বিদআতের সংজ্ঞা ও পরিচয়: হাদীসে নববীর আলোকে~ আনাস চৌধুরী
বিদআতের শাব্দিক বিশ্লেষণ
আরবি ভাষায় ‘বিদআত’ এর শাব্দিক অর্থ কী?
এ ব্যাপারে আরবি অভিধানের উৎসগ্রন্থ থেকে শুরু করে নিকট অতীতে প্রণীত অভিধানগুলোর বক্তব্য বলতে গেলে প্রায় একই। আমরা চতুর্থ শতাব্দীর প্রখ্যাত ভাষাবিদ আবু নাসার আল জাওহারির (মৃত:৩৯৩হি:) সিহাহ, ইবনে ফারিসের (৩৯৫হি:) মাকায়িসুল লুগাহ, ইবনে মানযুরের (৭১১হি:) লিসানুল আরব, ফিরোজাবাদীর (৮১৭হি:) আলকামূস এবং মিশরের আরবি ভাষাপরিষদ কর্তৃক প্রণীত আল মুজামুল ওয়াসিত প্রভৃতি অভিধানে বিদআতের শাব্দিক বিশ্লেষণ পড়েছি। অভিধানগুলোর মূল কথাটি ইমাম নববী এ শব্দে ব্যক্ত করেছেন, كل شيء عمل على غير مثال سبق
মোট কথা—আভিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিদআত শব্দটি ব্যাপক অর্থবোধক। আগে ছিল না, নতুন করে আবিষ্কৃত হয়েছে, এমন জাগতিক বা দীনি যেকোন জিনিসকে বিদআত বলা যাবে।
এই আভিধানিক অর্থে বিদাত ভালোও হতে পারে, মন্দও হতে পারে। (ফাতহুল বারী : ইতিসাম অধ্যায়)
শরীয়তের দৃষ্টিতে বিদআতের পরিচয় ও স্বরূপ:
সুন্নত এর বিপরীত হল বিদআত। সুন্নতের পরিচয় ও হাকিকত যেভাবে ইসলামের শুরু থেকে আজ অবধি একটি পরিষ্কার বিষয়, তেমনি বিদআতের পরিচয় ও স্বরূপও সুস্পষ্ট ও উজ্জ্বল। ইসলামের মহান ইমাম ফকীহ ও আলেমগণ যুগে যুগে কুরআন সুন্নাহের আলোকে বিদআতের পরিচয় পরিষ্কার ভাষায় তুলে ধরেছেন। তাদের ভাষা ও ভঙ্গিতে বৈচিত্র্য থাকলেও বিরোধ ও বৈপরিত্য নেই; সকলের মূল কথাটি একই। কেউ হয়তো বিস্তারিত বলেছেন, কেউ সংক্ষিপ্ত করার উদ্দেশ্যে গুরুত্বপূর্ণ বিষগুলো শুধু উল্লেখ করেছেন।
যেমন, বিদআত বিষয়ক কালজয়ী গ্রন্থ আল ইতিসামের লেখক মালেকী মাযহাবের প্রসিদ্ধ ইমাম আবু ইসহাক শাতেবী রহ. বলেছেন :
البدعة عبارة عن طريقة في الدين مخترعة، تضاهي الشرعية، يقصد بالسلوك عليها المبالغة في التعبد لله سبحانه.
বিদাত হল দীনের মধ্যে নতুন উদ্ভাবিত এমন একটি পথ, যা শরীয়ত নয়, কিন্তু শরীয়তের মতই মনে হয়। এ পথ অবলম্বন করা দ্বারা উদ্দেশ্য থাকে আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি অর্জন ও তাঁর ইবাদতের ক্ষেত্রে সীমাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করা। (আল ইতিসাম: বিদাতের পরিচয় অধ্যায় )
ইমাম শাতেবীর সংজ্ঞায় বিদআতের স্বরূপটি চমৎকার ভাবে ফুটে উঠেছে। মূল কথাটি হল, বিদআ’ত শরীয়তের মত আরেকটি শরীয়ত। নবীজির আনীত শরীয়ত পালন করা দ্বারা যেমন আল্লাহ পাকের ইবাদত ও সন্তুষ্টি কামনা করা হয়, বিদআতে লিপ্ত ব্যক্তিটিও বিদআত পালনের মাধ্যমে তাই করতে চা্য়।
আরেকটু স্পষ্ট করে আল্লামা তাফতাযানি রহ: বিদ’আতকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে—
هو المحدث في الدين من غير أن يكون في عهد الصحابة والتابعين ولا دل عليه الدليل الشرعي.
