নবীজীবনে নির্জনতার ধারণা
নবীজীবনের নির্জনতার ধারণা আমাদের জগৎ-সংসার বিরাগী নির্জনতার চেয়ে সম্পূর্ণই আলাদা। নবীজির নির্জনতা তাকে রবের আরও নিকটবর্তী করত। গভীর রাতে তিনি নিজের সমগ্র সত্তা সঁপে দিতেন পরম প্রভুর সমীপে। রজনীর গভীরতার মতো তার নিবেদন প্রগাঢ় হতে থাকত।
দিবসের কোলাহলে তিনি সান্নিধ্যের সেই সৌরভ বিলাতেন জনতার মাঝে। তাঁর জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ব্যয়িত হয়েছে মানুষের কাছে আল্লাহর নৈকট্য আরও সুলভ করার আয়োজনে। রবের সাথে সবের রাবেতা কায়েমই ছিল তাঁর শব্দ ও নৈশব্দের মাকসাদে-কুল।
তাই নির্জনতা শব্দের যে ছবি আমাদের মস্তিষ্কে গ্রথিত, নবীজির নিমগ্নতার সাথে তার বিস্তর ফারাক। নবুওতপূর্ব হেরা গুহার নিমগ্নতা, গারে ছাওরে আল্লাহর জিকির, বিদায় হজে ‘আল্লাহুম্মাশহাদে’র অলৌকিক উচ্চারণ, সর্বোপরি নবীজির কাজে-কর্মে আল্লাহর সার্বক্ষণিক হাজিরির উপলব্ধি তার নির্জনতাকে জনতার মাঝে ব্যয়িত সময়ের চেয়েও বেশি ঐশ্বর্যমণ্ডিত করে তোলে।
মানুষ নিজেকে সবচেয়ে প্রবলভাবে আবিষ্কার করতে পারে একান্ত ব্যক্তিগত মুহূর্তে— নির্জনতায়। আল্লাহর পয়গাম মানুষের মাঝে আম ও তাম করার দায়িত্ব মূলত নীরবতা ও নির্জনতাবিরোধী। তবু নবীজি বেশির ভাগ সময় থাকতেন নীরব। নবীজির মৌনতাও তাঁর বক্তব্যের মতোই অর্থাধিক।
নবীজির প্রথম প্রধান দায়িত্ব দাওয়াত ও তাবলিগ হলেও আল্লাহ তাআলা এই বাহ্যিক দায়িত্ব আদায়ান্তে জিকির এবং অন্যান্য এবাদতের জন্য সময় বের করার নির্দেশ দিয়েছেন তাঁকে। কারণ, দাওয়াত ও তাবলিগ হচ্ছে পরোক্ষ ইবাদত আর জিকির আজকারসহ আল্লাহ প্রদত্ত ইবাদত হচ্ছে প্রত্যক্ষ ইবাদত। এই জন্য আল্লাহ তাআলা নবীজিকে পরোক্ষ ইবাদতে সীমাবদ্ধ না থেকে প্রত্যক্ষ ইবাদতে মনোনিবেশ করতে বলেছেন৷ فَإِذَا فَرَغْتَ فَانْصَبْ (অবকাশ পেলেই [ইবাদতে] ক্লান্ত হোন) অধিকাংশ মুফাসসিরগণ এই আয়াতের এ তাফসিরই করেছেন। আর একান্ত ইবাদতের জন্য তো নির্জনতা খুবই জরুরি। এই আয়াত থেকে অনুমেয়, আম্বিয়ায়ে কেরামের উত্তরসূরী হিসেবে উলামায়ে কেরামেরও উচিত অবকাশ পেলেই নির্জনে আল্লাহর ইবাদতে নিমগ্ন হওয়া। (১)
নবীজি প্রয়োজন ছাড়া কথা বলতেন না। বেশিরভগ সময় থাকতেন নীরব। যেমন জাবির বিন সামুরা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,
كَانَ طَوِيلَ الصَّمْتِ، قَلِيلَ الضَّحِكِ
‘তিনি দীর্ঘ সময়ব্যাপী নীরব থাকতেন আর হাসতেন খুব কম।’ (২)
ব্যক্তিগত জীবনে নীরবতা
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্জনতার প্রথম ধাপ হলো, তার ব্যক্তিগত জীবন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন খুবই অনাড়ম্বর। নবীজি নিজের কাজ নিজে করতেন এবং স্ত্রীদের ঘরের কাজেও সহায়তা করতেন। আম্মাজান হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,
کَانَ بَشَرًا مِّنَ الْبَشَرِ یَفْلِیْ ثَوْبَهُ وَ یَحْلُبُ شَاتَهُ وَ یَخْدُمُ نَفْسَهُ
