এই লেখায় ড. বশীর ইসাম শাসকদের নানা অনৈতিক কাজের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিবাদ বিষয়ে ইসলামের মূল ধারণাটি নিয়ে আলোচনা করেছেন। এর অর্থ হচ্ছে—রাষ্ট্র যখন সম্পূর্ণরূপে বা মোটের উপর হলেও ইসলামের আনুগত্য করবে ও শাসন পরিচালনার মূল ভিত্তি হবে শরীয়ত, সে অবস্থায় প্রতিবাদের বিশ্লেষণটি কী—এ নিয়েই তাঁর আলোচনা। বাংলাদেশ যেহেতু ইসলাম শাসিত নয়, তাই এ আলোচনা বাংলাদেশের সাথে কীভাবে রিলেট করছে, তা আলাদাভাবে আলোচনার বিষয়। তবে, শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মূল কনসেপ্টটি যদি আমাদের কাছে পরিস্কার থাকে, তাহলে বাংলাদেশ বিষয়ে আমাদের ভিতরে বাই ডিফল্ট সহজ অনুমান ও ধারণা তৈরী হবে, বলাই বাহুল্য। মূল লেখাটি ড. বাশীর ইসাম এর। তরজমা করেছেন সাবের চৌধুরী। আজকে ধারাবাহিক সিরিজটির দ্বিতীয় পর্ব প্রকাশ করা হলো—সম্পাদক
শুরুর কথা
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যখন রাজনৈতিক আন্দেলন, মিটিং-মিছিল, প্রতিবাদ-প্রতিরোধ তুমুলভাবে হচ্ছে, কখনো শান্তিপূর্ণ পন্থায়, কখনো সহিংস পদ্ধতিতে, এরকম সময়ে ‘শরীয়তের দৃষ্টিতে রাজনৈতিক প্রতিবাদের হুকুম কী’—নিয়ে অনুসন্ধানে করতে বসা কিছুটা অস্বস্তিকর বটে; কিন্তু এই আলোচনাটি সঠিক কেন?
এর দুইটি কারণ :
১. সকল মুসলমানের জন্য অমোঘ এক বিধান হলো—জীবনের প্রতিটি বিষয়ে আল্লাহ তাআলার নির্দেশনাটি জেনে নেওয়া। এটা জানতে হবে ওহী থেকে ওহীর মর্ম উদ্ধারের নির্ধারিত টুলসগুলো ব্যবহারের মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে কোন একটি মতের উপর বেশি মানুষ আছে দেখে ধোঁকা খাওয়া যাবে না। কারন, সত্য অনেক সময় এর বিপরীতে থাকে।
২. সমকালে আমরা এমন কিছু রাষ্ট্রিয় পোষ্য তান্ত্রিকের দ্বারা আক্রান্ত, যারা বেশভূষায় দেখতে আলেমের মতো। এরা শাসকের আনুগত্যের উপর অন্যায়ভাবে অত্যাধিক জোর দেয়, যা স্পষ্টতই সীমালংঘন ও জুলুম। এই লোকগুলো শাসকের সব ধরণের বিরোধিতা নিষিদ্ধ বলে মনগড়া কথা নিরবিচ্ছিন্নভাবে বলতেই থাকে। কেউ শাসকের ব্যাপারে সামান্য একটু সমালোচনা করলেও একে বিদআত, ইজমার খণ্ডন এবং সলফে সালেহীন ও অনুসরণীয় হকপন্থী উলামায়ে কেরামের বিরোধিতা বলে আখ্যায়িত করে বসে।
রাজনৈতিক প্রতিবাদের অর্থ :
এই প্রবন্ধে রাজনৈতিক বিরোধিতার দ্বারা উদ্দেশ্য হলো অহিংস বিরোধিতা। এখানে আমরা সশস্ত্র সংগ্রাম, সহিংস আন্দোলন বা সামরিক অভ্যুথ্যান—ফিকহের ভাষায় যেগুলোকে শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শব্দ দিয়ে ব্যক্ত করা হয়—সেসব নিয়ে আলোচনা করব না। এসব নিয়ে আমাদের বিস্তরিত আলোচনাটি পরবর্তি ‘সমাপ্তি পর্বে’ পত্রস্ত করব ইনশাআল্লাহ।
