কত সুন্দর সেসব শব্দ, কী দারুণ ঝংকার তোলা সেই বাক্যাবলী; অথচ তা কোন কবির কল্পনা নয়, নয় কল্পনার শক্তিতে মনোলোক থেকে তোলে আনা কোন সাহিত্যিকের শব্দনৈপুন্য; এ বরং সুদীর্ঘ সাহচর্য, বাস্তব অবলোকন ও প্রত্যক্ষ ও গভীর উপলব্ধির পাটাতনে দাঁড়িয়ে সত্যভাষণ। যার প্রতিটি শব্দ দায়বদ্ধ ইতিহাসের কাছে, যার কথকেরা জানেন প্রতিটি শব্দ যাচাই করবেন অন্য সঙ্গীগণ, একটি মাত্র শব্দ ভুল হলে কেউ চুপ থাকবে না।
শুরুর আগে
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকল দিকে দিয়ে যে মানবিক পূর্ণতা, আল্লাহ প্রদত্ত ঐশি গুনাবলী ও সম্মোহনী ব্যক্তিত্ব নিয়ে এসেছিলেন, পৃথিবীতে কোনকালে কাউকেই এমনতর পূর্ণ করে দেওয়া হয়নি এসব। যারা তাঁর কাছে আসতো, পাগলের মতো ভালোবাসত তাঁকে। ব্যক্তিত্বের বিভা, চরিত্রের মাধুরী ও শারীরিক সৌন্দর্যে তিনি ছিলেন বর্ণনাতীত এক মহান মানুষ।
সাহাবায়ে কেরাম রা. নানাভাবে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রূপসৌন্দর্যের বিবরণ দিয়েছেন। উপমা ও তূলনা দিয়ে, শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে তারা চেষ্টা করেছেন তাঁর অপার সে সৌন্দর্যের কিছুটা হলেও যেন ফুটিয়ে তুলা যায়।
কত সুন্দর সেসব শব্দ, কী দারুণ ঝংকার তোলা সেসব বাক্যাবলী; অথচ তা কোন কবির কল্পনা নয়, নয় কল্পনার শক্তিতে মনোলোক থেকে তোলে আনা কোন সাহিত্যিকের শব্দনৈপুন্য; এ বরং সুদীর্ঘ সাহচর্য, বাস্তব অবলোকন ও প্রত্যক্ষ ও গভীর উপলব্ধির পাটাতনে দাঁড়িয়ে সত্যভাষণ। যার প্রতিটি শব্দ দায়বদ্ধ ইতিহাসের কাছে, যার কথকেরা জানেন প্রতিটি শব্দ যাচাই করবেন অন্য সঙ্গীগণ, একটি মাত্র শব্দ ভুল হলে কেউ চুপ থাকবে না। যে বিবরণের একেকটি শব্দ নির্মিত হয়েছে সুদীর্ঘ সময় পরিক্রমার ভিতর দিয়ে, সকলের চোখের সামনে দিনের পর দিন। এমনই সত্যভাষণ এসব, কিন্তু যেন হার মানায় কল্পনাকেও। সংক্ষিপ্ত এ পরিসরে পূর্ণ বিবরণটি আনা তো সম্ভব নয়; অপার সে সৌন্দর্যের একটু ঝলকমাত্র।
এসব বিবরণ দিতে গিয়ে কেউ কিছুটা বিস্তারিত বলেছেন, কেউ বা সংক্ষিপ্ত করে। এ লেখায় আমার নিজের থেকে কোন শব্দ নেই। সবগুলো অক্ষর নির্ভরযোগ্য বর্ণনায় সরাসরি সাহাবায়ে কেরামের মুখ নিঃসৃত বাণী। আমি শুধু ছোট বড় সেসব বিবরণকে একটি সমন্বিত ও ধারাবাহিক চিত্র আকারে পত্রস্থ করে দিয়েছি।
মধুর আবেশে নিমজ্জিত হয়ে, নরম স্বরে, ফিসফিস করে ইতিহাসের কাছে প্রশ্ন করি যদি: বলো তো কেমন ছিলেন তিনি? ইতিহাস তখন ততোধিক আবেশে আচ্ছন্ন হয়ে প্রেমময় এক ঘোরলাগা স্বরে বলে যায়, যেন বৃষ্টির নরম ফোঁটার মতো ঝরে পড়ে অজস্র শব্দেরা।
কেমন ছিলেন তিনি?
