তাবেঈ রাবী ইবনে খুসাইম:
একজন আলোকিত মানুষের আলোকিত জীবন
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা:) ফুরাত নদীর তীর ঘেঁসে হাঁটছেন। সাথে ছিলেন তাঁর কয়েকজন সাথী। অদূরে থাকা চুনের ফ্যাক্টরিতে কয়েকজন শ্রমিক কর্মরত। ফ্যাক্টরির চুল্লিতে তারা আগুন জ্বালানোর জন্য থেমে থেমে পাথর নিক্ষেপ করছে। ফলে নিভে যাওয়া আগুন আবার দাউ দাউ করে জ্বলে উঠছে। এ দৃশ্য দেখে জাহান্নামের স্মরণে তাঁরা থমকে দাঁড়ান। কাফেলার এক সদস্য কাঁপতে শুরু করেন। আগুন জ্বলতে থাকার এ দৃশ্য তার মাঝে জাগিয়ে তোলে জাহান্নামের ভীতিকর চেহারা। তিনি কোরআনের আয়াত তেলাওয়াত করতে শুরু করেন,
[দূর থেকে জাহান্নাম যখন কাফিরদের দেখতে পাবে — যারা কিয়ামতকে অস্বীকার করেছিল — কাফিররা তখন জাহান্নামের ক্রুদ্ধ গর্জন ও চিৎকার শুনতে পাবে। আর যখন কাফিরদেরকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে জাহান্নামের সংকীর্ণ স্থানে নিক্ষেপ করা হবে, কাফিররা তখন কেবলই নিশ্চিহ্ন হওয়া কামনা করবে।]। [১]
আয়াত তেলাওয়াত শেষ হতে না হতেই তিনি বেহুঁশ হয়ে জমিনে পড়ে যান। সাথে থাকা বিশিষ্ট তাবেয়ী আবু ওয়ায়িল রাহি. বলেন, তিনি ছিলেন রাবী বিন খুসাইম রাহি.। আমরা তাঁকে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করি এবং তাঁকে বাড়িতে নিয়ে আসি। [২]
তিনি ছিলেন দুনিয়াত্যাগী বিশিষ্ট আট তাবেয়ীর অন্যতম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগ লাভ করা সত্ত্বেও যাঁরা সাহাবি ছিলেন না, তিনি তাঁদের একজন। [৩]
মায়ের কোল থেকেই তিনি ইবাদত বন্দেগীর পরিবেশে বেড়ে উঠেন। রাতে সবাই ঘুমিয়ে গেলে কিশোর রাবী এর মা দেখতেন, ছেলে বিছানা ছেড়ে জায়নামাযে দাঁড়িয়ে আছে। কখনো সে মুনাজাতে অশ্রু ঝরাচ্ছে আর কখনো নামাযে নিমগ্ন।
তিনি কোমল কণ্ঠে ছেলেকে ডেকে বলতেন, ‘হে প্রিয় সন্তান, তুমি কি ঘুমাওনি?’ রাবী বলতেন, ‘যে শত্রুর আক্রমণের আশঙ্কায় থাকে, কিভাবে তার ঘুম আসতে পারে?’ উত্তর শুনে বৃদ্ধা মা কেবল অশ্রুবর্ষণ করতেন আর প্রিয় সন্তানের জন্য কল্যাণের দোয়া করতেন।
রাবী (র:) যখন টগবগে যুবক, তাঁর ইবাদত আর আল্লাহভীতিও তখন যৌবন লাভ করলো। রাত নীরব হলে যখন সবাই বিছানায় চলে যেতো, তখন যুবক রাবীর কান্না আর রোনাজারি মায়ের মনকে আরো অস্থির করে তুলতো। এমনকি বিভিন্ন অশুভ চিন্তাও মায়ের মনে উঁকিঝুকি দেয়া শুরু করলো। একসময় থাকতে না পেরে তিনি ছেলেকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বাবা, তোমার কী হয়েছে? তুমি কি বড় কোনো পাপ করে ফেলেছ? তুমি কি কাউকে হত্যা করেছ?’
