পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ কারা? ‘তাকফিরি’রা। যারা মানুষকে ঈমান থেকে কুফরের দিকে ঠেলে দেয়। এদের ব্যাপারে কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা চায়, তোমরাও অবিশ্বাসী হয়ে যাও, যেভাবে তারা অবিশ্বাসী হয়ে আছে, এতে যেন তোমরা সবাই সমান হয়ে যেতে পারো’। (সুরা নিসা, আয়াত ৮৯)
তারা যে পবিত্রতা সহ্য করতে পারে না, তা-ই শুধু নয়; বরং যারা অশ্লীলতাকে অপছন্দ করে তারা তাদের বিরোধিতা করে। ‘তারা বলে, তোমাদের ভূমি থেকে তাদের বের করে দাও। কারণ, তারা তো এমন মানুষ যারা অতি পবিত্র’। (সুরা আরাফ, আয়াত ৮২)
•
যে লোক মানুষকে কুফরের দিকে ডাকে, তার চেয়ে জঘন্য অপরাধী আর হতে পারে না। কারণ, কেউ যদি কোনো মুসলমানকে হত্যাও করে ফেলে তবু তার এতটা ক্ষতি হতো না। কারণ, মৃত্যুর পর মুসলমান লোকটি জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর হত্যাকারী নিপতিত হবে জাহান্নামে। কিন্তু যদি কেউ কাউকে কাফির বানিয়ে ফেলে, তখন তারা দুনিয়ার বাকি জীবনে হবে লাঞ্চিত আর পরকালে প্রবেশ করবে চিরস্থায়ী জাহান্নামে। এইজন্য আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘ফিতনা হত্যা করার চেয়েও মারাত্মক। (সুরা বাকারা, আয়াত ১২৭)
কারও ঈমান কেড়ে নেওয়া, তার জান কেড়ে নেওয়ার চেয়েও মারাত্মক। যারা মানুষের ঈমান ধ্বংসে ইন্ধন জোগায়, ‘তাকফিরি’ উপাধি তাদের জন্য সবচেয়ে বেশি মানায়।
•
বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এইজন্য আমাদের ঈমান ধ্বংসের জন্য তারা যে কতটা লালায়িত, আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারিমে তা বর্ণনা করেছেন। ইরশাদ হচ্ছে, ‘তোমরা তোমাদের দ্বীন ত্যাগ না করা পর্যন্ত, তারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতেই থাকবে’। (সুরা বাকারা, আয়াত ২১৭)। আল্লাহ তাআলা আমাদের সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ‘আর তোমাদের মধ্যে যারা তাদের দ্বীন থেকে ফিরে যাবে এবং কাফের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে, তাদের কাজসমূহ দুনিয়া ও আখেরাতে নিষ্ফল হয়ে যাবে। তারা হবে জান্নামের অধিবাসী, সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। (সুরা বাকারা, আয়াত ২১৭)
•
মুসলমানদের ঈমান হরণের জন্য তারা যে সব কৌশল অবলম্বন করে, আমরা এখন সেগুলো নিয়ে আলোচনা করব। কিন্তু তার আগে জানা দরকার, মুসলমানদের ঈমান হরণের জন্য কারা সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। যারা বর্তমান পৃথিবী নিয়ন্ত্রণ করছে, মানবতাকে করছে বিপন্ন, মানুষকে করে রেখেছে ক্রীতদাস, আর সমুদয় সম্পদকে করে রেখেছে কুক্ষিগত, তারাই মুসলমানদের বিপক্ষে চূড়ান্ত যুদ্ধে নেমে পড়েছে।
