দেশপ্রেম নিয়ে যখন লেখতে বসলাম, টের পেলাম সংগোপনে আমার মস্তিষ্কের মধ্যে কিছু প্রশ্ন তৈরী হয়েছে— দেশ কী? একে প্রেম করার মানে কী? এবং এই প্রেমটি আমাকে কেন করতে হবে? দেশপ্রেমের মত একটি স্বতঃস্ফুর্ত, কোমল ও আবেগঘনিষ্ঠ বিষয়ের সূত্রে এমন বেখাপ্পা প্রশ্নগুলোর কারণে আমি ভেতরে ভেতরে কিছুটা বিব্রত বোধ করলাম। এখন, এই স্বতঃপ্রণোদিত প্রশ্নগুলোর অমার্যাদা আমি করব না ঠিক, কিন্তু এই প্রশ্ন-দেয়ালের উপর দিয়ে ঘাড় উঁচু করে আমি যে কথাটা শুরুতেই বলতে চাই—আমি দেশকে ভালবাসি। এ আমার মাটি এবং আমার শেকড় গেঁথে আছে এর গভীর তলদেশে। সহস্র বছর ব্যাপী আমার পূর্বপুরুষের ক্ষয়িত দেহাবশেষ দিয়ে উর্বর হয়েছে এ মাটির শরীর।
এবার প্রশ্নগুলো নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করা যাক। আমরা যে জায়গা থেকে দেশ নিয়ে আলোচনা করতে বসেছি, এখানে প্রসঙ্গত আরো দুটো শব্দ সংযুক্ত রয়েছে—মাতৃভূমি ও জন্মভূমি। এ তিনটি শব্দই এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এগুলোর পূর্ন পরিচয়ের মাধ্যমেই কেবল আমার ‘প্রেম’টির পরিচয় পূর্ণতর ও প্রস্ফুটিত হয়ে উঠতে পারে।
জন্মভূমি
খুব আক্ষরিক অর্থ ধরলে জন্মভূমি মানে হলো যে চার-পাঁচ হাত জায়গাতে আমার ভূমিষ্ঠকার্যটি সম্পাদিত হয়েছে, সেটুকুই। কিন্তু জন্মভূমি শব্দটিকে আমি অবশ্যই এতো সংকীর্ণ অর্থ দিয়ে ব্যখ্যা করতে পারি না। কারণ, আমার জন্মটি স্বার্থক হয়ে উঠার জন্য আরেকটু বিস্তৃত পরিসরের দরকার পড়েছে। কিন্তু এর সীমানাটি কতদূর? জীবনকে ধারণ করবার প্রয়োজনে আমাকে পদসঞ্চালন করতে হয়েছে, শুইতে বসতে হয়েছে এবং একটা পরিসরের নানা অঞ্চলে বারংবার গমন করতে হয়েছে, সম্পর্কে জড়াতে হয়েছে নানান মানুষের সাথে। এভাবে মোটামুটি বড়সর একটা অঞ্চলকে ঘিরে আমার স্মৃতি ও সম্পর্কগুলো, প্রয়োজন ও পরিচয়গুলো গড়ে উঠেছে। আমার জীবনের এই যে সচলতা, এটি কিছু সময় ও স্থানের সাথে সংযুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে আমার একটা কেন্দ্র ছিল, যাকে ঘিরে আমি বার বার আবর্তিত হয়েছি—আমার বাড়ি। জন্মের অর্থ যদি আমার অস্তিত্বকে বুঝি, তাহলে নিরেট অর্থে জন্মভূমি বলতে আমি আমার বিস্তৃতির এই অঞ্চলগুলোকেই সত্য বলে অনুভব করি
জন্মভূমির মায়া
এগুলোর প্রতি আমার হৃদয়ের ভেতর এক গভীর টান, মায়া ও আকুলতার উপস্থিতি টের পাই। একই সাথে আমার আশ্রয় ও জীবনের আধার হিসেবে এর প্রতি একটা দায়িত্বশীলতার অনুভূতিও সৃষ্টি হয়েছে। এই অঞ্চলগুলোর প্রতি আমার হৃদয়ের যে স্বভাব-টান, স্মৃতির সম্পৃক্ততায় মায়া ও আকুলতা, বসবাসের সূত্রে পৃথিবীর আর কোন ভূখণ্ডের প্রতি আমি তা উপলব্ধি করি না। এই ব্যখ্যার আলোকে, ভূমিষ্ঠ হওয়ার সেই চার-পাঁচ হাত জায়গাটিও অনেক সময় মহিমা