০ সূচনা
বাংলাদেশে প্রতিকুল ফ্যাসিবাদী পরিবেশে বিএনপি ও অন্যান্য দল যেভাবে ফাইট দিয়েছে, এর জন্য আমি তাদের প্রশংসা করি। আসলে খুব কিছু তাদের করারও ছিল না। সামনে কিছু করতে পারবে বলেও মনে হয় না। তাদের এই সংগ্রামের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কয়েকটি কথা বলছি।
০ রাজনৈতিক দল ও আদর্শহীনতা
দলীয় সংবিধানে যা-ই থাক, চর্চাগত দিক থেকে আওয়ামীলীগ বা বিএনপির শক্তিশালী দলীয় কোন আদর্শ নাই। তারা মূলত ক্ষমতার চর্চা করে এবং ক্ষমতা সাপ্লাই দেয়। একেবারে মূল নেতৃত্ব থেকে নিয়ে সাধারণ কর্মী পর্যন্ত সকলের রাজনৈতিক সক্রিয়তা-নিষ্ক্রিয়তা মূলত ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে ঘুরপাক খায়। এখানে ক্ষমতা মানে স্বার্থ ও প্রবৃত্তি পূরণের নিশ্চয়তা। এটাই মূল। সাথে উপ-প্রনোদনা হিসেবে আরো কিছু বিষয় কাজ করে। যেমন, কোন গোষ্ঠির প্রতি বিদ্বেষ পূরণের সুযোগপ্রাপ্তি, নিজেদের যাপিত জীবনধারার উপর আক্রমণের ভয় ইত্যাদি।
এর বাইরে ন্যায্যতা, দেশপ্রেম, সার্বভোমত্ব রক্ষা, মানবিকতা, সমাজের সকল মানুষের অধিকার রক্ষা ইত্যাদি—যেগুলোকে আদর্শ হিসেবে দেখানো হয়, এগুলো চলমান রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের কাছে পার্টটাইম জবের মত। ক্ষমতার নিশ্চিতির পর ক্ষমতাশীনরা সুযোগ হলে নিজের মত করে তারা এসব পালন করে। এবং পালন করার চেয়ে এগুলোকে বেশি ব্যবহার করে। আর, নিগৃহিত বিরোধী দলটি নিগৃহের ভেতর থেকে এসবকে কিছুটা উপলব্ধি করে। কিন্তু, ক্ষমতাশীনদের ক্ষমতাও এগুলোর জন্য না, এবং বিরোধীদলের সংগ্রামও মোলিক অর্থে এসবের জন্য না। মূলত ক্ষমতার জন্য। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী ধারাটিও মূলত এই আবহেই আছেন। কারণ, তারা রাজনৈতিক কর্মী-ই, একটু ভিন্ন প্রকৃতির—এই যা।
০ দেশের শিক্ষিত মানুষ ও সাধারণ জনগণের অবস্থান
দেশের শিক্ষিত কিছু মানুষ আছেন, যারা মানবিকতা, সার্বভোমত্ব এবং অধিকার নিয়ে চিন্তিত হন। ফ্যাসিবাদ কায়েম হলে সমাজের অসহায় চেহারাটি কল্পনা করে তাদের কষ্ট লাগে এবং অনিরাপদ বোধ করেন। কিন্তু, তারা মাঠপর্যায়ে সক্রিয় না। নিরাপত্তার ভেতরে থেকে তূলনামূলক ভালোটা দেখে তারা সমর্থন দিয়ে নিজেদের দায়িত্ব আদায়ের চেষ্টা করেন।
