খৃষ্টধর্মের বৈরাগ্যবাদ কি হজরত ঈসা আঃ এর শিক্ষা? একটি দালিলিক পর্যালোচনা
শুরুর কথা
বৈরাগ্য প্রথা খৃষ্টধর্মে খুব পছন্দনীয় ও আকর্ষণীয় বিষয়। পাশাপাশি ধর্মীয় দৃষ্টিতে তাদের নিকট ইবাদাতও বটে। তাদের দৃষ্টিতে সংসার বিমুখ হয়ে যদি আশ্রমবাসী হওয়া যায় এবং সেখানে একমনে আল্লাহর উপাসনায় নিমগ্ন থাকা যায় তবে সেটাই সংসারজীবী হয়ে আল্লাহ ও বান্দার হক আদায়ে রত থাকা অপেক্ষা উত্তম। কিন্তু তাদের এ দৃষ্টিভঙ্গি আম্বিয়া আলাইহিস সালামের শিক্ষার সাথে সাংঘর্ষিক।
দুনিয়ায় যত নবী-রাসূল এসেছেন প্রত্যেকেই বিয়ে ও সংসার করেছেন এবং তাঁদের উম্মতকেও সেই শিক্ষা দান করেছেন। তাদের শিক্ষার ভেতর ইবাদত-বন্দিগীর মত মানুষের সাথে মেলামেশা, বেচা-কেনা ও সমাজ জীবনের প্রয়োজনীয় সব বিষয় সমান গুরুত্ব পেয়েছিল।
সুতরাং প্রশ্ন জাগে খৃষ্টধর্মে এ বৈপরীত্য কেন? হযরত মাসীহ আলাইহিস সালাম এর থেকেই কি তারা এ শিক্ষা পেয়েছে ?
প্রচলিত ‘বিকৃত’ ইনজীলসমূহে হযরত মাসীহ আলাইহিস সালাম থেকে এ বিষয়ে কোন বাণী পাওয়া যায় না। হ্যাঁ এ কথা ঠিক যে, তিনি নিজে বিবাহ করেননি ও সংসার জীবন যাপন করেননি কিন্তু তাই বলে এ বিষয়টি টেনে এনে সন্ন্যাসবাদ ও বৈরাগ্য প্রথার দলীল দেয়া যেতে পারে না। কেননা ব্যক্তিগত জীবনে মানুষের বিভিন্ন পারিপার্শ্বিকতা থাকে, যদ্দরুন ক্ষেত্র বিশেষে নিজ জীবন দর্শনের প্রতিফলন ঘটানো সম্ভব হয় না। কাজেই সেক্ষেত্রে ব্যক্তিগত কর্ম নয়, বরং তিনি কী বলেন সেটাই লক্ষণীয়। হযরত ঈসা মাসীহ (যীশু) আলাইহিস সালামের শিষ্যদের জীবনী যদি অধ্যয়ন করি তাহলে সেখানে দেখতে পাই যে, যীশুর সকল শিষ্য বিবাহিত ছিলেন। প্রেরিতদের প্রধান পিতরও (পিটার) বিবহিত ছিলেন। শুধুমাত্র সাধু (সেন্ট) পল বিবাহ করেননি। (পল ঈসা আলাইহিস সালামের শিষ্যদের অর্ন্তভূক্ত নয়।)
মোট কথা বৈরাগ্যবাদ হযরত মাসীহ আলাইহিস সালামের শিক্ষা নয় এবং মূল খৃষ্টধর্মের শিক্ষাও নয়। কুরআন মাজীদেও এর সাক্ষ্য দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
و رهبانية ابتدعوها ما كتبنا عليهم الا ابنتغاء رضوان الله فما رعوها حق رعايتها
(سورة الحديد )
অর্থ: সন্ন্যাসবাদ তো তারা নিজেরাই আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য প্রবর্তন করেছিল। আমি তাদেরকে এর বিধান দেইনি। অথচ তাও তারা যথাযথভাবে পালন করেনি। (হাদীদ : ২৭)
প্রকৃতপক্ষে বৈরাগ্যবাদ সেন্ট পৌলের উদ্ভাবন। তিনিই খৃষ্টধর্মে ঈসা আলাইহিস সালামের শিক্ষা বিরোধী এ প্রথার জন্ম দিয়েছেন। তিনি নিজে তো বিবাহ করেনইনি উপরন্তু তিনি চিঠিপত্র মারফত তার অনুসারীদেরকেও সে রকম জীবন যাপনে উৎসাহিত করেছেন।
সেন্ট পৌল বলেন, “অবিবাহিত আর বিধবাদের আমি বলছি তারা যদি আমার মত থাকতে পারে তবে তাদের পক্ষে তা ভাল”। (১ করিন্থিয় : ৭:৮)
তিনি যেমন বিয়েতে নিরুৎসাহী ছিলেন, তেমনি অর্থোপার্জনেও। মানুষের দান-খায়রাতের উপরই নির্ভর করতেন। এজন্য তার কোন গ্লানি তো ছিলই না। উল্টো ধর্মশিক্ষা দানের কারণে তাকে তার প্রাপ্য মনে করতেন। অথচ দীনী কাজের কারণে মানুষের থেকে কোন বিনিময় গ্রহণ না করাই নবী-রাসূলগণের শিক্ষা।
তিনি বলেন, “আমরা যখন তোমাদের মধ্যে রুহানী বীজ বুনেছি, তখন তোমাদের কাছ থেকে যদি জাগতিক খাওয়া- পরা জোগাড় করি তবে সেটা কি খুব বেশি কিছু”। (১ করিন্থিয়: ৯: ১২)
এভাবে খৃষ্টধর্মে কুমার জীবন যাপন, আয় রোজগার না করে ভিক্ষাবৃত্তি ও পরনির্ভরশীলতা তথা পুরোপুরি সন্ন্যাসবাদের প্রবর্তন সেন্ট পৌলের র্কীতি।
বক্ষমান এ প্রবন্ধে আমরা সন্ন্যাসবাদের পরিচয় ও তার বিভিন্ন দিক তুলে ধরার চেষ্টা করব ইনশা আল্লাহ।
সন্ন্যাসব্রতের সংজ্ঞা ও পরিচয়:
মন্ডলীর আইনবিধির সংজ্ঞা অনুযায়ী “ব্রত হচ্ছে কোনো সম্ভাব্য ও অধিকতর মঙ্গলজনক কল্যাণের বিষয়ে ঈশ্বরের নিকট স্বেচ্ছাকৃত ও স্বাধীন প্রতিজ্ঞা যা ধর্মীয় কারণবশতঃ পালন করা আবশ্যক”।
অথবা তার সংজ্ঞা এভাবে দেওয়া যায় যে, “যারা সম্পূর্ণভাবে ঈশ^রের সেবায় আত্মনিয়োগ করার উদ্দেশ্যে সংসার ত্যাগ করেছেন”। (খৃষ্ট মন্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি: পৃ: ৮২)
ব্রত গ্রহণ প্রকাশ্যে বা একান্ত হতে পারে। প্রকাশ্যে হয় যখন মন্ডলীর নামে বিধিসম্মত কর্তৃপক্ষের নিকট ব্রতবাণী উচ্চারণ করা হয়, অন্যথায় ব্রত গ্রহণ একান্ত হয়। ব্রত আবার সাড়ম্বর বা অনাড়ম্বও হতে পারে। যেসব সংঘের ব্রত গ্রহণ মন্ডলী সাড়ম্বর বলে গ্রহণ করেছে ,সেগুলো সাড়ম্বর ব্রত। এবং অন্যান্য সব অনাড়ম্বর বা সাধারণ ব্রত।
যারা চিরজনীন ব্রত গ্রহণ করেন না বরং সাময়িক তারা মেয়াদ শেষ হলে আবার নবায়ন করে নিবে।যারাই বৈরাগ্যব্রত জীবনে অংশ নেয় তারা সম্প্রদায়গত জীবনে ভাই বোন রূপে জীবন যাপন করবে। (খৃষ্টধর্মীয় শব্দার্থ: ১৯২ পৃ:)
সন্ন্যাস জীবন তিন প্রকার:
ব্রহ্মচর্য ব্রত
দারিদ্র ব্রত
বাধ্যতা ব্রত
এ বিষয়ে বলা হয়েছে: বাধ্যতা , দারিদ্রতা ,ও ঈশ্বরের নিকট আত্মোৎসর্গকৃত কৌমার্যের জীবন মঙ্গলসমাচারে বর্ণিত এই সুমন্ত্রণাগুলোর ভিত্তি হচ্ছে যীশু খৃষ্টের শিক্ষা ও জীবনার্দশ । মন্ডলী এগুলোকে ঈশ্বরের মহান দান বলে গ্রহণ করে আসছে এবং তাঁরই অনুগ্রহে সে তা রক্ষা করে যাচ্ছে।
(দ্বিতীয় ভাটিকান মহসভার দলিলসমূহ: ১৩৬ পৃ:)
ব্রহ্মচর্য বা কৌমার্য ব্রত:
খৃষ্টীয় শিক্ষানুসারে সাধারণভাবে কৌমার্য অবিবাহিত জীবনাবস্থাকে বুঝায়। কৌমার্য বা ব্রহ্মচর্য একটি আহবান যেখানে ‘ঐশ্ব রাজ্যের কারণে একজন স্বাধীনভাবে অবিবাহিত জীবন বেছে নেয়।’
এই আহবানে সাড়া দেয়া যেতে পারে সাধারণ খৃষ্টভক্ত অবস্থায় থেকে অথবা মন্ডলীর কারো অনুমোদিত কোন একটি সম্প্রদায়ে প্রবেশ করে। ল্যাটিন রীতির জন্য মন্ডলীর আইন অনুযায়ী কৌমার্য যাজক প্রার্থীদের জন্য আবশ্যক। (খৃষ্টধর্মীয় শব্দার্থ: ১৯২ পৃ:)
প্রাথমিকভাবে সন্ন্যাস বা বৈরাগ্যব্রত দুই ভাগে বিভক্ত:
নির্জনবাসী সন্ন্যাসী
আশ্রমবাসী সন্ন্যাসী
পরবর্তীতে আরো দুই প্রকার দল প্রকাশিত হয়েছে:
স্যারাবাইটিস: এরা এতটা প্রতিষ্ঠা পায়নি।তারা কোন নীতির ধার ধারে না,কারো অধীনতা মানেনা।তারা স্পষ্টত ঈশ্বরের উপর মিথ্যা আরোপ করে।তারা তাদের মনের চাহিদা অনুযায়ী চলে, ঐশ্বরিক কোন বিধান তারা মানে না।বরং তারা নিজেরা যা তৈরী করেন সেটাই তাদের বিধান।
গ্যারোভ্যাগাস:(gyrovagues):
এরা তাদের জীবন ব্যয় করে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ছুটে চলে।এক মাঠে তিন দিন থেকে চার দিন অবস্থান করে। তারা সর্বদা চলার উপরে থাকে। কোথাও স্থির থাকে না।
মঠবাসী সন্ন্যাসী আবার দুই প্রকার:
১.স্বাড়ম্বরপূর্ণ সন্ন্যাস
২.অনাড়ম্বরপূর্ণ সন্ন্যাস
