ইসলামের ইতিহাসে কারবালার ঘটনা এক ন্যাক্কারজনক ঘটনা। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে জন্ম নেয় নানা পক্ষ-বিপক্ষ। এক জুলুমের প্রতিরোধ করতে জন্ম হয় আরো জুলুমের। একদিকে আহলে বাইত বিদ্বেষী নাসেবি গ্রুপ, অন্যদিকে সাহাবাবিদ্বেষী রাফেজি গ্রুপ, একের পর এক প্রান্তিকতা জন্ম নেয় তাদের হাত ধরে। হাজার বছরের বেশি সময় ধরে দুই দলই নিজেদের মতামত উপস্থাপন করে চলেছে। মহররম এলে একদিকে তাই দেখা যায় ইয়াযিদের এমন প্রশংসা যাতে মনে হয় হজরত হুসাইনই (রা) ছিলেন প্রকৃত অপরাধি, অন্যদিকে দেখা যায় ইয়াযিদের দোষ তার পিতা হজরত মুয়াবিয়া (রা) পর্যন্ত টেনে নিয়ে অন্তরের সাহাবাবিদ্বেষ উগরে দেয়া। আল্লাহ আমাদেরকে এই দুই প্রান্তিকতা থেকেই হেফাজত করুন। আমিন।
এই লেখায় আমরা কারবালার ইতিহাসের পূর্বাপর-প্রেক্ষাপট বিস্তারিত আলোচনা করবো না। এ বিষয়ে কেউ বিস্তারিত পড়তে চাইলে মাওলানা ইসমাইল রেহান লিখিত তারিখে উম্মতে মুসলিমাহর দ্বিতীয় খন্ড পড়ে নিতে পারেন। মাকতাবাতুল আযহার ও ইত্তিহাদ থেকে বইটি অনুবাদ হয়েছে। উর্দু জানা না থাকলে বাংলাতেও পড়তে পারেন।
এই লেখায় আমরা কিছু মৌলিক কথা বলবো যা জানা থাকলে কারবালার বিস্তারিত ইতিহাস না জেনেও আমরা আকিদা-বিশ্বাসের জায়গায় সঠিক অবস্থানে থাকতে পারব। যে মৌলিক কথাগুলো জানা থাকলে ইতিহাস পাঠের সময় ইতিহাসের চোরাবালিতে আটকানোর সম্ভাবনা কম থাকবে।
অধ্যয়নের মূলনীতি
কারবালার ইতিহাস বলি বা মুশাজারাতে সাহাবার ইতিহাস বলি, তা অধ্যয়নের আগে আমাদের দুটি মূলনীতি মাথায় রাখতে হবে।
১। সাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে আমাদের আকিদার মূল ভিত্তি কোরআন, হাদিস ও আকিদার গ্রন্থাবলী।
আমরা যখন মুশাজারাতে সাহাবা বা কারবালার ইতিহাস পাঠ করবো তখন প্রথমেই এই মূলনীতি নিজেদের মাথায় বসিয়ে নিব। সাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে আমাদের শ্রদ্ধা, বিশ্বাস ও ভক্তির মূল রসদ সংগ্রহ করবো কোরআনুল কারিম থেকে। এ হিসেবে সুরা ফাতাহ-২৯, সুরা হুজুরাত-৩,৭, সুরা মায়েদাহ-৫৪, সুরা ফাতাহ-২৯, সুরা হাদিদ-১০, সুরা বাকারাহ-১৩, সুরা আহযাব-২৩, সুরা আলে ইমরান-১৫৫, ১৯৫, সুরা বাইয়্যিনাহ-৮ ইত্যাদি আয়াতগুলো তাফসির সহ পড়ে নেয়া যায়।
সাহাবিদের ব্যাপারে আমাদের অবস্থান কী হবে তা নির্ধারণ করতে আমরা কিছু হাদিস সামনে রাখতে পারি। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে আমার সাহাবিকে মন্দ বলে, তার ওপর আল্লাহর অভিশাপ। (১) অন্য হাদিসে নবিজি বলেন, আমার কোনো সাহাবিকে মন্দ বলো না, তাদের কাউকে গালি দিয়ো না। কেননা তোমাদের মধ্যে কেউ যদি উহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণও দান করে তবুও তাদের এক বা অর্ধ মুদ দান করার যে সওয়াব তার সামনেও পৌঁছাতে পারবে না। (২)