তারা ইসলামকে শত্রু জ্ঞান করে কেন? মুসলমানদের ঈমান তাদের কী ক্ষতি করল? কারণ, তারা জানে তাদের যাবতীয় অনৈতিক কর্মকান্ডের বিপক্ষে ইসলামই একমাত্র বাধা। ইসলামের অনিবার্য উত্থান তাদের ইহজাগতিক ভোগবাদের স্বপ্নকে ধুলিসাৎ করে দেবে। এইজন্য ইসলামের প্রাণশক্তি মুসলমানদের হৃদয় থেকে সমূলে উৎখাত করতে তারা মরিয়া।
অবশ্য মুসলমানদের মধ্যে পশ্চিমা চিন্তায় যারা আক্রান্ত, সেসব তথাকথিত মুসলমানদের তারা আবার খুবই ভালোবাসে। বিশেষত তারা যদি মুসলমানদের মিডিয়া ব্যক্তিত্ব হয়, তাহলে তো আর কথাই নেই। এইসব নামে মাত্র মুসলমানদের মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্স ব্যবহার করে সহজেই তারা তাদের আইডিয়া আমাদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়। তারা প্রথম সুযোগেই মুসলমানদের একেবারে কাফির বানিয়ে ফেলতে চায় না। বরং তারা চায়, তাদের কথা মতো যেন মুসলমানরা চলে, তাদের মনগড়া ইসলামে যেন সবাই দীক্ষিত হয়।
•
এই তাকফিরি গ্রুপগুলোর কমন কর্মপন্থা কী? মোটাদাগে একে দুইটি পয়েন্টে বর্ণনা করা যায়:
১. ইসলামের ব্যাপারে মুসলমানদের বীতশ্রদ্ধ করে তোলা।
২. শিরক-কুফরকে বিভিন্ন মুখরোচক নাম দিয়ে মুসলমানদের কাছে লোভনীয় আকারে উপস্থাপন করা।
ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা আর শিরক-কুফরকে সজ্জিত আকারে উপস্থাপনের নেপথ্যে তারা ইসলাম এবং কুফরের সীমারেখাকে মুসলমানদের জন্য অস্পষ্ট করে তুলতে চায়। বরং তারা কুফরকে ইসলামের চেয়েও উত্তম বলে উপস্থাপন করে। যাতে সহজেই মুসলমান মনের অজান্তেই কুফরকে ইসলামের বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করে এবং ইসলাম ও কুফরের মধ্যকার সত্যিকার পার্থক্য সম্পর্কে বেখবর থাকে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যে আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করে, সে যেন আকাশ থেকে পড়ল আর পাখিরা তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল কিংবা বাতাস তাকে কোনো দূরবর্তী স্থানে নিক্ষেপ করল।’ (সুরা হজ, আয়াত ৩১)
কুরআনে বর্ণিত এসব সতর্কবার্তা সত্ত্বেও তাদের নর্মালাইজের কারণে ধীরে ধীরে ইসলাম থেকে দূরে সরাকে আমাদের কাছে স্বাভাবিকই মনে হবে। মনে হবে, ‘ইটস নো বিগ ডিল। আসলেই হয়তো এতদুভয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। দুটোই সমান। সব পথই আল্লাহর সাথে গিয়ে মিলিত হয়েছে। আমরা যে পথেই যাই না কেন, আল্লাহকে পেলেই তো হলো’। এভাবে কখন যে আমরা ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাব, তা আমরা বুঝতেই পারব না।
•
