য কোন মতাদর্শের লোকদের কাবায় কোন ধরনের নিদর্শন স্থাপনের অধিকার ছিল না । এতকিছুর পরও হুদায়বিয়ার সন্ধির মধ্যে একটা চুক্তি ছিল, মুসলিমরা তাদের বেঁধে দেওয়া শর্তসমূহ মেনে কাবা চত্ত্বরে হজ্ব ও উমরা পালন করতে পারবে ।
সন্ধিচুক্তির সময় কুরাইশ দূত সুহাইল ইবনে আমরের উদ্ধত ও বিদ্বেষমূলক আচরণে সাহাবীরা ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন । যুদ্ধের বদলে শান্তিচুক্তিকে প্রাধান্য দিয়ে নবীজি সেসব আমলে নেননি। ফলে, সুহাইল ইবনে আমরের মন্দ আচরণ দেখেও না দেখার ভান করেছেন । সন্ধি আলোচনায় মুসলিম ও মুশরিকদের মাঝে দশবছরের শান্তিচুক্তি সম্পন্ন হয়েছিল । খুব দ্রুতই মুসলিমরা বুঝতে পেরেছিল, যুদ্ধের বদলে রাসুলের শান্তিচুক্তিকে প্রাধান্য দেয়া কতোটা কল্যাণমূলক ও বরকতময় ছিল । এই শান্তিচুক্তি ছিল স্পষ্ট বিজয়ের সূচনা ।
কুরাইশ দূত সুহাইল ইবনে আমর সন্ধিচুক্তিতে মুসলিমদেরকে নানাভাবে কোনঠাসা করাকে নিজের জন্য বিরাট বিজয় ভেবে নিয়েছিল । এইজন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়েও আপত্তি তোলা শুরু করে । সন্ধিচুক্তি লেখার সময় নবীজি যখন হজরত আলীকে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম লিখতে বললে সুহাইল আপত্তি জানায় ও বিসমিল্লাহ এর জায়গায় ‘আল্লাহুম্মা’ লেখার প্রস্তাব দেয় । শেষ পর্যন্ত আলী রা. এমনটাই লিখতে বাধ্য হন । এরপর যখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের নামের সঙ্গে ‘রাসুলুল্লাহ’ শব্দটি লেখার কথা বলেন, তখনও সুহাইল পুনর্বার আপত্তি জানায় । স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, যদি আমরা আপনাকে আল্লাহর রাসুল বলে মেনে নিতাম, তাহলে তো আপনার সঙ্গে যুদ্ধেরই প্রশ্ন আসে না । আপনার নাম এবং আপনার বাবার নাম লিখুন । হজরত আলী ইতোমধ্যে ‘রাসূলুল্লাহ’ লিখে ফেলেছিলেন । সুহাইলের প্রতিক্রিয়ায় নবীজি তা মুছে ফেলতে বললেন । কিন্তু হজরত আলী ইতস্তত করতে লাগলেন । তার পক্ষে এই মহান শব্দটি মুছে ফেলা সম্ভব হচ্ছিল না । ফলে আলী রা. এই বাক্য দেখিয়ে দেয়ার পর রাসুল নিজেই তা মুছে ফেলেন ও সে জায়গায় ‘মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ’ লেখার নির্দেশ দেন। এভাবেই রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ধৈর্য ও ঔদার্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেন ।
মুসলিম ও মুশরিকদের মাঝে দশবছর যুদ্ধবন্ধের চুক্তি হয়, যে সময়টাতে উভয় পক্ষের মাঝে কোন ধরনের যুদ্ধবিগ্রহ হবে না, মানুষ নিরাপদ থাকবে । তবে কুরাইশদের কেউ যদি অভিভাবকের অনুমতি ব্যতিত মুহাম্মদের কাছে চলে আসে, তাহলে মুহাম্মদ তাকে ফেরত পাঠাবে । কিন্তু মুহাম্মদের কোন সঙ্গী যদি কুরাইশদের কাছে চলে আসে তাহলে কুরাইশরা তাকে ফেরত পাঠাতে বাধ্য নয় । উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুসহ অনেক সাহাবী এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন তবু নবীজি এই একপাক্ষিক ফায়সালা মেনে নেন । এটি ছিল এক ঐতিহাসিক দূরদর্শী সিদ্ধান্ত । নবীজি বিষয়টি বুঝতে পেরেছিলেন, ফলে তিনি সহজেই একে মেনে নেন ।
