একজন মুসলিমের জীবনে সবচে’ মূল্যবান বিষয় হচ্ছে তার ঈমান। এই ঈমান দুনিয়ার জীবনে অতীব গুরুত্বপূর্ণ, আবশ্যকীয় বিষয়। কারণ ঈমান যখন বিশ্বাসের নাম তখন কারো মধ্যে যদি ঈমান না থাকে তাহলে এর অনিবার্য পরিণতি হল, সে অবিশ্বাসী হবে, সে সন্দেহ ও অস্থিরতার সংগীন সমুদ্রে হাবুডুবু খেতে থাকবে। কুফুরি আর সংশয়ের অন্ধকারে উদ্ভ্রান্তের ন্যায় বিরামহীন এদিক সেদিক ছুটাছুটি করে যাবে। ফলে এই অবিশ্বাস ও সংশয়ের রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি দুনিয়াতে যত কিছুই অর্জন করুক, মানসিক ও আত্মিক প্রশান্তি কখনোই অর্জন করতে পারবে না। এ সব থেকে মুক্তির একক ও একমাত্র উপায় হচ্ছে, ঈমান-বিশ্বাসের পথ। যে পথ একজন মানুষকে এই দুনিয়ার জীবনে এনে দেয় স্থীরতা, মনোবল, সাহস, আত্মিক ও বুদ্ধিক প্রশান্তি।
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
مَنۡ عَمِلَ صَـٰلِحࣰا مِّن ذَكَرٍ أَوۡ أُنثَىٰ وَهُوَ مُؤۡمِنࣱ فَلَنُحۡیِیَنَّهُۥ حَیَوٰةࣰ طَیِّبَةࣰۖ وَلَنَجۡزِیَنَّهُمۡ أَجۡرَهُم بِأَحۡسَنِ مَا كَانُوا۟ یَعۡمَلُونَ﴾
যে মুমিন অবস্থায় নেক আমল করবে, পুরুষ হোক বা নারী, আমি তাকে উত্তম জীবন দান করব এবং তারা যা করত তার তুলনায় অবশ্যই আমি তাদেরকে উত্তম প্রতিদান দেব। সূরা নাহল:৯৭
আয়াতের সরল মর্ম হল, দুনিয়ার জীবনে পুরুষ বা নারী যত ভালো কাজই করুক, পূণ্য ও সওয়াবের কাজই করুক, সেটা গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য ঈমান থাকা জরুরি। এই ঈমান সহ নেক কাজ করলে আল্লাহ তায়ালা তাকে উত্তম জীবন দান করবেন। আল্লামা ইবনে কাসীর বলেন,”উত্তম জীবন বলতে সব রকমের আরাম ও প্রশান্তিকে বুঝায়, তা যেকোনো ভাবেই অর্জিত হোক।”
আর এই কথার অনিবার্য ফলাফল হচ্ছে, যদি কারো মধ্যে ঈমান না থাকে, সে যত ভালো কাজই করে যাক, প্রকৃত প্রশান্তি সে অর্জন করতে পারবে না।
অপরদিকে মানুষের প্রকৃত ও অন্তহীন জীবন, যা মৃত্যুর পর থেকে শুরু হবে, সেই পরকালীন জীবনেই মূলত ঈমানের প্রকৃত মাহাত্ম্য-ফলাফল দেখা যাবে। সূরা তাওবায় এর একটি বিবরণ এভাবে এসেছে,
وَعَدَ ٱللَّهُ ٱلۡمُؤۡمِنِینَ وَٱلۡمُؤۡمِنَـٰتِ جَنَّـٰتࣲ تَجۡرِی مِن تَحۡتِهَا ٱلۡأَنۡهَـٰرُ خَـٰلِدِینَ فِیهَا وَمَسَـٰكِنَ طَیِّبَةࣰ فِی جَنَّـٰتِ عَدۡنࣲۚ وَرِضۡوَ ٰنࣱ مِّنَ ٱللَّهِ أَكۡبَرُۚ ذَ ٰلِكَ هُوَ ٱلۡفَوۡزُ ٱلۡعَظِیمُ﴾ [التوبة ٧٢]
আল্লাহ মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদেরকে জান্নাতের ওয়াদা দিয়েছেন, যার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হবে নহরসমূহ, তাতে তারা চিরদিন থাকবে এবং (ওয়াদা দিচ্ছেন) স্থায়ী জান্নাতসমূহে পবিত্র বাসস্থানসমূহের। আর আল্লাহর পক্ষ থেকে সন্তুষ্টি সবচেয়ে বড়। এটাই মহাসফলতা। (আয়াত-৭২)