প্রথমেই আমরা মুসলমানদের হৃদয়ে ইসলামের প্রতি বিতৃষ্ণা তৈরি করতে তারা যেসব মৌলিক কৌশল অবলম্বন করে, সেগুলো থেকে কয়েকটি কৌশল দেখে নিই। কেউ এগুলো নিয়ে বিস্তারিত পড়তে চাইলে, টিকায় দেওয়া রেফারেন্স থেকে পড়তে পারবেন।
যারাই ইসলামের ওপর আক্রমণ করে, ইসলামের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনাই যাদের একমাত্র কাজ, তারা তাদের হাইলাইট করে। তারা যতই বোকা হোক না কেন! মিডিয়ায় তাদের মুক্তচিন্তার প্রতীক, কুসংস্কারের বিপক্ষে বিল্পবী, নারীবাদের অগ্রদূত, প্রাচ্যের আঁধারে প্রতীচ্যের আলোকায়নের মশালবাহী হিসেবে উল্লেখ করে।
যে কোনো তুলনা বা প্রতিতুলনার ক্ষেত্রেই আল্লাহ ও তাঁর রসুলের প্রতি চিরন্তন শত্রুতার সূত্র ধরে, তাদের খুবই তুচ্ছ আকারে উপস্থাপন করে।
যেসব দেশ সরকারের সহায়তায় প্রত্যক্ষভাবে ইসলামকে ব্যঙ্গ করে, সেসব দেশের সাথে তারা তাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করে। এমনকি কিছু মুসলিম রাষ্ট্রও তাদের উষ্ণ সংবর্ধনা দেয়। পরোক্ষভাবে তারা যেন এই বার্তাই দিতে চায় যে, ‘হে মুসলমান, তোমাদের ধর্ম কিছুই নয়; রাজনৈতিক স্বার্থই বেশি জরুরি।
আল্লাহ, নবী-রসুল এবং আসমানি কিতাবসমূহকে ব্যঙ্গ করলে তার কোনো শাস্তির বিধানই নেই। ব্যঙ্গকারীর শাস্তি চাওয়াই বরং ধৃষ্টতা বলে গণ্য হয়। এই অপরাধের শিরোনাম হয়, ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’। অতএব আল্লাহর ও রসুলকে গালি দিলে যেহেতু কারও ক্ষতি হয় না। তাই তার শাস্তিও নেই। তাছাড়া আল্লাহর পবিত্রতা, সার্বভৌমত্ব এবং তাঁর ধর্ম তো তাদের আইনের অংশ নয়। তাই এই অপরাধের কোনো বিচার নেই। কিন্তু কেউ যদি তাদের আইন এবং ক্ষমতা নিয়ে সমালোচনা করে কিংবা তাদের জাতীয় পতাকাকে অপমান করে। তাহলে তাকে কঠোর শাস্তি দিতে মোটেই কালক্ষেপণ করা হয় না।
শরিয়তের বিধানাবলি বিকৃত করা এবং ইসলামের প্রতি সন্দেহ সৃষ্টি করার লক্ষে বিভিন্ন চ্যানেল এবং সোশাল মিডিয়ায় একাউন্ট খোলা হয়। আর এই চ্যানেল এবং একাউন্টগুলো পরিচালিত হয় তাদের অনুদানে পালিত কিছু মুসলমান দ্বারা, যারা আমাদের ভাষায় তাদের কথা বলে। কিন্তু এইসব চ্যানেলের ‘এবাউটে’ ঠিকই লেখা থাকে ফাউন্ডেড বাই ওয়েস্টার্ন ইনস্টিটিউশনস।
তাদের অপকৌশলগুলোকে একাডেমিক ভিত্তি দেওয়ার জন্য ‘র্যান্ড কোর্পোরেশনের’ মতো কিছু স্পেশাল সেন্টার খোলা হয়। যেগুলোর কাজ হচ্ছে ইসলামরে বিভিন্ন স্পর্শকাতর বিষয়ে অযৌক্তিক প্রশ্ন তোলা এবং হাস্যরসের অন্তরালে ইসলামের বিভিন্ন ব্যক্তিত্বকে ব্যঙ্গকরে বিকৃতরূপে উপস্থাপন করা। যা সবশেষে আল্লাহ এবং তার রসুলেকে ব্যঙ্গ করার পথই সুগম করে।
কতিপয় পশ্চিমা রাজনীতিবিদ সরাসরিই ইসলামের বিপক্ষে বক্তব্য রেখেছে। যেমন ট্রাম্পের সাবেক উপদেষ্টা জেনেরাল মাইকেল ফ্লেইন বলেন, ‘পৃথিবীর প্রায় দুইশ কোটি মানুষের শরীরে ইসলাম একটি দৃশ্যমান ক্যান্সারের রূপ ধারণ করে আছে। আর একে যেকোনো মূল্যে আমাদের থামানো উচিত’।
