এক ভদ্রলোক একবার জিজ্ঞেস করলেন, আমার একটা জিনিস জানবার ছিল, আপনি কি একটু সাহায্য করতে পারবেন? আমি সহাস্যে বললাম, আপনি বলুন, সম্ভব হলে অবশ্যই করব।
তখন তিনি বললেন, প্রশ্নটা ঠিক আমার নয়; আমার অফিসের জিএম জানতে চেয়েছেন, জান্নাতের সংখ্যা জাহান্নামের সংখ্যা থেকে বেশি কেন?
আমি বললাম, এই প্রশ্নের উপর আমার সুনির্দিষ্ট কোন পড়াশোনা নাই এবং সঠিক কোন ব্যাখ্যাও এখন দিতে পারব না। অনুমান থেকে আমি কয়েকটা উত্তর দিতে পারি। যেমন :
১. এটা আল্লাহর ইচ্ছা। কোন ব্যাখ্যা জানার দরকার নেই।
২. আল্লাহর রহমতের দিক বেশি, তাই এর প্রকাশও বেশি।
৩. মানুষকে ভালো হতে বিশেষভাবে উৎসাহিত করার জন্য।
৪. নৈরাশ্যের চেয়ে আশাবাদ ভালো, এই সবক দেওয়ার জন্য।
৫. الايمان بين الخوف والرجاء অর্থাৎ, ঈমান হলো আশা ও নিরাশার মাঝামাঝি অবস্থান; তবে, আশার দিকটা বেশি থাকতে হয়, এই শিক্ষা পাওয়ার জন্য।
এরকম আরো বেশ কিছু কথা বলা যাবে চিন্তা করলে; কিন্তু, আমি এখানে মূল যে উত্তরটি দিব, তা একটু বিস্তারিত। শুনতে গেলে আপনি হয়তো বিরক্ত হবেন। তবে, এই বিস্তারিত আলাপটাই আমি মনে করি এসব ক্ষেত্রে মৌলিক সমাধান।
ভদ্রলোক বললেন তিনি বিরক্ত হবেন না এবং শুনতে আগ্রহী।
দেখুন, প্রশ্ন একটি অসাধারণ শক্তি। এ হলো মানুষের জ্ঞানের রাজপথ। কিন্তু, দুঃখজনক হলো, অনেক মানুষের ধারণা, ইসলাম প্রশ্নশীলতা ও অনুসন্ধিৎসাকে অনুৎসাহিত করে নিঃশর্ত নিশ্চুপতার নির্দেশ দেয়। যার ফলে, মানুষের মেধা-প্রতিভা ও মননের বিকাশ হয় না।
ইসলামের ব্যাপারে এরকম বক্তব্যের উৎপত্তিস্থল হল-জ্ঞানহীনতা এবং ইসলামের ব্যাপারে জ্ঞানান্বেষার জন্য আন্তরিতক না হওয়া। এ ছাড়া এর আর কোন উৎস নাই। বাস্তবে ইসলামে প্রশ্নতত্ত্বটি এতো সুন্দর, সুশৃঙ্খল, যৌক্তিক ও বিস্তারিত যে, আমার ক্ষুদ্র জানাশোনা সত্তেও আমি মুগ্ধ-বিহ্বল হয়ে আছি।
প্রথম কথা হলো
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, আপনি প্রশ্ন কেন করবেন? একমাত্র উদ্দেশ্য হতে হবে জ্ঞান। কাউকে আটকানোরর উদ্দেশ্যে হঠকারিতামূলক প্রশ্ন গ্রহণযোগ্য নয়। ইসলামে নয়, সাধারণ যুক্তির দৃষ্টিতেও নয়।
দ্বিতীয় কথা হলো
আপনি কী বিষয়ে প্রশ্ন করবেন। এটা বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ।
প্রশ্ন আমরা দুটো বিষয়ে করতে পারি : ধর্মীয় বিষয় ও জাগতিক বিষয়।
[এক.] ধর্মীয় বিষয়ে প্রশ্ন
