শিরোনামে তিনটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে—কাদিয়ানি ধর্মের স্বরূপ,এর সূচনার ইতিহাস ও পরবর্তী ক্রমবিকাশ। সত্যিকার অর্থে এই বিষয় তিনটিকে পরিপূর্ণরূপে আলোচনা করা এই ক্ষুদ্র পরিসরে অসম্ভব একটি কাজ। তবু যথাসম্ভব সংক্ষিপ্ত আকারে কিছু আলোকপাত করা যাক। পাঠের সুবিধার্থে আলোচনাটিকে তিনটি ভাগে সাজানো হয়েছে :
এক. মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানি ও তার বিশেষ শাগরেদ হাকিম নূরুদ্দিনের পরিচয়,
দুই. কাদিয়ানি ধর্মটির স্বরূপ ও সূচনা যেভাবে হলো,
তিন. মির্যা গোলাম আহমদ-পরবর্তী কাদিয়ানি মতবাদের বিকাশ।
এক : গোলাম আহমদ কাদিয়ানি ও শাগরেদ হাকিম নূরুদ্দিন
মির্যা গোলাম আহমদ তৎকালীন ভারতের পাঞ্জাবে গুরুদাসপুর জেলার কাদিয়ান গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মসন ১৮৩৯ বা ৪০। ১৮৫৭’র বিপ্লবের সময় তার বয়স ষোল কি সতের ছিল। বংশীয় সূত্রে মোগল বংশের বরলাছ গোত্রের সাথে সম্পৃক্ত হলেও পরবর্তীতে তিনি ইলহামের মাধ্যমে জানতে পারেন তিনি মূলত ইরান বংশদ্ভূত। হাদীসে ইরান বংশদ্ভূত এক মনীষির বিশেষ গুণকীর্তনের কথা এসেছে। ইলহামের মাধ্যমে বংশ পরিবর্তন করে ফেলার পেছনে তার লোভ ছিল মূলত সে হাদীসের প্রতি। নিজের লেখা বই ‘কিতাবুল বারিয়্যাহ’তে তিনি বলেন, আমি হলাম সেই লোক। তার পরদাদার পাঞ্জাবে বড় রকমের জমিদারী ছিল। কিন্তু গোলাম আহমদের সময়কালে সেসব আর অবশিষ্ট ছিল না। ফলে,তার জীবনের প্রথম অংশ কাটে দারিদ্রের ভেতর দিয়ে। কিন্তু ভক্ত-মুরিদান তৈরী হবার পর তিনি বিত্তশালী হয়ে উঠেছিলেন।
শৈশবে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষাদীক্ষা নিজ ঘরেই হয়েছিল। কয়েকজন উস্তাদের কাছে কুরআন শরীফ, কিছু ফারসী কিতাব ও আরবি ব্যাকরণে প্রাথমিক কয়েকটি কিতাব পড়েন। ষোল-সতের বছর বয়সে গুল আলী শাহ নামে একজনের কাছে পড়েন আরবি ব্যাকরণ, মানতেক, হিকমত ইত্যাদি প্রচলিত শাস্ত্রগুলোর কিছু বই। এরপর পিতার কাছে কিছু দিন ডাক্তারি বিদ্যার সবকও নেন। তার বাবা ছিলেন ভালো ডাক্তার। মির্যা গোলাম আহমদ কোন বিদ্যালয়ে যাননি। শিক্ষকগণ তাকে বাড়িতে এসেই পড়িয়ে যেতেন। এরপর আর পড়ালেখা বেশি দূর এগোয়নি। পিতার নির্দেশে জমিদারি হিসেবে ফিরে পাওয়া কাদিয়ান গ্রামটি দেখাশোনার কাজে জড়িয়ে পড়েন। এর কিছুদিন পর শিয়ালকোট শহরে ডেপুটি কমিশনারের কাচারিতে সামান্য বেতনে চাকুরী করতে চলে যান। ১৮৬৪ থেকে ১৮৬৮ –চার বছর সেখানে চাকুরী করেন। এ সময়ে ইংরেজি সাহিত্যের দুয়েকটি বই পড়েন এবং মোক্তারির পরীক্ষা দিয়ে ফেল করেন। ১৮৬৮ সনে চাকুরি ছেড়ে দিয়ে নিজগ্রাম কাদিয়ানে ফিরে এসে জমিদারি দেখাশোনায় ব্যস্ত হন এবং ব্যক্তিগতভাবে কুরআন ও হাদীস চর্চা করতে থাকেন।
