কোয়ান্টাম মেথড: কুফরের ভিতর কুফর
শয়তানের সবচেয়ে বড় সফলতা হলো একজন মানুষকে ইমানের আলো থেকে বের করে কুফরের অন্ধকারে নিমজ্জিত করা। জান্নাতের অসীম নেয়ামত থেকে বঞ্চিত করে অনন্তকালের জন্য মানুষকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করার সর্ব ব্যবস্থা করা। এই প্রতিজ্ঞা করেই অভিশপ্ত শয়তান তার কাজে নেমে পড়েছে। এবং কিয়ামত পর্যন্ত সে এই কাজ নিরবিচ্ছন্ন করে যাবে কোনোরকম বিশ্রাম ও অবসর ছাড়াই। শয়তানের সে প্রতিজ্ঞার খবর কুরআন মানুষকে জানিয়ে দিয়েছে। যেনো মানুষ সর্বদা আল্লাহর রহমতের আশ্রয় নিয়ে শয়তানের সবরকম কুটচাল থেকে বেঁচে থাকতে পারে। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে,
قَالَ فَٱخۡرُجۡ مِنۡهَا فَإِنَّكَ رَجِيم وَإِنَّ عَلَيۡكَ لَعۡنَتِيٓ إِلَىٰ يَوۡمِ ٱلدِّينِ قَالَ رَبِّ فَأَنظِرۡنِيٓ إِلَىٰ يَوۡمِ يُبۡعَثُونَ قَالَ فَإِنَّكَ مِنَ ٱلۡمُنظَرِينَ إِلَىٰ يَوۡمِ ٱلۡوَقۡتِ ٱلۡمَعۡلُومِ قَالَ فَبِعِزَّتِكَ لَأُغۡوِيَنَّهُمۡ أَجۡمَعِينَ
(হে ইবলিস!) তুমি এখান থেকে বের হয়ে যাও। কেয়ামত পর্যন্ত তোমার উপর আমার লানত। ইবলিস বললো, হে আমার রব! আমাকে অবকাশ দিন। আল্লাহ তায়ালা বললে, নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তুমি অবকাশপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত। ইবলিস বললো, আপনার ইজ্জতের কসম, আমি সমস্ত মানব জাতিকে ধ্বংস পথভ্রষ্ট করবো।(১)
কিন্তু কুরআনের অসংখ্য স্পষ্ট ঘোষণার পরেও বিভিন্ন কারণে মানুষ শয়তানের ফাঁদে ‘পা’ দিচ্ছে। শয়তানের তৈরি নিত্যনতুন ফিতনার জালে সে ফেঁসে যাচ্ছে। হরেক রঙ আর ঢঙের ফিতনাকে এমনভাবে পেশ করা হচ্ছে মানুষ ধরতেই পারছে না ফিতনার আসল রূপ। কারণ ফিতনার স্বভাবই হলো তা স্বরূপে আসে না। নানান সৌন্দর্য আর অবর্ণনীয় মোহের ভেতর দিয়ে তা বিকশিত হয়। কখনো আসে উদারতা, প্রেম, ভালোবাসা, শান্তি সম্প্রীতির নামে, কখনো চিকিৎসার নামে, সামাজিক কাজ, মনের চিকিৎসা, জীবন যাপনের বিজ্ঞান ও আন্তঃধর্মীয় ঐক্যের নামে। ইমান আর কুফরকে এতটাই সংমিশ্রণ করে ফেলা হয় যে, সহজে বুঝে উঠা কষ্টকর।
শয়তান চায় মানুষের মাঝ থেকে ইমান কুফরের সংমিশ্রণ শেষ হয়ে যাক। উঠে যাক সমস্ত পার্থক্য রেখা যাতে অতি সহজেই মানুষের ইমানকে সে হরন করতে পারে। আর এইজন্যই সে অথবা তার মনুষ্য খন্নাসেরা খুব চাতুরতার সাথে এমন সব ফিতনাহ উদ্ভাবণ করে যা ইসলামের ভিতরে রেখেই মানুষের ইমানকে ধ্বংস করে দিতে পারে—মানুষ ভাবতে থাকে সে ইমানের ছায়াতলেই আছে, অথচ সে কুফরে লিপ্ত হয়ে ইমান হারিয়ে ফেলছে। বর্তমানে মুসলিম বিশ্ব সবচেয়ে বড় যে ফিতনার শিকার, তা হলো দ্বীনের আশ্রয়ে দ্বীনের নামেই ইমান কুফরের সংমিশ্রন এমনভাবে ঘটিয়ে ফেলা, যাতে মানুষ ঐ কুফরি কাজটি করাকেই ইমানের একটি দায়িত্ব মনে করে। ইমানি দায়িত্ব থেকেই সে কাজটি করতে থাকে।
ইসলামের সাথে বাহ্যত কিছু মিল রেখে মুমিনকে এই ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা করে হয়। বলা হয় কাজটি ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক কিছু নয়। আর বেখবর মানুষরা তা দেখে সহজেই ধোঁকায় পড়ে যায়। কোয়ান্টাম মেথড ঠিক এমনই এক ফিতনা। কোয়ান্টাম মেথডের লোকেরা মানুষকে এই কথা বুঝানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যে, কোয়ান্টাম মেথড পুরোটা ধর্মীয় বিধিনিষেধ পালন করেই তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে। ৩০০ কোর্স পূর্তি স্মারকে তারা উল্লেখ করে, “তাই নিঃসংশয়ে বলা যায়, মানবিক চেতনা শাশ্বত ধর্মীয় বীজ থেকে অঙ্কুরিত, আধুনিক নিজ্ঞানিক নির্যাসে লালিল। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কোয়ান্টামের দিক-নির্দেশনা ধর্মসম্মত।’’(২)
কিন্তু তাদের এই বক্তব্য আগাগোড়া পুরোটাই ধোঁকা আর মানুয়ষের ইমান হরনের শয়তানী চক্রান্তের একটি নতুন ধাপ তা ইনশাআল্লাহ প্রবন্ধে স্পষ্ট করা হবে।
কোয়ান্টাম মেথড পরিচিতি :