সেখানে ঈমান-বিশ্বাস ছাড়া সব কিছু বেকার হয়ে যাবে। একজন মানুষ ভালো-সত-মহত যতকিছুই হোক, ঈমান না থাকলে তার নিশ্চিত ঠিকানা হবে জাহান্নাম। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
قُلۡ هَلۡ نُنَبِّئُكُم بِٱلۡأَخۡسَرِینَ أَعۡمَـٰلًا ١٠٣ ٱلَّذِینَ ضَلَّ سَعۡیُهُمۡ فِی ٱلۡحَیَوٰةِ ٱلدُّنۡیَا وَهُمۡ یَحۡسَبُونَ أَنَّهُمۡ یُحۡسِنُونَ صُنۡعًا ١٠٤ أُو۟لَـٰۤىِٕكَ ٱلَّذِینَ كَفَرُوا۟ بِـَٔایَـٰتِ رَبِّهِمۡ وَلِقَاۤىِٕهِۦ فَحَبِطَتۡ أَعۡمَـٰلُهُمۡ فَلَا نُقِیمُ لَهُمۡ یَوۡمَ ٱلۡقِیَـٰمَةِ وَزۡنࣰا ١٠٥ ذَ ٰلِكَ جَزَاۤؤُهُمۡ جَهَنَّمُ بِمَا كَفَرُوا۟ وَٱتَّخَذُوۤا۟ ءَایَـٰتِی وَرُسُلِی هُزُوًا ١٠٦﴾
বল, ‘আমি কি তোমাদেরকে এমন লোকদের কথা জানাব, যারা আমলের দিক থেকে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত’? দুনিয়ার জীবনে যাদের চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেছে, অথচ তারা মনে করছে যে, তারা ভাল কাজই করছে’! তারাই সেসব লোক, যারা তাদের রবের আয়াতসমূহ এবং তাঁর সাথে সাক্ষাতকে অস্বীকার করেছে। ফলে তাদের সকল আমল নিষ্ফল হয়ে গেছে। সুতরাং আমি তাদের জন্য কিয়ামতের দিন কোন ওজনের ব্যবস্থা রাখব না’। এ জন্যই তাদের প্রতিফল জাহান্নাম। কারণ তারা কুফরী করেছে এবং আমার আয়াতসমূহ ও আমার রাসূলগণকে বিদ্রূপের বিষয় বানিয়েছে’। কাহফ: ১০৩-১০৬
এ আয়াতগুলোতে এসকল ব্যক্তিদের যাবতীয় কাজকর্ম নিষ্ফল হয়ে যাওয়া, এবং জাহান্নামী হওয়ার যে কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে তাহল, কুফুর ও কুফুরি কাজ।
ইহজীবন ও পরকালীন জীবনে ঈমান কতটা আবশ্যিক, কত গুরুত্বপূর্ণ উপরের কথাগুলো থেকে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ফলে এই ঈমানকে নিজের মধ্যে ধারণ করতে হবে, আমৃত্যু যত্নের সাথে ঈমানকে নিয়েই চলতে হবে।
তবে সচেতনভাবে ঈমানকে গ্রহণ ও ধারণ করা সম্ভব হবে তখনই যখন আমরা ঈমানকে সঠিকভাবে জানব, ঈমানের যথাযথ পাঠ গ্রহণ করব।
এ বিবেচনায় এখানে আমরা ঈমানের পরিচয়, মর্ম, স্বরূপটি সরল ভাষায় তুলে ধরছি।
আরবীতে ঈমান (إيمان) শব্দের আভিধানিক অর্থ হয়— কাউকে সত্যায়ন করা, কারো উপর নির্ভর করা।
আর কুরআন হাদীসের পরিভাষায় ঈমানের পরিচয় হল, আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে নবীজির আনীত সমস্ত শিক্ষা ও বিধান, যা অকাট্যভাবে নবীজি থেকে প্রমাণিত, এগুলোকে সত্য হিসেবে বিশ্বাস করা, সঠিক হিসেবে মেনে নেয়া এবং নবীজির আনুগত্যকে নিজের জন্য আবশ্যিক মনে করা ও তার স্বীকৃতি দেয়া।
