তিনি কবি। শব্দ দিয়ে সাজান রহস্যের বাগান। তৈরী করেন অনুপম হিল্লোল। কথা বলেন, জ্বলে উঠে ছন্দের সবুজ শিখা। আবৃত্তি করেন, বাজতে থাকে মোহময় সেতার। তাঁর শব্দে যেমন স্নিগ্ধতা, বাক্যে তেমন তেজ। স্নিগ্ধতা আর তেজ মিলে তৈরী হয় আশ্চর্য এক ঘোর। প্রেম ও যুদ্ধ তার কবিতায় সমান আবেদনে বলীয়ান।
তিনি যোদ্ধা । গোত্রনেতা। অভিজাত বংশের বাতি। প্রিয় নবীর সা. পিতামহ আবদুল মুত্তালিব তাঁর খালাতো ভাই। ইয়াসরিবের অন্যতম সর্দার। তাঁর নাম সুভায়দ । পিতা ছিলেন সামিত, দাদা আতিয়া, পরদাদা হাওত। সকলেই ছিলেন মদীনার একেক নেতা। হাওতের পিতা হাবীব, দাদা আমর ও পরদাদা আউফ ছিলেন যোদ্ধা, নিপুণ কথক। আউফের বাবা মালিক ছিলেন সেই আউসের সন্তান, যার নামে পরিচিত মদীনার প্রধান এক গোত্র আউস। সেই বংশমহিমায় বরেণ্য ব্যক্তিত্ব সুভায়দ। লোকেরা শ্রদ্ধা করে তাঁকে ডাকে আল কামিল। বহুমুখী গুণাবলীতে পরিপূর্ণ কাউকেই আল কামিল বলা হয়।
সুভায়দ এসেছেন হজ্বে, মক্কায়।মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে সংবাদ।তাঁর তাঁবুর দিকে নজর অনেকের। প্রিয় নবী সা. তখন ইসলামের জীবনবাণী ছড়াতে হজ্বে আগতদের কাছে যাচ্ছেন। প্রেম ও পূণ্যের পয়গাম তিনি পৌছে দিচ্ছেন জনে জনে। গেলেন সুভায়দের তাঁবুতে। পেশ করলেন সত্যের দাওয়াত। শুনালেন সেই মহিমান্বিত আলোর কথা, যা মহাকাশের ওপার থেকে এসেছে তাঁর সমীপে। জানালেন সেই ঐশী ঐশ্বর্যের বার্তা, যার সামনে শ্রদ্ধাবনত মানবীয় প্রজ্ঞা। সুভায়দের গর্ব ছিলো আপন কাব্যশক্তি আর বুদ্ধিমত্তায়। তাঁর জানা ছিলো প্রাচীন প্রজ্ঞাস্নিগ্ধ বহু বাণী ও বক্তব্য। তিনি ভাবলেন, প্রিয় নবী সা. এমনই কিছু জ্ঞানপূর্ণ কথামালা নিয়ে হাজির হয়েছেন, যার উত্স মানবমস্তিস্ক। এমন বাণীর যথেষ্ট সম্ভার ছিলো তাঁর কবিতায়, স্মৃতিতে। অতএব, তিনি বললেন, হয়তো আপনি এমন কিছু নিয়ে এসেছেন, যা আমার কাছে আছে!
প্রিয় নবী সা. জানতেন, সুভায়দের মনে প্রজ্ঞাদীপ্ত বাণীর ধারণা কাজ করছে। তিনি বললেন, কী আছে
তোমার কাছে?
সুভায়দ বললেন, সেই প্রজ্ঞা, যা লুকমান হাকিম থেকে এসেছে। নবীয়ে পাক সা. বললেন, আমাকে কিছু পড়ে শুনাও।
সুভায়দ আবৃত্তি করে শুনালেন। প্রজ্ঞার ব্যাপারে সুভায়দের শেষ ঠিকানা ছিলেন লুকমান
হাকিম। তার বাণীতে আসলেই ছিলো জাদুকরী প্রভাব ও গভীর তাত্পর্য । কিন্তু প্রিয় নবীর সা.
প্রজ্ঞা ছিলো এমন এক অন্তহীন আলোকের ধারা, যার একটি বিন্দু রাখাল লুকমানকে মহাজ্ঞানী
লুকমান বানিয়েছে।
লুকমানের বাণীর প্রশংসা করলেন প্রিয় নবী সা.। বললেন, সুভায়দ, আমি তোমাকে শুনাচ্ছি এক বাণী,যা অনেক উত্তম। যা নিজেই এক নূর, যে নূর আল্লাহ থেকে এসেছে। প্রিয় নবী সা. তেলাওয়াত করলেন কালামে এলাহী থেকে। সুভায়দ এ বাণীর সুরে ও সারে যে অপার্থিব শক্তি লক্ষ্য করলেন, তার স্বীকৃতি না দিয়ে পারলেন না। বললেন, সন্দেহ নেই, এ এক মহাবাণী। উত্তম বার্তা।
সুভায়দ ভাবনায় পড়ে গেলেন, এ বাণীর সত্যকে গ্রহণ করে নেবেন কি না? সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না তিনি। ভাবাতুর ও দোদুল্যমান মন নিয়ে ফিরে গেলেন মদীনায়। সেখানে গৃহযুদ্ধ লেগেই ছিলো। আওস-খাজরাজের এক যুদ্ধে নিহত হলেন সুভায়দ।
মৃত্যুর সময় তাঁর পাশে ছিলেন স্বগোত্রীয় অনেকেই। তাঁদের কেউ কেউ বলেছেন, সুভায়দ মুসলিম হয়েই মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
সুভায়দের মৃত্যু আওস গোত্রের পরাজয় নিশ্চিত করলো। হেরে যাওয়া গোত্রটি প্রতিশোধ নিতে হলো উন্মুখ। ইয়াসরিবে এটাই ছিলো বাস্তবতা। যুদ্ধে একদল হারবে, জিতবে আরেকদল। যুদ্ধ শেষে কেউই বসে থাকবে না। নতুন করে প্রস্তুতি নিতে থাকবে আরেকটি যুদ্ধের। যে যুদ্ধের আগুন জ্বালিয়ে দেয়ার জন্য ইয়াসরিবের ইহুদিরা ছিলো সারাক্ষণ সক্রিয়।আওসের প্রয়োজন প্রতিশোধ। পরবর্তী যুদ্ধে তাই বন্ধু চাই। সবল ও পরাক্রান্ত বন্ধু। অতএব কুরাইশের বিকল্প কোথায়? তাদের সাথে মিত্রতা চুক্তির জন্য আওসের শ্রেষ্ঠ কিছু মেধাবী ও বিচক্ষণ ব্যক্তি যাত্রা করলেন মক্কার পথে। কাফেলার নেতা আনাস বিন রফী। আবুল হাইসর তার ডাকনাম। গমগমে ও ভারি কণ্ঠস্বর, ভয় পেতে হয়, এমন ব্যক্তিত্ব। বনী আবদিল আশহাল গোত্র তার নেতৃত্বে হয় পরিচালিত। কাফেলায় তার সহকারী আয়াস বিন মুয়াজ। বনী আবদিল আশহালের তাগড়া নওজোয়ান।সাহসী ও লড়াকু। বুদ্ধিবিবেচনায় প্রাগ্রসর।