এর বাইরে সমাজের সাধারণ মানুষ নিজে, নিজের পরিবার ও সামান্য দূর পর্যন্ত নিজের আশপাশ ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে ভাবিত না। ফলে, রাজনৈতিক সূত্রে তারা হিসাবের ভেতরে নন। তবে, তারা রিজার্ভ ফোর্স। পরিশ্রম করলে এদেরকে ব্যবহার করা যায়।
০ রাজনৈতিক কর্মীদের সংগ্রাম-শক্তির উৎস
এখানে একটা বিষয় আছে, রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের যদি সমাজের প্রতি কোন গুডকমিটমেন্ট এবং আদর্শিক চেতনা না থাকে, তাহলে তারা ভীষণ প্রতিকূল সময়ে কীভাবে রক্ত, জীবন ও নিরাপত্তা বিসর্জন দিচ্ছেন? এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
আমি মনে করি, এখানে দুইটা বিষয় কাজ করে। এক হলো, ভবিষ্যতে ক্ষমতাপ্রাপ্তির সম্ভাবনা এবং বিরোধী পক্ষের সাথে রাজনৈতিক সূত্রে সৃষ্টি হওয়া দ্বন্ধের টান। এটা একটা স্বয়ংক্রিয় শত্রুতা। একবার শুরু হয়ে যাওয়ার পর মূল সূত্রটি বিদ্যমান থাকা পর্যন্ত স্ব-প্রণোদিত হয়ে সামনের দিকে চলতে থাকে। অবশ্য, ক্ষমতাপ্রাপ্তির সম্ভানা ফুরিয়ে গেলে, দ্বন্ধের প্রণোদনাটি নিজে থেকে ঝিমিয়ে যায়। কারণ, এটা চলতে থাকার জন্য মিনিমাম একটা নিরাপত্তার নিশ্চয়তার দরকার। সেটা তো তখন থাকে না।
০ বাংলাদেশের ভবিষ্যত
সে আলোকে, বর্তমান বাংলাদেশে আওয়ামীলী আগের চেয়ে আরো শক্তিশালী হয়ে বলা যায় ফ্যসিবাদ পুরোপুরি কায়েম করে ফেলেছে। সুতরাং, বিরোধীদলের ক্ষমতা প্রাপ্তির সম্ভাবনাও অনেক কমে এসেছে।
এর পরিণতি হলো—
– সাধারণ মানুষ নিজেদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট হয়ে থাকবে। নানাসূত্রে তাদের উপর যে জুলুম হবে, সেগুলো মুখবুজে সহ্য করে যাবে। কিছু বলবে না।
– বুদ্ধিজীবী শ্রেণীটি আরো বেশি নির্লজ্জ হয়ে যাবে। নিজেদের গৃহপালিত ভাবটি ঢেকে রাখার চেষ্টাও করবে না। আর, প্রতিশ্রুতিশীল ও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ বুদ্ধিজীবীগণও রাজনৈতিক সাপোর্ট না থাকায় নীরব হয়ে যাবেন।
– বিরোধীদলও তাদের রাজনৈতিক প্রণোদনাগুলো না থাকায় নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে, অনেকে আন্ডারগ্রাউণ্ডে চলে যাবে। এরপর যে উপস্থিতিটা থাকবে, সেটা নিয়ন্ত্রিত বিরোধীতা। ফলে ফলাফলশূণ্য।
সুতরাং,
নিকটভবিষ্যতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক কোন ভবিষ্যত নাই। এবং এই ভবিষ্যতহীনতা যে শুধু বাংলাদেশেই এসেছে এমন নয়, পৃথিবীর বহু দেশে বহুবার এসেছে।
০ সমাধান কী?
