বিয়ে মানব জীবনের অতীব গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায়। এজন্য বিয়ে ও বিয়ে বিচ্ছেদ নিয়ে আলাপের আগে স্বভাবতঃ জীবন ও জীবনের মর্ম নিয়ে আলোচনা উঠবে।
জীবনের মানে কী? মানব জীবনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য কী? এ নিয়ে নানা জনের নানা বক্তব্য ও বিশ্লেষণ আছে। দীর্ঘ বিবরণে না গিয়ে আমরা শুধু ইসলাম ও বস্তুবাদি পশ্চিমা সমাজের অবস্থান নিয়ে কিঞ্চিত আলোচনা করব। এর কারণ হচ্ছে, পুরো পৃথিবী ব্যাপকভাবে পশ্চিমা জীবন দর্শনকে নিজেদের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে। একে প্রত্যাখ্যান ও চ্যালেঞ্জ করার ইচ্ছা ও সাহস কোন জাতি গোষ্ঠি প্রদর্শন করছে বলে দৃশ্যমান হচ্ছে না। সবাই নিজেকে এই বস্তুবাদি দর্শনের কাছে সঁপে দিয়েছে। ব্যতিক্রম শুধু ইসলাম ও মুসলিমদের একটি উল্লেখযোগ্য জনগোষ্ঠি। যারা নিজেদের স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্রে বিশ্বাস করে। এবং অন্য কোন জাতির আদর্শ ও জীবন দর্শনে নিজেদের সঁপে দিতে নারাজ।
জীবনের মানে কী?
মানুষের সৃষ্টি ও মানব জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কুরআন হাদীসে যে আলোচনা করা হয়েছে তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ হচ্ছে, মানুষের মূল ও প্রধান পরিচয় হচ্ছে, মানুষ আল্লাহ তায়ালার সৃষ্ট আবদ-বান্দা বা দাস। তিনি এই মানবকে উদ্দেশ্যহীন ও অনর্থ সৃষ্টি করেন নি। সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। মানুষ আল্লাহ তাআলার পরিচয় লাভ করবে, তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে, তাঁর আনুগত্য ও ইবাদত বন্দেগীতে নিয়োজিত হবে। নবী রাসূলদের মাধ্যমে মানবজাতির কাছে যে বিধি বিধান দিয়েছেন, মানুষ তার অনুসরণ করবে। এভাবে ঈমান বিশ্বাস আনুগত্য ইবাদত ও পূণ্যকাজের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন করবে। এভাবে এক সময় মানুষের মৃত্যু হবে। পুনরুত্থানের পর পরকালীন জীবনে ইহকালীন জীবনের কর্মফল হিসেবে সর্বোচ্চ সাফল্য ও সম্মানের জান্নাত লাভ করবে।
কিন্তু কেউ যদি আল্লাহর পরিচয় লাভ না করে, তাঁর প্রতি ঈমান না আনে, ইবাদত ও আনুগত্য না করে, তাহলে তাঁর জীবন ব্যর্থ হিসেবে গণ্য হবে। এই ব্যররথ জীবনের ফল স্বরূপ পরকালে কঠোর শাস্তির শিকার হবে। তার স্থায়ী ঠিকানা হবে জাহান্নাম। এই হল, ইসলামী দর্শনে জীবনের মর্ম ও উদ্দেশ্য।
কিন্তু পশ্চিমা বস্তুবাদি দর্শনে জীবনের মর্ম এ থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত। সেখানে মানুষের সৃষ্টিকর্তা গুরুত্বপূর্ণ নয়, সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মানুষ! অধিকাংশ তো সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসই রাখে না। কেউ আছে সংশয়বাদি। অনেকে সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করলেও মানবজীবনে সৃষ্টিকর্তার বিশেষ কোন ভূমিকা স্বীকার করে না। ফলে মানুষ সৃষ্টিকর্তার গোলাম বা দাস, এই বিশ্বাস সেখানে অনুপস্থিত। ফলে সৃষ্টিকর্তার আনুগত্য, তাঁর আদেশ নিষেধ মেনে চলে সন্তুষ্টি অর্জন করা, কিংবা পরকালীন জবাবদিহিতা বা প্রতিদান লাভ করা, এসবের কোন কিছুই সেখানে উপস্থিত নেই। তাহলে তাদের জীবনে কী আছে? কেন তারা বাঁচে? সহজ করে বললে এর উত্তর হচ্ছে, তাদের কাছে এই দুনিয়ার জীবনই যখন একমাত্র জীবন এবং শেষ কথা, তাই এজীবনে কে কত বেশি সুখ লাভ করতে পারে, স্বাধীনভাবে যেভাবে খুশি জীবনকে উপভোগ করতে পারে, এটাই জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য।
ফলে এখানে ন্যায় অন্যায় নীতি নৈতিকতা বলে কিছু নেই। হালাল হারামের কোন ধারণা নেই।নেই পাপ পূণ্যের কোন মানদন্ড। পশ্চিমা এই দর্শন মতে, মানুষের অবাধ স্বাধীনতা রয়েছে। তার প্রবৃত্তি যা চাইবে সে তাই করতে পারবে, যতক্ষণ না এটি অন্য কারো ক্ষতি করছে। এবং এই ব্যক্তি স্বাধীনতা হচ্ছে তাদের কাছে সবচে গুরুত্বপূর্ণ। এর সামনে দুনিয়ার সবকিছু মূল্যহীন। ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষা করতে গিয়ে সবকিছু ত্যাগ করতে তারা প্রস্তুত।
বিয়ের স্বরূপ ও উদ্দেশ্য
জীবনের মর্ম সম্পর্কে বিপরীতমুখি দুই দর্শন আমরা বিয়ের স্বরূপ, লক্ষ্য ও মানব জীবনে বিয়ের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করতে পারি। একথা বলা বাহুল্য, জীবন সম্পর্কে ইসলাম ও পশ্চিমা বস্তুবাদি জীবন দর্শনের অবস্থান যখন ভিন্ন ভিন্ন, তাই বিয়ের ক্ষেত্রেও এই বৈপরিত্বের প্রভাব পড়বে।বাস্তবেও বিয়ের ব্যাপারে ইসলাম ও পশ্চিমা ভোগবাদি দর্শনের বক্তব্যে বিস্তর মৌলিক ব্যবধান রয়েছে।
বিয়েকে ইসলাম মানব জীবনের শুধু সাধারণ প্রয়োজনীয় বিষয় হিসেবে গণ্য করেনি। প্রয়োজন ও সামর্থ্য সাপেক্ষে বিয়ে করাকে ওয়াজিব বা আবশ্যক হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। সাধারণ অবস্থায় একে নবী রাসুলদের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত, পূণ্যকর্ম ও আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে নেয়ামত বিবেচনা করেছে। নবীদের সুন্নত বা গৃহীত আদর্শ হচ্ছে এমন বিষয় যা প্রত্যেক মুসলিমের সাফল্য অর্জনের বিকল্পহীন মাধ্যম। ইসলামে বিয়েকে কেন এতটা গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হয়েছে, বিয়ের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের দিকে তাকালে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
কুরআন হাদীসের বক্তব্য থেকে বিয়ের যে উদ্দেশ্যগুলো সম্পর্কে জানা যায় তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে তুলে ধরছি।
১। বিয়ের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে, নেককার মুসলিম পরিবার গঠন করা।
