আধুনিক কবিতা সম্পর্কে জানা থাকা কেন জরুরী
আগের যে কোন সময়ের তূলনায় বাংলা সাহিত্যে উলামায়ে কেরামের অংশগ্রহণ অনেক বেশি। আর, এটা খুবই সাধারণ বিষয় যে, সাহিত্যে সফল হওয়ার জন্য বিষয়, তথ্য, তত্ত্ব ও বিশ্লেষণের পাশাপাশি সুন্দর গদ্যশক্তি থাকা একান্ত দরকারী। অন্যথায় এ বিষয়গুলোকে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয়। ফলে, লেখালেখিতে আগ্রহী যারা, তাদের প্রথম প্রশ্নই থকে : গদ্যটা কীভাবে সুন্দর করব? তো, এর জন্য নানা কিছুর দরকার পড়ে। এর মধ্যে, আমার ব্যক্তিগত অবজার্ভেশন হলো : সুন্দর গদ্যের জন্য আধুনিক কবিতার নিবিষ্ট পাঠক হওয়া জরুরী। ভালো গদ্য যারা লেখেন, খোঁজ নিলে দেখা যাবে, তাদের বেশিরভাগই কবিতার মনোযোগী পাঠক।
কিন্তু আধুনিক কবিতার ব্যাপারে একটা সাধারণ ও জোরালো অভিযোগ হলো : এগুলোর কিছুই বুঝা যায় না। কেমন পাগলাটে আর খাপছাড়া মনে হয়। বিশেষত গদ্য কবিতার ক্ষেত্রে এই অভিযোগ সবচেয়ে বেশি। এই অভিযোগ আংশিক সত্য; বাকিটুকু সত্য কি না তার উত্তর রয়ে গেছে কবিতা বলতে আসলে আমরা কী বুঝি তার মধ্যে।
এই লেখায় আধুনিক কবিতার গতিপ্রকৃতি ও চরিত্র নিয়ে কিছু কথা বলব। এটি কবিতার ব্যাপারে একান্তই আমার নিজস্ব অনুভব। কোন বই বা কারো আলোচনা পড়ে রেফারেন্সসহ গবেষণাধর্মী কিছু নয়; একেবারেই সাধারণ। কবিতা বলতে আমি কী বুঝি, কীরকম অনুভব করি, একে কীভাবে কোনরূপে কামনা করি-এইসব হাবিজাবি, হৃদয়ের লতাগুল্ম, যা একান্তই নিজের মতো করে বেড়ে উঠেছে আলোছায়াঘেরা রহস্যময় মনোভূমিতে।
কবিতা : আমার অনুভবে
কথা দিচ্ছি উল্টাপাণ্টা কিছু বলব না। সুস্থ ও ভদ্র মানুষের মত স্বাভাবিক কথাবার্তাই বলে যাব। তবে, বিষয় যেহেতু কবিতা, তাই মাঝে মধ্যে যদি এদিক সেদিক, এসরা-তেসরা কিছু বলে ফেলি, দোষ নেবেন না। কারণ, কবিতার প্রভাব তো এমনই। এটি মানুষকে যুক্তিশীল করে, যুক্তিহীন হতে প্রবলভাবে প্ররোচিত করে। এজন্য দাড়ি কমার বন্ধনে আবদ্ধ সিদ্ধ বক্তব্য এখানে সর্বদা প্রার্থিত নয়। মাফ করবেন, আমি অবশ্যই কিছু অর্থহীন জটিল কথা বলব। নিশার আঁধারে পাওয়া মানুষের মত মধুর প্রলাপে নিমজ্জিত হব। উন্মুক্ত হব এবং উন্মত্ত হব।
যেহেতু কবিতা আমাদেরকে মুগ্ধ করে এবং বিভ্রান্ত করে। এ জন্য কবিতাকে আমি প্রচণ্ড ভালাবাসি এবং এর অস্তিত্বকে স্বীকার করি না।