হারাতে পারে। ধরা যাক, আমার জন্ম হয়েছে ইংল্যান্ডে, কিন্তু দুয়েকদিন পরেই আমি বাংলাদেশে চলে এসেছি ও এখানেই বড় হয়েছি। এখন, আমার জন্মভূমিগত আবগটি কোন ভূমিকে কেন্দ্র করে গঠিত হবে? এর বিপরীতে একটা ছেলের জন্ম হলো বাংলাদেশে, কিন্তু এর পর পর সে ইংল্যান্ডে চলে গেল—তার জন্মভূমি সংক্রান্ত আবেগটি কোন ভূমিটির সাথে সংযুক্ত হবে? আমি যেটা বুঝাতে চাচ্ছি, আমার জন্ম হবিগঞ্জের একটা গ্রামে, ফলে জন্ম ও বেড়ে উঠার সাথে সম্পৃক্ত আবেগ ও মায়ার দিক থেকে আমার বিস্তৃতির বাইরে বাংলাদেশের যশোর অঞ্চলটি যেমন, আমেরিকার একটি শহরও তেমন। কোনটিই আমার জন্মভূমি নয়, মায়া ও আবেগের ভূমিও নয়। ফলে, কোন কাজে যশোর গিয়ে সেখান থেকে বহু বহু দিনের জন্য চলে আসতে আমার কষ্ট হবে না। বিশেষ কোন কারণে যদি কষ্ট হয়, তাহলে এমনটি আফ্রিকার কোন শহরের বেলায়ও ঘটতে পারে। কিন্তু দীর্ঘদিনের জন্য আমার গ্রামটি ছেড়ে চলে যেতে আমার কষ্ট হবে। ঠিক এ আবেগটিই হলো জন্মভূমির মায়া। স্মৃতি ও সম্পর্কের টান। এই বাস্তব দৃষ্টিকোণ থেকে পুরো বাংলাদেশ আমার জন্মভূমি নয়; সুতরাং জন্মভূমির প্রতি প্রেমবোধটি পুরো বাংলাদেশের উপর প্রজোয্যও নয়। এই প্রজোয্য না-হওয়াটা স্বভাবজাত ও অনতিক্রম্য বাস্তবতা। এর মানে হলো–জন্মভূমির প্রতি মায়া আর দেশপ্রেম দুইটি দুই জিনিস। একটি দিয়ে আরেকটিকে প্রকাশ করা যায় না। দেশপ্রেমকে সকলে মিলে উদযাপন করতে পারলেও, জন্মভূমির প্রতি মায়াকে সম্মিলিতভাবে অনুভব করা সম্ভব নয়। এ অনুভব প্রত্যেকের আলাদা ও নিজস্ব।
জন্মভূমির মত মাতৃভূমির ধারণাটিও প্রায় হুবহু এক।
দেশ
আমি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র নই, ফলে দেশের একাডেমিক কোন সংজ্ঞা দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি কোন বিষয়ে অভিজ্ঞতার চেয়ে বড় রেফরেন্স আর নেই। ফলে, একাডেমিক সংজ্ঞার চেয়ে আমার অভিজ্ঞতার ভেতরে দেশের যে সংজ্ঞা প্রকাশিত আছে, তা অধিকতর শক্তিশালি ও নিখাঁদ। বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত অর্থে দেশ বলতে আমি বুঝি সুনির্দিষ্ট একটা ভূমিপরিসর এবং এর ভেতরে অনেক মানুষের সম্মিলিত জীবনযাপনের ব্যবস্থাপনা ও আয়োজন। আমার জীবিকার প্রয়োজন, শান্তি ও নিরাপত্তার প্রয়োজন, প্রয়োজন শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান, ধর্ম পালনের স্বাধীনতা, অবাধ গমনাগমন ও ইত্যাদি। এসবের প্রাপ্তির মাধ্যমে আমি একটা স্বচ্ছন্দ ও জীবনানন্দকে লাভ করতে চাই। মানবিক এই আকাঙ্খাগুলোর সূত্রে অনেকগুলো আমি একত্রিত হয়ে যথাসম্ভব বিস্তৃত একটা ভূমিকে চিহ্নিত করেছি সম্মিলিত চেষ্টার ক্ষেত্র হিসেবে। সম্মিলিত এই চেষ্টার শৃঙ্খলার জন্য প্রয়োজন একটা নিয়ন্ত্রণ-ব্যবস্থা, সকলে মান্য করে চলবে এমন কিছু মূল্যবোধ, এবং কিছু কমিটমেন্ট। আর, এই ঐক্যের প্রদর্শন ও চিহ্ন হিসেবে দরকার একটা পতাকার। সুতরাং, প্রচলিত অর্থে আমার কাছে দেশ মানে একটি বড়সর সংগঠন, যার কাজ হলো অনেক মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও ঐক্যকে গড়ে তোলা। পতাকা হলো সে সদস্যগণের একটি চুক্তিপত্র।