এ হিসেবে বিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। বিয়ের পর সন্তান জন্মগ্রহণের পর তাকে উত্তমরূপে প্রতিপালন ও ইসলামী আকীদা বিশ্বাস ও বিধানাবলি শিক্ষা দিয়ে নেক বান্দা হিসেবে গড়ে তোলা। এভাবে উত্তম নেককার মুসলিম পরিবার গঠন করে আদর্শ মুসলিম সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখা। এ বিচারে বিয়ে পৃথিবীতে মানব বংশ টিকিয়ে রাখার বিকল্পহীন মাধ্যম। নবীজি বলেছেন, তোমরা প্রেমময়ী অধিক সন্তান জন্মদানে সক্ষম নারীদের বিয়ে কর। আবু দাউদঃ (ইহয়াউ উলুমিদ্দিনঃ ২/২২, মাবসুতঃ ৪/১৯২) একাজ করতে গিয়ে স্বামীকে কিছু দায়িত্ব পালন করতে হয়। অর্থ উপার্জন, স্ত্রী সন্তানদের ভরণপোষন করা, তাদের পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষন করা ইত্যাদি। স্ত্রীর দায়িত্ব হচ্ছে, ঘর সংসার দেখাশোনা, সন্তান প্রতিপালন, স্বামীর আনুগত্য করা প্রভৃতি। উভয়কেই নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করতে হয় এ দৃষ্টিভংগি নিয়ে যে তারা এর মধ্য দিয়ে আল্লাহ তায়ালার বিধান পালন করছে।
২। আত্মিক ও চারিত্রিক পবিত্রতা নিশ্চিত করা।
ইসলামে মানুষকে যেসকল কর্তব্য দেয়া হয়েছে তার মধ্যে একটি হল, মানুষ তার লজ্জাস্থান ও চোখকে হারাম থেকে হেফাজত করবে। (দ্রষ্টব্য, সুরা নুরঃ ৩০) ফলে এক্ষেত্রে একজন মুসলিম নর ও নারী প্রবৃত্বির দাবী অনুযায়ী শৃংখলামুক্ত হয়ে চলতে পারেন না। বরং ইসলাম নির্দেশিত পথেই চলতে হয়। আর তা হচ্ছে, বৈবাহিক সম্পর্ক। নবীজি বলেছেন, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাঃ বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের বলেছেনঃ হে যুবক সম্প্রদায়! তোমাদের মধ্যে যে বৈবাহিক জীবনের ব্যয়ভার বহনে সক্ষম সে যেন বিয়ে করে। কারণ তা দৃষ্টিকে নিচু করে দেয় এবং লজ্জাস্থানকে সংরক্ষণ করে। আর যে (ভরণপোষণে) সমর্থ নয়, তাকে অবশ্যই রোজা রাখতে হবে। কারণ তা তার যৌবন কামনা দমনকারী। সহি মুসলিমঃ ১৪০০
তাহলে বিবাহের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে, বৈধ উপায়ে জৈবিক ইচ্ছা পূরণ করা। চোখকে পরনারী থেকে হেফাজত করা। এর মধ্য দিয়ে আত্মিক ও চারিত্রিক পবিত্রতা অর্জন করা। কেননা এক্ষেত্রে কেউ যদি হারাম পথে পা বাড়ায় তাহলে এটি তাকে অপবিত্র করে দিবে। এবং তার দুনিয়া ও পরকাল বর্ববাদ হওয়ার কারণ হবে। কুরআন এই আত্মিক পবিত্রতা ও কলুষতা সম্পর্কে বলছে, “সে-ই ব্যক্তি সফলকাম হবে, যে নিজ আত্মাকে পরিশুদ্ধ হবে। আর যে তার তাকে বিনষ্ট করবে সে হবে ব্যর্থ।“ (সুরা আশ শামসঃ ৯-১০)
৩। সামাজিক শৃংখলা ও নিরাপত্তা সুসংহত করা
মানব সমাজে নারী পুরুষের শৃংখলা ও নিরাপত্ত্বা সুসংহত ও স্থায়ী করার দাম্পত্য জীবন অতীব প্রয়োজনীয়। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিবাহের এই দিকটি কথা এভাবে ব্যক্ত করেছেন, যদি তোমাদের কাছে এমন কেউ বিবাহের প্রস্তাব দেয় যার দ্বীন ও চরিত্র তোমাদের পছন্দনীয় হয় তবে তাকে বিয়ে দিয়ে দাও। যদি এরূপ না কর তবে পৃথিবীতে ফিতনা ও বিরাট বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে। (তিরমিযিঃ ১০৮৩, ইবনে মাজাহঃ ১৯৬৭)
৪। আত্মিক ও মানসিক প্রশান্তি ও স্থীরতা অর্জন করা।
ইসলাম স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ককে প্রতিযোগীতামূলক হিসেবে দেখে না। ইসলাম স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ককে একে অন্যের সহায়ক ও পরিপূরক হিসেবে গণ্য করে। একে অন্যের দ্বারা মানসিক প্রশান্তি ও স্থীরতা অর্জন করবে। যে একাকীত্ব ও শূন্যতা মানুষকে অসহায় করে ফেলে, এ থেকে মুক্তির জন্য স্বামী স্ত্রীর প্রেমময় বন্ধন চাই। এ বিষয়টিও বিয়ের অন্যতম উদ্দেশ্য হিসেবে কুরআনে বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, তাঁর একটি নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদরই মধ্য হতে স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে গিয়ে শান্তি লাভ কর, এবং তিনি তোমাদের পরষ্পরের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয়ই এর ভেতর নিদর্শন আছে সেই সব লোকের জন্য যারা চিন্তা ভাবনা করে। (সুরা রূমঃ ২১) স্বামী স্ত্রীর পারষ্পরিক সম্পর্কের ভিত্তি হবে এই ভালোবাসা ও দয়া। এর মাধ্যমেই উভয়ের মধ্যে প্রশান্তি বিরাজ করবে।
ইসলামি শিক্ষায় বিয়ে যেহেতু মানব জীবনের শুধু একটি প্রাসংগিক অধ্যায়ই নয়, বরং এর সাথে ব্যক্তির আত্মিক চারিত্রিক পবিত্রতা, পরিবার গঠনের মত গুরু দায়িত্ব পালন, মানসিক প্রশান্তি অর্জন, সামাজিক নিরাপত্ত্বা ও শান্তি প্রতিষ্ঠাসহ আরো বহু উদ্দেশ্য যুক্ত রয়েছে, এজন্য ইসলাম বিয়েকে মানব জীবনে অতীব গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে গণ্য করে থাকে। শুধু তাই নয়, দাম্পত্যের এই সম্পর্কটি যেন সুদৃড় মজবুত ও স্থায়ী হয়, এ উদ্দেশ্যে বিয়ের আগে ও পরে বহু বিধান দিয়েছে। এর কিছু দিক সামনে আমরা বর্ণনা করব।
কিন্তু পশ্চিমা ভোগবাদি দর্শনে বিয়ের স্বরূপ কী? বিয়ের উদ্দেশ্যই বা কী?
আমরা ইতিপূর্বে বলে এসেছি, পশ্চিমা দর্শনে বিশ্বাসী মানুষের কাছে ইহকালীন জীবনে নিজের স্বার্থ ভোগ ও স্বাধীনতাই সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ফলে তার সামনে স্রষ্টার আনুগত্য, হালাল হারাম মেনে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের প্রেরণা অনুপস্থিত। বিয়ের উদ্দেশ্য হিসেবে ইসলাম যে বিষয়গুলো পেশ করেছে, এগুলো তার কাছে মূল্যহীন। এখানে চোখ ও লজ্জাস্থানের হেফাজত করার বালাই নেই। শ্লীল অশ্লীল ভালো মন্দ যা খুশি দেখতে পারে, বাধা নেই। পারষ্পরিক সম্মতিতে যে কেউ যে কারো সাথে যৌন সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারছে। কারণ ব্যক্তি স্বাধীনতার কাছে দুনিয়ার সব কিছু গৌণ ও তুচ্ছ। সুসন্তান জন্ম দিয়ে সুস্থ সুন্দর সভ্য সমাজ গড়ে তুলে পৃথিবীকে আবাদ রাখার নৈতিক ও ধর্মীয় দায়বদ্ধতাও তাদের নেই। যেখানে স্রষ্টার অস্তিত্ব অধিকার স্বীকারই করা হয় না, সেখানে নৈতিকতা ও ধর্মীয় দায়বদ্ধতার কোন প্রসংগই উঠে না!