মনে রাখি—প্রশ্নের মোটা দাগে দুটো ফর্ম আছে : “কেন ফর্ম” এবং “কী ফর্ম”। দেখুন, প্রশ্ন কিন্তু নানা শব্দে হতে পারে। আমি একে এখানে দুই শব্দে সীমিত করতে চাচ্ছি না; উদ্দেশ্য হলো—প্রশ্নের মৌলিক চরিত্র ও ধরণ সম্পর্কে ধারণা দেওয়া এবং আমার মনে হয় তা বুঝাতে পেরেছি।
= ধর্মীয় বিষয়ে কেন ফর্ম
আপনি খেয়াল করে দেখবেন, পুরো কুরআনুল কারীমে একটু পরপরই মানুষকে প্রশ্ন করতে বলা হয়েছে। নানাভাবে, নানা ঢঙে, নানা নানা চিত্রে। কত যে এর রূপ, কত যে এর প্রকাশ বৈচিত্র।
এবং শুধু তাই নয়; মানুষের প্রশ্নশীলতাকে জাগিয়ে তোলার পর, আল্লাহ তাআলাই নিজেই বলে দিচ্ছেন, আমি এসব দেখিয়েছি যেন তোমরা প্রশ্ন করো। প্রশ্নের ভেতর দিয়ে জ্ঞানকে খুঁজে পাও।
কুরআন ও হাদীসের দিকে সামগ্রিক দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, মানুষের ঈমানের ভীতই রাখা হয়েছে প্রশ্নের উপর। প্রশ্নের ভেতর দিয়ে মানুষ আল্লাহকে খুঁজে পায়।
এই প্রশ্ন কিন্তু ধারালো ছুরির মত নয়; এ হলো সমস্ত বোধ ও উপলব্ধি নিয়ে, সত্যকে পাওয়ার এবং পেলে হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করার আকুলতায় বিনয়-নত জিজ্ঞাসা।
এভাবে, একজন মানুষ যখন আল্লাহকে খুঁজে পাবে, অতঃপর, একইভাবে রাসূলের রিসালাতকে খুঁজে পাবে, তখন তাদের আদেশ নিষেধ বা কোন বক্তব্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা মৌলিকভাবে অযৌক্তিক। কেউ যদি তুলে, ধরে নিতে হবে সে মূলত আল্লাহ তাআলাকে তার গুনাবলীসহ চিনে নাই। তার উচিত হবে, এই প্রশ্নগুলো বাদ দিয়ে মূল জায়গাটিতে আরো মেহনত করা।
সার কথা হলো—তাওহীদ ও রিসালাতের ক্ষেত্রে অনুসন্ধিৎসার জন্য সঠিক মনোভঙ্গি নিয়ে প্রশ্নকে উৎসাহিত করা হয়েছে, স্বাধীনভাবে। সে জায়গাদুটোতে জবাব পাওয়ার পর তাদের কোন কিছু নিয়ে মৌলিকভাবে আর প্রশ্ন করার কোন অধিকার কারো নাই। এবং এটাই যৌক্তিক। একজন মুসলমান হিসেবে আমাদেরকে এই জায়গাটায় উঠে আসতে হবে এবং সমস্ত মানুষকে তুলে আনতে হবে।
আমাদের সাথে যে নাস্তিকদের তর্কগুলো হয়, তার বেশিরভাগই অনর্থক। কারণ, বিতর্কের মেরুদণ্ড হলো—উভয়ে মানে এমন একটি বিচারক বিষয় থাকা, যার ব্যাপারে উভয়দল একমত। এরকম একটি সমতল না থাকলে সারাদিন কথা বললেও সমাধান আসবে না। তবু, আমাদেরকে কথা বলতে হয়, নাস্তিকদেরকে ঠিক করার জন্য যতটা না, তারচেয়ে বেশি সাধারণ মুসলমানকে ফিরিয়ে রাখার জন্য।
তো, এই জবাব-সংস্কৃতি হলো—সাময়িক ব্যবস্থা। এরকম সাময়িক ব্যবস্থা বুজুর্গানে দীনও গ্রহণ করেছেন, সেই সাথে তারা মূলের উপর মানুষকে তুলে আনার জন্যও মেহনত করেছেন। এবং মূল সমাধান হলো উপরের তত্ত্বটি মানুষকে বোঝানো।