প্রথম কথা হলো—আমাদের সালফে সালেহীন থেকে ‘বিদ্রোহ’ ও বিদ্রোহ সংশ্লিষ্ট ফিকহি অনেক সিদ্ধান্ত ও বক্তব্য রয়েছে। কিছু মানুষ এ বক্তব্যগুলোকে টেনে এনে অহিংস রাজনৈতিক প্রতিবাদের গায়ে বসিয়ে দেয়। এরা হয়তো সালাফের বক্তব্য বুঝে না, না হয় এদের উদ্দেশ্য খারাপ।
এর মাঝে কিছু মানুষ আছে আরেকটু সতর্ক ও সূক্ষ্মভাবে কথা বলে। বলে, অহিংস বিরোধিতা সশস্ত্র বিদ্রোহেরই পূর্ববর্তী রূপ। কারণ, এটিই একসময় বিরোধীদেরকে সশস্ত্র বিদ্রোহের দিকে টেনে নিয়ে যায়। এরপর এ দলটি ফিকহের ‘সাদ্দুয যারীআহ’ বা ‘পূর্ব থেকে পথ বন্ধ করে রাখা’ নীতির কথা বলে অহিংস আন্দোলন নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করে। অর্থাৎ, অহিংস আন্দোলনের উপর ‘বিদ্রোহ’র তকমাটি সরাসরি না লাগিয়ে একটু ঘুরপথে লাগাচ্ছেন।
এই যে দোহাইটি—নিছক ফিকহি দৃষ্টিকোণ থেকে এর সম্ভাব্যতা আছে সত্য; কিন্ত নিতান্ত জটিল ও ধুম্র পরিস্থিতিতে সংঘটিত অহিংস আন্দোলনের বিশেষ কিছু অভিজ্ঞতার আলোকে এর একটি সীমাবদ্ধ অর্থ তৈরী করা, তারপর একে অহিংস প্রতিবাদের সাধারণ ও পূর্ণরূপ হিসেবে দেখিয়ে ‘বিদ্রোহের পথ’ আখ্যায়িত করার মাধ্যমে পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করতে চাওয়াটি খুবই আপত্তিজনক।
মনে রাখি, এখানে রাজনীতি দ্বারা আমি গণতান্ত্রিক পার্লামেন্টারি দলগুলোর একটিভিজমকে বুঝাচ্ছি না। (অবশ্য, যারা শরীয়ত নির্দেশিত নির্দিষ্ট শর্তসাপেক্ষে গণতান্ত্রিক রাজনীতি কর বৈধ বলেন, তাদের মত অনুযায়ী গণতান্ত্রিক দলগুলোর প্রতিবাদও এর আওতাভুক্ত হবে; তবে এখানে) আমার উদ্দেশ্য এর চেয়েও অনেক ব্যাপক ও বিস্তৃত কিছু। শাসনযন্ত্রের বিরোধিতার উদ্দেশ্যে রাজনীতি সংশ্লিষ্ট যে কোন কথা বা কাজ এ আলোচনার অন্তর্ভু্ক্ত। তা ব্যক্তিগত আলাপচারিতার বৈঠকে হোক, বা প্রভাবশালী রাজনৈতিক মিটিং ও সুবিশাল প্রতিবাদ মিছিলের বক্তব্য হোক।
সুতরাং, রাজনৈতিক প্রতিবাদের অর্থ দাঁড়াচ্ছে—শাসকের দেশ পরিচালনা সংক্রান্ত নানা বিষয়ের সমালোচনা ও তার উপর পর্যবেক্ষণ জারি রাখার উদ্দেশ্যে পরিচালিত যে কোন কর্মকাণ্ড। এবার এ সমালোচনা শাসককে অহিংসভাবে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে নিজে সেখানে যাওয়ার নিয়তে হোক, বা সংশোধনের উদ্দেশ্যে সাধারণ সমালোচনা হোক।
এ থেকে একটা জিনিস পরিস্কার হলো—ক্ষমতা পরিবর্তনের জন্য চেষ্টা করার বিষয়টি রাজনৈতিক প্রতিবাদের মূল মর্মের অন্তর্ভুক্ত নয়। এ কারণেই আমরা দেখি অনেক প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক পার্টি আছে, যারা নিশ্চিতভাবে জানে যে, নিজেরা কখনো ক্ষমতায় যেতে পারবে না, তা সত্তেও পর্যবেক্ষণ ও সমালোচনার কাজটি ক্লান্তিহীনভাবে করে যায়, বছরের পর বছর ধরে।
এখন আমরা প্রশ্ন করতে পারি—
বিরোধিতাটা আসলে কেন? এর প্রয়োজনীয়তা কোথায়?