তিনি ছিলেন দীপ্তিময় দেহের অধিকারী। দৈহিক গঠনটি বড় সুন্দর ছিল। অত্যাধিক বেঁটে নন, বেখাপ্পা লম্বাও নন—মধ্যম গড়নের দেহ তাঁর। তিনটি শাখার মধ্যবর্তী শাখাটি যেন। তিনি স্থুলকায় ছিলেন না। হাড়ের গ্রন্থি ও গ্রীবাসন্ধি ছিল বড় আর মজবুত। হাত পায়ের আঙ্গুল ও পাতাগুলো গোশতে পুরু। পায়ের গোছা দুটো সুষম তীক্ষ্মতাসম্পন্ন, শরীরের অন্যান্য অঙ্গের সাথে চমৎকার সামঞ্জস্যপূর্ণ।
প্রশস্ত হাতের তালু। সুষম গোড়ালি। উভয় কাঁধের মধ্যবর্তী স্থান বেশ প্রশস্ত। বুক প্রশস্ত ও মসৃণ এবং বুক ও পেটের উচ্চতা সমান্তরাল। দেহে অতিরিক্ত লোম নেই; বুক হতে নাভি পর্যন্ত হালকা লোমের একটি রেখা শুধু, আর কিছু লোম ছিল কাঁধেও দুই বাহুতে। কনুই থেকে কব্জি পর্যন্ত হাত দুটো লম্বা। হাতের কব্জিও প্রশস্ত। হাত-পায়ের হাড়গুলো সোজা, আঙ্গুলগুলো ছিল বড়-সড়। পায়ের পাতা দুটো স্থুল নয়; শূন্য। রেশমের চেয়েও মোলায়েম তাঁর হাতের তালু, আরামদায়ক, শীতল; আর এতো সুগন্ধময়, যেন এই মাত্র হাতখানি বের করে এনেছেন কোন আতরদানী হতে। শরীর হতে বিচ্ছুরিত হত অদ্ভুত সুন্দর এক জান্নাতি ঘ্রাণ।
দেহের রং ধবধবে সাদা নয়, তামাটে বর্ণেরও নয়; ফর্সা। গোলাপি আভাময়। দুধে আলতা মেশানো লালিমামাখা শুভ্র। মাথার গড়নটি বড়সর, পরিমিত। পেছন থেকে দুই কানের লতি পর্যন্ত বিস্তৃত ঘনকালো বাবড়ি চুল। খুব বেশি কোঁকড়ানো নয়, একেবারে সোজাও নয়; কিছুটা ঢেউ খেলানো। ইসলামের প্রথমাবস্থায় আহলে কিতাবিদের সঙ্গে সাদৃশ্য তৈরীর জন্য চুলগুলো আঁচড়াতেন পেছন দিকে। পরবর্তী সময়ে আঁচড়াতেন দুপাশে সিঁথি করে। ইন্তেকালের সময়ও তাঁর চুল ও দাড়ি ছিল কালো। সাদা চুল ও দাড়ি সব মিলিয়ে বিশটির মতও হবে না। শুধুমাত্র দুই জুলপিতে কিছু চুল সাদা হয়েছিল, সাদা হয়েছিল ঠোঁটের নীচের কয়েকটি নিমদাড়িও। শুভ্র রৌপ্যে চুবানো পুতুলের ঘাড়ের মতো কমনীয় ঘাড়।
মুখমণ্ডল বড় ও প্রশস্ত, লাবন্যময়, ইষৎ গোলাকৃতি, চাঁদের মতো, উজ্জ্বল আর মায়াবি। প্রশস্ত ললাট। উন্নত নাক। চোখ দুটো ঘন কালো, সাদা অংশ ধবধবে সাদা। টানাটানা। ভ্রু যুগল সুন্দর ঈষৎ বাঁকানো, পরস্পর সন্নিবেশিত আর দীর্ঘ। সুন্দর দীঘল তাঁর পাঁপড়ির চুলগুলোও। সুরমা না লাগালেও মনে হতো দুচোখে সুরমা দিয়েছেন তিনি। দীর্ঘ গ্রীবা। গাল ছিল হালকা পাতলা, মসৃণ।
তাঁর দাঁতগুলো বরফের মতো উজ্জ্বল শুভ্রতা নিয়ে আলো ছড়াতো। সামনের দুই দাঁতের মাঝে একটু ফাঁকা ছিল। যখন কথা বলতেন, সে জায়গাটি দিয়ে বিচ্ছুরিত হতো নূরের ঝলক। ঘন সন্নিবেশিত দাড়ি। আকর্ষণীয় দরাজ কণ্ঠস্বর। সুদর্শন। সুপুরুষ।