আরেকটি হাদিসে নবিজি বলেন, তোমরা আমার সাহাবিগণকে সম্মান করো। কেননা তারা তোমাদের মধ্যকার উত্তম মানব। (৩)
সাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে আমাদের অবস্থান কী হবে তা আকিদা ও ফিকহের ইমামগন নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। ইমাম মালেক বলেন, যে ব্যক্তি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোনো একজন সাহাবির বিরুদ্ধে বলবে হোক আবু বকর, উমর, উসমান, মুয়াবিয়া অথবা আমর ইবনুল আস (রাযিয়াল্লাহু তাআলা আনহুম), সে যদি তাদের ব্যাপারে বলে, তারা পথভ্রষ্ট ও কাফের ছিল তাহলে তাকে হত্যা করা হবে। আর যে তাদের এই অপবাদ না দিয়ে কেবল অন্যান্য মানুষের মতো সমালোচনা বা নিন্দা করবে তাকে বন্দী করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা হবে। (৪)
কাজি ইয়াজ বলেন, কোনো একজন সাহাবির সমালোচনা করা কবিরা গুনাহ। আমাদের (মালেকি) মাজহাবের জমহুর আলেমদের মত হচ্ছে, এই প্রকৃতির মানুষকে শাস্তি দেওয়া হবে তবে শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যাবে না। (৫) ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল বলেন, যদি কাউকে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোনো সাহাবির সমালোচনা করতে দেখো, তবে তার ইসলামের ব্যাপারে সংশয় পোষণ করো। (৬) সুফিয়ান ইবনু উয়াইনা বলেন, আল্লাহর রাসুলের সাহাবিদের বিরুদ্ধে কোনো কটূক্তি দ্বারা যার জবান খুলে যায় সে প্রবৃত্তির অনুসারী। (৭)
কোরআন-সুন্নাহ ও আকিদার মানদন্ডে নিজেদের অবস্থান ঠিক করে নেয়ার পর আমাদের সামনে এমন যত বর্ননাই আনা হোক যার মাধ্যমে সাহাবিদের দোষারোপ করা যায়, নিন্দা করা যায়, আমরা তা গ্রহন করবো না। কোরআন-সুন্নাহর মাধ্যমে সাহাবায়ে কেরামের যে অবস্থান নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে তাকে ইতিহাসের কোনো বর্ননা দ্বারা বদলাব না। অনেকে আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া বা তারিখুত তাবারি কিংবা আল কামিলের কোনো বর্ননা সামনে পেলে সেটা দ্বারা নিজের আকিদা বদলে ফেলে। অথচ ইতিহাসের বই কখনো আকিদার মানদন্ড হতে পারে না। বরং ইতিহাসের যে অংশ আকিদার সাথে সাংঘর্ষিক তা পরিত্যাজ্য। অনেকে সাহাবায়ে কেরামকে অপরাধি প্রমাণ করতে কিছু হাদিস নিয়ে আসে, ইতিহাসের কিছু বর্ননা নিয়ে আসে। এমন বর্ননা সম্পর্কে যদি আপনার বিস্তারিত জানাশোনা নাও থাকে তবুও ধরে নিন বর্ননাটি তিন অবস্থার কোনো এক অবস্থায় আছে –
ক – বর্ননাটির ভুল অনুবাদ করা হয়েছে।