রাবি উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ, মা, আমি একজনকে হত্যা করেছি।
তিনি আক্ষেপ করে বললেন, ‘তুমি কাকে হত্যা করেছ? আশা করি, আমরা তার পরিবারের কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইলে তারা তোমাকে ক্ষমা করে দেবে। আল্লাহর শপথ! তারা যদি তোমার অঝোর কান্না আর রাত্রি জাগরণ সম্পর্কে জানতে পারে, তাহলে অবশ্যই তোমাকে ক্ষমা করে দেবে।’
রাবি বললেন, ‘না, মা, তুমি কাউকে বলো না। আমি তো নিজেকেই নিজে হত্যা করেছি। আমি নিজেকে গুনাহ করে করে শেষ করে দিয়েছি।’[৪]
রাবী ইবনে খুসাইম (রা:) ছিলেন বিশিষ্ট ফকীহ সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা:) এর শিষ্য, যিনি ছিলেন স্বভাব চরিত্রে, আচরণ আর প্রকৃতিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সবচেয়ে সাদৃশ্যপূর্ণ সাহাবী। তিনি উস্তাদের সাথে এমনভাবে জড়িয়ে থাকতেন, যেমন দুগ্ধপোষ্য শিশু মায়ের সাথে জড়িয়ে থাকে। অপরদিকে উস্তাদও ছাত্রকে এমন ভালবাসতেন, যেমন একজন বাবা তার সন্তানকে ভালবাসে। রাবী’র জন্য ইবনে মাসউদ (রা:) এর হুজরা সর্বদা উন্মুক্ত ছিল। যতক্ষণ তিনি উস্তাদের সাথে থাকতেন অন্য কারো সেখানে প্রবেশাধিকার থাকতো না। [৫]
ইবনে মাসউদ রাযি. এর মত বিশিষ্ট সাহাবী রাবী রহ. এর প্রশংসা করে স্বীকৃতি দিতেন অকুণ্ঠচিত্তে। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি. সম্পর্কে একটি হাদীস উল্লেখ করার লোভ আমি কখনোই নিবৃত্ত করতে পারি না। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমার উম্মতের জন্যে আমি সে আমল পছন্দ করলাম যে আমল ইবনে উম্মে আবদ তথা ইবনে মাসউদ পছন্দ করবে। [৬]
তাঁর মত মহান সাহাবী প্রশংসা করতেন রাবী রাহি. এর। তিনি রাবী রাহি. এর পরিচ্ছন্ন ব্যক্তিত্ব, নিষ্কলুষ অন্তর আর ইবাদাতের একনিষ্ঠতা দেখে আফসোস করতেন আর বলতেন: ‘হে আবু ইয়াযিদ! যদি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাকে দেখতেন, তবে অবশ্যই তোমাকে ভালোবাসতেন। আমি তোমাকে যতবার দেখেছি, আমার কোরআনে বর্ণিত[৭] বিনয়ীদের কথা মনে পড়েছে।’[৮]
রাবী ইবনে খুসাইম (র:) রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সংস্রব গ্রহণ করতে সক্ষম হননি। কিন্তু তিনি আলিম সাহাবীদের বড় অংশের কাছ থেকেই ইলম অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সাহাবীগণের মাঝে বিশেষভাবে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি., আবু আইয়ুব আনসারী রাযি. ও আমর ইবনে মায়মুন রাযি. এর কাছ থেকে তিনি ইলম অর্জন করেন। তাঁর ছাত্রদের মাঝে উল্লেখযোগ্য হলেন শা’বী, ইবরাহীম নাখায়ী, হিলাল বিন ইয়াসাফ, মুনযির আস-সাওরী (র:)। হাদীস শাস্ত্রের মহান দিকপাল ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে মাঈন ছিলেন তাঁর ছাত্র। [৯] তাঁর আরেক ছাত্র ইমাম শা’বি বলেন: রাবীর বর্ণনা কেমন জানতে চাও? রাবী হচ্ছেন সত্যবাদিতার ভাণ্ডার।[১০]