কবিতা তাহলে কী? কবিতা কি তবে শব্দবৃত্তে বন্দি এক অশান্ত ঈগল? হয়তো। কারণ শব্দ হল এক চরম বিশ্বাসঘাতক। সে সে সর্বদা নিজের ভেতর অর্থহীন মরিচিকা দেখায়। কিন্তু আমি তো শব্দের নির্দিষ্টতায় বিশ্বাসী নই। অনির্দিষ্ট অসীমতার ব্যাপ্তি থেকে সংস্থানকে, সংলগ্নতাকে উদ্ধৃত করতে চই। আমি বিশ্বাস করি কবিতা মূলত ব্যক্ত-অযোগ্য শব্দহীন অনুভূতির সরল বয়ান। এজন্য বিশ্বাসঘাতক শব্দ দিয়ে এর পরিচয় পেশ করা অসম্ভব। আমার সুস্থতার ব্যাপারে আস্থা হারাবেন না। আমি বিশুদ্ধ আছি। কারণ প্রিয় কবি আল মাহমুদ নিজেই বলেছেন কবিতা নাকি মক্তবের চুলখোলা মেয়ে আয়েশা আক্তার, সাইকেলের ঘণ্টাধ্বণি, বাবার রাবেয়া রাবেয়া ডাক, ছোট ভাইয়ের ভয়ার্ত মুখ। আরো কি কি যেন। সাইকেলের ঘণ্টাধ্বণি কবিতা হবে কেন? কিন্তু আল মাহমুদ তো তাই বলছেন। তিনিও শেষ পর্য়ন্ত শব্দের কাছে পরাজিত হয়ে অনির্দিষ্ট অসীমতায় সমর্পিত হয়েছেন। সিলেটের প্রসিদ্ধ কবি দিলওয়ার একটি কবিতা লিখেছেন। তিনি মূলতঃ কবিতা লেখেননি; দৈনিক পত্রিকার দুঃখিত, শোকাক্রান্ত কিছু শিরোণামকে সাজিয়ে দিয়েছেন। এটা কবিতা হবে কেন?
কিন্তু আমার মাথায় পিস্তল ধরলেও বলবো এটা কবিতা এবং অতি উত্তম একটি কবিতা। এজন্য বলি কবিতা কবিতাই। বিশ্বাসঘাতক দুর্বল শব্দের বন্ধনীতে একে সংজ্ঞা আকারে উদ্ধৃত করা যায় না। কবিতা রচনা করতে হয় অনুভব দিয়ে। পাঠও করতে হয় প্রশ্নহীন অনুভূতির সরলতা দিয়ে। বুদ্ধি দিয়ে বিল্ডিং নির্মাণ করা যায়; কিন্তু কবিতা রচনা বা কবিতার সুখাবৃত্তি সম্ভব কি?
কবিতার বীজতলা
ঢাকার দারুল ফিকিরের ভদ্র শান্তশিষ্ট প্রিয় সহপাঠি মুহিব হঠাৎ একদিন কবিতার ব্যাপারে উৎসুক হযে জিজ্ঞেস করল- আচ্ছা, আমারে বুঝান তো কবিতার বাপারটা আসলে কি? আধুনিক কবিতা আমার পড়তে ইচ্ছে হয়, কিন্তু এইসব কী লেখে, পড়ে তেমন টেস্ট পাই না। আমি সেদিন তাকে যা বলেছি এবং ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অভাবে যা বলিনি, (কারণ মুখোমুখি বসে কাউকে এসব বলতে গেলে আক্রমণের ভয় আছে।) কিন্তু বলতে চেয়েছিলাম, তার সারমর্ম এই-
দেখুন, প্রশ্ন করলে কবিতা একটি জটিল বস্তু। সত্যিকার অর্থে কবিতা যে কি তা আমি নিজেও বুঝি না। আর বুঝি না বলেই এর প্রতি আমার এত মায়া। এ না বুঝার ভেতরে আমি বিষণ্ন সন্ধ্যার আঁধারে মোড়া পাখি উড়া মায়াবী দূর দিগন্তের আহ্ববান শুনতে পাই।
আপনি স্বচ্ছ জলের ভেতর মসৃণ পাথরের ছবি দেখেছেন। মুগ্ধ হয়ে অনেক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন। আপনার কাছে এটি মুগ্ধকর মনে হল কেন? এ মুগ্ধতার উৎস কি? জলতলে পাথরের অবয়বে কোমল অস্পষ্টতার উপলব্ধিটুকুই তো! জলের তলা থেকে পাথরটিকে উঠিয়ে আনলে আপনি দুঃখবোধ করবেন। কারণ জল-পাথরের এই কোমল অস্পষ্টতা আপনাকে প্রত্যিহিক যুক্তিনির্ভর বস্তুগত বোধ থেকে উঠিয়ে নিয়ে কোন এক অচিনলোকের বিস্তীর্ণ প্রান্তরে বিমূঢ় করে রেখেছিল। বিশ্বেস করুন, অনেক সময় এই অস্পষ্টতা, এই রহস্যময়তা, এই অপূর্ণতাটুকুই কবিতার প্রাণ।