যেহেতু এই সম্মিলিত আয়োজন আমার মানবিক ও মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করবে, এই ব্যবস্থাপনা ভেঙ্গে পড়লে আমরা নিদারুণ এক আত্মকলহে লিপ্ত হবো এবং অন্য কোন দখলদার শক্তির করালগ্রাসে প্রবিষ্ট হবো, তাই এই স্বাধীনতা আমার অস্তিত্বের জন্য একান্ত জরুরী। এ কারণেই আমি যেমন আমার অস্তিত্ব রক্ষার জন্য নিজের সবটুকু বিলিয়ে দিতে রাজি, তেমনি এই স্বাধীনতা রক্ষার জন্যও সংকল্পে মুষ্ঠিবদ্ধ। এ মাটি আমার জীবনের আধার, তাই একে রক্ষার জন্য আমি সংগ্রাম স্পৃহায় উজ্জিবীত। এই সংগ্রাম স্পৃহা শুধু বাইরে থেকে আগত জালিম শক্তির বিরুদ্ধে নয়, ভেতরের শান্তি ও নিরাপত্তা বিনষ্টকারী দস্যুদের জন্যও। দেশের সকল মানুষ গভীর বিশ্বাস নিয়ে আমার সাথে নাগরিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে, এবং আমাকে নিরাপত্তা দিয়ে নিজের জন্য নিরাপত্তার আকুতি জানিয়েছে, তাদের নিষ্কণ্টক জিন্দেগির জন্য আমি জীবন দিতে প্রস্তুত আছি।
আমি দেশপ্রেম বলতে এটুকুই বুঝি—এই প্রতিশ্রুতি, দায় ও এর বাস্তবায়নের জন্য বিবেকের চাপ; আমার সাথে চুক্তিবদ্ধ মানুষগুলোর প্রতি মায়া ও তাদের আকুতির প্রতি সম্মানবোধ এবং নিরাপত্তার সাথে বাধাহীনভাবে দেশের যে কোন জায়গায় গমন-সুবিধার কারণে অঞ্চলগুলোর প্রতি এক ধরণের আপনত্ববোধ। এবার একে কেউ যদি একশব্দে ‘দেশপ্রেম’ বলে অভিহিত করতে চায়, আমার আপত্তি নেই। দেশ আমার কাছে একটা অতীব গুরুত্বপূর্ণ জীবন-উপকরণমাত্র; এর বাইরে দেশকে আমি পুজনীয়, বা গদগদে ভক্তি প্রকাশের মত কোন স্বয়ং-পবিত্র সত্তা হিসেবে বিবেচনা করি না। এই দেশের পতাকাকেও আমি পুজনীয় কিছু মনে করি না। এটি একটি চুক্তিপত্রের মতই একান্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা পারস্পরি শান্তি নিরাপত্তা ও মানবিক আকাঙ্খাগুলোর ব্যাপারে আমাদের ঐক্যের জানান দেয়। ফলে, একটা ব্যবসায়িক চুক্তিপত্রকে আমি যেমন শ্রদ্ধা করি, তেমনি এর প্রতিও আমার শ্রদ্ধাবোধ আছে। এবং খুবই পরিস্কার যে, কাপড়ের ছোট্ট একটি টুকরার নিজের মধ্যে কোন মহিমা নেই; এর প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ হলো সেই কমিটমেন্ট ও এর সাথে নেপথ্যে সংযুক্ত লোকসমূহের প্রতি, তাদের সাথে আমার সহাবস্থানগত লেনদেনের প্রতি।