হুদাইবিয়ার সন্ধি ছিল শান্তিপ্রতিষ্ঠার জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক পন্থা । এ লক্ষ্যেই আল্লাহর রাসুল এই একপাক্ষিক চুক্তিতেও সম্মত হন। ইসলামি দাওয়াতের জন্য শান্তিমূলক প্রচেষ্টা অত্যন্ত কার্যকর একটি পথ। যে দাওয়াতের উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের হৃদয় ও বোধবুদ্ধিকে স্পর্শ করা । আর এটা তো সত্য, যুদ্ধ ও লড়াইয়ের মাধ্যমে মানুষের হৃদয় ও চিন্তাশক্তিকে সত্যমুখী করে তোলা যায় না, যেমনটা ইতিহাসের পাতায় আমরা দেখে থাকি । ফলে এই সন্ধিচুক্তিটিতে বাহ্যত ক্ষতিকর নানা দিক থাকলেও তা ছিল এক নিশ্চিত বিজয় । এ সন্ধি সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় আমি তোমাকে দান করেছি এক সুস্পষ্ট বিজয়’ ।
মক্কা বিজয় সংঘটিত হয়েছিল অষ্টম হিজরীর তেইশে রমজান । নিঃসন্দেহে এই বিজয়ের ঘটনাটি ছিল আল্লাহর রাসুলের মানবিক ও নবীচরিত্রের এক অনন্য দৃষ্টান্ত । এর মাধ্যমে তিনি ক্ষমা ও ঔদার্যের অনুপম এক উদাহরণ তৈরী করেন। পৃথিবী এমন উদার ও সহানুভূতিশীল ব্যক্তিত্ব এর আগে কখনো দেখে নি । হুদায়বিয়ার সন্ধির পরবর্তী ঘটনাবলী বলা এখানে উদ্দেশ্য নয় । এর বিস্তারিত বিবরণ তো ঐতিহাসিক গ্রন্থে পাওয়া যায় । হাদিস ও সিরাতের গ্রন্থসমূহেও বিশদ বিবরণ রয়েছে এই ঐতিহাসিক ঘটনার। বরং এখানে উদ্দেশ্য হচ্ছে সেই যুদ্ধনীতি সম্পর্কে অবহিত করা, যার ফলাফল স্বরূপ নবীজি মক্কা বিজয়ের মতো বিরাট সাফল্য লাভ করেছিলেন । অথচ ইসলামের শুরু যুগ থেকে বিশ বছরের বেশী সময় ধরে মক্কাবাসীরা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ধারাবাহিক কষ্ট দিয়ে আসছিল । এরমধ্যে দীর্ঘ তিন মাসের মতো সময় নবীজি ও সাহাবীদেরকে নিজেদের ঘরবাড়ি থেকে বিতাড়িত করে মরুভূমির উপত্যকায় নির্বাসনে প্রচণ্ড যন্ত্রণার মধ্যে ফেলে রেখেছিল। যাবতীয় সুযোগ সুবিধা হতে বঞ্চিত থেকে ক্ষুধা ও নিরাপত্তাহীনতার এক অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে সময় অতিবাহিত হয়েছিল । এমনকি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন হিজরতের নিয়ত করেন, তখন তারা তাঁকে হত্যার জন্য নানা ষড়যন্ত্র করে। কিন্তু মক্কায় হত্যার সব পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়।
