বেশ অনেক্ষণ ভাবলাম বিষয়টি কিভাবে শুরু করি। দশ মিনিট গেল কোন পথ পেলাম না। শেষে ঠিক করলাম এমনিই শুরু করি। জঙ্গল কেটেও তো মানুষ পথ তৈরী করে। তো, ব্যাপার হলো আমি আলাপ করতে চাচ্ছি প্রশ্রাবের পর ঢিলা নিয়ে হাঁটাহাটি করার বিষয়টি নিয়ে। এ নিয়ে আমার দেখা মতে আমাদের মাঝে একটা অস্পষ্টতা কাজ করছে এবং এ অস্পষ্টতা থেকে একটা প্রান্তিকতা তৈরী হয়েছে। এখানে দুই প্রান্তের গল্পই বলবো। মাঝ-ভূমির গল্পটিও বলবো।
সমস্ত নাপাকির মধ্যে অন্যতম একটি নাপাক বস্তু হলো প্রশ্রাব। আর আপনি জানেন যে, নামাজের জন্য আমার কাপড় ও শরীর সবধরণের নাপাকি থেকে পবিত্র থাকা আবশ্যক। এটি মুসলমান মাত্রই জানা আছে। এটি, এমনকি, অনেক অমুসলিমরাও জানে।
সুতরাং, প্রশ্রাবসহ সকল নাপাক থেকে আমার শরীর ও কাপড় পবিত্র না থাকলে আমার নামাজ অগ্রহণযোগ্য। এটি স্বতঃসিদ্ধ একটি বিষয়। এর জন্য আলাদা করে দলীল-প্রমাণের প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।
তবে বিশেষভাবে যা বলতে হয় তা হলো অন্যান্য নাপাকির তূলনায় প্রশ্রাবের ব্যাপারে আমাদের শিথিলতা ও গাফিলতিটা বেশি হয়। নানা কারণে। এটা আমরা সবাই বুঝি।
তো, এ কারণে হাদীসে বিশেষভাবে প্রশ্রাবের নাপাকি থেকে বেঁচে থাকার জন্য জোরালো তাগিদ এসেছে। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি বলেন লক্ষ্য করুন- তোমরা প্রশ্রাব থেকে বেঁচে থাকো। কারণ, বেশিরভাগ কবরের আজাব এর কারণে হয়ে থাকে। হাদীসটি নানা শব্দে অনেকেই রেওয়ায়েত করেছেন। দারাকুতনী, ইবনে মাজাহ, হাকেম, তাবারানী। কিছু সনদে কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত হাদীসখানা টিকে যায়। মুসনাদে আহমদে ৮৩৩১ নাম্বারে এটি পাওয়া যাবে।
আরেকটি হাদীস খেয়াল করুন, যার সারমর্ম- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার দুটি কবরের পাশ দিয়ে হেঁটে যাবার সময় শুনতে পেলেন কবরের লোক দুজনকে আযাব দেওয়া হচ্ছে। তখন এর কারণ হিসেবে তিনি সঙ্গের সাহাবাদের বললেন- এদের মধ্যে একজনকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে, কারণ, সে প্রশ্রাব থেকে বেঁচে থাকতো না।…
মূল বক্তব্যটি দেখুন বুখারী-২১৬, মুসলিম-৭০৩, আবু দাউদসহ অন্যান্য কিতাব।
তো, বুঝাই যাচ্ছে আমাদের শরীরে বা কাপড়ে প্রশ্রাবের ছিটা লেগে যাওয়ার যতগুলো আশংকা-ক্ষেত্র আছে সবগুলোতেই অত্যন্ত সতর্কতার সাথে বেঁচে থাকাটা আমাদের জন্য একান্ত আবশ্যক।
এ আশংকা-ক্ষেত্রগুলোর অন্যতম হলো আমাদের প্রতিদিনকার প্রশ্রাব পরবর্তী সময়টি। সাধারণত দেখা যায় প্রশ্রাবের মূল বেগটি শেষ হবার পর একটু সময় পর্যন্ত এক ফোঁটা দু’ফোঁটা করে ঝরতে থাকে। এই ঝরে পড়ার ব্যাপারটিতে সকল মানুষের অবস্থা এক রকম নয়। কারো অল্পতেই শেষ হয়। কারো একটু বেশি সময় লাগে। আবার কারো কারো বেশ সময় লাগে।
এ ব্যবধানটি হয় মূলতঃ স্বাস্থ্য, বিশেষ রোগ, অঞ্চলের পরিবেশ, আবহাওয়া, খাদ্যের ধরণ ইত্যাদির ভিন্নতার কারনে।
একটু খুলে বলা যাক।
যেমন, কেউ আছে এমন যে, গতর-স্বাস্থ্য খুব ভালো। টানটান। তেমন কোন রোগ নেই। তো, তার সাধারণত বেশি সময় লাগে না- অল্পতেই পুরোটা নিস্ক্রান্ত হয়।
