পারিবারিকসূত্রে ছোটবেলা থেকেই তাবলীগের সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম। ফলে, বড় হবার পর চিল্লায় যেতে হবে—এরকম একটা মানসিক প্রস্তুতি ছিল পূর্ব থেকেই। ছাত্রজীবনে নানা কারণে এই যাওয়াটা হয়ে উঠেনি। আম্মার খুব ইচ্ছে ছিল আমি যেন দ্রুতই বেরিয়ে পড়ি।
কর্মজীবনে প্রবেশ করার কয়েক বছর পর আমার মনে হলো আমি কর্মক্লান্তিতে কিছুটা অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। একটু নিমগ্নতা ও নির্জনতা দরকার, যেখানে আমি নিজেকে নিয়ে দীর্ঘ সময় বসতে পারব, স্বাধীনভাবে কুরআন তেলাওয়াত ও নামাযে নিমগ্ন হয়ে অশ্রুপাত করতে পারব এবং সমস্ত আয়োজনের বাইরে গিয়ে মানুষের হৃদয়ের কাছটিতে বসব, এরপর পিঠে আলতো হাত রেখে অত্যন্ত আবেগের সাথে বলতে পারব : ‘ভাই, আল্লাহ আমাদেরকে অনেক ভালোবাসেন’।
সবদিক মিলিয়ে ভেবে দেখলাম চিল্লায় বেরিয়ে পড়ার এখনই সময়।
•
এরকম প্রস্তুত ও সমর্পিত হৃদয় নিয়ে ২০১৮ সালের মাঝামাঝি রমজানের প্রথম দিন আমি বিছানাপত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। এ সময়টিতে রুখ (গন্তব্যস্থল) নেওয়ার জন্য ঢাকার কাকরাইলে যেতে হয় না; জেলা মারকাজ থেকেই জামাতগুলোকে বিভিন্ন দিকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আমাদের জামাতে ১৭-১৮ জন সাথী ছিলেন। সকলেই হবিগঞ্জের স্থানীয় লোকজন। চারজন তরুণ, দুইজন মধ্যবয়স্ক এবং বাকিরা প্রবীণ—প্রত্যন্ত গ্রামের অধিবাসী।
আমাদের আমির সাহেব ছিলেন তাবলীগের পুরনো সাথী। হাস্যোজ্জ্বল, বিনয়ী ও নরম প্রকৃতির মানুষ। আব্বার সাথে তার পুরনো সম্পর্ক থাকায় আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। তাছাড়া মাওলানা হওয়ার কারণে জামাতের সকলে আমার প্রতি যে প্রীতি ও হৃদ্যতা দেখিয়েছেন, আমি রীতিমত লজ্জায় পড়ে যেতাম।
•
পহেলা রমজান ফজরের পর জেলা মারকাজ মসজিদে হেদায়াতি বয়ান হলো। যারা চিল্লায় বের হোন, তাদের জন্য এ বয়ানটি শোনা অত্যন্ত জরুরী। এখানে সফরের পুরো সময়টা কীভাবে কাটাতে হবে, সে ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়— মোটিভেশন এন্ড ব্রিফিং। ক্লান্তির কারণে দুর্ভাগ্যজনকভাবে পুরো সময় আমি বসে বসে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিলাম। সাধারণ তন্দ্রাচ্ছন্নতা নয়; সময় নিয়ে প্রলম্বিত স্বপ্ন দেখার মত গভীর ঘুম। ফলে, হেদায়াতি বয়ানের কিছুই শুনতে পেলাম না। এ কারণে ঘুম থেকে জাগার পর বেশ মনক্ষুণ্ন হয়ে পড়লাম। শুরুতেই গলদ হয়ে গেল।