এরপর নবীজি যখন হিজরতেরর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন, তখন তারা তাঁর পিছু নেয় । যে নবীজিকে হত্যা করতে পারবে তার জন্য বিরাট পুরষ্কারের ঘোষণা করে । মক্কায় মুসলিমদের কাটানো শেষ আট বছরে মুশরিকরা তাদের বিরুদ্ধে সবসময় লেগে থাকত ও কিভাবে মুসলিমদের নানাবিধ যন্ত্রণা দেয়া যায় সে সুযোগের অপেক্ষায় থাকত। প্রায় সবসময় মক্কার মুশরিকরা ইহুদি ও মুনাফিকদের সাথে মিলে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতো ও শলাপরামর্শে লিপ্ত থাকত ।
এই দীর্ঘ সময়গুলো কেটে গেছে । এই যে শ্রেষ্ঠ মানুষ, যিনি ইসলাম প্রচারের জন্য বিভিন্ন কষ্ট ও নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন, তিনি আজ মক্কায় বিজয়ীরূপে আবির্ভূত হয়েছেন । হ্যাঁ, এই সেই মক্কা শহর, যেখান থেকে তাঁকে বের করা দেয়া হয়েছিল । তিনি তখন চোখের অশ্রু ফেলতে ফেলতে মাতৃভূমিকে সম্বোধন করে বলছিলেন, আল্লাহর শপথ, আমার কাছে পৃথিবীর সবচে প্রিয় ভূমি তো এই মক্কা । যদি এর অধিবাসীরা আমাকে বের করে না দিত, তাহলে আমি এই শহর ছেড়ে কখনোই যেতাম না । এটা অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক ঘটনা, একইসঙ্গে কাফেরদের খুবই কুৎসিত মানসিকতার আচরণ । পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তি, যিনি ইনসাফ ও সততার মূর্তপ্রতীক, তিনি এই বিজয়ের মুহূর্তে চাইলে শত্রুদের থেকে প্রতিশোধ নিতে পারতেন, তাঁর ও তাঁর সাহাবীদের বিরুদ্ধে হওয়া অসংখ্য নির্যাতন ও দুর্ব্যবহারের বদলা নিতে পারতেন । সাধারণত এমনটাই করা হয়ে থাকে । এই দীর্ঘ সময় ধারাবাহিক কষ্ট ও নির্যাতনের ফলে মুসলিমরা অপরিসীম ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিলেন । দেশত্যাগের মত এক অসম্ভব বিষয়ে তাদেরকে বাধ্য করা হয়েছিল । তাঁরা চাইলে এসবের ক্ষতিপূরণও আদায় করতে পারতেন।
নানা নির্যাতনের শিকার হয়ে মাতৃভূমি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন আল্লাহর রাসুল । দীর্ঘ সময় পর বিজয়ের বেশে সম্মানের সাথে যখন সেই মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন, তখন তিনি শত্রুদের নির্দ্বিধায় ক্ষমা করে দিলেন । পৃথিবীতে এমন ক্ষমা ও ঔদার্যের নজির আর নেই । কিন্তু নবীজির অনুপম চরিত্র – যে ব্যাপারে আল্লাহ বলেছেন, হে নবী নিশ্চয় আপনি সুচরিত্রবান- তা দেখে মনে হয় তিনি কেবল শ্রেষ্ঠ মানুষই নন; বরং তারও উর্ধ্বে তাঁর অবস্থান। আমরা যদি নবীজি মানুষ এই ব্যাপারটি বিশ্বাস না করতাম এবং আল্লাহর প্রতি নবীজির একান্ত দাসত্ব পর্যবেক্ষণ না করতাম তাহলে আমরা অনায়াসেই বলে দিতাম, নবীজি মানুষ নন । তিনি বিজয়ী হয়ে মক্কায় যেভাবে প্রবেশ করলেন, তাতে কোন বিজয়ী মানুষের পক্ষে এমনটা কল্পনা করাও সম্ভব না ।