এর বিপরীতে কারো যদি হার্নিয়া, ডায়াবেটিস, বা পেটের সমস্যা ইত্যাদি থাকে বা নাপাক নিয়ে অতিরিক্ত মানসিক চাপ থাকে তাহলে তার শেষ হতে অনেক সময় লেগ যায়।
আবার, কেউ আছেন শুকনো অঞ্চলে থাকেন, খাদ্যও গ্রহণ করেন রুটি বা এরকম শুকনো খাবার। এমন ব্যক্তিদেরও সাধারণত অল্পতেই শেষ হয়ে যায়। এর বিপরীতে, যারা আর্দ্র অঞ্চলে থাকেন, ভাত ও রসালো খাবার খান তাদের একটু বেশি সময় লাগতে পারে।
আবার কেউ কেউ আছেন এমন- দিনটি যদি রৌদ্রকরোজ্জ্বল হয় তাহলে সেদিন কোন সমস্যা হয় না। কিন্তু যে দিন আকাশে ভারী মেঘ জমে। দিনটি হয় ভেজা ভেজা সেদিন তার অনেক সময় লাগে।
যাই হোক, যে যে- অবস্থাতেই থাকুক, প্রত্যেকের জন্যেই প্রশ্রাবের ছিটা ও ফোঁটা থেকে বেঁচে থাকতে হবে। এটা হাদীসের ভাষ্য। শরীয়তের দাবি। রাসূলুল্লাহ সাল্রাল্রাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবাযে কেরামের আমল। পুরো উম্মতের ইজমা। এ নিয়ে কারো কোন দ্বিমত নেই।
এখন যাদের এ সমস্যা নেই। প্রশ্রাব শেষ হবার পর কয়েক ফোঁটা ঝরার পরই পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়, দাঁড়ানোর পর আর ফোঁটা ঝরার আশংকা না থাকে তাঁরা ঢিলা বা পানি ব্যবহার করে চলে আসবেন। তাঁদের জন্য ঢিলা নিয়ে হাঁটাহাঁটি করা বা অন্য কোন কসরত করা অনর্থক একটি কাজ। এমন সুস্থতার নেয়ামত থাকার পরও অযথা কোন কসরত করতে গেলে উল্টো ক্ষতির শিকার হতে পারেন।
আর যাদের সময় লাগে তারা পুরোপুরি পবিত্রতা অর্জন করার জন্য নিজের সুবিধামত এবং শরীয়তসম্মত যে-কোন পন্থা অবলম্বন করতে পারেন। এর জন্য কোন ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে পন্থাটি যেন শরীরের জন্য ক্ষতিকর এবং দৃষ্টিকটু না হয়। এ ধরণের ব্যাক্তিদের জন্য ফুকাহায়ে কেরাম কিছু পরামর্শ রেখেছেন।
আমাদের ফিকহের প্রায় সব কিতাবে আপনি এটা পাবেন। এখানে শুধু হানাফি মাজহাবের প্রশিদ্ধ কিতাব নূরুল ইযাহ, তার ব্যাখ্যাগ্রন্থ মারাকিল ফালাহ এবং টিকাগ্রন্থ হাশিয়াতুত তাহতাবী থেকে সরাসরি টেক্সট উঠিয়ে দিচ্ছি-
” পুরুষের জন্য ইস্তিবরা তথা ভালভাবে প্রশ্রাবের দূর করার চেষ্টা করা আবশ্যক। যেন প্রশ্রাবের চিন্হ দূর হয় এবং দূর হওয়ার ব্যাপারে তার মন আশ্বস্ত হয়। এটা করবে তার নিজস্ব অভ্যাস ও পন্থায়, যেমন, হেঁটে, কাশি দিয়ে, বাম কাতে শুয়ে, পদসঞ্চালন করে, শূণ্যে পা নেড়ে, লজ্জাস্থানকে আলতো করে নিংড়ে বা অন্য যে কোন পন্থায়। একে কোন সিস্টেমের সাথে নির্দিষ্ট করা যাবে না। কারণ, মানুষের একেকজনের অভ্যাস ও পদ্ধতি একেক রকম হয়ে থাকে।”
এতক্ষণের আলোচনা দ্বারা আশা করি এতটুকু পরিস্কার হয়েছে যে,
১. প্রশ্রাব থেকে পূর্ণরূপে পবিত্রতা অর্জন করা ওয়াজিব,
২. মূল লক্ষ্য হলো প্রশ্রাবের ফোঁটাকে ভালোভাবে ঝরানো
৩. এবং হাঁটাহাটি বা এরকম কোন কিছু করা মৌলিকভাবে শরীয়তের আলাদা কোন বিধান নয়; যাদের প্রয়োজন আছে তাদের জন্য একটি বিশেষ পরামর্শমাত্র।
৪. হাঁটাহাটি করাই একমাত্র পন্থা নয়; আরো অনেক পন্থা আছে। ব্যাপারটিকে শুধু হাঁটার মধ্যে সীমাবদ্ধ না করে যার যেটা সুবিধে সে সেটাই পালন করা উচিত।
কেউ কেউ প্রশ্ন করেন- এই যে আপনারা হাঁটাহাটি করেন, এটা কোন হাদীসে আছে? তো, যারা এমন প্রশ্ন করেন তারা আসলে মূল বিষয়টি বুঝেন নি।