তাহলে এই বস্তুবাদি দর্শনে বিয়ের মানে কী? আসলে এর উত্তর দেয়া একটু কঠিন। পশ্চিমা ভোগবাদি দর্শন, যেখানে অবাধ ব্যক্তি স্বাধীনতা সর্বোচ্চ লক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে, এবং লোকেরা আত্মকেন্দ্রিকতাকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে, ফলে বস্তুবাদি এই জীবন দর্শনে বিয়ে করাটা অযৌক্তিক।বরং ব্যক্তি স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বিয়ে থেকে দূরে থাকা আবশ্যক। যেমন পশ্চিমা বহু নারীবাদি চিন্তক স্পষ্ট করে বলেছেন (উদাহরণত, Betty friedan, Gloria Steinem, Kate Millett, Germaine Greer এর কথা বলা যায়।) কিন্তু তারপরও বড় একটি জনগোষ্ঠি শেষ পর্যন্ত বিয়ে করছে। যদিও এটি তাদের জীবন দর্শনের সাথে সাংঘর্ষিক।
কেন করছে? আল জাযিরার এক নিবন্ধকার এর উত্তর খুঁজতে চেষ্টা করেছেন।তিনি বলেছেন, এর উত্তর দেয়া বেশ কঠিন। পশ্চিমারা বিয়ে করছে হয়তো “দুনিয়ার স্বর্গ”
পাওয়ার স্বপ্নে, যে স্বর্গে একটি ভালো চাকরি থাকবে, একটি বাড়ি আর স্ত্রী থাকবে। কিংবা একটু মায়া ও প্রশান্তির খুঁজে, যা তাকে ভয়ংকর একাকীত্ব থেকে মুক্তি দিবে। অথবা তা্র ভেতরে থাকা সুপ্ত ফিতরাতের ডাকে সাড়া দিতে!
যাহোক, পশ্চিমা দর্শনে বিয়ে মানবজীবনের গুরুত্বপূর্ন কোন অধ্যায় নয়। এর পেছনে সুনির্দিষ্ট স্থীর কোন লক্ষ্য নেই। ফলে এই বৈবাহিক সম্পর্ক যত দিন স্বামী স্ত্রীর অবাধ ব্যাক্তি স্বাধীনতা ও জীবনকে নিজের মত উপভোগ করার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না, পশ্চিমা বস্তুবাদি জীবন দর্শনের মানদন্ডে উত্তীর্ণ হবে, তারা বিয়ে ও দাম্পত্য জীবন চালিয়ে যাবে। যখনই এই বিয়ে ও পারিবারিক জীবন ব্যক্তি স্বাধীনতাকে বাধা প্রাপ্ত করবে, তারা বিবাহ বিচ্ছেদের দিকে অগ্রসর হত দ্বিধা করে না। ব্যক্তি জীবনে অবাধ স্বাধীনতাই তো সর্বোচ্চ ও মৌলিক বিষয়, বিবাহ তো এখানে অতি গৌণ অনুষংগ।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমা বস্তুবাদি দর্শনে বিবাহ যেমন মানব জীবন বিশেষ গুরুত্ব বহন করে না, তাই বিবাহ বিচ্ছেদও তাদের নিকট অতি সাধারণ ব্যাপার। বিবাহও যখন বিতর্কিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে, তাহলে কারণে অকারণে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটবে, এটাই স্বাভাবিক। কেননা এটি ভোগবাদি জীবনের অনিবার্য ফলাফল।
তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদঃ ইসলামি দৃষ্টিকোণ
বিয়ের স্বরূপ ও লক্ষ্য সম্পর্কে তুলনা মূলক এই আলোচনার মধ্যে দিয়ে ইসলামে তালাকের অবস্থান কিছুটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। গুরুত্বের বিচারে বিষয়টিকে আরো পরিষ্কার ভাবে বর্ণনা করা প্রয়োজন মনে করছি।
১। আমরা শুরুতে দেখিয়েছি, ইসলামী শিক্ষায় বিয়েকে মানবজীবনের অতীব গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ও স্থায়ী সম্পর্ক হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। বিয়ের পেছনে ইসলামের সুনির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আছে। বিয়েকে স্থায়ী একটি সম্পর্ক হিসেবে গণ্য করা ছাড়া এগুলো অর্জিত হওয়া সম্ভব নয়। এজন্য বিবাহের পর তালাক বা বিয়ে বিচ্ছেদ নীতিগতভাবে ইসলামে অনাকাংখিত, অপছন্দনীয়। হাদীসে বলা হয়েছে, আল্লাহ তায়ালার নিকট হালাল কাজের মধ্যে সবচে অপছন্দনীয় বস্তু হচ্ছে তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদ। (সুনানে আবু দাউদঃ ২১৭৮, ইবনে মাজাঃ ২০১৮) অর্থাৎ তালাকের মাধ্যমে স্বামী স্ত্রীর বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাওয়া আল্লাহ তায়ালার নিকট খুবই অপছন্দনীয়। চরম সংকট ও অচলাবস্থা তৈরি হলেই কেবল এ কাজের বৈধতা দেয়া হয়েছে। অনেকটা অপারেশন করে অংগ কেটে ফেলার মত। (মাওলানা মঞ্জুর নোমানি কৃত মারিফুল হাদীসঃ ১৭২৫) সাওবান রাঃ বর্ণিত একটি হাদীসে নবীজি বলেছেন, যে স্ত্রী অকারণে তার স্বামীর কাছে তালাক চায়, তার জন্য জান্নাতের সুবাস হারাম বা নিষিদ্ধ। (সুনানে তিরমিযিঃ ১১৮৭) এজন্য বহু ফকীহ শরীয়তে স্বীকৃত কোন কারণ ছাড়াই তালাক দেয়া যে অবৈধ ও নিষিদ্ধ, এটি স্পষ্ট শব্দে বলেছেন। (খালেদ সাইফুল্লাহ রহমানি কৃত কামুসুল ফিকহঃ ৪/৩৩৫, আব্দুল কারীম যায়দান কৃত আল মুফাসসাল ফি আহকামিল মারআ ৭/৩৫২) তাছাড়া এই অকারণে তালাকের কারণে যে সবচে বেশি খুশি হয় সে হল মানুষের চির শত্রু ইবলিস। ইবলিস ও তার দলবলের অন্যতম কাজ হচ্ছে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সব রকমের বিচ্ছেদ তৈরি করা। (দ্রষ্টব্য, সহি মুসলিমঃ ২৮১৩)
২। দাম্পত্য সম্পর্কটি যাতে প্রেমময় মজবুত ও স্থায়ী হয়, এ উদ্দেশ্যে ইসলাম বিয়ের আগে ও পরে বহু বিধান প্রণয়ন করে দিয়েছে। বিয়ের আগে কনেকে দেখতে উতসাহিত করেছে। এতে তাদের মধ্যে ভালোবাসা তৈরি হবে ও স্থায়ী হবে। (সুনানে তিরমিযিঃ ১০৮৭) একইভাবে বিয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে কুফু বা সমতা রক্ষার নির্দেশনা দিয়েছে। এই সমতা কারণে উভয়ের মধ্যে রুচি চিন্তা ও আচরণগত দূরত্ব কমাবে। (বিস্তারিত দেখুন, আব্দুল কারীম যায়দান কৃত আল মুফাসসালঃ ৬/৩২৮)
বিয়ের পরেও দাম্পত্য জীবনের মৌলিক বিষয়, বিশেষত স্বামী স্ত্রীর অধিকার ও দায়িত্ব, যেখানে সাধারণত মতপার্থক্য হতে পারে, এমন সকল বিষয় শরীয়ত তাদের হাতে অর্পণ না করে, স্বতন্ত্রভাবে চিহ্নিত করে দিয়েছে। শুধু নির্দেশনাই নয়, উভয়ে যেন নিজ জায়গা থেকে এগুলো পালন করার প্রতি যত্নবান হয় সে জন্য পরকালীন বিপুল পুরষ্কার ও প্রতিদানের ঘোষণা করেছে।