এতটুকু বলেই তিনি ক্ষ্যান্ত দেননি। বরং ইসলামকে থামানোর একটি পন্থাও তিনি বাতলে দিয়েছেন। আর তা হলো, ‘ডিসক্রেডেটিং দ্যা আইডোলজি’, অর্থাৎ ইসলামের আদর্শে কালিমা লেপন করা। অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, তারা তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য যেকোনো কিছুই করতে পারে।
তাদের পরিচালিত কিছু বিশ্ববিদ্যালয় মুসলমানদের মধ্যে কীভাবে সন্দেহ সৃষ্টি করতে হয়, তা শিক্ষা দেয়। আমি বলছি না যে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মুসলমানদের সরাসরি ইসলাম থেকে বের করে কাফির বানিয়ে ফেলে। বরং তারা ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে মুসলমানদের মধ্যে সন্দেহ তৈরি করে দেয়।
নিহত, অত্যাচারিত, লাঞ্ছিত মুসলমানদের ছবি বেশি করে পাবলিশ করা। যেন বৈশ্বিক ক্ষমতা-প্রশ্নে মুসলমানরা নিজেদের অসহায় মনে করে।
আর মানসিকভাবে আমাদের পরাজিত করার জন্য ইসলামের চতুর্মাত্রিক সমালোচনা তারা জারি রাখে। একদিকে তারা মানুষের ব্যক্তিগত এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার বুলি আউড়ায় অন্যদিকে ইসলাম পালনের সকল পথও তারা বন্ধ করতে তৎপর, এ এক তুমুল হিপোক্রেসি! বিভিন্ন দেশ তাদের নাগরিকদের বেলায় ভিক্টিমের ছবি প্রকাশ না করলেও নিহত অত্যাচারিত এবং লাঞ্ছিত মুসলমানদের ছবি সাগ্রহে প্রকাশ করে ‘এগুলো লিকড’ হয়ে গেছে বলে চালিয়ে দেয়।
এসবের মধ্য দিয়ে তারা যে প্রচ্ছন্ন বার্তাটি আমাদের দিতে চায় তাহল, ‘যতদিন তুমি মুসলমান, ততদিন তুমি নিছক সংখ্যা ছাড়া কিছু নও’।
ফ্রান্সে যখন প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অবমাননাকারী নিহত হলো। মিডিয়া তখন এই ইস্যুর পেছনে উঠে-পড়ে লাগল। ফ্রান্সে পৃথিবীর সকল রাষ্ট্র থেকে শোক ও সমবেদনা বার্তা আসতে থাকে। কিন্তু এর কিছু দিন পরেই ফ্রান্স যখন মালদ্বীপে শতাধিক মুসলমান হত্যা করল। সেখানে কোনো মিডিয়া কভারেজই ছিল না। এই হলো তাদের তথাকথিত মানবতাবাদ। এইসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি সেই একটি মতকেই শক্তিশালী করে, আর তা হলো ‘মুসলমানরা কিছুই না’।
ইসলামের ইতিহাস বিকৃতকরণ এবং বিদ্যালয়গুলোতে এর আসল ইতিহাস পাঠাদান নিষিদ্ধকরণ। আর এগুলোও র্যান্ডের বাতলে দেওয়া পদ্ধতি। যেন মুসলমানরা মনে করে যে অনুসরণ করার মতো এবং গর্ব করার মতো তাদের কোনো ইতিহাস নেই।
আমাদের জীবিত রোল মডেলদের ম্লান করে দেখানোর জন্য এবং তাদের মর্যাদাকে খাটো করে দেখানোর জন্য গান্ধি, ম্যান্ডেলা, তেরেসা এবং চে গুয়েবারার সাথে তাদের তুলনা করা হয়।
