মূল : মাওলানা ওয়াইস নদভি নুগরামী।
অনুবাদ : আনাস চৌধুরী
৩.
কুরআনুল করীম থেকে পরিপূর্ণরূপে ও বিশুদ্ধ আঙ্গিকে আলো গ্রহণ করতে হলে আগে হৃদয়ের মধ্যে ভীষণ একটি ব্যাকুলতা তৈরী করতে হবে, থাকতে হবে এ বানীর বরকত পরশে নিজেকে ধন্য করার প্রতি সীমাহীণ আগ্রহ ও আকুলতা। এর নির্দেশনা ও শিক্ষাগুলো লাভ করার জন্য প্রয়োজন এমন এক পিপাসিত ও অনুসন্ধিৎসু মন, যেন খুব দামি কিছু হারিয়ে গেছে আর আপনি তা খুঁজছেন হন্য হয়ে। কারণ, পবিত্র এ কালামের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেছেন— هدى للمتقين . এই কিতাব পথ দেখায় মুত্তাকীদেরকে। এখানে মুত্তাকি বলতে কাদেরকে বুঝানো হয়েছে? জগদ্বিখ্যাত ইসলামী পন্ডিত মাওলানা কাসেম নানুতবী (রহ:) বলেছেন, আয়াতে উল্লেখিত “তাকওয়া” দ্বারা পারিভাষিক তাকওয়া বুঝানো হয়নি; এখানে বরং উদ্দেশ্য হলো—তাকওয়ার শাব্দিক অর্থটি—ভয় ভীতি শংকা। এ হিসেবে আয়াতের অর্থ দাঁড়ায়—যে সকল ব্যক্তিদের অন্তরে শংকা ও ভীতি আছে, যারা নিজেদের সংশোধনের জন্য চিন্তিত ও আগ্রহী, কুরআনে কারীম তাদেরকে সরল ও সঠিক পথ প্রদর্শন করে।
তাকওয়ার এই অর্থটি প্রমাণ করতে গিয়ে তিনি খুবই সূক্ষ্ম ও মজবুত একটি প্রমাণ পেশ করেছেন। তিনি বলেন, সূরাতুল লাইলে এক জায়গায় আল্লাহ তাআলা আরবি অলংকার শাস্ত্র অনুযায়ী বৈপরীত্যের পদ্ধতি (تقابل صنعة )অবলম্বন করে কিছু আয়াত অবতীর্ণ করেছেন। যেমন প্রথমে তিনি বললেন——فَأَمَّا مَنۡ أَعۡطَىٰ وَٱتَّقَىٰ ٥ وَصَدَّقَ بِٱلۡحُسۡنَىٰ ٦. অর্থ : আর যে দান করল ও সর্তকতা অবলম্বন করল; এবং পূন্যের বিষয় সত্যায়ন করল…’। এখানে প্রথম অংশে দান করা ও তাকওয়া অবলম্বনের কথা বলা হয়েছে, দ্বিতীয় অংশে সত্যায়নের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এরপরের আয়াত দুটোতে বলা হয়েছে—وَأَمَّا مَنۢ بَخِلَ وَٱسۡتَغۡنَىٰ ٨ وَكَذَّبَ بِٱلۡحُسۡنَىٰ ٩ . অর্থ : কিন্তু যে কৃপণতা করল ও অমুখাপেক্ষিতা প্রদর্শন করল; এবং পুন্যের বিষয়কে মিথ্যা প্রতিপন্ন করল…’। এখানে প্রথম অংশে কৃপণতা ও অমুখাপেক্ষিতার কথা বলা হয়েছে এবং দ্বিতীয় অংশে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।
এই দুটো বক্তব্যকে যদি সমান করে রাখা হয়, তাহলে দেখব সত্যের বিপরীতে রয়েছে মিথ্যা এবং তাকওয়ার বিপরীতে রয়েছে ইস্তেগনা বা অমুখাপেক্ষিতা। সুতরাং, তাকওয়ার সে অর্থটিই নিতে হবে, যা ইস্তেগনার বিপরীত হয়। ইস্তেগনা মানে হলো—চিন্তা মুক্ত থাকা, নিশ্চিন্ত হওয়া, অমুখাপেক্ষী হওয়া, বেপরোয়া হওয়া; তাই শাব্দিকভাবে তাকওয়া এর অর্থ হবে—চিন্তিত হওয়া, শঙ্কিত হওয়া, সতর্ক হওয়া। (মালফুজাতে থানভী: ৭/৪৭৬)