যারা সাড়ম্বরপূর্ণ সন্ন্যাসী হয় এদের নান বলা হয় । আর যারা অনাড়ম্বর সন্ন্যাসী হয় তাদেরকে সিস্টার বলে।
সন্ন্যাসীদের সন্ন্যাসজীবন পালনের বিভিন্ন ধরন:
মন্ডলীর শুরু থেকে খৃষ্টমন্ডলীর নারী পুরুষ অধিকতর মুক্ত হয়ে খৃস্টকে অনুসরণ করার এবং মঙ্গলবাণীর সুমন্ত্রণা অনুযায়ী জীবন যাপন করে অধিকতর অন্তরঙ্গভাবে তাঁকে অনুসরণ করার প্রয়াস পেয়েছেন। প্রত্যেকে নিজ নিজ পন্থা অনুসরণ করে তারা ঈশ্বরে নিবেদিত জীবন যাপন করেছে।তাদের মধ্যে কেউ পবিত্র আত্মার প্রেরণায় উদ্ব্দ্ধু হয়ে নির্জনে একক জীবন যাপন করেছেন। আবার অনেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন সন্ন্যাসব্রতী সংঘ।
মন্ডলী যাদের কালক্রমে সাগ্রহে স্বাগত জানিয়েছে এবং অনুমোদন করেছে। এভাবে ঈশ^রেরই পরিকল্পনা অনুসারে মন্ডলীতে মনোরম ও বিচিত্র ধরনের সন্ন্যাসব্রতী সংঘ গড়ে উঠেছে। এর ফলে মন্ডলী যে শুধুমাত্র বিভিন্ন ধরনের কল্যাণ কাজ করতে সক্ষম হয়ে উঠেছে। এবং খৃষ্ট দেহকে গড়ে তোলার লক্ষ্যে সেবাকাজের জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠেছে তা নয় উপরন্তু মন্ডলী তার সন্তানদের বহুবিধদানে বিভূষিতা হয়ে বরের জন্যে সজ্জিত নববধূরই মত হয়ে উঠেছে। এবং তার মাধ্যমেই প্রকাশিত হতে পেরেছে বহু বিচিত্র ঐশ প্রজ্ঞা।
( দ্বিতীয় ভাটিকান মহাসভার দলিলসমূহ: পৃ: ২৫৭-২৫৮)
যেহেতু খৃষ্টীয় বিশ্বাসমতে সন্ন্যাসব্রতের জীবন যাত্রার কোন ধরাবান্দা নিয়ম নীতি নেই তাই –
১.কেউ কেউ নিজ পরিবারেই বিধাবা জীবন যাপন করত।তাদের দারিদ্রতা চর্চা করতে পরামর্শ দেয়া হত। আশা করা হত তারা দয়ার কাজ করবেন,গরীব ও অসুস্থদের পরিদর্শন করবেন এবং ধর্মশাস্ত্র ধ্যান করবে।
২.কেউ কেউ গাছগাছালির মধ্যে বাস করতেন। এদেরকে Dendrites বা গাছগাছালি বাসী বলা হয়।
৩.কেউ কেউ গাদাগাদি করে গুহার মধ্যে বা কুড়েঘরে আবদ্ধ থাকতেন। তাদেরকে Reclueses বা স্বেচ্ছাচারী সন্ন্যাস বলা হয়।
৪.কেউ কেউ বনে বাস করত ,তারা বনের ঘাস খেয়ে থাকত।
৫.কেউ কেউ আবার স্তম্ভ এর উপর অবস্থান করত । এদেরকে Stylites বা স্তম্ভবাসী বলা হয়।
৬.অনেকে আবার গায়ের সমস্ত পরিধেয় কাপড় ফেলে দিয়ে নগ্নাবস্থায় থাকতেন। এদেরকে Adamites বা আদমী বলা হয়। (মন্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি: পৃ: ৮৩)
সন্ন্যাস বা বৈরাগ্যব্রতের উদ্দেশ্য:
১. ঐশ্ব রাজ্য পাবার জন্য। (মথি:১৯:১২)
২. ঐশ্ব পরিকল্পনায় পূর্ণ আত্ম নিবেদনের মাধ্যমে ভালোবাসাকে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত করার জন্য। যাতে এই ভালবাসা অনুযায়ী জীবন-যাপন করা যায় ও একে অপরের সহযোগিতা করা। এবং এভাবে ইতোমধ্যেই এই জগতে শুরু হয়ে যাওয়া ঐশ্বরাজ্যের জীবনের পূর্বস্বাদ গ্রহণ করা।
মঙ্গল সমাচারের জন্য পূর্ণ আত্মনিবেদনের মাধ্যমে দরিদ্র দূর্দশাগ্রস্থ মানুষের চাহিদার প্রতি সাড়া দেয়ার উদ্দেশ্যে।
(মুসলমান ভাইদের প্রশ্ন, খৃষ্টবিশ্বসীদের উত্তর: পৃ: ২৬)
৪.অপদেবতাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের উপর বিশেষ জোর দেয়া।
(মন্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি:পৃ: ৮৩)
৫.সন্ন্যাসীরা মানব জাতিকে আদি পতনের পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করত। আর এ কারণে তারা বন্য প্রাণী পুষত।
(মন্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি: পৃ: ৮৩)
সন্ন্যাসব্রতকে খৃষ্টানগণ যেভাবে দেখেন:
তাদের দৃষ্টিতে উৎসর্গীকৃত জীবন হলো জীবন যাত্রার স্থায়ী রূপ। যার মাধ্যমে ভক্তগণ পবিত্র আত্মার প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আরো ঘনিষ্ঠভাবে খৃষ্টকে অনুকরণ করে, ঈশ্বরের কাছে নিজেদেরকে পূর্ণভাবে নিবেদন করে তারা তাঁকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসে। ঐশরাজ্যের সেবায় ঈশ্বরের সম্মানের জন্য। মন্ডলী গঠনে এই জগতের পরিত্রাণের জন্য তারা নতুন ও বিশেষ উপায়ে ভালবাসার পূর্ণতা অনুসন্ধান করে। তারা মন্ডলীতে জাজ¦ল্যমান চিহ্ন এবং স্বর্গীয় মহিমার পূর্ণভাগ।
‘ প্রভু যীশু খৃষ্ট তাঁর শিষ্যদের জন্যে মঙ্গল সমাচারে বর্ণিত যে সুমন্ত্রণাগুলো রেখে গেছেন ,তার অনুশীলন মন্ডলীর পবিত্রতা অর্জন করতে বিশেষ সাহায্য করে থাকে।সেই সমস্ত সুমন্ত্রণাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উর্ধ্বে রয়েছে কৌমার্যব্রত। কৌমার্য ব্রত জীবনের দ্বারা তারা কেবল তাদের অবিভক্ত হৃদয় কেবল মাত্র ঈশ্বরের কাছেই উৎসর্গ করেন। স্বর্গরাজ্যের উদ্দেশ্য কৌমার্যব্রত পালন করাকে মন্ডলী সর্বদা গভীরভাবে শ্রদ্ধা করে আসছে।কারণ তা হচ্ছে প্রেমের চিহ্ন ও প্রেরণার শক্তি এবং জগতে আধ্যাত্মিক উন্নতির উৎসস্বরূপ। (খৃষ্টধর্মীয় শব্দার্থ,ধর্মব্রত ও কৌমার্য শব্দের অধীনে)
বৈরাগ্য জীবনের বৈশিষ্ট্যসমূহ ও তাদের কর্তব্য :
যারা বৈরাগ্যব্রত বেছে নিয়েছেন,তারা একটি ঐশ আহবানে সাড়া দিয়েছেন।শুধুমাত্র পাপের দিক থেকে মৃত্যুবরণ করাই নয় বরং সংসারকে পরিত্যাগ করে একমাত্র ঈশ্বরের জন্য জীবন-যাপন করার জন্য তারা ব্রত গ্রহণ করেছেন।তাই তাদের সম্পূর্ণ জীবন ঈশ্বরের সেবায় নিয়োজিত থাকবে।
তাদের আত্মোৎসর্গ মন্ডলী কর্তৃক গৃহীত হয়েছে বলে তাদের বুঝতে হবে যে, তারা মন্ডলীর সেবায় দায়বদ্ধ।
ঈশ্বরের সেবায় আত্ম নিবেদন তাদের মধ্যে বিভিন্ন গুণাবলি,বিশেষ করে নম্রতা,বাধ্যতা,সাহসিকতা,শুচিতা গুণ অনুশীলনের স্পৃহা জাগিয়ে দেবে এবং এসব লালন করতে সাহায্য করবে। এসব গুণাবলীর মধ্য দিয়েই তারা খৃষ্টের আত্মরিক্ততার অংশীদার হন। এবং একসময়ে তারা যীশুর আত্মিক জীবন লাভ করেন।
সন্ন্যাসব্রতীরা তাদের ব্রতের প্রতি বিশ্বস্ত থাকবে খৃষ্টের জন্য সমস্ত কিছুই ত্যাগ করবে।
খৃষ্টকে অনুসরণ করাই জীবনের একমাত্র প্রয়োজনীয় বিষয় বিবেচনা করে তাঁকে অনুসরণ করতে হবে। (লুক:১০:৩৯) এবং নিবিষ্টচিত্তে যা কিছু তাঁর তাই নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হবে।
(১ করিন্থিয়: ৭: ৩২)
ধ্যান সাধনায় তারা সর্বদা নিরত থাকবে।
প্রেমপূর্ণ প্রেরিতিক কাজেও তারা নিষ্ঠাবান হবে। কেননা এভাবেই তারা মুক্তি কাজের অংশীদার হয়ে ঐশরাজ্য বিস্তারের কাজে সহায়তা করতে হবে।
খাঁটি খৃষ্টীয় আধ্যাত্মিকতার ভান্ডার হতে আহরণ করে সন্ন্যাসব্রতী সংঘের সন্ন্যাসব্রতীদের উদ্যম সহকারে প্রার্থনার মনোভাব ও প্রার্থনা অনুশীলনে উৎকর্ষ লাভ করতে হবে।
প্রত্যেকদিন তাদের পবিত্র বাইবেল পাঠ করতে হবে,যেন তারা প্রভুযীশুকে জানতে পারার অমূল্য সৌভাগ্য উপলব্ধি করতে পারেন।
