ক্ষমা নাকি প্রতিশোধ, ইসলামের শিক্ষা কোনটি?
যালিম সরকারের পতনের পর দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ অপরাধী দূর্ণীতিবাজ সন্ত্রাসি ও খুনীদের বিচারের জোর দাবী জানাচ্ছেন। কিন্তু কেউ কেউ একচেটিয়াভাবে বলছেন, অপরাধিদের ক্ষমা করে দেয়া উচিত। ক্ষমার মাধ্যমে শান্তি ও সম্প্রীতি তৈরি হবে। এক্ষেত্রে কুরআন ও হাদীসে ক্ষমার যে শিক্ষা দেয়া হয়েছে, তারা সেগুলোও কখনো তুলে ধরছেন।
এসকল ক্ষেত্রে ইসলামের মূল বক্তব্য কী, ইসলাম কি সর্বাবস্থায় সবাইকে ক্ষমা করতে উতসাহিত করে, নাকি এখানে বিশ্লেষন রয়েছে, বিশ্বাসী মুসলিমগণ এটি জানার প্রয়োজন বোধ করছেন। খুব সংক্ষেপে এ বিষয়ে মৌলিক কথাটি আমরা তুলে ধরতে চাই। যাতে করে ইসলামের ভারসাম্যপূর্ণ শিক্ষাটি আমাদের সামনে পরিষ্কার থাকে।
১। সন্দেহ নেই, ইসলামে ক্ষমা করে দেয়াকে অনেক উন্নত স্বভাব ও বিপুল মর্যাদার কাজ হিসেবে দেখা হয়। ক্ষমা করে দেয়াকে বর্ণনা করা হয়েছে প্রকৃত মুমিনের অন্যতম গুণ হিসেবে। বিষয়টি কুরআন ও হাদীসে বারবার আলোচিত হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের সম্বোধন করে বলেন,
وَلْيَعْفُوا وَلْيَصْفَحُوا أَلَا تُحِبُّونَ أَنْ يَغْفِرَ اللَّهُ لَكُمْ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ ) النور/ 22
আর তারা যেন ক্ষমা করে ও উপেক্ষা করে। তোমরা কি পছন্দ কর না যে আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করবেন? আর আল্লাহ তো অতি ক্ষমাশীল পরম দয়ালু। (সুরা নুর-২২) সুরা আলে ইমরানের ১৩৪ নং আয়াতে মুত্তাকিদের বিশেষ গুণ হিসেবে বলা হয়েছে, যারা ক্রোধ সংবরণ করে এবং মানুষকে ক্ষমা করে থাকে।
এমনিভাবে হাদীসেও নবীজি ক্ষমা করার বিপুল সওয়াবের ঘোষণা করেছেন। ক্ষমা করতে উতসাহিত করেছেন। তিনি বলেন,
مَا نَقَصَتْ صَدَقَةٌ مِنْ مَالٍ ، وَمَا زَادَ اللَّهُ عَبْدًا بِعَفْوٍ إِلَّا عِزًّا ، وَمَا تَوَاضَعَ أَحَدٌ لِلَّهِ إِلَّا رَفَعَهُ اللَّهُ
সদকা কখনো সম্পদ হ্রাস করে না। আর ক্ষমা করার দ্বারা আল্লাহ তায়ালা বান্দার সম্মান কেবল বাড়িয়েই দেন। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যে বিনয়ী হবে তিনি তাকে উঁচুই করবেন। (সহি মুসলিম-৪৬৮৯)
২। তবে ক্ষমা করে দেয়ার ব্যাপারে যে সওয়াব ও মর্যাদার ঘোষণা করা হয়েছে তা অর্জন করার জন্য আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভ করার নিয়ত থাকতে হবে। এছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ক্ষমা করা হলে সেই সওয়াব ও মর্যাদা পাওয়া যাবে না। ক্ষমা করা একটি আমলে সালেহ বা মহত কাজ আর যেকোন মহৎ কাজের সওয়াব তখনই পাওয়া যায় যখন তা আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টির জন্য করা হয়। নবীজি বলেন,
وَلَا يَعْفُو عَبْدٌ عَنْ مَظْلَمَةٍ يَبْتَغِي بِهَا وَجْهَ اللَّهِ إِلَّا رَفَعَهُ اللَّهُ بِهَا
আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় যে বান্দাই তার উপর করা যুলুম ক্ষমা করে দিবে আল্লাহ এর দ্বারা তার মর্যাদা উন্নীত করবেন। (মুসনাদে আহমদ-১৫৮৪)
৩। যুলুম করার পর যালেমকে যেমন ক্ষমা করা যায়, তেমনিভাবে তাকে বিচারের মুখোমুখি করে প্রতিশোধ নেয়াও বৈধ।
فمن اعتدى عليكم فاعتدوا عليه بمثل ما اعتدى عليكم واتقوا الله واعلموا أن الله مع المتقين.