শৈশবকাল থেকেই তিনি ছিলেন অনেকটা আলাভোলা ও উদাসীন প্রকৃতির। তার ছেলে মির্যা বশীর আহমদ প্রণীত জীবনীগ্রন্থে উদাহারণ হিসেবে বলেন : ‘একবার কোন ব্যক্তি তাঁর জন্য গুরাগাবী নামের এক প্রকার জুতা নিয়ে এলেন। তিনি কোনকিছু না ভেবেই অনায়াসে জুতাগুলো পরিধান করে ফেললেন। উল্টাসিধা তিনি বুঝতেন না। কখনো কখনো উল্টো করে পায়ে দিতেন, যার দরুন পরিধান করতে কষ্ট হতো। কখনো উল্টো পায়ে দিয়ে বিরক্ত হয়ে বলতেন যে, তার কোন বস্তুই ভাল লাগে না।’

মির্যা গোলাম আহমদ মোট দুটি বিয়ে করেছেন। ১৮৫২ সনে নিজগোত্রেই ‘হুরমত বিবি’কে বিয়ে করেন এবং ১৮৯১ সনে তাকে তালাক দেন। তার ঘরে দুই ছেলের জন্ম হয়। মির্যা ফজল আহমদ ও মির্যা সুলতান আহমদ। এ দুই ছেলে তাদের পিতার আজগুবি মতবাদের সাথে একমত ছিলেন না, অনুসরীও ছিলেন না। মৃত্যু পর্যন্ত তারা মুসলমান ছিলেন। ফজল আহমদের ইন্তেকাল হয় পিতার জীবদ্দশাতেই, ১৯০৩ সনে। পিতার অনুসারী না হওয়ায় তিনি তার জানাযায় অংশ নেননি। এবং সুলতান আহমদের ইন্তকাল হয় ১৯৩১ সনে।
দ্বিতীয় বিয়ে করেন ১৮৮৪ সনে দিল্লীর নওয়াব নাসির সাহেবের মেয়ে নুসরাত জাহান বেগমকে। তার ঘরে মির্যা গোলাম আহমদের দশ সন্তানের জন্ম হয়। এদের অন্যতম হলেন মির্যা বশির মাহমুদ (পরবর্তীতে ২য় খলীফা), মির্যা বশীর আহমদ (পিতার জীবনীকার), মির্যা শরীফ আহমদ প্রমুখ।
মির্যা গোলাম আহমদ শৈশব থেকেই জীবনের শেষ পর্যন্ত নানা রোগে আক্রান্ত ছিলেন। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো হিস্ট্রিয়া, ডায়েবেটিস, মস্তিষ্কবিকৃতি, মাথাব্যথা, অনিদ্রা। তার অসুস্থতা ও ভগ্নস্বাস্থ্যের কথা নিজেই সবিস্তারে লিপিবদ্ধ করেছেন। লাহোরে অবস্থানকালে ১৯০৮ সনের পঁচিশে মে এশার পর তার পাতলা পায়খানা শুরু হয় এবং ২৬মে মঙ্গলবার মারা যান। লাশ কাদিয়ানে ফিরিয়ে আনা হয় এবং ২৭মে কাদিয়ান গ্রামে দাফন কার্য সম্পন্ন করা হয়।
কাদিয়ানি মতবাদকে বুঝতে হলে মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানির পাশাপাশি তার অন্যতম শাগরেদ হাকীম নূরুদ্দিন ভেয়রবির পরিচয়টি জানাও আবশ্যক। এই মতবাদে গোলাম আহমদের পরেই তার স্থান এবং তাকে এই মতবাদের মস্তিষ্ক বলা হয়। অদ্ভূত চরিত্রের এই লোকটি তৎকালে ভালো ডাক্তার ছিলেন, অপরদিকে কুরআন-হাদীসের উচ্চতর পাঠ নিয়েছেন বেশ বড় বড় মানুষদের থেকে। ফিকহে হানাফির কিতাবাদিও তার পড়া ছিল। যদিও পরবর্তিতে তিনি লা-মাজহাবি হয়ে গিয়েছিলেন। হাদীসের