♦ কেন ফর্মের দ্বিতীয় ধাপ
এরপর,
প্রশ্নের কেন ফর্মের আরেকটা ধাপ হলো—মাসায়েলের ইল্লত বা হেকমত বের করার জন্য। এটা প্রশংসিত এবং কাঙ্খিত।
.এ হলো ‘কেন’ ফর্মের প্রশ্ন নিয়ে মৌলিক আলোচনা। এর বাইরে কেন ফর্মের আরেকটা নির্দোষ অংশ আছে।
♦ কেন ফর্মের তৃতীয় ধাপ
একে আমরা বলতে পারি সুওয়ালে ইবরাহীমী। এটা আত্মার প্রশান্তির জন্য। এখানের ভঙ্গিটা এমন যে, যদি জানতাম তাহলে ভালো লাগতো, না জানলেও ক্ষতি নেই, খেদ তো নেই-ই। বরং بلى শব্দের বলিষ্ঠ উচ্চারণে আমার আনুগত্য সংশয়হীন।
এ মনোভাব থেকেই পণ্ডিত ও হৃদয়জগতের প্রাজ্ঞ মুসাফিরগণ নিজেদের বইপত্র ও বক্তব্যে নানা জবাব দিয়ে গেছেন।
এ ক্ষেত্রেও লক্ষণীয় হলো—যে কোন রকম প্রশ্নকে এই স্তরের মর্যাদা দেওয়া যায় না। বিনয়নত হৃদয় নিয়ে করা সেসকল প্রশ্নই এ মর্যাদা পায়, যা অযথা নয়। যার উত্তরের মধ্যে সুস্থ রুচির মানুষের জন্য সত্যিই প্রশান্তি ও শিক্ষা রয়েছে।
পোস্টে যে প্রশ্ন করা হয়েছে, আমার বোধমতে তা অনর্থক প্রযোজনরহিত। কিন্তু, তবু কিছু মানুষ থেকে যাবে, যারা বিনয়নত হয়েই এমন ধারা প্রশ্ন করে যাবে, তাদেরকে জবাব না দিয়ে এই প্রশ্নতত্ত্বটি সহজ ভাষায় বুঝিয়ে দিতে হবে।
♣ প্রশ্নের “কী ফর্ম”
প্রশ্নের দ্বিতীয় ফর্ম হলো— কী ফর্ম। এটা প্রয়োজন পরিমাণে প্রশংসিত। এবং এর ক্ষেত্রেই বলা হয়—‘প্রশ্ন জ্ঞানের অর্ধেক’; ‘অজ্ঞানতার অষুধ হলো প্রশ্ন করণ’।
এ প্রয়োজনের লিমিট কী? এটা সবার জন্য একরকম হবে না। আলেম ও তালেবুল ইলমের লিমিট একরকম, সাধারণ মানুষের লিমিট এক রকম। মেধা, উপলব্ধিক্ষমতা, জ্ঞান ইত্যাদি অনুযায়ী এর লিমিট উঠানামা করবে। এখানে লিমিটের বাইরে হলে, ক্ষতিকর নয়; কিন্তু অপ্রয়োজনীয়তার দোষে দুষ্ট।
এই যে, প্রশ্নের নানা পর্যায় ও নানা ধরণ, এবং এর একেকটির জন্য একেকরকম সিদ্ধতা ও অসিদ্ধতা—এর কারণেই প্রশ্নের প্রশ্নে কুরআন ও হাদীসের বক্তব্য বিভিন্ন রকমের দেখা যায়।
কোথাও আনসারী মহিলাদেরকে প্রশ্নের সাহসিকতার জন্য প্রশংসা করা হচ্ছে, কোথাও প্রশ্নের কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেহারা রক্তিম হয়ে যাচ্ছে। কুরআনুল কারীমের কোথাও দেখা যায়, প্রশ্নের বিস্তারিত জবাব আল্লাহ তাআলা দিচ্ছেন, আবার কোথাও জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করছেন। কোথাও তিরস্কার করছেন। মনে করুন, বনী ইসরাইলে গরু জবাইয়ের ঘটনা কি এমনি এমনি বললা হয়েছে?