লক্ষ্য করুন, আমরা ছোটবেলায় মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফুটবল খেলা দেখেছি। খেলোওয়ারেরা বল চালাচালি করেন। দৌড়-ঝাঁপ করেন। এসবই হল আটপৌরে বস্তুগত এবং যুক্তিগ্রাহ্য প্রক্রিয়া। কিন্তু একজন খেলোওয়ার যখন তিন চারজনকে ভেলকি দেখিয়ে অত্যন্ত নিপুণভাবে বলটিকে জালের ভেতর পাঠিয়ে দেন তখন তিনি বিপুল আনন্দিত হন। কিন্তু এ আনন্দকে প্রকাশ করার শক্তি তার নেই। তাই অক্ষম হয়ে তিনি চিৎকার করতে থাকেন।এ চিৎকারকে অন্য ভাষায় আমরা কবিতা বলতে পারি। এ অক্ষমতা থেকেই মূলত কবিতার জন্ম হয়। আমাদের শব্দ ভঙ্গুর এবং দুর্বল। আমাদের প্রকাশ করার ক্ষমতা আরো দুর্বল। এগুলো দিয়ে প্রাত্যহিক আটপৌরে যুক্তিগ্রাহ্য জীবনকে প্রকাশ করতে পারি; কিন্তু আমাদের মনে যখন সুখ-দুখ, আনন্দ-বেদনা, ক্ষোভ হতাশা, ক্রোধ-ভক্তি, বিভিষিকা-মহত্ত্ব-সৌন্দর্য়বোধ ও উপলব্ধির প্রাবল্য আসে তখন আমরা এগুলোকে আমাদের পরিচিত শব্দ দিয়ে প্রকাশ করার উপায় না পেয়ে অসহায় ও অক্ষম হয়ে পড়ি। একটি প্রবল তিক্ত-মধুর যন্ত্রণায় বিহ্বল হয়ে পড়ি।ঠিক এরকম মুহূর্তে গিয়ে একজন চিত্রকর তার শ্রেষ্ঠ চিত্রকর্মটি আঁকতে বসেন। একজন সুরকার সুরের মোহন ইন্দ্রজাল সৃষ্টি করেন। আর একজন স্বপ্নাহত কবি প্রবল যন্ত্রণায় কাতর হয়ে হাতের কাছে যা পান তাই দিয়ে একটি কবিতার বুনন করেন। এ জন্য কবিতাকে বলা যায় অসহায়ত্বের প্রকাশ। অক্ষমতার সন্তান। কবি তার কবিতায় শব্দের আশ্রয় নেন বটে কিন্তু এগুলো আসলে শব্দ বা বক্তব্য নয়; একজন অক্ষম ও অসহায় মানুষের গোঙানি মাত্র। আনন্দ বেদনা, ক্ষোভ-হাতাশা বা সৌন্দর্য়-মুগ্ধতায় যন্ত্রণাকাতর এক ব্যক্তির অস্ফুট আর্তনাদকে আমরা যুক্তির গ্রাহ্যতা দিয়ে ব্যবচ্ছেদ করতে যাব কেন? কবিতায় আমরা কোন ঘটনা কাহিনী সংবাদ বা কোন নিরেট বস্তুর উপস্থিতি পাই না। একটি কাতরতার আভাস পাই মাত্র।
কথাটিকে আমি আরো সহজ করে বলতে চাই। দেখুন, কবি যখন স্বপ্ন-দুঃস্বপ্নময় অতীতের কোন অপ্রাপ্তির বেদনায় মুগ্ধ হন, কোন স্মৃতি কোন গন্ধ বা কোন ঘটনার নির্মম উপসংহারে বিহ্বল হয়ে পড়েন, তখন কখনো তার হৃদয়টি মোমের মত জ্বলে উঠে। তখন সমস্ত পৃথিবীকে তার দু পাখনায় নিংড়ে নেবার পর যে বোধ চুইয়ে পড়ে রৌদ্রে শিশিরে, যে সত্য উদিত হয় হৃদয়ের গভীরে, সে বোধ সে সত্যকে তিনি শিলাভূত করেন উপমা কল্পনা আর বিভিন্ন ছদ্মচিত্র দিয়ে। ফলে দেখা যায় হৃদযের উপলদ্ধি চিত্র আর কবিতার বক্তব্যের মধ্যে তৈরী হয় বিস্তর ফারাক। অনেক কবিতায আমরা ঘটনার মূল কাহিনীটি জানতে পারি না; কেবল সে ঘটনার একটি প্রতিক্রিয়াকে ছদ্মচিত্রে অবলোকন করি। অনেক সময় কবি