মক্কায় প্রবেশ করার পর দীর্ঘ দুই যুগ ধরে যারা তাকে অস্বাভাবিক কষ্ট দিয়ে আসছিল, তিনি তাদের দিকে তাকালেন । তিনি মাথা ঝুঁকিয়ে এমন বিনয়াবনত হয়ে মক্কায় প্রবেশ করলেন, যেন আল্লাহর ভয় ও ভালবাসায় তাঁর মাথা সওয়ারির পিঠ ছুঁয়ে ফেলবে । যেন তিনি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন মহান আল্লাহর দরবারে, যিনি বিজয় দানকারী, অপমানিত ও নির্যাতিতদের সম্মানদাতা । কষ্টদায়ক অবস্থা পরিবর্তন করে এভাবে আলোর মুখ দেখানোর একমাত্র কৃতিত্ব যার সেই মহান সত্তার দরবারে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সওয়ারির উপর মাথা ঝুঁকিয়ে মক্কায় প্রবেশ করলেন । পৃথিবীর কোন বিজয়ী বাদশাহ বিনয়াবনত হয়ে বিজয়ী দেশে এভাবে প্রবেশ করেন না । দেখেই মনে হচ্ছিল একজন বিজয়ী নবী মক্কায় প্রবেশ করছেন ।
আবু সুফিয়ান তখন ইবনে আব্বাসকে বলে উঠলেন–তোমার চাচাতো ভাই তো এখন বিশাল সাম্রাজ্যের অধিপতি । ইবনে আব্বাস আবু সুফিয়ানের কথায় ভুল ধরলেন — না, তিনি বাদশাহ নন, তিনি সকলের নবী । অন্য সাম্রাজ্যের অধিপতিদের মত নন তিনি । আল্লাহর রাসূল তখন এক মনে সুরা ফাতহ পড়ে যাচ্ছিলেন । আনন্দ ও কৃতজ্ঞতায় তাঁর হৃদয় আপ্লুত হয়ে উঠছিল । চারপাশের কোনকিছু তাঁকে স্পর্শ করছিল না । তিনি তখন মসজিদুল হারাম ও কাবার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন । মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাজরে আসওয়াদে চুমু খেলেন । বাইতুল্লাহ তওয়াফ করলেন । অবশ্য তিনি ইহরাম পরিহিত ছিলেন না ( কিতাবুল মাগাজি, বুখারী) ।
এরপর তিনি কাবার চারপাশে থাকা মূর্তিগুলো উপড়ে ফেললেন । তখন তিনি তেলাওয়াত করছিলেন, ‘বলো, সত্য এসে গেছে, মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে । আর মিথ্যা তো বিলুপ্ত হওয়ারই’। এ সময় তিনি আল্লাহর একত্ববাদ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে তাকবির দিচ্ছিলেন । একইসঙ্গে কাবাঘর প্রদক্ষিণ করতে লাগলেন । মক্কার অধিবাসীরা তাদের পরিণতির জন্য অপেক্ষা করছিল ও একটু দূরে একটা উপত্যকায় অবস্থান করে নবীজিকে লক্ষ করছিল । আল্লাহর রাসুল তখন তো পৃথিবীর এই জগতে নেই । মহান আল্লাহর দরবারে একান্ত কৃতজ্ঞতায় নিজেকে বিলিয়ে দিচ্ছিলেন।
মক্কার অধিবাসীরা নিজেদের অত্যাচারী অতিতের কথা ভেবে দুশ্চিন্তায় সময় পার করছে । তাদের সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করা হয় এই নিয়ে তারা ভয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে আছে । নবীজি ঘুরে তাদের দিকে তাকালেন । তারা জানে, ইনসাফপূর্ণ ফায়সালাও আজ তাদের জন্য কতোটা ভয়ঙ্কর । এরপরও তারা আশা করছে, আল্লাহর নবী তাদের ব্যাপারে ইনসাফপূর্ণ ফায়সালায় যাবেন না । যেহেতু তারা জানত, মুহাম্মদ হলেন দয়া ও ক্ষমার রাসুল । যদি আজ তিনি তাদের ব্যাপারে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেন, তারা ধ্বংস হয়ে যাবে । নবীজি হঠাৎ তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন- হে কুরাইশ জাতি! আজ আমি তোমাদের সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করব বলে তোমাদের ধারণা? যেনবা স্বয়ং এই প্রশ্নই তাদের মুক্তির আভাস । কুরাইশরা দ্রুতই জবাব দিল- আমাদের ব্যাপারে আপনি কল্যাণের ফায়সালা করবেন । এরপর নবীজী বললেন, আজ আমি তোমাদেরকে বলছি, তোমাদের বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নেই । যেমনটা নবী ইউসুফ তার ভাইদেরকে বলেছিলেন । যাও, তোমরা আজ মুক্ত স্বাধীন ।