তাছাড়া স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে ফাঁটল তৈরি করতে পারে, একে অন্যের প্রতি সন্দেহ সৃষ্টি করতে পারে, এমন সকল কাজ উভয়ের জন্য নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। স্ত্রীর জন্য পর্দার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া মাহরাম নয় এমন পুরুষের সাথে আলাপচারিতা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। স্বামীর জন্য মাহরাম নয় এমন নারীর সাথে একাকী অবস্থান, অপ্রয়োজনীয় আলাপচারিতা নিষিদ্ধ করেছে। চোখের হেফাজত করার জোরালো নির্দেশ দিয়েছে।
৩। দাম্পত্য জীবনে ইসলামী নির্দেশনাগুলো যথাযথভাবে মেনে চললে সাধারণ অবস্থায় স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বড় কোন সংকট তৈরি হবে না। তারপরেও দুজনের বিচার বিশ্লেষণ ও উপলব্ধির ভিন্নতা কিংবা মানবীয় দুর্বলতার কারণে মনোমালিন্য বা সংকট তৈরি হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে শুরুতেই বিবাহ বিচ্ছেদের দিকে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ নেই। বরং স্বামী স্ত্রী একে অন্যের অন্যান্য উত্তম গুণাবলি বিবেচনায় এনে এমন সমস্যাকে উদারভাবে গ্রহণ করবে। কুরআনে কারীম স্বামীদেরকে বিশেষভাবে নির্দেশ দিচ্ছে,
তোমরা স্ত্রীদের সাথে সদ্ভাবে জীবন যাপন করো। তাদেরকে যদি অপছন্দ কর, তাহলে হতে পারে এমন জিনিসকে তোমরা অপছন্দ করছ, যাতে আল্লাহ তায়ালা প্রভূত কল্যাণ রেখেছেন।(সুরা নিসাঃ১৯) নবীজি বলেছেন, মুমিন পুরুষ (স্বামী) যেন মুমিন নারী (স্ত্রী)কে যেন অপছন্দ না করে। কারণ সে তার একটি স্বভাব অপছন্দ করলে আরেকটি স্বভাবের প্রতি খুশি হয়ে যাবে। (সহি মুসলিমঃ ১৪৬৯)
ধৈর্য্য সহনশীলতা ও উত্তম আচরণ স্বত্ত্বেও যদি স্ত্রীর পক্ষ থেকে অবাধ্যতা অস্বাভাবিক আচরণ কাজ কর্ম প্রকাশ পেতে থাকে, ইসলাম স্বামীকে কয়েক স্তরের নির্দেশনা দিয়েছে। প্রথমে উত্তমপন্থায় স্ত্রীকে উপদেশ দিবে, আনুগত্যের লাভ ও অবাধ্যতার ক্ষতি বুঝাবে।এতে কাজ না হলে স্ত্রীর সাথে শয্যা ত্যাগ করবে, কথা বন্ধ রাখবে। এই দুই পদ্ধতি ফলপ্রসূ না হলে, স্ত্রীকে হালকা প্রহারের অনুমতি আছে। তবে শর্ত হল চেহারায় আঘাত করতে পারবে না, দাগ সৃষ্টি হয় এমনভাবেও মারতে পারবে না। এসকল ক্ষেত্রে স্বামীর উদ্দেশ্য থাকবে, স্ত্রীর সংশোধন করা ও বৈবাহিক সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা। এই তিনস্তরের কথা সূরা নিসায় বলা হয়েছে, আর তোমরা যেসকল স্ত্রীদের অবাধ্যতার আশংকা কর, তাদেরকে উপদেশ দাও। তাদের শয়ন-শয্যা পৃথক করে দাও। এবং তাদের প্রহার কর।যদি তারা তোমাদের আনুগত্য করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কোন (ব্যবস্থা গ্রহণের) পথ খুঁজো না।নিশ্চয় আল্লাহ সমুন্নত, মহান। (সুরা নিসাঃ ৩৪)
এই পদ্ধতিও যদি ফলপ্রসূ না হয়, দাম্পত্য জীবনে কলহ বিবাদ লেগেই থাকে, তাহলে স্বামী স্ত্রী উভয়ের আত্মীয় স্বজনকে এ সংকট নিরসনে ভূমিকা রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পরের আয়াতে বলা হয়েছে, তোমরা যদি স্বামী স্ত্রীর মধ্যে কলহ সৃষ্টির আশংকা কর, তবে (তাদের মীমাংসা করার জন্য) পুরুষের পরিবার থেকে একজন সালিস ও নারীর পরিবার থেকে একজন সালিস পাঠিয়ে দেবে। তারা দুজন যদি মীমাংসা করতে চায় তবে আল্লাহ উভয়ের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি করে দেবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সবিশেষ অবহিত। (সূরা নিসাঃ ৩৫)
দাম্পত্য জীবনের এই সংকট স্ত্রীর পক্ষ থেকে যেমন তৈরী হতে পারে, স্বামীর দিক থেকেও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে স্ত্রীও শুরুতেই বিচ্ছেদের চিন্তা করবে না। সম্ভাব্য সব উপায়ে সমস্যা সমাধা করতে সচেষ্ট হবে।
৪। দাম্পত্য সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার সকল উপায় অবলম্বন করা হল, সর্বোচ্চ চেষ্টা সাধনা করা হল, তারপরও কলহ বিবাদ থামে নি, বরং চরম আকার ধারণ করেছে। অবস্থা এতটাই সংগীন হয়েছে যে উভয়ের একত্রে জীবন যাপন করা কোনভাবেই সম্ভব হচ্ছে না। অসহনীয় ও বিপদজনক হয়ে উঠেছে। এপর্যায়ে এসে বাস্তবতার দাবীকে স্বীকার করে ইসলাম স্বামীকে বিশেষ নিয়মে বিবাহ বিচ্ছেদের অনুমতি দিয়েছে। স্বভাবজাত ধর্ম ইসলাম এই দাবীকে উপেক্ষা করে নি। সন্তান বা পরিবারের কথা চিন্তা করে এমন বিপদজনক অবস্থা চোখ বন্ধ করে সহ্য করে যাওয়ার নির্দেশ দেয় নি। যদিও অনেক ধর্ম আছে (হিন্দু খ্রিষ্ট প্রভৃতি), যেখানে একবার বিবাহ হয়ে গেলে বিচ্ছেদের কোনই সুযোগ রাখা হয়নি! এখন দাম্পত্য সংকট যত তীব্রই হোক না কেন। এটি বাস্তবতাকে অস্বীকার বৈকি?!
৫। চূড়ান্ত সংকটের কারণে স্বামী যখন স্ত্রীকে তালাক দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলবে, তখন ইসলাম বলছে, একটি রাজঈ তালাক দিবে। যাতে ইদ্দত পালনের সময়ে, বিবাহ বিচ্ছেদের বাস্তবতা উপলব্ধি করে, স্বামী স্ত্রী যদি দাম্পত্য জীবনে ফিরতে চায় সে সুযোগ যেন থাকে।(দ্রষ্টব্য, সহি মুসলিমঃ ১৪৭১) এজন্য এক সাথে তিন তালাক দেয়াকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে। কারণ স্বামী স্ত্রী আবার দাম্পত্য জীবনে ফিরতে চাইলেও –জটিল এক প্রক্রিয়া ছাড়া- স্বাধারণত ফিরতে পারে না। (দ্রষ্টব্য, নাসাঈ কৃত সুনানে কুবরাঃ ৫৫৬৪, সুরা বাকারাঃ ২৩০) তাছাড়া স্ত্রীর মাসিক চলাকালীন সময়েও তালাক দেয়া নিষিদ্ধ। পবিত্র হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। (সহি মুসলিমঃ ১৪৭১) এতেও স্বামী চিন্তাভাবনার সময় পাবে, হয়তো তালাকের সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসতে পারে। আবার এভাবে তালাক দিলে স্ত্রীর ইদ্দতের মেয়াদও বেড়ে যাবে, যা তার জন্য কষ্টকর। ফল কথা, ইসলামে তালাকের পদ্ধতির মধ্যেও সূক্ষ্ম অনেক বিষয় বিবেচনা করা হয়েছে, উদ্দেশ্য– কোন ভাবে যেন স্বামী স্ত্রীর বৈবাহিক সম্পর্কটি টিকে যায়। বা তারা পুনঃবিবেচনা করতে চাইলে সে সুযোগ তাদের হাতে থাকে।