দ্রুতই তারা এলেন গন্তব্যে, তাঁবু ফেললেন মক্কার নিকটেই । প্রিয়নবী সা. তখন দাওয়াতে; পথে পথে, তাবুতে তাবুতে তার আলোকময় বিচরণ। এক সমুদ্র কল্যাণকামনা নিয়ে তিনি মক্কায় আগত প্রতিটি
কাফেলার কাছে যান। সাফল্যের সবক দিতে হবে তাদের! মুক্তির পথ চেনাতে হবে তাদের। যদি তারা কল্যাণের দিশা না পায়, বিপন্ন হবে তাদের ইহকাল, পরকাল। ব্যর্থ ও বিপন্ন হবার জন্য তো জন্ম নেয়নি মানুষ। সত্য-সুন্দরের শিক্ষা ও দীক্ষা ছাড়া তারা সফল হবে না। সেই সাফল্যের পথ ও পাথেয় নিয়ে প্রিয় নবী সা. আগমন করেছেন দুনিয়ায়। একটি মানুষও যেন বঞ্চিত না হয় সেই পথ ও পাথেয়
থেকে। ইয়াসরিব থেকে আগত কাফেলার দিকে এগিয়ে চলছেন প্রিয়নবী সা.। সরদার আবুল হাইসরের
তাবুতে প্রবেশ করবেন। সেখানে তখন কাফেলার সবাই অবস্থান করছিলো। বিশেষ পরামর্শে তাঁরা
মিলিত হয়েছে। প্রিয় নবী সা. তাবুতে হাজির হতেই তারা স্বাগত জানালো। মহান আল আমিন এসেছেন।
আরবের বিশ্বস্ত সজ্জন এসেছেন। কী বলতে চান তিনি?
প্রিয় নবী সা. বললেন, তোমরা যে উদ্দেশ্য সাধনে এখানে এসেছো, তার চেয়ে উত্তম বার্তা আমি কি
তোমাদের শোনাবো? তোমরা কি এমন কিছু গ্রহণ করবে?
যুদ্ধ, নৈরাজ্য ও হত্যা থেকে কে না পরিত্রাণ চায়? ইয়াসরিব তখন রক্ত ও ধ্বংসলীলায় বধ্যভূমি। এ
থেকে মুক্তি চাইতো সকলেই, কিন্তু মুক্তি কোথায়, কেউই জানতো না। এখানে জীবন যেন লড়াই ও
শত্রুতা, মারা ও মরার মধ্যেই খাবি খাচ্ছিলো। সব কিছুতেই এ মানসিকতার ছায়া পড়তো, গোত্রদ্বন্দ্ব
এসে জোড়ে বসতো। এই হঠাত্ ইয়াসরিবের লোকদের কানে উচ্চারিত হলো ভিন্ন ও উত্তম বাণীর
প্রস্তাব। তারা সাড়া দিলো । শুনতে চাইলো। প্রিয় নবী সা. বললেন, ‘আমাকে পাঠিয়েছেন নিখিলের
স্রষ্টা। আমি তারই প্রতিনিধি। তিনি আমাকে পাঠিয়েছেন, যেন আমি মানুষের পথকে তার পথে মিলিয়ে
দিই। সে পথে তাদের ডাকি। যেন তারা ইবাদত করে তারই, তার সাথে কাউকেই শরীক না করে। তিনি
প্রেরণ করেছেন তারই এক কিতাব, যেখানে আছে পথের দিশা। প্রিয় নবী সা. তাদের সামনে পেশ
করলেন ইসলামের নীতি-নিয়ম। তেলাওয়াত করে শুনালেন আল্লাহর কালাম।
আয়াস বিন মুয়াজের সত্যসন্ধানী হৃদয়ে জেগে উঠলো তরঙ্গ। নিজেদের লক্ষ্যের ক্ষুদ্রতা আর
প্রিয়নবী সা. প্রদর্শিত লক্ষ্যের মহিমা তিনি অনুভব করলেন। বললেন, হ্যাঁ, মহোত্তম এক আদর্শের
দিশা। বন্ধুগণ! সন্দেহ নেই, এটা এমন বিষয়,যা আমাদের বিষয়ের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর। আমরা যে জিনিশ
চাইছি, এর চেয়ে এই জিনিশ মহার্ঘ্য।
আবুল হাইসর ক্ষুব্ধ হলো। ভূমি থেকে অনেকগুলো পাথরকণা উঠিয়ে ছোড়ে মারলো আয়াসের মুখে।
বললো, বিতাড়িত হও আমাদের থেকে।আমরা লক্ষ্য ভুলে যেতে পারি না। নতুন ধর্মে দীক্ষা নিতে
আমরা এখানে আসিনি।’’
আয়াস চুপ হয়ে বসে রইলেন। প্রিয় নবী সা. বিদায় নিয়ে চলে আসলেন। প্রতিনিধিদল কুরাইশনেতাদের
কাছে গেলো। কামনা করলো বন্ধুত্ব। কিন্তু আবু জেহেল সায় দিলো না। ফলে চুক্তি হলো না। কাফেলা
ফিরলো ইয়াসরিবে। একটি লক্ষ্য তারা তাড়া করেছিলো, যাতে তারা ব্যর্থ। আরেকটি লক্ষ্য তাদের
সামনে হাজির হয়েছিলো, যাকে তারা শ্রেষ্ঠ হিসেবেই জানে, কিন্তু তাকে পরিহার করলো অবহেলায়।
বেদনা ও ব্যর্থতাবোধ তাদের মাথার উপর মেঘের মতো ঘুরছিলো।
ইয়সরিবে যুদ্ধের উনূনে যে আগুন ধীরে ধীরে জ্বলছিলো, তা লেলিহান হলো অচিরেই। সংগঠিত হলো
প্রলয়ঙ্করী এক যুদ্ধ, যার নাম হারবুল বুয়াস। সেটা ৬১৭ সনের ঘটনা। হিজরতের তখনো চার-পাঁচ
বছর বাকি। ইয়াসরিবের দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে, ইহুদিগোষ্ঠী বনু নযীর ও বনু কুরাইযার বসতির
পূর্বপ্রান্তে বয়ে গেলো রক্তনদী। বনূ নযীর ছিলো আওসের পক্ষে, বনূ কুরাইযা ছিলো খাজরাযের
