সমযের কি ঘ্রাণ আছে? আসলে তো নাই। সময় অঙ্গ ও অবয়বহীন একটি ব্যাপার। ফলে তার আঙ্গিক রূপান্তরও নাই। তার মাহাত্ম হয়, অর্থগত মর্যাদা আরোপিত হয় এর উপর। কিন্তু, রমজান মাসের ব্যাপারটি আমার কাছে ভিন্ন মনে হয়। ছোটবেলা থেকেই মনে হতো এ মাসের যেন কোমল দেহ আছে। এর অবয়ব যেন আমি দেখতে পাই। স্নিগ্ধ ও সুগন্ধিময়। এর গায়ে লেগে আছে অচেনা অপার্থিব কোন ঘ্রাণ। পবিত্র এই সময়ের ছোঁয়ায় দৃশ্যপট পাল্টে যায়, কোমল হয় বস্তুর পৃথিবী, কোমলতর হয়ে উঠে আমাদের মানসলোক। কোমল, পেলব, শান্ত, স্নিগ্ধ। অস্থির এই পৃথিবীর সময় যখন মাসের সিঁড়ি ভেঙ্গে ঘনিয়ে আসে রমজান, তখন প্রাণ যেন তড়পায়। আহা, কবে আসবে সে! সে যে আসে ধীরে…
এই মাসের সাথে আমাদের সমাজচিত্রের পরিবর্তনের একটা সম্পর্ক আছে। চারপাশের মানুষ খুব যে ধর্ম-কর্ম করে তা-তো না; কিন্তু, তবু, সবাই কেমন নরম হয়ে আসে। মানুষের মাথায়-মাথায় টুপি উঠে। একান্ত আবেগের সাথে সাহরী-ইফতার-তারাবির আমলগুলো পালন করে। আবেগ ও আনন্দের সাথে, অপার্থিব এক ভালোলাগার সাথে। চারপাশে তাকালেই মনে হয় মানুষ বড় সুখী আছে প্রেমময় এই সময়কে নিয়ে।
সীমাহীন মহান ও ফজীলতপূর্ণ এই সময়টিতে দুনিয়ার তাবৎ মুসলমান জীবনকে শুধু যাপনই করে না, রীতিমত উদযাপন করে। এই উদযাপনের সময়ে আমাদের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একান্তভাবে এবং যত্নের সাথে খেয়াল রাখতে হবে। এর মধ্যে দুটো বিষয় হলো সেহরী ও ইফতার। এই দুটো বিষয়কে আমরা যে আনন্দের ভেতর দিয়ে গ্রহণ করি, যেভাবে উৎসবের আমেজে উদযাপন করি, তা খুবই ভালো একটি দিক। কিন্তু, সে সাথে এটাও মনে রাখতে হবে—এ দুটো শুধু দীর্ঘ সময় অভুক্ত থাকার প্রস্তুতি ও দীর্ঘ অভুক্ততার পর সাগ্রহ খাবার গ্রহণই নয়; আলাদা ইবাদতও বটে। ইফতার না করে লাগাতার রোজা রাখা মাকরুহ এবং ইফতার গ্রহণে দেরী করাও সুন্নাহ পরিপন্থি কাজ। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মানুষ যতদিন দ্রুত ইফতার করবে, ততদিন তারা কল্যাণের মধ্যে থাকবে। (সহীহ বুখারী : ১৯৫৭) এমনিভাবে সেহরী খাওয়া পরিত্যাগ করাও ঠিক নয়। হাদীসে আছে— তোমরা সেহরী খাও। কারণ, এতে রয়েছে বিশেষ বরকত। (সহীহ বুখারী : ১৯২৩); আরেক হাদীসে আছে : আমাদের আর আহলে কিতাবের সিয়ামের মাঝে পার্থক্য হলো সেহরী খাওয়া। (সহীহ মুসলিম : ১০৯৬) সেহরী ও ইফতারের সময় এ দিকটি মাথায় রাখলে আমরা বিপুল সওয়াব অর্জন করবো এবং আমাদের উৎসব-আমেজ ভিন্ন এক মাত্রায় উন্নীত হবে।