আমি মনে করি এক শব্দে এর সমাধান হলো—আদর্শিক স্পিরিট, যা ক্ষমতাপ্রাপ্তির সম্ভাবনা বা স্বয়ংক্রিয় রাজনৈতিক শত্রুতার সাথে সম্পৃক্ত নয়; বরং, একান্ত এবং মোলিক।
০ সম্ভাব্য আদর্শিক স্পিরিট
আমাদের সামনে দুইটা স্পিরিট আছে। নিছক দেশ ও সমাজ কেন্দ্রিক আদর্শিকতা। আকেটা হলো ধর্মীয়। বিএনপি যদি কোন স্পিরিট তৈরী করতে চায়, তাহলে নিছক দেশ ও সমাজ কেন্দ্রিক আদর্শিকতাই নিবে। কারণ, তারা ধর্মীয় স্পিরিটের প্রবক্তা নয়। কিন্তু, রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতার চর্চা করে-করে এখন এমন অবস্থায় আছে, যে নেতা ও কর্মীদেরকে আবার নতুন করে সত্যিকার অর্থে আদর্শিক কোন স্পিরিটে তুলে আনা কোন মিরাকল ছাড়া অসম্ভব। এর বাইরে এই স্পিরিট নিয়ে দাঁড়ানোর মত অন্য কোন দলও দৃশ্যমান নয়। বাকি রইলো, ধর্মীয় স্পিরিট।
এখন ধর্মীয় স্পিরিট মানে কী, এটা আমাদেরকে বুঝতে হবে। রাজনৈতিক সূত্রে ধর্মীয় স্পিরিট মানে ধর্মও আবার দেশ ও সমাজ কেন্দ্রিকতাও। এক একসাথে এভাবে বলা যায় দেশ ও সমাজ কেন্দ্রিক ধার্মিকতা। আমি মনে করি, বাঙলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপট তৃণমূল পর্যায়ে ধর্মপ্রধান হওয়ার কারণে ধর্মীয় স্পিরিটটাই বিজয়সম্ভব।
০ ইসলামী দলগুলোর অবস্থান
মুশকিল হলো, বাঙলাদেশের ধর্মীয় দলগুলো বক্তব্যে আদর্শিক স্পিরিটের কথা মুখে বললেও এখন পর্যন্ত বিস্তারিত আকারে মানুষকে নিজেদের বক্তব্যটি বুঝাতে পারে নাই, এবং নিজেদের দক্ষতা ও বিশ্বস্ততার ব্যাপারে গণমানুষকে আশ্বস্ত করতে পারে নাই। এখানে তাদের নানা সীমাবদ্ধতা আছে এবং নিজেদের অনেক দোষত্রুটি আছে, আমি সেই দিকে যাইতেসি না। কিন্তু, শেষ কথা এইটাই যে তাদের উপর মানুষ রাজনৈতিকসূত্রে নির্ভর করতে রাজি নয়। ফলে, ইসলামি বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে নিরাপত্তার অনিশ্চয়তা আছে, সে-কারণে দেখা যায়, তাদের মধ্যে অসংহতি ও অস্থিরতা আছে। এবং ফলে ইসলামপন্থি তরুণদের মধ্যেও এটা আছে।
০ করণীয়
এ জন্য আমি মনে করি বর্তমানে দীর্ঘ মেয়াদী এবং বিস্তৃত, সুবিন্যস্ত ও বাস্তববাদী পরিকল্পনার মাধ্যমে এই দেশে একটি ইসলামী গণআন্দোলন ও গণবিপ্লবের উজ্জ্বল সময়। যে বিপ্লব শুধু রাষ্ট্রে ইনসাফ ও ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য হবে না; বরং, ব্যাক্তি ও রাষ্ট্র উভয়কে পরিশুদ্ধ করার জন্য চতুর্ভুজ-আকারে পরিচালিত হবে। ঠিক যেভাবে নবীযুগে হয়েছিল৷ একে আপনি খেলাফত কায়েমর আন্দোলন বলেন আর ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম-বলে নাম দেন।
চলমান “মন্দের ভালো” আর “আখাফ্ফুদ্দারাইন”- তত্ত্ব কোন মৌলিক সমাধান নয়; উপস্থিত পরিস্থিতি সামাল দেওয়া মাত্র৷ এ থেকে বেরিয়ে আসার সময় হয়েছে।
এর জন্য ইসলামপন্থি রাজনৈতিক ও অ-রাজনৈতিক লোকদের মধ্যে একটা সুন্দর বোঝাপড়া দরকার এবং এটাই বর্তমান পরিস্থিতির একমাত্র সমাধান।
সেই বিপ্লবের রূপরেখা এবং বোঝাপড়া কীভাবে হইতে পারে? দেখা যাক৷