উত্তরটা আসলে একদমই সহজ। এর জন্য খুব বেশি কষ্ট করার প্রয়োজন পড়ে না। কারণ, শাসনব্যবস্থাটি একক স্বৈরাচারী পদ্ধতিতে হোক, বা নিয়মতান্ত্রিক দলীয় শাসনই হোক, এর মাথায় যে বসে থাকে, সে শাসকটি তো শেষ পর্যন্ত একজন মানুষই। তার পক্ষে ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত ভুলত্রুটি থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব নয়। আর নিজের ভুলগুলো নিজেই ধরে ফেলতে পারে এমন মানুষের সংখ্যা আসলে খুব কম। বেশিরভাগ মানুষেরই এ কাজের জন্য একজন সঙ্গী লাগে, যে তাকে ভুল ধরিয়ে দিবে ও গাফিলতির সময়ে সজাগ করে দিবে—অনেকটা আয়নার মতো, যেখানে সে নিজের ত্রুটিগুলো সহজে অবলোকন করতে পাবে।
সুতরাং, বিরোধিতা ও প্রতিবাদ—
• রাজনৈতিক ভারসাম্য তৈরী করে;
• একক স্বৈরতন্ত্রকে রোধ করে;
• দেশ পরিচালনায় জুলুম থেকে পরিত্রাণ আনে;
• অকল্যাণজনক সিদ্ধান্ত নিতে সরকারকে বাধা দেয়;
• জনসাধারণের জন্য শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত অধিকারসমূহ সংরক্ষণে সাহায্য করে।
প্রতিবাদ ও আনুগত্য
কিছু দুষ্ট লোক জনসাধারণকে রাজনৈতিক প্রতিবাদ থেকে বিমুখ করার জন্য যে সকল ভিত্তিহীন সংশয় ছড়িয়েছে, এর অন্যতম একটি হলো—তারা দাবি করে এই প্রতিবাদ ও বিরোধিতা শাসকের প্রতি সাধারণ মানুষের জন্য অবশ্য পালনীয় আনুগত্যের বিপরীত। এটা একটা ভুল কল্পনা। শরীয়তের দৃষ্টিতে আনুগত্যের সঠিক অর্থটি সামনে নিলে আমরা দেখব—মুসলিম শাসকের বিরোধিতা তার আনুগত্যের বিপরীত নয়। পেছনের প্রবন্ধে এ বিষয়টি আমরা বিস্তারিতভাবে দেখিয়েছি। এখানে সংক্ষেপে শুধু এটুকু উল্লেখ করছি—শরীয়তের উদ্দিষ্ট আনুগত্যটি ‘সৎ কাজ’র সাথে শর্তযুক্ত। এ থেকেই অন্যায় কাজে বিরোধিতার বৈধতা প্রমাণিত হয়।
এই যে উভয়টাকে অযথা সাংঘর্ষিক দেখানোর প্রবণতা, এটি গড়ে উঠেছে ‘শরীয়তের উদ্দিষ্ট আনুগত্য’র মর্মটি বুঝতে গিয়ে বাড়াবাড়ি করার কারনে। এই বাড়াবাড়ির কারণেই তারা শাসককে নিষ্পাপ পর্যন্ত দাবি করে বসে। যদিও মুখে বলে না, কিন্তু কর্ম ও আচরণ দিয়ে মূলত তা-ই বুঝায়। এমনকি এক সময় গিয়ে দেবতা ও ইলাহ পর্যন্ত মনে করতে থাকে।
এই বক্র চিন্তা ইসলামের প্রথম যুগের আচরণের সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। এর বিস্তারিত বিবরণ সামনে আসছে, ইনশাআল্লাহ।
রাজনৈতিক প্রতিবাদ ও বিরোধিতার বৈধতা :