৬। ইসলামে তালাকের অধিকার মূলত স্বামীকে দেয়া হয়েছে। এর পেছনে সংগত কারণ ও নানা হেকমত রয়েছে। তবে ক্ষেত্রবিশেষে স্ত্রীকেও বিবাহ বিচ্ছেদ করার সুযোগ দিয়েছে। যেমন বিয়ের সময় স্ত্রী স্বামীর কাছে তালাকের অধিকার দেয়ার শর্ত করতে পারে। স্বামীর সন্তুষ্টিতে স্ত্রী খুলা করার আবেদন করতে পারে। কিংবা স্বামী যদি নির্যাতন নিপীড়ণ করে, শারীরিকভাবে অক্ষম হয়, ভরণপোষণ দিতে অস্বীকার করে, তাহলে স্ত্রী শরয়ী বিচারকের দারস্থ হতে পারবে। এক্ষেত্রে আদালত সংগতি বিবেচনা করে তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটাতে পারে। (দ্রষ্টব্য, তাকমিলা ফতহুল মুলহিমঃ ১/১৩৪, তাফসিরে মাআরিফুল কুরআনঃ ১/৫৫৭)। তবে স্বামীকে যেমন তালাকের দিকে অগ্রসর হওয়ার আগে বহু স্তর অতিক্রম করতে হয়, অবস্থার সংশোধনের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হয়, সমস্যা হলেই তালাকের অধিকার ব্যবহার করার সুযোগ নেই, একই কথা স্ত্রীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সমস্যা সমাধানের জন্য সব রকম উপায় অবলম্বন করে ব্যররথ হলেই কেবল কোন স্ত্রী বিবাহ বিচ্ছেদের কথা ভাবতে পারেন।
৭। ইসলামে তালাকের ব্যাপারে একটি মৌলিক দর্শন হচ্ছে, স্বামী বা স্ত্রী কারো ক্ষতি করার জন্য তালাকের বিধান প্রণয়ন করা হয় নি। এই তালাকের মাধ্যমে এক পক্ষ অন্য পক্ষ থেকে প্রতিশোধ নিবে, এমন মনোভাব লালনেরও সুযোগ নেই। বরং তালাক প্রণয়নের উদ্দেশ্যই হল, দাম্পত্য জীবনে যদি চরম সংকট তৈরি হয়ে যায়, অচলাবস্থা নেমে আসে, তাহলে তালাকের মাধ্যমে স্বামী স্ত্রী একে অন্যের ক্ষতি করা থেকে বাঁচতে পারবে। কেউ কারো প্রতি যুলুম করবে না, কারো অধিকার ক্ষুণ্ণ করবে না। প্রত্যেকেই নিজের জায়গায় নিরাপদে শান্তিতে জীবন যাপন করতে পারবে। এই হচ্ছে ইসলামে তালাকের দর্শন।
একারণে বিবাহ বিচ্ছেদের পর, যখন স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সাধারণত বিদ্বেষ ,শত্রুতা ও প্রতিশোধপরায়ণতা চরম আকার ধারণ করে থাকে, সে সময়টাতে তারা যেন সৌজন্যতা ও পারষ্পরিক কল্যাণকামিতা লালন করে, একে অন্যের ক্ষতি করার মানসিকতা পরিহার করে, ইসলাম সেই নির্দেশনা দিয়েছে। এই বিষয়টিকে নিশ্চিত করে এমন একাধিক বিধান ইসলামে প্রণয়ন করা হয়েছে।
#বিবাহ বিচ্ছেদের পর স্ত্রী স্বামীর ঘরে ইদ্দত পালন করবে। স্বামী তাকে আলাদা থাকার জায়গা দিবে। প্রয়োজনীয় খরচাদিও তাকে বহন করতে হবে। ঘর থেকে স্ত্রী নিজে যেমন বের হতে পারবে না, স্বামীও তাকে বের করতে পারবে না।
#বিবাহ বিচ্ছেদের সময় স্বামী তাকে এক জোড়া পোষাক উপহার হিসেবে দিবে। কুরআনে এই উপহারকে “মুতআ” হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
# বিবাহ বিচ্ছেদের পর স্ত্রী যখন ইদ্দতের শেষ সীমায় পৌঁছে যাবে, তখন তাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করার ইচ্ছা না থাকলে শুধু কষ্ট দেয়ার উদ্দেশ্যে বিবাহে ফিরিয়ে নিবে না। এটি ইসলামে নিষিদ্ধ।
#বিচ্ছেদের সময় উত্তম পন্থা গ্রহণ আদেশ করা হয়েছে। কথায় বা কাজে কোন ভাবে তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীদের কষ্ট দেয়া, তাদের নামে বদনাম ছড়ানো, এগুলোকে ইসলাম জঘন্য কাজ হিসেবে গণ্য করেছে। (মাআরিফুল কুরআনঃ সূরা আহযাবের ৪৯ নং আয়াতের তাফসীর, ও অন্যান্য)
৮। ইসলাম পূর্ব যুগে তালাকের কোন সীমারেখা ছিল না। স্বামী যতবার ইচ্ছা স্ত্রীকে তালাক দিত, আবার ফিরিয়ে নিত। এটা নারীর জন্য খুবই অমানবিক ও মর্যাদা পরিপন্থি। ইসলাম তালাকের ক্ষেত্রে সীমারেখা নির্ধারণ করে দিয়েছে। তালাক দেয়ার পর স্বামী স্ত্রীকে সর্বোচ্চ দুইবার ফিরিয়ে নিতে পারবে। তিনবার তালাক দিয়ে দিলে স্বামীর এই অধিকার থাকবে না। এটা তার জন্য শাস্তি স্বরূপ।
৯। বিশেষ প্রয়োজনে ইসলাম তালাকের দরজা খোলা রেখেছে। ফলে এটি যখন যৌক্তিক কারণে সংঘষ্টিত হবে, শরীয়ত নির্দেশিত পদ্ধতিতে ঘটবে, তখন একে অপরাধ বা ট্যাবু হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। এবং যে তালাক দিয়েছে, বা যাকে দেয়া হয়েছে, কাউকেই হেয়, তুচ্ছ বা অপরাধী বিবেচনা করা বৈধ নয়। তারা অন্যান্য দশজন মানুষের মত সাধারণ ও স্বাভাবিক জীবন যাপন করবেন। এব্যাপারে আল্লাহ তায়ালার ঘোষণা হচ্ছে, “আর যদি তারা (স্বামী স্ত্রী) পৃথক হয়ে যায়, তবে আল্লাহ নিজ প্রাচুর্য দ্বারা প্রত্যেককে (অপরজন থেকে) অনপেক্ষ করে দিবেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, প্রজ্ঞাবান। (সুরা নিসাঃ ১৩০) এ আয়াত আস্বস্ত করছে, বিবাহ বিচ্ছেদটা যদি সৌজন্যমূলকভাবে সম্পন্ন করা হয়, তবে আল্লাহ তায়ালা উভয়ের জন্য আরো উত্তম ব্যবস্থা করবেন। যার ফলে তারা একে অন্য থেকে বেনিয়াজ বা অমুখাপেক্ষী হয়ে যাবে। (তাওজিহুল কুরআন) এজন্য ইসলাম যেখানে সামর্থ্যবানদের বিয়ের উতসাহ দিয়েছে, সেখানে তালাকপ্রাপ্তরাও আছে। যেমন বলা হয়েছে, তোমাদের মধ্যে যারা স্ত্রী বা স্বামীহীন তাদের বিয়ে দাও। (সুরা নুরঃ৩২) যারা এখনো বিয়েই করে নি, তাদের কথা যেমন বলা হয়েছে, যারা বিয়ে করার পর বিচ্ছেদ হয়েগেছে তাদের কথাও বলা হয়েছে। (জালালাইন) নবীজি একমাত্র আয়েশা সিদ্দীকা রাঃ ব্যাতিত অন্য যাদের বিবাহ করেছিলেন, তাদের সবারই ইতিপূর্বে বিয়ে হয়েছিল। অনেকেই ছিলেন বিধবা, তালাকপ্রাপ্তাও ছিলেন। সাহাবীদের কর্মপন্থাও এমন ছিল। ব্যাপকভাবে তারা তালাকপ্রাপ্ত নারীদের বিয়ে করতেন। জানা বিষয়, নবীজি ও তাঁর মহান সাহাবীদের কর্মপন্থা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য উত্তম আদর্শ। শুধু উতসাহ ও বাস্তব কর্মপদ্ধতিই নয়, নবীজি তালাকপ্রাপ্ত নারীদের বিয়ের স্বতন্ত্র বিধানও বর্ণনা করেছেন।
এই হচ্ছে ইসলাম তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদকে যেভাবে মূল্যায়ন করে, তার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ।
দেশে তালাকের উর্ধ্বগতিঃ
