আহমাদ ইবনে হাম্বল, এই উম্মতের মহান ইমাম, মুহাদ্দিসদের সর্দার, ফকিহদের শিরোমণি, আল্লাহভীরুদের মাথার মুকুট, সত্যের পথে সংগ্রামীদের উত্তম আদর্শ। আহমদ ইবনে হাম্বল,ইসলামের এই সুবিশাল আকাশে উজ্জ্বল লুব্ধক নক্ষত্র হয়ে জ্বলছেন। তাঁর কথা যখন ভাবি তখন সেই দুঃসাহসী নাবিকের কথা মনে পড়ে, যে তুমুল ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ অন্ধকার মাতাল সমূদ্রের মোকাবেলায় একাকি জাহাজ নিয়ে চলেছে উপকূলের দিকে। তিনি সেই বীর পুরুষ, যিনি সত্যকে বুকে ধারণ করে অনায়াসে মাথা পেতে দিয়েছিলেন তরবারীর নিচে। ভয়াবহ ফিতনার একটি তুফানকে একাই রোধ করে দিয়েছেন।
তাঁর বন্ধু ও সহযাত্রী আলি ইবনুল মাদিনি (২৩৪ হি.) বলেন : আল্লাহ এই দীনকে শক্তিশালী করেছেন দুই ব্যক্তির মাধ্যমে,একজন হযরত আবুবকর রা., অপরজন আহম ইবনে হাম্বল। হযরত আবুবকর রিদ্দাহ বা দীন ত্যাগের ফিতনাকে মোকাবেলা করেছিলেন, আর আহমদ ইবনে হাম্বল খালকে কুরআনের ফিতনাকে মোকাবেলা করেছেন”।
হযরত আবুবকর রা. যদি যথাসময়ে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ না করতেন তাহলে রিদ্দাহ’র এই প্রবল স্রোতকে সামলানো কোনমতেই সম্ভব হতো না। একইভাবে আহমদ ইবনে যদি প্রতাপশালী খলীফা মামুন ও মুতাযিলা সর্দারদের বিরুদ্ধে হকের পতাকা নিয়ে না দাঁড়াতেন তাহলে বিদআত ও ভ্রান্ত চিন্তার স্রোতকে রোধ করা যেতো না।
ইবনে হাম্বলের সবচে বড় পরিচয় হলো তিনি তাঁর সময়ের শ্রেষ্ঠতম মুহাদ্দিস, সেরা ফকীহ এবং অন্যতম বিদ্বান।
২.
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল ইলম, আমল, তাকওয়া, দুনিয়াবিমুখিতার অলঙ্কারে সজ্জিত এক অনুপম জীবনের অধিকারী মানুষ। তাঁর রচিত মুসনাদ হাদিস ভান্ডারের সমৃদ্ধতম ( মতান্তরে সবচে বড়) হাদিসের সঙ্কলন! রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র হাদিস সংগ্রহের জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে দিয়ছিলেন। বর্তমান লেখায় আমরা দেখবো, তিনি কাদের থেকে এবং কোথা থেকে এই অমূল্য রত্ন-ভান্ডার সংগ্রহ করেছেন। ইলমের অন্বেষণে তিনি কোথায় ছুটে বেড়িয়েছেন!