পাঠ নেওয়ার জন্য তিনি হারামাইন শরীফাইনেও সফর করেছেন। নানা জায়গায় ঘুরেফিরে একসময় জম্মুর মহারাজার ব্যক্তিগত চিকিৎসক হিসেবে যোগ দেন। সে সময় মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানি শিয়ালকোটে চাকুরিরত ছিলেন। জম্মু থেকে নিজগ্রাম পাঞ্জাবের ভেয়রাতে আসা যাওয়ার পথে হাকীম নুরুদ্দিনের পরিচয় হয় মির্যা গোলাম আহমদের সাথে। পরবর্তিতে দেখা যায় তিনি মির্যা সাহেবের একান্ত অনুগত ভক্তে পরিণত হয়েছেন এবং জম্মুর চাকুরি ছেড়ে দিয়ে স্থায়ীভাবে কাদিয়ান গ্রামে পীর ও মুর্শিদ গোলাম আহমদের খেদমতে এসে জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। মির্যা গোলাম আহমদের মত তিনিও স্যার সৈয়দ আহমদের রচনাবলী দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত ছিলেন।
দুই : কাদিয়ানি ধর্মটির স্বরূপ এবং যেভাবে সূচনা হলো
মির্যা গোলাম আহমদ তার মতবাদটি দাঁড় করাতে গিয়ে অনেকগুলো বই রচনা করেছেন। তার জীবনের সামগ্রিক কর্মকাণ্ড ও বইগুলো পড়লে দেখা যায় তিনি একজন অপ্রকৃতস্থ মানুষ। সবগুলো বই নানা কৌতুকপূর্ণ ও হাস্যকর কথাবার্তায় ভরপুর। ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে সাধারণ নলেজ দিয়েই তা স্পষ্ট করে টের পাওয়া যায়। তা সত্ত্বেও কীভাবে তার মত একজন অসুস্থ মানুষ একটা মতবাদ দাঁড় করিয়ে ফেললেন? বাহ্যিকভাবে এটা খুবই কৌতুহলোদ্দীকপক একটা প্রশ্ন। কিন্তু, আমরা দীন সম্পর্কে অজ্ঞ সাধারণ মানুষদের দিকে তাকালে দেখব খবিস প্রকৃতির উলঙ্গ একজন মানুষও যখন কোন বক্তব্য নিয়ে দাঁড়ায়, তখন তার পিছনেও একদল মুরিদান জুটে যায়। অজ্ঞতা ও কুসংস্কারাচ্ছন্নতা এভাবেই মানুষকে বিভ্রান্তিতে বন্দি করে ফেলে। তার উপর মির্যা গোলাম আহমদের সময় ও পরিবেশটি ছিল আরো নাজুক। ১৮৫৭’র বিপ্লবসহ নানা ধর্মীয় ও সামরিক আন্দোলনগুলো ব্যর্থ হওয়ার ফলে মুসলমানদের মধ্যে চারদিকে হতাশা ও পরাজয়ী মনোবৃত্তি দেখা দিয়েছিল। এবং একটি কথা ছড়িয়ে পড়েছিল—হিজরী তেরতম শতাব্দি শেষ হওয়ার সাথে সাথেই হাদীসে বর্ণিত শেষ যামানার ত্রাণকর্তা মাসীহে মাওউদের আগমন ঘটবে। অপরদিকে পাঞ্জাবে লাগাতার শিখদের শাসন ও মুসলিম নিপীড়নের কারণে সেখানকার মুসলমানদর মধ্যে বিশেষভাবে ধর্মীয় অজ্ঞতা দেখা দিয়েছিল। সব মিলিয়ে তখনকার সময়ে কাদিয়ানির মত উদ্ভট একটি মতবাদ প্রতিষ্ঠা পাওয়ার অনুকূল পরিস্থিতি প্রস্তুত হয়েছিল।