বয়ান ও মাশওয়ারা শেষ হওয়ার পর দলবেঁধে গিয়ে উঠলাম গাড়িতে। গন্তব্য কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদি থানার অন্তর্গত মসুয়া ইউনিয়ন। ১৩-১৪টি মসজিদকে কেন্দ্র করে চলবে আমাদের এই পরিভ্রমণ। তাবলীগের জামাতে বের হলে প্রথমেই যে বিষয়য়টি আমার মনযোগ আকর্ষণ করে, তা হলো সকল সাথীকর্তৃক আমিরের আনুগত্য এবং এই আনুগত্যের সূত্র ধরে পরিচালিত নিপুণ শৃংখলা, নিয়মানুবর্তিতা ও ধীরস্থিরতা। কোন তাড়াহুড়া নেই। সকল কাজ সকলে মিলে পরামর্শ করে হয় এবং একটা মধ্যম গতির নিয়মের ভেতর দিয়ে হয়, যেখানে দুর্বল ও সবল সকলেই স্বাচ্ছন্দে শামেল হতে পারে।
কিশোরগঞ্জ আরো একটি জামাত যাবে, আমাদের পাশের বা কাছাকাছি কোন ইউনিয়নে। উভয় জামাত বাসে আরোহনের পর পরামর্শ মোতাবেক একজন আমির ঠিক করা হলো, যিনি সফর চলাকালীন উভয় জামাতের নেতৃত্ব দেবেন এবং একজন রাহবার ঠিক করা হলো, যিনি পথ দেখিয়ে আমাদেরকে গন্তব্যস্থানে নিয়ে যাবেন।
বয়স্কদেরকে আগে বসতে দেওয়া হলো, আমরা তরুণরা গিয়ে বসলাম একেবারে পেছন দিকে। আমীর সাহেবসহ অন্যান্য সাথীগণ আমাকে জোর করে এনে একেবারে সামনের দিকের একটি সিটে বসিয়ে দিলেন। এটা আমি বিশেষভাবে বলছি তাবলীগের সাধারণ সাথীদের মধ্যে উলামায়ে কেরামের প্রতি প্রবল সম্মানবোধের জায়গাটি দেখানোর জন্য। আমি আলেম নই, দাওরা পাশ করা অর্থে সাধারণ একজন মাওলানা। কিন্তু তাতে কী, পুরো সফরে তারা আমার প্রতি যে সম্মান ও আস্থার প্রকাশ ঘটিয়েছেন, এতে আমি আমার অযোগ্যতার অনুভূতি নিয়ে কুণ্ঠিত হয়ে পড়তাম।
•
কিশোরগঞ্জ পোঁছে আমরা প্রথম যে মসজিদে গেলাম, এর নাম লালখাঁর মসজিদ। মসজিদটি আয়াতনে ছোট ও বেশ পরিপাটি। সামনে ছোট্ট উঠোনমত এবং পাশে নূরানী মক্তব ও হিফজখানা নিয়ে একটি গ্রামীণ মাদরাসা। সে মসজিদে গিয়ে আমরা একজন বয়োবৃদ্ধ মানুষের দেখা পেলাম। বয়সের ভারে শরীর দুর্বল– ঠিকমত হাঁটতে পারেন না তিনি; কিন্তু আমাদেরকে পেয়ে আনন্দে উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। উমুমী-খুসুসী গাশতে নিয়ে যাওয়া, খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করা, কাঁধে করে কাঁঠাল নিয়ে আসাসহ নানাবিধ কর্মব্যস্ততায় তিনি নবযৌবনপ্রাপ্ত একজন যুবকের মত চঞ্চল হয়ে উঠলেন। ৪০ দিনের সফরে বিভিন্ন এলাকায় এরকম আরো অনেক মুরুব্বির দেখা পেয়েছি, যারা নিজস্ব পরিসরে কর্তৃত্তের অধিকারী, মজবুত ঈমানদার এবং দীনের জন্য অত্যন্ত আবেগপ্রবণ।