কোয়ান্টাম মেথড মেডিটেশন বা যোগ ব্যায়ামের এক ভিন্ন সংস্করণ যা ১৯৭৩ সালে প্রসিদ্ধ জ্যোতিষী ও রাশিফলগণক মহাজাতক শহীদ আল বোখারী পরিকল্পনা ও তত্ত্ববধানে শুরু হয়। শুরু দিকে কোয়ান্টাম ছিলো শুধুই একটি ধ্যানভিত্তিক কার্যক্রম। হিন্দুদের যোগ সাধনার মত করে কিছু জপ আউড়িয়ে আধ্যাতিক কিছু প্রশান্তি অর্জন করার কথা তারা বলতো। কিন্তু ধাপাধাপে বিভিন্ন ধর্মীয় স্লোগান তারা যোগ করতে থাকে। প্রচার করতে থাকে, কোয়ান্টাম মেথড বা আমাদের এই যোগ ব্যায়াম ধর্মের সাথে সাংঙ্গর্ষিক নয়। এবং আমরা কোনো ধর্মের প্রতিই বিদ্বেষ রাখি না। বরং সকল ধর্মই আমাদের কাছে শ্রদ্ধাশীল ও সত্য।
কোয়ান্টাম মেথড কী :
কোয়ান্টাম মেথড কি তা এক কথায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কোয়ান্টাম মেথডের বই পত্রে কোয়ান্টামকে বিভিন্নভাবে পরিচিয় দেওয়া হয়। এক জায়গায় তারা বলে, “কোয়ান্টাম মেথড হলো মনের অসীম শক্তিকে ব্যবহারের সবচেয়ে সহজ ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি।’’(৩)
কোয়ান্টাম কী তার উত্তরে তাদের অন্য বইতে বলা হয়, “এক কথায় কোয়ান্টাম হচ্ছে ভালো থাকার বিজ্ঞান। সবসময় ‘ভালো আছি’ বলতে পারা, ইচ্ছেমতো নিজেকে বদলাতে পারা, নিজের চাওয়াকে পাওয়ায় পরিণত করার সহজ সরল বিজ্ঞান।’’(৪)
কোয়ান্টাম মেথডের প্রতিষ্ঠাতা ও ইতিহাস :
কোয়ান্টাম মেথডের প্রতিষ্ঠাতা হলো শহীদ আল বোখারী। যার মূল নাম শহিদ উল্লাহ বলেই জানা যায়।(৫) সাংবাদিক হিসেবে তারা কর্মজীবন শুরু হলেও একসময় বিভিন্ন বিজ্ঞানিক থিউরি আর নিজস্ব কিছু পদ্ধতি দিয়ে সে তৈরি করে এই কোয়ান্টাম মেথড। তার কর্মজীবন ও ব্যক্তিত্ব অনেকটা ধোঁয়াশাতেই রাখা হয়েছে। কোয়ান্টামের বইগুলোতে তার সম্পর্কে বিস্তারিত কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে ‘নিমারোলজি সংখ্যা’ নামক এক বইয়ে শহীদ আল বোখারীর পরিচয় দেওয়া হয় এভাবে, “বরেণ্য ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা মহাজাতক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের মর্মান্তিক মৃত্যু, মহাশূন্যযান চ্যালেঞ্জারের দূর্ঘটনা, সোভিয়ত ইউনিয়নে সমাজতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সূচনা, পূনর্নিবাচনে জজ বুশের ভরাডুবিসহ অসংখ্য নির্ভুল ভবিষ্যদ্বাণীর মাধ্যমে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এক অনন্য মর্যাদার আসনে আসীন হয়েছেন। জ্যোতিষ বিজ্ঞান, যোগ, মেডিটেশন, প্রকৃতিক নিরাময় তথা অতীন্দ্রিয় বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় রয়েছে তার স্বচ্ছন্দ বিচরণ। …… দৈনিক ইত্তেফাকে নিয়মিত রাশিফল ও বর্ষশুরুতের ভবিষ্যদ্বাণী লিখে আসছেন ১৯৭৭ সাল থেকে।
শহীদ আল বোখারী কর্মজীবন শুরু করেন সাংবাদিক হিসেবে। সাইকিক কনসালটেন্ট হিসেবে সার্বক্ষনিক কাজ শুরু করার আগে তিনি ছিলেন দেশের প্রাচীনতম দৈনিক আজাদের বার্তা সম্পাদক। ১৯৮৩ সাল থেকে জ্যোতিষ বিজ্ঞান পাশাপাশি যোগ ও মেডিটেশনকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্যে স্থাপন করেন যোগ মেডিটেশন কেন্দ্র। পরে এই প্রচেষ্টাকে আরও সংহত করার জন্যে প্রতিষ্ঠা করেন যোগ ফাউন্ডেশন। তিনি মেডিটেশন ও মননিয়ন্ত্রনের সহজ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি “কোয়ান্টাম মেথড”-এর উদ্ভাবক ও সফল প্রশিক্ষক।’’(৬)
কোয়ান্টামের এই বইতে শহীদ বোখারীর যে পরিচয় দেওয়া হয় তার মাঝে কয়েকটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
১. ভবিষ্যৎদ্রষ্টা।
২. রাশিফল দেখে বা মহাজাতক। (ভাগ্য গণক)
৩. অসংখ্যা নির্ভুল ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন।
৪. অতিন্দ্রীয় (গায়েবী বিষয়ে) বিজ্ঞানের জ্ঞান রাখে।
উপরোক্ত চারোটি গুণ ইসলামের সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। যার একটিও যদি কোনো মুমিন বিশ্বাস করে তাহলে তার ইমান থাকবে না। সংক্ষিপ্তভাবে এখানে এই কুফরিগুলো নিয়ে আলোচনা করা হবে।
ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা ও গায়েবের খবর :
আল্লাহর ব্যাপারে একজন মুমীনের জন্য যে সকল বিশ্বাস রাখা ইমানের পূর্ব শর্ত তার মধ্যে অন্যতম হলো এই বিশ্বাস যে, আল্ললাহই একমাত্র গায়েবের খবর রাখেন। এবং মানুষের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একমাত্র তিনিই জ্ঞান রাখেন। এছাড়া কোনো মানুষের পক্ষে এই গুন অর্জন সম্ভব নয়। চাই সে নবী-রাসুলই হোক না কেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
