আমার মনে হয় কি, পরকিয়া একটা বিরাট ব্যাপার। মানে, বিরাট রকমের সাংঘাতিক ব্যাপার। বিয়ের পর সাধারণত মানুষ এই অনৈতিক পথে পা বাড়ায় না। একদিকে ধর্মীয় চেতনা, সাধারণ নৈতিকতাবোধ, পারিবারিক-সামাজিক নানা সীমাবদ্ধতা-ভয় ইত্যাদির কারণে হৃদয়ের গভীর থেকে এ ব্যাপারে একটা নিষেধাজ্ঞা উপলব্ধ হয়, অপরদিকে পরিবারের মানুষটির প্রতি থাকে ভালোবাসা, মায়া, প্রতিশ্রুতি। এ জন্য সমাজে বিয়ে-পূর্ববর্তী যতগুলো প্রেমের সম্পর্ক হয়, বিয়ে পরবর্তী পরকিয়া ততটা না। অন্তত দৃশ্যমান সংখ্যার বিচারে এটা তূলনামূলক কম। তারপরও পরকিয়ার মত ব্যাপারটিতে অনেকে জড়িযে যায়।
এই সরাসরি পরকিয়ার বাইরে ভিন্ন আরেকটি পরকিয়া আছে। একে পরকিয়া শব্দে উল্লেখে অনেকের আপত্তি থাকতে পারে। তা থাকুক। কিন্ত, পরকিয়ার একটা একক ধরে আমরা যখন বিন্দু থেকে শুরু করবো, তখন আশা করছি এই মতভিন্নতাটি থাকবে না। এখন প্রশ্ন হলো, পরকিয়ার এককটা কী? আমি মনে করি বিয়ের পর কোন পরপুরুষ বা পরনারীর প্রতি কামজনিত প্রেমবোধ।
এই যে বললাম কামজনিত এবং প্রেমবোধ, এটা একটু বোঝা দরকার। প্রেমবোধের অর্থ কিন্তু এই না যে, তাকে নিজের মত করে না পেলে আমার এখন-কি-তখন কিছু একটা হয়ে যাবে—এমন পরিস্থিতিতে চলে যাওয়া। ব্যাপারটা এমন না হয়ে সামান্যও হতে পারে; মৃদু বাতাসের মত, শরীরের লোম ছুঁয়ে যায়, গাছের পাতাটি একটু নড়ে-কি-নড়ে না।
হৃদয়ের এই ক্ষুদ্র কাণ্ডটি আসলে মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এটা মুহুর্ত অলক্ষে হয়, আবার একটু সচেতনায় উবে যায়। এ থেকে বেঁচে থাকতে পারে এমন মানুষ কি আছে? মনে হয় না। এ জন্য একে আমি পরকিয়ার মত ভারী্ শব্দ দিয়ে চিহ্নিত করতে রাজি নই এবং ঐ অর্থে দোষণীয়ও বলছি না। আমি বরং বলছি যে, এটা হলো সেই সম্পর্কের একক। এখান থেকে অনৈতিক সম্পর্কটির যাত্রা শুরু হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। এরপর এর প্রতি আর মনোযোগ না দিলে এখানেই শেষ।
কিন্তু, কেউ যদি আগ্রহী হতে শুরু করে, তাহলে হৃদয়গত ক্ষুদ্র এই অভিব্যক্তিটি পরবর্তি চারটি স্তরের দিকে যেতে শুরু করে।
১. সে মানুষটিকে নিয়ে মাঝে মাঝে ভাবে। এটা ভাবতে গিয়ে প্রথম প্রথম অস্বস্তি বোধ করে। আবার ভাবে। এভাবে একটা সময় গিয়ে ভাবনা গভীর হয় এবং বার বার হতে থাকে। এরপর একসময় গিয়ে সেই অস্বস্তিটিও থাকে না আর। তাকে নিয়ে সে কল্পনায় আনন্দিত থাকে। গপসপ করে। নানা রোমান্টিক সিন ক্রিয়েট করে।
সেই সাথে ভাবনার লোকটি যদি তার আশপাশের হয়, বা কখনো কোন পরিবেশে কাছাকাছি হয়, তখন ভেতরে ভেতরে সে একটা প্রেম-প্রেম আবহে প্রবেশ করে বসে থাকে। অবশ্য সে-সময় খুব সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। বাহ্যিক কোন আচরণে কখনোই তা প্রকাশ করে না এবং ভাবনার মানুষটির সাথে সম্পর্কেও জড়াতে চায় না। কারণ, সে তার স্বামী বা স্ত্রীকে ভালোবাসে এবং তার প্রতি আন্তরিক প্রতিশ্রুতিশীল।