এমনিভাবে একান্ত রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনাগত সীমানা আমার ভেতরে আপন-পর এর কোন ধারণাও জন্ম দেয় না এবং সীমানাকেন্দ্রিক গড়ে উঠা জাতিবাদি চিন্তাও আমার ভেতরে কোনরূপ শ্রেষ্ঠত্বের মহিমা তৈরী করে না। আমি একজন বৈশ্বিক মানুষ। পৃথিবীর কারো সাথে আমার কোন শত্রুতা নেই, যতক্ষণ না গ্রহণযোগ্য কোন উৎস থেকে শত্রুতার নিদিষ্ট কোন কারণ সৃষ্টি হয়। গ্রহণযোগ্য উৎসের মূলে রয়েছে শরীয়াহ।
দেশপ্রেম ও উদযাপন
দেশপ্রেমের প্রকৃত উদযাপন হলো একজন নাগরিক দেশের প্রতি তার দায়িত্বশীলতার অনুভুতিকে জাগ্রত রাখা এবং মাটি ও মানুষের কাছে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ব্রতী হওয়া। দেশপ্রেম প্রদর্শনের বস্তু নয়। নানা রকমের প্রতিকায়নের মাধ্যমে উৎসবের উপলক্ষ্যও নয়। এ হলো একজন নাগরিকের ভেতরগত উপলব্ধি, যা তার কর্মের মাধ্যমে স্বতঃপ্রকাশিত হয়। বর্তমান সময়ে একধরণের সাংস্কৃতিক আধিপত্য জন্ম নিয়েছে, যারা নানা রকমের প্রতিক সৃষ্টি করেছে এবং দেশপ্রেমের মেকি উদযাপনপদ্ধতি বানিয়ে এর মাধ্যমে দেশপ্রেমিক ও দেশদ্রোহী হিসেবে মানুষের মধ্যে বিভাজনে লিপ্ত হয়েছে। আমার প্রেম আমি কিভাবে উদযাপন করব, তা আর কেউ এসে ঠিক করে দিবে কোন যুক্তিতে? এটা বোকামি, অযোক্তিকতা ও হঠকারিতা। এই হঠকারিতাকে বৈধতা দেবার জন্য যত কথা বলা হবে, সে সমস্ত কিছুকে আমি অস্বীকার করি। মানুষের মধ্যে অন্যায়ভাবে বিভাজন তৈরীকারী রাষ্ট্রের ভেতরে গড়ে ওঠা এই আরেক আধিপাত্যবাদি মেকি রাষ্ট্রটিকে সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ করতে হবে এবং ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়ে সকল মানুষকে একই সমতলে নিয়ে আসতে হবে। অন্যথায়, দেশ তার মূল লক্ষ্যকে হারিয়ে নাগরিকদের জন্য নিজেই একটা সমস্যা হিসেবে হাজির হবে।
আমাদের এই যে সম্মিলিত আয়োজন, এর নিয়ন্ত্রণব্যবস্থাটি কী হবে, আইন-কানুন কী হবে এবং এই যূথবদ্ধ অভিযাত্রার চূড়ান্ত গন্তব্যস্থল কী হওয়া উচিত—এ নিয়ে আদর্শ ও বিশ্বাসের জায়গা থেকে আমার নিজস্ব প্রস্তাবনা ও প্রচেষ্টা আছে—শরীয়াহ। এটা হলো আদর্শের সাথে আদর্শের দ্বন্দ্ব এবং সিস্টেমের সাথে সিস্টেমের দ্বন্দ্ব। শরীয়াহকে শতভাগ প্রতিষ্ঠা করার জন্য আমি কাজ করে যাব, এবং উপযুক্ত সক্ষমতা আসার পর নিয়ন্ত্রক শক্তি হিসেবে আমি একেই প্রতিষ্ঠিত করব। এর আগ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত সকল অত্যাচারী নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে আমি সর্বক্ষণ সংগ্রামে নিয়োজিত। কিন্তু এ মাটির বিরুদ্ধে আমার কোন সংগ্রাম নেই। এ মাটির মানুষের বিরুদ্ধে আমার কোন সংগ্রাম নেই। এ মাটি ও মানুষ একান্ত আমার। আমি এ মাটির সন্তান, এখানেই আমার বেড়ে ওঠা। আমার পূর্বপুরুষ ঘুমিয়ে আছেন এ মাটির আশ্রয়েই।
খোদার কসম আমি কোন অভ্যাগত ভীনদেশি নই। এ আমার দেশ।