এক.
শিশুদের কিছু আচরণের মধ্যে মাঝে মাঝে কিছু পলিটিক্যাল ব্যাপার আমি লক্ষ্য করেছি। পলিটিক্যাল শব্দটা এখানে মূল অর্থে না, বর্তমানে এর যে কালচারাল ইমেজ দাঁড়িয়েছে সেই অর্থেও না; বরং প্রবণতা ও কৌশল অর্থে। এর মাঝে কিছু তো আছে অসাধারণ। এসব দেখে আনন্দে হাসতে হাসতে আমার খুন হয়ে যেতে ইচ্ছে করে৷ আমি সে-সব আলাপে যাচ্ছি না৷ একটু ক্রিটিক্যাল একটা ব্যাপারে আমার অভিজ্ঞতাটা বলি৷
একটা শিশু তার মা’কে বেশি ভালোবাসে, না বাবাকে? এই প্রশ্নকে পাশ কাটিয়ে একটা সরল সত্য হলো : বাবার সাথে তাদের ভালোবাসার প্রকাশ বা বাহ্যিক লেনদেনটা একটু বেশি হয়৷ এর কারণ হলো, মাকে সে সবসময় কাছে পায়। দীর্ঘ সহাবস্থানের কারণে মা’র মনে সে নানা দুষ্টুমির মাধ্যমে কিছু বিরক্তিও তৈরী করে। ঘরের কাজবাজ সামলিয়ে এর দুষ্টুমির সামাল দেওয়ার জন্য কিছুটা শাসন-ধমকেরও প্রয়োজন পড়ে৷ এটা একদমই ন্যাচারাল। বাবা যদি টানা দুই-তিনদিন ঘরে থাকে, তাহলে বাবাও এমন করবে, বরং বেশি করবে। কিন্তু বাবা তো ঘরে থাকে না৷ সাক্ষাতটা সাধারণত হয় স্বল্পকালীন, ফলে বাবার সাথে তার সম্পর্কের মধ্যে শাসন থাকে না। শুধু উলুতুলু আদরই থাকে। এই জিনিসটা শিশুদের মনে একটা ‘চক্রান্তমনস্কতা’ তৈরী করে।
দেখা যায়, বাবা ঘরে থাকা অবস্থায় মা যখন শাসন করে, ধমক দেয়, বা কোন ধরণের চাপ তৈরী করে, তখন শিশুটা আচরণের মধ্যে একটা পক্ষাপক্ষির আবহ তৈরী করে ফেলে। হাউমাউ করে কেঁদেকেটে গলে গিয়ে বাবার কোলে আশ্রয় নেয়। অনেক সময় মায়ের নামে নালিশও দেয়। নালিশের ভাষাগুলোও কি কিউট–বাবা, আম্মু মাচ্চে; আম্মু পচা। বাবা, আপনে আমারে চকলেট কিনে দিবেন, না? আম্মুকে দিব না।
এ সময়টাতে বাবারা অনেক সময় ইমোশনে আক্রান্ত হন৷ শিশুকে শাসন করে যেহেতু অভ্যস্ত নন, তাই তিনি এটা নিতে পারেন না৷ কষ্ট হয়৷
প্রশ্ন হলো, এ সময়টাতে বাবাদের আচরণটা কী হওয়া উচিত? আমার মনে হয় :
১. মায়ের শাসনটিকে ভরপুর সাপোর্ট দিতে হবে। এর অর্থ হলো : শিশুটিকে আশ্রয় দিতে হবে, কিন্তু প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না৷ বলতে হবে, বাবা, তুমি কেন এমন করো! আম্মুর কথা কেন শুনো না? যাও, আম্মুকে উম্মা দিয়ে আসো৷ আম্মুর কথা না শুনলে আব্বুও তোমাকে আদর করব না৷
২. যদি মনে হয় মায়ের শাসনটা বেশি হয়ে গেছে, বা ভুলভাবে হচ্ছে, তাহলে শিশুর সামনে এটা ধরা যাবে না৷ একান্তে মায়ের সাথে তা নিয়ে পরামর্শমূলক আলোচনা করতে হবে। শিশুর সামনে ইমোশন প্রকাশ করলে বা ভুল ধরলে সে আশকারা পাবে, এবং মায়ের মনে কষ্ট লাগতে পারে৷ মনে রাখা দরকার, বাবা তার শিশুটিকে যতটুকু ভালোবাসে, মা তারচেয়ে অনেকগুন বেশি ভালোবাসে। এটা আমার অনুমান৷
করা যাবে না
১. শিশুটিকে জবাবদিহি না করে স্রেফ আদর করা উচিত হবে না৷ ‘আচ্ছা, বাবা, আর কান্দে না৷ আম্মুকে বকে দিব’–এ জাতীয় কথা বলা অসঙ্গত৷ এতে তার তারবিয়ত ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷
২. একজন শাসন করলে অপরজন আশ্রয় দিতে হয়। অন্যথায় শিশুটি মানসিকভাবে আঘাত পাবে এবং মা-বাবার উপস্থিতি সত্তেও সে অসহায়ত্ব বোধ করবে৷ এটা তার মানসিক বিকাশের জন্য ক্ষতিকর৷ তাছাড়া এটা নির্মমতাও বটে। অতএব, তাকে আশাকারা না দিতে গিয়ে বাবাও শাসন শুরু করা ঠিক হবে না৷ তিনি অবশ্যই আশ্রয় দিবেন, এবং আদরের সুরে জবাবদিহিতা করে মায়ের শাসন গ্রহণের সুযোগ করে দিবেন।
দুই.
শিশুদের ঘুম ভাঙার পর আমি কিছুদিন গভীরভাবে লক্ষ্য করে দেখেছি। আমার মনে হয়েছে ওরা এ সময়টাতে কিছুটা অসহায়ত্ব ও নৈঃসঙ্গ বোধ করে৷ এরপর থেকে ঘুম ভাঙার পর আমি কাছে থাকলে তাদেরকে কোমলভাবে জড়িয়ে ধরি। থুঁতনি নেড়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করি তার কেমন লাগছে। নাকে নাক ঘষে ফিসফিসিয়ে আদুরে স্বরে বলি যে, সে জেগে উঠাতে আমি খুবই আনন্দিত হয়েছি এবং এখন সে একা নয়৷
হে মানবকুল!
সদ্য ঘুম-ভাঙা শিশুটিকে অভিনন্দিত করুন।