মিডিয়ায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী পুরো বাংলাদেশে তালাকের হার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৩ জুন ২০২৩ তারিখে বিডিনিউজ২৪ প্রকাশিত একটি সংবাদে জানিয়েছে, এক বছরের ব্যবধানে দেশে তালাকের হার বেড়ে দ্বিগুণ হওয়ার উদ্বেগজনক তথ্য এসেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক জরিপে।‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস’ অনুযায়ী ২০২২ সালে দেশে তালাকের স্থুল হার বেড়ে প্রতি হাজারে ১ দশমিক ৪টি হয়েছে। ২০২১ সালে এই হার ছিল প্রতি হাজারে ০ দশমিক ৭টি।“
একই তারিখে প্রথমআলোতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “ঢাকার দুই সিটির মেয়রের কার্যালয়ের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ২০২২ সালে তালাকের আবেদন এসেছিল মোট ১৩ হাজার ২৮৮টি। এর মধ্যে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ৭ হাজার ৬৯৮টি, উত্তর সিটিতে ৫ হাজার ৫৯০টি। এ হিসাবে রাজধানীতে প্রতিদিন ভেঙে যাচ্ছে প্রায় ৩৭টি দাম্পত্য সম্পর্ক, অর্থাৎ তালাকের ঘটনা ঘটছে ৪০ মিনিটে ১টি করে। আর চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে আবেদনের সংখ্যা ২ হাজার ৪৮৮।
২০২০ ও ২০২১ সালেও রাজধানীতে বিবাহবিচ্ছেদের আবেদনের সংখ্যা ছিল ১২ হাজারের বেশি। ঢাকার দুই সিটির মেয়রের কার্যালয়ের তথ্য অনুসারে, এই দুই বছরে আবেদন জমা পড়েছে যথাক্রমে ১২ হাজার ৫১৩ এবং ১৪ হাজার ৬৫৯টি। গত চার বছরে তালাক হয়েছে ৫২ হাজার ৯৬৪টি।
বিবাহবিচ্ছেদ যে কয়েক বছর ধরে বাড়ছে, তা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যেও দেখা যায়। বেশি বাড়ছে শিক্ষিত দম্পতিদের মধ্যে। বিবিএসের ২০২১ সালের ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৫ বছর ধরে তালাকের হার ঊর্ধ্বমুখী।“
সেই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, “দুই সিটি করপোরেশনের তথ্যে বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন বেশি আসতে দেখা যাচ্ছে স্ত্রীদের পক্ষ থেকে। প্রতি ১০টি আবেদনের প্রায় ৭টি করেছেন স্ত্রী।
২০২২ সালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে মোট তালাক হয়েছে ৭ হাজার ৬৯৮টি। এর মধ্যে স্ত্রীরা আবেদন করেছিলেন ৫ হাজার ৩৮৩টি, যা মোট আবেদনের ৭০ শতাংশ। ঢাকা উত্তরের চিত্রও একই। ২০২২ সালে সেখানে তালাকের আবেদনের ৬৫ শতাংশ নারীর।“
এই পরিসংখ্যান সংরক্ষিত তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি করা। ফলে এই তথ্যের বাইরে বাস্তবে তালাকের হার যে আরো অনেক বেশি তা সহজেই অনুমেয়।
কেন বাড়ছে তালাকের হার?
তালাকের উর্ধ্বগতির পেছনে কোন বিষয়গুলো দায়ী? কেন হুর হুর করে বেড়ে যাচ্ছে তালাকের হার? বলাবাহুল্য, এর পেছনে একক কোন কারণকে চিহ্নিত করা সম্ভব নয়। এখানে বিভিন্ন ধরণের কারণ ও বিষয় সক্রীয় রয়েছে। তাছাড়া উত্তরদাতা বা বিশ্লেষকের বিশ্বাস চিন্তা ও জীবন দর্শনের ভিন্নতার কারণেও কারণ চিহ্নিত করতে ভিন্নতা আসবে।
মানবজমীনে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুই সিটিতে নারীদের করা আবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, স্বামীর সঙ্গে বনিবনা না হওয়া, ভরণ-পোষণ না দেয়া, স্বামীর সন্দেহবাতিক মনোভাব, ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধকরণ, কাবিন না হওয়া, স্বামীর মাদকাসক্তি, পুরুষত্বহীনতা, নির্যাতন, যৌতুক, মানসিক পীড়ন, পরকীয়া, আর্থিক সমস্যা ও ব্যক্তিত্বের সংঘাতের কথা বলা হয়েছে। আর পুরুষরা পরকীয়া, বেপরোয়া জীবনযাপন, বদমেজাজ, সংসারের প্রতি উদাসীনতা, সন্তান না হওয়া, অবাধ্য হওয়া, টিকটকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অবাধ বিচরণ করা, ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী না চলাসহ বিভিন্ন কারণের কথা উল্লেখ করছেন। ইনকিলাব ও প্রথমআলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদনেও কাছাকাছি কারণ বর্ণনা করা হয়েছে।
প্রথমআলো র উল্লেখিত প্রতিবেদনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ফাতেমা রেজিনা পারভীন জানিয়েছে, সমাজে সহিষ্ণুতা কমছে। নগরজীবনের চাপ, ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, সঙ্গীর পছন্দ-অপছন্দ, জৈবিক চাহিদা পূরণ না হওয়া ইত্যাদি বিষয় দাম্পত্য সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলছে। নারীরা সংসারে নিজের মর্যাদা না পেয়ে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। স্বামী-স্ত্রীর সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যও বড় হয়ে উঠছে।
মানবজমীনে প্রকাশিত একপ্রতিবনে ড. তৌহিদুল হক বলেন, “চলতি সময়ে যারা বিবাহ বন্ধনের মাধ্যমে পরিবার গঠন করছেন তাদের মধ্যে ছাড় দেয়ার মানসিকতা এবং সামান্য ভুল-ত্রুটি এড়িয়ে যাওয়ার মানসিকতা কম। তাদের কাছে নিজের বিষয়টি কতোটুকু গুরুত্ব পেলো বা পেলো না সেটি বিবেচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
ভোগবাদের প্রভাব যখন কোনো সম্পর্কের উপরে পড়ে তখন সেই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। আর এরকম বাস্তবতার সঙ্গে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের বিষয়টি যখন নতুন মাত্রা যোগ করে তখন বিচ্ছেদের পরিমাণ আরও বেড়ে যায়। বর্তমান সময়ে পরস্পর সন্দেহ, কার সঙ্গে ফেসবুকিং করছে, কার সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করছে এই বিষয়গুলোর কারণে বিচ্ছেদের পরিমাণ বাড়ছে। তিনি যোগ করেন, এখন সামান্য ভুল বোঝাবুঝিতে নারী ও পুরুষ উভয়ই চিন্তা করেন যে, আমার উপার্জনে তো কোনো সমস্যা নেই। তাহলে তার সঙ্গে কেন আমাকে থাকতে হবে।“
অনেকে মনে করছেন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মতো একটি একপেশে আইনের কারণেও সংসার ভাঙ্গছে।
এটি কি ইতিবাচক?