সুতরাং কেউ যদি তোমাদের উপর যুলুম করে, তবে তোমরাও তার যুলুমের বদলা নিতে পার সেই পরিমাণে, যেমন যুলুম সে তোমাদের প্রতি করেছে। (সুরা বাকারা-১৯৪) মুমিনদের গুণাবলি সম্পর্কে বলা হয়েছে,
والذين إذا أصابهم البغي هم ينتصرون.
এবং তাদের রীতি হল তাদের উপর যুলুম হলে তারা প্রতিশোধ গ্রহণ করে। (শুরা-৩৯)
আর জুলুমের শিকার হওয়ার পর যে প্রতিশোধ গ্রহণ করল তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই। (শুরা-৪১)
৪। তবে এই প্রতিশোধ গ্রহণ করতে গিয়ে কোন ধরণের সীমালংঘন করা যাবে না। যেমনটি সুরা বাকারার উল্লেখিত আয়াতেও এটি বলা হয়েছে। অন্যান্য আয়াতেও এবিষয়ে নির্দশনা রয়েছে। বলা হয়েছে,
وإن عاقبتم فعاقبوا بمثل ما عوقبتم به،
তোমরা যদি (কোন জুলুমের) প্রতিশোধ নাও তবে ঠিক ততটুকুই নেবে, যতটুকু জুলুম তোমাদের উপর করা হয়েছে। (সুরা নাহল-১২৬)
جزاء سيئة سيئة مثلها،
মন্দের বদলা অনুরূপ মন্দ। (সুরা শুরা-৪০)
৫। প্রতিশোধ গ্রহণ করা নাকি ক্ষমা করে দেয়া, কোনটি উত্তম বা আমদের করা উচিত?
এক্ষেত্রে ইসলামের অবস্থান হচ্ছে, ক্ষমা করাটাই মূল ও সাধারণ শিক্ষা। তবে ক্ষেত্রে বিশেষে বিচারের সম্মুখীন করা, প্রতিশোধ গ্রহণ করাও উত্তম। এজন্য কুরআনে কারীমে প্রতিশোধ গ্রহণ করা অনুমতি দিয়ে ক্ষমা করতে উতসাহিত করেছে। সুরা শুরায় বলা হয়েছে,
وَجَزَاءُ سَيِّئَةٍ سَيِّئَةٌ مِثْلُهَا فَمَنْ عَفَا وَأَصْلَحَ فَأَجْرُهُ عَلَى اللَّهِ إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الظَّالِمِينَ (40)
আর মন্দের বদলা মন্দ। তবে যে ক্ষমা করে ও সংশোধনের চেষ্টা করে তার প্রতিদান আল্লাহর দায়িত্বে। নিশ্চয় তিনি জালেমদের পছন্দ করেন না। (শুরা-৪০)
মুফাসসির আল্লামা ক্বুরতুবি ইবনুল আরাবি এর উদ্ধৃতিতে লিখেছেন, ক্ষমা করা ও প্রতিশোধ গ্রহণ করা আল্লাহ তায়ালা দু’জায়গায় দুটিকেই প্রশংসা করেছেন। ফলে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থায় এই দুটি আচরণ উত্তম হিসেবে বিবেচিত হবে। প্রথম অবস্থা হচ্ছে, অপরাধী ব্যক্তি প্রকাশ্যে পাপ করে বেড়ায়, নির্লজ্জ্ব, ছোটবড় সবাইকে নির্যাতন করে, এক্ষেত্রে তার থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করা উত্তম। প্রসিদ্ধ তাবেঈ ইবরাহীম নাখায়ী এক্ষেত্রে সাহাবি ও তাবেঈদের কর্মপন্থা বর্ণনা করে বলেন, তারা নিজেদের অপমানিত করা পছন্দ করতেন না, এতে করে পাপীষ্ঠরা তাদের বিরুদ্ধে দুঃসাহসি হয়ে উঠবে। (অর্থাৎ তারা ক্ষেত্র বিশেষে প্রতিশোধ গ্রহণ করতেন।)
দ্বিতীয় অবস্থা হল, যার থেকে অপরাধটি সংঘটিত হয়েছে এটি ব্যতিক্রম ও আকস্মিক ঘটনা। তিনি নিয়মিত এমন অপরাধ করেন না। অথবা অপরাধী ব্যক্তিটি নিজের ভুল স্বীকার করে অনুতপ্ত হয়ে মাফ চাচ্ছে। তার ক্ষেত্রে ক্ষমা করা উত্তম। মাফ করতে উতসাহমূলক যে সকল আয়াত রয়েছে এগুলো এশ্রেণির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। (তাফসীরে কুরতুবি-১৬/৩৯)