সাথে। আওস ও খাজরায হলো মুখোমুখি। বনূ নযীর ও বনূ কুরাইযা উভয়কে কেবলই উস্কে দিয়েছিলো
আর দিয়েছিলো এমন প্রতিশ্রুতি, যা তারা বাস্তবায়ন করবে না। যুদ্ধ এড়ানোর কোনো পথই থাকলো
না। আওস-খাজরাজের অধিকাংশ বীর নিহত হলো এ যুদ্ধে। বুয়াস যুদ্ধ দুই গোত্রকে নেতৃত্বশূন্য করে
দেয়। ইয়াসরিবে নিয়ে আসে ব্যথাহত দীর্ঘ রাত। বিনাশের শোকে ছেয়ে যায় প্রতিটি ঘর। যদিও আউসের
জয় হয়েছিলো, কিন্তু এর জন্য এতো মূল্য দিতে হয়েছিলো, যা ছিলো অসহনীয়। যুদ্ধে আয়াস অংশ নেন
এবং যাতনা নিয়ে ঘরে ফিরেন। কিছু দিন পরেই তাঁর মৃত্যু হয়। যারা মৃত্যুর সময় নিকটে ছিলেন, তারা
বলেন, আয়াস মরণের সময় অনবরত পাঠ করছিলেন তাহলিল বা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, তাকবীর বা
আল্লাহুআকবার, তাহমিদ বা আলহামদুলিল্লাহ, তাসবিহ বা সুবহানাল্লাহ! তার ইহকালের সফর শেষ
হয় এসব বাক্য মুখে নিয়েই। ইমাম তাবারী লেখেন, নিকটজনের দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো, আয়াস রা. মারা
গেছেন মুসলিম হয়েই। অথবা কমপক্ষে আয়াস ইসলামের সত্যতার স্বীকৃতি দিয়েছিলেন, সত্যধর্ম
হিসেবে একে মেনে নিয়েছিলেন!ইবনে কাসীরের বক্তব্য, তিনি যে মুসলমান হয়ে মৃত্যুবরণ করেন, এতে
কারো সন্দেহ ছিলো না।
যুদ্ধ ইয়াসরিবের রুগ্ন চেহারা বের করে আনলো। সহিংসতার আঁচড়ে সমাজজীবন মলীন ও বিবর্ণ্।
ভেঙ্গে পড়েছে শৃঙ্খলা। নষ্ট হয়েই চলছে সম্পদ, ফসলের বাগান। বিপন্ন হয়ে উঠেছে বসতিগুলোর
ক্ষমতার উrস। একজন নেতা প্রয়োজন ছিলো ইয়াসরিবের। যে বিবাদমান গোত্রগুলোর ঐক্য রচনা
করবে। কিন্তু কে হবে সেই নেতা?
আবদুল্লাহ ইবনে উবাই খাজরাজ গোত্রের বড় এক সর্দার। সে বুয়াস যুদ্ধে অংশ নেয়নি। সে চায়নি
এ যুদ্ধ। যুদ্ধের বিরুদ্ধে তার অবস্থান তৈরী করেছিলো নিরপেক্ষ এক ভাবমূর্তি। ইয়াসরিবের সর্ব্ময়
নেতৃত্ব ও রাজাসন তার জন্যেই স্থির হতে যাচ্ছিলো। কারণ এমন কোনো নেতা আর ছিলেন না,
যাকে বিরোধলিপ্ত উভয় গোত্র মেনে নেবে। কিন্তু আবদুল্লাহ ইবনে উবাই মানুষ হিসেবে ছিলো
বিপজ্জনক, আত্মকেন্দ্রিক,বহুরূপী।গরীব ও বলহীনদের সাথে তার আচরণ ছিলো অবিচারমূলক। তার
হাতে নেতৃত্ব যদি যায়, তবে কি তৈরী হচ্ছে না নতুন অনিশ্চয়তা? একজন নেতাকে ক্ষমতায়
বসানোই কি সমাধান ? সঙ্কট থেকে সত্যিকার উত্তরণে নতুন ব্যবস্থা কি জরুরী নয়? এসব প্রশ্নে
বহু হৃদয় ছিলো কম্পমান । এমনকি খাজরাজ গোত্রের অনেকেই ছিলেন ইবনে উবাইকে নিয়ে
বিচলিত।
ইয়াসরিব তখন নতুন নেতৃত্বের জন্য উদগ্রীব। জনপদের অধিবাসীরা ছিলো আত্মসচেতন,
স্বাধীনচেতা। তাদের ছিলো সুদৃঢ় মনোবল। কোনো অন্যায়ের সাধ্য নেই, তাদের উপর রাজত্ব করে।
শান-শওকত ছিলো তাদের ঐতিহ্য। মেহমানদারি ও আভিজাত্য ছিলো মজ্জাগত। তাদের নেতৃত্ব দিতে
হলে অবশ্যই ন্যায়নিষ্ট, সত্য ও সততাঋদ্ধ নেতৃত্ব ও ব্যবস্থা ছিলো অপরিহার্য। সহজাত নেতৃত্বগুণ
ঈযাসরিবের অনেকের মধ্যে থাকলেও তারা জনপদকে পারছিলো না অশান্তির অন্ধকার থেকে পরিত্রাণ
দিতে। অধিবাসীরা ছিলেন নতুন জীবনব্যবস্থার জন্য কাতর। সত্য ও ইনসাফের নতুন সকাল পেতে
চাচ্ছিলো তারা। আর এদিকে খোদাপ্রদত্ব জীবনব্যবস্থার আলোকশিখা নিয়ে মক্কায় দাওয়াতী অভিযান
চালাচ্ছেন রাসূলে কারীম সা.। ধ্বংস ও বিপন্নতা থেকে তিনি মানুষের মুক্তির পথ বাতলে দিচ্ছেন।
সত্য ও ইনসাফের নতুন সকাল তিনি পৃথিবীকে উপহার দিতে চান।
হজ্বের মৌসুম। নবুওতের একাদশ বর্ষ্।(কারো মতে দশম বর্ষ্, আবুল কালাম আযাদের মতে
নবম বর্ষ্) খাজরাজ গোত্রের কিছু লোক মক্কায় এলেন। তারা হজ্ব করবেন। পবিত্র এক আবেগ
তাদের মনে, মগজে। তারা অবস্থান করছিলেন জবলে হেরা ও মীনা পাহাড়ের মধ্যবর্তী আকাবায়।
জায়গাটি মক্কা থেকে আনুমানিক তিন মাইল দূরে। প্রিয় নবী সা. এখানে এসেছেন দূরাগতদের প্রতি
দ্বীনের পয়গাম নিয়ে। সাক্ষাr হলো ইয়াসরিবের আগন্তুকদের সাথে। প্রিয় নবী সা. এর সাথে তাদের
শুরু হলো প্রাথমিক কথাবার্তা।-
: তোমরা কোন কাবিলার লোক?
: আমরা খাজরাজী
: তোমরা কি ইয়সরিবের ইহুদিদের সহযোগি ও বন্ধু-মাওয়ালি ?
