ইসলামে বিদআত কেন ঘৃণিত ও পরিত্যাজ্য : একটি দালিলিক আলোচনা
বিদআত ও একট প্রশ্ন
ইসলামের যে কোন আমল ও পুণ্যের কাজ আল্লাহ তাআলার নিকট গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য দুটি প্রধান শর্ত রয়েছে। এক. কাজটি সম্পাদিত হতে হবে একমাত্র আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে। দুই. আমলটি করতে হবে একমাত্র নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দেখানো পথ ও পন্থা অনুযায়ী। (ইবনু কাসীর, সূরা বাকারা, ১১২ নং আয়াত)। এজন্য কোরআন ও হাদিসে নবীজির সুন্নাহ তথা তাঁর অনুসৃত ও দেখানো পথকে আঁকড়ে ধরার জোরালো নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এবং বলা হয়েছে দুনিয়ার সফলতা ও পরকালীন মুক্তির জন্য এটিই একমাত্র পথ। এর পাশাপাশি সুন্নত এর বিপরীত বিদআত সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে বার বার। বিভিন্ন হাদিসে বিদাতকে আখ্যায়িত করা হয়েছে সবচেয়ে নিকৃষ্ট কর্ম, ভ্রষ্টতা ও প্রত্যাখ্যাত বিষয় হিসেবে।
বিদআতে আক্রান্ত ব্যক্তির প্রতি উচ্চারণ করা হয়েছে কঠোর সাবধান বাণী। এজন্য আমরা দেখি সাহাবায়ে কেরাম, যারা উম্মতে মুসলিমার মধ্যে তাকওয়া, পরহেজগারি ও ইলমের গভীরতায় সব চেয়ে অগ্রগামী ছিলেন, তাদের কাছে বিদআত ছিল সবচেয়ে ঘৃণ্য ও নিকৃষ্ট বিষয়।(তিরমিজি : ২৪৪)
ইসলামের ইতিহাসে সব সময় হকপন্থি আলেম বিদআতের প্রতি কঠোর ও আপোষহীন ছিলেন, এবং বিদা’আতকে রুখে দাঁড়ানোর জন্য তারা নিজেদের সর্বোচ্চ কোরবানি করেছেন।
এখানে গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন তৈরী হয়—বিদআত শরীয়তে এতোটা ঘৃণিত কেন?
এ রচনায় আমরা সে রহস্যটিই উদ্ঘাটনের চেষ্টা করব।
বিদআত ঘৃণিত হওয়ার কারণসমূহ
১. আল্লাহ তাআলার সমকক্ষতা
বিদআতের মূল পরিচয় হলো—কোনো বিশ্বাস, কথা বা কাজকে দ্বীনের অংশ মনে করে সওয়াবের আশায় সম্পাদন করা। অপরদিকে এই বিষয়টি—অর্থাৎ কোন কাজটি দ্বীনের অংশ, কোন কাজ করলে সওয়াব হয়, এবং কী কী বিষয় বর্জন করতে হবে, এ সবকিছু নির্ধারণ করে দেওয়ার অধিকার ও ক্ষমতা একচ্ছত্র অধিপতি হলেন একমাত্র আল্লাহ তাআলা। তিনি ছাড়া আর কারো এ ক্ষমতা নেই। (সূরা ইউসুফ : ৪০, সূরা আরাফ : ৪০)
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দায়িত্ব হচ্ছে আল্লাহর পক্ষ হতে ওহী প্রাপ্ত হয়ে উম্মতকে সেসকল বিষয় জানিয়ে দেওয়া। (মায়েদা :৯২) তিনি তা জানিয়েছেনও, কখনো সরাসরি কুরআনের আয়াত হিসেবে, কখনো হাদীসের মাধ্যমে। কিন্তু বিদআতে আক্রান্ত ব্যক্তি যখন দীন বহির্ভূত কোন কাজকে দ্বীনের অংশ মনে করছে, তখন তিনি সরাসরি মহান আল্লাহর সে অধিকার ও ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করছেন। যদিও বিদাতে জড়িত কোন ব্যক্তি নিজেকে এই ধৃষ্টতার জায়গায় দেখতে চাইবে না, কিন্তু বাস্তবতা হলো, ইসলামের ভিতরে মনগড়া একটি বিষয় পালন করার দ্বারা তিনি নিজেকে মূলত সে জায়গাটিতেই নিয়ে যান। বড় ভয়াবহ এই পদক্ষেপ।
২. নববী পথ থেকে দূরে সরে যাওয়া :
বিদআতের কদর্যতার একটি দিক হচ্ছে এর অন্ধকার মানুষকে সুন্নতের নূর থেকে বঞ্চিত করে। বিদআত পালনে মগ্ন ব্যক্তি নব আবিস্কৃত এসব আমলের ব্যাপারে যতটা ব্যস্ত ও সজাগ থাকে, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত পালন ও অনুসরণে ততটা নয়। এটি মানুষের একটি স্বভাবজাত প্রবণতা। কোন বিশেষ জিনিসের প্রতি যখন সে বিশেষ মনোযোগ দিয়ে দেয়, তখন অন্যান্য বিষয় তার কাছে গৌণ হয়ে যায়।