এ ছিলো ধর্মীয় বিষয়ে প্রশ্নতত্ত্বের বিশ্লেষণ।
[দুই.] জাগতিক বিষয়ের প্রশ্ন
এর বাইরে জাগতিক বিষয় নিয়ে “কেন ফর্ম” বা “কী ফর্ম”—যেরকমই হোক, প্রশ্নের প্রবণতা ও অনুসন্ধিৎসায় ইসলামের না নেই। এ অনুসন্ধিৎসা বরং আল্লাহর সৃষ্টির নিপুনতা ও তাঁর প্রভুত্বকেই শক্তিশালি করে। এবং ইসলামের কোন বক্তব্য বাস্তবতার বিপরীত না হওয়ার কারণে জাগতিক বিষয়ে কোন প্রশ্ন ও অনুসন্ধিৎসাকেই ইসলাম ভয় পায় না।
কিন্তু, একটা কথা সবসময় মাথায় রাখতে হবে—জাগতিক বিষয়েও প্রশ্ন হতে হবে সৎ উদ্দেশ্যে এবং এ প্রশ্নের পিঠে একটি কল্যানপ্রাপ্তির সম্ভাবনা থাকতে। কেননা, অর্থহীন সমস্ত কাজই পরিত্যাজ্য।
ফুটনোট :
কেউ বলতে পারেন, কিছু মানুষ আছে তাদেরকে শুরুতেই মূল জিনিস বুঝানো যায় না; সাময়িক উত্তর দিয়ে হাত রাখতে হয়, এবং ধীরে ধীরে মূলটা বুঝাতে হয়।
তো, এটা আমি স্বীকার করি। কিন্তু, প্রথম কথা হলো—এটা যেন শুধু চিন্তার ভেতরেই না থাকে; কার্যকরও যেন হয়। কিন্তু, আমার ইদানিংকার অবজার্ভেশন হতাশার। চারদিকে শুধু জবাবের চর্চা দেখি। প্রশ্ন-তত্ত্ব নিয়ে আলাপ নজরে পড়ে না তেমন।
তাছাড়া, সব প্রশ্নের ক্ষেত্রে কাছে আনো নীতি সঠিক মনে হয় না। কিছু প্রশ্ন আছে, হিকমাহমূলক জবাব দেওয়া যায়, এবং জবাব দেওয়ার পর যে সূক্ষ্ম একটি শিক্ষা সামনে আসে, তা উপকারী হয়। কিন্তু, বেশিরভাগই দেখা যায় এমন নয়; অজ্ঞতা ও হঠকারিতা থেকে অযথা প্রশ্ন। এগুলো সম্পূর্ণ এড়িয়ে যাওয়াই উচিত। যেমন, আল্লাহর পক্ষে ঘুমানো, মিথ্যা বলা ও স্বপ্ন দেখা সম্ভব কিনা? জাহান্নামের চেয়ে জান্নাতের সংখ্যা বেশি কেন? আল্লাহ নিজেকে নিজে ধ্বংস করতে পারবেন কিনা? এমন প্রশ্ন আমাকে কেউ করলে আমি সোজা বলে দিই, এইডা আমারে জিগান ক্যা? আল্লাহরে জিগান।