বাস্তবেও বিষয়টি এমনই : কুরআন মাজীদ থেকে উপকৃত হওয়ার জন্য সত্যের সন্ধানে একনিষ্ঠ যাত্রা, আমাকে পেতেই হবে—এমন একটি শক্ত প্রতিজ্ঞা, যদি না পাই, আমার কী হবে?—এই শংকা ও বিপুল পিপাসা ছাড়া এ পথ পাড়ি দেওয়া সম্ভব নয়। এই একনিষ্ট যাত্রার অর্থ হলো—কুরআনুল কারীম থেকে উপকৃত হওয়ার জন্য সহায়ক সমস্ত বিষয়ে সাধ্যের সবটুকু দিয়ে প্রয়োজনীয় ধারণা ও জ্ঞান অর্জন করা, এ পথ থেকে বিচ্যুত করে এমন সকল অন্তরায় থেকে দূরে থাকা এবং বিপরীত ও সাংঘর্ষিক সমস্ত বিষয়কে বর্জন করা।
এ বিষয়ে হাফেজ জালাল উদ্দিন সুয়ূতী রহ. উলুমুল কুরআন (কুরআন সম্পর্কিত জ্ঞান) বিষয়ক তার কালজয়ী গ্রন্থ ‘আল ইতকান’-এ আল্লামা আবুল মাআলির বরাতে অতি মূল্যবান একটি বক্তব্য এনেছেন। তিনি বলেন, যদি কারো অন্তরে বিদআত অহংকার দাম্ভিকতা প্রবৃত্তির অনুসরণ ও দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসা থাকে, সে যদি প্রাত্যহিক জীবনে পাপকাজে নিমজ্জিত থাকে, দুর্বল ঈমানের অধিকারী হয়, অনুসন্ধান ও সত্য যাচাই এর গুন কম থাকে, কিংবা অনির্ভরযোগ্য ব্যাক্তিদের তাফসির গ্রহণ করে নিতে অভ্যস্ত হয়, তাহলে এ শ্রেণীর মানুষ কুরআন বুঝতে সক্ষম হবে না; কোরআনের রহস্যাবলিও তার সামনে উন্মোচিত হবে না।
আল্লামা আবুল মাআলির এই বক্তব্যের পক্ষে দলিল হিসেবে তিনি নিম্নোক্ত আয়াতটি পেশ করেছেন—
سَأَصۡرِفُ عَنۡ ءَایَـٰتِیَ ٱلَّذِینَ یَتَكَبَّرُونَ فِی ٱلۡأَرۡضِ بِغَیۡرِ ٱلۡحَقِّ وَإِن یَرَوۡا۟ كُلَّ ءَایَةࣲ لَّا یُؤۡمِنُوا۟ بِهَا وَإِن یَرَوۡا۟ سَبِیلَ ٱلرُّشۡدِ لَا یَتَّخِذُوهُ سَبِیلࣰا وَإِن یَرَوۡا۟ سَبِیلَ ٱلۡغَیِّ یَتَّخِذُوهُ سَبِیلࣰاۚ ذَ ٰلِكَ بِأَنَّهُمۡ كَذَّبُوا۟ بِـَٔایَـٰتِنَا وَكَانُوا۟ عَنۡهَا غَـٰفِلِینَ ١٤٦ أعراف
জমিনে যারা অন্যায় ভাবে অহংকার করে বেড়ায় আমার নিদর্শনসমূহ থেকে আমি তাদের অবশ্যই ফিরিয়ে রাখব।আর তারা প্রত্যেকটি নিদর্শনসমূহ থেকে আমি তাদের অবশ্যই ফিরিয়ে রাখব। আর তারা প্রত্যেকটি নিদর্শন দেখলেও তাতে ঈমান আনবে না এবং তারা সৎপথ দেখলেও সেটাকে পথ বলে গ্রহণ করবে না, কিন্তু তারা ভুল পথ দেখলে সেটাকে পথ হিসেবে গ্রহণ করবে।এটা এ জন্য যে ,তারা আমাদের নিদর্শনসমূহকে মিথ্যারোপ করেছে এবং সে সম্বন্ধে তারা ছিল উদাসীন। (সূরা আরাফ:১৪৬)
আয়াতটির ব্যাখ্যায় সুফিয়ান ইবনে উয়ায়না বলেছেন, এই চরিত্র ও স্বভাবের ব্যক্তিদের থেকে কোরআনের উপলব্ধি ও অনুধাবন ছিনিয়ে নেয়া হয়। ইতকান: ২/১৮১