উপরের কথাগুলো যদি পরিস্কার হয়ে থাকে, তাহলে আমরা দেখব অহিংস রাজনৈতিক প্রতিবাদ হারাম হওয়ার কোন দলীল নেই। সুতরাং, আমরা এখানে ‘আল আসলু আল ইবাহাহ’ বা ‘হারাম হওয়ার নির্দিষ্ট দলীল পাওয়ার আগ পর্যন্ত সব কিছুর মূল অবস্থা হলো বৈধতা’ নীতিটি গ্রহণ করব। এখানে এই নীতিটি আরো অনেকগুলো দলীলের দ্বারা শক্তিশালী হয়ে উঠে।
সেসব থেকে সামান্য কয়েকটি প্রমাণ উল্লেখ করছি :
এক.
শরীয়তে ‘সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ’ একটি বৈধ ও কাঙ্খিত বিষয়। ইসলামের এটি একটি বড় মূলনীতি। অনেকগুলো আয়াত ও হাদীস এর অনিবার্যতার কথা বলেছে। শাসকের ভুল কাজের কথা বলা ও সমালোচনার মাধ্যমে বিরোধিতা করা ‘অসৎ কাজের নিষেধ’রই একটি অংশ।
সহীহ মুসলিমের একটি বিবরণে আছে সর্বপ্রথম ঈদের দিন নামাজের আগে খুতবা দিয়েছিলেন খলীফা মারওয়ান। তখন এক লোক দাঁড়িয়ে বলেছিলেন : ‘নামাজ খুতবার পরে নয়, আগেই হবে’। এ কথা শুনে খলীফা মারওয়ান পাল্টা জবাব দিলেন : এ নিয়ম ওই যুগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল।
এসব শুনার পর সাহাবী আবু সাঈদ রা. বললেন : ওই যে লোকটি প্রতিবাদ করলো, সে তার দায়িত্ব আদায় করেছে। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি : তোমাদের কেউ যখন কোন অসৎ কাজ হতে দেখে, তখন সে যেন হাত দিয়ে বাধা দেয়; যদি সম্ভব না হয়, তাহলে যেন মুখ দিয়ে বাধা দেয়; তা-ও সম্ভব না হলে অন্তত হৃদয়ে যেন এর প্রতি ঘৃণা লালন করে, এবং এটি ঈমানের সর্বনিম্ন স্তর।
ইমাম নববী রহ. এর ব্যাখ্যায় বলেন : উলামায়ে কেরাম বলেছেন—সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করার দায়িত্ব শুধু শাসকশ্রেণীর উপর নয়; এটি বরং সকল মুসলমানের যিম্মাদারি।
ইমামুল হারামাইন বলেছেন—এর দলীল হলো এ ব্যাপারে মুসলমানদের ঐকমত্য। কারণ, প্রথম ও এর ঠিক পরবর্তী যুগে শাসকশ্রেণীর বাইরের লোকেরা শাসকশ্রেণীকে সৎ কাজের নির্দেশনা দিতেন এবং অসৎ কাজ হতে বারণ করতেন। অন্যান্য মুসলমানগণ তাদের এ কাজকে সমর্থন করতেন এবং শাসক শ্রেণীর বাইরে থেকে এসে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ নিয়ে তৎপর হলেন কেন—এ নিয়ে তাদেরকে কোন ধরণের তিরস্কার করতেন না।
এই কথাগুলো আপনি ভালো করে ভাবুন এবং সমকালের কিুছু মানুষের কথার সাথে মিলিয়ে দেখুন!