আবিষ্কার এবং উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে মুসলিম সভ্যতার সোনালি ঐতিহ্যকে তারা যে সম্পূর্ণভাবেই গোপন করে রাখতে চায়, তা তো এখন ওপেন সিক্রেট।
শধু এগুলোই নয়; মুসলমানদের মধ্যে ইসলাম সম্পর্কে ভ্রান্তি তৈরি করতে তারা আরও অসংখ্য শয়তানি ও দাজ্জালি পন্থা অবলম্বন করে। সেগুলো থেকে এখানে অল্প কয়েকটাই মাত্র উল্লেখ করা হলো।
•
এ তো গেল, মুসলমানদের অন্তর থেকে ইসলামের ভালোবাসা দূর করার আয়োজন।
মুসলমানদের অন্তরে কুফরকে জায়গা করে দেওয়ার জন্যও তাদের আয়োজনের শেষ নেই। কুফরকে আকর্ষণীয় এবং গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্যও তারা কিছু কৌশল অবলম্বন করে।
যেমন :
১. এর মধ্যে একটি হচ্ছে, কুফরকে মুখরোচক এবং শৈল্পিক কিছু নাম দেয়া। যেমন, বাকস্বাধীনতা, সংস্কৃতি, এনলাইটমেন্ট, সেকুলারিজম এবং মডার্নিজম ইত্যাদি। সেকুলারিজমকে প্রায় প্রতিটি মুসলিম দেশে গ্রহণযোগ্য করে তুলা হয়েছে। সেকুলারিজমের গ্রাহ্যতার কারণে আজকাল যে কেউ শরিয়তকে উপহাস করে বলতে পারে, ‘আমরা ধর্মনিপেক্ষ রাষ্ট্রে বাস করি। এখানে শরিয়ত কী বলে না বলে তা আমাদের দেখার সময় নেই’। সেকুলারিজের কারণে শরিয়তের প্রতি এসব ধৃষ্টতা দেখানোর পরও নিজেকে তারা মুসলিমই মনে করে। রাষ্ট্রে এর গ্রাহ্যতা স্বীকৃত থাকায় তাকে সরাসরি কাফিরও ঘোষণা করা যায় না। ফলে মরার পরে একজন মুসলমানের মতোই তারও কাফন-দাফন হয়।
এমনকি ইসলামি দল নামে পরিচিত কিছু দলও এইসব শব্দসন্ত্রাসে বেড়াজালে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে।
২. এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য তাদের রিসার্চ সেন্টারগুলো বিভিন্ন গবেষণাপত্র প্রকাশ করে। Civil Democratic Islam এবং Building Moderate Muslim Networks এর মতো গবেষণাপত্রে ‘মধ্যপন্থি (মডারেট) মুসলিমদের’ সাহায্য ও সমর্থন করার সুপারিশ করা হয়েছে। কারা এই তথাকথিত মডারেট মুসলিম? তাদের নাম দেখলেই আপনি বুঝবেন, এরা জন্মগ্রহণ করেছিল মুসলিম পরিবারে। পরিণত বয়সে তারাই কুরআনকে অভিযুক্ত এবং কুরআনি শাসনব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা শুরু করে।
এই সুপারিশের মাধ্যমে তারা সহজেই মিডিয়ায় ভালো জায়গা দখল করে নেয়। এদের মাধ্যমেই পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে তাদের কাজগুলো অনূদিত হয়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
এর বিপরীতে যারা ইসলামি শাসনব্যবস্থার প্রয়োজনিয়তা অনুভব করেন, তাদের ‘চরমপন্থি’ আখ্যা দেয়া হয়।
৩. তারা মুসলিমদের পরিচয় ইসলামি শরিয়তের পরিবর্তে ইসলামপূর্ব জাহিলিয়ার সাথে জুড়ে দিতে চায়। শরিয়তের কথা বললে তারা বলবে, ‘তোমরা কি আমাদের চৌদ্দশ বছর পেছনে নিয়ে যেতে চাও?’ অথচ তারও হাজার বছর পূর্বের কুফর-শিরক আর ফেরাউনের দাসত্বের যুগে ফিরে যেতে তাদের কোনো আপত্তি নেই ।