মন্ডলীর সঙ্গে একাত্ম হয়ে সমস্ত হৃদয় মন দিয়ে পবিত্র উপাসনা বিশেষ করে খৃষ্ট প্রসাদীয় পূণ্য রহস্যানুষ্ঠানে তাদের অংশ গ্রহণ করা উচিত।আধ্যাত্ম সম্পদের এই সর্বোৎকৃষ্ট উৎস হতেই তাদের আধ্যাত্মিক জীবনের পুষ্টি লাভ করা উচিত।
তারা ত্যাগ স¦ীকার ও ইন্দ্রীয় দমনে যত্মবান হবেন। তবে শরীর ও মনের স্বাস্থ্য ভাল রাখে এমন স্বাভাবিক উপায়গুলো তাদের অবহেলা করা উচিত নয়।
( দ্বিতীয় ভাটিকান মহাসভার দলিলসমূহ: ২৬০,২৬১ ও ২৬৫ পৃ:)
সন্ন্যাস জীবনের সূচনা:
শুরু থেকেই খৃষ্টীয় সমাজ কর্তৃক স্বর্গ রাজ্যের খাতিরে কৌমার্য ও ব্রহ্মচর্য বেছে নেওয়াকে উচ্চ সম্মান দেওয়া হত। সাধু পলের দৃষ্টান্ত ও শিক্ষা এ জীবনের ভিত্তি বলে ধারণা করা হয়।
সাধু পল বলেন, ‘অবিবাহিত ও বিধবাদের আমি বলছি,তারা যদি আমার মত থাকিতে পারে তবে তাদের পক্ষে তা ভাল। কিন্তু যদি তারা নিজেদের দমন করতে না পারে তবে বিয়ে করুক, কারণ শরীরের কামনায় জ¦লে-পুড়ে মরবার চেয়ে বরং বিয়ে করা অনেক ভাল। যাদের বিবাহ হয়েছে তাদের আমি এই হুকুম দিচ্ছি অবশ্য আমি দিচ্ছিনা প্রভুই দিচ্ছেন, স্ত্রী যেন স্বামীর কাছ থেকে চলে না যায়। কিন্তু যদি সে চলেই যায় তাহলে আর বিয়ে না করুক কিংবা স্বামীর সংগে আবার মিলিত হোক। স্বামীও তার স্ত্রীকে তালাক না দিক।
( ১ করিন্থিয়: ৭: ৮-১১)
১ তিমথিয়ের ৫ অধ্যায়ে উল্লেখিত আছে: “ বিধাবাদল, ফিলিপের চার জন কুমারী কন্যা যারা সবাই প্রবক্তা/ ভাববাদী ছিলেন (শিষ্যচরিত :২১:৮-৯) এরা সবাই ছিলেন ধর্মোদ্দেশ্যে নিবেদিত জীবনের প্রথম সাক্ষী।
নির্যাতনের প্রথম শতাব্দীগুলোতে খৃষ্টভক্তগণ এমন সমাজ গঠন করেছিলেন যাদের মধ্যে ছিল গভীর সর্ম্পক। তাঁরা মঙ্গল সমাচারের পথ অনুসরণ করতেন ভীষন ঝুঁকি নিয়ে। তবে যখন খৃষ্টধর্ম রাজা কন্সটান্টাইনের সময় রাষ্ট্রীয় ধর্মের মর্যাদা পেয়েছিলেন এবং রোমান সাম্রাজ্যের প্রায় সকল অধিবাসী খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করেছিল, হতে পারে সাধারণভাবে এর মানের অবক্ষয় হয়েছিল। অনেক খৃষ্টভক্ত এমন জীবন যাপন করেছিল যা যীশুর জীবন ও উদাহরণের প্রতিফলন ঘটায়নি।
এর পরবর্তী সমাজের অবস্থা থেকেই উঠে এসেছিল মরুবাসী সন্ন্যাসীদের আন্দোলন। ইহুদী সমাজ ইতোমধ্যেই এসেনীয় সমাজগুলোতে নজির সৃষ্টি করেছিল; যাদের মঠাশ্রম ছিল মরুসাগরের তীরে কুমরানের নিকট। এই সমাজগুলো মনে করত যে, পার্থিব সমাজ হল, অনুদ্ধার্যরূপে মন্দ। আর তারা চেষ্টা করেছিল নিজেদের প্রলোভনমুক্ত রাখতে ও সমাজের দুর্নীতি থেকে মুক্ত রাখতে। এজন্য তারা বিকল্প পথ বেছে নিয়েছিল মরুজীবন।
তৃতীয়-চতুর্থ শতকে কোন কোন খৃষ্টভক্ত একই পথ বেছে নিয়েছিল। তারা শহর যেমন-আলেকজান্দ্রিয়া আর আন্তিয়োক ত্যাগ করে নির্জনে প্রার্থনায় ও কঠোর সাধনায় জীবন যাপনের লক্ষ্যে মিশর ও সিরিয়ার মরুভূমিতে বাস করতে গিয়েছিল। যখন সবাই জানত যে, এই মরুভূমিতে একজন পুণ্য সন্ন্যাসী বাস করেন। তখন অন্যেরা তার পরামর্শ ও উপদেশ গ্রহণ করতে এবং প্রার্থনায় সময় কাটাতে সন্ন্যাসীর কাছে আসতেন ও থাকতেন। অবশেষে কেউ কেউ সন্ন্যাসীর সঙ্গে থেকে যেতেন এবং একই ধরণের জীবন অতিবাহিত করতেন। এভাবে নির্জন মরুতে কঠোর তপস্বী সন্ন্যাসীকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল সন্ন্যাস সংঘ যারা সহভাগিতার জীবন যাপন করতেন।
এ চিত্র প্রথমে শুরু হয়েছিল মিশরীয় মরুভূমিতে এবং দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল সিরীয় আর আরবীয় মরু অঞ্চলগুলোতে। সাধু আন্তনি (মৃ: ৩৫৬খৃ:) এবং সাধু মাকারিওস (মৃ: ৩৯৯ খৃ:) ছিলেন প্রথম মিশরীয় সন্ন্যাসী যারা একাকী বাস করতেন এবং অতিরিক্ত কৃচ্ছ্রতাপূর্ণ জীবন যাপন করতেন। (খৃষ্টবিশ^াসের পরিচিতি: পৃ: ১২৫-১২৬)
গোটা দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতাব্দীতে এমন আরও অনেক নারী ও পুরুষের সাক্ষাৎ মেলে যারা কৃচ্ছব্রত/বৈরাগ্য/ সন্ন্যাসব্রত ও শুচিতা বেছে নিয়েছিলেন। এতে খৃষ্টীয় প্রনোদনা অর্থাৎ স্বর্গরাজ্যের খাতিরে সমস্ত কিছু ত্যাগ করার সঙ্গে অন্যান্য উদ্দেশ্যও যুক্ত হত। প্রচলিত অনৈতিকতার প্রতি বিরাগ কাউকে কাউকে শুচিতার পথ বেছে নিতে উদ্বুদ্ধ করে। কৌমার্যব্রত গ্রহণ মহিলাদের জন্য বিবাহের সামাজিক নিপীড়ন থেকে নিজেদের মুক্তির নারীমুক্তির সূচনার একটি উপায় স্বরূপ হতে পারত। (মন্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি: পৃ: ৮২-৮৩)
একটি প্রশ্ন ও তার উত্তর:
খৃষ্টানগণ মনে করেন যে, যীশু খৃষ্টই এ বৈরাগ্য প্রথা গ্রহণের ব্যাপারে উৎসাহিত করেছেন। এ বিষয়ে তারা যীশুর একটি বাণী উল্লেখ করেন তা হলো, ‘ যীশু বলেন, যদি তুমি পুরোপুরি খাঁটি হতে চাও তবে গিয়ে তোমার সমস্ত সম্পত্তি বিক্রি করে গরীবদের দান কর। তাতে তুমি বেহেশতে ধন পাবে। (মথি: ১৯: ২১)
এর উত্তরে আমরা বলতে পারি যে, এ বক্তব্য কিছুতেই বৈরাগ্যব্রতকে সমর্থন করেনা বা উৎসাহ দেয় না,বরং এর দ্বারা উদ্দেশ্য কেবল সৎকাজের প্রতি উৎসাহ দান করা। তাই এ বক্তব্যকে বৈরাগ্যব্রত এর উৎস হিসেবে ধরা যায় না।
সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করার কারণ:
১.প্রচলিত অনৈতিকতার প্রতি বিরাগ কাউকে কাউকে শুচিতার পথ বেছে নিতে উদ্বুদ্ধ করে।
২. কৌমার্যব্রত গ্রহণ মহিলাদের জন্য বিবাহের সামাজিক নিপীড়ন থেকে নিজেদের মুক্তির অর্থাৎ নারী মুক্তির সূচনা –একটি উপায়স্বরূপ হতে পারত। ( মন্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি: ৮৫)
৩.ঈশ^রকে পূর্ণভাবে ভালবাসতে ও তাঁর উপাসনা করতে যে সমস্ত বাঁধা আসতে পারে, তা থেকে নিজেকে মুক্ত করা।
৪. আরও নিষ্ঠার সাথে ঈশ^রের সেবার্থে নিজেকে উৎসর্গ করা।
(দ্বিতীয় ভাটিকান মহাসভার দলিলসমূহ:পৃ:১৩৭)
সন্ন্যাসব্রত গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা:
সুসমন্ত্রণাগুলো অনুশীলনের মাধ্যমে সন্ন্যাসব্রতীরা যে বন্ধনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ , সেই বন্ধন খৃষ্ট ও তাঁর ভার্যা মন্ডলীর মধ্যকার নিবিড় সংযোগকেই ব্যক্ত করে। এই বন্ধন যত দৃঢ় এবং স্থায়ী হয় খৃষ্টীয় সন্ন্যাস-জীবনের আত্মোৎসর্গ ততই পূর্ণ হয়।
মঙ্গল সমাচারের সুমন্ত্রণাগুলোর মাধ্যমে ও তার ব্যবহারে যে প্রেমের উদ্ভব হয় এর দ্বারা সন্ন্যাসব্রতীরা মন্ডলী ও তার রহস্যের সাথে এক নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ হন। সন্ন্যাসীদের আধ্যাত্মিক জীবন গোটা মন্ডলীর মঙ্গল সাধনে নিয়োজিত।নিজ সামর্থ অনুসারে এবং প্রতিটি সন্ন্যাস-সংঘের আপন বৈশিষ্ট্য অনুসারে ধ্যান- আশ্রমিক বা প্রৈরিতিক সন্ন্যাসব্রতী সংঘই হোক,সন্ন্যাসব্রতদের কর্তব্য রয়েছেঃ মানুষের অন্তরে খৃষ্টের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা ও তা শক্তিশালী করে তোলা এবং পৃথিবীর চর্তুদিকে তার বিস্তার সাধন করা।