ﵟوَعِندَهُۥ مَفَاتِحُ ٱلۡغَيۡبِ لَا يَعۡلَمُهَآ إِلَّا هُوَۚ وَيَعۡلَمُ مَا فِي ٱلۡبَرِّ وَٱلۡبَحۡرِۚﵞ
তার কাছে রয়েছে গায়বের চাবিসমূহ, তিনি ছাড়া এ বিষয়ে কেউ জানে না। এবং তিনি অবগত রয়েছেন স্থল ও সমুদ্রে যা কিছু রয়েছে।(৭)
অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা বলেন,
ﵟقُل لَّا يَعۡلَمُ مَن فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ ٱلۡغَيۡبَ إِلَّا ٱللَّهُۚ ﵞ
হে নবী আপনি বলুন, আসমান ও জমীনে যারা রয়েছে তারা কেউ গায়েবের খবর জানে না। শুধু আল্লাহই গায়েবের খবর জানেন।(৮)
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় আব্দুর রহমান আসসাদী রহ. (মৃত্যু ১৩৭৬ হি.) বলেন,
فهذه الغيوب ونحوها اختص الله بعلمها فلم يعلمها ملك مقرب ولا نبي مرسل
গায়েব সম্পৃক্ত যা আছে তা শুধু আল্লাহর ইলমের সাথেই খাস। গায়েবের জ্ঞান নিকটতম ফেরেশতা ও নবি-রাসুলগণও জানে না।(৯)
আল্লামা শামী রহ. (মৃত্যু ১২৫২ হি.) গায়েবের দাবীকারী ব্যক্তির ব্যাপারে বলেন,
وحاصله أن دعوى علم الغيب معارضة لنص القرآن فيكفر بها، إلا إذا أسند ذلك صريحا أو دلالة إلى سبب من الله تعالى كوحي أو إلهام، وكذا لو أسنده إلى أمارة عادية يجعل الله تعالى
যে ব্যক্তি দাবী করবে সে গায়েব জানে তাকে তাকফির করা হবে। (অর্থাৎ সে কাফের হয়ে যাওয়ার কারণে ওলামায়ে কেরাম তাকে কাফের ঘোষণা করবে।)(১০)
গণক ও ভাগ্য বক্তা ও তাদের নিকট যাওয়ার বিধান :
শহীদ বুখারীর পরিচয়ে এই কথা বলা হয়েছে সে ভবিষ্যদ্বাণী করে এবং সে রাশিফল দেখে ভাগ্য বলতে পারে। অথচ উভয়টি ইসলামের দৃষ্টিতে কুফর। শুধু তাই নয়, কেউ যদি এসমস্ত ভাগ্য গনকের কাছে বা ভবিষ্যৎ বলে দেওয়া ব্যক্তিদের কাছে যায় এবং তাদের বলা কথা বিশ্বাস করে তাহলে সে কাফের হয়ে যাবে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
عن أبي هريرة، والحسن، عن النبي صلى الله عليه وسلم قال: ” من أتى كاهنا، أو عرافا، فصدقه بما يقول، فقد كفر بما أنزل على محمد
যে ব্যক্তি কোনো গণক বা ভাগ্যবক্তা বা ভবিষ্যদ্ববানী করে তাদের নিকট যায় এং তাদের কথা সত্যায়ণ ও বিশ্বাস করে তাহলে তাহলে সে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর অবতীর্ণ দ্বীনের প্রতি কুফরি করলো।(১১)
আল্লামা শামী রহ. (মৃত্যু ১২৫২ হি.) গণক ও তাদের কথার উপর বিশ্বাস স্থাপনকারীদের সম্পর্কে লেখেন,
والحاصل أن الكاهن من يدعي معرفة الغيب بأسباب وهي مختلفة فلذا انقسم إلى أنواع متعددة كالعراف. والرمال والمنجم: وهو الذي يخبر عن المستقبل بطلوع النجم وغروبه، والذي يضرب بالحصى، والذي يدعي أن له صاحبا من الجن يخبره عما سيكون، والكل مذموم شرعا، محكوم عليهم وعلى مصدقهم بالكفر. وفي البزازية: يكفر بادعاء علم الغيب وبإتيان الكاهن وتصديقه. وفي التتارخانية: يكفر بقوله أنا أعلم المسروقات أو أنا أخبر عن إخبار الجن إياي اهـ
অর্থাৎ, গণক বলা হয় যে বিভিন্ন মাধ্যমে গায়েব জানার ব্যাপারে দাবী করে।… এদের এবং এদের কথা যারা বিশ্বাস করবে তারা কাফের হয়ে যাবে।(১২)
কোয়ান্টাম মেথডের প্রতিষ্ঠাতার সারাজীবনের কর্ম ও তার ভক্তদের দেওয়া সাক্ষী থেকে স্পষ্ট এই কথা বলা যায়, শহীদ বুখারী আর যাই ছিলো মুসলিম ছিলো না। আর এ থেকেই এই ফাউন্ডেশন ও তার কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে ইসলামের বিধানের একটি ছক হয়ে যায়। কিন্তু বিষয়টির ভয়বহতার প্রতি লক্ষ্য করে কোয়ান্টাম মেথডের কুফরি কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আরেকটু বিস্তারিত আলোচনা করার প্রয়োজন।
কোয়ান্টাম মেথডের মৌলিক কুফরী :
কোয়ান্টাম মেথড মৌলিকভাবে দুটো কুফরি সমাজে প্রচার করছে। এক. আন্তধর্ম তথা সকল ধর্ম সঠিক ও সম্মানের। দুই. নফসের পুঁজা করে এমন অসীম শক্তির অধিকারী হওয়া যা দিয়ে ব্যক্তি সব কিছু করতে সক্ষম। দেখা অদেখা সব কিছুর উপর নিয়ন্ত্রণ নিতে সম্ভব। এমনকি এর মাধ্যমে ব্যক্তি মৃত্যুর হাত থেকেও ফিরে আসতে পারবে। এই দুই কুফরি সামনে রেখেই তাদের সকল আকিদা বিশ্বাস ও কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