বাম কাঁধের নরম হাড় ঘেঁষে দুই কাধের মধ্যবর্তী স্থানে ছিল নবুওয়তের মোহর। কবুতরের ডিমের আকৃতির, দেখতে মুষ্ঠিবদ্ধ হাতের মতো, দেহের রঙের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। আশপাশে আঁচিলের মতো তিলও ছিল কিছু। তিনি ছিলেন খাতামুন নাবিয়্যীন—নবীগণের সিলসিলা সমাপ্তকারী সর্বশেষ মানুষটি। হাঁটেন দ্রæত বেগে এবং দৃঢ় পদক্ষেপে, আলতো পা ফেলে, যেন ঢালু কোথাও হতে নেমে আসছেন তিনি সমতল ভূমির দিকে।
কারও দিকে তাকাতে হলে পুরো শরীর ঘুরিয়ে তাকাতেন। কোনও কিছুর প্রতি ইশারা করলে সম্পূর্ণ হাত দিয়ে করতেন। বিস্মিত হলে হাতের তালু উল্টাতেন। যখন নীরব থাকেন, মোন গাম্ভীর্য উপচে পড়তো। কথা বললে, ঝর্ণার মত ঝরে পড়ত দীপ্তি ও সৌন্দর্য। তিনি সবার চেয়ে সুন্দর। এমন যে, দূর থেকেই তাঁর সৌন্দর্য নজর কেড়ে নেয়। সবার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। কাছে গেলে বড় আপন ও মধুর লাগে।
তিনি সবার মধ্যমনি। সকলের ভালোবাসা ও সেবার পাত্র, সকলের মর্যাদার নিশানা। স্বভাবে কঠোর নন। কোমল, মধুর। কারও নিন্দা করেন না। কাউকে তুচ্ছও করেন না। সকল মানুষের চেয়ে প্রশস্ত হৃদয়ের অধিকারী। সবচেয়ে বেশি দানশীল। তাঁর মতো সাহসী কেউ নেই, ছিলও না কোনকালে। সদা সত্যবাদী। মানুষের দেওয়া আমানতের তূলনাহীন হেফাজতকারী। অসাধারণ কোমল এক হৃদয় তাঁর। শ্রেষ্ঠ, অভিজাত এবং সবচেয়ে উচ্চ বংশের মানুষ। কেউ তাঁকে হঠাৎ দেখলে ভীত হয়ে পড়ত তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রভাবে। কিন্তু যে তাকে চিনত, কাছে এসে মিশতো ঘনিষ্ঠ হয়ে, ভক্তি ও ভালোবাসায় তার প্রাণ ভরে যেত। যখন খুশি হতেন, লাজুকতায় চোখ নামিয়ে ফেলতেন। এ সময় চেহারা মুবারক ঝলমল করে উঠত, আলোর বন্যায় ভেসে যাওয়া চাঁদের টুকরোটি যেন।
সবসময় মুচকি হাসতেন। যেন ফারাযদাকের সেই কবিতাটি তিনি:
সে লজ্জায় দৃষ্টি নামিয়ে রাখে,
তার গাম্ভীর্যের প্রভাবে অন্যরাও নত করে ফেলে চোখ।
আর, সে কথা বলে কেবলই মায়াবি মধুর মৃদু হাসির তরঙ্গ ছড়িয়ে, চারপাশ ভরিয়ে আলোয় আলোয়।
যখন ক্রোধান্বিত হতেন, ডালিমের দানা নিংড়ানো একটি লালিমা ছড়িয়ে পড়তো পুরো চেহারা জুড়ে। শরীর হতে ঝরে পড়া ঘাম ছিল জ¦লজ¦লে, মুক্তোদানার মত সুন্দর। রুবায়্যি‘ বিনতে মুআউবিয রা. যথার্থই বলেছেন—তাঁকে যদি দেখতে, দেখতে যেন উদিত হয়েছে একটি সূর্য।
কবি হাসসান বিন সাবিত রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন:
আপনাকে সৃষ্টি করা হয়েছে সকল ত্রুটি থেকে মুক্ত করে।
যেন সৃষ্টি করা হয়েছে আপনি যেভাবে নিজেকে চেয়েছেন সেভাবে।’’