বিদআত হল দিনের মধ্যে নব আবিস্কৃত এমন বিষয়, সাহাবী ও তাবেঈদের যমানায় যার অস্তিত্ব পাওয়া যায় না এবং যে বিষয়ে শরীয়তে কোন দলীলও নেই। (শরহুল মাকাসিদ:২/২৭১)
আল্লামা আব্দুল হাই লাখনৌবী রহ. বিদাতের সংজ্ঞায় লিখেছেন—
هو ما زيد على ما شرع من حيث الطاعة بعد انقراض الأزمنة الثلاثة، بغير إذن من الشارع، لا قولا ولا فعلا ولا صريحا ولا إشارة.
তিন যুগ চলে যাওয়ার পর শরীয়তে প্রমাণিত বিষয়গুলোর উপর এমন কোন বিষয় বৃদ্ধি করা, যে ব্যপারে শরীয়তপ্রণেতার পক্ষ থেকে মৌখিক-কর্মগত-স্পষ্ট বা ইঙ্গিতমূলক কোন ধরনের পাওয়া যায় না (তারবিহুল জানান)।
উলামায়ে কেরামের বর্ণিত সংজ্ঞাগুলো সামনে নিয়ে আমরা যে মূল কথাটি পাই, তা হলো—বিদআত বলা হয় নতুন আবিষ্কৃত কোন কাজ, কথা বা বিশ্বাস, যা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে ছিল না, তাঁর সাহাবী, তাবেঈ ও তাবে তাবেঈদের মধ্যেও প্রচলিত ও স্বীকৃত ছিল না, এবং কোরআন হাদীস ইজমা কিয়াস— শরীয়তের এই চার দলীলের কোনটি দ্বারাও প্রমাণ করা যায় না— এমন কিছুকে দীনের অংশ মনে করা, বা দীনের অংশ মনে করে সওয়াব লাভের আশায় পালন করা।
বিদআতের এই পরিচয়ের মূল উৎস :
বিদআতের এই পরিচয়টি গ্রহণ করা হয়েছে শরীয়তের সরাসরি বক্তব্যসমূহ থেকে। উদাহরণত কিছু হাদীস আমরা উল্লেখ করছি :
১. আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণিত প্রসিদ্ধ একটি হাদীসে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, مَنْ أَحْدَثَ فِي أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ “.
যদি কোন ব্যক্তি আমাদের এই বিষয়ে ( অর্থাৎ, দীন ও শরীয়তে) এমন নতুন কিছুর অনুপ্রবেশ ঘটায় যা এই দ্বীনের অংশ নয়, তাহলে তা প্রত্যাখ্যাত ও অগ্রহণযোগ্য হিসেবে গণ্য হবে। (বোখারী: ২৬৯৭ মুসলিম: ১৭১৮)
“আমাদের এই বিষয়ে” বলতে নবীজি দ্বীনি বিষয় বুঝিয়েছেন। কাজী ইয়াজ, হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি, ইবনে রজব হাম্বলীসহ হাদিসের বিখ্যাত ব্যাখ্যাকারগণ সুস্পষ্টভাবে এ কথা বলেছেন। সুতরাং দ্বীনী বিষয়ের বাইরে নিছক দুনিয়াবী ক্ষেত্রে মানুষের জীবনকে সহজ ও আরামদায়ক করার জন্য, কিংবা দীনের অংশ মনে না করে দীন পালনের সুবিধার জন্য যত নতুন নতুন জিনিস আবিষ্কার করা হবে, এর কোনটাই শরীয়তের দৃষ্টিতে বিদআত হিসেবে গন্য হবে না। যেমন, বিজ্ঞানের নানা আবিস্কার বা দীনী ইলম অর্জনের জন্য পরীক্ষাপদ্ধীত কিংবা অন্য কোন বিষয়। কেননা হাদীসের স্পষ্ট ভাষ্যমতে নতুন আবিষ্কৃত জিনিসটি কেবল তখনই প্রত্যাখ্যাত হবে, যখন সেটা দীনের অংশ হিসেবে দীনের ভিতরে সংযুক্ত করা হবে।