এ বিষয়ে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি হাদীস আছে। তিনি বলেন, যে সম্প্রদায় দীনের মধ্যে নতুন কোন নিয়ম আবিষ্কার করবে, তাদের থেকে এর অনুরূপ সুন্নতকে উঠিয়ে নেওয়া হবে। সুতরাং বিদআত তৈরি করার চেয়ে সুন্নতকে আঁকড়ে ধরাই কল্যাণকর (মুসনাদে আহমদ : ১৭০৯৫)।
৩. তওবা থেকে বঞ্চিত হওয়া :
শরীয়তে নিষিদ্ধ অন্যান্য পাপের সাথে বিদআতের একটি বিশেষ পার্থক্য রয়েছে। কোন মানুষ কখনো যদি নিষিদ্ধ কিছু করে ফেলে, সেটি সে অন্যায় মনে করেই করে; ফলে তার ভেতরে এ থেকে তওবা করার প্রেরণা কাজ করে, এবং এ প্রেরণা থেকে সে তওবা করেও বটে; কিন্তু বিদা’আতে জড়িত ব্যক্তি তার পালিত বিদ’আতকে নিষিদ্ধ ও অবৈধ মনে করে না। উল্টো সোয়াবের কাজ হিসেবে যত্ন ও গর্বের সাথে পালন করে। ফলে সাধারণত দেখা যায় অন্যান্য পাপ থেকে সে তওবা করলেও এসব থেকে তওবা করার কথা কল্পনাও করে না। হযরত আনাস ইবনে মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণিত একটি হাদিসে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ব্যাপারটি চিহ্নিত করে দিয়ে বলেছেন, আল্লাহ তাআলা বিধাতা আক্রান্ত ব্যক্তি ও তওবার মধ্যে অন্তরায় সৃষ্টি করে দেন (হাইতামিকৃত মাজমাউজ জাওয়াইদ : ১০/১৯২)
৪. দীন অপূর্ণ হওয়ার অভিযোগ করা :
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর আল্লাহ তাআলা দীর্ঘ ২৩ বছর যাবৎ ওহীর মাধ্যমে প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন বিধান অবতীর্ণ করেছেন। অবশেষে দশম হিজরির জিলহজ মাসে বিদায় হজের সময় আল্লাহ তা’আলা এই দীন পরিপূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ হওয়ার কথা ঘোষণা করেন। অর্থাৎ, আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের যত উপায় ও পদ্ধতি আছে, সবকিছুর বিবরণ কুরআন ও হাদিসে বর্ণনা করে সম্পূর্ণ করে দেওয়া হয়েছে। এখন কেউ নতুন কিছু যোগ করতে চায়, এর অর্থ হলো—এ ব্যাক্তি যেন দীন অসমাপ্ত ও অপূর্ণাঙ্গ হওয়ার অভিযোগ তুলছে।
অথবা বলতে চাচ্ছে—আল্লাহ তো আপন দীনকে পূর্ণাঙ্গ করেছিলেন ঠিক, কিন্তু নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নতুন আবিস্কৃত এই বিষয়গুলো উম্মতকে না জানিয়ে গোপন করে রেখেছেন। নাউজুবিল্লাহ। হিজরতের পূণ্যভূমি মদিনা মুনাওয়ারার প্রখ্যাত ফকীহ ইমাম মালেক রহ. পরিস্কার শব্দে ঠিক এ কথাটিই বলেছেন। তিনি বলেন, যে ব্যক্তি ইসলামের মধ্যে সওয়াবের কাজ মনে করে কোন বিদআতকে আবিষ্কার করবে, তাহলে এর মাধ্যমে সে এই দাবি করছে যে, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রিসালাতের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে যাননি। কেননা আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারীমে পরিস্কার ঘোষণা করেছেন—আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণ করে দিয়েছি’। তো, চূড়ান্ত কথা এটিই—নবীজির যুগে যে বিষয়টি দীন ও ইসলামের অন্তর্ভুক্ত ছিল না, আজকেও তা দীনের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি পাবে না (আল ইতিসাম : ১/৪৯)।
৫. দীন বিকৃতি :