তাছাড়া নিচের আয়াতটিতেও এ বিষয়ে ইঙ্গিত রয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন—(শুধু তরজমা)
إِنَّ فِی ذَ ٰلِكَ لَذِكۡرَىٰ لِمَن كَانَ لَهُۥ قَلۡبٌ أَوۡ أَلۡقَى ٱلسَّمۡعَ وَهُوَ شَهِیدࣱ ٣٧
নিশ্চয় এতে উপদেশ রয়েছে তার জন্য, যার আছে অন্তঃকরণ’ অথবা যে শ্রবণ করে মনোযোগের সাথে।
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় হাফেজ ইবনুল কায়্যিম রহ. লিখেছেন, প্রভাব বিস্তারের বিষয়টি একটি যোগিক ব্যাপার। এর জন্য একই সাথে অনেকগুলো জিনিসের প্রয়োজন হয় :
১. প্রভাব বিস্তারকারী বস্তুটি। ( المؤثِّر)
২. যার উপর প্রভাব বিস্তার করবে, অর্থাৎ—প্রভাবের ক্ষেত্র। (المؤثر فيه)
৩. প্রভাব বিস্তারের জন্য প্রয়োজনীয় শর্তগুলো উপস্থিত থাকা। (شروط التأثير)
৪. প্রভাব বিস্তারে বাধাদানকারী বস্তু বা বিষয়সমূহ না থাকা। (انتفاء موانع التأثير)
এই আয়াতে কুরআনুল কারীম থেকে উপকৃত হওয়ার ক্ষেত্রে উল্লেখিত সব বিষয়ের বিবরণ রয়েছে। যেমন, إن في ذلك لذكرى “নিশ্চয়ই এতে উপদেশ রয়েছে।” বলে প্রভাববিস্তারকারীর (المؤثر) দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। لمن كان له قلب “যার অন্তর রয়েছে” বলে প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রকে (محل التأثير) বুঝানো হয়েছে। তা হচ্ছে— জাগ্রত অন্তর।
এই আয়াতে যদিও কলব এর সাথে ‘জাগ্রত’ বন্ধনীটি নেই, কিন্তু অন্য আয়াতে তা উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন—
إِنۡ هُوَ إِلَّا ذِكۡرࣱ وَقُرۡءَانࣱ مُّبِینࣱ ٦٩
لِّیُنذِرَ مَن كَانَ حَیࣰّا وَیَحِقَّ ٱلۡقَوۡلُ عَلَى ٱلۡكَـٰفِرِینَ ٧٠
এটা তো শুধু এক উপদেশ এবং সুস্পষ্ট কুরআন; যাতে তা সতর্ক করতে পারে জীবিতকে এবং যাতে কাফিরদের বিরুদ্ধে শাস্তির কথা সত্য হতে পারে। (সুরা ইয়াসীন: ৬৯-৭০)
আর “মনোযোগসহ শ্রবণ করে” (“ألقى السمع”)
বলে বুঝানো হয়েছে যখন কথা শুনবে তখন তার মন সজাগ ও সচেতন থাকবে। কেননা উদাসীনতা ও নিশ্চিন্ত হয়ে থাকা— প্রভাব সৃষ্টিতে প্রতিবন্ধকতা তৈরী করে।
ফলে যখন প্রভাব বিস্তারকারী—কোরআন মাজীদ, প্রভাব গ্রহনের ক্ষেত্র—সজাগ ও সচেতন অন্তর, প্রভাব বিস্তার করার শর্ত—পূর্ণ মনোযোগ, এ বিষয়গুলো উপস্থিত থাকবে, এবং প্রভাব বিস্তারে বাধা—উদাসীনতা ও নিশ্চিন্ত ভাবটি অনুপস্থিত হবে, তখন ইনশাআল্লাহ কুরআন অনুধাবন ও কুরআন থেকে উপকৃত হওয়ার লক্ষ্যটি অর্জিত হয়ে একজন মানুষ কাঙ্খিত লক্ষ্যে গিয়ে উপনীত হতে পারবে।(তাফসীরে কায়্যিম-৪৪৪)
৪.