তাহলে ‘ঈমান’এর জন্য তিনটি বিষয় একসাথে থাকতে হবে।
১. নবীজির আনীত সমস্ত পয়গামকে সত্য হিসেবে জানা ও বিশ্বাস করা
২. সত্য হিসেবে মেনে নেয়া
৩. নবীজির আনুগত্যকে আবশ্যিক মনে করে স্বীকৃতি দেয়া।
ঈমানের এই সংজ্ঞা থেকে অনেকগুলো বিষয় সাব্যস্ত হয়:
১. নবীজির আনীত সমস্ত বিধানকে সত্য হিসেবে জানতে হবে। এই জানার মধ্যে কোন রূপ সন্দেহ সংশয় বা দ্বিধা থাকলে ঈমান হিসেবে গণ্য হবে না।
إِنَّمَا ٱلۡمُؤۡمِنُونَ ٱلَّذِینَ ءَامَنُوا۟ بِٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ ثُمَّ لَمۡ یَرۡتَابُوا۟ حجرات: ١٥
মুমিন তো তারাই যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, তারপর সন্দেহ করে না। (হুজুরাত:১৫)
২. নবীজির আনীত বিধানকে শুধু সত্য হিসেবে জানার নাম ঈমান নয়। যেমন, মদীনার ঈহুদীরা নবীজি যে সত্য নবী, তাঁর আনীত সমস্ত কিছু সঠিক, এটা তারা খুব ভালোকরেই জানত। তবে এটা মানুষের সামনে প্রকাশ করত না। কুরআনে কারীমের বিভিন্ন আয়াতে বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে। তন্মধ্যে সূরা বাকারায় আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
ٱلَّذِینَ ءَاتَیۡنَـٰهُمُ ٱلۡكِتَـٰبَ یَعۡرِفُونَهُۥ كَمَا یَعۡرِفُونَ أَبۡنَاۤءَهُمۡۖ وَإِنَّ فَرِیقࣰا مِّنۡهُمۡ لَیَكۡتُمُونَ ٱلۡحَقَّ وَهُمۡ یَعۡلَمُونَ ١٤٦
আমি যাদেরকে কিতাব দিয়েছি, তারা তাঁকে চেনে যেমন তারা চেনে তাদের সন্তানদেরকে। আর তাদের একটি দল জেনেশুনে সত্যকে গোপন করে। সূরা বাকারা:১৪৬
তো কুরআনে কারীম ঈহুদীদের এই নিছক সত্য জানাকে গ্রহণ তো করেই নি, বরং এমন আচরণকে কঠোরভাবে নিন্দা করেছে। এবং এই জানা সত্ত্বেও তারা যে কাফেরই রয়ে গেছে, কুরআন বারবার স্পষ্ট করে বর্ণনা করেছে।
৩. একইভাবে কেউ যদি নবীজিকে সত্য হিসেবে জানে, এবং এই কথা মানুষের সামনে প্রকাশও করে, কিন্তু নবিজির আনুগত্যকে নিজের জন্য আবশ্যিক না করে, তাঁর আনীত সমস্ত বিধানকে মেনে না নেয়, তাহলেও সে মুমিন হবে না। যেমন,
নবীজির চাচা আবু তালিব, তিনি জানতেন নবীজি আল্লাহর পক্ষ থেকে যা বলেন সব সত্য ও সঠিক, এবং এই কথা তিনি বিভিন্ন সময় মুখে ব্যক্তও করতেন। একটি কবিতায় তিনি বলেছিলেন,
ودعوتني وزعمت أنك صادق+ وصدقت فيه وكنت ثم أمينا
তুমি আমাকে (ঈমানের পথে) ডেকেছ, আমি জানি, তুমি সত্যবাদি, এক্ষেত্রে তুমি সঠিক বলছ…
কিন্তু তিনি কোরায়েশ গোত্রের লোকদের নিন্দা ও ভর্তসনা র ভয়ে নবীজির আনুগত্যকে নিজের জন্য আবশ্যিক করেন নি, নবীজির আনীত বিধানাবলিকে মেনে নেননি।