খ- বর্ননাটির সঠিক ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হয়নি।
গ- বর্ননাটি বানোয়াট। শিয়া, সাবাঈ বা মুনাফিকদের কোনো পক্ষ এটি বানিয়েছে।
সাহাবায়ে কেরামের সম্মানবিরোধি কোনো বর্ননা সামনে পেলে ধরে নিন এখানে এই তিনটির কোনো একটি হয়েছে। তারপর বিস্তৃত অনুসন্ধান করুন, দেখবেন আপনার ধারণা সঠিক।
সুতরাং মূলনীতি মনে রাখুন, কোরআন হাদিস সাহাবায়ে কেরামের যে সম্মান ঘোষণা করেছে ইতিহাসের কোনো বর্ননা তা বদলাতে পারে না।
২। ইতিহাসের বর্ননা আর ইতিহাসবিদের আকিদা এক নয়।
এখানে এসে আমরা অনেকেই ভুল করি। আমরা ভাবি একজন ইতিহাসবিদ তার গ্রন্থে যা কিছু উল্লেখ করেছেন তার সবটাই তিনি বিশ্বাস করেন এবং সেটিই তার অবস্থান। পরেরদিকে রচিত বিশ্লেষনধর্মী গ্রন্থের ক্ষেত্রে এ কথা সত্য হলেও শুরুর দিকে রচিত সংকলনধর্মী ইতিহাসগ্রন্থের ক্ষেত্রে এই কথা সত্য নয়। ইবনু জারির তাবারির কথাই ধরা যাক। তারিখুত তাবারিতে তিনি অনেক ধরনের বর্ননা এনেছেন। অনেকক্ষেত্রে একই বিষয়ে দুধরণের বর্ননাও এনেছেন। এ থেকে স্পষ্ট হয় তিনি শুধু বর্ননাগুলো জমা করেছেন, কোনোটা সত্যায়ন করেননি। কারণ, এক বিষয়ে বিপরীতমুখি দুধরনের মত লালন করা সম্ভব নয়। তারিখুত তাবারির ভূমিকাতেও তিনি বলেছেন, আমার এই গ্রন্থে এমন অনেক বর্ননা আছে যা পাঠক অপছন্দ করবেন। কিন্তু এগুলো আমার নিজের পক্ষ থেকে নয়, আমার কাছে যেভাবে পৌছেছে সেভাবে উল্লেখ করেছি মাত্র।(৮)
তারিখুত তাবারিতে মিথ্যুক শিয়া বর্ননাকারিদের থেকেও অনেক বর্ননা আছে। এই বর্ননাগুলোয় আছে সাহাবিদের ব্যাপারে অন্যায় অপবাদ। অনেকে এসব বর্ননা সামনে এনে বলে, দেখুন ইমাম তাবারির মত বিজ্ঞ আলেমও সাহাবিদের এসব অপরাধের স্বীকৃতি দিয়েছেন।
তাদের এ ধরণের কথা শুনে ধোঁকায় পড়বেন না। এক্ষেত্রে আপনি মূলনীতি মনে রাখুন, ইতিহাসের বর্ননা আর ইতিহাসবিদের আকিদা এক নয়। এই মূলনীতি মনে রেখে সাহাবায়ে কেরামের সম্মানে আঘাত করা থেকে বিরত থাকুন। তারপর বর্ননাটি নিয়ে তত্ত্বতালাশ করতে থাকুন। দেখবেন, ঐ বর্ননা যদি আহলুস সুন্নাহর কোনো আলেমের বইপত্র এসেও থাকে তাহলে এসেছে সংকলন হিসেবে, তার নিজস্ব আকিদা বিশ্বাস হিসেবে নয়।
অনেকে আছে মুশাজারাতে সাহাবার ইস্যু টেনে সাহাবিদের উপর আক্রমন করে মজা পায়। এমন কারো সাথে যদি আপনার দেখা হয় এবং তার সবগুলো আপত্তির জবাব আপনার জানা না থাকে তাহলে উমর ইবনু আবদুল আযিযের মত বলে দিন, আল্লাহ যে রক্ত থেকে আমার হাতকে পবিত্র রেখেছেন, আমি সেখানে আমার জবানকেও পবিত্র রাখতে চাই। কথা সহজ, এলোমেলো গবেষণা করে আকিদা-বিশ্বাসের পদস্খলন হওয়ার চেয়ে আলেমদের উপর ভরসা করে চুপ থাকা নিরাপদ।