শুরুর দিকে মির্যা গোলাম আহমদ খ্রিষ্টান পাদ্রী ও হিন্দু পুরোহিতদের সাথে বিতর্কে লিপ্ত হতেন। ১৮৭৯ সনে তিনি ঘোষণা দেন ইসলাম ধর্মের সত্যতা ও অন্যান্য ধর্মের মিথ্যা হওয়ার উপর ৩০০টি দলীল বিশিষ্ট একটি কিতাব রচনা করবেন, ৫০ খণ্ডে। নাম হবে ‘বারাহীনে আহমাদিয়া’। প্রকাশের আগেই তিনি এর ব্যাপক প্রচার চালিয়ে মুসলমান সমাজে একটা চাঞ্চল্য সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। ৮৪ সাল পর্যন্ত মোট চারটি খণ্ড প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত হওয়ার পর দেখা গেল এতে গুরুত্বপূর্ণ কিছুই নেই। এই গ্রন্থে তিনি নিজের ব্যাপারে অত্যন্ত উঁচু উঁচু কথা বলেন এবং ‘ইলহামের ধারা বন্ধ হয়নি, তিনি সংস্কারক, ঈসা আ. এর সাথে তার সাদৃশ্য রয়েছে ইত্যাদি এমন সব অস্পষ্ট কথা ঘোষণা করতে থাকেন, যার দ্বারা আঁচ করা যায় অচিরেই তিনি নিজেকে মসীহ ও নবী বলে দাবি করে বসবেন। ১৮৯১ সনে তার সেই শাগরেদ হাকীম নূরুদ্দিন তাকে মাসীহ দাবি করার পরামর্শ দেন। কথামত তিনি নিজেকে মাসীহে মাওউদ বা শেষ জামানার ঈসা বলে দাবি করে বসেন। এ লক্ষে তিনি তিনটি গ্রন্থ রচনা করেন—ফাতহে ইসলাম, তাওযিহে মারাম ও ইযালাতুল আওহাম। ১৯০০ সনে তার উপস্থিতিতে জুমআর নামাজের খুতবায় মালভি আব্দুল করীম তার জন্য নবী ও রাসূল শব্দদুটো ব্যবহার করেন, এবং এরপর মির্জা সাহেব তা মেনে নিয়ে নিজেকে নবী বলে দাবি করে এর প্রচার করতে শুরু করেন। মির্যা গোলাম আহমদ তার জীবনে নিজেকে নানা সময়ে নানা কিছু বলে দাবি করেছেন। এই দাবিগুলোর সংক্ষিপ্ত একটা চিত্র উল্লেখ করা যায়।
১৮৮১ তে ‘বাইতুল্লাহ’; ১৮৮২ তে মুজাদ্দিদ, আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশিত ও নযীর; ১৮৮৩তে আদম মরিয়ম ও আহমদ; ১৮৮৪ তে প্রচ্ছন্নভাবে রেসালত; ১৮৯১ তে ঈসা সদৃশ; ১৮৯২ তে ‘কুন ফায়াকুন’; ১৮৯৪ তে মসীহ ও মাহদি; ১৮৯৮ তে ইমামুজ্জামান; ১৮৯০ সনে ছায়া নবী; এবং ১৯০০ সনে পরিপূর্ণ নবী হওয়ার দাবি করেন।
নমুনা স্বরূপ একটা উদ্ধৃতি উল্লেখ করছি :
আমি বার বার বর্ণনা করেছি যে কথাগুলো আমি শুনাচ্ছি, নিশ্চিতভবে তা আল্লাহ কালাম। যেমন কুরআন ও তওরাত আল্লাহর কালাম। আর আমি আল্লাহর জিল্লিী ও বুরুযী নবী। দীনি বিষয়ে আমার অনুকরণ করা সকল মুসলমানের ওপর ওয়াজিব। (মির্যা গোলাম রচিত তুহফাতুন নাদওয়া, পৃ. ৪)
মির্যা কাদিয়ানি তার ধর্মে যারা দীক্ষিত হবে না তাদেরকে কাফের বলে ঘোষণা দিতেন। তাদের পেছনে নামাজ পড়া নাজায়েজ, তাদের জানাজা পড়া যাবে না, তাদের কাছে মেয়ে বিয়ে দেওয়া যাবে না; তবে মুসলমানদের মেয়েদেরকে বিয়ে করা যাবে ইত্যাদিসহ নবী হিসেবে নানারূপ নতুন নতুন বিধান প্রবর্তন করতে শুরু করেন।
