লেখক- সালমান মানসুরপুরি
অনুবাদক- উমর আল ফারুক
একজন মুসলমানের জন্য নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লামের সুন্নাহ-মাফিক জীবনযাপন করতে পারার চেয়ে বড়ো সৌভাগ্য আর নেই। নবিজির আদর্শ শুধু মুসলমান নয়; বরং সমগ্র মাবনজাতির মুক্তির মূলমন্ত্র। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমাদের (যারা আল্লাহ, রাসুল এবং আখিরাতকে ভয় করে, তাদের) জন্য তোমাদের রাসুলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ’। [১]
কেউ আল্লাহ তাআলাকে ভালোবাসার দাবি করলেই তা গ্রহণীয় হবে না, যাবৎ না সে নবিজির তরিকামাফিক জীবনযাপন করে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে নবি, আপনি বলে দিন, আল্লাহকে ভালোবাসতে চাইলে তোমরা আমার অনুসরণ করো। তাহলেই আল্লাহ তাআলা তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের গুনাহ মাফ করবেন’। [২]
নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমার সকল উম্মত জান্নাতে যাবে। তবে তারা বাদে, যারা আমাকে অস্বীকার করে। সাহাবায়ে কেরাম রিদওয়ানুল্লাহি আজমাইন জিজ্ঞেস করলেন, ‘কারা অস্বীকার করে’? নবিজি বললেন, ‘যারা আমার অনুসরণ করে, তারা জান্নাতে যাবে। আর যারা আমার অবাধ্যতা করে, তারাই আমাকে অস্বীকার করে’। [৩]
মোটকথা, সকল মানুষের জন্যই আল্লাহ তাআলার আনুগত্যের সাথে সাথে নবিজির অনুসরণ-অনুকরণকেও অপরিহার্য ঘোষণা করা হয়েছে। তাই কুরআনুল কারিমে যেখানেই আল্লাহর আনুগত্যের কথা বলা হয়েছে, সেখানেই নবিজির অনুসরণের কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে নবি, আপনি বলে দিন, তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো এবং রাসুলের অনুসরণ করো। কিন্তু যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও তাহলে রাসুলের ওপর অর্পিত দায়িত্বের জন্য তিনি দায়ী এবং তোমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্বের জন্য তোমরা দায়ী। তোমরা যদি তার আনুগত্য করো তাহলে সঠিক পথ পাবে। রাসুলের দায়িত্ব কেবল স্পষ্টভাবে (বাণী) পৌঁছে দেওয়া।’ [৪]
এ ছাড়াও অন্যান্য আায়াতে উল্লিখিত বিষয়ে সবিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। কতেক আয়াতে রাসুলের আনুগত্যের সাথে সাথে সুন্নাহবিমুখতার ভয়াবহতার কথাও তুলে ধরা হয়েছে। এবং এসব আলোচনার ভেতর দিয়ে যে বিষয়টি খোলাসা করা হয়েছে তা হলো, আল্লাহর হুকুম ও নবিজির তরিকার বাইরে মুমিনের গ্রহণীয় কোনো বিকল্প নেই। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যে বিষয়ে আল্লাহ ও তার রাসুলের হুকুম বিদ্যমান, সে বিষয়ে মুমিন নর-নারীর হস্তক্ষেপের কোনো সুযোগ নেই। আর যে আল্লাহ ও তার রাসুলের অবাধ্য সে তো স্পষ্টতই পথভ্রষ্ট’। [৫]
উল্লিখিত আয়াতসমূহ থেকে ইসলামে ইত্তিবায়ে সুন্নাহ তথা নবিজির সন্নাহ-মাফিক জীবনযাপনের গুরুত্ব এবং সুন্নাহ-বিমুখ জীবনযাপনের ভয়াবহতা সহজেই অনুমেয়।
হাদিসে নববিতেও ইত্তেবায়ে সু্ন্নতের যারপরনাই গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। হজরত আরবাজ বিন সারিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, একদিন নবিজি আমাদের এমন সব উপদেশ দিলেন, যে উপদেশ হৃদয়ে কম্পন এবং চোখে অশ্রু নিয়ে আসে। আমরা আরজ করলাম, ‘আপনার কথাগুলো শেষ বিদায়ের নসিহতের মতো মনে হচ্ছে, অতএব আপনি আমাদের কিছু অসিয়ত (অন্তিম উপদেশ) করুন’। তখন নবিজি বললেন, আমি তোমাদের অসিয়ত করছি, তোমরা আল্লাহকে ভয় করবে। শাসক গোলাম হলেও তার অনুগত থাকবে। যারা লম্বা হায়াত পাবে, তারা অচিরেই অনেক মতপার্থক্য দেখতে পাবে। অতএব তোমরা আমার সুন্নাহ এবং খোলাফায়ে রাশেদার অনুসৃত পদ্ধতি বিপুল বিক্রমে আঁকড়ে থাকবে। প্রত্যেক অবিনব বিষয়ে সতর্ক থাকবে। কারণ, সকল বিদআতই (শরিয়াবর্জিত অবিনব বিষয়াবলি) গোমরাহি। [৫]