তাদের উদ্দেশ্যে সংক্ষেপে বলি-
হাঁটাহাটি করার কথা হাদীসে থাকতে হবে কেন? হাদীসে আছে প্রশ্রাব থেকে বেঁচে থাকতে হবে। এটা ওয়াজিব। এখন যা করলে এ থেকে বেঁচে থাকা যায় সেটাও তো আবশ্যক হবে। আমি দেখি হাঁটাহাটি না করলে আমার পেশাব পরিস্কার হয় না। আপনি বলছেন হাঁটাহাটি করা যাবে না। এখন, আপনার কথা মানলে হাদীসের উল্টো গিয়ে নাপাক নিয়েই আমাকে নামাজ পড়তে হবে। আপনার ধমকে তো আমার পেশাব বন্ধ হচ্ছে না। বলুন, আমি কার কথা মানবো? এতো একেবারে সহজ হিসেব।
হ্যাঁ, একে কেউ যদি কেবল হাঁটার মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলে তাহলে তা অগ্রহণযোগ্য। এমনিভাবে কেউ যদি একে মৌলিক কোন আবশ্যকিয় বিধান মনে করে বলে যে, প্রয়োজন থাকুক বা না থাকুক, হাঁটতে হবে বা এরকম কিছু করতে হবে, তাহলে তা-ও অগ্রহণযোগ্য ও বিদআত বলে গণ্য হবে।
যাদের হাঁটতে হয় তারা মনে রাখুন-
আপনি একটি বিশেষ অবস্থায় আছেন। পুরো বিষয়টিই আড়ালে সারার কাজ। একান্ত যদি আড়াল না-ই পান তাহলে যথাসম্ভব মানুষের দৃষ্টি এড়িয়ে চলুন। মানুষ থেকে যথাসম্ভব দূরত্ব বজায় রাখুন। সবার সাথে মিশে যাবেন না। অন্যদের সাথে কথা বলবেন না। অনেককে দেখা যায় এ অবস্থায় অত্যন্ত বেপরোয়াভাবে স্বাভাবি ভঙ্গিতে রাস্তায় চলেন। আর দশজনের সাথে মিশে গল্পগুজব জুড়ে দেন। বা পুরে এলাকায় জোরে জোরে লেফট-রাইট করতে থাকেন। হাবভাব আচরণ চেহারা দেখলে মনে হয় না তিনি একটি বিশেষ অবস্থায় আছেন। এমন করা অত্যন্ত দৃষ্টিকটু। আর যতটুকু করলে হয়ে যায় অতটুকুই করুন; এরচে বেশি না।
শরীয়তের বক্তব্য হলো পাক-নাপাকির ব্যাপারে মানসিক অবস্থাটি স্বাভাবিক রাখতে হবে। এ ব্যাপার প্রয়োজনের অতিরিক্ত মনোযোগ দেওয়া সঠিক নয়। এর কারণে মানসিক রোগ সৃষ্টি হবে। আর এক বিষয়ে খুঁতখুতে মানসিকতা সৃষ্টি হলে সেটি আপনার অন্যান্য বিষয়েও ছড়িয়ে পড়তে পারে। ধীরে ধীরে আপনি সকল বিষয়ে সুচিবায়ূগ্র্রস্ত হয়ে পড়বেন। এ ধরণের লোকদের ব্যাপারে পরামর্শ দিয়ে এক হাদীসে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন যার সারমর্ম হলো- যদি মনে হয় প্রশ্রাবের ফোঁটা রয়ে গেছে তাহলে কাপড়ে একটু পানি ছিটিয়ে দাও। ( অর্থাৎ পানি ছিটিয়ে দিলে শয়তান আসার রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ভিজা দেখলেও মনে হবে এ তো প্রশ্রাব নয়; ছিটানো পানি।)
আমার ব্যক্তিগত উপলব্ধি ও অনেকের অভিজ্ঞতা থেকে বলি- প্রশ্রাবের ফোঁটা ঝরার বিষয়টি একটা পর্যায়ে গিয়ে মনের সাথে সম্পৃক্ত থাকে। আপনি চাইলে এক-দুই ফোঁটা করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঝরাতে পারবেন। শেষ হবে না। এ জন্য স্বাভাবিক থাকুন। এ অভ্যাস দূর করার জন্য প্রয়োজনে নামাজের সময় কিছুদিন আলাদা কাপড় ব্যবহার করুন। তবু অতিরিক্ত চাপাচাপি করতে যাবেন না। আমার বোধমতে অতিরিক্ত চাপ দিতে থাকলে এর দ্বারা আপনি বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। এর মধ্যে অন্যতম হলো, আমার ধারণা, হার্নিয়া। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে হেফাজত করুন। আমীন।