আহমদ ইবনে হাম্বল ১৬৪ হিজরীর রবিউল আওয়াল মাসে বাগদাদে জন্মগ্রহন করেন। বাবা এবং মা উভয় দিকেই বংশীয় আরব রক্ত নিয়ে জন্মান তিনি। জন্মের আগেই বাবাকে হারান। মায়ের একান্ত স্নেহের ছায়ায় বড় হতে থাকেন। মা তাঁর সর্বস্ব দিয়ে লালিত পালিত করেন তাঁর একমাত্র সন্তান কে। ছেলেকে বড় আলেম ও মুহাদ্দিস বানানোর স্বপ্ন নিয়েই গড়ে তুলতে লাগলেন মা। সে অনুযায়ি মকতব ও অন্যান্য বিষয়ের প্রাথমিক পড়াশোনা শেষে ১৭৯ হিজরিতে পনের বছর বয়সে বাগদাদের বিখ্যাত শায়েখদের হাদিসের মজলিসে যাতায়াত শুরু করেন।
বাগদাদে তখন ফিকহ ও হাদিস উভয়টির কেন্দ্রই ছিলো। কাযি আবু ইউসুফ বাগদাদে আসার পর সেখানে ফিকহ চর্চা নতুন মাত্রায় শুরু হয়; কিন্তু ইমাম আহমদ হাদিসকেই নিজের লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করলেন, এবং সে অনুযায়ী তিনি মুহাদ্দিসগণের মজলিসে উপস্থিত হওয়া শুরু করলেন। হাদিস সংগ্রহের অন্যতম একটি আদব হলো প্রথমে নিজের শহরের শায়েখদের হাদিস সংগ্রহ করতে হয়, অতঃপর অন্যান্য শহরের শায়েখদের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়তে হয়।
তিনি প্রথমেই হুশাইমের মজলিসে যান। এর পাশাপাশি কিছুদিনের জন্য ইমাম আবু হানিফার প্রধান শিষ্য কাজী আবু ইউসুফের মজলিসেও যাতায়াত শুরু করেন। আলী ইবনে হাশেম (১৭৯ হিঃ) এর মজলিসেও উপস্থিত হন, কিন্তু খুব বেশিদিন নয়, মাত্র দুয়েক মজলিসের উপস্থিত হওয়ার পরই তাঁর ইন্তেকাল হয়ে যায়।
একই বছরে (১৭৯হি) ইমাম মালেক এবং হাম্মাদ ইবনে যাইদের মৃত্যু সংবাদও তাঁর কাছে পৌঁছে। এতে ইমাম আহমদ যারপরণাই বিমর্ষ হয়ে পড়েন। কেননা তাঁর মতো হাদিসের ছাত্রের জন্য ইমাম মালেক এবং হাম্মাদ, উভয়েই স্বপ্নপুরুষ ছিলেন। তাদের মুখ থেকে একটি হাদিস শোনার সুযোগকেও তারা নিজেদের জন্য পরম সৌভাগ্যের বিষয় বলে মনে করতেন। ইমাম আহমদের এই না পাওয়ার দুঃখ আরও দ্বিগুন হলো, যখন আব্দুল্লাহ ইবনে মোবারকের (১৮১) সাক্ষাৎ লাভের সুযোগও হাতছাড়া হয়ে গেলো।
১৭৯ হিজরীতে আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক সামান্য কিছুদিনের জন্য বাগদাদ এসেছিলেন। আহমদ ইবনে হাম্বল সেই সংবাদ পেয়ে ছুটেও গিয়েছিলেন তাঁর কাছে। কিন্তু তিনি পৌঁছার আগেই ইবনে মুবারক ত্রিপলীর উদ্দ্যেশ্যে যাত্রা শুরু করেছেন। তিনি আর কখনও বাগদাদ ফিরেননি,এবং তাঁর সাথে আহমদের সাক্ষাৎ ও হয়নি।
আহমদ এবার বাগদাদের সবচে প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস হুশাইম ইবনে বাশীরের (১৮৩ হি) মজলিসে নিয়মিত ছাত্র হয়ে গেলেন। একাধারে পাঁচ বছর হুশাইমের কাছেই পড়ে রইলেন, হুশাইমের একান্ত বিশ্বস্ত শাগরেদ হয়ে। মাঝে মাঝে অন্যান্য মজলিসেও যেতেন, যেমন উমাইর ইবনে আব্দুল্লাহর (১৮২) মজলিস। এই দীর্ঘ সময়ে হুশাইম থেকে প্রায় তিন হাজারেরও বেশি হাদিস শুনেছেন। যা শুনেছেন তার সবটাই মুখস্থ করে নিয়েছেন। এজন্য সবচে বেশী হাদিস বর্ণনা করেছেন তাঁর কাছ থেকেই।
৩.