নবী বা মসীহ দাবি করার পর যখন কুরআন ও হাদীসের বক্তব্য দিয়ে তার উপর আপত্তি উঠানো হত, মির্যা তখন খুবই হাস্যকর যুক্তি ও ব্যাখ্যা দাঁড় করাতেন। উদাহরণত যখন মাসীহ দাবি করলেন, তখন আপত্তি উঠলো মাসীহের সাথে দুটো হলুদ চাদর থাকবে। এর উত্তরে তিনি বললেন, ঐ দুই হলুদ চাদর, যার ব্যাপারে হাদীস শরীফে এসেছে এর ব্যাখ্যা হলো আমার দুই রোগ। একটা শরীরের উপরের অংশে—মাথাব্যাথা, মাথা ঘোরা, অনিদ্রা ও খিচুনীর রোগ। আর দ্বিতীয়টি হলো নিম্নাঙ্গে—ডায়াবেটিস ও বহুমূত্র রোগ। হাদীসে দামেশকের পূর্ব মিনারের কথা উল্লেখ আছে। একে নিজের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য কাদিয়ানের পূর্ব এলাকায় একটি মিনার নির্মাণের জন্য চাঁদা উঠানো শুরু করলেন। তার কর্মকাণ্ডগুলো এমনই হাস্যকর ছিল। বারাহীনে আহমদিয়্যাহ গ্রন্থটি ৫০ খণ্ডে লেখার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এরপর ঠিক করলেন ৫ খণ্ডেই শেষ করে দিবেন। এর পক্ষে যুক্তি হিসেবে বলেছেন : প্রথমে ৫০ খণ্ড লেখার ইচ্ছো ছিল। এখন ৫০ থেকে পাঁচে সীমাবদ্ধ করা হল। যেহেতু পঞ্চাশ ও পাঁচের মাঝে শুধু একটি শূন্যের পার্থক্য এর জন্য পাঁচ খণ্ড দ্বারা সে ওয়াদা পূর্ণ হয়ে গেছে। (বারাহিনে আহমাদিয়্যা, পঞ্চম খণ্ডের ভূমিকা।)
আরেকটি গ্রন্থ তিনি ৪০ খণ্ডে লেখার ওয়াদা করেছিলেন। কিন্তু সেটাও চার খণ্ড শেষ করার পর বলেন, মূলত তা-ই হয়েছে যা আমি ইচ্ছা করেছিলাম। এ জন্য গ্রন্থের ধারা আমি চার সংখ্যায় শেষ করেছি। আর ভবিষ্যতে কখনো তা প্রকাশ হবে না। যেমন আল্লাহ তাআলা পথমে ৫০ নামায ফরজ করেছিলেন, অতঃপর সহজ করার জন্য ৫০ এর স্থানে পাঁচকেই নির্ধারণ করলেন। তেমনি আমিও পরওয়ার দেগারের নিয়ম অনুযায়ী চল্লিশ এর স্থলে চারকে নির্ধারণ করেছি। (আরবাঈন : ৪) পৃ. ১৪. এইসব ব্যাখ্যা প্রদানে যুক্তিদাতা ছিলেন তার সেই বিশেষ শাগরেদ হাকিম নূরুদ্দিন।
মির্যা গোলাম আহমদের এই বিভ্রান্ত মতবাদটির পুরোটি গড়ে উঠেছে ইংরেজদের ছত্রছায়া ও আনুকুল্যে। তাদের হয়ে তিনি জিহাদকে হারাম বলে ঘোষণা দিয়েছেন। ইংরেজদের সাথে তার সম্পর্ক ও যোগসাজশের কথা, তাদের প্রতি ভক্তিতে গদগদ হওয়ার কথা তার যে কোন বইয়ে তালাশ করলেই পাওয়া যাবে। একে তিনি লুকিয়ে রাখতেন না। পরিস্কার ভাষায় সবিস্তারে বয়ান করতেন। তার ধারণা ছিল এ দেশে ইংরেজদের রাজত্ব কোনদিন শেষ হবে না।
তিনি নিজেকে সত্য নবী বলে প্রমাণ করার জন্য অসংখ্য ভবিষ্যতবাণী করেছেন, যার একটিও বাস্তব প্রমাণিত হয় নি। উদাহরণ স্বরূপ একটি ভবিষ্যতবানির কথা উল্লেখ করছি।