•
জামাতে গিয়ে সর্বপ্রথম যে সমস্যায় পড়লাম, তা হলো তিন-চারজন মিলে একপ্লেটে খাবার খাওয়া। খাবার বিষয়ে আমার রুচিগত একটু দুর্বলতা আছে। এই সময়টা আমার জন্য কিছুটা স্পর্শকাতর। অপ্রীতিকর কোন দৃশ্য ও অরুচিকর কিছুর উপস্থিতিতে আমি খাদ্য গ্রহণ করতে পারি না। এমনকি এমন কোন শব্দ যদি উচ্চারিত হয়, যা অযাচিত কোন দৃশ্য তৈরী করে, তখনও আমি বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ি। একে আমি নিজের দুর্বলতা হিসেবে দেখি এবং মনে করি যে, এমন স্পর্শকাতরতা কারো মধ্যে না থাকাটা স্বস্তিদায়ক।
অবশ্য, এভাবে খাবার খাওয়াতে আমি অনভ্যস্থ ছিলাম—বিষয়টা এমনও নয়। দীর্ঘ একটা সময় পর্যন্ত সহপঠিদের সাথে এক প্লেটে খেয়েছি, উস্তাদগণের সাথে খেয়েছি এবং ঘরে মাঝে মাঝে আপনজনদের সাথে বসেও খেয়েছি–কখনোই খারাপ লাগেনি। কিন্তু, এখন এটা আমার অভ্যস্ত ও পরিচিত পরিসর নয়। ফলে এখানের হিসেবটা একটু ভিন্ন।
শুরুর দিনগুলোতে খাবারের সময় হলে আমি খুবই অসহায় বোধ করতাম। নানাভাবে চেষ্টা করতাম আমরা তরুণরা যেন একপ্লেটে বসতে পারি। কিন্তু, এটা সবদিন সম্ভব হতো না। আবার কিছু বলতেও পারছিলাম না। কারণ, আমার আবেদনটি সাথীগণকে আহত করতে পারে। তাছাড়া, এ কাজটিকে তারা সুন্নতের আবেগ দিয়ে গ্রহণ করেছে, ফলে আমার ব্যাপারে তাদের মনে একটা বিরূপ ধারণাও জন্ম নিবে। তবু একদিন সাহস করে নিজের অসুবিধাটির কথা আমির সাহেবকে জানালাম। তিনি সহাস্যে সম্মতি দিলেন এবং বললেন : কেউ আলাদা প্লেটে খেতে চাইলে এর পরিপূর্ণ সুযোগ আছে। এখানে কোন জবরদস্তি নেই। মুরুব্বিদের পক্ষ থেকেই এ ব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়া আছে। আমি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
শেষে দেখা গেল আরো ৪ জন সাথী আলাদা খেতে আগ্রহী হয়েছেন। এই জায়গাটিতে সম্ভবত জনমনে কিছুটা ভুল ধারণা ও অমূলক ভীতি তৈরী হয়েছে। আমি তিন-চারজন লোককে জানি, যারা চিল্লায় যেতে আগ্রহী, কিন্তু একসাথে খেতে হবে—এই ভয়ে যাচ্ছেন না। কিন্তু এটাতো সত্য নয়। এই ভুল ধারণা গড়ে উঠার পেছনে সম্ভবত কিছু সাধারণ সাথীরও ভূমিকা আছে। তারা ‘সুন্নতি খাবার’ বলে খাদ্যগ্রহণের এই প্রক্রিয়াটির উপর বিকল্পহীনভাবে অত্যাধিক জোর দিয়ে থাকেন এবং আলাদা খাওয়াকে কিছুটা বিরূপ নজরে দেখেন।