১৮৩ হিজরিতে হুশাইমের ইন্তেকাল হয়ে যায়। আহমদ তখন মাত্র বিশ বছরের তরুণ। হুশাইমের ইন্তেকালের পর আহমদ ইলমের অন্বেষণে দূর দূরান্তের শহর নগরগুলির উদ্দ্যেশ্যে বেরিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নেন। সেসব শহরেও তখন ফিকহ ও হাদিসের মাশায়েখ দ্বারা পূর্ণ। এই বছরেই তিনি এক বেদুইন সঙ্গীকে সাথে নিয়ে কূফার উদ্দ্যেশ্যে বেরিয়ে পড়েন। সেখানে আ’মাশের (১৪৮ হি) বিখ্যাত শিষ্য আবু মুওয়াবিয়া (১৯৫ হি) এবং ওয়াকি’ ইবনুল জাররাহ (১৯৭ হি) এর মজলিসে উপস্থিত হতে লাগলেন।
কিন্তু সেবারে কূফায় বেশিদিন অবস্থান করতে পারেন নি। তাঁর বেদুইন সঙ্গী তাঁকে ফেলে হজে চলে যায়। তিনি এই অচেনা জায়গায় প্রচণ্ড একাকিত্তে ভূগতে থাকেন। তাছাড়া থাকা খাওয়ার কষ্টও হচ্ছিল বেশি। সহায় সম্বলহীন মানুষ, এক কিতাবের বোচকা ছাড়া আর কিছুই নেই তাঁর কাছে।
যে ঘরে রাতে থাকতেন সে ঘরে কোন বিছানা বালিশ ছিলো না। মাথার নিচে ইট, আর তার উপর কিতাব দিয়ে মেঝেতে শুয়ে রাত কাটাতেন। এরই মাঝে প্রচণ্ড জ্বরে আক্রান্ত হলেন। আসার সময় মায়ের অনুমতি নিয়েও আসেননি। সেজন্য মনে মনে কিঞ্চিৎ অপরাধবোধও কাজ করছিলো। সবমিলিয়ে এই ত্রিমুখী কষ্ট তাঁর বেশিদিন সহ্য হয়নি। বাড়ি ফিরে আসলেন দ্রুতই। কিন্তু এই সামান্য সময়েই কূফার হাদিসের ছাত্র ও শিক্ষকগণ তাঁকে ভালো করেই চিনে নিয়েছিলেন।
৪.
পরবর্তীতে কূফায় আরও অনেকবার গিয়েছেন, এবং সেখানকার প্রসিদ্ধ সকল মাশায়েখ থেকে হাদিস সংগ্রহ করেছেন। বিশেষভাবে কূফায় ইয়াহ্য়া ইবনে আদাম (২০৩ হি), আব্দুল্লাহ ইবনে ইদ্রিস (১৯২ হি) এবং হাফস ইবনে গিয়াস (১৯৪ হি) তাঁর অন্যতম শিক্ষক। কূফায় তিনি সুফিয়ান সাওরী (১৬১ হিঃ) এবং আ’মাশের বর্ণীত হাদিসগুলোকে ভালো করে রপ্ত করেন।
তাঁর শিক্ষক ওয়াকি’ তাঁকে ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও অত্যাধিক সম্মান করতেন। আহমদের দুই শিক্ষক হাফস ইবনে গিয়াস এবং ওয়াকি’ ইবনুল জাররাহ,উভয়েই তার ব্যাপারে এই স্বিকৃতী দিয়েছেন যে,কূফায় আজ পর্যন্ত এই যুবকের ন্যায় এতো মেধাবী কোন ছাত্র আর আসে নাই।
৫.
