ইসলামী পোশাক ও ব্যক্তি জীবনে তার প্রভাব

ইসলামে রয়েছে একটি সুন্দর জীবন ব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ রূপ। মানুষের রাষ্ট্রীয় জীবন সামাজিক জীবন পারিবারিক জীবন এবং ব্যক্তি জীবনের খুঁটিনাটি বিষয়েরও দিকনির্দেশনা রয়েছে ইসলামে। ইসলাম সর্বকালের ধর্ম। ইসলাম সব যুগেই প্রাসঙ্গিক। ইসলাম সেকালের ধর্ম ছিলো যেমন তেমনই প্রযুক্তির উৎকর্ষতার যুগ আধুনিকতার শ্রেষ্ঠ সময় একবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ-সত্য এবং একমাত্র ধর্মও ইসলাম।

ইসলাম মানব জীবনের প্রতিটি শাখার যথোপযুক্ত নীতিমালা এবং রূপরেখা দিয়েছে। ইসলাম এমন অনেক বিষয়ের নীতি নির্ধারণ করেছে, পথ ও পন্থা বলে দিয়েছে যার ছিটেফোঁটাও অন্য কোনো ধর্মাদর্শে পাওয়া মুশকিল। চলাফেরা উঠাবসা কথাবার্তা আচার আচরণ আহার নিদ্রা পোশাক পরিচ্ছদ লেনদেন ব্যবসা বাণিজ্য বিয়ে শাদি এমনকি হাসিরও সুন্দর নীতি রয়েছে ইসলামে।

মানব জীবনের অন্যান্য বিষয়ের মতো পোশাকের ক্ষেত্রেও রয়েছে ইসলামের দিকনির্দেশনা। মানুষের পোশাক নারী-পুরুষের পোশাক ঘরের পোশাক বাইরের পোশাক সাধারণ মানুষের পোশাক বিশেষ মানুষের পোশাক বিশেষ দিনের পোশাক সব পোশাকের সুন্দর সহজতম ও উন্নত নীতি রয়েছে ইসলামে। 

পোশাক মানুষের মৌলিক প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোর অন্যতম। আল্লাহ তায়ালা মানুষকে লজ্জা এবং আত্মমর্যাদা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। তাই সতর ঢেকে রাখা এবং পরিপাটি থাকা মানুষের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। মানুষের মান সম্মান মর্যাদা অক্ষুন্ন থাকে পোশাকেই। মানুষের মান ক্ষুণ্ন করতে মানুষকে লাঞ্ছিত অপদস্থ করতে মানব সৃষ্টির শুরু থেকেই কর্ম তৎপর মানুষের চির শত্রু শয়তান।

ইসলাম মানুষের ফিতরত বা প্রকৃতির ধর্ম। মানুষের ওপর সাধ্যাতীত কিছুই চাপিয়ে দেয়নি। ইসলামেই রয়েছে মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতা। কিন্তু মানুষ বড় বোকা। শয়তানের ধোঁকায় পড়ে ইসলামের উদারনীতি থেকে বেরিয়ে পশ্চিমাদের তৈরি সংকীর্ণ পোশাকে আবদ্ধ হয়ে নিজেদের স্বাধীনতাবিসর্জন দিতে ব্যাকুল। ইসলামী পোশাক এবং ব্যক্তি জীবনে তার প্রভাব এ আলোচনায় আসার আগে পোশাক সম্পর্কে কিঞ্চিত আলোচনা সঙ্গত হবে।

পোশাক:

পোশাক শরীরের কৃত্রিম আচ্ছাদনকে বলে। যে কাপড় মানুষের সতর আবৃত করে ইসলামের দৃষ্টিতে তাকেই পোশাক বলে। আল্লাহ তাআলা বলেন,          

یٰبَنِیۡۤ اٰدَمَ قَدۡ اَنۡزَلۡنَا عَلَیۡکُمۡ لِبَاسًا یُّوَارِیۡ سَوۡاٰتِکُمۡ وَرِیۡشًا ؕ وَلِبَاسُ التَّقۡوٰی ۙ ذٰلِکَ خَیۡرٌ ؕ ذٰلِکَ مِنۡ اٰیٰتِ اللّٰہِ لَعَلَّہُمۡ یَذَّکَّرُوۡنَ 