হযরত জাবের ইবনে সামুরা রা. বলেন— কোন এক জোছনা রাতে আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখলাম। তাঁর পরনে তখন একজোড়া লাল রঙের পোশাক, ডোরাকাটা। আমি একবার তাঁকে দেখি, আরেকবার তাকাই চাঁদের দিকে। মনে হলো চাঁদ নয়; তিনিই বেশি সুন্দর।
তাঁর সঙ্গীগণ সবাই তাঁর জন্য উৎসর্গপ্রাণ। সবময় তাঁকে ঘিরে রাখেন তারা। যখন কথা বলেন, নিবিষ্ট হয়ে শুনেন। কোনও আদেশ করলে সঙ্গে সঙ্গে পালন করেন। তাঁর প্রতি সঙ্গীদের ভালোবাসা ও ভক্তি এতো বিপুল ছিল, পৃথিবীতে যার একটি তূলনাও নেই। তিনি অজু করলে অঙ্গধোয়া পানি নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যেত তাদের মাঝে, তিনি থুতু ফেললে তারা সাগ্রহে হাত পেতে দিতেন পবিত্র সে থুতুর ভাগ পাওয়ার আশায়। শত্রুর আঘাতে শরীর যখন রক্তাক্ত হলো, তারা সে রক্ত পরিস্কার করতে গিয়ে খেয়ে ফেলতেন। বরকতময় পবিত্র এ জিনিস নিজের ভিতরে নিয়ে নেওয়ার সুযোগ তো হাতছাড়া করা যায়। তাঁর সুগন্ধি ঘাম বোতলে জমিয়ে রাখতেন যতœ করে। আঙুলের সামান্য ইশারায় হাসতে হাসতে উৎসর্গ করে দিতেন আপন প্রাণ। পৃথিবীতে কে কবে পেয়েছে এমন ভালোবাসা! এমন পাগল আশেক ভক্তের দল!
তাঁর কথা ছিল খুবই সুন্দর। সাহাবায়ে কেরামের বিবরণ থেকে দেখা যায় তিনি ছিলেন স্পষ্ট, বিশুদ্ধ ও অনন্য মিষ্টভাষী। কথা বলেন পরিমিতভাবে। কম নয়, বেশিও নয়। নেই অনর্থক কোন কিছু। তাঁর কথা যেন ছড়িয়ে পড়া মুক্তোদানা। প্রজ্ঞাপূর্ণ। প্রাঞ্জল। প্রতিটি কথা একটি থেকে আরেকটি আলাদা হতো। অনর্থক বিস্তারিত ছিল না আবার দুর্বোধ্য রকমের সংক্ষিপ্তও ছিল না।
ফলে সকল স্তরের মানুষ তাঁর কথা সহজেই বুঝতে পারত। কথায় কঠোরতার ছাপ ছিল না, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের ভাবও ছিল না। নরম ও অমায়িক। প্রতিটি কথা ছিল অতল মর্মবাহী। লোকিকতাহীন। অল্প শব্দে গভীর অর্থ প্রকাশ করার ঐশি এক ক্ষমতা ছিল তাঁর। আরবের সর্বশ্রেষ্ঠ বিশুদ্ধভাষী। প্রতিটি গোত্রকে সম্বোধন করতেন সে গোত্রের নিজস্ব বাকরীতিতে। তাঁর ভাষায় ঝংকৃত হতো আরব বেদুইনদের শুদ্ধতা ও অলংকার, নগরের পরিমার্জন, রুচি ও মিষ্টতা, ওহীর মাধ্যমে প্রাপ্ত আলোর কিরণ। প্রয়োজন ছাড়া কথা বলতেন না। অধিকাংশ সময় নীরব থাকতেন। ঠোঁটের কোণ দিয়ে নয়; কথা বলতেন পুরো মুখ ও ঠোঁট ভরে।
তিনি ছিলেন ধৈর্য ও সহনশীলতার মূর্তপ্রতীক। জীবনভর অজস্র ঘটনার ভিতর দিয়ে তার সহনশীলতার বিষয়টি প্রকাশিত ও বিকশিত হয়েছে সাহাবায়ে কেরামের সামনে। ব্যক্তিগত কারণে কখনো প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি। সহজ ও কঠিন দুটোর কোন একটি গ্রহণের সময় সহজটিই গ্রহণ করতেন। সহজে রাগ করতেন না। কখনো রাগান্বিত হলে দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে যেতেন। মুসলিম অমুসলিম, মানুষ প্রাণী, গাছপালা, উদ্ভিদ সকল কিছুর প্রতি ছিলেন সীমানীহন মমতাবান, দয়ার্দ্র ও কল্যাণকামী।