রাবী (র:) ছিলেন আল্লাহভীতিতে পরিপূর্ণ সতর্ক ব্যক্তিত্ব। প্রতিবেশীদের যারা তাকে দীর্ঘ সময় দেখেছেন, তারা বলেছেন, আমরা তাকে কখনো এমন কথা বলতে শুনিনি, যা নিয়ে তার বদনাম করা যায়। বরং তিনি তো সর্বদা এমন কথা বলতেন, যা আমলনামায় নেক হিসেবে গণ্য করা হয়।
তিনি কোরআন, হাদীস ও ফিকহসহ একাধিক ইলম ও শাস্ত্রে ছিলেন পারদর্শী ব্যক্তিত্ব। তবে তাঁর জীবন ছিল কোরআন নির্ভর। সালাফের মধ্যে কুরআনের প্রতি তীব্র প্রেম ও অন্তরঙ্গতার তিনি ছিলেন এক বিস্ময়কর নমুনা। তিনি অনেক বেশি কোরআন তিলাওয়াত করতেন। এমনকি কখনো কখনো এক আয়াত বা কয়েক আয়াত তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে রাত কাটিয়ে দিতেন।
একারণে তাঁর নসীহতের একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে কুরআনে কারীম। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ইবনে সা’দ (র:) (২৩০হি.) এমনই এক নসীহত উল্লেখ করেন। রাবী ইবনে খুসাইম রাহি. বলেন, ‘হে আল্লাহর বান্দা! সবসময় ভালো কথা বলবে, ভালো কাজ করবে, ভালো স্বভাবের উপর থাকবে, নিজের জীবনকালকে দীর্ঘ মনে করবে না, নিজের অন্তরকে কঠিন করে তুলবে না এবং সেইসব লোকদের মতো হবে না, যারা বলে আমরা শুনছি, অথচ তারা শোনে না। আল্লাহ তা’আলা বলেন, [অনুবাদ] তোমরা তাদের মতো হয়ো না; যারা বলে আমরা শুনেছি, অথচ তারা শোনার মত শোনে না।’ [১১]
‘হে আল্লাহর বান্দা! যদি তুমি ভালো কাজ করো; তাহলে তা করতে থাকো। কেননা, শীঘ্রই এমন দিন আসবে যখন তুমি বলবে, হায়! যদি এই ভালো ভালো কাজ আরও বেশী করতে পারতাম। যদি তুমি অতীতে খারাপ কাজের সাথে জড়িত থাকো; তাতেও সমস্যা নেই। তুমি ভালো কাজ করতে শুরু করো। কেননা আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, [অনুবাদ] ভালো কাজ মন্দ কাজকে দূর করে দেয়। আর এ হলো উপদেশ গ্রহণকারীদের জন্য উপদেশ।’ [১২]
‘হে আল্লাহর বান্দারা, আল্লাহ তা’আলা কোরআন মাজীদের মাধ্যমে তোমাদের যে জ্ঞান দান করেছেন, সে জন্য তোমারা আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো। তাঁর প্রশংসা করো। আর যা কিছুর জ্ঞান তিনি তোমাদেরকে দেননি; তা আল্লাহর কাছে সোপর্দ করে দেও। কোনো কৃত্রিমতার আশ্রয় গ্রহণ করো না। কেননা আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, [অনুবাদ] হে নাবী! আপনি বলুন, আমি সত্য প্রকাশের জন্য কোনোরূপ প্রতিদান চাই না। আর আমি কৃত্রিমতার আশ্রয় গ্রহণকারীদের দলভুক্ত নই। নিশ্চয়ই এই কোরআন বিশ্বজগতের জন্য উপদেশ। আর এমন এক সময় আসবে যখন তার প্রকৃত অবস্থা অবশ্যই তোমরা জানবে।[১৩]
‘হে আল্লাহর বান্দা! জেনো রাখ, মানুষের অনুপস্থিতি যখন দীর্ঘ হয় আর তার প্রত্যাবর্তনের সময় নিকটবর্তী হয় তখন পরিবার তার জন্য এমনভাবে অপেক্ষা করে যেন সে চলে এসেছে। সুতরাং তোমরা মৃত্যুকে এমনভাবে স্মরণ করো যার স্বাদ ইতিপূর্বে আস্বাদন করোনি। আর তোমাদের গোপন কাজগুলোকে ভয় করো, যেগুলো মানুষের নিকট অপ্রকাশিত কিন্তু আল্লাহ তা’আলার নিকট প্রকাশিত।’ [১৪]