: হ্যাঁ, আমরা তাদের বন্ধু, সহযোগি।
: আপনারা কি মেহেরবানী করে কিছু সময়ের জন্য বসতে পারবেন, যাতে স্বস্তির সাথে আপনাদের
সমীপে কিছু কথা নিবেদন করতে পারি।
প্রিয় নবীর সা.ব্যক্তিত্ব, বাক্যের বিনয় এবং উচ্চারণের শীতলতা তাদেরকে টানছিলো ক্রমাগত।
তারা খুব আগ্রহ নিয়ে বসলেন। প্রিয় নবী সা. তাদেরকে তাওহিদের দাওয়াত দিলেন। প্রতিমাপূজা
থেকে আহবান করলেন মুক্ত হবার জন্য, তাদের সামনে পেশ করলেন ইসলামের শিক্ষা ও সুন্দরতা।
আর শুনালেন খোদার কালাম!
কিছুক্ষণের সান্নিধ্য । আগন্তুকদের বুঝতে বাকি থাকলো না, কে তাদের সম্মুখে বসে আছেন! তাদের
মনের গহীনে শেষ নবীর সা. একটি প্রতীক্ষা ছিলো জাগ্রত। সেটা জাগিয়ে দেয় মদীনার ইহুদীরা।
তারা নানা প্রেক্ষাপটে আওস-খাজরাজকে হুমকি দিতো, বেশি বাড়াবাড়ি করবি না, আসতেছেন শেষ
ও শ্রেষ্ঠ নবী। তিনি এ শহরেই আসবেন। তার হাতে পরাজিত হবে দুনিয়ার সকল শক্তি। তার
পেছনে ঐক্যবদ্ধ হবো আমরা। তিনি আসবেন আমাদেরই মধ্য থেকে …
খাজরাজের আগন্তুকরা মহাসুযোগ পেয়ে গেলেন। ইহুদিদের হারাতে হবে। তাদের আগে আমরা পেয়ে
গেছি শেষ নবীর সা.সন্ধান! সৌভাগ্য ও মহিমার দিক থেকে ইহুদিরা আমাদের পেছনে ফেলতে পারে
না।দ্রুতই তারা ইসলাম গ্রহণ করে নিলেন।
প্রিয় নবীর সা. সমীপে তারা পেশ করলেন একটি নিবেদন। ‘আমরা আমাদের জাতিকে ছেড়ে
এলাম।কারণ আর কোনো কবিলা ঘৃণা ও হিংসায় ওদের মতো এতো বেশি টুকরো টুকরো হয়নি।
হয়তো মহান প্রভু আপনার মাধ্যমে তাদেরকে আবারো এক করে দেবেন, জোড়া লাগাবেন। যদি
আপনি অনুমতি দেন, আমরা তাদের কাছে ফিরে যাই, তাদেরকে আপনার শেখানো সত্যের আহ্বান
জানাই। দয়াময় যদি তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে দেন, তাহলে আপনার চেয়ে শক্তিমান কেউ থাকবে
না।’
খাজরাজ গোত্রের মহিমান্বিত এই ছয় সাড়াদানকারী ইতিহাসকে নতুন বাকবদলের সামনে হাজির করলেন। তারা
ছিলেন –
১.হযরত আসাদ ইবন যুরারা রা.
২.হযরত আউফ ইবন হারিস বিন রেফায়া বিন আফরা রা.
৩.হযরত রাফি ইবন মালিক বিন আজলান রা.
৪.হযরত কুতবা ইবন আমির বিন হাদীদা রা.
৫.হযরত উকবা ইবন আমির বিন নবী রা.
৬.হযরত জাবির ইবন আবদুল্লাহ ইবন রিয়াব রা.
কোনো কোনো ঐতিহাসিক হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ রা. এর পরিবর্তে হযরত উবাদা ইবন সামিত রা. এর নাম
উল্লেখ করেছেন কোনো বিবরণে এসেছে আটজনের উল্লেখ, যারা তখন মুসলমান হয়েছিলেন। সপ্তমজন ছিলেন
হযরত বারা ইবনে মারুর রা. অষ্টমজন হযরত আবুল হাইছম মালিক বিন তায়্যিহান রা.।
এরা ছিলেন ইয়াসরিবের জ্ঞানী ও গুণী নেতা। বয়সে তরুণ। যুদ্ধ ও বিনাশ তাদেরকে ক্লান্ত করেছিলো। তাদের
অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্ব হযরত আসআদ বিন যারাহ রা. ছিলেন খাজরাজের বনু নাজ্জার উপগোত্রের অন্যতম সরদার। তার উপনাম ছিলো আবু উমামা। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, সবার আগে তিনিই বায়আত গ্রহণ করেন
প্রিয়নবীর সা. হাতে। খোদার হাবীব সা. তাঁকে বানালেন বনু নাজ্জারের নকীব। তিনি সা. হিজরত করে
ইয়াসরিবে আগমন করলে নবীজীর সা. উটনী থাকতো আসআদ রা.এর তত্ত্বাবধানে। তিনিই এর দেখাশোনা
করতেন।মদীনায় প্রিয় নবীর সা. শুভাগমনের পরে সবার আগে যে সাহাবী দুনিয়া থেকে বিদায় নেন, তিনি হলেন
হযরত আসআদ বিন যারারাহ রা.। পহেলা হিজরীর শাওয়াল মাসে তিনি দুনিয়ার সফর সমাপ্ত করে পরকালের
মেহমান হন। আওফ বিন হারিস রা. ছিলেন বনু নাজ্জারের অসম সাহসী এক যোদ্ধা্ ইবনে আফরা নামে তিনি
ছিলেন প্রসিদ্ধ। আফরার সন্তানরা সত্যপ্রীতি ও আত্মত্যাগে ছিলেন অগ্রণী।আওফ বিন হারিসের ভাই ছিলেন হযরত
মায়াজ ও মুআউয়িজ ইবনে আফরা রা.। বদরের যুদ্ধে এ দুই কিশোর দু:সাহসের অবাক দাস্তান তৈরী করেন।
হত্যা করেন উম্মতের ফারাও-আবু জেহেলকে!