দানশীলতায় অনন্য। ইবনে আব্বাস রা. বলেন—রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ দানশীল। তাঁর দানশীলতা ছিল বহমান বাতাসের চেয়েও বেশি। হযরত জাবের রা. বলেন—রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে কিছু চাওয়া হলে কখনও না করতেন না।
শক্তি, সাহসিকতা, বীরত্ব ও শৌর্যবীর্যে তিনি ছিলেন সবার চেয়ে আলাদা। সবার চেয়ে বেশি। আল্লাহর ভয় ছাড়া আর কোন ভীতি তার আত্মায় জায়গা পায়নি কখনোই। আলী রা. বলেন—যুদ্ধ যখন তীব্র আকার ধারণ করতো এবং উভয় পক্ষ লড়াই শুরু করে দিতো, আমরা তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আড়ালে নিজেদেরকে বাঁচানোর চেষ্টা করতাম। ফলে তিনি ছাড়া আমাদের আর কেউ শত্রুর অধিক নিকটবর্তী থাকত না।
তাঁর বিশেষ একটি গুণ ছিল লাজুকতা। আবু সাঈদ খুদরী রা. বলেন—রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্দার অন্তরালে থাকা কুমারী মেয়ের চেয়েও অধিক লজ্জাশীল ছিলেন। অপছন্দনীয় কিছু দেখতে পেলে চেহারার দিকে তাকালেই বুঝা যেত। তিনি কখনও কারও প্রতি দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকতেন না। দৃষ্টি অবনত রাখতেন। কারও প্রতি অসন্তুষ্ট হলে তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতেন এবং অমনোযোগীতা প্রকাশ করতেন। কেউ আপত্তিকর কিছু করলে তাকে সরাসরি জিজ্ঞাসাবাদ বা সম্বোধন করতে লজ্জা হতো তাঁর। এ সময় কথা বলতেন পরোক্ষ সম্বোধনে। কী হলো মানুষের? তারা এমন করে কেন! এভাবে বলে সতর্ক করে দিতেন শুধু।
তাঁর সত্যবাদিতা, সচ্চরিত্রবান হওয়া, আমানতদারিতা ও ন্যায় বিচারের কথা তাঁর শত্রুরাও স্বীকার করত অকুন্ঠচিত্তে। এ জন্যই নুবওয়াতের পূর্বে তাকে সবাই ডাকত আল আমীন বলে। জাহেলি যুগে বিচার-আচার বিষয়ে বিচারক হিসেবে তাঁকেই গ্রহণ করতো সবাই। এমনকি ইসলামের দাওয়াত দিতে শুরু করার পরও কাফেররা ‘ব্যক্তি মুহাম্মদ’-এর সত্যবাদিতা নিয়ে কখনো আপত্তি তুলেনি। তাদের আপত্তি ছিল শুধু রাসূল হিসেবে যা বলছেন সেসব নিয়ে।