প্রাথমিক এই দুটি মূলনীতি মাথায় রেখে এবার আমরা কারবালা প্রসঙ্গে প্রবেশ করবো। আগেই বলেছি কারবালার বিস্তারিত ইতিহাস আলোচনা করা উদ্দেশ্য নয়। বরং নির্দিষ্ট কয়েকটি বিষয়ে বিভ্রান্তি দূর করাই উদ্দেশ্য।
ইয়াযিদের ব্যক্তিত্ব
অনেকে মনে করেন ইয়াযিদ নির্দোষ ব্যক্তিত্ব। কারবালার ঘটনায় তার কোন হাত নেই। তাকে নিন্দাও করা যাবে না। এটি ভুল। এ প্রসঙ্গে আলেমদের কিছু মতামত দেখা যাক। ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বলকে ইয়াযিদ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি জবাব দেন, সে তো ঐ ব্যক্তি যে মদীনায় সবকিছু করেছিল। সে সাহাবাদের হত্যা করে এবং মদীনা লুট করে। (৯) একবার ইমাম আহমাদের ছেলে বললেন, অনেকে ইয়াযিদের প্রশংসা করে। ইমাম আহমাদ জবাব দেন, কোনো মানুষের মধ্যে সামান্যতম কল্যান থাকলেও সে কী করে ইয়াযিদের প্রশংসা করে। (১০)
ইমাম যাহাবী বলেন, ইয়াযিদ ছিল নেশাখোর। নাজায়েজ কাজে সে ছিল অভ্যস্ত। সে ছিল নাসেবি। তার জীবনে কোনো বরকত হয়নি। (১১) আল্লামা ইবনু হাজার হাইতামি ইয়াযিদকে ফাসেক, নেশাখোর ও জালিম বলেছেন। (১২) ইবনু আবেদিন শামিও ইয়াযিদকে ফিসকে লিপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে গন্য করেছেন। (১৩) আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মেরী বলেন, নিঃসন্দেহে ইয়াযিদ ফাসেক ছিল। (১৪) হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলি থানভী বলেন, ইয়াযিদ ফাসেক ছিল। (১৫) ইউসুফ বিন্নুরী রহিমাহুল্লাহ লিখেছেন, ইয়াযিদের ফাসেক হওয়ার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। (১৬) শাইখুল হাদিস আল্লামা সলিমুল্লাহ খান বলেন, ইয়াযিদ ফাসিক হওয়ার ব্যাপারে আমার কোনো দ্বিধাদ্বন্দ নেই। (১৭)
ইয়াযিদ সম্পর্কে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের অবস্থান এটিই। ইয়াযিদের ব্যাক্তিত্ব ও তার কৃত অপরাধসমূহ সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানতে পড়ুন আল্লামা আবদুর রশিদ নুমানি রচিত ‘আকাবির সাহাবা আওর শুহাদায়ে কারবালা পর ইফতেরা’ ও ‘ইয়াজিদ কি শখসিয়্যত আহলে সুন্নত কি নজর মে’। পাশাপাশি নাসেবি চিন্তার খন্ডন জানতে পড়ুন হজরতের লেখা ‘নাসিবিয়্যত তাহকিক কি ভেস মে’।
ইয়াযিদের মনোনয়ন
প্রশ্ন উঠে ইয়াযিদ যদি ফাসেক ও জালিমই হয় তাহলে হজরত মুয়াবিয়া (রা) তাকে মনোনয়ন দিলেন কেন? এটা কি তার স্বজনপ্রীতি নয়? এ প্রশ্নের জবাবে নিচের কয়েকটি কথা মাথায় রাখা যেতে পারে।
১। হজরত মুয়াবিয়া (রা) জীবিত অবস্থায় ইয়াযিদের বড় কোন পাপাচার প্রকাশিত হয়নি। (১৮)
২। খিলাফতের জন্য যে শরয়ী শর্ত দরকার ইয়াযিদের মধ্যে তা ছিল, তবে সে সময় তার চেয়েও যোগ্য মানুষ জীবিত ছিলেন।