১৮৮৮ সনে ৫০ বছর বয়সে তিনি দাবি করেন আল্লাহ তাআলা মুহাম্মদি বেগমের সাথে আসমানে তার বিয়ে দিয়েছেন। অতএব এই মেয়েরে সাথে তার বিয়ে হবে। এই বিয়ে কেউ আটকানোর ক্ষমতা রাখে না। এই বিয়ের উপর তিনি অস্বাভাবিক রকমের জোর দেন এবং একে তিনি অকাট্য ও তার মতবাদের সত্যতার প্রমাণ হিসেবে প্রচার করতে থাকেন। কিন্তু মেয়ের পরিবার তাতে রাজি হয় না। তিনি বলেন এর যদি অন্য কোথাও বিয়ে হয় তাহলে আড়াই বছরের ভিতর তার স্বামী মারা যাবে। এ বিয়ের বিরোধিতা করার কারণেই প্রথম স্ত্রীকে তালাক দেন এবং পুত্র মির্যা সুলতানকে ত্যাজ্যপুত্র করে মিরাস থেকে বঞ্চিত করে দেন। ১৮৯২ সনে তার অন্যত্র বিয়ে হয়ে যায় এবং আড়াই বছর অতিক্রম হওয়ার পরও যখন স্বামী মৃত্যুবরণ করলেন না, তখন তিনি ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়ে বললেন, আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হয়েছে। আমার সাথে তার বিয়ে হবেই। যদি আমি মিথ্যাবাদী হই তাহলে বিয়ের আগেই আমার মৃত্যু এসে যাবে। অবশেষে ১৯০৮ সনে বিয়ে করতে না পারার আফসোস নিয়েই তাকে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল। ভবিষ্যতবাণী করা ছিল তার সকাল-সন্ধ্যার অভ্যাস। সামান্য সামান্য উপলক্ষ্যেও মির্যা এই কাজ করতেন, এবং এর একটাও সত্য বলে প্রমাণিত হত না।
তিন : মির্যা গোলাম আহমদ-পরবর্তী কাদিয়ানি মতবাদের বিকাশ
১৯০৮ সনে মির্যা গোলাম আহমদের মৃত্যুর পর হাকীম নুরুদ্দিনকে তার খলীফা ও স্থলাভিষিক্ত নির্বাচন করা হয়। ১৯১৪ সালে তার মৃত্যু হলে পরবর্তী খলীফা কে হবে, এ নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। একদলের মত ছিল মির্যা কাদিয়ানির বড় ছেলে মির্যা বশীর মাহমুদের পক্ষে, অপর দলের পছন্দ ছিল মির্যার একান্ত শাগরেদ মিস্টার মুহাম্মদ আলী। মির্যার স্ত্রী নুসরাত বেগমের প্রানান্তকর চেষ্টায় ছেলে খলীফা নির্বাচিত হলে মুহাম্মদ আলী তার অনুসারীদের নিয়ে আলাদা হয়ে যান। দলবল নিয়ে ১৯২০ সাল পর্যন্ত কাদিয়ানে অবস্থান করার পর লাহোরে চলে যান এবং আঞ্জুমানে এশাআতে ইসলাম আহমাদিয়া নামে আলাদা দল গড়ে তোলেন। তার পরে এ দলটির নেতৃত্ব দেন আমির সদরুদ্দিন নামে একজন। তারা নিজেদেরকে আহমদি এবং অপর দলটিকে কাদিয়ানি বলে পরিচয় দেয়। এই লাহোরী দলটি কাদিয়ানি মতবাদের সকল কিছুর সাথে একমত হলেও দুটো বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করে। এক হলো লাহোরী দল মির্যা গোলাম আহমদকে কাদিয়ানি দলের মত নবী হিসেবে স্বীকার করে না; বরং তাকে মুজাদ্দিদ ও মাসীহে মাওউদ বা শেষ যামানার ঈসা আ. হিসেবে মানে। এবং কাদিয়ানী মতবাদে দীক্ষিত নয় এমন মুসলমানদেরকে কাদিয়ানিদের মত কাফের মনে করে না। বরং কালেমা পাঠকারী সকলকে মুসলমান বলে স্বীকৃতি দেয়।