এমনিভাবে, কোন বিষয় নতুন উদ্ভাবিত হলেও তা যদি শরীয়তের কোন দলিল দ্বারা প্রমাণিত হয়, তাহলে তাকেও বিদআত মনে করা যাবে না। কারণ, বিদআত হওয়ার জন্য হাদীসের মধ্যে শর্ত করা হয়েছে, জিনিসটি এমন হতে হবে, ‘যা এই দীনের অন্তর্ভুক্ত নয়’। কিন্ত শরীয়তের কোন একটি দলীল দ্বারা প্রমাণিত হয়ে গেলে সেটি দীনৈর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়, তাই বিদআত বলার আর সুযোগ থাকে না। এ জন্যই কাজী ইয়াজ রহ. হাদীসের শর্তমূলক এই অংশটির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন : ‘যা দীনের অন্তর্ভুক্ত নয়’ কথাটির মানে হলো—কেউ এমন কোন বিষয় আবিষ্কার করল, কোরআন ও সুন্নাহয় যার পক্ষে স্পষ্ট বা সূক্ষ্ম কিংবা গবেষণায় আহরিত কোন দলিল নেই, তাহলে সেটি প্রত্যাখ্যাত হবে। (আলী কারী কৃত মিরকাত: আল ইতিসাম অধ্যায়)
এখানে মনে রাখা প্রয়োজন— কোন বিষয় শরীয়তের কোন বক্তব্যের বিপরীত না হয়েও বেদআত হতে পারে। এমনিভাবে বিষয়টির ব্যাপারে সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা থাকাও জরুরী নয়। কারণ, নিষেধাজ্ঞা থাকলে তো তা বিদআতের আওতায় যাবে না; নিষিদ্ধ বিষয় হিসেবেই পরিত্যাজ্য হবে। (আল্লামা সারফারাজ খান কৃত ‘রাহে সুন্নত’ পৃ. ৯১)
পূর্বে আমরা বলেছি বেদাত আকিদা-বিশ্বাসে যেমন হয়, কথা ও কাজের ক্ষেত্রেও হতে পারে। কিন্তু বেদাতপন্থী কোন কোন লেখক দাবি করেছেন—বেদাত শুধু আকীদার ক্ষেত্রে হয় এবং বিদআতের নিন্দা করে যত হাদিস বর্ণিত হয়েছে, সবগুলোই আকীদার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
কিন্তু তাদের এই দাবিটি একেবারেই অমূলক। কারণ উপরের হাদিসটিতে বলা হয়েছে—‘যে ব্যক্তি আমাদের দীন ও শরীয়তে নতুন কিছু অনুপ্রবেশ করাবে…’; দীন ও শরীয়ত তো শুধু আকীদার নাম নয়; আকীদা ও আমল—উভয়ের যোথ সম্মিলনই পরিপূর্ণ দীন। উপরন্তু, উপরের হাদীসটি মুসলিম শরীফে বর্ণিত হয়েছে এভাবে— من عمل عملا ليس عليه أمرنا فهو رد
অর্থ : যে ব্যক্তি এমন কোন কাজ করল যা আমাদের বিষয় (তথা দীনের) পদ্ধতি মাফিক নয়, তাহলে সে কাজটি প্রত্যাখ্যাত হবে। (সহি মুসলিম:১৭১৮) এই শব্দ দ্বারা তাদের দাবিটি সুস্পষ্টভাবে ভুল প্রমাণিত হয়।
২. হযরত ইরবায ইবনে সারিয়া রা. বর্ণনা করেন—নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরাম এর মজলিসে একদিন ওসিয়ত করে বলেছিলেন—আর, তোমাদের মধ্য থেকে (আমার পর) যে বেঁচে থাকবে, সে বহু মতপার্থক্য দেখতে পাবে। তখন তোমাদের কর্তব্য হবে আমার সুন্নত এবং হেদায়েতের উপর অটল থাকা ও খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নতকে আঁকড়ে ধরা। শোনো, এগুলোকে খুব শক্ত করে মাড়ির দাঁত দিয়ে কামড়ে ধোরো। (তিরমিযি: ২৬৭৬ আবু দাউদ:৪৬০৭)