হযরত রাফে’ বিন মালিক রা. ছিলেন ইয়াসরিবের হাতে গোণা শিক্ষিতদের অন্যতম। খাজরাজের বনী যুরায়ক
শাখার উজ্জ্বল এক ব্যক্তিত্ব তিনি। ছিলেন যোদ্ধা ও বোদ্ধা। ইসলাম গ্রহণের পরে তার হাতে প্রিয় নবী সা. তুলে
দেন আল কুরআনের এক অনুলিপি, যাতে লিখিত ছিলো এ সময় অবধি নাযিল হওয়া সকল আয়াত। তিনি এর
তেলাওয়াত ও হিফজে হন নিমগ্ন। নিয়োজিত হন কোরআনের শিক্ষাদান ও প্রচারে।
হযরত কুতবা বিন আমির রা. ছিলেন খাজরাজের বনী সালমাহ শাখার এক নেতৃতরুণ।তার উপনাম ছিলো আবূ
যায়েদ।ইসলাম গ্রহণের পরে ইয়াসরিবে এর প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় তিনি রাখেন বিশেষ ভূমিকা। বদর-ওহুদে তিনি
ছিলেন প্রিয় নবী সা. এর নিকটে অবস্থানকারী দু:সাহসীদের একজন।বীরত্ব ও আত্মত্যাগের নজির পেশ করেন
ইসলামের প্রতিটি জিহাদে। বনু সালমাহ এর নেতৃত্বে তার বিচক্ষণতা ও দূরদৃষ্টি ছিলো অসাধারণ। মক্কা বিজয়ে
তার হাতে ছিলো তার গোত্রের পতাকা। হযরত ওসমান রা. এর খেলাফতকালে তিনি দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণ
করেন।
জাবির ইবনে আবদুল্লাহ রা. ছিলেন খাজরাজের বনু উবাইদ বিন গনম শাখার সরদারপুত্র। তার পিতা
আবদুল্লাহ রা. ছিলেন শেষ আকাবার অন্যতম নকীব। তার দাদা আমর ছিলেন বনু সালামা ও জাবির
ইবনে আতিকের নিকটে অনেকগুলো দুর্গের মালিক। ছিলেন আয়নুল আরযাক নামক বিখ্যাত কুয়োর
মালিক। আরবের মশহুর এক রইস ছিলেন তিনি।তার মৃত্যুর পর এসব সম্পদের মালিক হন হযরত
আবদুল্লাহ রা.। যাবির রা. যখন ইসলাম গ্রহণ করেন, তখন তিনি সবেমাত্র তরুণ। আবু আব্দিল্লাহ ছিলো
তার উপনাম। প্রিয় নবীর সা. সান্নিধ্যে তিনি এতোই আলোকিত হন, যে, ইসলামী জ্ঞানশাস্ত্রে হয়ে উঠেন
চিরকালের অবিকল্প এক ব্যক্তিত্ব। তার সূত্রে বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা ১৫৬০টি। প্রিয় নবীর সা. সাথে ১৯
টি যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। সিফফিনের যুদ্ধে ছিলেন হযরত আলী রা. এর সঙ্গী। ইন্তেকাল করেন ৯৪
বছর বয়সে, ৭৮ হিজরীতে।
উকবা ইবনে আমির রা. প্রথম জীবনে ছিলেন মদীনার বনু জুহানা গোত্রের এক বুদ্ধিমান রাখাল।
বিচক্ষণতার জন্য তার খ্যাতি ছিলো। ইসলাম তাকে জ্ঞানজগতের মহীরোহ বানালো। তিনি হলেন মহান
এক আলেম, আইনবিদ, কুরআনবিশেষজ্ঞ।নিজ হাতে কুরআন মজিদের একটি সঙ্কলন তৈরী করেন। সুমধুর
ও হৃদয়গ্রাহী ছিলো তাঁর কুরআন তেলাওয়াত। একই সাথে দক্ষ যোদ্ধা, ধনী ও দানশীল এবং সুশাসক।
সবকিছুর উপর তিনি ছিলেন মুহাদ্দিস, হাদীস রেওয়ায়েতকারী। ওহুদ থেকে নিয়ে প্রিয় নবীর সা.
জীবদ্ধশায় সংগঠিত প্রতিটি যুদ্ধেই তিনি ছিলেন অগ্রণী সক্রিয়। ওমর রা.এর শাসনামলে দামেশক জয়ে
তার নিপুণ তীরন্দাজির খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। মুয়াবিয়া রা. তাকে মিসরের শাসক নিয়োগ দেন।
প্রসিদ্ধমতে ৫৮ হিজরীতে তার ইন্তেকাল হয়।
এরা সকলেই ছিলেন গুণী, সম্মানিত। ইসলামের বাহক হয়ে এলেন ইয়াসরিবে। যে বৈঠকে বসতেন, সেখানেই
নবী সা. এর উল্লেখ করতেন। প্রচারণা পৌঁছে বিশেষ মাত্রায়। এমন কোনো গৃহ বাকি থাকেনি, যেখানে প্রিয় নবীর
সা. প্রসঙ্গ আলোচিত হচ্ছিলো না। এমন কোনো বৈঠক বাকি থাকেনি, যেখানে খোদার হাবীবের সা. নাম গুঞ্জরিত
হতো না। চারদিকে ছড়াতে থাকলো ঔrসুক্য। সত্য ও মুক্তিসন্ধানীরা আলোর এই আন্দোলনের প্রতি উদগ্রীব হয়ে
উঠলেন।
বছর পেরোলো। নবুওতের বারোতম সন।হজ্বের মৌসুম। ৬২১ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাস। বারো আলোকপিয়াসী
ইয়াসরিব থেকে যাত্রা করলেন প্রিয়নবীর সন্নিধানে। গতবছরের সত্যলাভকারী পাঁচজনই আছেন কাফেলায়। জাবির
বিন আবদুল্লাহ রা. আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অসুবিধা তাঁকে আটকে দিয়েছে। নতুন যারা যাত্রী, তারা আওস-
খাজরাজের গুণীজন। খাজরাজের বনূ নাজ্জার গোত্রের আওফ ইবনে হারিস রা. তার ভাই মুআয বিন হারিসকে
অনুপ্রাণিত করেছেন। তিনি শামিল হয়েছেন কাফেলায়। রাফি বিন মালিকের রা. প্রচেষ্টায় তার বন্ধু ও আত্মীয় বনু
যুরাইক গোত্রের যাকওয়ান বিন আবদে কাইস ইসলামের প্রতি হয়েছেন উদ্বুদ্ধ। তিনিও রওয়ানা মক্কাগামী দলে।