৪. কুফুরকে শোভনীয় করার একটি মাধ্যম হল, বিভিন্ন পৌত্তলিক ধর্মের উপাসনালয়, যেমন হিন্দু মন্দির বানানো। অথচ তাদের দেশে কুরআন হিফজ করার প্রতিষ্ঠানগুলোতে নানা চাপ সৃষ্টি করা হয়। ছাড়পত্র না থাকার অজুহাতে বহু মসজিদ ভেংগে দেয়া হয়।
৫. তাওহিদ এবং শিরকের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি করার জন্য তারা উদ্দেশ্য-প্রণোদিতভাবে ‘ইবরাহিমি ধর্মের’ নামে একটি বিশেষ ধারণা প্রচার করে। অথচ কুরআনে ইবরাহিম আলাইহিস সালামের ধর্মের ব্যাপারে ইরশাদ হয়েছে, ‘ইবরাহিম ইহুদি বা খ্রিস্টান ছিলেন না। বরং তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ মুসলিম। আর তিনি মুশরিকও ছিলেন না।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত ৬৭)
৬. ইতিহাসের আস্তাকুঁড় থেকে ঘৃণিত চরিত্রগুলোকে খুঁজে বের করে তাদের হিরো হিসেবে প্রচার করা। বিভিন্ন টিভি শো এবং সিরিয়ালের মাধ্যমে তাদের চরিত্র ও চিন্তাকে আকর্ষণীয় করে তুলে ধরা।
৭. নাস্তিকতাকে এভাবে দেখানো করা যে, এটিও একটি মত, একে সম্মান করা জরুরি। এর নিজস্ব দর্শন রয়েছে।
সমাজের যে সকল লোক মুরতাদ হয়ে যায় তারা এদেরকে সমাজের ‘শিক্ষিত মানুষ’ হিসেবে উপস্থাপন করে। যারা গভীর পড়াশোনা করার পর ইসলাম ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এভাবে তারা এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করে যাতে আপনি এদেরকে ‘মুরতাদ-নাস্তিক’ বলতে ভয় পেয়ে যান।।
এসব কিছুর পেছনে লক্ষ্য হচ্ছে, নাস্তিকদেরকে সমাজের একটি সাধারণ অংশ হিসেবে গণ্য করা। তারাও অন্যান্য নাগরিকদের মত সব সু্যোগ সুবিধা নিয়ে বসবাস করবে।
এভাবে তার পরের ধাপটি গ্রহণ করে। কেউ যখন যৌক্তিকভাবে নাস্তিকদের চিন্তা, মতবাদ ও আপত্তিগুলোকে খন্ডন করে, এর অন্তসারঃশূন্যতা মানুষের কাছে তুলে ধরে, তখন তারা বলে, এটি তাদের অনুভূতিতে আঘাত দিচ্ছে, জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট করছে, এবং সমাজে হানাহানি ও ফিতনা সৃষ্টি করছে।
৮. ‘মানবতাবাদ’র প্রচার, যেখানে মানুষই মুখ্য এবং একমাত্র গ্রাহ্য হিসেবে বিবেচিত হবে। তাই আল্লাহর আইনে যা অপরাধ, তা এখানে অপরাধ বলে বিবেচ্য হবে না। মানবতাবাদে আল্লাহর বিধানের কোনো মূল্য নেই। মানুষের কোনো ক্ষতি হচ্ছে কি না এটাই এখানে সর্বোচ্চ বিচার্য বিষয়।
৯. নাস্তিকতাকে সংহত করতে পশ্চিমা উকালতির মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান নিশ্চিত করা এবং ভূয়া বিজ্ঞানবাদের মাধ্যমে বিজ্ঞানকে সহজে উপস্থানের নামে নাস্তিকতার প্রসার ঘটানো।