দুই.
জনগণ শাসকদের কল্যাণ কামনা করবে—এটি শরীয়ত নির্দেশিত একটি কাজ এবং নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত একটি বিষয়। এখন, তাদেরকে সত্য পথে চলতে সহযোগিতা করাও কল্যাণকামিতার একটি দিক। এই সহযোগিতাটা কীভাবে হবে? শাসকগণ যখন জনগণের হক নষ্ট করবে, তখন সেসব বিষয় তাদেরকে সতর্ক ও সজাগ করে দিবে এবং সঠিক কাজটির প্রতি দিক নির্দেশনা দিবে। পাশাপাশি তারা যেসব ভুলত্রুটি করবে, সেগুলো তাদেরকে জানিয়ে সেসব বিষয়ে সমালোচনা করবে।
তাদের বিরোধিতায় না গিয়ে চুপ করে বসে থাকার নাম কল্যাণকামিতা নয়; দুনিয়ালোভী চাটুকারদের মতো বানোয়াট প্রশংসা করা তো কল্যাণকামিতার ক’-ও নয়।
তিন.
সত্যের প্রচার করা এবং মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকা একটি বৈধ ও কাঙ্খিত কাজ। এবং এটা কোনভাবেই সম্ভব নয় যে, শরীয়ত এ ব্যাপারে উৎসাহিত করে অসংখ্য বক্তব্য দিবে এরপর এ কাজটিকে শুধুমাত্র জনগণ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ করে শাসকদেরকে এর আওতার বাইরে রাখবে।
সুতরাং, শাসক যে সকল ভুলত্রুটি করে, শরীয়তের সীমা লঙ্ঘণ করে এবং জনগণের সাথে অন্যায় আচরণ করে, সেসব বিষয়ে তাকে দিক নির্দেশনা দেওয়াও সে কাঙ্খিত প্রচার ও আহ্বান কর্মের অন্তর্ভুক্ত।
চার.
বিশেষভাবে কাউকে ছাড় না দিয়ে ব্যাপকভাবে সকল ধরনের জুলুম প্রতিরোধ করা বৈধ। যেমনটি হাদীসে এসেছে—যে তার সম্পদ রক্ষার জন্য লড়াই করে মারা গেল সে শহীদ। এখন এই হাদীসকে যদি শাসকশ্রেণীর বাইরের জুলুমের সাথে বিশেষায়িত করতে হয়, এর জন্য আলাদা দলীল দিতে হবে।
আমরা বরং এর উল্টোটা দেখতে পাই। মক্কা ও তায়েফের গভর্ণর আনবাসা ইবনে আবু সুফিয়ান যখন নিজের জমিতে সেঁচ দেওয়ার জন্য পানি ছেড়ে দিল, আবদুল্লাহ ইবনে উমর তখন অস্ত্রসহ দলবল নিয়ে তাকে প্রতিরোধ করতে নামলেন। তিনি তখন এই হাদীসটি দিয়েই দলীল দিয়েছিলেন। এ থেকেও প্রমাণিত হয় ‘জুলুমকে প্রতিরোধ করো’ নির্দেশের ভিতরে শাসকের জুলুমও অন্তর্ভুক্ত।
পাঁচ.