এমনিভাবে এ দুই সময় হলো বিশেষ বরকতপূর্ণ ও দোয়া কবুলের সময়। ইফতারের সময়ের ব্যাপারে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : তিন ব্যক্তির দোয়া ফিরিয়ে দেওয়া হয় না : ন্যায়পরায়ণ শাসক, রোজাদার—যখন ইফতার করে এবং মাজলুম। (সুনানে তিরমিজি-১০/৫৬)
কিন্তু, এ জায়গাটাতে মনে হয় আমাদের খুবই গাফিলতি হয়। ইফতারের নান্দনিক আয়োজন আর উৎসবের ভেতর দিয়ে কাটে এই সময়। কখনো এমনিতেই বসে থাকি সময় কাটানোর জন্য, গপসপ করি, বই পড়ি। খুব ভালো হবে যদি আমরা কমপক্ষে আধা ঘণ্টা আগে থেকে একান্ত দোয়ায় মশগুল হয়ে যাই। কখনো আমরা দোয়ার আয়োজন করি বটে, কিন্তু, তা-ও সেই আনুষ্ঠানিকতার ভেতর বন্দি হয়ে থাকে। অথচ, আমাদের উচিত একান্ত হয়ে আপন প্রভুর সাথে ঘনিষ্ঠ আলাপে মগ্ন হওয়া। এবং তা দিন বেঁধে নয়; প্রতিদিন।
এমনিভাবে, আমরা পুরুষরা তো চাইলেই সময় বের করতে পারি, কিন্তু, আমাদের নারীগণ? ইফতারির রকমারি আয়োজনের ফাঁদে পড়ে আমাদের ঘরের নারীগণ যেন এ সবের চিন্তাই করতে পারেন না। ফলে, ব্যাপকভাবে দেখা যায় তারা এসবে অভ্যস্তও নন। অতএব, নিজেরাও সময়টিকে মূল্যায়ন করবো এবং নারীদেরকেও সুযোগ করে দিয়ে উৎসাহিত করবো, এমনকি ইফতারির আয়োজন কমিয়ে হলেও।
আর, সেহরীর সময় তো হলো শেষ রাতের চির মহিমান্বিত প্রহর। তাহাজ্জুদের জায়নামাজ রহমত আর ঐশি করুণায় উপচে উঠার স্বর্ণ সময়। প্রতিদিন রাতের শেষ তৃতীয়াংশে দুনিয়ার আকাশে এসে আল্লাহ তাআলা মানুষকে কী আবেগপূর্ণ আর প্রেমেরে ভাষায় ডাক দিয়ে যান : আমাকে যে ডাকবে, আমি সাড়া দিব; আমার কাছে যে চাইবে, আমি তাকে দিব; আমার কাছে যে ক্ষমা চাইবে, আমি তাকে ক্ষমা করে দিব! (বুখারী : ১১০৭)
সারা বছর তো আর সবার পক্ষে এই গুরুত্বপূর্ণ সময়টি পাওয়া সম্ভব হয় না। কিন্তু, একটু মনোযোগ দিলে পূর্ণ এক মাস আমরা সবাই পেতে পারি তাহাজ্জুদ, এবং শেষ রাতের তুমুল রোনাজারি—নবীজির একান্ত প্রিয় এই আমল দুটো। এবং গুরুত্বের সাথে এক মাস অভ্যাস করে নিলে সারা বছর পালন করা সম্ভাব্য হয়ে উঠে।
রমজান আমাদের মাঝে আসে। রহমতের বৃষ্টিতে ভিজে যায় পথঘাট, ঘরবাড়ি, মসজিদের জায়নামাজ, আর মুমিনের হৃদয় জমিন। আল্লাহ তাআলার প্রেমের দরিয়ায় তুফান উঠে। কিন্তু, আমার কেন যেন মনে হয় আমরা একে সেইভাবে টের পাই না। রমজানকে আসলে আমরা সেভাবে গ্রহণ করতে অভ্যস্ত হচ্ছি না। কেমন একটা জাগতিক উদযাপন ও উৎসবের ভেতর দিয়ে কাটিয়ে দেই একেকটা রমজান। আহা, বছরে আসেই তো মাত্র একবার। আর কে জানে কার জীবনে কয়টা রমজান আসে। হয় তো এটিই আমার শেষ রোজা, শেষ তারাবি… আর কোন দিন জাগবো না সেহরীর জন্য।