খাজরাজের বনী আওফ শাখার উবাদা বিন সামিতকে কাফেলায় যুক্ত করাটা ছিলো বিরাট সাফল্য। এ জন্য অনেক
সাধনা করতে হয়েছে জাবির বিন আবদুল্লাহ রা. উকবা বিন আমির রা. প্রমুখকে। রাফে’ বিন মালিকের রা. কাছ
থেকে কুরআন শুনে তিনি বিশেষবাবে আগ্রহী হন নতুন দ্বীনের প্রতি। কুতবা বিন আমিরের রা. বন্ধু বনী
সালিমের আব্বাস বিন উবাদা বিন নাজলাহ বনী সালিমের রত্ন। খাজরাজের এই উপগোত্র তাকে নিয়ে ফখর করে।
তিনি আছেন যাত্রীদলে।খাজরাজের বনূ গনমের মিত্র ছিলো বনি বাল্লি গোত্র। আবু আবদুর রহমান ইয়াজিদ বিন
সালাবা সেই গোত্রের সr, ন্যায়বান সুপুরুষ। কাফেলায় তার অংশগ্রহণ সবাইকে করেছে আনন্দিত।
খাজরাজের কিছু লোক নতুন দ্বীনের দাওয়াত দিলেও আওসের কিছু সত্যপিপাসু তাতে সাড়া দেন। এটা অস্বাভাবিক
ছিলো তখনকার বাস্তবতায়। কিন্তু যে দ্বীনকে তারা উপস্থাপন করেন আওসের বন্ধুদের কাছে, সেখানে ছিলো গোত্রীয় সীমানার উর্ধ্বের এক জীবনীশক্তি। নতুন জীবনবোধ, নতুন ঐক্য, নতুন বন্ধনের পয়গাম। যেখানে কবিলার নামে , গোষ্ঠীগত আবেগে বিভক্তি, হানাহানি ও নরহত্যার কোনো জায়গা নেই। খাজরাজের আহবায়কদের নিয়ে আসা পয়গামে সাড়া দিতে অসুবিধা হলো না আওসের বনী আবদিল আশহালের আবুল হাইসাম মালিক বিন
তায়্যিহানের,আওসের বনী আমর বিন আওফের উয়ােইম বিন সায়িদাহ এর।
বহু কাল পরে আজ আওস-খাজরাজের উপস্থিতিতে একটি কাফেলা এগিয়ে চলছে একই লক্ষ্যে, একই আবেগে, একই গন্তব্যে।এর আগে তাদের প্রতিনিধিদল বহু বার মক্কায় গিয়েছে।গিয়েছে আলাদাভাবে, পরস্পরের গলাকাটায় সহায়তা লাভের প্রয়োজনে। এবার তারা যাচ্ছেন মিলিতভাবে, পরস্পরের বুকে বুক, আর গলায় গলা মিলিয়ে দেয়ার
আয়োজনে। তারা প্রিয়নবীর সা. সাথে সাক্ষাতে মিলিত হলেন মীনার সন্নিকটে, আকাবার এক ঘাঁটিতে।
তারা বায়আত গ্রহণ করেন নবীজীর সা. হাতে। সত্য অবলম্বনের জন্য প্রিয়নবীর সা. আনুগত্যের জন্য।
বায়আতের ছিলো কয়েকটি ধারা, যা লিপিবদ্ধ করেন হযরত উবাদা ইবনে সামিত রা.। তারা প্রতিশ্রুত হন,
আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক না করার জন্য।
চুরি না করা, ব্যভিচার না করা এবং শিশুহত্যা না করা, কারো বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ না রটানো, কারো
দুর্নাম না করার ওয়াদায় আবদ্ধ হন তারা । তারা শপথ নেন রাসুলে খোদার সা. কোনো আইনসঙ্গত আদেশ
অমান্য করবেন না বলে এবং সুখে-দু:খে প্রিয় নবীর সা. অনুগত থাকবেন এবং তাকে মেনে চলবেন বলে।
এটা ছিল আনসারদের প্রথম মিলিত শপথ। ইতিহাসে যা বিখ্যাত আকাবার প্রথম বায়আত নামে। বারোটি তাজা ও
উদ্যমী প্রাণ সত্যের শিখাকে হৃদয়ে জ্বালালেন। এ শিখা তাদেরকে জ্যোতির জয়ের জন্য জাগিয়ে তুললো। এখন তারা ইয়াসরিবে সত্য-সুন্দরের রাজত্ব দেখতে চান। সবার প্রত্যাশা, সকল মানুষ আলোর ছাদের নিচে সমবেত হোক।
তারাও লাভ করুক সেই সত্যসুধা, যাতে তারা অবগাহন করলেন এই মাত্র। তারা প্রিয় নবীর সা. সমীপে আরজ
করলেন, আমাদের শিক্ষক দিন, যিনি শেখাবেন আল কোরআন, যিনি আমাদের জানাবেন ইসলামের আইন-কানুন।
ঈমান অবধারিত করলো শিক্ষাকে। ঈমান যেইমাত্র প্রবেশ করলো হৃদয়ে, হৃদয় জানলো তাকে কী চাইতে হবে! হৃদয় চাইলো শিক্ষা, শিক্ষক!
প্রিয় নবী সা. শিক্ষক হিসেবে পাঠালেন হযরত মুসআব ইবন উমায়র রা.কে।তিনি আবদুদদার গোত্রের যুকব।
বিত্তবান ছিলেন তিনি। অভিজাত, রাজপুত্রের মতো ছিলো তার জীবন। যখন ঘোড়ায় চড়ে বের হতেন, তার গায়ে থাকতো অতিশয় দামী পোশাক। পেছনে থাকতো দাসের বহর। কিন্তু ইসলাম গ্রহণের ছেড়ে দেন সকল বিলাস। মুসলিম হওয়ার অপরাধে পিতার চরম অত্যাচারের সম্মুখিন হন। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত তার উপর দিয়ে বয়ে গেছে অগ্নিময় নিষ্ঠুরতা। এরই মধ্যে থেমে যায়নি তার কুরআন শিক্ষা। গতিমান ছিলো জ্ঞানের চর্চা । সব ধরণের সুবিধা ও প্রাপ্য থেকে তাকে বঞ্চিত করে পরিবার ও সমাজ।তখন শুধু একটি কম্বল পরিধান করতেন তিনি। কয়েকটি কাঁটার সাহায্যে যা আটকানো থাকতো গায়ে। কিন্তু ইসলাম তাকে দেয় মহিমার আসন। ইয়াসরিবে তিনি নতুন জগতজয়ের যিম্মা নিয়ে যাত্রা করেন। তিনিই মূলত ইয়াসরিবে ছিলেন পালাবদলের রূপকার। একজন দাঈ ও শিক্ষক হিসেবে তার নেতৃত্বে এখানে আসে জীবনের নতুন ঋতু, নতুন সুবাতাস!