রাবী ইবনে খুসাইম (র:) এর একটি অন্যতম গুণ হচ্ছে, তিনি অত্যন্ত শান্ত স্বভাবের অধিকারী ছিলেন। আখেরাত নিয়ে সদা চিন্তিত থাকতেন। কখনো কাউকে বকাঝকা বা কারো সম্পর্কে গালমন্দ করতেন না। এমনকি প্রকাশ্য গুনাহগার সম্পর্কেও নিজ যবানের হিফাজত করতেন।
একবার তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো, আপনি মন্দ কারো বিষয়ে কেন কখনো কোন খারাপ কিছু বলেন না? তিনি বললেন, ‘আল্লাহর শপথ! আমি তো নিজের বিষয়ে নিশ্চিত নই। অন্যকে খারাপ বলবো কীভাবে? মানুষের অবস্থা তো এই— সে অন্যের পাপের বিষয়ে আল্লাহকে ভয় করে; কিন্তু নিজেকে পাপের শাস্তি থেকে নিরাপদ মনে করে।’ [১৫]
রাবী (র:) সর্বদা জামাতের সাথে সালাত আদায় করতেন। জীবনের শেষদিকে তিনি যখন বয়সের কারণে অনেক অসুস্থ হয়ে পড়েন তখনও তিনি জামাত ছাড়তেন না। আবু হাইয়্যান (র:) তাঁর পিতা রাবী সম্পর্কে বলেন, আব্বা রোগাক্রান্ত হয়ে পঙ্গু হয়ে যান। ফলে চলাচলের শক্তি হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু তবুও অন্যের সাহায্য নিয়ে মসজিদে উপস্থিত হতেন। তাঁর অবস্থা দেখে মানুষজন বলতে শুরু করলো, আবু ইয়াযিদ! আপনি তো অসুস্থ। এই অবস্থায় মসজিদে উপস্থিত না হওয়ার সুযোগ তো শরীয়ত দিয়েছে। আব্বা বললেন, حي على الصلاة (নামাজের দিকে আসো) এর আহ্বান শোনার পর যতদূর সম্ভব সাড়া দেওয়া উচিত; হামাগুড়ি দিয়ে হলেও মসজিদে উপস্থিত হওয়া উচিত। [১৬]
মৃত্যুর পূর্বে তিনি উপস্থিত সবার সামনে এই স্বীকৃতি দেন: আমি আমার বিষয়ে আল্লাহকে সাক্ষী হিসাবে গ্রহণ করছি। তিনি তাঁর নেক বান্দাদের সাক্ষ্য ও প্রতিদানের জন্য যথেষ্ট। আমি আল্লাহকে রব হিসেবে, ইসলামকে দীন হিসেবে, রাসূলুল্লাহকে নবী ও রাসূল হিসেবে আর কোরআনকে পথ-প্রদর্শক হিসেবে সন্তুষ্টচিত্তে গ্রহণ করছি। [১৭]
হিজরি পঁয়ষট্টি সালে ইয়াযিদ ইবনে মুয়াবিয়ার খিলাফতকালে কুফা নগরীতে রাবী ইবনে খুসাইম (র:) ইন্তেকাল করেন। [১৮]
সূত্র:
[১] সূরা ফুরকান ২৫:১২
২] হিলয়াতুল আউলিয়া, ২/১১০
[৩] সিফাতুস সফওয়া ২/৩৪
[৪] সুওয়ারুম মিন হায়াতিত তাবিয়ীন ৬০-৬১
[৫] সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৫/১৪৭
[৬] আল মুসতাদরাক লিল হাকিম, ৫৩৮৭
[৭] সূরা হজ্জ ২২:৩৪-৩৫ [আল্লাহ বলেন: তোমাদের প্রভু একজনই। সুতরাং তাঁর নিকটই আত্মসমার্পণ কর। সুসংবাদ বিনয়ীদের জন্য; যাদের হৃদয় আল্লাহর নামের স্মরণে কম্পিত হয়, যারা বিপদ-আপদে ধৈর্য ধারণ করে, নিয়মিত জামাতের সাথে সালাত আদায় করে এবং আমার (আল্লাহর) দেওয়া অর্থ-সম্পদ থেকে ব্যয় করে।]
[৮] সিফাতুস সাফওয়া ২/৩৪
[৯] সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৫/১৪৭
[১০] তাযকিরাতুল হুফফাজ ১/৪৬
[১১] সূরা আনফাল ৮:২১
[১২] সূরা হুদ ১১:১১৪
[১৩] সূরা সোয়াদ ৩৮:৮৬-৮৭
[১৪] আত তাবাকাতুল কুবরা, ৬/১৮৩
[১৫] আত তাবাকাতুল কুবরা ৬/১৮৬
[১৬] সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৪/২৬০
[১৭] আত তাবাকাতুল কুবরা ৬/১৯২
[১৮] তাযকিরাতুল হুফফাজ ১/৪৬