৩। সদুদ্দেশ্য নিয়ে নিজের সন্তানকে পরবর্তী খলিফা নির্ধারণ করে যাওয়া নাজায়েজ কিছু নয়। তা জায়েজ। তবে এতে একদিকে থাকে অপবাদের সুযোগ অন্যদিকে এটা নিজের ও সন্তানের জন্য বিশাল পরীক্ষা। খোলাফায়ে রাশেদিন এজন্য নিজের সন্তানদেরকে উত্তরাধিকার মনোনিত করেননি। (১৯)
৪। আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর, হুসাইন ইবনে আলী, আবদুল্লাহ ইবনে উমর প্রমুখ হজরত মুয়াবিয়ার জীবদ্দশায় ইয়াযিদকে বাইয়াত দেননি। মুয়াবিয়া (রা) ও তাদেরকে আর চাপাচাপি করেননি। (২০)
৫। হজরত মুয়াবিয়া (রা) ইয়াযিদের পক্ষে বাইয়াত দেয়ার জন্য কাউকে ঘুষ দেননি। এ সংক্রান্ত যে বিশুদ্ধ বর্ননাগুলো পাওয়া যায় তার বাস্তবতা হলো, আগ থেকেই হজরত মুয়াবিয়া (রা) উনাদেরকে উপহার পাঠাতেন। এটি ইয়াযিদের বাইয়াতের সাথে সম্পর্কিত নয়। (২১)
কনস্টান্টিনোপল হামলার সুসংবাদ
অনেকে ইয়াযিদের প্রশংসা করতে গিয়ে বলেন সহিহ হাদিসে ইয়াযিদের জন্য সুসংবাদ আছে। নবিজি বলেছেন যারা কনস্টান্টিনোপল হামলা করবে তারা ক্ষমাপ্রাপ্ত। ইয়াযিদ কনস্টান্টিনোপলের অভিযানে উপস্থিত ছিল সুতরাং এ থেকে বুঝা যায় ইয়াযিদের ক্ষমা প্রমানিত। তার ব্যাপারে কোন খারাপ মন্তব্য করা যাবে না। এই বিষয়টিও স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন।
১। প্রথমত হাদিসে সরাসরি কনস্টান্টিনোপলের কথা বলা হয়নি। হাদিসে বলা হয়েছে, আমার উম্মতের যে দল সর্বপ্রথম কায়সারের শহরে জিহাদ করবে তারা ক্ষমাপ্রাপ্ত। (২২) কায়সারের শহর বলতে কায়সারের রাজধানী উদ্দেশ্য। নবিজির যুগে কায়সারের রাজধানী দুটি ছিল। কায়সারের এশিয়ার রাজধানী ছিল সিরিয়ার হিমস শহর, ইউরোপের রাজধানী ছিল কনস্টান্টিনোপল। যদি এই হাদিস দ্বারা হিমস উদ্দেশ্য হয় তাহলে ইয়াযিদ এই সুসংবাদ পাবে না। কারণ হিমস বিজিত হয়েছে হজরত উমর (রা) এর শাসনামলে, ইয়াযিদের তখন জন্মই হয়নি। (২৩)
যদি এই হাদিস দ্বারা কনস্টান্টিনোপলের বাহিনী উদ্দেশ্য হয় তাহলে আমরা দেখি কনস্টান্টিনোপলে প্রথম হামলা হয় হজরত উসমান (রা) এর শাসনামলে, যখন ইয়াযিদের বয়স মাত্র ৬ এবং সে এই বাহিনীতে উপস্থিত ছিল না। (২৪) এই হামলার পর কনস্টান্টিনোপলে আরো একাধিক হামলা চালানো হয় যাতে ইয়াযিদ উপস্থিত ছিল না। (২৫) ইয়াযিদ কনস্টান্টিনোপলে শুধু একটি অভিযানে উপস্থিত ছিল, আর সেটি হলো হিজরি ৫২ সনের অভিযান, যা কোনোভাবেই কনস্টান্টিনোপলে মুসলমানদের প্রথম অভিযান ছিল না। (২৬)
প্রথমত স্পষ্ট হলো হাদিসে কায়সারের শহর বলতে যে শহরই উদ্দেশ্য নেয়া হোক সুসংবাদটি ইয়াযিদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয় না।