মুসলিম শরীফের একটি হাদীসে এসম্পর্কে একটি বিবরণ এসেছে, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর চাচার মৃত্যুর সময় তাকে বলেছিলেন, চাচা, আপনি বলুন, আল্লাহ ব্যতিত কোন উপাস্য নেই, আমি কিয়ামতের দিন এর দ্বারা আপনার পক্ষে সাক্ষ
দিব! কিন্তু আবু তালিব এটা বলতে অস্বীকার করলেন। তখন আল্লাহ তায়ালা আয়াত অবতীর্ণ করলেন, নিশ্চয় আপনি যাকে পছন্দ তাকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারেন না।( আল ক্বাসাস:৫৬) সহি মুসলিম:২৫
ফল কথা, আবু তালিব কাফের অবস্থায় মারা যান। এবং শুধু নবীজিকে সত্য জানা ও মুখে প্রকাশ করাকে তার ঈমান হিসেবে গণ্য করা হয় নি। কেন? কারণ তিনি নবীজির আনুগত্যকে মেনে নেননি।
এই আনুগত্য ও মেনে নেয়া যে ঈমানের জন্য জরুরি বিষয়টি কুরআনে বার বার ঘোষণা করা হয়েছে।
فَلَا وَ رَبِّکَ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ حَتّٰی یُحَکِّمُوۡکَ فِیۡمَا شَجَرَ بَیۡنَہُمۡ ثُمَّ لَا یَجِدُوۡا فِیۡۤ اَنۡفُسِہِمۡ حَرَجًا مِّمَّا قَضَیۡتَ وَ یُسَلِّمُوۡا تَسۡلِیۡمًا ﴿۶۵﴾
“অতএব তোমার রবের কসম, তারা মুমিন হবে না যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে বিচারক নির্ধারণ করে, তারপর তুমি যে ফয়সালা দেবে সে ব্যাপারে নিজদের অন্তরে কোন দ্বিধা অনুভব না করে এবং পূর্ণ সম্মতিতে মেনে নেয়।” নিসা:৬৫
وَ مَا کَانَ لِمُؤۡمِنٍ وَّ وَّ لَا مُؤۡمِنَۃٍ اِذَا قَضَی اللّٰہُ وَ رَسُوۡلُہٗۤ اَمۡرًا اَنۡ یَّکُوۡنَ لَہُمُ الۡخِیَرَۃُ مِنۡ اَمۡرِہِمۡ ؕ وَ مَنۡ یَّعۡصِ اللّٰہَ وَ رَسُوۡلَہٗ فَقَدۡ ضَلَّ ضَلٰلًا مُّبِیۡنًا ﴿ؕ۳۶﴾
“আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন নির্দেশ দিলে কোন মুমিন পুরুষ ও নারীর জন্য নিজদের ব্যাপারে অন্য কিছু এখতিয়ার করার অধিকার থাকে না; আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অমান্য করল সে স্পষ্টই পথভ্রষ্ট হবে।” ( আহযাব:৩৬)
৪. নবীজির আনীত সমস্ত শিক্ষা বিধান ও পয়গামকে সত্য ও সঠিক হিসেবে বিশ্বাস করতে হবে। ফলে কোন ব্যক্তি যদি কিছু বিধানকে সত্য হিসেবে মেনে নেয়, কিন্তু অপর কিছু বিধান বা কোন একটি অকাট্য বিধানকে প্রত্যাখ্যান করে, অবিশ্বাস করে, তাহলে তার ঈমান গ্রহণযোগ্য হবে না।
উদাহরণ হিসেবে কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের কথা বলা যায়। তারা যদিও বাহ্যত মুসলিমদের মত নামাজ রোজা যাকাতের কথা বলে, এবং ইসলামের অনেক কিছুই নিজেদের মধ্যে চর্চা করে। কিন্তু নবীজির আনীত ও অকাট্যভাবে প্রমাণিত অনেক বিষয়কে তারা আবার অস্বীকার করে, মানে না। যেমন, নবীজি সর্বশেষ নবী, তাঁর পরে আর কোন নবীর আগমন ঘটবে না। কাদিয়ানী সম্প্রদায় ইসলামের