‘নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাধারণ মানুষের মতোই নিজের কাপড় নিজে পরিষ্কার করতেন, বকরির দুধ দোহন করতেন এবং নিজের কাজ নিজেই করতেন।’ (৩)
পরিবারের কাজে সহায়তার জন্য নবীজি সাহাবায়ে কেরামকে উৎসাহ দিতেন। তিনি বলেন,
خَیْرُکُمْ خَیْرُکُمْ لِاَھْلِهِ وَ اَنَا خَیْرُکُمْ لِاَھْلِيْ
‘তোমাদের মধ্যে সেই সর্বোত্তম, যে তার পরিবারের নিকট সর্বোত্তম। আর আমি আমার পরিবারের কাছে সর্বোত্তম।’ (৪)
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বাবস্থায় আল্লাহর জিকিরে মশগুল থাকতেন। হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, کَانَ یَذْکُرُ اللّٰہَ عَلٰی کُلِّ حَالٍ ‘তিনি সর্বাবস্থায় আল্লাহর জিকিরে নিরত থাকতেন। আল্লাহর প্রতি নবীজির আত্মসমর্পন সবচেয়ে প্রবলভাবে প্রকাশ পায় বিভিন্ন মাসনুন দুআয়। নবীজির দুআগুলো পড়লে তার নিবেদনের গভীরতা হৃদয়ে আল্লাহর প্রতি এক ঐকান্তিক ভালোবাসা ও নির্ভরতা তৈরি করে। একাকী সময়ে আল্লাহর সকাশে একান্ত নিবেদনের সেইসব দুআয় ‘ওয়াহিদ মুতাকাল্লিমের সিগা’ (প্রথম পুরুষের ক্রিয়া) ব্যবহৃত হয়েছে। এই শব্দচয়ন থেকেও দুআর সময়ে নবীজির নির্জনতার ব্যাপারটি পরিষ্কার বুঝে আসে।
দুআর সময়ে নবীজি যেন ফেস টু ফেস আল্লাহর সাথে কথা বলতেন। একান্তে করা প্রতিটি দুআর ভাষা ও সংবেদ থেকে বুঝা যায় নবীজি আল্লাহর প্রতি কী অসীম ভরসা রাখতেন। দুআ করার সময় মনে হতো নবীজি এবং আল্লাহ তাআলার মাঝে আদৌ কোনো পর্দা নেই। হজরত ওমর বিন খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত বদর যুদ্ধের রাতে নবীজি দুআয় আল্লাহর সমীপে আরজ করেন,
اَللّٰھُمَّ اِنْ اَھْلَکْتَ ھٰذِہٖ الْعِصَابَةَ فَلَنْ تُعْبَدْ فِی الْاَرْض اَبَدًا
‘হে আল্লাহ, আজ এই কাফেলা ধ্বংস হয়ে গেলে জমিনে আপনার ইবাদাত করার মতো কেউ থাকবে না।’ নবীজি এত কাতর স্বরে কায়মনে দুআ করছিলেন যে, তাঁর কাঁধ থেকে চাদর পড়ে যায়। হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু চাদর তুলে দিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললেন, হে আল্লাহর নবী! আপনার এই বিগলিত মোনাজাতই যথেষ্ট, আল্লাহ নিশ্চিয়ই আপনার সাথে কৃত ওয়াদা পূরণ করবেন। আপনি শান্ত হোন। (৫)
তাঁর আত্ম নিবেদনের সর্বোত্তম নমুনা হলো বিভিন্ন সময়ে পঠিত দুআগুলো। প্রাকৃতিক প্রয়োজনে যে সামান্য সময়টুকু নবীজির জিকিরবিহীন অতিবাহিত হতো, এর জন্যও নবীজি ইস্তেগফার পড়তেন,
غُفْرَانَكَ الْحَمْدُلِلّٰهِ الذَّيْ أَذْهَبَ عَنِّيْ الأَذَى وَعَافَانِيْ
‘হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তাআলার জন্য, যিনি আমার কষ্টদায়ক বস্তু দূর করে দিয়েছেন এবং আমাকে দান করেছেন প্রশান্তি।’ (৬) সামান্য সময়ের জন্য নবীজি বিশ্রাম গ্রহণ করলে এই দুআ পড়তেন,
بِاسْمِكَ رَبِّي بِكَ وَضَعْتُ جَنْبِي وَبِكَ أَرْفَعُهٗ فَإِنْ أَمْسَكْتَ نَفْسِي فَارْحَمْهَا وَإِنْ أَرْسَلْتَهَا فَاحْفَظْهَا بِمَا تَحْفَظُ بِهٖ عِبَادَكَ الصَّالِحِينَ