আসলে বিধানটি কী? হাদীসে আছে একসাথে মিলেমিশে খাবার খাওয়ার কথা। এতে খাবারে বরকত হয়। এই ‘একসাথে খাওয়ার’র দুই রকমের অর্থ হতে পারে : একপ্লেটে খাওয়া; আবার, আলাদা আলাদা প্লেটে একস্থানে বসে মিলেমিশে খাওয়া। যেভাবেই খাওয়া হোক, সুন্নতের উপর আমল হয়ে যাবে। হাদীসের নির্দেশনার মাঝে এই প্রশস্ততার সংবাদটুকু সাথীদেরকে সুন্দর করে বুঝিয়ে বললেই সমস্যাটি মিটে যায়।
•
নতুন কোন মসজিদে গিয়ে আমাদের প্রথম কাজ হলো এলাকার পুরনো সাথীদেরকে খোঁজে বের করা। এরপর তাদের সহযোগিতায় পুরো এলাকায় উমুমী-খুসুসী ও তালিমী গাশত করা, বয়ান-তালিম-মুজাকারা করা, কারগুজারি শোনা, মাশওয়ারা করা এবং ব্যক্তিগত আমল ও অবসর যাপন করা।
প্রতিদিন রুটিন করে এই কাজগুলো করে যেতে লাগলাম। যেহেতু পূর্ব থেকে মানসিক প্রস্তুতি ছিল, মোটিভেশন ছিল, কল্যাণপ্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা ছিল এবং বাহ্যিক ফলাফলের দর্শন ছিল, ফলে একই কাজের পুনরাবৃত্তিতে অবসাদ বা ক্লান্তি ছিল না। সকল সাথীই উদ্দিপনার সাথে চালিয়ে যেতে লাগলাম এই দাওয়াতি মিশন। এভাবে চিল্লার পুরো সফরটি আমার অন্যরকম এক আনন্দের ভেতর দিয়ে কাটতে লাগলো।
এর আগে আমি দশদিন-বিশদিন করে সময় লাগিয়েছি; কিন্তু চিল্লার সফর এই প্রথম। ফলে, এই সফরে আমি তাবলীগের কর্মপ্রক্রিয়াটি যথাসম্ভব গভীরভাবে দেখার চেষ্টা করলাম। আমার বয়স যখন আরো কম ছিল, তখন তাবলীগের এই কর্মপদ্ধতি নিয়ে আমার মনে কিছুটা দ্বিধা ছিল। আমার মনে হয়েছে তাবলীগের লোকজন দীনকে এই পদ্ধতিটির ভেতরেই সীমাবদ্ধ করে ফেলেছে। কিন্তু দীন পালন তো এই তাবলীগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না এবং দাওয়াতের পদ্ধতিও তো এই একটি না। এই দ্বিধা তৈরী হয়েছিল আমার পরিচিত তাবলীগের সাথীগণের অনেকের আচরণ ও কথার কারণে এবং মাওলানা সাদ সাহেবের ইজতেমার মাঠের বয়ান ও বিভিন্ন সময়ে শোনা তাবলীগের কয়েকজন মুরুব্বির বক্তব্যের কারণে।
সে সময় আমি বিষয়টিকে মূল থেকে জানার জন্য মাওলানা ইলিয়াস রহ. এর সময়কার ইতিহাসটি জানতে আগ্রহী হলাম। এ কাজে আমাকে বিশেষভাবে সাহায্য করেছে মাও. মনযূর নোমানী রচিত ‘মালফুজাত’ এবং আবুল হাসান আলি নদবি রচিত ‘মাওলানা ইলিয়াস রহ. অওর উনকি দীনি দাওয়াত’ বই দুটো। সেখানে আমি সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র দেখতে পেলাম।
