গ্রন্থ-আলোচনা
রিসালাতুন ইলা শাবাবিল উম্মাহ
মানুষ সম্ভবত সবচে বেশি ভয় পায় নিজেকে।
এজন্য নিজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আত্মজবাবদিহিতা অত্যন্ত কঠিন একটি কাজ। কিন্তু সাহস করে কেউ যদি দাঁড়িয়ে যায় তাহলে সে জীবনের মুক্ত উপত্যকায় দাঁড়িয়ে সীমাহীন স্পর্ধায় দিগন্তকে আলিঙ্গন করতে পারে।
ড. রাগেব আস্সারজানী ছোট্ট এ বইয়ের অল্পকয়েকটি পৃষ্ঠায় মুসলিম যুব সমাজকে অত্যন্ত কঠোরভাবে নিজের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন।
এ বইটি হাতে নিয়ে আপনি একটি ভুল করতে পারেন। ভাবতে পারেন এটি একটি বই, যা লেখা হয় এবং দিনশেষে অনেক মানুষ একে কিনে নিয়ে যায়।
কিন্তু আমি বলছি আপনি এ ভুলটি করবেন না। কারণ এ তো আসলে কোন বই নয়; সত্যিকার অর্থে এটি একজন দূরদর্শী ব্যথিত মানুষের একান্ত আলাপচারিতামাত্র।
ড. সারজানী যেন যন্ত্রণাবিদ্ধ হয়ে একটি পথের মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছেন এবং একদল বিষণ্ন যুবককে বিনীত শাসনে নিয়ে গেছেন নিজের একান্ত রুমটিতে। আর পরম মমতায় শুনেছেন তাদের বিষণ্নতার কথা। তাদের সে বিবরণে তিনি সহমর্মী হন নি; তাদের স্বপ্নের অধঃগামীতা ও সে স্বপ্নভঙ্গের বেদনা দেখে বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়েছেন।
এরপর তিনি অবতীর্ণ হয়েছেন একজন নির্দয় বিশ্লেষকের ভূমিকায়। চলমান সময়কে কেটেছিঁড়ে বর্তমান যুবমানসের একটি ভয়াবহ বাস্তবতাকে তাদের সামনে তুলে ধরেছেন। ইতিহাসের সোনালী যবকদের গল্প শুনিয়েছেন আর মৃদু তুমুল আঘাতে তাদেরকে লজ্জিত করেছেন। রক্তাক্ত করেছেন। গভীর পর্যবেক্ষক দৃষ্টিতে চিহিত করেছেন এ অধঃগামীতার কারণগুলোও। এরপর তিনি তাঁর উজ্জ্বল তর্জনীর লক্ষভেদী ইশারায় এমন কিছু দিক দেখিয়েছেন যেগুলো আপনাকে পরিবর্তন করে দিবে না; তবে বলে দিবে আপনাকে কেন পরিবর্তন হওয়া দরকার এবং কীভাবে।
লেখক সারজানী হতাশ নন। পুরো বইয়ে বারবার যেটা বলতে চেয়েছেন তা হল মুসলিম জাতি পরাজিত হয় জেগে উঠার জন্যেই। তারা ফিনিক্স পাখির মত ধ্বংসস্তুপ থেকে ছাই ঝেড়ে জেগে উঠে বারবার। আর এজন্য একজন সারজানী আজ হাত পেতেছেন মুসলিম যুবকদের কাছে। “শোন হে যুবক!”