এ কারণে মন্ডলীতে সন্ন্যাসব্রতী সংঘগুলোর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রক্ষা ও তার উন্নতি সাধন করা হয়ে থাকে। মঙ্গল সমাচারের সুমন্ত্রণাগুলোর অনুসরণে সন্ন্যাসব্রতীর জীবন খৃষ্টভক্তদের জন্যে চিহ্ন ও উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রকাশ পাবে। সন্ন্যাস-জীবন মন্ডলীতে সেই জীবনেরই প্রতিচ্ছবি ও তার বাস্তবায়ন যা ঈশ্বর-পুত্র খৃষ্ট আমাদের জন্যে রেখে গেছেন।
এ ছাড়া পার্থিব জিনিসের উপর ঐশরাজ্য ও তার সকল বিষয়ের যে অগ্রাধিকার রয়েছে,তার উজ্জ্বল নিদর্শন হচ্ছে সন্ন্যাস জীবন। সন্ন্যাস জীবন আরও সাক্ষ্য দিচ্ছে : ঐশরাজ্যের সেই সর্বোত্তম বন্ধন যা মানুষের কাছে প্রকাশ করে খৃষ্টের অপরিসীম মহত্বের সার্বভৌম ক্ষমতা এবং মন্ডলীতে কার্যরত পবিত্র আত্মার অপরিসীম শক্তি।
মঙ্গল সমাচারের সুমন্ত্রণাগুলোর অনুকরণে গঠিত সন্ন্যাস জীবন যদিও মন্ডলীর প্রশাসনিক সংগঠনের আওতাভুক্ত নয় তথাপি তা নিঃসন্দেহে মন্ডলীর জীবন ও পবিত্রতার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত।
(দ্বিতীয় ভাটিকান মহাসভার দলিলসমূহ: পৃ: ১৩৭-১৩৮)
সন্ন্যাস-পোশাক:
সন্ন্যাসব্রতীদের ধর্মীয় পোশাক নিবেদিত জীবনেরই প্রতীক। সুতরাং সেই পোশাক হতে হবে সাদা-সিধে ও অনাড়ম্বর একই সময়ে তা হতে হবে দীনতা প্রকাশক ও শোভনীয়। উপরন্তু এই পোশাক হতে হবে স্বাস্থের অনুকূল এবং স্থান,কাল ও সন্ন্যাসব্রতীদের পৈরিতিক কাজের উপযোগী। পুরুষ-মহিলাদের যে সব সন্ন্যাসব্রতী সংঘের পোশাক বিধিসমূহের পরিপন্থী সেগুলো পরিবর্তন করতে হবে।
(দ্বিতীয় ভাটিকান মহাসভার দলিলসমূহ: পৃ: ২৬৯)
আশ্রম জীবনের প্রতিষ্ঠা ও এর ক্রমবিকাশ: (প্রাচ্যের আদি সন্ন্যাসীগণ)
যারা জাগতিক বিষয়ে কম ব্যতিব্যস্ত থেকে নিবিষ্ট খৃষ্টীয় জীবন-যাপন করতে ইচ্ছুক ছিল,তাদের কেউ কেউ মরুভূমিতে যেত।এ থেকে আশ্রমজীবনের সূচনা হয়।
আন্তনি হলেন নির্জনবাসী সন্ন্যাসীদের ও মিশরের মরুবাসী সন্ন্যাসীদের পিতা। তাঁর সম্বন্ধে জানা যায় যে,আলেকজান্দ্রিয়ার ধর্মপাল আথানাস্তাসিয়াস কর্তৃক রচিত কিছুটা রোমা কর জীবনীগ্রন্থ। আন্তনির দৃষ্টান্ত বিপুল সংখ্যক খৃষ্টবিশ্বাসী অনুসরণ করেন।
সাধু আগস্তিন তাঁর স্বীকারোক্তি গ্রন্থে এর অনুরুক্তি করেছেন। নীলনদের উপরিস্থিত উপত্যকায় পাকোমিয়ুস (২৮৬-৩৪৮খৃ:) পুরুষদের জন্য সংঘবদ্ধ আশ্রম জীবন প্রতিষ্ঠা করেন। অন্যদিকে তারই বোন মেরী স্থাপন করেন মহিলাদের জন্য প্রথম সমাজ/ সম্প্রদায়।
এ প্রাথমিক আশ্রমজীবন দ্রুত মিশর,প্যালেষ্টাইন,সিরিয়া ও মেসোপটেমিয়ায় বিস্তার লাভ করে। এর জন্য কোন একটি সুনির্দিষ্ট আইনগত কাঠামো ছিল না। কোন প্রার্থী যতদিন না নিজের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম হতেন ততদিন পর্যন্ত তাকে কোন আধ্যাত্মিক গুরু,ধর্মপিতা বা মঠাধ্যক্ষের অধীনে থাকতে হত।নির্জনবাসী সন্ন্যাসীর জীবন সাধনার প্রতিযোগীতায় পরিণত হয়।
( মন্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি: পৃ: ৮৩)
সাধু বাসিলের সংস্কার:
সিজারিয়ার ধর্মপাল বাসিল (৩৩০-৩৭৯ খৃ:) আশ্রম জীবনের খামখেয়ালী বা অস্বাভাবিক আচরণ বা অভ্যাসের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তাঁর রচিত নিয়মাবলিতে সংঘবদ্ধভাবে জীবন যাপন করাকে সন্ন্যাসীদের জন্য অত্যাবশ্যক করেন। বুদ্ধিবৃত্তিক বা মননশীল কাজে এবং দরিদ্রদের সেবাকাজে তিনি তাদেরকে উৎসাহ দান করেন।
জেরুজালেমের সেই আদি খৃষ্টীয় সমাজটি হয়ে ওঠে মঠবাসী সন্ন্যাসীদের আদর্শস্বরূপ। সন্ন্যাসীর প্রথম কর্তব্য ছিল মঠাধ্যক্ষের প্রতি বাধ্যতা। ধর্মাধ্যক্ষ শুধুমাত্র সুসমাচারের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম নীতি ব্যাখ্যা ও প্রাত্যহিক জীবনে তা প্রয়োগ করতেন।
(মন্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি: পৃ: ৮৩-৮৪)
সাধু বাসিল সন্ন্যাসীদের জন্য নিয়মাবলী রচনা করেছিলেন যা আজও প্রাচ্য মন্ডলীগুলোতে অনুসরণ করা হয়। বাসিলীয় মঠাশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সমগ্র সিরিয়া আর আরবীয় মরুভূমি জুড়ে এবং এ্যানাটলিয়া ও গ্রীসের সে সমস্ত অঞ্চলে যেখানে জনসংখ্যা কম।
(খৃষ্টবিশ্বাসের পরিচিতি: পৃ:১২৭)
পাশ্চাত্যে সন্ন্যাস জীবন:
অতীতে যেমন দেখা গেছে অনেক কুমার-কুমারী ও তাপস-তাপসী ধর্মীয় ব্রত গ্রহণ করার পরও তাদের পরিবার-পরিজনদের সঙ্গে বসবাস করতেন।প্রাচ্য থেকে আগত পর্যটকরা যেমন আথানাসিয়াস ও জেরোম সন্ন্যাস জীবনের পক্ষে ব্যাপক প্রচারণা চালান ।
কুমার-কুমারীদের বিপুল সংখ্যা যৌন অপব্যবহার ও পদস্খলনের সম্ভাবনা ,প্রাচ্যজগতের বিভিন্ন দৃষ্টান্ত ও বড় বড় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার সাধারণ প্রবণতা এ সবই ব্রতজীবন সুসংগঠনের লক্ষ্যে প্রেরণা যোগাচ্ছিল ।
৩৫০ সালের দিকে রোমে সম্ভ্রান্ত বংশের মহিলাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি ধর্মসমাজের অস্তিত্ব ছিল। বিবাহ অনুষ্ঠান থেকে প্রেরণা নিয়ে কুমার কুমারীদের আত্মোৎসর্গ বা ধর্মীয় পোশাক গ্রহণের ধর্মানুষ্ঠান প্রচলন করা হয়েছিল। আম্রোজ কুমার কুমারীদের আদর্শরূপে কুমারী মারীয়াকে গ্রহণের সুপারিশ করেছিলেন।
(মন্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি: পৃ: ৮৫)
সংকটের দিক:
তৃতীয় শতাব্দীতে বিভিন্ন রচনা কৌমার্যের একটি আধ্যাত্মিকতা সূচনা করে যা ছিল দীক্ষাস্নানেরই একটি সংযোজন। এটা ছিল সেই আদি পতনের পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়ার সামিল। এ সময়েই খৃষ্টের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ধারণাটির জন্ম হয়। সেই সঙ্গে কিছু কিছু বিচ্যুতি বা বিকৃতিরও প্রকাশ ঘটে।
কয়েকজন মহিলার কাছে তাদের জীবনাবস্থা নির্বাচনে গঠিত ছিল।অন্যেরা এমন পুরুষের সঙ্গে মিলে-মিশে বসবাস করত যারা তাদের অনুরূপ জীবনাবস্থা এক প্রকারের মরমী বা অতীন্দ্রিয় বিবাহ বেছে নিয়েছিলেন।আবার কৌমার্যর এত বড় প্রসংশার পর খৃষ্ট বিশ্বাসীদের বিবাহ অশ্রদ্ধার বস্তুতে,এমনকি তা নিষেধাজ্ঞায় পরিণত হয়।
(প্রাগুক্ত : পৃ: ৮৫)
কয়েকজন সন্ন্যাসী ও তাঁদের কর্ম:
১-সন্ন্যাসী জেরোম:
প্রাচ্য জগতে একজন প্রসিদ্ধ নির্জনবাসী সন্ন্যাসী ছিলেন জেরোম (৩৪৭-৪১৯ খৃ:) । তিনি রোমীয় অভিজাত শ্রেণীর মহিলাদের মধ্যে সন্ন্যাস জীবনের পক্ষে প্রচার করেন।
যারা তার বিরোধীতা করত,তিনি তাদের বিরুদ্ধে বিবাহের উপর কৌমার্যের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করার জোর প্রচেষ্টা চালান।
