অভ্যস্ততা খুবই অবাককর একটি বিষয়। এই অভ্যস্ততার পিঠে আসে স্বাভাবিকতা। এ দুটোকে নানা দিক থেকে বিচার করা যায়। তবে এসবের মধ্যে বিশেষ খারাপ একটি দিক হলো এটি আমাদের বোধ ও উপলব্ধির ভেতরে এক ধরণের নিস্ক্রিয়তার তৈরী করে। আমাদের মুগ্ধতার গুনটিকে মেরে ফেলে সে স্থলে ভিত্তিহীন একটি যৌক্তিকতাকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলতে চায়। অথচ যৌক্তিকতা একটি কাকতালীয় ব্যাপার মাত্র, যা ঘটে গেছে এবং এরকম করে না ঘটলে এটি কোন সিদ্ধতাই পেত না; এমনকি এ নিয়ে কেউ মন খারাপও করতো না।
অভ্যস্ততা মানে পুনঃপৌনিকতার ভেতর দিয়ে কোন কিছুতে নিজেকে সহজলভ্য করা। স্বাভাবিকতা মানে মানুষ, প্রাণী বা বস্তুর কোন কাজ, আচরণ, স্বভাব, প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি সচরাচর একই রকম করে ঘটা। যৌক্তিকতা মানে, স্বাভাবিকতার ভেতর দিয়ে আমরা যে নিয়মকে ধ্রুব বা প্রায়ধ্রুব বলে স্বীকার করি, কোন কিছু সে নিয়ম মেনে প্রকাশিত হওয়া।
অভ্যস্ততা, স্বাভাবিকতা এবং এ দুটোর আশ্রয়ে গড়ে উঠা যুক্তির বৈধতা—এগুলো কিন্তু মৌলিকভাবে খারাপ কিছু নয়। তবে, এসবে অতি মাত্রায় আসক্তি আমাদের বিস্ময়বোধকে নষ্ট করে এবং আমাদের বোধ ও উপলব্ধিগত নানা অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়ে বসে। এটা খুবই খারাপ কথা।
যেমন, আমরা যখন কোন কিছুকে একই নিয়মে বার বার ঘটতে দেখি তখন আমরা তেমন একটা গা করি না। বলি— এ আর এমন কি, এটা তো স্বাভাবিক। অর্থাৎ আমরা বিস্মিত হই না। এখানে এসেই প্রশ্ন উঠে—স্বাভাবিকতার ব্যাপারটি আসলে কতটুকু স্বাভাবিক? আমার সর্বদাই মনে হয় এ জগতের সবকিছুই গভীর রকমের বিস্ময়কর।
যেমন, মানুষ মুখ দিয়ে কথা বলে। অভ্যস্ততার বাইরে গিয়ে আপনি নির্মোহভাবে চিন্তা করে দেখুন তো, এটা কী রকম মারাত্মক বিস্ময়কর একটি ব্যাপার? দুজন মানুষ যখন মনোযোগ দিয়ে কথা বলে আমি গভীর আনন্দ নিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকি। এতো সুন্দর আর অপার্থিব লাগে দৃশ্যটা! আজকে মুখ দিয়ে কথা বলা আমাদের কাছে স্বাভাবিক। এটা নিয়ে আমরা বিস্মিত হই না। কিন্তু যদি কেউ যদি হাতের তালু দিয়ে কথা বলতে শুরু করে তখন কিন্তু বিস্ময়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলবো।
অথচ, শুরু থেকেই যদি সকল মানুষ হাতের তালু দিয়ে কথা বলতো, তাহলে এটাই আমাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হতো। সে সময় কেউ মুখ দিয়ে কথা বললে আমরা বিস্ময়ে থতমত খেয়ে যেতাম। অতএব, হাতের তালু দিয়ে কথা বলা যেমন বিস্ময়কর, ঠিক ততটুকু বিস্ময়কর মুখ দিয়ে কথা বলার ব্যাপারটি। কিন্তু হই না কারণ আমরা এতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি।