প্রথম কুফরি : মনপূজা
কোয়ান্টামের সংজ্ঞায় তারা বলেছে বিজ্ঞানিক পদ্ধতির মাধ্যমে তারা নিজেকে এমন স্তরে নিয়ে যাবে যেখানে সে যা ইচ্ছা করতে পারবে, যা ইচ্ছে বদলাতে পারবে। অর্থাৎ এই মৌন শক্তির মাধ্যমে তার মনটাই হয়ে উঠবে ইলাহ। যার সকল কিছু করার অধিকার আছে, তাকদির পরিবর্তন করে ফেলতে পারবে, এমনকি পারবে মৃত থেকে মানুষকে জীবিত করে ফেলতে। কোয়ান্টামের এই বিশ্বাসের মূলে রয়েছে এই আকিদা যে, “মানুষের মনের শক্তি অসীম”(১৩)।
আর এই অসীম শক্তির সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে সে দৃশ্য ও অদৃশ্যের সকল কিছুর উপর নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। নিজের সকল রোগ সে ভালো করে ফেলতে পারে। তাকদির পরিবর্তন করতে পারে। এমনকি পারে মৃত থেকে নিজেকে জীবত করে ফেলতে। দেখতে পারবে নিজের ভবিষ্যৎ। অর্থাৎ কোয়ান্টামের মাধ্যমে মনের শক্তি অর্জন করে ব্যক্তি এমন এক অসীম ক্ষমতার অধিকারী হয়ে যেতে পারবে যা একমাত্র আল্লাহর সিফাত।
কোয়ান্টামের আকিদার কিছু অংশ তাদের উদ্ধৃতিসহ দেখলে মনের অসীম শক্তি দ্বারা তাদের উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়ে যাবে।
নমুনা ১ : ধ্যানের মাধ্যমে অর্জিত মনের শক্তি সকল কিছু করে ফেলা সম্ভব :
“শিথিলায়ন পুরোপুরি আয়ত্ত হলেই আপনি মনের শক্তি বলয় নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি হাতে পাবেন। এ চাবিকাঠির অপর নাম হচ্ছে মনের ধ্যানাবস্থা। ধ্যানাবস্থায় মন হয় ত্রিকালদর্শী, চেতনা অতিক্রম করে সকল বস্তুগত সীমা। মনের এই ধ্যানাবস্থার শক্তিকে প্রয়োগ করেই প্রাচ্যের সাধক-দরবেশ-ঋষিরা একদিন আপতদৃষ্টিতে অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। ইচ্ছে করেছেন-ঘটনা ঘটেছে। ইচ্ছে করেছেন-মানুষ রোগমুক্ত হয়েছে। ইচ্ছে করেছেন-বিপদ কেটে গেছে। ইচ্ছে করেছেন-সুযোগ এসেছে, সাফল্য এসেছে। এপনিও এই চাবিকাঠিকে কাজে লাগিয়ে সকল স্ব-আরোপিত সীমাবদ্ধতা ও স্বসৃষ্ট ব্যর্থতাকে (আপনার সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতা মূলত স্ব-আরোপিত ও স্বসৃষ্ট) নিজেই অতিক্রম করবেন।(১৪)
পর্যালোচনা :
ব্যর্থতা ও সফলতা, বিপদ ও তার থেকে মুক্তি, কোনো কিছু ইচ্ছে করলে তা করার তাওফিক—একজন মুসলিমের আকিদা হলো এই সবকিছু আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়। মানুষের চাওয়ার সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
أَمۡ لِلۡإِنسَٰنِ مَا تَمَنَّىٰ فَلِلَّهِ ٱلۡأٓخِرَةُ وَٱلۡأُولَىٰ
মানুষের জন্য তা কি হয় সে যা চায়? বস্তুত দুনিয়া ও আখিরাতের সবকিছুই আল্লাহরই।-সূরা নাজম আয়াত নং ২৪,২৫
আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন,
وَمَا تَشَآءُونَ إِلَّآ أَن يَشَآءَ ٱللَّهُ رَبُّ ٱلۡعَٰلَمِينَ
আর তোমরা কোনো ইচ্ছে করতে পারো না, যদি না সৃষ্টি কূলের রব আল্লাহ ইচ্ছে করেন।(১৫)
ইমাম তহাবী রহ. (মৃত্যু ৩২১ হি.) লেখেন,
وكل شيء يجري بتقديره و مشيئته، و مشيئته تنفذ لا مشيئة للعباد إلا ما شاء لهم، فما شاء لهم كان، وما لم يشأ لم يكن
সবকিছু আল্লাহর ইচ্ছা এবং নির্ধারণ অনুযায়ী পরিচালিত হয় এবং তাঁর ইচ্ছাই বাস্তবায়িত হয়-বান্দার ইচ্ছা বাস্তবায়িত হয় না। সুতরাং মাখলুকের জন্য তিনি যা চান তা-ই হয়, আর যা চাননা তা হয়না।(১৬)
এই আয়াতগুলো ও ইমাম তহাবীর বক্তব্য -যা আহলুস সুন্নাহের সকল নিকট গৃহিত- থেকে স্পষ্ট মানুষ তার ইচ্ছে শক্তির মাধ্যমে চাইলেই কিছু করতে পারে না, যতক্ষণ আল্লাহ তায়ালা তা করার তাকে তাওফিক দেয়। এবং মানুষের ইচ্ছা শক্তিও সীমাবদ্ধ আর তা আল্লাহর কাছে দায়বদ্ধ। মানুষের মনের মধ্যে আল্লাহ এমন কোনো শক্তি রাখেনি যার মাধ্যমে মানুষ কোনো এমন কিছু করতে পারবে যা শুধুই আল্লাহর গুণ। কোনো মুমিন যদি উপরের কোনো একটি বিশ্বাস করে তাহলে সে আর মুমিন থাকতে পারবে না।
নমুনা ২ : মনের শক্তির মাধমে সুস্থতা অর্জন করতে পারবে
“শুধু সাফল্য নয়, দেহের ওপরও বিশ্বাসের শক্তি অপরিসীম। বিশ্বাস আপাতদৃষ্টিতে দুরারোগ্য ব্যাধিকেও নিরাময় করে দিতে পারে। হোলেন কেলার বিশ্বাস করতেন যে, তিনি কথা বলতে শিখতে পারবেন। যদিও তার দৃষ্টি, শ্রবণ ও বাকশক্তি বিনষ্ট হয়েছিলো। তার বিশ্বাস ও প্রচেষ্টাই তার বাক শক্তি পুনরুদ্ধার করে। তিনি কথা বলতে শিখেন।’’(১৭)