এ হাদীসটি থেকে বুঝা যাচ্ছে খোলাফায়ে রাশেদীনের আমল, তাদের কিয়াস, ইজতেহাদ বা গবেষণাকে বিদআত হিসেবে গণ্য করা হবে না। নবীজির পরিষ্কার ঘোষণা মাফিক এগুলোও সুন্নত। (ইবনে রজব হাম্বলী ও মুহাদ্দিস আব্দুল হক দেহলভী)
খোলাফায়ে রাশেদীনের আমল কেন বেদআত হবে না, এর কারণ ব্যাখ্যা করে মোল্লা আলী কারী লিখেছেন, তারা যা করেছেন, মূলত নবীজির সুন্নত অনুযায়ীই করেছেন। সুন্নতের বাইরে নিজে থেকে উদ্ভাবন করে কিছু করেননি। কিন্তু তারপরও বিষয়গুলোকে তাদের দিকে সম্পৃক্ত করে ‘খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নত’ বলা হয়, কারণ নবীজির সুন্নত অনুযায়ী তারা আমলগুলো সম্পাদন করেছেন; অথবা ইজতেহাদ-গবেষণা করে উদঘাটন করেছেন ও বেছে নিয়েছেন। (মিরকাত: বাবুল ইতিসাম)
৩. হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা: বর্ণিত একটি হাদিসে নবীজি বলেছেন—বনু ইসরাঈল তো বাহাত্তর দলে বিভক্ত হয়েছিল, আমার উম্মত বিভক্ত হবে তেহাত্তর দলে। এদের একটি দল ছাড়া সব দলই হবে জাহান্নামী। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! সেই একটি দল কোনটি? তিনি বললেন, আমি এবং আমার সাহাবীরা যার উপর প্রতিষ্ঠিত। (তিরমিযি:২৬৪২)
এ হাদিস থেকে প্রমাণিত হয়, নবীজির সুন্নত এবং ঈমান আকীদা ও আমলের ক্ষেত্রে সাহাবীগণ যে পথ ও পদ্ধতির উপর ছিলেন, সেটা মুক্তিপ্রাপ্ত দল হওয়ার মানদণ্ড। ফলে নবীজি যা করেছেন ও বলেছেন, এবং তাঁর সাহাবীগণ দীন হিসেবে যা পালন করেছেন, পরকালে মুক্তি পেতে হলে, সে পথ ও পদ্ধতিতে দীন পালন করতে হবে। ফলে সাহাবীদের কোন আকিদা ও আমল বিদআত হিসেবে গণ্য হওয়ার কোন সুযোগ নেই।
৪. প্রসিদ্ধ ফকীহ সাহাবী হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা:) এর সূত্রে বর্ণিত একটি মশহুর হাদীসে নবীজি বলেছেন—আমার উম্মতের মধ্যে সর্বোত্তম মানুষ হলো আমার যুগের মানুষ। অতঃপর এর পরের যুগ। অতঃপর এর পরের যুগ। এ তিন যুগের পর এমনসব মানুষ আসবে, যারা সাক্ষ্য দেওয়ার আগে কসম কাটবে, কসম কাটার আগে সাক্ষ্য দিবে। (অর্থাৎ, সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য প্রমাণ করার জন্য কসম আর সাক্ষের মতো ভারী বিষয়গুলোকে কিছুই মনে করবে না।) (সহি বুখারী: ৩৩৮৯)
এই হাদীসটিই নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে হযরত উমর ফারুক রা. বর্ণনা করেছেন। তার শেষের শব্দগুলো ছিল এমন—এরপর মিথ্যার বিস্তৃতি ঘটবে। এমনকি একজন কসম করে বসবে অথচ তাকে কসমের কথা বলা হয়নি; আরেকজন সাক্ষ্য দিয়ে ফেলবে, অথচ তার জন্য অনুরোধ করা হয়নি।(তিরমিযি:২১৬৮)