ইলিয়াস রহ. এ কাজটি মূলত শুরু করেছিলেন পৃথিবীব্যাপী একটি ঈমানী জাগরণ তৈরীর লক্ষ্যে, যে জাগরণ দীনের বিষয়ে মানুষের মূল ভীতটি তৈরী করে দিবে, তাদের ঈমানকে জাগ্রত করবে এবং পরিপূর্ণ দীন পালনের জন্য সর্বোতভাবে প্রস্তুত করে তুলবে।
‘তাবলীগ’ শব্দটি তিনি নির্বাচন করেননি; বরং তিনি একে একটি ‘তাহরীকে ঈমান’ বা ঈমানী আন্দোলন বলে চিহ্নিত করেছিলেন। এটা মূলত শস্য উৎপাদনের আগে জমিনকে শস্যসম্ভবা করে তোলার মত একটি ব্যাপার। একটি মানুষের জীবনে এবং এসব মানুষের সমন্বয়ে গড়ে উঠা একটি সমাজে পরিপূর্ণ ইসলামের জাগরণের গোড়ার কাজ এটি। শুরুর এই ইতিহাসটি পাঠ করার পর আমার মনের দ্বিধা দূর হয়ে গেল। চিল্লার সফরে আমি এই কর্মপ্রক্রিয়ার স্বরূপটি খুব কাছে থেকে গভীরভাবে বোঝার চেষ্টা করলাম। বর্তমান সময়ে এর দর্শন ও কর্মে নানা সীমাবদ্ধতা তৈরী হয়েছে এবং অনেক অসমর্থিত কর্ম ও উদ্দেশ্য যুক্ত হয়েছে। এগুলো যে শুধুমাত্র মাওলানা সাদ সাহেবের অনুসারীদের মধ্যেই আছে, এমন নয়; উলামায়ে কেরামের সাথে আছেন, এমন সাথীদের মধ্যেও প্রচুর পরিমাণে এমন অসমর্থিত কর্ম ও চিন্তা বিদ্যমান। এসবকে দূর করে তাবলীগের কাজটিকে তার মূল ট্র্যাকে ফিরিয়ে আনতে হলে তৃণমূল পর্যায়ে উলামায়ে কেরামের প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা ও উদ্যোগ প্রয়োজন।
•
এবার একটা বিশেষ ঘটনার কথা বলি। আমার একাকি হাঁটার অভ্যাস ছিল ছাত্রজীবন থেকেই। এই অভ্যাসটা মূলত তৈরী হয়েছে নৈঃসঙ্গের লোভ থেকে। নির্জন ও নিঃসঙ্গ হয়ে আমি আমার চারপাশটাকে অনুভব করার চেষ্টা করি। একটা মোরগ আহারের জন্য মাটিতে খুব দ্রুত একটা ঠোকর বসিয়েছে, পরক্ষণেই মোরগটি মাথা উঠিয়েছে, এবং চিন্তিত হয়ে উদাস মনে দূর কোথাও তাকিয়ে আছে। এই ঘটনা আমাকে বিস্মিত করে। পাশ দিয়ে একটা কুকুর দৌড়ে যাচ্ছে। সে খুব দ্রুত যেতে চাচ্ছে, কিন্তু ক্লান্তির কারণে পারছে না। হাঁপাচ্ছে। কোথায় গিযেছিল সে। কী করে এসেছে? আমি কোতূহলী হয়ে তাকিয়ে থাকি। একটু বাতাসে গাছের পাতাটি কাঁপছে, মরা একটি পাতা হতাশার মত ঝরে পড়ছে, নদীর প্রবহমানতা এবং আকাশের বিস্তার—এসবের মধ্য দিয়ে একাকি হেঁটে যাওয়া আমার ভেতরে একটা প্রশান্তি তৈরী হয়। এটা এক ধরণের আত্মিক বিশ্রাম। বন্দিত্বকে কখনোই নিতে পারিনি আমি। কী গ্রামে, কী নগরে—সর্বত্রই একাকি যাত্রার এই আনন্দকে আমি জীবনভর উদযাপন করে এসেছি। এমনও হয়েছে, আনমনে হাঁটতে হাঁটতে বহুদূর গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলেছি।