এই অকাট্য বিশ্বাসকে স্বীকার করে না। বরং মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীকে নবী হিসেবে বিশ্বাস করে। এমনিভাবে কেয়ামতের পূর্বে হজরত ঈসা আ. আগমন করবেন, এটি নবীজির বহু হাদীস দ্বারা অকাট্যভাবে প্রমাণিত। কিন্তু কাদিয়ানী সম্প্রদায় এই আকীদাকে অস্বীকার করে থাকে। এমন আরো অনেক বিষয় রয়েছে। ফলে কাদিয়ানী সম্প্রদায় বাহ্যিকভাবে ইসলামের কিছু বিধান পালন করলেও তারা মূলত কাফের, মুমিন নয়। কারণ তারা নবীজির আনীত সমস্ত বিধানকে সত্যায়ন করেনি। অনেক অকাট্য বিধানকে প্রত্যাখ্যান করেছে।
এমনিভাবে কেউ যদি আল্লাহ তায়ালার একত্ববাদ, পরকাল, নামাজ রোজা যাকাত হজ্ব প্রভৃতি বিষয় বিশ্বাস করে, কিন্তু কুরআন হাদীসে নারীদের পর্দার যে বিধান দেয়া হয়েছে সেটা অস্বীকার করে, পর্দাকে ইসলামের অংশ হিসেবে না মানে, তাহলে সে মুমিন হতে পারবে না।
অথবা কোন ব্যক্তি ইসলামের সকল বিধান সত্য বিশ্বাস করে, তবে শুধু সুদকে বৈধ মনে করে, অথচ সুদ কুরআন ও হাদীসের স্পষ্ট ভাষ্য মতে হারাম, নিষিদ্ধ। এমন ব্যক্তির ঈমানও গ্রহণযোগ্য হবে না।
হ্যাঁ, এটা ভিন্ন বিষয় যে, কোন নারী শয়তানের প্ররোচনায় নিজে পর্দা করে নি, কিন্তু পর্দা করাকে ইসলামের আবশ্যিক বিধান হিসেবে স্বীকার করে, পর্দা না করাকে গোনাহ মনে করে। তাহলে এমন নারী পর্দা না করার কারণে কঠিন গোনাহগার হবে, কিন্তু সে ঈমানহারা হবে না।
একইভাবে সুদকে হারাম মনে করার পরও কেউ সুদী লেনদেন করল, এতে সে শক্ত গোনাহে জড়িত হল, কিন্তু সে সুদকে যেহেতু হালাল বা বৈধ মনে করছে না, তাই কাফের হয়ে যাবে না।
কারণ ঈমান-বিশ্বাস এক বিষয়, আর আমল বা কর্ম ভিন্ন বিষয়। যদিও দুটোর মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে।
ঈমান গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য নবীজির আনীত সমস্ত শিক্ষা ও বিধানকে মেনে নিতে হবে, কিছু গ্রহণ, কিছু প্রত্যাখ্যান-অস্বীকারের দ্বারা ঈমান গ্রহণযোগ্য হয় না, বিষয়টি কুরআন হাদীসে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বারবার আলোচিত হয়েছে। তন্মধ্যে দুটি আয়াত পেশ করছি।
★ সূরা বাকারার শুরুতে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
وَ الَّذِیۡنَ یُؤۡمِنُوۡنَ بِمَاۤ اُنۡزِلَ اِلَیۡکَ وَ مَاۤ اُنۡزِلَ مِنۡ قَبۡلِکَ ۚ وَ بِالۡاٰخِرَۃِ ہُمۡ یُوۡقِنُوۡنَ ؕ﴿۴﴾اُولٰٓئِکَ عَلٰی ہُدًی مِّنۡ رَّبِّہِمۡ ٭ وَ اُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡمُفۡلِحُوۡنَ ﴿۵﴾