‘হে আল্লাহ, আপনার নামে বিশ্রাম গ্রহণ করছি। আপনার নামে আমার পাজর বিছানায় রাখলাম এবং আপনার নামেই আবার বিছানা থেকে উঠব। আমার রুহ কবজ করে নিলে আপনি তার ওপর রহম করুন আর রুহ পুনরায় পাঠিয়ে দিলে তাকে হেফাজত করুন যেভাবে আপনি আপনার নেক বান্দাদের হেফাজত করে থাকেন।’ (৭)
গভীর রজনীতেও নবীজির সবচেয়ে প্রিয় আমল ছিল নামাজ। সাধারণ মানুষ রাতের প্রায় পুরো সময়টাই স্ত্রী-সংসার নিয়ে কাটায়। নবীজির প্রতি এগারো জন স্ত্রীর হক ছিল। এই হক যথাযথ আদায়ের পরও নামাজ ছিল তার রাতের সবচে প্রিয় আমল। তিনি বলেন, قُرَّۃُ عَیْنِیْ فِی الصَّلٰوۃِ ‘নামাজের মধ্যে রয়েছে আমার চোখের শীতলতা’।
নবীজির নিশি-যাপন
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাতের বেশির ভাগ সময় ইবাদত-বন্দেগির মধ্যে কাটাতেন। বহু হাদিসে নবীজির রাতের ইবাদদের বর্ণনা এসেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, إِنَّ نَاشِئَةَ اللَّيْلِ هِىَ أَشَدُّ وَطْأً وَأَقْوَمُ قِيْلاً ‘রাতে ওঠা (ইবাদতের জন্য জাগ্রত হওয়া) শক্তভাবে (প্রবৃত্তিকে) দমনে এবং সঠিকভাবে (দুআ তেলাওয়াত ইত্যাদি) উচ্চারণে সহায়ক। (৮)
এছাড়া আবু উমামা বাহিলি রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদিসে সর্বোত্তম আমলের ব্যাপারে নবীজি বলেন, اَلصَّلٰوۃُ بِاللَّيْلِ وَالنَّاسُ نِیَامٌ ‘রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে, সেই সময়ের নামাজ’ (৯) এই জন্য নবীজি রাতের অধিকাংশ সময় নামাজে অতিবাহিত করতেন।
শুধু নামাজ নয়; ইসলামের সকল বিষয়েই নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মতের চেয়ে অনেক বেশি অগ্রগামী ছিলেন। নবীজি বছরে ছয় মাস রোজা রাখতেন আর আমাদের জন্য ধার্য করা হয়েছে মাত্র এক মাস। নবীজি নিয়মকরে তাহাজ্জুদ পড়তেন, অথচ আমাদের জন্য তা বাধ্যতামূলক করা হয়নি। ঘরে যা থাকত নবীজি তাই দান করে দিতেন। অথচ আমাদের জন্য সম্পদের একতৃতীয়াংশের বেশি দান করার অনুমতি নেই। তো নবীজি রাতে এই পরিমাণ আমল করতেন যা আমাদের জন্য কল্পনা করাও সম্ভব নয়। হজরত আনাস বিন মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,
أنَّه كانَ يقومُ حتّى تَورَّمَ قدماهُ، فقيلَ لَهُ: أتفعلُ ذلِكَ؟ وقد غفرَ اللَّهُ لَكَ ما تقدَّمَ من ذنبِكَ وما تأخَّرَ؟ قالَ: أفلا أَكونُ عبدًا شَكورًا
‘নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এত বেশি নামাজ পড়তেন যে, তার দুই পা ফুলে যেত। তাকে বলা হতো, আল্লাহ তাআলা তো আপনার পূর্বাপর সকল গুনাহ মাফ করে দিয়েছেন। তার পরও আপনি নিজেকে এত কষ্ট দিচ্ছেন কেন? নবীজি বলতেন, আমি কি শুকরগুজার বান্দা হব না’? (১০)
গারে হেরা থেকে গারে সাওর
নবুওতপূর্ব সময়ে পৃথিবীর অবস্থা খুব ভালো ছিল না। মানুষ এবং সমাজের এহেন শোচনীয় অবস্থা নবীজির কোমল হৃদয়ে প্রগাঢ় বেদনা তৈরি করত। এসব চতুর্মাত্রিক সমস্যার সমাধান কল্পে নবীজি গারে হেরায় ধ্যান করতেন, নিজের মতোকের সবকিছু নিয়ে ভাবতেন, একান্ত নির্জনতায় সময় কাটাতেন। গারে হেরার অবস্থান সম্পর্কে কুরাইশদের খুব কম লোকই অবগত ছিল। নবীজির দাদা আব্দুল মুত্তালিব সেখানে প্রায়শ ইবাদতের জন্য যেতেন। লোক সমাগম থেকে দূরে পাহাড়চূড়ার সে জায়গাটি ইবাদত-বন্দিগির খুবই উপযোগী ছিল।