প্রিয় অগ্রজ, স্বপ্নচারী তরুন আলেম, সফল ও দক্ষ অনুবাদক মাওলানা আব্দুল আলীম “শোন হে যুবক” নাম দিয়ে এ বইটির অনুবাদ করেছেন তাঁর স্বভাবসুলভ মুন্সিয়ানায়।
ফলে ড. সারজানীর ভাষার প্রবল আকর্ষণ, লালিত্য, ঋজুতা ও প্রাঞ্জলতার ছোঁয়া তাঁর অনুবাদেও বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
ধারণা করি, এ অনুবাদ তাঁর পূর্বপরিকল্পিত নয়; বইটি হঠাৎ তার হাতে এসেছে। তাঁকে স্বপ্ন দেখিয়েছে। উদ্দিপ্ত করেছে। এরপর একটি দায়বদ্ধতা থেকে অনুবাদের কাজে তিনি হাত দিয়েছেন। চলমান এ সময়ে ছোট্ট এ বইটি তরুণদের হাতে হাতে উঠে আসার দরকার আছে। কারণ, সময় অনেক গড়িয়েছে। পতনের দিন শেষ। রাতের কালো আকাশে শুরু হয়েছে নতুন বিপ্লবের অবিনাশী তুফান।
বইয়ের নাম : রিসালাতুন ইলা শাবাবিল উম্মাহ।
ভাষা : আরবি।
লেখক : ড. রাগেব আস্সারজানী।
(জন্ম- ১৯৬৪. মিশর। ইতিহাসবিদ, বহু মূল্যবান গ্রন্থপ্রণেতা। আল আজহার ইউনিভার্সিটির মেডিকেল সাইন্সের প্রফেসর। জনপ্রিয় ইসলামিক সাইট Islamstory-র কর্ণধার।)
পৃষ্ঠা সংখ্যা : ১৫৬.
সাইজ : A4 সাইজের কাগজে সাধারণ বইয়ের আকৃতি।
সূচি, প্রকাশনী, প্রকাশকাল :
সরাসরি লেখকের নেটসাইট Islamstory থেকে
নেওয়া PDF সংস্করণে এ বিষয়গুলো উল্লেখ নেই।
.
অনূদীত নাম : শোন হে যুবক!
অনবাদক : মাওলানা আ. আলীম।
(শিক্ষক, ইদারাতুল উলূম, আফতাব নগর ঢাকা।)
প্রকাশক : মাকতাবাতুল হাসান। ঢাকা।
পৃষ্ঠা সংখ্যা : ১০৮.
বইয়ের ধারক্রমটি এমন – ভূমিকা। বর্তমান মুসলিম যুবকদের সমস্যার ধরণ। আসলে সমস্যা কি হওয়া উচিত ছিলো। ইসলামে যুবকদের অবস্থান ও ইসলামী ইতিহাসের কয়েকজন সোনালী যুবকের গল্প। সে যুবকদের সাথে বর্তমান যুবপ্রজন্মের পার্ক্যের ৪টি মূল কারণ। এ সমস্যা থেকে উঠে দাঁড়ানোর জন্য ১০টি পরামর্শ। শেষ কথা।
সহজ এবং প্রাঞ্জল আরবিতে হৃদয়গ্রাহী উপস্থাপনা। বইটির মধ্যে বিশেষ একটি দুর্বল দিক আমার কাছে মনে হয়েছে, উত্তরণের জন্য তিনি যে দশটি পরামর্শ দিয়েছেন, তার মধ্যে জিহাদের বিষয়টিকে অন্তর্ভুক্ত না করা। নিচে বইটির সংক্ষিপ্ত চিত্রটি উল্লেখ করছি।
রিসালাতুন ইলাশ শাবাব এর সারসংক্ষেপ
ক. এক সেমিনারে যুবকদের থেকে প্রাপ্ত স্বীকৃতিতে তারা নিজেদের জীবনে যে সব বিষয়কে সমস্যা মনে করছে
১. চাকরি না পাওয়া।
২. এক পক্ষীয় ভালোবাসা।
৩. বাড়ি বা গাড়ি না থাকা।
৪. ইচ্ছে থাকা সত্তেও বিয়ে করতে না পারা।
৫. গোপন খারাপ অভ্যাস থাকা।
৬. চক্ষু হেফাজত করতে না পারা।
৭. পড়ালেখার বিষয়বস্তু ও মানহাজ কঠিন মনে হওয়া। এবং এ পাঠ্য বিষয়ের উপকারীতার ব্যাপারে হতাশা।
৮. কারো কারো সমস্যা এমনও যে, সে একটা মোবাইল কিনতে পারছে না।
বস্তুত, এগুলোই পুরো পৃথিবীর প্রায় সকল মুসলিম যুবকের ভাবনা।
খ. কিন্তু যুব সমাজের আসলে যেগুলো সমস্যা হওয়ার কথা ছিলো
১. পৃথিবী জুড়ে শরীয়াহ প্রয়োগ না হওয়া। বিশেষত মুসলিম দেশগুলোতে।
২. মুসলিম রাষ্ট্রগুলো বেদখল হওয়া।
৩. মিডিয়ার নানাভাবে, নানা ক্ষেত্রে।
৪. ইসলামি রাষ্ট্রগুলো বিরাট ঋণে জড়িয়ে পড়া।
৫. মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে ব্যাপক দুর্নীতি হওয়া।
৬. শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া।
৭. পৃথিবীর সর্বত্র ইসলাম প্রচারিত না হওয়া।
গ. দুই সমস্যার মূল পার্থক্য—
আগেরগুলো ব্যাক্তিগত, আর পরেরগুলো পুরো উম্মাহ কেন্দ্রিক। আগেরগুলো সমস্যা নয়-এমন নয়। আপত্তি হল—ব্যাক্তিগত সমস্যাগুলো যুবকদের মনে সবচে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। এগুলো প্রথম স্থান অধিকার করে বসে আছে, আর সেগুলো তাদের মাথা থেকে বের হয়ে গেছে।
ঘ. যুবকরা এসবে মনোযোগী নয় কেন?