১৮৬ হিজরীতে বসরার উদ্দ্যেশ্যে রওয়ানা করেন। সেখানে তখন আব্দুর রহমান ইবনে মাহদি, ইয়াহয়া ইবনে সাঈদ আল ক্বাত্তান, ইসমাইল ইবনে উলাইয়্যাহ, মুতামির ইবনে সুলাইমান সহ দুনিয়া বিখ্যাত মুহাদ্দিসগন হাদিসের দরস দিচ্ছেন। তাদের হাদিস সংগ্রহ করেন। এই বসরাতেই আলি ইবনুল মাদিনীর (২৩৪ হি) সাথে তাঁর গভীর বন্ধুত্ব হয়। ১৮৬ থেকে ১৯৫ হিজরি, এই সময়ের মাঝে বসরায় মোট পাঁচবার যান তিনি। প্রতিবারে পাঁচ থেকে ছয় মাস পর্যন্ত অবস্থান করতেন সেখানে। এর মাঝে আব্দুর রহমান ইবনে মাহদি (১৯৮ হি), ইয়াহয়া ইবনে সাইদ আল কাত্তান (১৯৮ হি) এবং ইসমাইল ইবনে উলায়্যাহর (১৯৩ হি) নিকট অধিক সময় অতিবাহিত করেন। তাদের হাত ধরেই রিজাল শাস্ত্রের উপর গভীর পাণ্ডিত্য লাভ করেন।
৬.
বসরায় থাকাকালেই পাশের শহর ওয়াসেতেও যান বেশ কয়েকবার। সেখানকার বিখ্যাত মুহাদ্দিস ইয়াযিদ ইবনে হারুনের (২০৬ হি) হাদিস সংগ্রহ করেন।
১৮৭ হিজরিতে হিজাজের উদ্দ্যেশ্যে হজ্বের নিয়তে রওয়ানা করেন। সেখানে ইমাম শাফেঈ এবং সুফিয়ান ইবনে উয়াইনার (১৯৮হি) সাথে সাক্ষাৎ করেন। শাফেইর কাছ থেকে ফিকহ এবং সুফিয়ানের কাছ থেকে হাদিস সংগ্রহ করেন। ইমাম শাফেঈর সাথে পরবর্তীতে বাগদাদেও দীর্ঘ একটা সময় অতিবাহিত করার সুযোগ পান। তারা উভয়েই একে অপরের কাছ থেকে উপকৃত হন। কিন্তু সুফিয়ানের সাথে সাক্ষাৎ ছিলো আজীবনের লালিত স্বপ্ন। এ ব্যপারে তাঁর অনুভুতি হলো- মালেক এবং হাম্মাদের সাথে সাক্ষাত না হওয়ার আফসোস আল্লাহ সুফিয়ানের মাধ্যমে পুর্ণ করে দিয়েছেন। মদীনা বাসীর হাদিস সম্পর্কে সুফিয়ানের চেয়ে বেশি জানাশোনা লোক আর কেউ ছিলোনা তৎকালীন সময়ে। যুহরী ও আমর ইবনে দীনারের হাদিসের বিশাল ভান্ডার ছিলো সুফিয়ানের কাছে। সুতরাং ইমাম আহমদ প্রাণভরে এই সুযোগ গ্রহণ করেন। এবং সুফিয়ানের হাদিস ভাণ্ডার থেকে নিজেকে সমৃদ্ধ করেন।
৭.