হে আদমের সন্তান-সন্ততি! আমি তোমাদের জন্য পোশাকের ব্যবস্থা করেছি, যা তোমাদের দেহের যে অংশ প্রকাশ করা দূষণীয় তা আবৃত করে এবং তা শোভাস্বরূপ। বস্তুত তাকওয়ার যে পোশাক, সেটাই সর্বোত্তম।  এসব আল্লাহর নিদর্শনাবলীর অন্যতম, যাতে মানুষ উপদেশ গ্রহণ করে। 

 —আল আ’রাফ – ২৬

পোশাক দিয়ে মানুষ সতর ঢাকে, আব্রু হেফাজত করে। আবহাওয়ার বৈরিতা থেকে বাঁচতে কিংবা যুদ্ধে আত্মরক্ষার জন্যও মানুষ পোশাক পরিধান করে। আল্লাহ তায়ালা বলেন,

وَاللّٰہُ جَعَلَ لَکُمۡ مِّمَّا خَلَقَ ظِلٰلًا وَّجَعَلَ لَکُمۡ مِّنَ الۡجِبَالِ اَکۡنَانًا وَّجَعَلَ لَکُمۡ سَرَابِیۡلَ تَقِیۡکُمُ الۡحَرَّ وَسَرَابِیۡلَ تَقِیۡکُمۡ بَاۡسَکُمۡ ؕ کَذٰلِکَ یُتِمُّ نِعۡمَتَہٗ عَلَیۡکُمۡ لَعَلَّکُمۡ تُسۡلِمُوۡنَ 

এবং আল্লাহই নিজ সৃষ্ট বস্তুসমূহ হতে তোমাদের জন্য ছায়ার ব্যবস্থা করেছেন, পাহাড়-পর্বতে তোমাদের জন্য আশ্রয়স্থল বানিয়েছেন, আর তোমাদের জন্য বানিয়েছেন এমন পোশাক, যা তোমাদেরকে তাপ থেকে রক্ষা করে এবং এমন পোশাক, যা যুদ্ধকালে তোমাদেরকে রক্ষা করে। এভাবে তিনি তোমাদের প্রতি নিজ অনুগ্রহ পূর্ণ করেন, যাতে তোমরা অনুগত হয়ে যাও। —আন নাহ্‌ল – ৮১

মানুষ সৃষ্টির শুরু থেকেই পোশাকের সূচনা। হযরত আদম আলাইহিস সালাম এবং হযরত হাওয়া আলাইহাস সালাম জান্নাতে আবৃত ছিলেন। শয়তানের ধোকায় পড়ে যাক্কুম ফল খেলে অনাবৃত হন এবং সঙ্গে সঙ্গে জান্নাতের পত্রপল্লবে শরীর ঢাকতে শুরু করেন। কোরআনের ভাষ্য:

 فَأَكَلَا مِنْهَا فَبَدَتْ لَهُمَا سَوْءَٰتُهُمَا وَطَفِقَا يَخْصِفَانِ عَلَيْهِمَا مِن وَرَقِ ٱلْجَنَّةِ ۚ 

অতঃপর তারা সেখান থেকে খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের সতর অনাবৃত হয়ে গেল। এবং তাঁরা তাঁদের গায়ে জান্নাতের (গাছের) পাতা জড়াতে লাগলেন।

ইসলামী পোশাক:

যে বস্ত্রে মানুষের সতর আবৃত হয় ইসলামের পরিভাষায় তাই পোশাক। মানুষের প্রয়োজনীয় সকল জিনিসের মতো পোশাকের ক্ষেত্রেও রয়েছে ইসলামের অনুপম আদর্শ। ইসলাম পোশাকের এমন এক রূপরেখা দিয়েছে যা মানুষের স্বভাবজাত চাহিদা পূরণ করে। ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে তোলে। ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রাখে। মানুষকে ভালো কাজের দিকে ধাবিত করে এবং ব্যক্তিগত ও সামাজিক বহু অন্যায়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ইসলামী পোশাক বলতে বুঝায় যে পোশাক ইসলামের প্রতিনিধিত্ব করে। যে পোশাক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরিধান করেছেন এবং যে পোশাক পরিধানের অনুমোদন দিয়েছেন। ইসলাম সব বিষয়ের মতো পোশাকের ক্ষেত্রেও দিয়েছে এমন নীতি যা সব যুগেই প্রাসঙ্গিক। দেশ জাতি রুচি অবস্থা ও মৌসুমের ভিন্নতায় ইসলামের নীতি মেনে যে কোনো পোশাক পরিধানকে ইসলাম সমর্থন করে।

পোশাকের ক্ষেত্রে ইসলামের মৌলিক নীতিমালা:

এক.