পর্যালোচনা :
অথচ কুরআনের স্পষ্ট ঘোষণা হলো,
ﵟوَإِذَا مَرِضۡتُ فَهُوَ يَشۡفِينِ ﵞ
যখন আমি অসুস্থ হই তখন তিনিই -আল্লাহই- আমাকে সুস্থতা দান করেন।(১৮)
নমুনা ৩ : মৃত ব্যক্তিকে জীবন দানের ক্ষমতা :
“শুধু পঙ্গুত্ব নয়, শুধু রোগ থেকে মুক্তি নয়, মনের শক্তি ও বিশ্বাস মানুষকে ক্লিনিক্যালি ডেড বা মৃত অবস্থা থেকেও জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারে। এজন্যে প্রয়োজন শুধু নিজের ওপর বিশ্বাস। এর জ্বলন্ত প্রমাণ বাংলাদেশে ফলিত মনোবিজ্ঞানের পথিকৃৎ এবং আত্মউন্নয়নের ধ্যানপদ্ধতি প্রয়োগের প্রবর্তক প্রফেসর এম ইউ আহমেদ। তিনি ‘ক্লিনিক্যালি মৃত্যুবরণ’ করার পরও পুনরায় জীবন লাভ করেছিলেন ১৯৭৩ সালের ২৬ মার্চ ৬৪ বছর বয়সে।’’(১৯)
পর্যালোচনা :
কুরআন ও ইসলামি আকিদার সম্পূর্ণ বিরোধী একটি বিশ্বাস, যেটা দ্বীনের জ্ঞান রাখে এমন একজন সাধারণ মুমিনও বুঝতে পারবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
ﵟوَٱللَّهُ يُحۡيِۦ وَيُمِيتُۗ وَٱللَّهُ بِمَا تَعۡمَلُونَ بَصِيرٞ ﵞ
আল্লাহই জীবন দান করেন এবং তিনিই মৃত্যু দান করেন। এবং তোমরা যা করো তিনি তা দেখেন।()
ইমাম তাহাবী রহ. (মৃত্যু ৩২১ হি.) লেখেন,
أنه محيي الموتى بعد ما أحيى
আল্লাহই মৃতকে জীবন দান করেন তাকে জীবন দেওয়ার পর।(২০)
কোয়ান্টামে মৃত্যু সম্পর্কে যে আকিদা লেখা হয়েছে তা সম্পূর্ণ ভুল ও কুফরি একটি মতবাদ। কোনো মুমিন এমন কিছুতে বিশ্বাস করতে পারেনা। প্রবন্ধের সংক্ষিপ্ততার জন্য মাত্র তিনটি নমুনা উল্লেখ করা হলো। এধরনের কুফরি আকিদা কোয়ান্টামের আরো অসংখ্য রয়েছে।
নমুনা ৪ : কোয়ান্টাম সেন্টার যেখানে বসে ভবিষ্যত দেখা যায় ও অন্যের দুনিয়ার যেকোনো বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা যায়
“কমান্ড সেন্ট্রারকে এককথায় বলা হয়, মনের বাড়ির শক্তি ও কল্যাণকেন্দ্র। মানব অস্তিত্বের যে অংশ স্থান-কালে (Time and space) আবদ্ধ নয়, সে অংশ এই কমান্ড লেভেলে প্রকৃতির নেপথ্য স্পন্দন ও নিয়মের সাথে সহজেই যোগাযোগ স্থাপন করে। আর আপনি জানেন, দৃশ্যমান সবকিছুর পেছনেই সক্রিয় রয়েছে প্রকৃতির এই নেপথ্য স্পন্দন ও নিয়ম। স্থান-কালের সীমা অতিক্রম করে যোগাযোগ, তথ্যনুসন্ধান এবং নিজের ও মানবতার কল্যাণের সকল প্রক্রিয়া সম্পাদনের প্রয়োজনীয় সব উপাদানই রয়েছে এখানে।…. কমান্ড সেন্টার মনের বাড়ির মূল শক্তি কেন্দ্র। মনের বাড়ির ড্রইংরুমের বাম দিকের কোনায় অবস্থিত দরজা দিয়ে ১০ থেকে ০ পর্যন্ত গণনা করে অন্তান্ত সুরক্ষিত কমান্ড সেন্টারে প্রবেশ করতে হয়। … এখানে আপনার জন্যে একটি বিশেষ চেয়ার, অন্তর্গুরুর জন্যে বিশেষ চেয়ার, তিনটি মনিটরিং স্ক্রিন, ডান দিকের কোনায় ‘রহম বলয়’ বা আশীর্বাদ বলয় বা ‘প্লেস অব ব্লিস’,….চেয়ারের হাতলে বা চেয়ারের সামনে টেবিলে সব রিমোর্ট কন্ট্রোল সুইচ। চেয়ারের সামনে তিনটি মনিটরিং স্ক্রিন। বামেরটি অতীতের সবকিছু দেখার জন্যে। মাঝেরটি বর্তমান আর ডানে ভবিষ্যৎ দেখার জন্য। … এছাড়া মানুষের নিরাময় ও সার্বিক কল্যাণ সাধনের জন্য যা যা উপকরণ প্রয়োজন তা সবই এখানে রয়েছে।’’(২১)
মনের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে মানুষ স্থান-কালের উর্ধ্বে গিয়ে মনের ইচ্ছে শক্তি দিয়েই যে কয়টি কাজ করতে পারবে বলে এখানে উল্লেখ করা হয়েছে,
১. অন্যের সাথে যোগাযোগ।
২. বিভিন্ন গোপন তথ্য অনুসন্ধান।
৩. মানবতার কল্যাণে যেকোনো কাজ।
৪. নিজের ও অন্যের ভবিষ্যৎ দেখতে পারবে।
৫. অন্য মানুষকে সুস্থ করে তুলতে পারবে।
কোয়ান্টাম মনের অসীম শক্তি দ্বারা কি বুঝায় ও কোয়ন্টাম থেকে তাদের কি উদ্দেশ্য, তা স্পষ্ট হয় এই কোয়ন্টাম সেন্টারের আকিদাগুলো থেকে। মনের ব্যাপারে এই প্রতিটি আকিদা যে, ইসলামের দৃষ্টিতে ভ্রান্ত ও কুফর তা উপরের আলোচনা থেকে একদম স্পষ্ট তাই এখানে পূনরাবৃত্তির প্রয়োজন অনুভব করছিনা।
মোট কথা কোয়ান্টাম মেথডের মৌলিক কুফরি হলো তারা মনকে ইলাহ হিসেবে গ্রহণ করে এবং বিভিন্নভাবে শিরনামে মনের পূঁজার শিক্ষাই এখানে দেওয়া হয়। আল্লাহ তায়ালা এই ধরনের কুফরে লিপ্ত ব্যক্তিদের ব্যাপারে স্পষ্ট করে কুরআনে বলেছেন,