অন্য একটি হাদিসে নবিজি বলেন, ‘প্রতিটি কাজেই আছে কর্মচাঞ্চল্য, এরপরে আসে অবসর। তো যার অবসর যাপনও আমার সুন্নাহ-কেন্দ্রিক, সে হেদায়েতপ্রাপ্ত। আর যার অবসরযাপন আমার সুন্নাহকে অতিক্রম করে, তার জন্য রয়েছে ধ্বংস’। [৬]
বিশেষত সুন্নাহ-বিস্মৃত এমন নাজুক সময়ে, যখন সুন্নাহের অনুসারী বিরলপ্রায়। অর্থাৎ, সমাজে যখন সুন্নাহ-মাফিক জীবনযাপন অসম্ভবপ্রায়, ঠিক সেই সময়ে কেউ যদি অস্তিত্বের বিনিময়ে তুমুল যত্নে নবিজির সুন্নাহ আঁকড়ে ধরে, সেই ব্যক্তি হবে অসীম সৌভাগ্যবান। নবিজি বলেন, ’আমার উম্মতের নাজুক সময়ে যে আমার সুন্নাহ আঁকড়ে থাকবে, সে শহিদের মর্যাদা লাভ করবে। [৭] বাইহাকির সূত্রে কতেক বর্ণনায় একশত শহিদের মর্যাদার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।
সুন্নাহ-মণ্ডিত জীবনযাপনকারী জান্নাতে নবিজির বন্ধু ও সাথি হিসেবে বরিত হবেন। একদা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবি-সেবক হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বলেন, ‘ বৎস, সম্ভব হলে সকাল থেকে সন্ধ্যা তথা পুরা দিন মানুষের প্রতি বিদ্ধেষবিহীন কাটাতে পারলে, তা-ই করবে। কারণ এটা আমার সুন্নাহ। আমার সুন্নাহকে ভালোবাসা মানে আমাকেই ভালোবাসা। যে আমাকে ভালোবাসবে, সে আমার সাথে জান্নাতে থাকবে। [৮]
তাই প্রত্যেক মুসলমানের উচিত নবি-জীবনের ক্ষুদ্রবৃহৎ প্রতিটি মুহূর্ত যথাসম্ভব অসীম ভালোবাসায় নিজের জীবনে বিমূর্ত করা। একজন প্রেমিকের কাছে তার ভালোবাসার মানুষের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র-তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়ও প্রাণাধিক প্রিয়। মাহবুবের ব্যাপারে নেতিবাচক কিছু তো এমনকি কল্পনা করাও প্রেমিকের পক্ষে অসম্ভব। আমরা যারা নবিজিকে ভালোবাসি বলে দাবি করি, এই ক্ষণভঙ্গুর মোহগ্রস্ত প্রেমের বিপরীতে নবিজির দরবারে কেমনতরো প্রেম নিয়ে আমাদের হাজির হওয়া উচিত?
ইসলামি আইন-শাস্ত্রমতে কোনো সাধারণ সুন্নাহের প্রতি অবহেলা-উপহাস ঈমানের সীমানা থেকে খারিজ করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। তাই সুন্নাহ পালনের অপারগতার বঞ্চনায় দম্ভ ও অহমের পরিবর্তে অপরাধবোধে বরং লজ্জাবনত থাকা উচিত। যেন এই লজ্জাই কোনো এক সময় বিবেক জাগার নেপথ্য কারণ হয়ে উঠতে পারে।
পরম পরিতাপের বিষয় যে, মুসলিম সমাজে আজ বিজাতীয় সংস্কৃতি গ্রহণীয় ও আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। বিপরীতপক্ষে আমরা নিজেরাই নবিজির সুন্নাহ বিস্মৃত হতে চলেছি। এহেন পরিস্থিতিতে যতই বিলাপ করা হোক; কম হবে।
এখনো সময় আছে, সমাজের সকল স্তরে হৃত সফলতা ও কল্যাণ ফিরিয়ে আনতে নবিজির সুন্নাহকেই একমাত্র মিশন ও ভিশন বানিয়ে আমাদের সকলের একযোগে কাজ করা উচিত। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সন্নাহর খেদমতে শামিল থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।
তথ্যসূত্র:
১. সুরা আহজাব, আয়াত ২১
২. সুরা আলে ইমরান, আয়াত ৩১
৩. সহিহ বুখারি, হাদিস ২৯৫৭
৪. সুরা নুর, আয়াত ৫৪
৫. সুরা আহজাব, আয়াত ৩৬
৬. আবু দাউদ, হাদিস ৪৬৭০
৭. মিশকাত, হাদিস ১৭৬
৮. আত তারগিব ওয়াত তারহিব, পৃষ্ঠা ৬৯