তো ওহি নাজিলের কিছুকাল পূর্বে থেকে নবীজি গারে হেরায় নিয়মিত যাতায়াত করতেন। কয়েকদিনের খাবার নিয়ে যেতেন। একান্ত মনে ধ্যান করতেন। খাবার শেষ হলে খাদিজা রাদিয়াআল্লাহু আনহুর কাছে আসতেন। খাবার নিয়ে আবার ফিরে যেতেন। এভাবেই একদিন হজরত জিবরাইল আলাইহিস সালাম ওহির আলোসমেত হেরা গুহায় আগমন করেন।
বুখারি শরিফে হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহুর বর্ণনায় এসেছে,
أول ما بدئ به رسول الله صلّى الله عليه وسلم الرؤيا الصالحة في النوم، فكان لا يرى رؤيا إلّا جاءت مثل فلق الصبح، ثم حبب إليه الخلاء وكان يخلو بغار حراء فيتحنث فيه الليالي ذوات العدد قبل أن ينزع إلى أهله ويتزود لذلك ثم يرجع إلى خديجة فيتزود لمثلها، حتى جاءه الحق وهو في غار حراء
‘নবীজির প্রতি ওহির সূচনা হয়, নিদ্রায় স্বপ্নের মাধ্যমে। তিনি যা-ই স্বপ্ন দেখতেন, তা-ই প্রভাতের আলোর মতো বাস্তব হয়ে যেত। এরপর তার কাছে নির্জনতা প্রিয় হতে লাগল। নবীজি হেরা গুহায় থাকতে লাগলেন। খাবার শেষ হয়ে গেলে পুনরায় খাবার নেওয়া ছাড়া লাগাতার তিনি হেরা গুহায় ইবাদত-বন্দেগিতে মগ্ন থাকতে লাগলেন। এভাবে খাবার শেষ হয়ে গেলে হজরত খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহুর কাছ থেকে আবার এসে খাবার নিয়ে যেতেন। এভাবে ওহি যখন নাজিল হয়, তখন নবীজি হেরা গুহাতেই ছিলেন।’ (১১)
নবীজি কর্তৃক আলোকিত করা দ্বিতীয় গুহাটি হলো গারে সাউর। হিজরতের সময় আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই গুহায় তিন দিন অবস্থান করেন। কাফেররা তখন চারদিকে নবীজিকে হন্য হয়ে খুঁজছিল। এক পর্যায়ে তারা গুহার খুব কাছে চলে আসে, তখন আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু ভয়ে পেয়ে বলেন, ‘এখন তো আমরা ধরা পড়ে যাব।’ নবীজি তখন বললেন, ‘ভয় পেয়ো না; আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন।’ (১২) আল্লাহ তাআলার প্রতি এই বর্ণনাতীত আস্থা, ভাষাতীত ভরসা এবং অপার্থিব আনুগত্য নবীজিকে সকলের মাঝে আলাদা করে রাখত। নীরবে-সরবে তার যাপিত জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ছিল একান্তই আল্লাহ তাআলার প্রতি নিবেদিত।
নীরবতাবিষয়ক হাদিস
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকেও নীরবতার তালিম দিতেন। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত,
من صمَت نجا
‘চুপ থাকে যে, মুক্তি পায় সে’। (১৩)
হজরত আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত অপর একটি হাদিসে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
مِنْ حُسْنِ إسلامِ المرءِ تَرْكُهُ ما لا يَعْنِيهِ
অনর্থক কথা ও কাজ পরিহার করাই ইসলামের সৌন্দর্য। (১৪)