সমাজের বেশির ভাগ মানুষের কাছে তালাকের এই চিত্র উদ্বেগজনক ও অস্বাভাবিক। তারা ভাবছেন, এটি ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে পরিবার সমাজ ও দেশ, সবকিছুতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। অপরদিকে কিছু বিশ্লেষক আছেন, যারা তালাকের এই প্রবণতাকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করছেন। এনিয়ে বিশেষ উদ্বিগ্ন না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। যেমন প্রথমআলোয় প্রকাশিত হেলাল মহিউদ্দিনের নিবন্ধে বেশ জোরের সাথে বলা হয়েছে। তিনি লিখেছেন, “নারীরা উদ্যোগী হয়ে বেশি তালাক দিচ্ছেন তথ্যটি কৌতুহলোদ্দীপক, তবে চমকে দেওয়ার মতো নয়। নারীর ক্ষমতায়ন বেড়েছে। আত্মনিয়ন্ত্রণের ও স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা বেড়েছে। এ কারণে পুরোনো পুরুষতান্ত্রিক পারিবারিক মূল্যবোধের বজ্র-আঁটুনি কাটাতে সাহস করে তাঁরা দুই কদম বেশি স্বপ্রণোদিত হয়েছেন বলে অনুমান করা যায়। … বিবাহবিচ্ছেদ ‘মহামারির মতো’ বেড়ে যাচ্ছে ভেবে উদ্বিগ্ন না হয়ে বরং পরিবার ও শিশু কল্যাণ কর্মসূচিকে জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত করা দরকার।“ নিবন্ধের শুরুতে পশ্চিমা দেশগুলো এর মোকাবেলায় কিভাবে সফল (?) হয়েছে, এবং বিবাহ বিচ্ছেদ যে তাদের ক্ষতি করতে পারে নি (?), তার বিবরণও তুলে ধরেছেন।
তালাক প্রদানে নারীদের অগ্রগামিতাকে কিছু বিশ্লেষক দেখছেন নারীদের সাফল্য ও বিজয় হিসেবে। তারা নারী পুরুষকে একে অন্যের সম্পূরক না ভেবে, প্রতিযোগি বা শত্রু ভাবেন। যেখানে নারীর কর্তব্য হচ্ছে, শক্তি প্রদর্শন করে পুরুষের কাছে থেকে নিজ অধিকার ছিনিয়ে নেয়া। এটি করতে পারলেই নারী সফল ও বিজয়ী। এদিক থেকেও কেউ কেউ তালাকের প্রতি বিশেষত নারীদের ধাবমানতাকে ইতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করছেন।
বলার অপেক্ষা রাখে না, যারা এই পরিস্থিতিকে ব্যাপকভাবে স্বাভাবিক ও ইতিবাচক হিসেবে গণ্য করছেন, তারা পশ্চিমা বস্তুবাদি দর্শনে বিশ্বাসি। ফলে পশ্চিমাদের মত তাদের কাছে বিয়ে আদতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণই না। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ব্যাক্তি স্বাধীনতা, সর্বক্ষেত্রে নারী পুরুষের সম অধিকার। ফলে এই দুই মূলনীতির সাথে যখন দাম্পত্য জীবনের সংঘর্ষ হচ্ছে, তারা বিয়ে বিচ্ছেদকে সমর্থন করতে এতটুকু কুন্ঠিত হচ্ছেন না। যদিও সাহসের অভাবে, পশ্চিমাদের মত সরাসরি বিয়ে বা পরিবার প্রথাকে একেবারে বর্জন করার দাবী করতে পারছেন না।
ইতিবাচক হওয়ার যুক্তি কি যথাযথ?
অবাধ ব্যক্তি স্বাধীনতা ও সর্বক্ষেত্রে নারী পুরুষের সমান অধিকারকে মূল ও সর্বোচ্চ বিষয় গণ্য করে যারা বিবাহ বিচ্ছেদকে উতসাহিত করছেন, তারা প্রধাণত পশ্চিমের সাফল্যের উদ্ধৃতি দিচ্ছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, অবাধ ব্যক্তি স্বাধীনতা ও সমানাধিকার নিশ্চিত করতে বৈবাহিক জীবনকে প্রায় বর্জন করে পশ্চিমা সমাজ কি নারীদের নিরাপত্ত্বা দিতে পেরেছে? নারীরা কি শান্তি ও স্বস্তির জীবন লাভ করেছে? আমরা পশ্চিমাদের পরিসংখ্যান থেকেই দেখব তারা কেমন সাফল্য অর্জন করেছে।
সংগত কারণে প্রথমেই আমরা ফ্রান্সের দিকে নজর দিব। ফরাসী কোন নারী যখন ইউনিভার্সিটি বা কাজের উদ্দেশ্যে বাইরে বের হন, এবং পরিবহন হিসেবে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করেন, তখন তার সাথে কী ঘটতে পারে, FRANCE24 প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে অনুমান করা যায়। এতে বলা হয়েছে, একটি সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১০০% ফরাসি নারী, যারা পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করেন তারা কোন না কোন ধরণের যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। https://www.france24.com/ar/20150417-%D9%81%D8%B1%D9%86%D8%B3%D8%A7-%D8%AA%D8%AD%D8%B1%D8%B4-%D8%AC%D9%86%D8%B3%D9%8A-%D9%85%D8%AA%D8%B1%D9%88-%D8%A7%D9%84%D8%A3%D9%86%D9%81%D8%A7%D9%82-%D9%86%D8%B3%D8%A7%D8%A1
পশ্চিমা নারী কি তার শিক্ষাংগনে নিরাপদ? ২০১৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি দি গারডিয়ান একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যার শিরোনাম ছিল, ইউকের অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থীরা বলছে, তারা অনাকাংখিত যৌন আচরণের মুখোমুখি হয়েছে। More than half of UK students say they have faced unwanted sexual behaviour | Students | The Guardian
শিক্ষাংগনে শিক্ষকদের দ্বারা ছাত্রীরা যেমন এই সমস্যার শিকার হচ্ছেন, ছাত্ররাও শিক্ষিকাদের হয়রানি করছে। Nurse academics’ experience of contra-power harassment from under-graduate nursing students in Australia – PubMed (nih.gov)
পড়াশোনা শেষ করে একজন নারীকে কাজের সন্ধানে নামতে হয়। কেননা এই কাজই তার ব্যাক্তি স্বাধীনতা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করবে। প্রশ্ন হচ্ছে, পশ্চিমা নারীরা কি কর্মেক্ষেত্রে শান্তি ও নিরাপত্বার সাথে থাকতে পারছে? ২০০২ সালের ১৩ জুন বিবিসি এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এর শিরোনাম দিয়েছে, প্রতি চারজন নারীর মধ্যে একজন কর্মক্ষেত্রে যৌন সম্পর্কে করেন। http://news.bbc.co.uk/2/hi/business/2042540.stm
২০১৬ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে safeline জানাচ্ছে, এর পরিমাণ বেড়ে অর্ধেকেরও বেশি ছাড়িয়ে গেছে। Sexual Harassment in the Workplace is Found to Affect Over Half of UK Women – Safeline – Believe in you – Surviving sexual abuse & rape
নারীরা কোথায় যাবে? পার্লামেন্টের কাছে আইন পাশ করার আবেদন করবে? কিন্তু সেই পার্লামেন্টের অবস্থাও ব্যতিক্রম নয়! ২০১৮ সালের অক্টোবরে সিএনএন একটি সমীক্ষা তুলে ধরে, যার শিরোনাম ছিল, ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টগুলোতে নারীদের হয়রানি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। Abuse of women in Europe’s parliaments widespread, study shows | CNN
ব্যক্তি স্বাধীনতা ও সমানাধিকার অর্জন করা নারীরা পরিবার ও বৈবাহিক জীবন ধারা বাদ দিয়ে নিজেদেরকে যে ভয়াবহ সংকটে ফেলে দিয়েছে, এদেশের একটি মহল কি আমাদের সেদিকেই আহবান করছে না!