কুরআনের মুসাফিরের সামনে আরেকটি বিষয় খুব পরিস্কার থাকতে হবে—মহান এই গ্রন্থখানি থেকে আমরা আসলে ঠিক কোন ধরনের পথনির্দেশ চাই? কুরআনের মূল আলোচ্য বিষয় এবং আসল পরিচয়টি কী? এ ব্যাপারটি স্পষ্ট না থাকার কারণে কত মুসাফির কাঙ্ক্ষিত মঞ্জিলে পৌঁছুতে পারেনি। কত কত মানুষ হারিয়ে গেছে বিস্তীর্ণ মরুর বালিতে, মরীচিকাকে তৃষ্ণার জেল ভেবে। ফলাফল হিসেবে পেরেশানি ও অস্থিরতা ব্যতীত তাদের ভাগ্যে আর কিছুই জোটেনি।
এই হাকিকত হৃদয়ের গহীন ভূমিতে খুব ভালো করে গেঁথে নিই— কুরআনুল কারীমের মূল কাজ হল, মানুষকে চিরকালীন ও অনন্ত সৌভাগ্যের প্রতি আহবান করা। আল্লাহ তাআলার মহান এই কালাম মানুষের যাহির-বাতিনের জগতকে এমনভাবে নির্মাণ ও আবাদ করতে চায়, যেন পরকালীন জীবনে তাকে কোন প্রকার কষ্ট ও দুর্ভোগের মুখোমুখি না হতে হয়। মানুষকে এতটা পরিশুদ্ধ ও পবিত্র করতে চায়, যেন এই মানুষ মহান আল্লাহর শাহী দরবারে হাজির হওয়ার যোগ্য হয়ে উঠে।
সন্দেহ নেই—কোরআনুল কারীম পার্থিব জীবনের যাবতীয় মূলনীতি ও বিধিবিধান বর্ণনা করেছে। ব্যক্তিক ও সামাজিক জীবনের নীতিমালা, আকীদা-বিশ্বাস, ইবাদত-বন্দেগী, আখলাক-উত্তম আচরণ, লেনদেন, বিভিন্ন অধিকার ও শিষ্টাচার— এ সব সম্পর্কেই কোরআনে সংক্ষিপ্ত বা বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। তবে এগুলো মূল লক্ষ নয়; মূল লক্ষ্যটি হলো— পরকালীন শান্তি ও সৌভাগ্যময় জীবন।
এ কারণে কুরআন অধ্যায়ন করতে গেলেই দেখতে পাব, এসব থেকে যে বিষয়েই আলোচনা করা হয়েছে, আয়াতের শুরুতে, শেষে কিংবা মাঝখানে উল্লেখ করা হয়েছে জান্নাত জাহান্নাম, শান্তি বা শাস্তি, উৎসাহ বা ভীতি প্রদর্শনের নানা বিবরণ, সাথে উল্লেখ করা হয় প্রসঙ্গ সম্পর্কিত আল্লাহ তাআলার গুণবাচক কোন নাম।
এই পদ্ধতি অবলম্বনের উদ্দেশ্য হলো—কোরআন অধ্যয়নকারী যেন ধারাবাহিকভাবে এ বিষয়টি উপলব্ধি করতে থাকে যে, এই নিয়মনীতিগুলো অনুসরণ করলে চিরস্থায়ী শান্তির একটি জীবন লাভ করা যাবে, এবং অমান্য করলে মুখোমুখি হতে হবে পরকালে ভীষণ এক লাঞ্ছনার।
এ প্রসঙ্গে ইমাম শাতেবী রহ. বড় মূল্যবান একটি কথা লিখেছেন। তিনি বলেন—কুরআনুল কারীমের মৌলিক বিষয় তিনটি :
১. আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পবিত্র যাত ও সত্তার পরিচয়।
২. তাঁর সন্তুষ্টি লাভের পদ্ধতিসমূহের বিবরণ।
৩. মানুষের শেষ পরিণতি।
প্রথম বিষয়—আল্লাহর পবিত্র সত্ত্বার পরিচয় : এর মধ্যে আসবে আল্লাহ তাআলার নামসমূহ, তাঁর পবিত্র গুণাবলী ও তাঁর কাজ সম্পর্কিত জ্ঞান। তাছাড়া নবুওত সংশ্লিষ্ট আলোচনাও এখানে অন্তর্ভুক্ত হবে। কেননা নবুওয়ত হচ্ছে আল্লাহ তাআলা ও তাঁর বান্দাদের মধ্যকার সম্পর্কের সূত্র ও মাধ্যম।