শিক্ষক হিসেবে ছিলেন আরেকজন। তিনি হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতূম রা.। ছিলেন অন্ধ। কিন্তু ইসলাম
তাকে শিক্ষক বানিয়ে দেয়। প্রতিবন্ধী হওয়া তার শিক্ষা লাভ ও উন্নত মর্যাদায় সমাসীন হতে বাঁধা দেয়নি। তিনি
শিক্ষক হিসেবে প্রিয়নবীর সা. পক্ষ থেকে প্রেরিত হন ইয়াসরিবে।
হযরত আসআদ ইবন যুরারা রা. এর গৃহে ছিলো মুসআব রা. এর অবস্থান। তিনি শিক্ষক এবং দাঈইলাল্লাহর
ভূমিকাকে সমন্বিত করেন। তখন যারা ছিলেন ইসলামের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, তারা ছিলেন দাঈইলাল্লাহও, সমাজকর্মীও,
মানবসেবীও, মুজাহিদও।মুসআব বিন উমাইর রা. ছিলেন এর অন্যতম এক নমুনা। লোকদের ইসলামের দাওয়াত
দিতেন, শেখাতেন কল্যাণ-সততা, সত্যতা ও আদর্শ্ জীবনের দিশা। মদীনার মুসলমানদের নামাজে করতেন ইমামতি।
তার পরিচিতি হয় আল মুকাররি বা কুরআন মজিদের শিক্ষক হিসেবে।
তিনি শিক্ষক ছিলেন মানুষের, ছিলেন বন্ধুও। মিশে যেতেন লোকদের হৃদয়ে ও জীবনে। চষে বেড়াতেন ইয়াসরিবের
পথ-প্রন্তর। আকাবায় শপথকারী মুসলিমরা ছিলেন তার সঙ্গী। তারা একা দাওয়াত দেন, কখনো দু’জন, চারজন
হয়ে। বন্ধুত্ব ও শুভবাদিতার মাধ্যমে তারা করেন সত্যের আহবান। বুকে প্রেমের মধু, মুখে মুক্তি ও কল্যাণের
দাওয়াত। ধীরে ধীরে ইসলামের ছায়া হতে থাকলো প্রসারিত। লোকেরা জড়ো হতে থাকলো প্রশান্তির ঠিকানায়। ঘরে
ঘরে ছড়াতে থাকলো ইসলামের প্রাণাবেগ। একে একে মুসলিম হতে থাকেন অনেকেই। দল বেঁধে মুসলিম হবার
ঘটনাও ঘটছে।
আউসের প্রধান ছিলেন সা’দ ইবনে মুআয আর উসাইদ ইবনে হুযাইর। তাদের কাছে বিষয়টি ছিলো চরম উদ্বেগের।
একদিন। অনেক দিনে মতো একদিন। হযরত মুসআব ইবন উমায়র রা. লোকদের ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছেন।একটি জনসভার মতো লোকের সমাগম। তিনি তেলাওয়াত করেন কোরআন। বলেন শান্তি ও সাম্যের কথা।সত্যবাদিতা ও
সদাচারের কথা। বলেন একক প্রভু ও তার প্রদত্ব হেদায়েতের কথা। লোকদের উrসুক্য, এটাই তাহলে নতুন দ্বীন?
কতো সুন্দর!
উসায়দ ইবন হুযায়রের কাছে খবর এলো দ্রুত। বিভ্রান্তি ও ধর্মহীনতার প্রচার চলছে অদূরেই। খোলা তরবারি হাতে
নিয়ে তিনি রওয়ানা হলেন। এসবের মেষ দেখে নিতে হবে! সক্রোধে উপস্থিত হচ্ছেন গোত্রপতি।দেখলো পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আসআদ বিন যুরারাহ রা. এর হুশিয়ার চোখ। তিনি মুসআবকে রা. বললেন, ঐ যে তেড়ে আসছেন কবিলার রইস! মুসআব বললেন, শুভ হোক, খোদা এমন করুন যে, তিনি আপনার সত্য মেনে নিয়েছেন! উসাইদ ইবনে হুযাইরের মুখে ছিলো গালি। আসআদ বিন যুরারাহ তার বন্ধু। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করেই তিনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মুসআবকে বলতে থাকলেন ক্রেধী কথা। বললেন আপনি এখানে কেন এসেছেন? আমাদের নারী ও শিশুদের কেন বিভ্রান্ত করছেন? আপনারা এখান থেকে ভালোয় ভালোয় চলে যান, এটাই উত্তম।
হযরত মুসআব ইবন উমায়র রা. ধীর ও শান্ত। সহিষ্ণু হতে হয় দাঈদের। গালির জবাবে তারা হাজির করেন উত্তম
বার্তা। মুসআব রা. সেটাই করলেন। বললেন, যদি সম্ভব হয় তবে দয়া করে সামান্য সময় এখানে বসুন, আমি যা বলি
মেহেরবানী করে শুনুন। আপনার বিবেক-বুদ্ধির সাথে বুঝাপড়া করে সিদ্ধান্ত নেবেন। । উসায়দ ইবন হুযায়র বললেন, এটা অবশ্য ইনসাফপূর্ণ কথা। উচিত প্রক্রিয়া।
উসাইদ বসে পড়লেন। হযরত মুসআব ইবন উমায়র রা. অত্যন্ত নম্র।প্রজ্ঞাস্নিগ্ধ তার উচ্চারণ। ইসলামের সৌন্দর্য
বর্ণনা করলেন ধীর, উদাত্তভাবে। মুসআব রা. পবিত্র কোরআন থেকে তিলাওয়াত করলেন। শুনে উসায়দ ইবন হুযায়র বললেন, ما احسن هذا الكلام واجمله অর্থাৎ “কত উত্তম এ বাণী, কতই না চমৎকার!” হৃদয়ে লেগে গেলো কালামে ইলাহীর শিহরণ। পরিবর্তনের জন্য এ ছিলো যথেষ্ট।
উসাইদ বললেন ইসলামে প্রবেশ করতে হলে কি করতে হয়? মুসআব রা. বললেন পবিত্র হতে হয়।, প্রথমে শরীর এবং পোশাক পবিত্র করুন , গোসল করুন। এরপর পাঠ করুন কালিমা শাহাদাত এবং নামাজ আদায় করুন।উসায়দ রা. বিলম্ব করতে চান না। দ্রুত উঠে দাঁড়ালেন। পোশাক পবিত্র করে গোসল করলেন এবং পাঠ করলেন আশহাদু আল্লা ইলাহা…
আদায় করলেন দু রাকাত নামাজ।
বললেন, আমার পরে আসবেন আরেক ব্যক্তি। তিনি সাদ ইবন মু'আয। যদি তিনি আপনার অনুসারি হয়ে যান, আওস সম্প্রদায়ের কেউই অমুসলমান থাকবে না। আমি এখনই গিয়ে তাকে প্রেরণ করছি।
উসাইদ রা. ফিরলেন অবিলম্বে। সাদ ইবন মুআয তখন এক জনসভায়। তিনি লক্ষ্য করলেন উসাইদকে। একটি প্রশান্তি সুস্থির হয়ে আছে চেহারায়। এটা তো আগে ছিলো না। সাদ বললেন, যে উসাইদ এখান থেকে গেল, সে তো ফিরছে না। ফিরছে বদলে যাওয়া এক উসাইদ!
উসাইদ রা. নিকটে এলেন। সাদ জানতে চান, তুমি কি করলে? উসায়দ বললেন, আমি তাদের কথা শুনলাম। আল্লাহর কসম, তারা মন্দ কিছু বলছে না। আমি তাদের নিষেধ করেছি। জবাবে তারা বলেছে-আপনি যা চান, তাই হবে।
আর শুনেন, বনু হারেসার লোকেরা আসআদ বিন যুরারাকে হত্যা করতে চায়। কারণ আর কিছু নয়। তার
অপরাধ, সে আপনার খালাতো ভাই!