৪৭ এর দেশভাগের সময় কাদিয়ানিদের মূল কেন্দ্র পাকিস্তানে স্থানান্তরিত হয়। ১৯৬৫ সালে মির্যা বশীর মাহমুদ মৃত্যুবরণ করলে তৃতীয় খলীফা হিসেবে নির্বাচন করা হয় তার ছেলে নাসির আহমদ কাদিয়ানিকে। এই লোক মতবাদটিকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য অনেক প্রচেষ্টা চালায়। ১৯৮২ সালে হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে হঠাৎ করে মারা যায়। এরপর খলীফা হিসেবে আবির্ভুত হন মির্যা তাহের আহমদ, অপর প্রতিন্ধন্দি মির্যা রাফে আহমদকে গুম করে। ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানে কাদিয়ানিদেরকে রাষ্ট্রিয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণা করা হয়। জেনারেল জিয়াউল হকের সময় এই আইন পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে মির্যা তাহের প্রতিকুল পরিস্থিতি দেখে লন্ডন পালিয়ে যান এবং সেখানে স্থায়ীভাবে দলের কাজ চালিয়ে যান। ২০০৩ সালে পঞ্চম খলীফা হিসেবে মির্যা মাসরুর আহমদ ইংলেন্ডে অবস্থান করে এখন পর্যন্ত দলীয় কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যে তারা নানা আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে, মিডিয়ায় নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরী করেছে এবং তাদের দাওয়াতি মিশন চালিয়ে যাচ্ছে পুরো দমে।
শেষ একটা কথা বলেই রচনাটির ইতি টানছি। কাদিয়ানি ধর্মকে ইসলামের আর সাধারণ দশটা ফেরকার মত বিচার করলে ভুল হবে। কাদিয়ানি মতবাদ ইসলামের ভ্রান্ত কোন মতবাদের নাম নয়; আলাদা একটি ধর্মের নাম। একে সেইভাবেই বিচার করতে হবে। মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানি নিজে অসংখ্য বই লিখে গেছেন, তার পরবর্তী লোকেরাও লিখে গেছেন ও যাচ্ছেন। সেগুলো নিয়ে সামান্য ঘাঁটাঘাঁটি করলেই তা পরিস্কার বুঝা যায়। এই রচনার সামান্য পরিসরে না বিস্তারিত কিছু বলার সুযোগ আছে, না রেফারেন্স ও উদ্ধৃতি দেওয়ার অবকাশ আছে।
দীর্ঘ হওয়ার ভয়ে এই রচনায় রেফারেন্সগুলো সব জায়গায় উল্লেখ করা যায়নি৷ তবে এখানে উল্লেখিত তথ্যগুলো আবুল হাসান আলি নদবি রচিত ‘কাদিয়ানিয়্যাত’, মনজূর আহমদ চিনিয়ুটি রচিত ‘রদ্দে কাদিয়ানিয়্যাত’, ডক্টর খালেদ মাহমুদ রচিত ‘আকিদাতুল উম্মত’ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে৷ এ বইগুলো তারা মির্যা কাদিয়ানি রচিত বইসমূহ, তার ছেলে রচিত গ্রন্থ ও অন্য শাগরেদদে রচনা থেকে সরাসরি নিয়েছেন,উদ্ধৃতিসহ ৷ এর বাইরে আরো কিছু তথ্য নিয়েছি কাদিয়ানিদের নিজস্ব ওয়েবসাইটগুলো থেকে।