দ্বিতীয় বিষয়—তাঁর সন্তুষ্টি লাভের পদ্ধতিসমূহ : এখানে আসবে ইবাদাত, সামাজিক সম্পর্ক, লেনদেনসহ ইত্যাদি।
তৃতীয়—মানুষের শেষ পরিণতি : এখানে মৃত্যু ও মৃত্যুর আগে পরের অবস্থা, কেয়ামত ও তার পরবর্তী বিভিন্ন পরিস্থিতি, জান্নাত-জাহান্নামের বিবরণ, উৎসাহ ও ভীতি সঞ্চারক আয়াতসমূহ। পাশাপাশি নেককার লোকদের মুক্তি ও শান্তি আর পাপাচারীদের শাস্তির বিবরণমূলক আয়াতও এই তৃতীয় প্রকারের অন্তর্ভুক্ত। (আল মুওয়াফাকাত)
এসব আলোচনার উপসংহারটি হলো এই—কোরআনুল কারিমের মূল আলোচ্য বিষয় ও সেসব আলোচনার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে সেই পথ প্রদর্শন করা, যে পথে মানুষ দুনিয়াতে এমনভাবে জীবন যাপন করতে পারবে, যা পরকালে তার মুক্তির মাধ্যম হবে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি এনে দিবে এবং পরম শান্তির ঠিকানা জান্নাতে পোঁছিয়ে দিবে।
সমগ্র দুনিয়ার সামনে কুরআনূল কারীম নিজেকে এই পরিচয়েই পেশ করেছে এবং এই বার্তাটিই দিয়েছে। আল্লাহ তাআলা বার বার কুরআনুল কারীমের এই আহবান ও আবেদনের প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এ ক্ষণে এ সম্পর্কিত কয়েকটি আয়াত পাঠ করে নিন :
ذٰلِکَ الۡکِتٰبُ لَا رَیۡبَ ۚۖۛ فِیۡہِ ۚۛ ہُدًی لِّلۡمُتَّقِیۡنَ ۙ﴿۲﴾
এটা সে কিতাব; যাতে কোন সন্দেহ নেই মুত্তাকীদের জন্য হেদায়েত। (বাকারাহ: ২)
﴿إِنَّ هَـٰذَا ٱلۡقُرۡءَانَ یَهۡدِی لِلَّتِی هِیَ أَقۡوَمُ وَیُبَشِّرُ ٱلۡمُؤۡمِنِینَ ٱلَّذِینَ یَعۡمَلُونَ ٱلصَّـٰلِحَـٰتِ أَنَّ لَهُمۡ أَجۡرࣰا كَبِیرࣰا ٩ وَأَنَّ ٱلَّذِینَ لَا یُؤۡمِنُونَ بِٱلۡـَٔاخِرَةِ أَعۡتَدۡنَا لَهُمۡ عَذَابًا أَلِیمࣰا ١٠
নিশ্চয়ই এ কুরআন হেদায়াত করে সে পথের দিকে যা সরল, সুদৃঢ় এবং সৎকর্মপরায়ণ মুমিনদেরকে সুসংবাদ দেয় যে, তাদের জন্য রয়েছে মহাপুরস্কার। আর যারা পরকালে বিশ্বাস রাখে না আমি তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছি যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। (সুরা বনি ইসরায়েল:৯-১০)
وَنُنَزِّلُ مِنَ ٱلۡقُرۡءَانِ مَا هُوَ شِفَاۤءࣱ وَرَحۡمَةࣱ لِّلۡمُؤۡمِنِینَ وَلَا یَزِیدُ ٱلظَّـٰلِمِینَ إِلَّا خَسَارࣰا﴾ [الإسراء ٨٢]
আর আমি নাযিল করি কুরআন, যা মুমিনদের জন্য আরোগ্য ও রহমত, কিন্তু তা যালিমদের ক্ষতিই বৃদ্ধি করে। (বনি ইসরায়েল: ৮২)
قُلۡ هُوَ لِلَّذِینَ ءَامَنُوا۟ هُدࣰى وَشِفَاۤءࣱۚ فصلت ٤٤
আপনি বলুন, এটা মুমিনদের জন্য পথনির্দেশক ও আরোগ্য। (সুরা ফুসসিলাত:৪৪)
یَـٰۤأَیُّهَا ٱلنَّاسُ قَدۡ جَاۤءَتۡكُم مَّوۡعِظَةࣱ مِّن رَّبِّكُمۡ وَشِفَاۤءࣱ لِّمَا فِی ٱلصُّدُورِ وَهُدࣰى وَرَحۡمَةࣱ لِّلۡمُؤۡمِنِینَ ٥٧