কুরাইশরা যেন নবজীবন লাভ করল । তারা কল্পনাও করে নি, এভাবে এক মুহূর্তে এক কথায় তারা মুক্তি পেয়ে যাবে । কিন্তু আল্লাহর রাসুল যুদ্ধে যেমন সহনশীল, একইভাবে ক্ষমা ও ঔদার্যে তিনি হলেন মূর্তপ্রতীক । যারা তাঁর প্রতি জুলুম করেছে তাদেরকে ক্ষমা করার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন উঁচু মানসিকতার অধিকারী । ক্ষমা ও ইনসাফ দিয়ে তাদের হৃদয়কে সত্যের প্রতি আগ্রহী করে তুলতেন । একজন সত্য নবীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নেয়া । মানুষকে সত্যমুখী করে তোলা । তিনি তো পৃথিবীর রাজা বাদশাহদের মতো নিরেট আনুগত্য চান না; বরং তিনি আনুগত্যের সঙ্গে ভালবাসাও অর্জন করতে চান ।
একজন নবী, যাকে আল্লাহ বিশ্ববাসীর জন্য রহমতস্বরূপ পাঠিয়েছেন, তার জন্য তো এমনটাই শোভা পায় । তিনি যা চেয়েছেন, কর্মে ও আচরণে ঠিক সেটিই বাস্তবায়ন করেছেন । এরপর নবীজির উদার ও সহনশীল চিন্তাধারার আরো অনেক দৃষ্টান্ত দেখা যায় । কাবার চাবি উসমান ইবনে আবু তালহা থেকে নিয়ে বনু হাশিমের আব্বাস অথবা আলীকে দেয়ার কথা উঠলে তিনি তা সমর্থন করেন নি । ফলে কাবার চাবি উসমান ইবনে আবি তালহার কাছেই রয়ে যায় । নবীজী ঘোষণা করেন, ‘আজ ক্ষমা ও ঔদার্যের দিন’ । নিশ্চয় আল্লাহর রাসুল তো প্রতিশোধ ব্যাপারটার সঙ্গেই পরিচিত নন ।
মুসলিম সৈন্যদল এগিয়ে যাচ্ছিল মক্কার দিকে । কঠোরভাবে তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, কোনপ্রকার রক্তারক্তি করা যাবে না, শুধুমাত্র আত্মরক্ষার প্রয়োজন ছাড়া । সেদিন সাদ বিন উবাদার মত মহান সেনাপতি ভুল করে বলে বসেছিলেন, আজ যুদ্ধের দিন । আজ আল্লাহ কুরাইশকে লাঞ্ছিত করবেন । পরক্ষণেই আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদেশে তার হাত থেকে পতাকা ছিনিয়ে নিয়ে দেয়া হল তার পুত্র কায়েসের হাতে । তার এই ধরনের স্লোগান শুনে মক্কাবাসীরা ভয় পেয়ে যেতে পারে, তাই নবীজি তার স্লোগান বদলে দিয়ে বললেন, আজ রহমতের দিন । আজ আল্লাহ কুরাইশকে সম্মানিত করবেন ।
নবীজি সত্যি কথাই বলেছিলেন । ইসলামের ইতিহাসে যদি নবীজি ও মক্কা বিজয়ের অস্তিত্ব না থাকত, তাহলে সেই মক্কা আর কুরাইশদের কোন মূল্যই থাকত না ।
খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার যেটাকে অবহেলা করার সুযোগ নেই । পৃথিবীর সমস্ত রাষ্ট্রের অধিপতিরা যে অপরাধ ক্ষমা করবে না, নবীজি সেই অপরাধ নির্দ্বিধায় ক্ষমা করে দিয়েছেন । নিশ্চয় এই অপরাধ ছিল সব বিচারেই অনেক বড় বিশ্বাসঘাতকতা, স্পষ্ট রাষ্ট্রদ্রোহিতা । যুদ্ধপরাধের মত অপরাধ তিনি ক্ষমা করেছেন । হাতেব ইবনে আবি বালতাআ; যার একটি উজ্জ্বল অতীত রয়েছে । যিনি উহুদ যুদ্ধে নবীজিকে রক্ষার জন্য এগিয়ে এসেছিলেন ।
আরেকবার ষষ্ট হিজরীতে সাহাবী হাতেবকে চিঠি দিয়ে পাঠানো হয় মিশরের অধিপতি মুকাওকিসের নিকট । হাতেব তখন অত্যন্ত বিচক্ষণতা ও দক্ষতার সাথে দূতালির কাজ পরিচালনা করেন । বাদশাহর বিভিন্ন প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসাবাদের জবাব খুব স্পষ্টভাবেই দেন । মদিনার মুসলিমরা যখন মক্কাযুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন হাতেব চিন্তিত হয়ে পড়েন । মক্কার ভেতরে তার পরিবার ছিল । ফলে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে তার পরিবারের উপর নির্যাতন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে । কাজেই হাতেব সহানুভূতি পাওয়ার জন্য মক্কার মুশরিকদের গোপনে যুদ্ধের খবরটা জানিয়ে দিতে চেয়েছিলেন । মক্কার মুশরিকদের উদ্দেশ্যে একটা চিঠিতে মুসলিমদের যুদ্ধপ্রস্তুতির কথা উল্লেখ করে একজন মহিলাকে দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন তিনি। কিন্তু তা সফল হয়নি। আল্লাহর রাসুল ওহীর মাধ্যমে এই বিষয়ে অবগত হয়ে যান । যে মহিলা চিঠি নিয়ে যাচ্ছিল তাকে পাকড়াও করার জন্য নবীজি আলি ইবনে আবি তালেব, মিকদাদ ইবনে আমর ও যুবাইর ইবনুল আওয়ামকে ‘রওযাতে খাক’ নামক জায়গায় পাঠান । মহিলা তখন সেখান পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল । নবীজি যেভাবে যেই স্থানের কথা উল্লেখ করেছেন, সাহাবীরা সেই জায়গাতেই মহিলাকে পেয়ে গেলেন ।
আল্লাহর রাসূল হাতেবের কাছে এই ঘৃণ্য অপরাধের কারণ জানতে চাইলেন । হাতেব তার কারণ উল্লেখ করলে আল্লাহর রাসূল তাকে ক্ষমা করে দেন । পৃথিবীর কোন রাষ্ট্র এমন অজুহাতে যুদ্ধপরাধ ক্ষমা করবে না । এমনকি সাহাবী উমর হাতেবকে মুনাফিক বলে তাকে হত্যার অনুমতি প্রার্থনা করলে তিনি নিষেধ করেন । তিনি উমরকে বলেন, তোমার কি জানা নেই উমর, মহান আল্লাহ বদরী সাহাবীদের ব্যপারে কি বলেছেন? আল্লাহ বদরী সাহাবীদের উদ্দেশ্যে বলেন, তোমাদের যা ইচ্ছা করো, আমি তো তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছি ।
আধুনিক বিশ্বের যুদ্ধাপরাধী দেশীয় বিশ্বাসঘাতক গাদ্দাররা পরবর্তীতে স্বদেশের কল্যানের জন্য যত কিছুই করুক না কেন, আদালত তাদেরকে কোনমতেই ক্ষমা করে না; কিন্তু ইসলামের মানদণ্ড মানবরচিত আইন থেকে ভিন্ন। আর ইসলামের মানদণ্ডের বাস্তবায়নকারী যদি হন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, যিনি পরহেজগারদের সর্দার, যুদ্ধে ও সন্ধিতে সারা জগতের জন্য রহমত, ক্ষমা, দয়া, মানবতায় যিনি শ্রেষ্ঠ আদর্শ, তাহলে তো আর কোন কথাই নেই ।