সাদ ইবন মুআয খুবই রাগান্বিত হলেন। তরবারি খাপমুক্ত করে ছুটলেন আসআদ বিন যুরারার রা. কাছে।আসআদ
রা. লক্ষ্য করলেন, সাদ আসছেন! মুসআব রা.কে বললেন, এমন একজন আসছেন, যার পেছনে ছায়ার মতো
দাঁড়িয়ে আছে গোটা সম্প্রদায়। যিনি কবিলার প্রধান। তিনি যদি আপনার শিক্ষাকে গ্রহণ করেন, গোটা সম্প্রদায়ের
কেউ আর ইসলাম গ্রহণ থেকে বিরত থাকবে না।
ক্ষুব্ধ সাদ ভেবেছিলেন বনু হারেসার সাথে হট্টগোলের মুখোমুখি হবেন। কিন্তু এসে দেখেন সব কিছু শান্ত,
স্বাভাবিক। তিনি বুঝলেন, উসাইদ বুদ্ধি করে তাকে পাঠিয়েছেন, যেন তিনি মুসলিমদের মুখোমুখি হন। মুসলিমদের
মজমা দেখে সাদ আগুনের মতো ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেনেআসআদ বিন যুরারাকে রা. বললেন, যদি তোমার সাথে আমার
নৈকট্য না থাকত আর তুমি যদি আমার খালাতো ভাই না হতে, তা হলে এখনই এ তরবারি তোমার অবসান ডেকে
আনতো। সম্প্রদায়কে বিভ্রান্ত করার জন্য তুমিই ওদের এখানে এনেছ।
মুসআব রা. একেবারে নিরুদ্বেগ! কোনো হুমকি-উত্তেজনা যেন তাকে স্পর্শই করছে না। বিনয়মাখানো আন্তরিকতার
কণ্ঠে তিনি বললেন, এটা কি হতে পারে না যে, আপনি এখানে কিছুক্ষণ বসে আমার কথা শুনলেন, পছন্দ হলে গ্রহণ
করবেন? আমরা যদি খারাপ কিছু বলি, তাহলে আপনার যা ইচ্ছে, করবেন!
‘তুমি ইনসাফের কথাই বলেছ’ বলে সাদ বসে পড়লেন। মুসআব রা. তার সামনে ইসলাম উপস্থাপন করলেন এবং
পবিত্র কোরআন থেকে তিলাওয়াত করলেন। শোনামাত্রই সা‘দের চেতনার জমিনে বৃষ্টিপাত শুরু হলো। চেহারার রং
গেল বদলে।অনুভবের এক অবাক তরঙ্গে হতে থাকলেন আন্দোলিত। কী বিস্ময়কর কালাম! – না, এটা আল্লাহর
পক্ষ থেকেই এসে থাকবে!!
বললেন, এ ধর্মে প্রবেশের পথ কি? মুসআব রা. বললেন, প্রথমে শরীর এবং পোশাক পবিত্র করুন এবং গোসল
করুন। এরপর কালিমা শাহাদাত পাঠ করুন এবং দু'রাকাত নামাজ আদায় করুন। সা'দ রা. তৎক্ষণাৎ উঠে পোশাক পবিত্র করে গোসল করলেন এবং কালিমা শাহাদাত পাঠ করে দু রাকাত নামাজ আদায় করলেন।এখন তিনি মুসলিম।
সত্যের প্রচারক। গোত্রের হেদায়েতে তার দায়িত্ব আছে। সেটা তাকে পালন করতে হবে।হাতিয়ার কাঁধে নিলেন।
সোজা চলে গেলেন নিজের গোত্রের বৈঠকে । সম্প্রদায়ের লোকেরা দূর থেকেই বুঝে ফেলল সা’দও বদলে গেছেন।
মজলিসে তিনি সবাইকে সম্বোধন করে বললেন, তোমরা আমাকে কেমন মনে করো? সবাই সমস্বরে বলল, তুমি
আমাদের সরদার, মতামত গ্রহণ করে সিদ্ধান্ত দানকারী, খ্যাতিমান, সবচে উত্তম, সবচে’ সম্মানী।
সাদ বললেন, তাহলে শুনো, আমার সিদ্ধান্ত। আল্লাহর কসম, আমি তোমাদের সাথে কথা বলব না, যদি তোমরা
আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের উপর বিশ্বাসী না হও। চারদিকে নেমে এলো স্তব্ধতা। লোকদের বুঝতে অসুবিধা হয়নি,
কীসের প্রতি আহবান জানালেন সাদ। কারণ ইসলাম তখন ইয়াসরিবে অপরিচিত কিছু নয়। ইসলাম মহত্ব ও মুক্তি
নিয়ে এসেছে, ইয়াসরিবে এটা নতুন বার্তা নয়। অনেকের মন আগ থেকেই তৈরী হয়ে আছে ইসলামের জন্য। সা’দ
রা. এর সিদ্ধান্ত তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করলো প্রবলভাবে। দিন শেষে সন্ধ্যা নামার আগেই বনী আব্দিল আশহাল
গোত্রের এমন সকল নারী-পুরুষ ইসলামে দীক্ষিত হলেন।কেবল উমাইয়া ইবনে যায়দের পরিবারের ক’জন লোকের
অমুসলিম থাকার বিবরণ এসেছে কোনো কোনো সূত্রে।কিন্তু শেষ অবধি অমুসলিম থাকলেন মাত্র একজন। কেবল
এক ব্যক্তি নিজেকে পারেননি ইসলামের জন্য প্রস্তুত করতে। তিনি আমর ইবন সাবিত, যার উপাধি ছিল উসায়রিম।
তিনি প্রথা ও প্রাচীন ভাবধারার বাঁধন থেকে পারেননি মুক্ত হতে । কেউ তার উপর কোনো জবরদস্তি করলো না।তিনি ইসলামকে দেখলেন এবং দেখতে থাকলেন। ওহুদ যুদ্ধের দিন তার হৃদয়ে প্রবেশ করে ইমান। ইসলামগ্রহণ করেই জিহাদের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং শহীদ হয়ে যান। রাসূলুল্লাহ সা. তাঁকে জান্নাতের সুসংবাদ দেন।হযরত আবু হুরায়রা রা. রসিকতা করে বলতেন, বল তো কে সেই ব্যক্তি, যিনি এক ওয়াক্ত নামাজও পড়েন নি অথচ
জান্নাতে পৌছে গেছেন? লোকেরা যখন জবাব দিতে পারতো না, তখন তিনি বলতেন, সেই জান্নাতী হচ্ছেন বনি আব্দুল আশহালের উসায়রিম রা.। [ ইবন ইসহাক হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে হাসান সনদে এ ঘটনা বর্ণনা করেছেন। হুজুর সা. তার সম্পর্কেই বলেন, সে পরিশ্রম করলো কম, পারিশ্রমিক পেলো বিপুল!
আওস এবং খাজরাজে ইসলাম হয়ে উঠলো পরমাত্মীয়। অনেকের হিংসা এবং শত্রুতাও হতে থাকলো ফেণায়িত।
দ্বিতীয় পর্বে সমাপ্য…
পরবর্তী পর্ব পড়ার জন্য এখানে ক্লিক করুন