ﵟأَفَرَءَيۡتَ مَنِ ٱتَّخَذَ إِلَٰهَهُۥ هَوَىٰهُ وَأَضَلَّهُ ٱللَّهُ عَلَىٰ عِلۡمٖ وَخَتَمَ عَلَىٰ سَمۡعِهِۦ وَقَلۡبِهِۦ ﵞ
তবে তুমি কি তাকে লক্ষ্য করেছো, যে তার প্রবৃত্তিকে আপন ইলাহ বানিয়েছে? তার কাছে জ্ঞান আসার পর আল্লাহ তাকে পথভ্রষ্ট করেছেন এবং তিনি তার কান ও অন্তরে মোহর মেরে দিয়েছেন।(২২)
দ্বিতীয় কুফরি : ইন্টারফেইথ তথা আন্তঃধর্মের প্রচার
ইন্টারফেইথ একটি ইমান বিধ্বংসী মতবাদ। যার সার কথা হলো সকল ধর্মই সত্য এবং সকল ধর্মই সম্মানের পাত্র। ব্যক্তির আখিরাতের সফলতার জন্য একমাত্র ইসলাম ধর্ম পালন করা আবশ্যক নয়। এই মতবাদ কুরআনের অসংখ্য আয়াত, রাসুলের অসংখ্য হাদিস ও ফিকহের প্রসিদ্ধ মূলনীতি “কুফরের প্রতি সন্তুষ্টি কুফর”-এর সাথে সতভাগ সাংঘর্ষিক। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
ﵟإِنَّ ٱلدِّينَ عِندَ ٱللَّهِ ٱلۡإِسۡلَٰمُۗ ﵞ
আল্লাহর নিকট একমাত্র গ্রহণীয় দ্বীন হলো ইসলাম।(২৩)
অন্য আয়াতে আরো স্পষ্ট করে বলেন যারা ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্মের অনুসন্ধান করবে আরা ক্ষতিগ্রস্থ।
ﵟوَمَن يَبۡتَغِ غَيۡرَ ٱلۡإِسۡلَٰمِ دِينٗا فَلَن يُقۡبَلَ مِنۡهُ وَهُوَ فِي ٱلۡأٓخِرَةِ مِنَ ٱلۡخَٰسِرِينَ ﵞ
যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্যকোনো ধর্ম গ্রহণ করবে তার থেকে তা গ্রহণ করা হবে না। আর সে আখিরাতে হবে ক্ষতিগ্রস্থদের অন্তর্ভুক্ত।(২৪)
অন্যত্র আল্লাহ বলেন,
ﵟإِنَّ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ مِنۡ أَهۡلِ ٱلۡكِتَٰبِ وَٱلۡمُشۡرِكِينَ فِي نَارِ جَهَنَّمَ خَٰلِدِينَ فِيهَآۚ أُوْلَٰٓئِكَ هُمۡ شَرُّ ٱلۡبَرِيَّةِ ﵞ
নিশ্চয় আহলে কিতাবের মধ্যে যারা শিরক করেছে ও মুশরিকরা চিরস্থায়ীভাবে জাহান্নামে থাকবে। আর তারাই হলো নিকৃষ্ট সৃষ্টি।(২৫)
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
عن أبي هريرة، عن رسول الله صلى الله عليه وسلم أنه قال: «والذي نفس محمد بيده، لا يسمع بي أحد من هذه الأمة يهودي، ولا نصراني، ثم يموت ولم يؤمن بالذي أرسلت به، إلا كان من أصحاب النار»
হযরত আবু হুরাইরাহ রা. বর্ণিত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, কসম সে সত্ত্বার যার হাতে আমার প্রাণ, এই উম্মতের ইহুদি ও খ্রিস্টানদের মধ্য হতে আমি যে দ্বীন নিয়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছি তা জানতে পেরেও আমার উপর ইমান আনেনি এবং মতবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে তাহলে সে নিশ্চিত জাহান্নী হবে।(২৬)
কুরআন ও হাদিসের এমন নস (টেক্সট) দ্বারা এই কথা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট যে, ইসলাম ছাড়া বাকি সকল ধর্ম ভ্রষ্ট। এবং তাদের অনুসারীরা ভ্রান্ত এবং ইমান না আনলে চিরস্থায়ী জাহান্নামী। সুতরাং সকল ধর্ম সঠিক ও সত্য এই শিরোনামে আন্তঃধর্ম নামে এই নব্য ফিতনা একটি কুফরি চিন্তা যা মুমিনকে গিলানো হছে তার ইমান হরণ করার জন্য। কোয়ান্টাম মেথড এই কুফরি কাজটি সমাজে খুব সন্তর্পণে করে যাচ্ছে। কয়েকটি নমুনা দেখলে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে।
নমুনা ১ : সকল ধর্মের শিক্ষা এক ও সেগুলোর বানী পবিত্র
“সকল ধর্মের মূল শিক্ষাই এক। সকল ধর্ম একই উৎস থেকে উৎসারিত। ধর্মের মূল শিক্ষা হচ্ছে এক স্রষ্টার উপসনা করো, সবার সাথে সদাচারণ করো আর সৃষ্টির সেবা করো। তাহলেই তুমি পরিত্রান পাবে। পবিত্র ধর্মবানীগুলোকে আমরা বিন্যস্ত করেছি সময়কাল অনুসারে। বেদ, ভগবদগীতা, ধম্মপদ, বাইবেল এবং কোরআন ও হাদীসের মর্মবাণীর মূল সুরের ঐক্য আপনাকে মুগ্ধ ও বিস্মিত করবে।’’(২৭)
নমুনা ২ : অন্য ধর্ম পালণে উৎসাহ প্রধান
“কোয়ান্টাম প্রত্যকের ধর্মবিশ্বাসকে শ্রদ্ধা করে। প্রত্যেককে উৎসাহিত করে আন্তরিকভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালনে।(২৮)
নমুনা ৩ : সকল ধর্মের প্রতি রয়েছে শ্রদ্ধা
“কোয়ান্টাম বিশ্বাস করে সকল ধর্মের মূল শিক্ষা এক। স্থান কাল ভাষা পরিবেশ অনুসারে ধর্মচারে পার্থক্য রয়েছে। স্বধর্ম পালন ও অন্যের ধর্মপালনের অধিকার নিশ্চিত করাই ধর্মের শিক্ষা। কোরআন কণিকার পাশাপাশি বেদ কণিকা, বাইবেল কণিকা, ধম্মপদ কণিকা প্রকাশের মধ্য দিয়ে সকল ধর্মের প্রতি কোয়ান্টামের শ্রদ্ধাবোধের প্রকাশ ঘটেছে।(২৯)