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল মোট পাঁচ বার হিজাজ গমন করেন, হজ এবং হাদিস সংগ্রহের উদ্দ্যশ্যে। এর মাঝে তিনবার অর্থাভাবে পায়ে হেঁটে গমন করেন। হাফেয ইবনে কাসীর তার আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া তে এই হিজাযী ভ্রমণ গুলোর ব্যাপারে সবিস্তারে আলোচনা করেছেন। ১৯৭ হিজরীতে হজে গেলেন, সঙ্গী হিসেবে ছিলেন তাঁর একান্ত বন্ধু ও সহপাঠী ইমাম ইয়াহয়া ইবনে মাঈন (২৩৩ হি)। সেবারে একাধারে দুই হজ করলেন ১৯৭ এবং ১৯৮ হিজরীতে। তাদের ইচ্ছা ছিলো হজ শেষ করে ইয়ামানের দিকে যাবেন, আব্দুররাযযাক ইবনুল হাম্মামের (২১১ হি) কাছে। ঘটনাক্রমে আব্দুর রাযযাকও সে বছর হজে আসেন।
বাইতুল্লাহর তওয়াফের সময় তাদের সাথে দেখা হয়ে যায়। এতে তারা যারপরনাই আনন্দিত হন। ইয়াহয়া ইবনে মাঈন বলেন, শায়েখ আমরা তো আপনার কাছে যাওয়ার ইচ্ছা করেছিলাম, আপনাকে এখানেই পেয়ে যাওয়াতে আমাদের আর এতদূর যাওয়ার কষ্ট করে যেতে হবেনা। আপনি যদি আমাদেরকে একটা নির্দিষ্ট সময় বলে দিতেন, তাহলে আমরা আপনার কাছে আসতাম। আব্দুর রাযযাক রাজী হলেন এবং একটা সময় ঠিক করে দিলেন। কিন্তু আহমদের পছন্দ হলো না এই ব্যপারটা।
তিনি ইবনে মাঈন কে বললেন, আমরা একবার যখন ইয়ামান যাওয়ার নিয়ত করেছি তখন ইয়ামান গিয়েই আব্দুর রাযযাকের হাদিস শুনব, এখানে না। এটা হাদিসের আদবের পরিপন্থি বলে মনে হলো তাঁর কাছে। ইবনে মাঈন তাঁকে বুঝানোর চেষ্টা করলেন বটে, কিন্তু আহমদ তাঁর কথায় অনড় রইলেন।
হজের পর তারা দুই বন্ধু মিলে ইয়ামানের পথে যাত্রা করলেন। সেটা ছিলো জীবনের সবচে কঠিন সফর। একে তো অজানা অচেনা বন্ধুর পথ, তার উপর প্রচণ্ড অর্থ কষ্ট। পর্যাপ্ত খাবার কেনার সামর্থ্যও ছিলো না তাদের। স্রেফ প্রবল ইচ্ছা দৃঢ় মনোবল এবং রাসুলের হাদিসের প্রতি অপ্রতিরোধ্য ভালোবাসার টানে এই দূর্গম পথ পাড়ি দিয়ে ইয়ামান পৌঁছে যান। আব্দুর রাযযাক তাদের কে অনেক সম্মানের সাথে গ্রহণ করেন। তাদের সুনাম সুখ্যাতি ইয়ামানে আরও আগেই পৌঁছে গিয়েছিলো।
আব্দুর রাযযাক তাদের থাকা খাওয়ার জন্য কিছু পয়সা দিতে চেয়েছিলেন। বলেছিলেন : দেখো, সান’আ এমন এক জায়গা, যেখানে চাষবাস বা ব্যবসায় বানিজ্য কিছুই করা সম্ভব না তোমাদের পক্ষে। আমার এ পয়সাগুলো রাখো তোমাদের খরচের জন্য। কিন্তু ইমাম আহমদ সম্মান ও আদবের সাথে তা ফিরিয়ে দিয়েছেন।
দীর্ঘ দুই বছর ছিলেন ইয়ামানে, আব্দুর রাযযাকের দরবারে। পুরোটা সময় প্রচণ্ড অর্থাভাব ও থাকা খাওয়ার কষ্টে কেটেছে। এমন কি এক পর্যায়ে তাদের সাথে থাকা একটা লোহার পাত্র বন্ধক দিয়ে খাবার কিনতে হয়েছে। কখনও সেটাও ছিলো না, দিনের পর দিন অনাহারে কাটিয়েছেন। দাঁতে দাঁত চেপে সবকিছু সয়ে গেছেন।
৮.
বাগদাদ থেকে বিদায় নিয়ে ইমাম শাফেঈ যখন মিশরের দিকে রওয়ানা করেন, তখন আহমদ তাঁকে কথা দিয়েছিলেন মিশরে গিয়ে তাঁর সাথে মিলিত হবেন; কিন্তু অর্থাভাব ও প্রবল দারিদ্র্য কোন সময়ই তাঁকে ছেড়ে যায়নি। ফলে উস্তাদের কাছে দেয়া তাঁর ওয়াদা পূরণ করতে সক্ষম হননি। এ নিয়ে তাঁর আফসোসের অন্ত ছিলোনা। ইমাম শাফেঈর শাগরেদ হারমালা ইবনে ইয়াহয়া (২৪৩ হি) বলেন : শাফেঈ প্রায়ই আহমদের কথা স্মরণ করে বলতেন–তারতো আমার কাছে আসার কথা ছিলো!