দ্বিতীয়ত, কোনো বিষয়ে আমভাবে কোনো সুসংবাদ দেয়া হলে এটি জরুরি নয় যে সকল সদস্যের উপর সবসময়ের জন্য তা প্রযোজ্য হবে। সুসংবাদ লাভের প্রথম শর্ত হলো এর যোগ্য হতে হবে। কেউ যদি যোগ্যতা নষ্ট করে ফেলে তাহলে সে এমনিতেই এটি পাবে না। বিভিন্ন হাদিসে দেখা যায় নবিজি শহিদদের জন্য নানা ফজিলত ও ক্ষমার ঘোষনা দিয়েছেন। এবার দেখা যায় নবিজির সাথে জিহাদ করা ব্যক্তি সম্পর্কেও বলা হয়েছে সে জাহান্নামে যাবে। (২৭) অর্থাৎ, যতক্ষণ ফজিলতের শর্তগুলো পূরন করা হবে ততক্ষন তা বহাল থাকবে। কিন্তু শর্ত ভঙ্গ করা হলে ফজিলত আর প্রযোজ্য হবে না। কাইসারের শহরে জিহাদ করা সংক্রান্ত এই হাদিসের ব্যাখ্যায় আল্লামা কাসতাল্লানি লিখেছেন,
‘কোনো আম সুসংবাদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার অর্থ এই নয় যে বিশেষ কারণেও সে তা থেকে বের হবে না। এই কথায় কারো দ্বিমত নেই, নবিজি কর্তৃক ঘোষিত ক্ষমাপ্রাপ্ত হওয়ার প্রথম শর্ত হলো তার মধ্যে ক্ষমা অর্জনের যোগ্যতা থাকতে হবে। যদি কোনো ব্যক্তি এই জিহাদের পর মুরতাদ হয়ে যায় তাহলে সে এই সাধারণ সুসংবাদের অন্তর্ভুক্ত হবে না’। (২৮)
ইয়াযিদকে কোনোভাবে টেনেটুনে যদিও কনস্টান্টিনোপলের প্রথম বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করা যায় কিন্তু তার পরের জীবনে সে এত বড় বড় অপরাধ করেছে যার কারণে অবশ্যই সে এই মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হবে। ইয়াযিদের নির্দেশেই তার সেনারা মদীনা আক্রমন করেছে, সম্পদ লুণ্ঠন করেছে, রক্ত ঝড়িয়েছে, মদীনার মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তাদেরকে মদীনা ত্যাগে বাধ্য করেছে। এই অপরাধ সাধারণ অপরাধ নয়। সরাসরি নবিজির ধমকি আছে এ বিষয়ে। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি মদীনায় কোনো জুলুম করবে তার উপর আল্লাহ তার ফেরেশতা ও সকল মানুষের পক্ষ থেকে লানত। তার কোনো ফরজ ইবাদত কবুল হবে না। (২৯) অন্য হাদিসে নবিজি বলেন, যে ব্যক্তি মদীনাবাসিদের ভয় দেখাবে, আল্লাহ তাকে ভয় দেখাবেন। তার উপর আল্লাহ, ফেরেশতা এবং সকল মানুষের পক্ষ থেকে লানত। তার কোনো ফরজ বা নফল ইবাদত কবুল হবে না। (৩০)
হাররার ঘটনায় ইয়াযিদ যে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছে তার কারণে সে চরম অপরাধি। তার উপর নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এসকল বদদোয়া প্রযোজ্য। সে কোনোভাবেই কাইসারের শহরে যুদ্ধের ফজিলত পাবে না। কারণ প্রথমত সে প্রথম বাহিনীতে ছিলই না। দ্বিতিয়ত, প্রথম বাহিনীতে সে থাকলেও পরের জীবনে সে এত বড় বড় অপরাধ করেছে যার কারণে সে অবশ্যই সেই ফজিলত থেকে বঞ্চিত হবে।
প্রসঙ্গ কারবালা –ইয়াযিদ কি নির্দোষ ?