তিনি তার বান্ধবী পাউলার সঙ্গে প্যালেস্টাইনে ফিরে এসে বেথলেহেমে মহিলাদের সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী সু-ব্যবস্থিত মহিলাদের জন্য একটি ধর্মসমাজ এবং পুরুষদের জন্যও একটি ধর্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করেন যেখানে তিনি নিজেও বাস করতেন।
সন্ন্যাস জীবন যার জন্য জেরোমের নিকট সবচেয়ে বেশী Ĺণী, তা হল পবিত্র বাইবেল চর্চার স্পৃহা সৃষ্টি করা,ঐশবাণী,দীর্ঘ অনুসন্ধান ও ধ্যানের ফলে সন্ন্যাসীর আত্মিক খোরাকে পরিণত হয়। বর্ববরদের উপর্যুপরি আক্রমণে প্রাচীন গ্রীক ও রোমীয় সভ্যতা ভেঙ্গে পড়ার পর জেরোম হলেন সেই ধরণের নির্জনবাসী সন্ন্যাসীর মূলাদর্শ যিনি খৃষ্টীয় ও সার্বজনীন কৃষ্টির সেবায় আত্মনিয়োজিত হন।
২.সাধু আগস্তিন:
আগস্তিন (৩৫৪-৪৩০ খৃ:) তার মন পরিবর্তনের পর একজন সন্ন্যাসীর জীবন বেছে নিয়েছিলেন এবং চেয়েছিলেন তাঁর যাজকগণ সন্ন্যাসজীবনের স্বাতন্ত্র্য সূচক জীবন যাপন গ্রহণ করুন। এ থেকে নতুন দিকদর্শনের সূচনা হয় সন্ন্যাসী রূপে যাজকদের গ্রহণ।
সন্ন্যাসীদের মধ্য থেকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে যাজকদের বেছে নেয়া হত,অথবা যাজকদের জন্য সন্ন্যাস জীবনের কোন কোন বিশেষ দিক যেমন – কৌমার্য গ্রহণ করা আবশ্যক হয়।২১১ সালে একটি চিঠির সঙ্গে সংযুক্ত সাধু আগস্তিনের নিয়মাবলীতে ব্রত জীবন সম্বন্ধীয় কতগুলো সাধারণ মন্তব্য ও পরামর্শের একটি সংক্ষিপ্ত রূপ রেখা বা বর্ণনা রয়েছে।
৩.জন কাসিয়ান:
জন কাসিয়ান (৩৬০-৪৩৫ খৃ:) ছিলেন রোমানিয়ার অধিবাসী। তিনি প্রাচ্যের মঠ বা আশ্রমগুলো পরিদর্শনের পর মার্সেইতে দুটি আশ্রম স্থাপর করেন। যথা: পুরুষদের জন্য সাধু ভিক্টর আশ্রম ও মহিলাদের জন্য সাধু সেভিয়র আশ্রম। প্রথম সন্ন্যাসজীবনের উপর লিখেছিলেন বলে ধারণা করা হয়।
তারই লেখা আশ্রমিক প্রতিষ্ঠান এবং উপদেশমালা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দুনিয়ার নির্জনবাসী সন্ন্যাসীদের মধ্যে একটি সেতু রচনা করে।তাঁর কাছে আশ্রম জীবনের শীর্ষগুণ ছিল বিচার বুদ্ধিসম্পন্নতা। লেরিন্সের দ্বীপগুলোও ছিল আশ্রম জীবনের সমৃদ্ধশীল কেন্দ্রবিন্দু।
(মন্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি: পৃ: ৮৫)
৪.ক্লুনি ও তাঁর কর্ম:
৯১০ সালে প্রতিষ্ঠিত ক্লুনির ধর্মাশ্রম বেনেডিক্টীয় নিয়মাবলীর মূল নীতিমালা পুনরুজ্জীবিত করে যথা মঠাধ্যক্ষের স্বাধীন নির্বাচন ,রাজবাজড়া ও ধর্মপালদের কবল থেকে নিষ্কৃতি । উপরন্তু ধর্মাশ্রম পোপের প্রতি তার প্রত্যক্ষ আনুগত্য পুনর্ব্যক্ত করে।
একাদশ ও দ্বাদশ শতাব্দীতে উক্ত ধর্মাশ্রমটি এমন একটি ধর্মসংঘের প্রধান হয়ে উঠে যা সমগ্র ইউরোপে বিস্তার লাভ করেছিল। বস্তুত আর এটা একটা নতুনত্ব যে পুরনো মঠগুলোর তুলনায় নতুন স্থাপিত মঠগুলো কিন্তু ক্লুনির মঠাধ্যক্ষের কর্তৃত্বাধীনে ছিল। এর স্বর্গ যুগে ক্লুনির রাজ্যে ৫০০০০ সন্ন্যাসী ছিল।
ক্লুনি মঠের কায়িক পরিশ্রমের উপর কম গুরুত্ব দিয়ে উপাসনা ও অবিরত প্রার্থনার উপর বিশেষ জোর দিয়েছিলেন। ক্লুনির মাজলুস (৯৪৮-৯৯৪ খৃ:) ওদিলো(৯১৪-১০৫৯ খৃ) হাগ (১০৪৯-১১০৯ খৃ:) ও মান্যবর পিটার (১১২২-১১৫৬ খৃ:) প্রমুখ আদি মঠাধ্যক্ষগণের ব্যক্তিত্ব ও দীর্ঘায়ু একাদশ ও দ্বাদশ শতাব্দীতে ক্লুনির প্রভাব-প্রতিপত্তিতে যথেষ্ট ইন্ধন যুগিয়েছিল। অন্যান্য মঠের সংস্কারে ও খৃষ্টমন্ডলীর সার্বিক সংস্কারে ক্লুনি বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেছিলেন।
কোন রকম জাগতিক লাভের আশা না করে উক্ত ধর্মসংঘটি পোপতন্ত্রের ভূমিকা সমর্থন ও রক্ষা করে এবং খৃষ্টমন্ডলীর সেবায় অনেক ধর্মপাল ও পোপ দান করে। ধর্মাশ্রমটি দরিদ্রদের সেবায়ও উদার ছিল।
রোমেনেস্ক শিল্পকলা ও স্থাপত্যরীতি বিস্তারে ইহা বিশেষ অবদান রেখেছিল ক্লুনির গীর্জাটি দীর্ঘকাল ধরে ইউরোপের বৃহত্তম গীর্জা ছিল।ক্লুনির প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের আশপাশের অন্যান্য দালান-কোঠার সমাবেশকে আকৃষ্ট করে। ক্লুনির সমসাময়িক অন্যান্য বেনেডিক্টিয় ধর্মাশ্রমগুলো তাদের এলাকা সমূহে যেমন- অভারগ্নে লা শেই দিউ, মার্সেই এর সেন্ট ভিক্টর , তাসকানিতে সাধু রোমাউয়াল্ড কর্তৃক স্থাপিত কামালডলিতে প্রভাব ফেলেছিল। (মন্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি: পৃ: ১৪৩-১৪৫)
৫.সাধু পাকোমিয়াস:
সাধু পাকোমিয়াস Pachomius মৃ: ৩৪৬ খৃ:) ছিলেন প্রথম যিনি সন্ন্যাসীদের সাধারণ জীবন পরিচালনার জন্য কিছু নিয়ম তৈরী করেছিলেন। তাঁর ছিল অনেক সঙ্গী ও শিষ্য। তিনি নয়টি মঠাশ্রম স্থাপন করেছিলেন যার প্রতিটিতে ছিল ১০০ জন করে সন্ন্যাসী।
(খৃষ্টবিশ্বাসের পরিচিতি:পৃ: ১২৬)
আরো তিনজন কাপ্পাডোসীয় পিতৃ বাজিল,গ্রেগরী নাজিয়ানজেন এবং নিঃস্যার গ্রেগরী এর সন্ন্যাসজীবন সম্পর্কে ছিল ভিন্ন মত। তাদের মতে, মানব সমাজ মন্দ নয় এবং এটাকে ত্যাগও করতে হবে না। এই তিনজন ছিলেন ব্যস্ত বিশপ, সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন ঐশতাত্ত্বিক বিরোধগুলোতে এবং রাজনৈতিক বিষয়ে। তবুও তারা সব সময় মরুভূমিতে ফিরে আসতেন এবং ধ্যান করতেন। এভাবে তারা অনুভব করেছিলেন যে কাজের মধ্যে ‘ডুবে যাওয়া’ থেকে তারা রক্ষা পেতে পারে এবং তাদের জীবনের লক্ষ্য স্মরণ করতে পারে,অর্থাৎ মঙ্গলসমাচারের শিক্ষাকে পূর্ণভাবে অনুসরণ করা।
(খৃষ্টবিশ্বাসের পরিচিতি: পৃ: ১২৬)
৬.সাধু বেনেডিক্ট:
পাশ্চাত্যে সন্ন্যাসবাদের আসল পিতা ছিলেন সাধু বেনেডিক্ট (Benedict মৃ: ৫৪৭ খৃ:) যুবক বয়সে তিনি রোম নগরীর পাহাড়ী অδলে চলে গিয়েছিলেন প্রার্থনায় একাকী জীবন ধারণের জন্য। কয়েক বৎসরের মধ্যেই আরো অনেক যুবক তার সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন প্রথমে শিক্ষার জন্য এবং পরে তার জীবন সহভাগিতার জন্য। বেনেডিক্ট সংঘবদ্ধ জীবনের জন্য নিয়মাবলী লিখেছিলেন যা পাশ্চাত্য সন্ন্যাসবাদের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দলিলে পরিণত হয়েছিল।
সাধু বেনেডিক্টের সন্ন্যাস জীবনের মূল সুর হল ‘প্রার্থনা ও কাজ’। তাদের মঠে রয়েছে প্রতিদিনের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়সূচি। যার মূলে রয়েছে দলীয়ভাবে সাত বার সামসঙ্গীত আবৃত্তি করা আর তা শুরু হতো নিশি ভোর দু’টো থেকে। মূলত তাদের কাজ ছিল কৃষিকাজ,কিন্তু যখন রোমান সাম্রাজ্য অন্ধকার যুগের ধ্বংসের মুখে পতিত হয়েছিল তখন মঠাশ্রমগুলি দায়িত্ব নিয়েছিল দর্শনভিত্তিক,বিজ্ঞানভিত্তিক এবং ঐশতত্ত্বভিত্তিক শিক্ষা সংরক্ষণের। বেনেডিক্টাইন সন্ন্যাস আশ্রমগুলিকে ঘিরে ইউরোপে গড়ে উঠেছিল অনেক মহানগরী। অনেক অনেক শিক্ষার মহাকেন্দ্র শুরু হয়েছিল সন্ন্যাসবাদী বিদ্যালয় হিসেবে।