১০. মুসলমানদের মধ্য থেকে ইসলাম ত্যাগ করে যারা বিপথগামী হয়ে গেছে, তাদের সাথে খারাপ কিছু ঘটলে মিডিয়াকে কাজে লাগিয়ে এই বিষয়গুলো খুবই বড় করে উপস্থাপন করা। যাতে এর মাধ্যমে তাদের নাগরিক অধিকার নিশ্চিত হয়। এইসব ঘটনা মিডিয়ায় হাইলাইট করে মুসলমানদের ‘মুসলিম এবং কাফির’ পরিভাষা ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করে।
•
এমন আরও বহু অপকৌশল তারা অবলম্বন করে। এবং এসবের উদ্দেশ্য হলো, কুফরকে মেকআপ করে সজ্জিতরূপে পেশ করা। মুসলমানদের হৃদয়ে ইসলামের প্রতি ভালোবাসার বদলে সংশয় তৈরি করা। এভাবে মুসলমানদের ধর্ম ত্যাগে প্রস্তুত করা।
মুসলমানদের কাফের বানানোর এক অনিঃশেষ যুদ্ধের মুখোমুখি আজ আমরা দাঁড়ানো, যার একমাত্র লক্ষ্য হলো ইসলামকে সমূলে উৎখাত করা এবং এর শেষ নিশানাটুকু মুছে ফেলা।
তাই আমাদের উচিত মুসলমান হিসেবে প্রথমে নিজেদের গুরুত্ব অনুধাবন করা এবং পশ্চিমা প্রপাগান্ডা আমাদের মধ্যে যে মানসিক পরাজয়ের মনোভাব তৈরি করে, তা থেকে বের হয়ে আসা। আমাদের দুনিয়া ও আখেরাতের যাবতীয় কল্যাণ রয়েছে কেবলমাত্র ইসলামে এই বিশ্বাস হৃদয়ে ধারণ করা। আমাদের অস্তিত্বের জন্য, এই উম্মতের জন্য বরং মানবতার পুনরোদ্ধারের জন্যই আমাদের সেই বিশ্বাস অর্জন করতে হবে। কারণ, বিশ্বমানবতার কল্যাণের জন্যই তো আমাদরে সৃষ্টি করা হয়েছে।
পশ্চিমারা কোনো একক ব্যক্তির অপরাধের অজুহাত দেখিয়ে সম্পূর্ণ অনৈতিভাবে দেশের পর দেশ ধ্বংস করে দিয়ে বলে, ‘নিজেদের রক্ষা করার অধিকার আমাদের আছে’; অথচ মুসলমানদের নিজেদের সত্তা এবং তাদের ধর্ম রক্ষার অধিকারটুকু পর্যন্ত নেই। এমনকি নিজেদের দাবির ব্যাপারে কলম ধরলে বা ইনসাফের সাথে ইসলামের সুস্পষ্ট মতামত তুলে ধরলেও মৌলবাদি এবং চরমপন্থী বলে আখ্যা দেওয়া হয়।
•
এহেন শোচনীয় অবস্থায় আমাদের করণীয় কী? তাদের চতুর্মখি ষড়যন্ত্রে আমরা কি ভয় পেয়ে যাব? কখনোই নয়। আমাদের বরং জেগে উঠতে হবে। নিজেদের মধ্যে সচেতনতা তৈরিই এর প্রথম স্টেপ। দ্বিতীয় কাজ হচ্ছে তাদের কৌশল সম্পর্কে সতর্ক থাকা। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘সতর্কতা অবলম্বন করো’ ( সুরা নিসা, আয়াত ১০২)। এমনিভাবে ধৈর্যধারণ করা এবং আল্লাহ তাআলার ওপর ভরসা রাখা যে, তাদের ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল থেকে তিনিই আমাদের রক্ষা করবেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যদি তোমরা ধৈর্য ধারণ করো এবং আল্লাহকে ভয় করো, তাহলে তাদের ষড়যন্ত্র তোমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিফহাল। (সুরা আলে ইমরান, আয়াত ১২০)
কিন্তু প্রশ্ন তো একটা থেকেই যায়, মানবতার জন্য এবং একটি সুন্দরতম পৃথিবীর জন্য মুসলমান কি আসলেই জরুরি? না এটা কেবলই আমাদের হৃদয়-মনন আচ্ছন্ন করে রাখা আবেগি শ্লোগান? আগামী লেখায় আমরা তা সবিস্তারে জানব ইনশাআল্লাহ।
জাযাকুমুল্লাহ