হে লোকসকল! তোমাদের প্রতি তোমাদের রবের কাছ থেকে এসেছে উপদেশ ও অন্তরসমূহে যা আছে তার আরোগ্য এবং মুমিনদের জন্য হিদায়াত ও রহমত। (সুরা ইউনুস: ৫৭)
মোটকথা, কুরআনুল কারীমের বিধিবিধান, শিক্ষা ও পথনির্দেশনাগুলো মূলত কোরআনের সেই বিশেষ গুণাবলী, যেগুলো কোরআনের দাওয়াতের মূল আলোচ্য বিষয়। এ বিবেচনা থেকেই শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ., শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভি রহ.-সহ বড় বড় ইমাম ও পণ্ডিতদের একটি অংশ এদিকটিকেই কুরআনুল কারীমের মোজেযারর মূল বিষয় বলে আখ্যা দিয়েছেন। ফলে, কোরআনের আয়াত সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করা অতীব জরুরী।
আল ফাউযুল কাবীর গ্রন্থে শাহ ওয়ালীউল্লাহ রহ. স্পষ্ট করে বলেছেন—কুরআনুল কারীম অবতরণের মৌলিক উদ্দেশ্য হলো—মানুষকে পরিশীলিত করা, দীক্ষা দেয়া। মানুষের ভ্রান্ত বিশ্বাস ও অন্যায় কাজ এবং আচরণকে সংশোধন করা।
শাহ সাহেব তাঁর ‘তাফহীমাত’ গ্রন্থে বিষয়টিকে এভাবে বর্ণনা করেছেন : আল্লাহ তাআলা আমাকে তাফসীরের জ্ঞান খুব সংক্ষিপ্ত শব্দে দান করেছেন। যার মূল কথাটি হচ্ছে, প্রকৃত ঈমান প্রত্যেক মানুষের অন্তরে গচ্ছিত রাখা আছে; কিন্তু বস্তুবাদী জীবনের মোহ মানুষের উপর আধিপত্য বিস্তার করে বসে। আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারীম অবতীর্ণ করেছেন এ উদ্দেশ্যে যেন মানুষ এর সাহায্যে নিজেদের এই প্রবৃত্তিকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়। (২/১২২,১২৩)
অর্থাৎ কোরআন মাজিদের মূল বিষয় বস্তু হচ্ছে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ও তাঁর বান্দাদের মধ্যকার সম্পর্ককে সঠিক মূলনীতির উপর মজবুতভাবে প্রতিষ্ঠিত করা এবং দুনিয়ার পার্থিব জীবনকে পরকালীন জীবনের সফলতার সিঁড়ি ও মাধ্যম হিসেবে গড়ে তোলা।
এখন ভেবে দেখুন, এটা কত বড় অন্যায় যে, মানুষ আজকাল হেদায়াতের আলোদানকারী মহান এই গ্রন্থটিতে প্রাচীন ও আধুনিক দর্শনের আলোচনা তালাশ করে! এখানে তারা খুঁজে জ্যোতির্বিজ্ঞানের তথ্য, বিজ্ঞানের অভিনব আবিষ্কার, ইতিহাস ও ভূগোলের সূক্ষ্ম বিষয়াদি। তারা এই দৃষ্টিকোন থেকেই কুরআনুল কারীমের সত্যতা যাচাই করতে চায় এবং এই মানদণ্ড দিয়েই এর মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব মাপ মারতে আগ্রহী
এ ধরনের প্রচেষ্টার কিছু প্রাসঙ্গিক উপকারিতা রয়েছে—আমরা সেটা অস্বীকার করছি না; কিন্তু এটা একেবারে পরিষ্কার বিষয় যে, এজাতীয় বিষয়গুলো কুরআনুল কারিমের মৌলিক আলোচ্য বিষয় নয়।