কুরআনুল কারীমে দীন কীভাবে বিকৃত হয়, এর মোলিক দুটি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। একটি হলো—বিভিন্ন স্বার্থে সত্যকে গোপন করা, অপরটি হলো—নানা কারণে সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশিয়ে ফেলা। বিদআতের মধ্যে এই দ্বিতীয় কারণটি পরিপূর্ণরূপে বিদ্যমান। বিদআতের কদর্যতার এটি হলো আরেকটি বিশেষ দিক। এখানেও বিদআতে লিপ্ত ব্যক্তি দীনের পালনীয় সত্য বিষয়ের সাথে নব আবিস্কৃত পরিত্যাজ্য বিষয়গুলোকে একই সমতলে এনে দাঁড় করায়। ফলে এর মাধ্যমে দীন তার আপন রূপটি হারাতে থাকে। বিকৃতি ও বিশৃঙ্খলা তৈরী হয় এবং দীনের মূল কাঠামোটি নষ্ট হয়ে যায়। ফলে, এক সময় গিয়ে আর টের পাওয়া যায় না কোনটি আসল দীন আর কোনটি পরবর্তীতে আবিস্কৃত বিদআত।
ইহুদি খ্রিস্টানরা নবী-রাসূলগণের আনীত সত্যধর্ম থেকে এতোটা দূরে সরে গেল কীভাবে? এমন যে, একদম চেনই যায় না। এটা এক দুই দিনে হয়নি। হয়েছে অল্প করে, নতুন বিষয়গুলোকে একটু একটু করে যোগ করে। এভাবে একসময় গিয়ে দেখা গেল তারা কুফর ও শিরক পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। এর মূলে ছিল এই বিদআত ও মনগড়া সংজোযন বিয়োজনের প্রবণতা।
৬. উম্মতের মধ্যে অনক্য তৈরী হওয়া :
কুরআন ও হাদীসে বারবার মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এটা ইসলামের মোলিক একটি নির্দেশনা। এটি একদমই স্বতঃসিদ্ধ একটি বিষয়। এমন যে, আলাদা করে আয়াত হাদীস দিয়ে প্রমাণ করার কিছু নেই। মুসলিমমাত্রই অবগত আছেন। এই ঐক্য কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে এবং টিকে থাকবে, সে পদ্ধতিও কুরআন হাদীসে দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে। তা হলো—আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে পথ ও পদ্ধতি নিয়ে এসেছেন, এর পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ করা। এর জন্য বিশেষভাবে দেখা যেতে পারে সূরা শূরা, আয়াত নং ১৩, এবং সূরা আনআম, আয়াত নং ১৫৩। ফলে, উম্মতের মধ্যে যত বেশি বিদআত সৃষ্টি হবে, তত বেশি অনৈক্য তৈরী হবে। এর বাস্তব প্রমাণ আমরা আমাদের সমাজে অহরহ দেখছি।
এখানে মুসনাদে আহমদে বর্ণিত একটি হাদিস খুবই প্রাসঙ্গিক। প্রখ্যাত সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বর্ণনা করেন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার মাটির উপর নিজ হাতে একটি সরল রেখা টেনে বললেন বললেন এটি আল্লাহর সরল পথ। এরপর রেখাটির ডানে-বাঁয়ে আরো কয়েকটা দাগ টেনে বললেন, এই প্রত্যেকটি পথে একজন করে শয়তান রয়েছে এবং আপন পথটির দিকে মানুষকে ডাকছে। অতঃপর তিনি পাঠ করলেন : وان هذا صراطي مستقيما فاتبعوه
অর্থ : আর, এই হলো আমার সরল পথ। সুতরাং তোমরা তা অনুসরণ করো।
(মুসনাদে আহমদ : ৪৪৩৭)
বিদআত ঘৃণিত ও নিন্দনীয় হওয়ার আরো কিছু কারণ বিজ্ঞ আলেমগণ তুলে ধরেছেন; কিন্তু সংক্ষিপ্ত এই পরিসরে আমরা কেবল ছয়টি বিষয় আলোচনা করলাম। এই ছয়টি বিষয়ের প্রত্যেকটির দিকে যদি আলাদাভাবে নজর দেওয়া হয়, তাহলে দেখা যাবে বিদআত নিন্দনীয় ও পরিত্যাজ্য হওয়ার জন্য যে কোন একটি কারণই যথেষ্ট। ভয়ংকর হওয়ার দিক থেকে প্রতিটিই পূর্ণাঙ্গ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ। সে জায়গায় সবগুলো যখন একসাথে এসে বিদআতের মধ্যে একত্রিত হয়েছে, তখন বিদআত কত ভয়ংকর। এ কারণে বিদআতকে অত্যন্ত কঠোরভাষায় বর্জন করা হয়েছে। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুবই প্রশিদ্ধ একটি হাদীসে বলেছেন, যে আমাদের এই দীনের মধ্যে নতুন কিছু সংযোজন করবে, সে আমাদের দলভুক্ত নয়। আল্লাহ আমারেদকে হেফাজত করুন।