আর যারা ঈমান রাখে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তাতেও এবং আপনার পূর্বে যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তাতেও। আর পরকালের প্রতি তারা পরিপূর্ণ বিশ্বাস রাখে। তারা তাদের রবের পক্ষ থেকে হিদায়াতের উপর রয়েছে এবং তারাই সফলকাম। সূরা বাকারা:৪-৫
এখানে বলা হয়েছে, আপনার প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে যা যা অবতীর্ণ করা হয়েছে, এটা ব্যাপক অর্থবোধক, নবীজির আনীত সমস্ত কিছুকে বুঝাচ্ছে।
★অপর আয়াতে আরো স্পষ্ট করে ঈমানের এই বিষয়টি বর্ণনা করা হয়েছে, আল্লাহ তায়ালা বলেন,
أَفَتُؤۡمِنُونَ بِبَعۡضِ ٱلۡكِتَـٰبِ وَتَكۡفُرُونَ بِبَعۡضࣲۚ فَمَا جَزَاۤءُ مَن یَفۡعَلُ ذَ ٰلِكَ مِنكُمۡ إِلَّا خِزۡیࣱ فِی ٱلۡحَیَوٰةِ ٱلدُّنۡیَاۖ وَیَوۡمَ ٱلۡقِیَـٰمَةِ یُرَدُّونَ إِلَىٰۤ أَشَدِّ ٱلۡعَذَابِۗ وَمَا ٱللَّهُ بِغَـٰفِلٍ عَمَّا تَعۡمَلُونَ.
তোমরা কি কিতাবের কিছু অংশে ঈমান আনবে আর কিছু অংশ অস্বীকার করবে? সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা তা করে দুনিয়ার জীবনে লাঞ্ছনা ছাড়া তাদের কী প্রতিদান হতে পারে? আর কিয়ামতের দিনে তাদেরকে কঠিনতম আযাবে নিক্ষেপ করা হবে। আর তোমরা যা কর, আল্লাহ সে সম্পর্কে গাফিল নন। (সূরা বাকারা:৮৫)
ঈমানের পরিচয় সম্পর্কে আরেকটি বিষয় বর্ণনা করেই লেখার ইতি টানছি।
ঈমানের পরিচয় ও স্বরূপ সম্পর্কে মৌলিক কথাগুলো আমরা আলোচনা করলাম। বলার অপেক্ষা রাখে না, ঈমানের বিপরীত বিষয় হল, কুফুর বা অবিশ্বাস। যেহেতু ঈমান এবং কুফুর দুটি বিপরীত জিনিস, তাই কারো এমধ্যে একসাথে কখনো একত্রিত হতে পারে না। কারণ পরস্পর বিপরীতমুখি দুটি বস্তু কখনো একসাথে একই স্থানে থাকতে পারে না।
উদাহরণ স্বরুপ, একটি বস্তু একই সাথে কালো আবার সাদা হতে পারে না, তেমনি একটি স্থান একই সময় আলোকিত আবার অন্ধকার হতে পারে না। যখন আলো আসবে অন্ধকার দূর হয়ে যাবে। আলো যতক্ষণ থাকবে অন্ধকার আসতে পারবে না।
ঈমানের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ফলে কারো ঈমান গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য তাকে কুফুর শিরক ও এসবের যত প্রতীক নিদর্শন আছে, সব কিছু থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। বিশ্বাসের দিক থেকেও, কার্যতভাবেও।
মানবজাতির সর্বোচ্চ আদর্শ নবী রাসূলগ্ণ একদিকে যেমন ঈমানের ঘোষণা দিয়েছেন, ঠিক একই সাথে কুফুর শিরক ও মূর্তি দেব দেবি এবং কুফুরের সমস্ত নিদর্শন থেকে নিজেদের সম্পর্কহীনতার ঘোষণা করেছেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁদের কাজ ও কর্মপন্থাকে আমাদের জন্য অনুকরণীয় ও পালনীয় বানিয়েছেন।
সূরা কাফিরুনে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