মহাগ্রন্থ আল কুরআন এসব থেকে বহু উর্ধ্বে। সন্দেহ নেই সৃষ্টিজগৎ ও তার বড় বড় ঘটনাবলী সম্পর্কে এই গ্রন্থে আলোচনা করা হয়েছে; কিন্তু এই আলোচনার ধরন ও প্রকৃতিটা কী? এ ব্যাপারে শাহ অলিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী রহ এর বিশ্লেষণ করুন পাঠ করুন।
কুরআনুল কারীম প্রকৃতিবিজ্ঞানের আলোচনাও করে থাকে, তবে কুরআনের পাঠক আর একজন দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে পার্থক্য আছে। যেমন ধরুন একজন ডাক্তার যখন পশু দেখেন, তখন তিনি এই পশুর বৈশিষ্ট্য ও গুনাগুন সম্পর্কে ভাবেন এবং অনুসন্ধান করেন; কিন্তু একজন ধনী ব্যক্তি যখন পশুকে দেখেন, তিনি চিন্তা করেন কোনটি আরোহন এর জন্য উপযুক্ত, কিংবা প্রজনন ক্ষমতা ভালো। একইভাবে কুরআনুল কারীম সৃষ্টি জগত সম্পর্কে আলোচনা ও চিন্তাভাবনা করে, তবে এর দ্বারা প্রকৃতিবিদ্যা শিখানো উদ্দেশ্য নয়; উদ্দেশ্য হলো এসবের ভিতর দিয়ে আল্লাহ তাআলার সীমাহীন ক্ষমতা জ্ঞান ও প্রজ্ঞা তুলে ধরা। এ ছাড়া এসবের আর কোন উদ্দেশ্য নেই।
এতো ছিল কুরআনুল কারীমে পৃথিবী ও জ্ঞান-বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনার কথা। শাহ ওলিউল্লাহ দেহলভি রহ. সেসব ব্যক্তিদের ব্যাপারেও অভিযোগ করেছেন, যারা কুরআন অধ্যয়ন করতে গিয়ে এতে উল্লেখিত দীনি জ্ঞানেরও বিভিন্ন শাস্ত্রে এত বেশি নিমগ্ন হয়ে যান যে, এতে কুরআনের মূল উদ্দেশ্যটিই শেষ পর্য়ন্ত তাদের হাত ছাড়া হয়ে যায়।
কুরআনুল কারীমে বর্ণিত ঘটনাবলী সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, এতে বর্ণিত ঘটনাসমূহের বিস্তারিত আলোচনা করা হয়নি; শুধু গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় অংশটুকুই উল্লেখ করা হয়েছে। এর পিছনে হেকমত হল—একটি ঘটনাকে যদি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়, তাহলে
মানুষ ঘটনার মধ্যে আটকে যাবে। কিন্তু এর যে মূল উদ্দেশ্য—ঘটনাটি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা, এ ব্যাপারে উদাসীনতা ও অমনোযোগিতা দেখা দিবে। এক বুজুর্গ বলেছিলেন—যখন থেকে মানুষ তাজবীদ ও কায়দা-কানুন নিয়ে বাড়াবাড়ি রকমের মগ্ন হয়ে গেল, তখন কোরআন তেলাওয়াতের নম্রতা ও কোমলতা অবশিষ্ট রইলো না; এবং মুফাসসিরগণ যখন তাফসীর করতে গিয়ে দূর-দূরান্তের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনা শুরু করলেন, তখন তাফসীর শাস্ত্রটিও প্রাণহীন হয়ে পড়লো। (আল ফাওজুল কাবীর)
তাই, কুরআন অধ্যয়ন করতে গিয়ে আমাদেরকে খুব সচেতন থাকতে হবে, যেন আমাদের দৃষ্টি সবসময় কুরআনের মূল আলোচ্য বিষয় ও উদ্দেশ্যটির উপরে থাকে। অন্যথায় হয়তো নানা জ্ঞান অর্জিত হবে, কিন্তু কুরআনের প্রদর্শিত মাঞ্জিলে মাকসুদটিতে পোঁছুতে পারব না।
চলবে ইনশাআল্লাহ..