পর্যালোচনা :
উপরের নমুনা হিসেবে উল্লেখ করা আকিদা ও বিশ্বাস যে কুফরি তা স্পষ্ট। একজন মুমিন কখনোই কুফরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও কুফরের প্রতি উৎসাহিত করতে পারে না। যে এর কোনোটিই করবে সে ইসলাম ধর্মের গণ্ডি থেকে বের হয়ে যাবে। ইবনে হাজার হাইতামী রহ. (মৃত্যু ৯৭৪ হি.) বলেন,
ومن المكفرات أيضاً أن يرضى بالكفر ولو ضمناً كأن يسأله كافر يريد الإسلام أن يلقنه كلمة الإسلام فلا يفعل, أو يقول له: اصبر حتى أفرغ من شغلي أو خطبتي لو كان خطيباً, أو كأن يشير عليه بأن لا يسلم وإن لم يكن طالباً للإسلام فيما يظهر
কুফর অপরিহার্যকারী আরেকটি বিষয় হলো কোনো মুসলিম কুফরের উপর সন্তুষ্ট হওয়া, যদিও তা পরোক্ষভাবেই হোক না কেন। উদাহরণস্বরূপ, কোনো কাফের ইসলাম গ্রহণের ইচ্ছে প্রকাশ করে তাকে কালিমা পড়ানোর জন্য বললো; কিন্তু সে তা করলো না অথবা এ কথা বলে বসলো যে, তুমি ধৈর্য ধরো; আমি আমার ব্যস্ততা বা কক্তৃতা শেষ করে আসি, যদি সে বক্তা হয়। অথবা কাউকে এই পরামর্শ দিলো যে, সে যেনো ইসলাম গ্রহণ না করে। যদি বাহ্যিকভাবে সেই ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করতে আগ্রহী নাও হয় তাহলেও পরামর্শদাতা কাফের হয়ে যাবে।(৩০)
আন্তঃধর্মের নামে আল্লাহর সাথে জঘন্য শিরক :
কোয়ান্টাম মেথড আন্তঃধর্মের প্রতি তাদের গুরুত্ব এবং সকল ধর্মের প্রতি তাদের কেমন একনিষ্ঠ বিশ্বাস তা বুঝাতে গিয়ে লেখে, “আমরা শোকর আলহামদুলিল্লাহ বলি, হরি ওম বলি, থ্যাংকস গড বলি, প্রভু তোমাকে ধন্যবাদ বলি, ভগবান তোমাকে ধন্যবাদ বলি, ঈশ্বর তোমাকে ধন্যবাদ বলি। কারণ আমাদের কাছে আল্লাহ যেরকম পবিত্র, ভগবান পবিত্র, গডও পবিত্র। কারণ একই প্রভুর অনেক নাম। যে নামে আমরা ডাকি একজনকেই ডাকি।’’(৩১)
এটা আল্লাহর সাথে জঘণ্য রকম এক শিরক যা কোনো মুসলিম থেকে প্রকাশ পেলে সে যিন্দিকের অন্তর্ভুক্ত হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
ﵟوَلِلَّهِ ٱلۡأَسۡمَآءُ ٱلۡحُسۡنَىٰ فَٱدۡعُوهُ بِهَاۖ وَذَرُواْ ٱلَّذِينَ يُلۡحِدُونَ فِيٓ أَسۡمَٰٓئِهِۦۚ سَيُجۡزَوۡنَ مَا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ﵞ
আর আল্লাহর জন্য রয়েছে সব উত্তম নাম।আআআকাজেই সে নাম ধরেই তাকে ডাক।আর তাদের বর্জণন করো, যারা তাঁর নামে ব্যাপারে বিকৃত পথে চলে। তারা নিজেদের কৃতকর্মের ফল শীঘ্রই পাবে।(৩২)
আব্দুর রহমান সাদী রহ. এই আয়াতের তাফসিরে লেখেন,
إما بأن يسمى بها من لا يستحقها، كتسمية المشركين بها لآلهتهم، وإما بنفي معانيها وتحريفها، وأن يجعل لها معنى ما أراده الله ولا رسوله، وإما أن يشبه بها غيرها، فالواجب أن يحذر الإلحاد فيها، ويحذر الملحدون فيها
আল্লাহর নাম দ্বারা এমন কারো নামকরণ করা যে তার উপযুক্ত নয়। যেমন মুশরিকরা আল্লাহর বিভিন্ন নামে তাদের ইলাহদের ডাকে। অথবা তার অর্থগুলোকে অস্বীকার করা বা বিকৃতি সাধণ করা এবং তার এমন অর্থ করা যা ল্লাহ এবং তার রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করেননি। বা তা দ্বারা অন্যদের সাথে সামঞ্জস্য তৈরি করা। (এসবগুলোই ইলহাদের অন্তর্ভুক্ত) সুতরাং এ জাতীয় ইলহাদ থেকে বেঁচে থাকা ওয়াজিব।(৩৩)
একটি ভ্রান্তি আপত্তি ও তার জবাব :
কোয়ান্টাম মেথডের সংক্ষিপ্ত বিবরণ থেকে এটা স্পষ্ট যে, কোয়ান্টাম মেথডের নামে মুসলিমদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ ইমানকে ধ্বংস করে চিরস্থায়ী জাহান্নামে ফেলার এক ইবলিসি কর্মকাণ্ড চালানো হচ্ছে। এবং তা করাও হচ্ছে ধর্মের নামে! ইসলামের সাথে উপযোগী করে!! কোয়ান্টামের পক্ষ থেকে তাদের কাজের বৈধতার জন্য সবচেয়ে বড় যে জালিয়াতির কথা মানুষকে বুঝানো হয় তা হলো, এরকম ধ্যান মগ্ন হওয়া ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। যুগে যুগে আল্লাহকে পাওয়ার জন্য ওলি-আউলিয়ারা বিভিন্ন সময় ধ্যানে মগ্ন হতেন যাকে ইসলামের পরিভাষায় মোরাকাবা বলে। এমনকি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গারে হেরায় এভাবে মুরাকাবা করেছে। তাহলে কিভাবে বলা যায় আমাদের এই ধ্যান ভ্রান্ত বা কুফরি?!