(খৃষ্ট বিশ্বাসের পরিচিতি: পৃ: ১২৭)
সাধু বেনেডিক্টের নিয়মাবলী:
তিনজন আইরিশ সন্ন্যাসী প্যাট্রিক, কলম্বা ও কলম্বানুস যে সময়টায় এমন ধরনের সন্ন্যাস জীবনের গোড়াপত্তন করেন যার সাথে প্রাচ্যের আদি নির্জনবাসী সন্ন্যাসীদের (৫ম থেকে ৭ম শতাব্দী) নৈরাজ্যের সঙ্গে মিলিত করেছিল একই সময় সাধু বেনেডিক্ট এর লেখা (৪৮০-৫৪৭ খৃ: এর মধ্যে) ‘নিয়মাবলী’ দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত পাশ্চাত্যের সকল আশ্রমের জন্য প্রেরণায় উৎস হয়ে ওঠে।
উক্ত নিয়মাবলী পূর্বেকার আশ্রম ঐতিহ্য গ্রহণ করে উহা সাদরে সুপারিশযোগ্য ঘোষণা করে। নিয়মাবলীতে ‘সুস্থিতি’র উপর বিশেষ জোর দেয়া হয় সন্ন্যাসীকে তার মঠ বা আশ্রমে বসবাস করার প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করতে হত।
মঠাধ্যক্ষ ছিলেন সংঘবদ্ধ জীবনধারাকে সুসংহত রাখার চালিকা শক্তিস্বরূপ।তাই তাকে ধর্মগুরু ও সংঘের প্রধান উভয় ভূমিকাই পালন করতে হত।তিনি সন্ন্যাসীগণ তাদের কর্তব্য হিসেবে তার প্রতি একান্ত অনুগত থাকতে বাধ্য থাকতেন। এই আনুগত্য তাদেরকে নম্রতার উচ্চ শিখরে আরোহন করতে সাহায্য করত কেননা নম্রতাই ছিল আধ্যাত্মিক অগ্রগতি সাধনের ভিত্তি। স্থিরতা, বাধ্যতা ও নম্রতাই কঠোর সাধনার পথে এগিয়ে নিয়ে যেত।
বেনেডিক্টই মধ্যপন্থী দেশে সন্ন্যাস জীবন সূচনা করেন যার জন্য প্রাচ্যের অমিতাচার পরিহার করেন।
সন্ন্যাসীগণ দরিদ্রতা ব্রতে নিবেদিত জীবন যাপন করতেন বটে, কিন্তু তাদের পোশাক-পরিচ্ছেদ,আহার,নিদ্রা ও প্রার্থনার ব্যাপারে কঠোর সংযম ভাব পরিমিত করা হয়।
গোটা দিনকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়: ঈশ্বরের কাজ (প্রার্থনা ও উপাসনা) ধর্মশ্রাস্ত্র পাঠ ও ধ্যান করা এবং কায়িক পরিশ্রম ও বিশ্রাম। ধর্মশাস্ত্র অধ্যয়ন হয়ে ওঠে বুদ্ধি বৃত্তিক কাজের সূচনা বিন্দু।
সাধু বেনেডিক্টের নিয়মাবলীতে মঠাধ্যক্ষ:
একজন মঠাধ্যক্ষ যিনি কোন মঠ বা আশ্রম পরিচালনার যোগ্য তার কথা সর্বদা মনে রাখতে হবে এবং সৎজীবন যাপন করার মাধ্যমে ধর্মাধ্যক্ষের পদমর্যাদা সু-রক্ষা করতে হবে,কেননা তার নাম বা আখ্যার কারণে আশ্রমে তিনি খৃষ্টের স্থানে অধিষ্ঠিত আছেন বলে মনে করা হয়।
(মন্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি: পৃ: ৮৭)
ক্লেয়ারভ ও সাধু বার্ণার্ড:
১১১৫ সালে স্থাপিত ক্লেয়ারভর ধর্মাশ্রম থেকে বার্ণার্ড (১০৯০-১১৫৩ খৃ:) সিষ্টারীয় ধর্মসংঘের ক্রমবিকাশে যথেষ্ট অবদান রাখেন। তিনি নিজে ৬৬ টি ধর্মাশ্রম স্থাপন করেন। সাধু বার্ণার্ডের তৎপরতা ক্লেয়ারভ এর গন্ডী ছাড়িয়ে গিয়েছিল। দ্বাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে তিনি ছিলেন খৃষ্টমন্ডলীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব।প্রায়শঃ তিনি তার ধর্মাশ্রমের বাইরেও বহু ভিন্নমুখী বিষয়ে জড়িত ছিলেন।
ক্লেয়ারভ এর একজন সন্ন্যাসী যাকে ১১৪৫ সালে তৃতীয় ইউজিনিউ নামে পোপ করা হয়েছিল জীবন বিধান তৈরী করে দেন।বার্ণার্ড সামন্ততান্ত্রিক সমাজকে খৃষ্টীয় ভাবধারা পুষ্ট করতে চেষ্টা করেছিলেন।তিনি সামন্তরাজদের ব্যয়বহুল জীবনধারা কঠোর সমালোচনা করেন ও বিবাহের পবিত্রতা ঘোষণা করেন।
(মন্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি: পৃ: ১৪৭-১৪৮)
মরুবাসী সন্ন্যাসীগণ ও তাদের জীবন:
একাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে মরুবাসী সন্ন্যাসীদের একটি প্রবল আন্দোলন দানা বেঁধে উঠে। প্রায়শ্চিত্ত ও দরিদ্রতার বাসনায় আবিষ্ট হয়ে অনেক নারী-পুরুষ তাদের পাপের ক্ষতিপূরণার্থে বনবাদাড়ে,গুহা,গভীর সংর্কীণ উপত্যকা,দ্বীপ ইত্যাদির ন্যায় ভয়ানক স্থানে আশ্রয় নেয়।
কিন্তু তাদের সাধুতার সুখ্যাতিই মানুষকে বেশী আকৃষ্ট করেছে। এবং তারা হয়ে উঠতেন জনপ্রিয় প্রচারক।মরুবাসী সন্ন্যাসী পিটার সর্বাধিক পরিচিতি হলেও আরব্রিসেলের রর্বাটের ( ১০৪৫-১১১৬ খৃ:) কার্যাবলী সর্বাধিক সুদূর-প্রসারী ফল ফলিয়ে।
লয়রে উপত্যকায় ফন্টেভ্রল্ট এ মহিলাদের ধর্মসমাজ ও পুরুষদের ধর্মসমাজ রূপে তাঁর শিষ্য-শিষ্যাদের প্রতিষ্ঠিত করেন। তবে সন্ন্যাসব্রতিনীদের ধর্মাধ্যক্ষা বিভিন্ন মঠের উপর কর্তৃত্ব করার অধিকার ছিল।
মধ্যযুগ সেই অদ্ভূত ধরণের ধর্মীয় জীবন সেই একান্তবাসী বা নির্জনবাসী সন্ন্যাসীর জীবন প্রত্যক্ষ করেছে।
গীর্জার পাশে নির্মিত ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠ বা খুপড়ীর মধ্যে নর-নারীগণ সারাজীবনের জন্য নিজেদের আবদ্ধ করে রাখতেন।প্রকোষ্ঠের ছোট্ট জানালাগুলো তাদেরকে মাত্র প্রাহরিক প্রার্থনার শব্দ শোনার ও খাদ্য গ্রহণের সুযোগ দিত।
(মন্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি: পৃ: ১৪৫)
নির্জনবাসী সন্ন্যাসী ও তাদের মর্যাদা:
এমনই এক যুগে যখন যাজকগণ ছিলেন একমাত্র লোক যারা লিখিত বাণী মারফতে নিজেদের ব্যক্ত করতেন,তখন খৃষ্টীয় আদর্শের ধারক ও বাহক ছিলেন নির্জনবাসী সন্ন্যাসী। সাধু-সাধ্বীদের পηিকা ধর্মপাল নির্জনবাসী সন্ন্যাসী ও অন্যান্য সন্ন্যাসব্রতীদের ছাড়া অন্য কাউকে স্বীকৃতি দিত না বললেই চলে। সেখানে বড় জোর এমন রাজকন্যার স্থান থাকত যিনি বিয়ের পর অতি শীঘ্রই বিধবা হলে জীবনের বাকী দিনগুলো কাটান প্রায়শ্চিত্ত করে ও গরীব দুঃখীদের প্রতি সৎকাজ করে।
সাধু বার্ণার্ড জগৎ সংসারকে একটি বিশাল সাগরের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন যে সাগরকে পরিত্রাণ লাভের আগে অতিক্রম করতে হত। নির্জনবাসী সন্ন্যাসীগণ সেই সাগর পার হতে যেয়ে ভিজতেন না, কেননা তাঁরা সাগর পার হতেন একটি পুল দিয়ে। কর্মযোগী ধর্মযাজকগণ সাধু পিতরের নৌকা ব্যবহার করতেন।কিন্তু হতভাগ্য বিবাহিত লোকদের সাঁতরিয়ে সাগর পার হতে হত এবং তা করতে গিয়ে অনেকে ডুবে মরত।
সন্ন্যাসব্রতী হতে না পেরে ধর্মপরায়ন ভক্ত সাধারণ সন্ন্যাস জীবনের কিছুটা অনুসরণ করতে চেষ্টা করেন। সাধু লুইস প্রাহরিক প্রার্থনাগুলো আবৃত্তি করতেন,রাত্রি দ্বিপ্রাহরিক প্রার্থনার জন্য রাতে ঘুম থেকে জাগতেন। এবং অনেক ত্যাগ স্বীকার করতেন। ভক্ত সাধারণের অনেকেই মৃত্যুর সময় এই মর্মে নির্দেশ দিয়ে যেতেন যে, মৃত্যুর পর যেন তাদেরকে সন্ন্যাসী পোশাকে সমাহিত করা হয়।
(মন্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি: পৃ: ১৪৯)
মঠবাসী যাজক:
মঠবাসী যাজকগণ সাধু আগস্টিনের নিয়মাবলীকে গ্রহণ করে সেবাদায়িত্ব পালনের কৃচ্ছ্রসাধনার সন্ন্যাস জীবনের সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন। ১১২৬ সালে নর্বাট কর্তৃক স্থাপিত প্রেমনস্টাটেনসীয়গণ এ ক্ষেত্রে সর্বাধিক পরিচিতি পেয়েছিলেন।