এ জন্যই আবু জেহেল বলত—আমরা আপনাকে মিথ্যুক বলছি না। তবে আপনি যেসব বিষয় নিয়ে এসেছেন সেগুলোকে মিথ্যা মনে করছি। ইসলাম গ্রহণের আগে কাফের সর্দার আবু সুফিয়ান হিরাক্লিয়াসের ভরা দরবারে সাক্ষ্য দিয়ে এসেছিলেন তার সত্যবাদিতার; অথচ আবু সুফিয়ান তখন জানতেন এটা সাধারণ কোন দরবার নয়; আন্তর্জাতিক পরিসর। এখানে বলা কথাটি ছড়াবে দুনিয়াব্যাপী, তবু ‘মুহাম্মদ সত্যবাদী’ এ স্বীকৃতি দিতে তিনি বাধ্য ছিলেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী প্রকৃতির মানুষ। অহংকারের ছিটেফোঁটাও তাঁর মধ্যে ছিল না। তাঁর সম্মানে কারো দাঁড়ানোকে তিনি পছন্দ করতেন না। তিনি অসহায়দের সেবা-শুশ্রুষা করতেন। দরিদ্রদের সঙ্গে ওঠাবসা করতেন। একজন সাধারণ গোলামের দাওয়াতও তিনি গ্রহণ করতেন।
হযরত আয়েশা রা. বলেন—রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের জুতা ও কাপড় নিজেই সেলাই করতেন। নিজ বকরির দুধ দোহন করতেন। নিজের কাজ সব নিজেই সম্পন্ন করতেন।
প্রতিজ্ঞাপূরণে তিনি ছিলেন সীমাহীন যত্নবান। সকল অশালীন স্বভাব ও আচার থেকে মুক্ত ছিলেন। তিনি কাউকে অভিশাপ দিতেন না। বাজারে গিয়ে উচ্চস্বরে হল্লা করতেন না। পথে চলতে গেলে কাউকে তিনি পেছনে ফেলে যেতেন না। খাবার ও পোশাকে তাঁর দাস-দাসীর উপর নিজেকে কখনও প্রাধান্য দিতেন না।
(উম্মতের চিন্তায়) সর্বদা ব্যথিত হয়ে থাকতেন। ডুবে থাকতেন গভীর চিন্তা ভাবনার ভিতর। সাহাবাদের সাথে তাদের হাসি ও আনন্দে শরীক হতেন, তারা বিস্মিত হলে, বিস্মিত হতেন তিনিও। তাঁর মমতা ও ভালোবাসা, উত্তম আচরণ ও হৃদয়ের উষ্ণতা সকলের মাঝে সমানভাবে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। ফলে সকলেই তাঁকে গ্রহণ করেছিল মমতাবান পিতার মতো। ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর কাছে সবাই ছিল সমান। ভীনদেশি মুসাফিরকে আদরে আপ্যায়নে অভিভূত করে দিতেন।
তিনি সদা হাস্যোজ্জ্বল থাকতেন। উচ্চস্বরে কথা বলতেন না, অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করতেন না, কাউকে তিরস্কার করতেন না এবং কারও উচ্চ মাত্রার প্রশংসা করতেন না। প্রত্যেক গোত্রের মর্যাদাবান ব্যক্তিকে যথাযথ মর্যাদা দিতেন এবং তাকে সে গোত্রের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করতেন। তিনটি বিষয় থেকে তিনি দূরে থাকতেন—লোকদেখানো, সব কিছুতে আধিক্য গ্রহণ এবং অনর্থক কাজ ও কথাবার্তা। তিনটি কাজ থেকে লোকদের বিরত রাখতেন—কারও নিন্দা করা, কারও ছিদ্রান্বেষণ করা এবং কারও দোষ প্রকাশ করা।
মহান আল্লাহ তাআলা তাঁর চরিত্রমাধুরির অনন্যতার সাক্ষ্য দিয়ে বলেছেন
নিশ্চয়ই আপনি চরিত্রের সর্বোচ্চ স্তরে রয়েছেন।
[সূরা কলাম: ৪]
তাঁর উচ্চতার পরিমাপ কে করতে পারে?
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
-
তথ্যসূত্র:
আর রাহিকুল মাখতুমের বরাতে: ইবনে হিশাম,জামে তিরমিযি, সহীহ মুসলিম,
সহীহ বুখারী ,সুনানে দারেমী, মিশকাতুল মাসাবীহ,আশ-শিফা লিল কাযী ইয়ায, শামায়েলে তিরমিযি, খুলাসাতুস সিয়ার।