১। ইয়াযিদ সরাসরি হজরত হুসাইন (রা) কে হত্যার নির্দেশ দেয়নি। এটি ছিল কুফার গভর্নর উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত। (৩১)
২। ইয়াযিদ যদিও সরাসরি উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদকে হত্যার নির্দেশ দেয়নি কিন্তু হত্যার পর সে তাকে কোনো শাস্তিও দেয়নি। এই হত্যার কোনো বিচার সে করেনি। যা থেকে বুঝা যায় এই হত্যার মাধ্যমে পথের কাঁটা পরিষ্কার হয়েছে ভেবে ক্ষমতালোভী পাপাচারি ইয়াযিদ মনে মনে খুশিই ছিল। যদি সত্যি সত্যি ইয়াযিদ উবাইদুল্লাহর উপর অসন্তুষ্ট হত তাহলে সে এই খুনের বিচার করত।
৩। উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদও টের পেয়েছিল ইয়াযিদের মনোভাব। সে জানতো হজরত হুসাইনকে সরিয়ে ফেললে ইয়াযিদ খুশিই হবে। সে জানতো ইয়াযিদ সরাসরি নির্দেশ না দিলেও খুনের পেছনে মৌন সমর্থন দিবে। এজন্যই উবাইদুল্লাহর মত একজন আঞ্চলিক প্রশাসকও কোন অনুমতি ছাড়া আহলে বাইতের রক্ত ঝরাতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেনি। এক অপরাধি অন্য অপরাধির মনস্তত্ব ভালো করেই বুঝে। এ দিক থেকে উবাইদুল্লাহ ও ইয়াযিদ ছিল মানিকজোড়।
৪। ইয়াযিদ সরাসরি হত্যার নির্দেশ দেয়নি একথা বলে ইয়াযিদের অপরাধ আড়াল করার সুযোগ নেই। কারণ সে খুনিদের বিচার করেনি, কাউকে অপসারণও করেনি। দামেশকের দরবারে বসে হজরত হুসাইনের মৃত্যুর জন্য তার আফসোস একটি ‘রাজনৈতিক অভিনয়’ ছাড়া আর কিছুই ছিল না, তা বেশ স্পষ্ট।
টীকা
১। মুসনাদুল বাজ্জার, হাদিস ৫৭৫৩; আল-মুজামুল আওসাত, হাদিস ৪৭৭১, সনদ হাসান।
২। সহিহ মুসলিম, ২৫৪১।
৩। মুসান্নাফে ইবনু আবদির রাযযাক, হাদিস ২০৭১০; আস সুনানুল কুবরা, , হাদিস ৯২২২, হাদিসটির সনদ সহিহ। তাখরিজু আহাদিসিল মাসাবিহ, মুনাবি, ৫/২৫৮।
৪। আশ-শিফা, ২/১১০৭-১১০৮।
৫। শরহুল মুসলিম, নববি, ১৬/৩২৬; তুহফাতুল আহওয়াযি, ১০/২৪৯।
৬। আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ৮/১৪২।
৭। শারহুস সুন্নাহ, বারবাহারি, ৪৪।
৮। তারিখুত তাবারি, ১/৭।
৯। আস সুন্নাহ, ৮৪৫- আবু বকর খল্লাল।