এই কথার উত্তরে এতটুকু বলাই যথেষ্ট যে, ইসলামের ধ্যান বা মুরাকাবার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা। অথচ উপরের আলোচনা থেকে স্পষ্ট যে, কোয়ন্টামের ধ্যান বা যোগ ব্যায়ামের দ্বারা উদ্দেশ্য কোনোভাবেই আল্লাহকে পাওয়া নয় বরং নফস ও প্রবৃত্তির পূজা এবং ইসলামের আকিদা ও তাকদির বিশ্বাসকে চিরতরে শেষ করে দেওয়া। আল্লাহ আমাদেরকে ইমান বিধ্বংসী এমন জঘণ্য কর্ম থেকে হিফাজত করুক। আমীন।
সর্বশেষ কোয়ান্টামের বিষয়ে বাংলাদেশের একজন শীর্ষ মুফতির ফতোয়া দিয়েই প্রবন্ধ শেষ করছি। বসুন্ধারা ইসলামি রিসার্চ সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা মুফতি আব্দুর রহমান সাহেব রহ. কোয়ান্টাম সম্পর্কে লেখেন, “সম্প্রতী একটি ভয়াবহ ফিতনার নাম হলো “কোয়ান্টাম”। সুস্থ দেহ, প্রশান্ত মন, কর্মব্যস্ত সুখী জীবন—এ স্লোগানে এটি একটি এরতেদাদী ফিতনা। অত্যন্ত সূক্ষ্ণ কৌশলে মুসলমানদেরকে মুরতাদ বানানোর গভির ষড়যন্ত্র।’’(৩৪)
রেফারেন্স ও টীকা—–
[১] সূরা সোয়াদ আয়াত নং ৭৭-৮২
[২] কোয়ান্টাম উচ্ছাস (৩০০ তম কোর্স পূর্তি স্মারক) পৃ. ১৪৩
[৩] সাফল্যের চাবী কাঠি, কোয়ান্টাম মেথড মহাজাতক পৃষ্ঠা ১৪, বর্ধিত নতুন সংস্করণ পূনর্মুদ্রণ ২০১৩ ইং
[৪] হাজারো প্রশ্নের জবাব ১/১১, যোগ ফাউন্ডেশন, পকাশ ১৫ জুন ২০১২
[৫] ইসলাম ও কোয়ান্টাম মেথড-মাওলানা আফসারুদ্দীন পৃষ্ঠা ২১
[৬] নিমারোলজি সংখ্যা -সৌভাগ্যের চাবিকাঠি পৃ. ৪
[৭] সূরা আনয়াম আয়াত নং ৫৯
[৮] সূরা নাম্ল আয়াত : ৬৫
[৯] তাফসিরে সাদী পৃ. ৬০৮
[১০] ফাতাওয়ায়ে শামী ৬/৩৭১
[১১] মুসনাদে আহমদ হাদিস নং ৯৫৩৬
[১২] ফাতাওয়ায়ে শামী ৬/৩৭১
[১৩] সাফল্যের চাবী কাঠি, কোয়ান্টাম মেথড মহাজাতক পৃষ্ঠা ২০
[১৪] সাফল্যের চাবী কাঠি, কোয়ান্টাম মেথড মহাজাতক পৃষ্ঠা ১০
[১৫] সূরা তাকভীর আয়াত নং ২৯
[১৬] আকিদাতুত তহাবী পৃষ্ঠা ১৪
[১৭] সালফাল্যের চাবিকাঠি-কোয়ান্টাম মেথড মহাজাতক পৃষ্ঠা ২২
[১৮] সূরা শুয়ারা আয়াত নং ৮০
[১৯] সালফাল্যের চাবিকাঠি-কোয়ান্টাম মেথড মহাজাতক পৃষ্ঠা ২৩
[২০] সূরা আলে ইমরান আয়াত নং ১৫৬
[২১] আকিদাতুত তহাবী পৃষ্ঠা ১২
[২২] সালফাল্যের চাবিকাঠি-কোয়ান্টাম মেথড মহাজাতক পৃষ্ঠা ২৫৭-৫৮
[২৩] সূরা জাসিয়া আয়াত নং ২৩
[২৪] সূরা আলে ইমরান আয়াত নং ১৯
[২৫] সূরা আলে ইমরান আয়াত নং ৮৫
[২৬] সূরা বাইয়্যিনাত আয়াত নং ৬
[২৭] সহিহ মুসলিম হাদিস নং ১৫৩
[২৮] কোয়ান্টাম কনিকা পৃষ্ঠা ১২ , পরিমার্জিত পঞ্চম মুদ্রণ অক্টোবর ২০১৯
[২৯] কোয়ান্টাম উচ্ছাস (৩০০ তম কোর্স পূর্তি স্মারক) পৃ. ১৪৩
[৩০] কোয়ান্টাম উচ্ছাস (৩০০ তম কোর্স পূর্তি স্মারক) পৃ. ৯
[৩১] আল ইলাম বি কাওয়াতিয়িল ইসলাম পৃষ্ঠা ১০০, দারুত তাকওয়া, সিরিয়া
উদাহরণে ইসলাম গ্রহণে ইচ্ছুক কাফেরকে যদি এই জন্য দেরি করানো হয় যে, ব্যস্ততা শেষ করে ভালো করে সুন্দর করে তাকে ইসলাম গ্রহণ করানো হবে তাহলে এই কাজের দ্বারা ব্যক্তি কাফের হবে না। হাঁ তবে এভাবে দেরি করানো অনুচিত। তবে যদি দেরি করানো দ্বারা উদ্দেশ্য হয় যে, কাফের আছিস থাক, আর কিছু অল্প সময়ে কাফের থাকলে সমস্যা কোথায়। তাহলে তার কুফরির আশংখা রয়েছে। আল্লাহ আমাদের মাফ করুক।
[৩২] হাজারো প্রশ্নের জবাব ১/৫৫, যোগ ফাউন্ডেশন, পকাশ ১৫ জুন ২০১২
[৩৩] সূরা আরাফ আয়াত নং ১৮০
[৩৪] তাফসিরে সাদী পৃষ্ঠা ৩১০
[৩৫] কুরআন সুন্নাহর আলোকে কোয়ান্টাম মেথড বইয়ের শুরুতে মুফতি আদবুর রহমান রহ.-এর লেখিত ‘দোয়া’ থেকে পৃ. ১৩