বিবাহ বিচ্ছেদের হিড়িকঃ পর্যবেক্ষণ ও প্রস্তাবনা
যে হারে বিবাহ বিচ্ছেদ বাড়ছে, এটি ভয়াবহ ও বিপদজনক। এক্ষেত্রে মোটা দাগে কয়েকটি বিষয় আমাদের বিবেচনায় আনতে হবে।
১। স্বামী স্ত্রীদের মাঝে মনোমালিন্য হওয়া অস্বাভাবিক নয়। এই মনোমালিন্য কিছু ক্ষেত্রে তিক্ততায় রূপান্তরিত হয়ে বা অন্য কোন বড় কারণে কিছু দম্পতির মাঝে বিচ্ছেদ ঘটতে পারে। কিন্তু সেটা পরিমাণে খুব কম। এখন যে পরিমাণ বিবাহ বিচ্ছেদ হচ্ছে এটি অস্বাভাবিক। এবং এর পেছনে বড় বড় কিছু কারণ কার্যকর রয়েছে। যা মানুষের জীবনকে ব্যাপকভাবে পরিবর্তন করেছে।
২। প্রধাণতম কারণটি হচ্ছে, আমরা খেয়াল করলে দেখব, একদিকে মুসলিমরা ইসলামি আকীদা বিশ্বাস মূল্যবোধ ও আদর্শ থেকে দিনদিন দূরে সরে যাচ্ছেন। ইসলামি বিধিবিধান, আচরণ আখলাক ও শিষ্টাচারের উপস্থিতি তাদের জীবনে দুর্বল হয়ে আসছে। অপরদিকে রাষ্ট্র ও তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মিডিয়া, সাহিত্য সংস্কৃতি সব জায়গা থেকে ইসলাম, ইসলামি শিক্ষা ও মূল্যবোধগুলোকে ধাপে ধাপে দূর করে দেয়া হচ্ছে। বিপরীতে মুসলিমরা ব্যাপকভাবে পশ্চিমা বস্তুবাদি জীবন দর্শন গ্রহণ করছে। বরং অনেক ক্ষেত্রে তাদেরকে এই ভোগবাদি দর্শনের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। এজায়গায় আন্তর্জাতিক সংস্থা, রাষ্ট্র, মিডিয়া, ও বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির বড় ভূমিকা রয়েছে।
কোন ব্যক্তি যখন ইসলাম থেকে দূরে সরে পশ্চিমা জীবন দর্শনকে আদর্শ হিসেবে বরণ করে নিবেন, তখন বিয়ে পরিবার সন্তান প্রতিপালনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গুরুত্ব হারাবে। এটি খুবই স্বাভাবিক বিষয়। যেমনটি ইতিপূর্বে আমরা দেখিয়েছি।
৩। এজন্য প্রত্যেক মুসলিমকে জেনে বুঝে ইসলামি আদর্শ মূল্যবোধ ও জীবন দর্শনকে গ্রহণ করতে হবে। এর সাথে সাংঘর্ষিক পশ্চিমা জীবন দর্শনকে বর্জন করতে হবে সচেতন ভাবে। ইসলাম মানুষকে অবাধ ব্যাক্তি স্বাধীনতা ও নারী পুরুষের সর্বক্ষেত্রে সমান অধিকার দেয় নি। মুসলিম হিসেবে এই মূলকথাটি আমার ধারণ করা আবশ্যক। এমনিভাবে বিয়ের আগে, ইসলাম বিয়ের যে স্বরূপ ও লক্ষ্য বর্ণনা করেছে, তা ঠিকভাবে উপলব্ধি করা কর্তব্য।
৪। বৈবাহিক জীবনে স্বামী স্ত্রীর প্রত্যেককে আলাদা আলাদা দায়িত্ব ও অধিকার ইসলাম দিয়েছে। এই দায়িত্ব ও অধিকারের প্রতি যত্মবান হওয়া শুধু নৈতিক বা মানবিক দায়িত্বই নয়, ধর্মীয় গুরু দায়িত্বও বটে। এটা ইসলামের একটি স্বাতন্ত্র ও বৈশিষ্ট্য যে এখানে স্বামী বা স্ত্রী কেউই শুধু অন্যের জন্য বা শুধু সন্তানের জন্য কর্তব্য পালন করেন না। তারা যে দায়িত্বই পালন করেন বা অবদান রাখেন, এর পেছনে প্রধাণত উদ্দেশ্য থাকে আল্লাহ তায়ালার আদেশ পালন করে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করা, পরকালে প্রতিদান লাভ করা। স্ত্রী যে স্বামীর আনুগত্য করেন, এটি শুধু এজন্য নয় যে স্বামীর আদেশ পালন করতে হয়। বরং এজন্য যে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল স্ত্রীকে স্বামীর আনুগত্য করতে নির্দেশ করেছেন। সন্তান লালন পালন ও তাদের শিক্ষা দীক্ষা দেয়ার ব্যাপারেও একই কথা প্রযোজ্য। স্বামীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তিনি স্ত্রীর সাথে সুন্দর আচরণ করবেন, কোমল ও নম্র ব্যবহার করবেন, তার খরচাদি বহন করবেন। স্বামী এগুলো শুধু স্ত্রী হিসেবে নয়, বরং ইসলামের নির্দেশ হিসেবে পালন করছেন। এগুলো করলে তিনি সওয়াব পাবেন। না করলে গোনাহগার হবেন। তাহলে বৈবাহিক জীবন ও এর সুষ্ঠ পরিচালনায় পরকালের প্রতি বিশ্বাস ও পরকালমুখিতা গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বস্তুবাদি জীবন দর্শনে যার অস্তিত্ব নেই।
৫। দায়িত্ব ও অধিকারের সাথে সাথে আখলাক বা সুন্দর আচরণও দাম্পত্য জীবনের জন্য আবশ্যকীয় একটি বিষয়। আমরা আখলাককে ইসলামের দৃষ্টিতে অনেক সময় প্রাসংগিক বা কমগুরুত্বপূর্ণ মনে করি। এটি ভুল চিন্তা এবং একারণে অনেক জটিলতা তৈরি হয়ে থাকে। মূলত আখলাক বা সুন্দর আচরণ ইসলামের কেন্দ্রীয় একটি শিক্ষা। একদিকে যেমন এর চর্চার দ্বারা মানুষ বিপুল পুরষ্কার লাভ করে, অপরদিকে সুন্দর আখলাকের অভাবে মানুষ শাস্তি ভোগ করবে। তাছাড়া বাস্তব জীবনে, বিশেষত দাম্পত্য জীবনে এর সুফল কেমন, তা একটু চিন্তা করলেই স্পষ্ট হয়ে যায়। চিন্তা করুন, একজন মানুষ যার মধ্যে ধৈর্য্য, ক্রোধসংবরণ, অগ্রাধিকার দেয়া, বদান্যতা, উদারতা, ক্ষমা করা, সুধারণা পোষণ করার মত উন্নত আখলাক আছে, তার দাম্পত্য জীবন কেমন হবে! অপর দিকে যার মধ্যে এগুলো নেই, যে প্রতিক্রিয়াশীল, ছাড় দিতে নারাজ, কৃপণ, মন্দ ধারণকারি, তার দাম্পত্য জীবন কেমন হবে? দুজনের জীবনে আকাশ পাতালের পার্থক্য তৈরি হবে, এটা বলাই বাহুল্য।
৬। দাম্পত্য জীবনে এমন ধসের প্রধাণতম কারণ ইসলামি অনুশাসন মেনে না চলা। এজন্য স্বামী স্ত্রী উভয়কেই জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামের আদেশ নিষেধ মেনে চলতে হবে। স্বামী কখন যৌতুকের জন্য স্ত্রীকে নির্যাতন করতে সাহস পায়? যখন তার ভেতর ইসলামী অনুশাসন থাকে না। যথাযথভাবে ইসলামকে ধারণ করলে মাদকের দিকে হাত বাড়ানোর সুযোগ কোথায়? স্ত্রীর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
৭। এই ব্যক্তিক পারিবারিক ও সামাজিক সংকট নিরসনের জন্য মানুষ বহু আইন করেছে। এদেশেও করা হয়েছে। পশ্চিমারা আইনের প্রয়োগও করে দেখেছে। কিন্তু আশানুরূপ ফলাফল পাওয়া যায় নি। এসবগুলোই মানবরচিত আইন ও শিক্ষা। যার চরিত্রই হচ্ছে, এগুলো দুর্বল সংকীর্ণ ও পক্ষপাতদূষ্ট হবে। কেননা মানুষ দুর্বল। “আর মানুষকে দুর্বল করে সৃষ্টি করা হয়েছে।“ (সুরা নিসাঃ ২৮) এই কারণে মানুষ মানবরচিত আইনের প্রতি কমই আনুগত্য করে।
অপরদিকে আল্লাহ তায়ালা সীমাহীনজ্ঞানের অধিকারি , তিনি পরমকরোনাময়, অতিদয়ালু, সব রকমের দুর্বলতা ও ত্রুটি থেকে পবিত্র, তিনি সুউচ্চ সুমহান সত্ত্বা। তাই মানুষকে জীবনের সকল ক্ষেত্রে আল্লাহ প্রদত্ত্ব শিক্ষা নির্দেশনা ও বিধানের প্রতিই ফিরতে হবে। পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্রে ইসলামকে সংকুচিত নয়, ইসলামের শিক্ষাকে করতে হবে মজবুত ও সুসংহত। ইসলামি অনুশাসন মেনে চলার উপযোগী পরিবেশ প্রতিবেশ তৈরি করতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
(লেখাটি আসলাফ একাডেমী প্রকাশিত ই-ম্যাগাজিনে প্রকাশিত)