২. প্রথম স্তরটি অতিক্রম করার পর সে দ্বিতীয় স্তরে প্রবেশ করে। অবশ্য, সবাই যে প্রথম স্তরটি দীর্ঘদিন চর্চা করার পর ধীরে-সুস্থে দ্বিতীয় স্তরে প্রবেশ করে, এমন নয়। এই দ্বিতীয় স্তরে প্রবেশের ব্যাপারটি খুব অল্প সময়ের ভেতরেও হতে পারে। এখানে সে কিছু কাজও করে। যেমন, সাধারণ কথাবার্তা, প্রয়োজনীয় যোগাযোগ, টুকটাক সহযোগিতা ইত্যাদি। কিন্তু, এ ক্ষেত্রেও খুব সতর্কতার সাথে সেইসব কাজ থেকে সে প্রেমের আবহটি লুকিয়ে রাখে।
বর্তমান ফেসবুকের যুগে এই মৃদু বা মৃদতম প্রেম প্রকাশের বিচিত্র মাধ্যমও বের হয়েছে। যেমন, উদ্দিষ্ট ব্যক্তিটির সাথে ফ্রেন্ডশিপ করা বা তাকে ফলো করা, তার পোস্টে নিয়মিত লাইক-কমেন্ট করা। কমেন্টে-রিপ্লাইয়ে নানা বিষয় নিয়ে সিরিয়াস আলাপ-আলোচনা করা। মজা করা ইত্যাদি। এমনকি সহনীয় পর্যায়ের আক্রমনাত্মক কমেন্ট-রিপ্লাই করেও হতে পারে সে প্রেমের উদযাপন।
এসবের মধ্যে সবচে খারাপ মাধ্যমটি হলো ইনবক্স। এই গোপনকক্ষে গিয়ে তারা যে ভালোবাসার আলাপ জুড়ে দেয় এমন না। দেখা যাবে, আলোচনা হবে খুব সিরিয়াস বিষয় নিয়ে, বা সাধারণ জীবনালাপ, সুখদুখ ইত্যাদি। সেসব আলাপে হৃদয়গত দুর্বলতাটি সযত্নে সামলে রাখা হয়, কিন্তু, ভেতরে ভেতরে প্রেমেরে আবেগ নিয়ে চলে এই দরকারি কথা-বার্তা । এসব করতে গিয়ে তারা সাধারণত সবসময় পরস্পরে বিনয়, সম্মান এবং বিপুল শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে করে থাকে।
অবশ্য, ফেসবুকে কেউ কাউকে ফলো করলেই বা ইনবক্সে আলাপ করলেই যে প্রেমবোধও আক্রান্ত হতে হবে, এমনটি বলছি না। প্রেমবোধ ছাড়াও মানুষ এসব করতে পারে। আমি বলছি, প্রেমবোধ থেকেও মানুষ এসব করে থাকে, আমার ধারণা।
তো, যোগাযোগটা যেভাবেই হোক, এটা বাড়তে বাড়তে একসময় জরুরী বা নির্দোষ কথা বার্তায় ভরপুর ফোনালাপে পর্যন্ত গড়ায়। এই স্তরের শেষ সীমা হলো—ভালো লাগা ও বন্ধুত্ব; প্রেম নয়। কারণ, সে মানুষটির সাথে কোন সম্পর্কে জড়াতে চায় না। কারণ, সে তার স্বামী বা স্ত্রীকে ভালোবাসে এবং তার প্রতি আন্তরিক প্রতিশ্রুতিশীল।
৩. সরাসরি প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়া। মানুষটিকে কি পেতে চাই? জানি না। এর লক্ষ্য অস্পষ্ট ও অনিশ্চিত; কিন্তু, প্রেমটা করে আনন্দ পাওয়া যাচ্ছে। এডভেঞ্চার, রোমান্স, মধুময়তা। আমাদের এ প্রেমের ভবিষ্যত কী? এটা নিয়ে তখন ভাবতে চায় না। আবার, কেউ ভাবেও। মানে, আমাদের মিলন সম্ভব নয়, কিন্তু, প্রেমটা চলুক। এতে মজা পাওয়া যাচ্ছে।
৪. গভীর প্রেমে ডুবে যাওয়া। তাকে পাওয়ার জন্য পাগলপারা হয়ে যাওয়া।
.এর মধ্যে প্রথম স্তরকে পরকিয়া বলা যায় না। এটা দোষণীয়, গুনাহ এবং ঝুঁকিপূর্ণ। অতএব দ্রুত পরিত্যাজ্য। তৃতীয় ও চতুর্থ স্তরটি সরাসরি পরকিয়া। এর ব্যাপারে এখানে কিছু বলার নেই। ক্রিটিকাল হলো দ্বিতীয় স্তরটি। এই জায়গাটি নিয়ে আমি বিশেষ কিছু কথা বলতে চাই।
এই স্তরের লোকগুলো কারা?