প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও মুফাসসির আল্লামা শিব্বির আহমদ উসমানি, মুফতি মুহাম্মদ শফী রহ, সহ অনেকেই এই ব্যখ্যা করেছেন। আল্লামা শিব্বির আহমদ উসমানি লিখেছেন, যেখানে ক্ষমা করা সংগত তারা (প্রকৃত মুমিনরা) ক্ষমা করে। যেমন এক ব্যক্তির আচরণে রাগান্বিত হল আর সে অনুতপ্ত হয়ে নিজের দোষ স্বীকার করে নিল। তখন ক্ষমা করে দিবে। এমন ক্ষেত্রে ক্ষমা করাই প্রশংসনীয়। আর যেখানে প্রতিশোধ নেয়াই সংগত সেখানে তার প্রতিশোধ গ্রহণ করে। যেমন কোন ব্যক্তি অযথাই বাড়াবাড়ি করে চলেছে এবং জুলুম ও ক্ষমতাবলে পরাভূত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে, অথবা উত্তর না দিলে তার ধৃষ্টতা বেড়ে যাচ্ছে, কিংবা তার ব্যক্তিগত অমর্যাদার কথা বাদ দিলেও দীনের অমর্যাদা বা মুসলমানদের অপমান হয়, এসব অবস্থায় তারা প্রতিশোধ গ্রহণ করে। তবে তা অপরাধীর অপরাধের সমপরিমাণ হয়, অপরাধ অপেক্ষা অধিক শাস্তি দেয় না। (তাফসীরে উসমানি, সুরা শুরার ৩৯ আয়াত, রাহনুমা প্রকাশনি)
আল্লামা আবু সাঈদ খাদেমী হানাফি লিখেছেন, সাধারণ অবস্থায় ক্ষমা করাটাই উত্তম। তবে বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে প্রতিশোধ গ্রহন করা ক্ষমা করার চেয়ে উত্তম বিবেচিত হয়। যেমন, ক্ষমা করলে জুলুম বেড়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে, প্রতিশোধ গ্রহণ করা হলে জুলুম কমবে বা বন্ধ হয়ে যাবে অথবা অন্যদের জন্য শিক্ষা ও উপদেশ হয়ে থাকবে। (বুরাইক্বা মাহমুদিয়াঃ ২/২৬৪)
আল্লামা ইবনে তাইমিয়া লিখেছেন, ক্ষমা করা উত্তম হওয়ার জন্য শর্ত হচ্ছে এই ক্ষমার কারণে কোন ক্ষতি না হওয়া। যদি ক্ষমা করার দ্বারা ক্ষতি সাধিত হয় তাহলে এটা ক্ষমাকারির পক্ষ থেকে জুলুম হবে। হয়তো নিজের প্রতি নয়তো অন্যের প্রতি। তাই এধরণের ক্ষমা বৈধ নয়। (জামিউল মাসাইলের সূত্রে ইসলাম সুওয়াল জওয়াব ওয়েবসাইট)
৬। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যক্তিগত জীবনে নিজের জন্য প্রতিশোধ গ্রহণ করেন নি। বরং উদারভাবে ক্ষমা করে গেছেন। তবে অনেক ক্ষেত্রে ইসলামের স্বার্থে, মুসলিমদের স্বার্থে তিনি প্রতিশোধ গ্রহণ করেছেন। মক্কা বিজয়ের সময় ব্যাপকভাবে সবাইকে ক্ষমা করলেও ইকরিমা ইবনে আবু জেহেল, আব্দুল্লাহ ইবনে খাতাল, আব্দুল্লাহ ইবনে সারহ সহ অনেককেই তাদের অপরাধের কারণে হত্যা করার আদেশ জারী করেছিলেন। হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় যখন ছড়িয়ে পড়ল কাফেররা উসমান রা, কে শহীদ করে ফেলেছে, তখন নবীজি এর প্রতিশোধ গ্রহণ করার অঙ্গিকার নিয়েছিলেন সাহাবীদে কাছ থেকে। যা বাইয়াতে রিদওয়ান নামে অভিহিত এবং এর কথা কুরআন শরীফেও বর্ণিত হয়েছে।
৭। কিছু অপরাধ আছে যেগুলো প্রমাণিত হয়ে যাওয়ার পর এর শাস্তি বাস্তবায়ন করা অবধারিত হয়ে যায়। তখন কোন মানুষের এখতিয়ার থাকে না এগুলো মাফ করার। এগুলোকে শরীয়তের পরিভাষায় “হুদুদ” বলা হয়। যেমন চুরি, ব্যভিচার-ধর্ষণ, ডাকাতি, মদ্যপান ইত্যাদি। শরীয়তে এধরণের শাস্তি বিদ্যমান থাকাটাও এবিষয়ে জোর দেয় যে সব অপরাধীর অপরাধ ক্ষমাযোগ্য নয়।