নিজেও ভুলে যান ঐ কবিতাটি তিনি ঠিক কোন উপলব্ধি থেকে লিখেছিলেন। কিন্তু কবিতায় চিত্রটি বা সংলগ্ন অসংলগ্ন চিত্রসমূহ যেহেতু একটি বোধ ও উপলব্ধির গভরিতা থেকে জন্ম নেয় এজন্য তা হয় সূক্ষ মার্জিত ও শিল্পিত। তাই মূল ছবিটি হারিয়ে গেলেও এখানে হারানোর বেদনা নেই। আমরা কবিতায় একটি শিল্পিত স্পেস বা শূন্যতাকে লাভ করি। এরপর আমরা আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে উপার্জিত বা শিল্পগ্রস্ত হৃদযের কল্পনা থেকে আহরিত উপলন্ধি ও বোধ দ্বারা সে শূন্যতাকে অর্থপূর্ণ করে তুলি। এ কারণে একটি কবিতা দশজন পাঠকের কাছে দশ রকমের অর্থ নিয়ে হাজির হয়।
আমার এ সকল বক্তব্য হল সে সকল কবিতার ব্যাপারে যেখানে আমরা কোন নির্দিষ্ট ঘটনা কাহিনী বা সংবাদ পাই না। কিন্তু কবি অনেক সময় ছদ্মচিত্র পরিহার করে তাঁর উপলদ্ধির সে নির্দিষ্ট ঘটনা নিয়েই উপস্থিত হন। কিন্তু ভেবে দেখুন, সে নির্দিষ্ট বিষয়ের তথ্য ও সংবাদগুলোই কি তাঁর মুখ্য উদ্দেশ্য? তাহলে তো এগুলো টানা গদ্যে লিখে গেলেই পারতেন। কবিতা রচনার মত কষ্টসাধ্য কাজটি কেন করতে এলেন? আসলে কবি কিছু সংবাদ ও তথ্য কেন্দ্র করে তাঁর সেই গভরি ও গভীরতর অনুভবকে মূর্ত করে তুলতে চান। এখানেও আমাদের জন্য একটি স্পেস নির্মিত হয়। আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা ও ব্যক্তিগত উপলদ্ধি অনুভব দিয়ে কবির সাথে একাত্ম হয়ে একটি অধরা সত্য সৌন্দর্য়কে তালাশ করি। এজন্য শুধু শব্দ কবিতা নয়; কবিতা শব্দেরও ওপারে কিছু। এই অস্ফুটতা, যন্ত্রণা ও উপলন্ধির এই গভীরতা যে কবিতায যত বেশি হবে সেটি তত বেশি কবিতা হয়ে উঠবে। এবং যে কবিতায় এটি কমতে থাকবে সেটি তত বেশি অসফল হতে হতে একসময় কেবলি ছড়া-কবিতা বা ছন্দ-বাক্য ও শব্দব্যায়ামে পর্য়বসিত হবে। কবিতার একজন নগণ্য পাঠক হিসেবে কবিতা আর ছড়াকবিতার মধ্যকার এ পার্থক্যটুকু আমি মান্য করতে চাই। আমি তীব্রভবে বিশ্বাস করি, গভীরতাহীন নিছক উত্তেজনা কিংবা আবেগধর্মী কিছু কথাকে ছন্দাকারে সাজিয়ে তুললে তা উপভোগ্য হয় বটে; কবিতা হয় না এবং এগুলো দ্বারা কালের নজরুল-ফররুখ-বেদনানন্দ (জীবনানন্দ) হওয়া যায় না।
আমি বলতে চাই কবিতাকে কোন নির্দিষ্ট সংজ্ঞায় নিরূপিত করা যায় না; কবিতা কবিতা হিসেবে চিহ্নিত হয় পাঠক-হৃদয়ের সমর্থন দিয়ে, এর শরীর ও ভঙ্গি এবার যেমনই হোক।
আমি শুরুতেই বলেছি কবিতা কী তা আমি নিজেও জানি না। তবে অন্ধ লোকটি যেমন আকাশ দেখে না; কিন্তু তার হৃদয়ে নিজের মত করে আকাশের একটি অক্ষম অবয়ব আছে। তেমনি আমার কাছেও কবিতার একটি ব্যক্তিগত ধারণা আছে। অপারগতার কারণে অন্ধকে দোষারোপ করা য়ায় না, আমাকে দোষ দেবেন কেন?