১. তারা নানা রোগে আক্রান্ত। এর মধ্যে বড় রোগ হল—জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে অস্পষ্টতা। তাদের লক্ষ্য সীমাবদ্ধ হয়ে আছে সামান্যতে। কিন্তু সে জানে না উম্মত ডুবলে সাথে সে-ও ডুববে।
২. মনে করে আমি এখনো ছোট। জাতিসংঘের ঘোষণা মতে ১৮ বছরের নীচে সবাই শিশু। এ কথা সে নিজের অজান্তে কবুল করে বসে আছে। অথচ ইসলাম যুবককে মুকাল্লাফ করে আরো অনেক আগেই।
ঙ. ইসলামে যৌবনের গুরুত্ব—
১. যুবাইর ইবনুল আওয়াম। ১৫. (ইসলাম গ্রহণকালের বয়স)
২. তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ। ১৬.
৩. সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস। ১৭.
৪. আরকাম ইবনে আবুল আরকাম। ১৬
৫. আলী ইবনে আবু তালিব। ১০.
৬. যায়েদ ইবনে সাবেত। ১৩.
৭. মু’আয ইবনে আমর। ১৪.
৮. মুআওয়াজ ইবনে আফরা। ১৩.
৯. উসামা ইবনে জায়েদ।
এ লোকগুলো এতো অল্প বয়সে ইসলাম গ্রহণ করে যুবক বয়সেই ইতিহাস কাঁপিয়েছেন।
চ. উভয় প্রজন্মের মাঝে এমন পার্থক্যের কারণ—
১. ইসলামি তারবিয়তের অভাব।
২. অনুসরণীয় মুরুব্বির অভাব। যারা যুবকদেরকে পাপ থেকে নিষেধ করবে তারাই পাপে লিপ্ত। উদাহরণত পিতা নিজেই নামাজ পড়ে না, ছেলেকে কীভাবে বলবে?
৩. নিজের জীবন ও মুসলিম বিশ্বের ব্যাপারে নৈরাশ্য।
৪. মিডিয়ার নানামুখী আক্রমণ ও প্রোপাগান্ডা।
ছ. উত্তরণের উপায়—
১. এখনই সমস্ত গুনাহ থেকে ফিরে আসুন।
২. দীনকে উত্তমভাবে যথেষ্ট পরিমাণে জানুন।
৩. মসজিদের সাথে সম্পর্ক মজবুত করুন।
৪. জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা শাখায় সবাইকে ছাড়িয়ে যান।
৫. নানাভাবে আত্মীয়তার সম্পর্কগুলো সর্বদা সজীব রাখুন। যোগাযোগ রাখুন। সিলায়ে রেহমী করা।
৬. যেখানেই থাকুন ভালো সঙ্গী নির্বাচন করুন।
৭. পৃথিবীর চলমান বাস্তবতাকে বুঝুন।
৮. শরীর চর্চা করুন। নানাভাবে শরীরকে সবসময় কাজের জন্য ফিট রাখুন।
৯. অপরকে আপনার পথে অর্থাৎ, দীনের পথে ডাকুন।
১০. সময়কে পরিকল্পিতভাবে খরচ করুন। রুটিন বানান, রুটিনকে ভালোভাবে অনুসরণ করুন।