হজরত আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহুর সূত্রে বর্ণিত আছে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
وَمَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ فَلْيَقُلْ خَيْرًا أَوْ لِيَصْمُتْ
‘যে আল্লাহ এবং আখেরাতে বিশ্বাস করে, সে যেন ভালো কিছু বলে নতুবা চুপ থাকে। ’ (১৫)
হজরত আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
إِذَا رَأَيْتُمُ الْعَبْدَ يُعْطَى زُهْدًا فِي الدُّنْيَا وَقِلَّةَ مَنْطِقٍ، فَاقْتَرِبُوا مِنْهُ، فَإِنَّهُ يُلْقِي الْحِكْمَةَ
‘দুনিয়াবিমুখ স্বল্পবাক মণীষীদের সোহবতে থেকো; কারণ তাদের কাছে রয়েছে আল্লাহপ্রদত্ত প্রজ্ঞা। ’ (১৬)
হজরত আহনাফ ইবনে কায়েস রহমাতুল্লাহি আলাইহি থেকে বর্ণিত হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আরহু বলেন,
مَنْ كَثُرَ ضَحِكُهُ قَلَّتْ هَيْبَتُهُ، وَمَنْ كَثُرَ مِزَاحُهُ اسْتُخِفَّ بِهِ، وَمَنْ أَكْثَرَ مِنْ شَيْءٍ عُرِفَ بِهِ، وَمَنْ كَثُرَ كَلَامُهُ كَثُرَ سَقَطُهُ، وَمَنْ كَثُرَ سَقَطُهُ قَلَّ حَيَاؤُهُ، وَمَنْ قَلَّ حَيَاؤُهُ قَلَّ وَرَعُهُ، وَمَنْ قَلَّ وَرَعُهُ مَاتَ قَلْبُهُ
বেশি হাসলে গাম্ভীর্য আর বেশি রসিকতায় প্রভাব কমে। যে যেই কাজ বেশি করে, সে সেই কাজেই সমাজে পরিচিত হয়। যে বেশি কথা বলে তার ভুলও হয় বেশি। যে বেশি ভুল করে, তার লজ্জা কমে যায়। যার লজ্জা কমে যায়, তার আল্লাহভীতি হ্রাস পায় আর যার আল্লাহভীতি হ্রাস পায়, তার হৃদয় মরে যায়। ’(১৭)
এই জন্য নীরবতার চেয়ে আমাদের বক্তব্য জোরালো না হলে, আমাদের উচিত নীরব থাকা। জবান খোলার আগে অজ্ঞতা ও বিজ্ঞতা উভয়ই আড়ালে থাকে। কিন্তু মুখ খোলার সাথে সাথেই আমাদের বক্তব্যের মাধ্যমে আমাদের অবস্থান নির্ণিত হয়। অধিক কথা অধিক বিপদের কারণ। তাই কথাবার্তায় আমাদের সবিশেষ সতর্কতা কাম্য।
মাওলানা রুমি বলেন, নীরবতা হচ্ছে আল্লাহর ভাষা; বাকিসব তার দুর্বল অনুবাদ।
আল্লামা ইকবাল বলেন,
خدا اگر دلِ فطرت شناس دے تجھکو
سکوتِ لالہ وگل سے کلام پیدا کر
❝প্রকৃতির রহস্য অনুধাবনের মতো হৃদয়ের অধিকারী হলে, ফুলের নীরবতার মতো বক্তব্য তৈরি করো❞
তথ্যসূত্র:
১. তাফসিরে মারেফুল কুরআন
২. সুনানে তিরমিজি, হাদিস নং ২৮৫০
৩. শামায়েলে তিরমিজি, হাদিস নং ২৬৩
৪. সুনানে ইবনে মাজা, হাদিস নং ১৯৭৭
৫. সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৪৪৮০
৬. সুনানে ইবনে মাজা, হাদিস নং ৩০১
৭. সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ২৮১৪
৮. সুরা মুজজাম্মিল, আয়াত: ০৬
৯. নাইলুল আওতার তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬৮
১০. আল বাজ্জার, ২৯২
১১. সহিহ বুখারি, হাদিস নং ০৩, সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ১৬০
১২. সুরা তাওবা, আয়াত: ৪০
১৩. সুনানে তিরমিজি, হাদিস নং ২৫০১
১৪. সুনানে তিরমিজি, হাদিস নং ২৩১৮
১৫. সহিহ বুখারি, হাদিস নং ৬১২০
১৬. বাইহাকি, হাদিস নং ৪৭৫৯
১৭. তাবরানি, হাদিস নং ২২৯৯; বাইহাকি, হাদিস নং ৪৭৬৮
Comments 1