চিল্লায় যাওয়ার পরও আমার ভেতরে এই পিপাসা তৈরী হতো। ফলে, আসরের পর আমল শেষ করে নদীর পারে গিয়ে একাকি বসে থাকতাম, হাঁটতাম। নিজের প্রয়োজনে অন্যের প্রয়োজনে একাকি হেঁটে বহুদূর বাজারে যেতাম। এবং এখানেই আমার একটা ভুল হয়েছে।
তাবলীগের নিয়ম হলো সফরে বের হওয়ার পর কোথাও একাকি যাওয়া যাবে না। আরো দুজনকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হবে। এটি খুবই সুন্দর একটি নিয়ম এবং সুন্নাহ-নির্দেশিতও বটে। এর অনেক যৌক্তিকতা ও উপকারিতা আছে। বড় একটি উপকারিতা হলো নানাবিধ ফিতনা থেকে মুক্ত থাকা। বিশেষ করে নারীঘটিত ফিতনা থেকে যুবকদের মুক্ত থাকার জন্য এটা একটা নিরাপত্তার মত। এ নিয়মের কথা আমি জানতাম; কিন্তু কী কারণে যেন সে সময় মাথায় ছিল না। বেশ কয়েকদিন আমি একাকি নদীর পাড়ে বা বাজারে গিয়েছি। আমির সাহেবও স্নেহবশত না করতেন না।
আমার এই একা গমনের বিষয়টি স্থানীয় এক দুইজনের যিম্মাদার কয়েকদিন দেখলেন। এর মধ্যে একজন মধ্যবয়স্ক আলেম। অত্যন্ত পরহেজগার ও কর্তব্যনিষ্ঠ মানুষ। কাজির চর এলাকায় তাঁর প্রতিষ্ঠিত একটি মাদরাসা আছে এবং পুরা ইউনিয়নজুড়ে তাবলীগের কাজের সূত্রে তিনি একটা দারুণ কর্মচাঞ্চল্য তৈরী করেছেন। অপরজন বয়স্ক ও জেনারেল শিক্ষিত। সদা হাস্যোজ্জ্বল অমায়িক একজন মানুষ।
কিন্তু সমস্যাটা হলো–পথে দেখা হওয়ার সময় তারা আমাকে কিছুই বলেননি। হাসিমুখে সালাম ও কুশলাদি বিনিময় হয়েছে। কিন্তু একদিন মসজিদে এসে শুনতে পেলাম দুজনেই আমার একাকি বাজারে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। তারা অবশ্য সে সময়ে আমার নাম উল্লেখ করেননি। কিন্তু তাদের অসন্তোষ প্রকাশের ভাষা ও ভঙ্গিটি অমায়িক ছিল না। যেমন, বয়স্ক মুরুব্বির মন্তব্য করেছেন এমন ভাষায় : ‘শুধু এলেম থাকলেই হয় না, এতাআতের মাদ্দাহও (আনুগত্যের মানসিকতা) থাকতে হয়’।
আর, আলেম যিনি, তিনি অন্যান্য কথা বলার পাশাপাশি একটা হাদীস শুনিয়েছেন। হাদীসটির মর্ম হলো : মুমিন যখন সওয়ারে আরোহন করে একা যায়, তখন সে একটি শয়তান, যখন দুইজন যায়, তখন তারা দুইটি শয়তান; যদি তিনজন যায়, তাহলে একে আরোহীদল বলা যায়।