৯.
বস্তুত আহমদ ইবনে হাম্বলের পুরো জীবনটাই এমন বহুমুখী সংগ্রাম আর ত্যাগের উপাখ্যানে পূর্ণ। উঁচু ব্যক্তিত্ব, প্রবল আত্মমর্যাদাবোধ এবং বিপদের মুখে কঠোর ধৈর্যের পারাকাষ্ঠা প্রদর্শন–এগুলোই তাঁর জীবনে বারবার ফিরে এসেছে। তার প্রবাদতূল্য প্রচন্ড আত্মমর্যাদাবোধ জীবনে কারো কাছ থেকে একটি পয়সাও নিতে দেয়নি। জীবনের শুরুলগ্ন থেকেই কঠিন দারিদ্র্য তাঁর সাথে লেগেই ছিলো। একবার তার সঙ্গীসাথী অনেকেই রাই শহরের উদ্দেশে গেলো, জারীর ইবনে আব্দুল হামীদের (১৮৮ হি) কাছে। জারির তখন সে অঞ্চলের প্রবীন শায়েখ এবং মুহাদ্দিসদের শিরোমনি ছিলেন। কিন্তু আহমদ অর্থাভাবের দরুণ তাদের সাথে যেতে পারেননি। তিনি বলেন, মাত্র পঞ্চাশটা দিরহাম হাতে না থাকায় আমি তাদের সঙ্গে জারিরের কাছে যেতে পারিনি। হাফেয যাহাবীর মতে, পরবর্তীতে জারির থেকেও তিনি হাদিস শুনেছেন অন্যকোন সময়ে।
কিন্তু ইলম অন্বেষণের পথে এই সীমাহীন দুঃখ ও কষ্ট কে তিনি নিজের জন্য নিয়ামত মনে করতেন। এবং এই দারিদ্র্য তাঁকে ইলম অন্বেষণ থেকে ঠেকিয়েও রাখতে পারেনি। তাঁর লিখিত হাদিসের কিতাব মুসনাদে আহমদে দেখা যায় পুরো ইসলামী ভূখণ্ডের প্রসিদ্ধ সকল শায়েখদের হাদিসকে একত্রিত করেছেন।
১০.
ইলমের প্রতি, হাদিসের প্রতি তাঁর এই সিমাহীন আগ্রহ জীবনের শেষ পর্যন্ত ছিলো। যখন তিনি নিজেই ইমাম হয়ে গিয়েছিলেন তখনও শায়েখদের মজলিসে ঘুরতেন ইলমের সন্ধানে। তাঁর এক বন্ধু তাঁকে বললো,আহমদ আর কত এভাবে খাতা কলম নিয়ে ঘুরে বেড়াবে? আর কত এভাবে কুফা আর বসরায় ছুটাছুটি করবে? এবার অন্তত ক্ষ্যান্ত দাও! এর জবাবে আহমদ বললেন : আমার হাতের এই খাতা ও কলমদানি কবর পর্যন্তই আমার সাথে থাকবে – মৃত্যু পর্যন্ত আমি ইলমের সন্ধানেই কাটাবো। এর বিনিময়ে আল্লাহ তাঁকে এই অগাধ ইলম দান করেছিলন। দশ লক্ষ হাদিস সনদ সহ তাঁর বুকে ধারন করা ছিলো। তাঁর সময়ের শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস এবং ফকীহ ছিলেন। এই উম্মাহর একজন সম্মানিত ইমাম তিনি। আল্লাহ এই মহান ইমামকে তাঁর মর্যাদা অনুযায়ী প্রতিদান দিন। আমাদের পক্ষ থেকে তাঁর প্রতি দোয়া ও শুকর পৌঁছে দিন।
দ্বিতীয় পর্বে আলোচনা হবে তাঁর সংগ্রাম নিয়ে, ইনশআল্লাহ।