কেউ কেউ আছেন চরিত্রগত দিক থেকে অনেক দুর্বল। খারাপ শব্দে যাকে আমরা বলি চরিত্রহীন। এই ক্যাটাগরির লোকজন এ স্তরটি দ্রুত পার করে তৃতীয় স্তরে ঢুকে পড়ে বা ঢুকার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করতে থাকে।
কিন্ত এ স্তরের বেশিরভাগ সাধারণত ভালো মানুষ হয়। হয়তো মোটামুটি ভালো মানুষ, অথবা সৎচরিত্রবান এবং আন্তরিক দীনদার। এমনও হতে পারে, ঐরকম দীনদার নয় ঠিক, তবে সৎচরিত্রবান। স্বাভাবিক ও প্রাত্যহিক জীবনযাপনে তাদের দীনদারি ও চরিত্রবান হওয়ার বিষয়টি অনুভব করা যায়।
ভালো হওয়া স্বত্তেও এসবে জড়ায় কেন?
খুব পরিকল্পিত বা ভেবে চিন্তে সময় নিয়ে নয়। মানবিক দুর্বলতার এক বিশেষ সময় এটা। এখানে মানুষের হৃদয়গত ইতিহাসটি ব্যাখ্যাহীন, যুগে যুগেই।
তো, এঁরা ‘আমি তো আর প্রেম করছি না’ বা, এ-ই তো মাত্র কয়দিন, দ্রুতই বাদ দিয়ে দেব’—ধরণের একটা নির্দোষ মনোভাব থেকে নিজেকে প্রবোধ দিয়ে এগিয়ে যায় এবং খুব সহজে এক সময় আটকে যায়। অনেক সময় কখন যে সে এখানে এসে পোঁছেছে, নিজেও জানে না। কিন্তু, নিজেদের ভেতরগত সত্যিকারের ভালোমানুষির কারণে এই যোগাযোগটিতে স্বস্তিও পায় না। এই সময়টাতে একদিকে যেমন আনন্দ অনুভব করে, আবার ভেতরগত বিষণ্নতায়ও আক্রান্ত হয়। এ কারণে সে দ্বিতীয় স্তরটিতেই থেমে থাকে। তৃতীয় স্তরে যায় না এবং চতুর্থ স্তরে যাওয়ার কথা কখনো চিন্তাও করে না। এই সময়টাতে তারা বড় অসহায়।
ফেসবুকে অচেনা কারো সাথে, পুরনো ক্লাসমেট, সাবেক প্রেমিক বা প্রেমিকা, প্রতিবেশি, বন্ধুর স্ত্রী, বান্ধবীর স্বামী ইত্যাদি নানা সূত্রে এসবে জড়াতে পারে মানুষ।
এতে তাদের প্রধাণত দুইটি ক্ষতি হয়—আত্মীক এবং পারিবারিক। ভেতরে সবসময় একটা অপরাধবোধ কাজ করে, নামাজে, দোয়ায় অর্থাৎ, আল্লাহ তাআলার সামনে সে একান্ত ও স্বতঃস্ফুর্ত হতে পারে না। এভাবে সে ধীরে ধীরে আমল থেকে দূরে সরে যায়। দ্বিতীয় হলো পরিবারের ভালোবাসার মানুষটির সামনে অস্বস্তি ও বিষণ্নতায় আক্রান্ত হওয়া।
এবং সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হলো, কোন কারণে যদি তার কাছে ধরা পড়ে যায়, তখন স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসায় স্থায়ী একটা ফাটল ধরে, এমনকি একসময় তা বিচ্ছেদে রূপান্তরিত হয়। এর বাইরে সামাজিকভাবে সে অপদস্থ হতে পারে। এমনকি ভুলক্রমে বিষয়টি লিক্ড হয়ে গেলে যে কারো মাধ্যমে ব্ল্যাকমেইলের শিকার হতে পারে।
এরকম পরিস্থিতি থেকে দ্রুত দ্রুত বের হয়ে আসা উচিত। নিজের স্বামী বা স্ত্রী ছাড়া প্রেমজনিত হৃদয়গত এই আবেগটির ব্যাপারে অন্য সবার থেকে একদম চাঁছাছোলা এবং নিস্পৃহ হয়ে উঠা একান্ত আবশ্যক, যদি আমি জীবনকে সুন্দর করে যাপন করতে চাই।
এখানে আমার আরেকটি বিশেষ পরামর্শ আছে। কেউ যদি তার স্বামী বা স্ত্রীর ব্যাপারে এমন কিছু জানতে পারে, তাহলে তার উচিত বিষয়টি ঠাণ্ডা মাথায় বিবেচনা করে একে সহজভাবে গ্রহণ করা। কারণ, এ স্তরে এসেও সে মূলত ভালো মানুষই, এবং তখনও সে আপনাকেই ভালোবাসে। আর, সমাজের অন্যান্য লোকদের উচিত তাকে এ সময়ে সাহায্য করা।