যারা মুজিজা ও কারামতের ব্যাপারে উশখুশ করেন, অস্বস্তিবোধ করেন, আর মাথা চুলকে বলেন, এসব তো অস্বাভাবিক, ব্যাখ্যাহীন। কীভাবে সম্ভব? তো, তারা যে স্বাভাবিকতার উপর দণ্ডায়মান হয়ে এগুলোকে অস্বাভাবিক বলছেন, তাদের সে স্বাভাবিকতার ব্যাখ্যা কী? ইবরাহীম আ.-কে আগুনে না পোড়ানোটা অস্বাভাবিক, পোড়ানোটা স্বাভাবিক। প্রশ্ন হলো-পোড়ানোটা স্বাভাবিক কেন? অর্থাৎ আগুন পোড়ায় কেন? এর মাঝে এই আছে; সেই আছে। এই-সেই থাকলেই পোড়াতে হবে কেন? এর কোন ব্যাখ্যা নাই।
একমাত্র ব্যাখ্য হলো— এগুলো হলো সুন্নাতুল্লাহ। জগত পরিচালনায় আল্লাহ তাআলার সাধারণ নিয়মাবলী। আল্লাহ তাআলা একটা সাধারণ কার্যকারণের সূত্রে এবং অহরহ ঘটা কিছু রীতিতে সমস্ত প্রাণী ও বস্তুকুলকে বেঁধে দিয়েছেন। এই স্বাভাবিকতার ভেতর দিয়ে আমরা একটা শৃঙ্খলা ও নিয়মকে আবিস্কার করি এবং সেসব নিয়মের আওতায় নানা কিছুকে ঘটতে দেখি। এগুলো খুবই মুগ্ধকর এবং সাংঘাতিক রকমের বিস্ময়কর। এইসব কার্যকারণ ও রীতিগুলোর মত আল্লাহ তাআলার প্রতিটি সৃষ্টিও সীমাহীন বিস্ময়কর। ফলে তার সৃষ্টি ও জগতের বিষয়াশয়ের মধ্যেই রয়েছে তাঁর বিদ্যমানতা ও নানা গুণাবলীর নির্জলা প্রমাণ।
কিন্তু, অনেক সময় আমাদের অভ্যস্ততা এসব নিয়ে সঠিক মাত্রায় মুগ্ধ ও বিস্মিত হবার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এ জন্য আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারীমে বার বার আমদেরকে তার সৃষ্টির দিকে তাকিয়ে দেখতে বলেছেন। নানা কার্যকারণের দিকে আকৃষ্ট করেছেন। মানুষ তো এসব দেখেই আসছে, তবু কেন বারবার নতুন করে দেখতে বলা হচ্ছে। কারণ, আমরা দেখি অভ্যস্থতার ভেতর থেকে বিস্ময় ও ভাবনাহীনভাবে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে চিরাচরিত অভ্যস্ততার বাইরে গিয়ে নির্মোহভাবে দেখতে বলেছেন। এভাবে মূল থেকে তাকালেই কেবল আমরা বিস্মিত হয়ে আল্লাহ তাআলার মহিমাকে আবিস্কার করতে পারি।
তো, সুন্নাতুল্লাহ হলো আল্লাহ তাআলার শক্তি ও মহিমার চিরাচরিত প্রকাশ। তবে, অভ্যস্থতার বাকল ফাটিয়ে আমাদেরকে বিশেষভাবে ঝাঁকুনি দেওয়ার জন্য তিনি মাঝে মাঝে চিরাচরিত সাধারণ নিয়মের বাইরেও যান। সেগুলোকে আমরা বলি—কুদরাতুল্লাহ।
সুতরাং কুদরাতুল্লাহ যেমন বিস্ময়কর, সুন্নাতুল্লাহও বিস্ময়ক। বিস্ময়কর তার সমস্ত সৃষ্টিও। অভ্যস্ততার চাদর যেন আমাদের এ বিস্ময়ের পথে বাধা না হয়ে দাঁড়ায়। আমরা যেন সবগুলো থেকেই শিক্ষা নিতে পারি। আর, সত্য সংবাদের মাধ্যমে পাওয়ার পরও কোন মুজিজা বা কারামাতের কথা শুনে যারা “স্বাভাবিক নয়; এর তো কোন ব্যাখ্যা নাই”-বলে একে নাকচ করতে চায় তারা আরো মূল থেকে ভাবুক এবং স্বাভাবিকতা, যৌক্তিকতা ইত্যাদির গ্রহণযোগ্য কোন ব্যাখ্যা দিক।