قُلۡ یَـٰۤأَیُّهَا ٱلۡكَـٰفِرُونَ ١ لَاۤ أَعۡبُدُ مَا تَعۡبُدُونَ ٢ وَلَاۤ أَنتُمۡ عَـٰبِدُونَ مَاۤ أَعۡبُدُ ٣ وَلَاۤ أَنَا۠ عَابِدࣱ مَّا عَبَدتُّمۡ ٤ وَلَاۤ أَنتُمۡ عَـٰبِدُونَ مَاۤ أَعۡبُدُ ٥ لَكُمۡ دِینُكُمۡ وَلِیَ دِینِ ٦
বলে দিন, হে সত্য অস্বীকারকারীগণ! আমি সেই সব বস্তুর ইবাদত করি না, যাদের ইবাদত তোমরা কর। এবং তোমরা তাঁর ইবাদত কর না, যার ইবাদত আমি করি। এবং আমি (ভবিষ্যতে) তার ইবাদতকারী নই, যার ইবাদত তোমরা কর।
আর আমি যার ‘ইবাদাত করি তোমরা তার ‘ইবাদাতকারী হবে না’। তোমাদের জন্য তোমাদের দীন, আমার জন্য আমার দীন। (আয়াত:১-৬)
যার মূল কথা হল, আকীদা বিশ্বাস ইবাদত এসকল ক্ষেত্রে একজন মুমিন কোন অবস্থাতেই কুফুর ও কাফেরদের সাথে আপোষ করতে পারেন। বরং এসকল ক্ষেত্রে তাদের থেকে স্পষ্টভাবে আলাদা ও স্বকীয় থাকবে।
কুরআনে কারীম এক্ষেত্রে ইবরাহীম আ. এর আদর্শ বারবার মুসলিমদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। সূরা মুমতাহিনায় বলা হয়েছে,
قَدۡ کَانَتۡ لَکُمۡ اُسۡوَۃٌ حَسَنَۃٌ فِیۡۤ اِبۡرٰہِیۡمَ وَ الَّذِیۡنَ مَعَہٗ ۚ اِذۡ قَالُوۡا لِقَوۡمِہِمۡ اِنَّا بُرَءٰٓؤُا مِنۡکُمۡ وَ مِمَّا تَعۡبُدُوۡنَ مِنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ ۫ کَفَرۡنَا بِکُمۡ وَ بَدَا بَیۡنَنَا وَ بَیۡنَکُمُ الۡعَدَاوَۃُ وَ الۡبَغۡضَآءُ اَبَدًا حَتّٰی تُؤۡمِنُوۡا بِاللّٰہِ وَحۡدَہٗۤ
ইবরাহীম ও তার সাথে যারা ছিল তাদের মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ। তারা যখন স্বীয় সম্প্রদায়কে বলছিল, ‘তোমাদের সাথে এবং আল্লাহর পরিবর্তে তোমরা যা কিছুর উপাসনা কর তা হতে আমরা সম্পর্কমুক্ত। আমরা তোমাদেরকে অস্বীকার করি; এবং উদ্রেক হল আমাদের- তোমাদের মাঝে শত্রুতা ও বিদ্বেষ চিরকালের জন্য; যতক্ষণ না তোমরা এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আন। (আয়াত:০৪)
قَالَ إِنِّیۤ أُشۡهِدُ ٱللَّهَ وَٱشۡهَدُوۤا۟ أَنِّی بَرِیۤءࣱ مِّمَّا تُشۡرِكُونَ ٥٤ مِن دُونِهِۦۖ
(হুদ) বললেন, আমি আল্লাহকে সাক্ষী রাখছি, এবং তোমরাও সাক্ষী হও, আল্লাহ ব্যতীত অন্যান্যদেরকে তোমরা যে অংশীদার সাব্যস্ত করছ, আমি তা থেকে মুক্ত। সূরা হুদ:৫৪-৫৫
আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে ঈমানের সঠিক পরিচয় ও পাঠ গ্রহণ করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
সূত্র:
১. ফয়যুল বারি, কিতাবুল ঈমান, আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরি
২. শরহে আকাঈদ, আল্লামা তাফতাযানি
৩. জাওয়াহিরুল ফিকহ, মুফতী শফি
কুফুর ও কাফেরদের সাথে আপোষ করতে পারেন না হবে।
না বাদ পড়েছে