এ ব্যাপারে আরো কয়েকটি হাদীস আছে। এর মধ্যে সহীহ বুখারীতে বর্ণিত প্রশিদ্ধ একটি হাদীস হলো—আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে বাইআত নিয়েছি এ কথার উপর যে, সুখে-দুঃখে, আনন্দে-বেদনায়, এমনকি আমাদের অধিকার ক্ষুণ্ন করে যখন স্বজনপ্রীতি চলবে, তখনও আমরা অনুগত হয়ে মেনে চলব; শাসনকার্য নিয়ে শাসকদের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হব না, এবং যেখানেই থাকি সত্য বলব, আল্লাহর আনুগত্য করতে গিয়ে কোন তিরস্কারকারীর তিরস্কারকে ভয় করব না।
হাদীসটির প্রথম অংশ নিয়ে আমরা এখন কোন মন্তব্য করব না। কারণ, এটি শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের বিধানের সাথে সম্পর্কিত এবং পরবর্তী প্রবন্ধে এ বিষয়ে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ; এখন শুধু হাদীসের শেষাংটির দিকে তাকাই। এ অংশটি কোন শর্ত ছাড়াই ব্যাপকভাবে সত্য বলা ও প্রকাশ করার জন্য নির্দেশনা দিচ্ছে। লক্ষ্য করে দেখুন, হাদীসটি কিন্তু শাসকের সাথে জনগণের সম্পর্ক বিষয়ে—শুরুর অংশটি দেখলেই বিষয়টি পরিস্কার হয়—এই হাদীসে যখন কারো পরোওয়া না করে সত্য প্রকাশের নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। এটি অহিংস রাজনৈতিক প্রতিবাদ ছাড়া আর কি? একদমই সুস্পষ্ট বিষয়।
সহীহ বুখারিতে আরেকটি হাদীস আছে—”আল্লাহ তাআলা আমার পূর্বে যে নবীকেই পাঠিয়েছেন, তাদের প্রত্যেকের সাথেই তার স্বজাতির কিছু নিত্যসহচর ও বন্ধু ছিল, যারা তার আদর্শকে আঁকড়ে ধরত ও তাঁর আদেশ মেনে চলত; অতঃপর তাদের পরবর্তীতে কিছু প্রজন্ম আসত (মুসনাদে আহমেদের শক্তিশালী সূত্রে একটি বর্ণনায় এসেছে : তাদের পর কিছু শাসক প্রজন্ম আসত), তারা যা করত না, তা করেছে বলে দাবি করত; কিন্তু যা যা করতে বলা হয়েছিল, তা পালন করত না। সুতরাং, যে তাদের সাথে হাত দিয়ে যুদ্ধ করে, সে মুমিন; যে কথা দিয়ে জিহাদ করে, সে মুমিন; যে অন্তর দিয়ে তাদেরকে ঘৃণা করে, সে মুমিন। এই তিন স্তরের বাইরের লোকদের মধ্যে সরিষা পরিমাণ ঈমানের উপস্থিতিও নেই”।
এই স্তরগুলোর কথা ভালোভাবে চিন্তা করুন, এবং মনে রাখুন—হাত দিয়ে জিহাদ করা মানেই সবসময় বিদ্রোহ নয়; বরং জুলুম-অন্যায় ও খারাপ কাজকে হাত দিয়ে পরিবর্তন করার মাধ্যমেও হাতের জিহাদ হতে পারে। ইবনে রজব হাম্বলি রহ.সহ অন্যান্যরা এ কথাই বলেছেন।
আর, কথার জিহাদ হলো আমরা এখন যে বিষয়টি নিয়ে কথা বলছি, অর্থাৎ, অহিংস রাজনৈতিক প্রতিবাদ ও বিরোধিতা।
আমরা যা যা বললাম, এর সবটুকু ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. ছোট্ট এই বক্তব্যটির মধ্যেই বলে দিয়েছেন। তিনি বলেন : বাদশা যে অন্যায় শত্রুতা করবে এবং মানুষের যে যে অধিকার নষ্ট করবে, সেসব কিছুর জন্য তাকে ধরা হবে, তাকে ক্ষমতায় রেখেই।
ছয়.
সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম শাসকদের নানা কাজে আপত্তি উঠিয়েছেন। ওহীর মর্ম সম্পর্কে উম্মতের মধ্যে তারাই সবচেয়ে বেশি অবগত ও অনুধাবনকারী। এবং পুরো ইতিহাসজুড়ে অনেক ইমামগণ তাদেরকে এ কাজে অনুসরণ করেছেন। হিসাব দিতে গেলে কথা অনেক লম্বা হয়ে যাবে, এ প্রবন্ধে সে ফুরসত নেই। শাসকদের দ্বারা যে সকল ইমাম নির্যাতিত হয়েছেন, তাদের বেশিরভাগই নির্যাতিত হয়েছেন এই অহিংস রাজনৈতিক প্রতিবাদ ও বিরোধিতার কারণে।
শাসকের উপর প্রকাশ্যে অভিযোগ উঠানো
সালাফে সালেহীনগণ শাসকদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অভিযোগ উঠিয়েছেন, তাদের উপস্থিতিতে মুখোমুখি হয়ে যেমন, তাদের অনুপস্থিতিতেও। এ ব্যাপারে প্রচুর পরিমাণে বর্ণনা পাওয়া যায়। এখানে আমি একটি গ্রন্থের রেফারেন্স দিচ্ছি—আল হুররিয়্যাতুস সিয়াসিয়্যাহ আল মুআসিরাহ ফি দাও-ই ফিকহিস সাহাবাহ (সাহাবায়ে কেরামের জ্ঞান ও বুদ্ধির আলোকে সমকালের রাজনৈতিক স্বাধীনতা)।
গ্রন্থটি লিখেছেন ড. ফাহাদ আজলান। সেখানে তিনি ৪৭৫ পৃষ্ঠা থেকে নিয়ে ৪৮৬ পৃষ্ঠা জুড়ে সে সব বিবরণের বেশ ভালো একটা অংশ উল্লেখ করেছেন। এই বিবরণগুলো সামনে রাখার পর আমরা দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি—যারা বলেন সালাফে সালেহীন শাসকের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অভিযোগ করাকে হারাম বা বিদআত বলতেন, তারা সালাফের নামে সম্পূর্ণ ভুল কথা প্রচার করেন।
এটা সত্য, সালাফের কেউ কেউ অতীতের নির্দিষ্ট কিছু পরিস্থিতিতে গোপনে প্রতিবাদ ও অভিযোগ করাকে পছন্দ করেছেন ও নিজেরা সে মোতাবেক কাজ করেছেন; কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, প্রকাশ্যে অভিযোগ করা বিদআত এবং সালাফের পথ ছিল শুধুমাত্র গোপনে প্রতিবাদ জানানো। তাছাড়া প্রকাশ্যে অভিযোগ করার ব্যাপারে তাদের থেকে প্রচুর পরিমাণ ঘটনা ও বিবরণ তো আছেই। বরং, সঠিক হলো উভয়টিই শুদ্ধ। এখন কোনটি ভালো? এটি নির্ভর করে পরিস্থিীত অনুযায়ী তূলণামূলক কল্যাণ ও অকল্যান বিবেচনার উপর।
শেষ কথা
আমাদের এই সময়ে, যখন আধুনিক রাষ্ট্রে প্রতিবাদ জানানোর ভাষা ও মাধ্যমগুলো নির্ধারিত, এবং এগুলোর গুরুত্ব সর্বজনবিদিত, সে সময়ে শুধুমাত্র গোপনে নির্জনে গিয়ে প্রতিবাদ ও অভিযোগ জানানোর কথাটি কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
এই কথাটি আরো জোরালো হয়, যখন দেখি—শাসকেরা গোপনে অভিযোগ জানাবার জন্যও দরজা খোলে না এবং তাদের নানা কাজের অসমর্থনকারী আলেম উলামা দাঈদের সাথে তারা বিশেষ বৈঠকে বসতেও আগ্রহী না। তাদের বেশিরভাগ মিটিং হয় কেবল অনুচর ও চাটুকারগণের সাথে। এই অবস্থায় শুধুমাত্র গোপনে অভিযোগ জানাবার কথা বলা মানে এ কথা বলা যে, কোন অভিযোগই করা যাবে না। অনেক মুসলিম রাষ্ট্রে যারা এই মত অবলম্বন করছেন, তাদের বাস্তব অবস্থান এর বাইরে কিছু নয়।
শাসক ও জনগণের সম্পর্ক বিষয়ে আমাদের আরো কিছু কথা আছে। আল্লাহ চাহেন তো সামনের প্রবন্ধগুলোতে বলব সেসব।