( প্রাগুক্ত:পৃ: ১৪৫-১৪৭)
অর্থডক্স মন্ডলীতে সন্ন্যাসবাদ:
অর্থডক্স মন্ডলী সমূহেও খৃষ্টধর্মের উন্নয়নের জন্য সন্ন্যাসবাদ কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। অর্থডক্স সন্ন্যাসীগণ বাজিল কর্তৃক বাজিলিয় নিয়ম ‘ অনুসরণ করেন যা পরামর্শ প্রদান করে প্রতিদিন দলীয়ভাবে প্রার্থনা এবং আশ্রমের ভিতরে বিভিন্ন কাজ।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য স্থান হলো এথস পর্বত যা অবস্থিত উত্তর গ্রীসের একটি উপদ্বীপে। এই পর্বতের উপরই রয়েছে ২০ টি আলাদা আলাদা মঠাশ্রম। এথস পর্বতের আশ্রমগুলির সঙ্গে সিনাই পর্বতের সাধ্বী ক্যাথারিনের আশ্রম সংযুক্ত আর শতাব্দীর পর শতাব্দী বিশেষ ভূমিকা রেখে আসছে অর্থডক্স মন্ডলীর আধ্যাত্মিক জীবনের প্রতি। বিশেষ ভাবে রাশিয়ান অর্থডক্স মন্ডলীতে। সেই দেশের খৃষ্টধর্মের ইতিহাসে সন্ন্যাসবাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
(খৃষ্টবিশ্বাসের পরিচিতি: পৃ: ১২৭-১২৮)
সন্ন্যাসীদের জীবন ধরণ:
সন্ন্যাসীরা শুধু প্রার্থনাপূর্ণ জীবনই অতিবাহিত করেনি কিংবা ধর্মীয় পরামর্শ বা শহর থেকে দেখতে আসা লোকদের উৎসাহই প্রদান করেননি বরং তারা জড়িত ছিল সমাজের মহামূল্যবান কার্যক্রমে। মরুভূমির মঠাশ্রমগুলো তাদের প্রদান করত নিরাপদ আশ্রয় ও আতিথিয়েতা,নীরবতা ও শান্তি যারা মরুভূমিতে ভ্রমণ কালে হারিয়ে গেছে।
এ বিষয়ে আমরা বাজিল ,গ্রেগরী নাজিয়ানজেন এবং গ্রেগরী নিঃস্যার জীবন থেকে দেখতে পাই যে, তারা তিনজনই ছিলেন ব্যস্ত বিশপ, সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন ঐশতাত্ত্বিক বিরোধগুলোতে এবং রাজনৈতিক বিষয়ে। তবুও তারা সব সময় মরুভূমিতে ফিরে আসতেন প্রার্থনা এবং ধ্যান করতে। এভাবে তারা অনুভব করেছিলেন যে, কাজের মধ্যে ‘ডুবে যাওয়া’ থেকে তারা রক্ষা পেতে পারে। এবং তাদের জীবনের লক্ষ্য স্মরণ করতে পারে। অর্থাৎ মঙ্গল সমাচারের শিক্ষাকে পূর্ণভাবে অনুসরণ করা।
(খৃষ্ট বিশ্বাসের পরিচিতি: পৃ: ১২৬-১২৭)
অযাজকীয় সন্ন্যাস-জীবন:
মহিলাদের জন্য ও পুরুষদের জন্য যে অযাজকীয় সন্ন্যাস জীবন মন্ডলীতে রয়েছে তা এমন একটি পূর্ণ জীবনাবস্থা যার লক্ষ্য হল মঙ্গল বাণীর সুমন্ত্রণাগুলো পালনের ব্রত গ্রহণ। এই পবিত্র মহাসভা (দ্বিতীয় ভাটিকান মহাসভা) তাদের জীবনের মহত্ব স্বীকার করেছে, কারণ তারা তরুণদের শিক্ষা দিয়ে দুঃস্থ-পীড়িতদের সেবা করে এবং অন্যান্য সেবামূলক কাজ সম্পন্ন করে মন্ডলীর পালকীয় কাজে বিশেষ সাহায্য দান করেন।
সন্ন্যাসব্রতী ভ্রাতৃসংঘগুলো যদি তাদের আশ্রমের প্রয়োজনে কোন কোন সভ্যকে পবিত্র যাজক বরণ পদে উন্নীত করতে চায়,তাহলে কোন বাঁধা বা আপত্তি থাকবে না। অবশ্য এতে সে সব সংঘের অযাজকীয় বৈশিষ্ট্যটি অপরিবর্তিত থাকবে এবং সংঘের আশ্রমগুলোর যাজকীয় সেবা কাজের প্রয়োজনার্থে এরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।
(দ্বিতীয় ভাটিকান মহাসভার দলিলসমূহ:পৃ:২৬৩-২৬৪)
হেজেকিজম:(Hesychasm):
হেজেকিজম শব্দটি হল একটি গ্রীক শব্দ যার অর্থ ‘নীরবতা’ আর এটি নির্দেশ করে অর্থডক্স খৃষ্টধর্মে অতীন্দ্রিয়বাদের ব্যবহারের প্রধান ধারা। এই আধ্যাত্মিকতার পদ্ধতি যীশুর নাম ‘জপ’ করে উপলব্ধি করতে চায় ঈশ্বরপুত্র যীশুর গৌরব। এই পদ্ধতিটি শুরু হয়েছিল চতুর্থ থেকে পঞ্চম শতাব্দীর সন্ন্যাসীদের মধ্যে যা বর্তমানের তুরস্ক ও গ্রীস।
এই পদ্ধতিটি এর বেশীর ভাগ অনুপ্রেরণা লাভ করত গ্রীক পিতৃগণের লেখা থেকে যেমন নিঃচ্ছার গ্রেগরী,জন ক্রিসস্তম, সাধু ম্যাক্সিমাস (মৃ: ৬৬২ খৃ:) ।হেজেকিজমের প্রধান তত্ত্ববিদ হলেন ‘ নতুন ধর্মতত্ত্ববিদ’ নামক সিমেওন (Simeon মৃ: ১০২২ খৃ:) আর গ্রেগরী পালামাস । তারা দু’জন ইতোমধ্যেই এথস ও সিনাই পর্বতের সন্ন্যাসীরা যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পালন করে আসছিল আর হয়ে উঠেছিল রাশিয়ান সন্ন্যাসবাদী আধ্যাত্মিকতার প্রধান রূপ।
(খৃষ্ট বিশ্বাসের পরিচিতি: পৃ: ১২৮)
সন্ন্যাসব্রত বা বৈরাগ্যব্রতের উদ্ভাবক:
পূর্বে ভূমিকায় সামান্য আলোচনা করা হয়েছে যে, বৈরগ্যবাদ পৌলের আবিষ্কার। তিনি নিজেও বিয়ে করেননি এবং তার অনুসারীদেরকেও চিঠি পত্রের মাধ্যমে বিয়ে না করতে উৎসাহিত করেছেন। এখানে আরেকটু বিস্তারিত ভাবে বর্ণনা করছি। এতে স্পষ্ট হবে যে, আসল খৃষ্ট ধর্মে বৈরাগ্যব্রতের কোন স্থান নেই।
এ বিষয়ে পৌল বলেন, ‘অবিবাহিত আর বিধবাদের আমি বলছি, তারা যদি আমার মত থাকতে পারে তবে তাদের পক্ষে তা ভাল। কিন্তু যদি তারা নিজেদের দমন করতে না পারে তবে বিয়ে করুক, কারণ শরীরের কামনায় জ্বলে-পুড়ে মরবার চেয়ে বরং বিয়ে করা অনেক ভাল। যাদের বিয়ে হয়েছে তাদের আমি এই হুকুম দিচ্ছি অবশ্য আমি দিচ্ছি না,প্রভুই দিচ্ছেন- স্ত্রী যেন স্বামীর কাছ থেকে চলে না যায়। কিন্তু যদি চলেই যায় তবে আর বিয়ে না করুক কিংবা স্বামীর সংগে আবার মিলিত হোক। স্বামীও তার স্ত্রীকে তালাক না দিক’। ( ১ করিন্থীয়: ৭: ৮-১১)
উক্ত পত্রে তিনি আরো বলেন , ‘আমি চাই যেন তোমরা ভাবনা চিন্তা থেকে মুক্ত থাকতে পার। অবিবাহিত লোক প্রভুর বিষয়ে ভাবে; সে চিন্তা করে কিভাবে সে প্রভুকে সন্তুষ্ট করবে। বিবাহিত লোক সংসারের বিষয়ে ভাবে; সে চিন্তা করে কিভাবে সে স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করবে।এভাবে দুই দিকই তাকে টানতে থাকে। যে মেয়ের স্বামী নেই এবং অবিবাহিতা মেয়ে প্রভুর বিষয়ে চিন্তা করে যাতে সে শরীরে আর দিলে প্রভুর হতে পারে।কিন্তু বিবাহিতা স্ত্রীলোক সংসারের বিষয়ে ভাবে; সে চিন্তা করে কেমন করে সে স্বামীকে সন্তুষ্ট করবে।
এই কথা আমি তোমাদের উপকারের জন্যই বলছি। আমি তোমাদের ধরাবাঁধার মধ্যে রাখবার জন্য তা বলছি না, বরং যা করা উচিত ও ভাল তা করবার জন্য তোমাদের উৎসাহ দিচ্ছি,যেন তোমরা সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে প্রভুর সেবা করতে পার’।
(১ করিন্থীয় : ৭: ৩২-৩৫)
তিনি আরো বলেন, অবিবাহিতা মেয়েদের জন্য প্রভুর কাছ থেকে কোন হুকুম আমি পাইনি। তবে আল্লাহর রহমত পেয়ে আমি বিশ্বাসযোগ্য হয়েছি বলে আমার মত জানাচ্ছি।যে ভীষণ দুঃখ-কষ্টের সময় আসছে তার জন্য আমার মনে হয় তোমরা যে যেমন আছ তেমন থকাই ভাল। তোমার কি স্ত্রী আছে তবে স্ত্রীকে তালাক দিতে চেষ্টা কোরো না। কিন্তু বিয়ে যদি তুমি করই তাতে তোমার কোন গুনাহ হয় না। কোন অবিবাহিতা মেয়ে যদি বিয়ে করে তাহলে তারও গুনাহ হয় না। কিন্তু যারা বিয়ে করে তারা এই সংসারে কষ্ট পাবে, আর আমি এই সব থেকে তোমাদের রেহাই দিতে চাইছি।
( প্রাগুক্ত : ৭: ২৫-২৮)
এ সকল বাণী থেকে স্পষ্ট প্রতিয়মান হয় যে, এ বৈরাগ্য প্রথার বীজ পৌলই বপন করেছেন।