উল্লেখ্য হাদীসে বর্ণিত ‘যুগ’ বলতে সে যুগের মুসলিম-অমুসলিম সকল মানুষ উদ্দেশ্য নয়; বরং সে সময়কার উৎকৃষ্ট মানুষজন, অর্থাৎ সাহাবী তাবেয়ী তাবে তাবেঈনদেরকেই শুধু বুঝানো হয়েছে। (ইমাম নববীকৃত শরহে মুসলিম)
কিয়ামত পর্যন্ত যত যুগ আসবে, এর মধ্যে এই তিন যুগ শ্রেষ্ঠ হিসেবে গণ্য হবে। দীন ও শরীয়তের বিচারে এই তিন যুগ পরবর্তী সবার জন্য আদর্শ। যদি কোন দীনি বিষয় সাহাবা, তাবেই ও তাবেতাবেয়ীগণ কোন আপত্তি ছাড়া পালন বা বর্জন করে থাকেন, তাহলে তাদের এই পালন বা বর্জনটি শরীয়তে দলিল হিসেবে গণ্য হবে। পরিভাষায় একে ‘খাইরুল কুরূন’ বা শ্রেষ্ঠ তিন যুগের ধারাবাহিক কর্মপন্থা (তাআমুল) হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় এবং এ তিন যুগে স্বীকৃত ও পালনীয় কোন বিষয়কে বিদাত হিসেবেও গণ্য করা হবে না। উপরে বর্ণিত হাদীসগুলোতে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ বিষয়ে সাক্ষ্য দিয়ে গেছেন।
এই তিন যুগের অধিকাংশ মানুষ নবীজির ভবিষ্যতবাণী অনুযায়ী দীন পালনে এবং দীনের মূল কাঠামো সংরক্ষণ করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে সজাগ ও সচেতন ছিলেন। তাদের মধ্যে বিদআতের প্রতি ঘৃণাবোধ ও সুন্নতের অনুসরণের প্রতি আকুলতা এত বেশি পরিমাণে ছিল, ইতিহাসের সাক্ষ্য হল, পরবর্তীকালে এমনটি কখনো পাওয়া যায়নি।
একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন:
এখানে এসে বেদাতপন্থী অনেক আলেম একটি প্রশ্ন উঠিয়েছেন—সাহাবী তাবেয়ী ও তাবেতাবেয়ীদের যুগেও তো বিদাত ছিল। উদাহরণত রাফেজী, কাদরিয়া, মুতাজিলা প্রভৃতি বিদআতি দলগুলো সে যমানাতেই সৃষ্টি হয়েছে!
কিন্তু এটি খুবই অবান্তর ধরণের একটি প্রশ্ন। কারণ, পরবর্তী অন্যান্য সময়ের তুলনায় তখন বিদআত খুবই কম পরিমাণে ছিল। সবচেয়ে বড় কথা হল, শ্রেষ্ঠ তিন যুগের অধিকাংশ মানুষ ব্যাপকভাবে বিদ’আতকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। ফলে যে সকল বিষয় তাদের আপত্তি ছিল এবং তারা প্রত্যাখ্যান করেছেন এমন বিষয়কে সামনে এনে প্রশ্ন উঠানোর কোন সুযোগ নেই।
একটি বিশেষ প্রশ্ন উঠতে পারে এমন—মুজতাহিদ ইমাম ও ফকিহদের ইজতিহাদ ও কিয়াস, তাজকিয়া ও তাসাউফের নিয়ম-পদ্ধতি ও দীনি বিধান পালনে সহায়ক-উপকরণসমূহ কি বিদআত বলে গন্য হবে? উপরে আমরা বিদআতের পরিচয় সম্পর্কে বিস্তারিত যে আলোচনা করেছি, সে আলোকে আশা করছি বুঝাই যাচ্ছে এগুলোকে বিদআত বলার সুযোগ নেই। এ সংক্রান্ত বিস্তারিত আলোচনাটি সামনের সংখ্যার জন্য তুলা রইল।