১০। আল মাসাইল ওয়াল আজইবাতুন, ৮০ – ইবনু তাইমিয়্যা।
১১। সিয়ারু আলামিন নুবালা, ৫/৫।
১২। আস সওয়ায়িকুল মুহরিকা, ২/৬৩২।
১৩। রদ্দুল মুহতার, ৩/১৬২।
১৪। আল উরফুশ শাযি, ২/২১৩।
১৫। ইমদাদুল ফাতওয়া, ৪/৪৬৫।
১৬। মাআরিফুস সুনান, ৬/৮।
১৭। মাহনামা সফদর, ১৪ – ডিসেম্বর, ২০১৫।
১৮। মুয়াবিয়া আওর তারিখি হাকায়েক, ১১৪। তালিফাতে রশিদিয়্যা, ২৪২। আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ১১/৩০৮।
১৯। মুয়াবিয়া আওর তারিখি হাকায়েক, ১১৪।
২০। আত তারিখুল আওসাত, ১/১০৩। তারিখু খলিফা ইবনি খইয়াত, ২১৩,২১৪। আল মুজামুল আওসাত, ৩৮৮৫। সনদের মান হাসান। মাওসুয়াতু আকওয়ালি ইমাম আহমাদ, ৪/১৫৭,১৫৮।
২১। তারিখে উম্মতে মুসলিমাহ, ২/৪২৩।
২২। বুখারি, ২৯২৪।
২৩। বিস্তারিত জানতে দেখুন, ফুতুহুশ শাম, ১২২। আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৯/৬৪৯।
২৪। আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ১০/২৪৩।
২৫। এসব হামলার বিবরণ জানতে দেখুন, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ১০/১৩০-৩৭০। তারিখুত তাবারি,৪/৩০৪। আল ইবার, ১/২৪। আল মুন্তাজাম, ৫/১৯। আল বিদায়া ওয়ান নিহায়ার বিবরণ থেকে জানা যায় হজরত মুয়াবিয়া (রা) একাই কনস্টান্টিনোপলে ১৬টি অভিযান চালিয়েছেন।
২৬। ইয়াযিদের উপস্থিতির প্রমাণ মেলে মাহমুদ বিন রবি থেকে বর্নিত একটি হাদিসে। সেখানে তিনি বলেন, আমরা কনস্টান্টিনোপলের অভিযানে ছিলাম। এই অভিযানে হজরত আবু আইয়ুব আনসারি ইন্তেকাল করেন এবং ইয়াযিদ বিন মুয়াবিয়া ছিলেন আমাদের সেনাপতি। (বুখারি, ১১৮৬) এ বর্ননা থেকে জানা যায় ইয়াযিদ সেই অভিযানে অংশ নেন যে অভিযানে আবু আইয়ুব আনসারি ইন্তেকাল করেন। সর্বসম্মত মত হলো আবু আইয়ুব আনসারি ৫২ হিজরিতে ইন্তেকাল করেছেন।
২৭। একজন ব্যক্তি জিহাদের এক পর্যায়ে আহত হয়ে আত্মহত্যা করে ফেলে। তার ব্যাপারে নবিজি এ কথা বলেন। মুসনাদু আবি ইয়ালা, ৭৫৪৪।
২৮। ইরশাদুস সারি, ৫/১০৪।
২৯। সহিহ বুখারি, ৩১৭৯।
৩০। আল মুজামুল কাবির, ৭/১৪৩।
৩১। মিনহাজুস সুন্নাহ, ৪/৫৫৭। আল ফাতাওয়া লিইবনিস সালাহ, ২১৬।