বৈরাগ্য জীবনের কুফল:
বৈরাগ্য জীবনে বিবাহ বর্জন করে চলার একটি বড় কুফল হচ্ছে, সহজাত প্রবৃত্তি ও কাম রিপুকে অবদমিত রাখার ফলে বৈধ খাতের পরিবর্তে তা অবৈধ খাতে প্রবাহিত হয়েছে। খৃষ্টানদের বিবাহ বর্জনকারী পাদ্রী ও যাজক-যাজিকাদের অবৈধ ও বিকৃত যৌনাচারের সুদীর্ঘ ইতিহাস এর জ্বলন্ত সাক্ষী। চার্চের মতো পবিত্র স্থানে কত নারী ও অবুঝ শিশু যে এসব সাধুদের বিকৃত যৌনাচারের শিকার হয়েছে, তার পরিসংখ্যান দেওয়া কঠিন। প্রমাণ ও দৃষ্টান্ত স্বরূপ আমাদের জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলো থেকে কিছু রিপোর্ট তুলে ধরছি:
১. দৈনিক প্রথম আলোর ২৫,৮,২০০৩ সংখ্যায় একটি রিপোর্টের শিরোনাম ছিল‘‘সহকয়েদির হাতে শিশুদের যৌন নিপীড়ক মার্কিন যাজক খুন। রিপোর্টার লিখেছেন, প্রসঙ্গত , ধর্মীয় শিক্ষা নিতে চার্চে আসা শিশুদের ওপর জন গিওঘানের যৌন নিপীড়নের কাহিনী যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে আলোড়ন তুলেছিল। ১৯৯১ সালে ১০ বছরের একটি বালক সুইমিং পুলে গোসলের সময় গিওঘান তার সাথে সমকামিতায় লিপ্ত হন বলে আদালতে প্রমাণিত হয়েছে। এ ঘটনায় ২০০২ সালে জানুয়ারীতে তাকে ১০ বছরের কারাদন্ড দেওয়া হয়। এ ছাড়া আরোও ১৩০ নারী পুরুষ তার বিরুদ্ধে একই ধরণের কুকর্মের মামলা দায়ের করেন। গিওঘান তার দীর্ঘ ৩০ বছরের যাজক জীবনে এ ধরণের অসংখ্য অপকর্ম করেছেন।
২. দৈনিক কালের কন্ঠ এর ২৯,৩,২০১০ সংখ্যায় ‘‘ ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে ভাষাহীন শিশুদের ধর্ষণ’’ শিরোনামে লেখা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের উইন্স কনসিন অঙ্গরাজ্যে মহৎ মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন ফাদার লরেন্স সি মারফি।আদালতের তদন্তে প্রমাণিত হয় যে, প্রায় ২০০ বধির শিশুকে তিনি যৌন নির্যাতন করেছেন। অনেক চেষ্টা করেও ভাষাহীন শিশুরা সে নির্যাতনের তথ্য মানুষকে জানাতে পারেনি।পরিণত বয়সে এসে এখন মুখ খুলছে তারা। গ্যারি স্মিথ নামে এক ভুক্তভোগী জানায় যে,১২ বছর বয়স থেকে শুরু করে ফাদার মারফি তাকে ৫০-৬০ বার ধর্ষণ করেছে। তিনি সবকিছুকেই ঈশ্বরের যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করতেন। ফলে আমরা মোহিত হয়ে যেতাম।
৩. দৈনিক ইনকিলাবের ২৫,৮,২০০৩ সংখ্যায় এপির বরাত দিয়ে লেখা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে ধর্মযাজকদের যৌন কেলেংকারী নিয়ে জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এ সময় আমেরিকার ৪৬ হাজার ধর্মযাজকের মধ্যে ৩২৫ জনের বেশী ধর্মযাজককে যৌন কেলেংকারীর দায়ে অভিযুক্ত করে বরখাস্ত অথবা ইস্তফা দানে বাধ্য করা হয়।
৪. দৈনিক কালের কন্ঠের ২৯,৩,২০১০ সংখ্যায় আরেকটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, মেক্সিকোর ফাদার মার্সিয়া মার্সিয়েল ফেগোলাদোর অবৈধ যৌনাচারের কথা তারই প্রতিষ্ঠিত গির্জা স্বীকার করেছে। চার্চটি ক্ষতিগ্রস্থদের কাছে ক্ষমা চেয়ে জানায় যে, কেবল শিশুদের সঙ্গেই নয়, একাধিক নারীর সঙ্গেও তার যৌন সম্পর্ক ছিল। তিনি একাধিক অবৈধ সন্তানেরও জনক।
(খৃষ্টবাদ বিকৃতি তথ্য ও প্রমাণ: পৃ: ১১৪-১১৬)
বৈরাগ্যবাদ ও ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি:
দুনিয়ায় যত নবী-রাসূল এসেছেন, প্রত্যেকেই সংসার জীবন যাপন করেছেন এবং মানুষকেও সে রকমই শিক্ষা দিয়েছেন। তাদের শিক্ষার ভেতর ইবাদত-বন্দেগীর মত মানুষের সাথে মেলামেশা, বেচাকেনা ও সমাজ জীবনের প্রয়োজনীয়া সব বিষয়ও সমান গুরুত্ব পেয়েছিল। প্রচলিত বিকৃত ইনজীল সমূহে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের এমন কোন উক্তি পাওয়া যায় না, যা বৈরাগ্যকে সমর্থন করে। তিনি বনী ইসরাঈলের মৌলিক অনুসরণীয় নির্দেশনা তথা তাওরাতের বিধান অনুসারে সমাজ-সংসারজীবন ঘনিষ্ঠ শিক্ষাই দান করতেন। ইসলামেও এ বৈরাগ্য জীবনের কোন স্থান নেই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিবাহ করার বিষয়ে উৎসাহ দান করেন। তিনজন সাহাবী নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইবাদাত জানতে উম্মুহাতুল মুমিনীনদের প্রশ্ন করেন। নবীজীর ইবাদাতের কথা শুনে তাদের একজন বলে উঠলেন, আল্লাহ তাআলা নবীজীর পূর্বাপর সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দেয়ার পরও তিনি এত পরিমাণে ইবাদত-বন্দেগী করেছেন! আল্লাহর শপথ আমি আর ঘর সংসার করব না। স্ত্রী, সন্তান-সন্তুতির কাছে যাব না। যখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এসব কথা সম্পর্কে অবগত হলেন তখন খুব রুষ্ঠ হলেন। এবং তাদেরকে কঠোরভাবে নিষেধ করেন। কুরআনেও বিবাহ করার বিষয়ে গুরুত্ব প্রদান করেছে। কুরআনে বলা হয়েছে,
ربنا هب لنا من ازواجنا و ذريتنا قرة اعين
অর্থ : ‘‘হে আমাদের প্রতিপালক ! আমাদেরকে দান করুন আমাদের পত্নিগণ ও সন্তানদিগের মধ্য থেকে চক্ষু শিতলতা’’। (সূরায়ে ফুরকান: ৭৩ আয়াত)
এমনিভাবে আলী রা: ربنا اتنا في الدنيا حسنة এ আয়াতের ব্যাখ্যা করেছেন সৎ নারী দ্বারা ( দ্রষ্টব্য মিরকাত শরহে মিশকাত) ।
এমনিভাবে হাদীস শরীফেও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, اربع من سنن المرسلين و فيه النكاح
চারটি জিনিস সকল নবী ও রাসূলগণের আদর্শ তার মধ্যে একটি হলো বিবাহ করা ।(মুসনাদে আবু আইয়ুব আনসারী রা: দ্রষ্টব্য:)
আরেক হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যখন কেউ বিবাহ করে সে তার অর্ধেক ঈমান পূর্ণ করে ফেলেছে সে যেন বাকী অর্ধেকের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করে।
(মিশকাত শরীফ)
আরেক বর্ণনায় স্পষ্টভাবে বৈরাগ্যবাদকে নিষেধ করেছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘ইসলামে বৈরাগ্যবাদের কোনও স্থান নেই।’ (لا رهبانية في الإسلام)
এমন আরো অনেক হাদীস আছে, যা রাসূল সা: বিবাহ করার প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন।
এ সকল বক্তব্য থেকে স্পষ্ট প্রতিয়মান হয় যে, ইসলামে সন্ন্যাসবাদের কোন স্থান নেই। এবং সকল নবী ও রাসূলগণের আদর্শ হলো, বিবাহ করা ।
শেষ কথা:
উপরোক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, আসলে সন্ন্যাসবাদ প্রকৃত খৃষ্ট ধর্মে কোন স্থান নেই, এবং হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের শিক্ষার বিরোধী, বরং সকল আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামের শিক্ষার বিপরীত। এ শিক্ষা কেবল প্রচলিত খৃষ্ট ধর্মের রূপকার পৌল সাহেবের একান্তই উদ্ভাবন এবং কল্পনা প্রসূত মনগড়া শিক্ষা।
লেখক, মাওলানা ফাহাদ হাসান
শিক্ষক, দারুল উলুম আজমপুর, ঢাকা