তাঁদের এই হঠাৎ অযাচিত আচরণ সাথীদের মধ্যে একটা বিরূপ পরিস্থিতি তৈরী করলো। আমি আসার পর তারা আমাকে বললো, উনারা আমাদেরকে এভাবে বলতে পারেন না। শয়তান শব্দটা সম্ভবত তাদেরকে আহত করেছে বেশি। আমি বুঝিয়ে বললাম, এটা হাদীসের শব্দ। বিশেষ উদ্দেশ্যে একে ব্যবহার করা হয়েছে। তারা এ কাজটি আমাদের ভালোর জন্যই করেছেন। কারণ, তারা তো এলাকার কাজের জিম্মাদার। এটা স্রেফ দায়িত্ব পালন; আমাদের প্রতি তাদের কোন রাগ নেই। এরপর আমি আর কখনো বাজারে একাকি যাইনি।
এ ঘটনা বলার দ্বারা আমি মূলত দুইটি কথা বলতে চাই। এক হলো—জিম্মাদারগণ চাইলে কথাটা আমাকে সরাসরি বলতে পারতেন। একটু মনে করিয়ে দিলেই হতো। এবং চাইলে তারা বিষয়টি আরেকটু নরমভাবে ডিল করতে পারতেন। কিন্তু করেননি কেন? অথচ, তাদের সাথে আমার অনেক হৃদ্যতাপূর্ণ আলাপ আলোচনা হয়েছে ইতিপূর্বে। এটা একটা মনস্তাত্ত্বিক সংকট। আমি আরো অনেকের মধ্যে এটি দেখেছি। এমনকি আমাদের জামাতের পুরনো সাথীদের মধ্যেও এই সংকট অবলোকন করেছি নতুন সাথীদের সাথে আচরণের সময়, নানা ইস্যুতে।
বিষয়টা হলো—আমরা যখন বাইরের কোন লোককে গাশত করে মসজিদে নিয়ে আসি, তখন তার অনেক অন্যায় আচরণও হাসিমুখে মেনে নিই। উদ্দেশ্য থাকে একে যেভাবেই হোক ধরে রাখতে হবে। তাকে খুশি রাখতে হবে। কিন্তু যে লোকটি ইতিমধ্যে আমার সাথে চলে এসেছে, তার সাথে এই আচরণটি দিতে সম্মত হই না। সমপর্যায়ের সাথী হলে মনে করি— সে তাবলীগের লোক হয়ে এমনটি করবে কেন? আর জিম্মাদার হলে তখন অধীনস্তদের ব্যাপারে একটা কর্তৃত্বের ভাব চলে আসে। কেমন যেন একটা শাসনের সম্পর্ক তৈরী হয়ে যায়। কিন্তু তাবলীগ তো একটা হেকমতপূর্ণ মায়াবি কাজ। এখানে আনুগত্য ও নিয়ন্ত্রণের বিষয় আছে ঠিক, কিন্তু শাসনের উত্তাপ থাকাটা অনুচিত মনে হয়।
এমনিভাবে বাইরের লোকদেরকে আমরা দাওয়াত দেওয়ার সময় বলি, আপনাকে তিনদিনে যেতে হবে না, আজকে শুধু একটু তালিমে আসেন; কিন্তু সাথীদের ব্যাপারে বলি, যে চিল্লা দেওয়ার পরে বাড়িতে গিয়ে এই কাজের সাথে যুক্ত থাকে না, তার জীবন ধ্বংস। সে গোমরাহ হয়ে যাবে। আমি অনেক জায়গায় অনেক বার এই কথাটি বলতে শুনেছি।
বাড়িতে গিয়ে কাজের সাথে জুড়ে থাকা অবশ্যই ভালো। এ ব্যাপারে উৎসাহিত করতে হবে, চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে; কিন্তু ধ্বংস হওয়ার সিদ্ধান্ত দেওয়াটি কি ঠিক? ভালো কাজ যে যতটুকু করলো ততটুকুই তো লাভ। ধ্বংস আর গোমরাহ হবে কেন?
দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, তাবলীগের অনেক সাধারণ সাথীর মধ্যে ভিত্তিহীন ঘটনা ও জাল হাদীস চর্চা করার প্রবণতা আছে। এ জন্য আমি তাদেরকে দোষ দেই না। এ সংকটটা কাটিয়ে তোলার দায়িত্ব উলামায়ে কেরামের।
এর পাশাপাশি আরেকটি বিষয় আছে–অনেক সহীহ হাদীসকে কখনো কখনো ভুলভাবে প্রয়োগ করা হয়। যেমন, এখানে যে হাদীসটি তিনি বলেছেন, আমার জানামতে এটি একটি গ্রহণযোগ্য হাদীস। কিন্তু এর বিধানটি আবশ্যকীয় নয়, এবং এর প্রয়োগও সর্বব্যাপী নয়। যদি ব্যাপক অর্থে গ্রহণ করা হয়, তাহলে বাড়িতে থাকা অবস্থায়ও আপনি একা একা একটু দূরে কোথাও যেতে পারবেন না। এটা জনজীবনে এক অসম্ভব পরিস্থিতি তৈরী করবে, এবং হাদীসেও এ কথা বলা হয়নি।
মূলত এটি একটি পরামর্শমূলক বক্তব্য। এর প্রয়োগ নির্ভর করে পরিবেশ ও পরিস্থিতির উপর। জামাতের সাথী একা কোথাও যাওয়ার সাথে এই হাদীসের একটা সংশ্লিষ্টতা আছে, কিন্তু যে আঙ্গিকে এই হাদীসকে প্রয়োগ করা হয়, এবং যেরকম ব্যাখ্যাহীনভাবে ব্যাপক অর্থে বর্ণনা করা হয়, তা সঠিক নয়। যিনি এই হাদীসটি শুনিয়েছেন, তিনি নিজেও কিন্তু অনেক দূর থেকে একা একা এসেছেন।
আপনি ভাবতে পারেন, এটা খুবই ছোট একটা ব্যাপার। এতো গুরুত্বের সাথে লক্ষ্য করা বা বলার দরকার নেই। কিন্তু, একটু খেয়াল করলে দেখবেন, নুসুসের এই ব্যাখ্যাহীন ছোট ছোট ব্যবহারগুলো থেকেই বর্তমানে তাবলীগের মধ্যে নানারূপ অসঙ্গতি সৃষ্টি হয়েছে। সূক্ষ্ম এই জায়গাগুলোতে উপযুক্ত লোকদের মনোযোগ দেওয়া একান্ত দরকার।
•
শুরুতে মনে হয়েছিল, জমিয়ে একটা সফরকাহিনী লিখবো; পরে দেখলাম সফর-কাহিনী বলতে আমরা যা বুঝি, এখানে ঠিক এমন কিছু করা সম্ভব নয়। কারণ, এখানে দিনযাপন ও পথচলায় নতুনত্ব নেই; শব্দ ও সময় একই রেখায় আবর্তিত হয় কেবল। বিস্তারণ যা আছে, সামান্য। এ জন্য সফরকাহিনীর চেয়ে অনুভব ও অভিজ্ঞতার উপস্থিতিই এখানে বেশি। এখানে বহুবর্ণিল অভিজ্ঞতা আছে এবং প্রতিনিয়ত নানারূপ আত্নবিশ্লেষণের মুখোমুখি হতে হয়েছে। ফলে দ্রষ্টব্যের চেয়ে দ্রষ্টা ও দৃষ্টির উপস্থিতি প্রবল হয়েছে। এ জন্য আমি আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করছি।
আমি যে নির্জনতা ও নিমগ্নতার আশায় এসেছিলাম, প্রতিদিনই আমি একে উপলব্ধি করছিলাম একান্ত হয়ে। মনে হচ্ছিল যেন জীবনসফরে দীর্ঘ সময় হেঁটে আসার পর শ্রান্ত হয়ে কিছু সময়ের জন্য একটা শীতল ছায়ার আশ্রয়ে বসে জিরিয়ে নিচ্ছি। দীর্ঘ ক্লান্তির পর এই একাগ্রতা ও নিবিষ্টতার দরকার ছিল বোধ করি।
সফরের মাঝামাঝি গিয়ে আম্মা আব্বা ভাইবোনের প্রতি, প্রেমময় স্ত্রী ও দেড় বছরের ছোট্ট মেয়েটির প্রতি, যে কিনা আমাদের আচরিত সমস্ত শব্দকে অতিক্রম করে আমাকে ‘বাবাজি’ বলে ডাকে, এবং ফেলে আসা মধুময় জীবনের প্রতি গভীরতর এক প্রেমবোধ নতুন মাত্রায় সংগঠিত হতে লাগল। আমার মনে হলো, আমাদের জীবনের জন্য এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দূরত্ব ও বিচ্ছিন্নতার একান্ত প্রয়োজন, যা আমাদেরকে নতুন প্রতিজ্ঞার জন্য প্ররোচিত করে যায় ক্রমাগত।