পোশাকটি এমন হবে যা সতর আবৃত করে। যে পোশাকে সতরাবৃত হবেনা তা ইসলামের দৃষ্টিতে পোশাকই নয়। মানুষের উপর সতর ঢাকা ফরজ এবং সতর উন্মুক্ত রাখা হারাম। পুরুষের সতর নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত হলেও নারীর সতর ক্ষেত্রবিশেষ পুরো শরীর।

এই মূলনীতির কারণে তিন ধরনের পোশাক এমন আছে যেগুলো পরিধান করেও ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ পোশাকহীন বা উলঙ্গ হিসেবে গণ্য হবে।

১. কাপড় যদি এত ছোট বা সংক্ষিপ্ত হয় যা দিয়ে সতর আবৃত হয় না।

২. কাপড় যদি এতোই পাতলা হয় যার উপর দিয়ে সতর বুঝা যায় ।

৩. কাপড় যদি এতটাই আঁটোসাঁটো হয় যার উপর দিয়েও সতর বুঝা যায়। হাদিসে এসেছে, 

عَنْ ضَمْرَةَ بْنِ ثَعْلَبَةَ أَنَّهُ أَتَى النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم وَعَلَيْهِ حُلَّتَانِ مِنْ حُلَلِ الْيَمَنِ فَقَالَ يَا ضَمْرَةُ أَتَرَى ثَوْبَيْكَ هَذَيْنِ مُدْخِلِيكَ الْجَنَّةَ. فَقَالَ لَئِنِ اسْتَغْفَرْتَ لِىْ يَا رَسُولَ اللهِ لاَ أَقْعُدُ حَتَّى أَنْزِعَهُمَا عَنِّى. فَقَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِضَمْرَةَ بْنِ ثَعْلَبَةَ. فَانْطَلَقَ سَرِيْعاً حَتَّى نَزَعَهُمَا عَنْهُ.

যামরাহ ইবনু ছালাবাহ (রা.) বলেন, তিনি এক জোড়া ইয়ামানী কাপড় পরিধান করে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নিকট আগমন করেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, হে যামরাহ! তুমি কি মনে কর যে তোমার এই কাপড় দু’টি তোমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে? যামরাহ বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি যদি আমার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন, তবে আমি বসার আগেই (এখনি) কাপড় দু’টি খুলে ফেলব। তখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে আল্লাহ! আপনি যামরাকে ক্ষমা করে দিন। তখন যামরাহ দ্রুত গিয়ে তার কাপড় দু’টি খুলে ফেলেন।

অন্য হাদীসে এসেছে,

صِنْفَانِ مِنْ أَهْلِ النَّارِ لَمْ أَرَهُمَا قَوْمٌ مَعَهُمْ سِيَاطٌ كَأَذْنَابِ الْبَقَرِ يَضْرِبُوْنَ بِهَا النَّاسَ وَنِسَاءٌ كَاسِيَاتٌ عَارِيَاتٌ مُمِيلاَتٌ مَائِلاَتٌ رُءُوسُهُنَّ كَأَسْنِمَةِ الْبُخْتِ الْمَائِلَةِ لاَ يَدْخُلْنَ الْجَنَّةَ وَلاَ يَجِدْنَ رِيْحَهَا وَإِنَّ رِيْحَهَا لَيُوجَدُ مِنْ مَسِيْرَةِ كَذَا وَكَذَا-

‘দু’শ্রেণীর জাহান্নামীকে আমি দেখিনি। প্রথম শ্রেণী-যাদের হাতে থাকবে গরুর লেজের ন্যায় ছড়ি, তা দ্বারা তারা লোকদেরকে প্রহার করবে। দ্বিতীয় শ্রেণী- ঐ সকল নারী, যারা কাপড় পরিধান করেও নগ্ন, পুরুষদেরকে নিজেদের প্রতি আকৃষ্টকারিণী এবং নিজেরাও পুরুষদের প্রতি আকৃষ্ট। তাদের মাথা হবে লম্বা গ্রীবাবিশিষ্ট উটের চুঁটির ন্যায়। তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না এবং তার সুগন্ধও পাবে না। অথচ জান্নাতের সুগন্ধি এত এত দূর থেকেও পাওয়া যাবে’।

দুই.

পোশাকের ক্ষেত্রে বিজাতিদের অনুসরণ না করা। বিজাতিদের পোশাক পরিধান করা ইসলামের পোশাক নীতিকে প্রত্যাখ্যান করার নামান্তর। মুসলমানদের ঈমান এবং আত্মমর্যাদার দাবিও বিজাতিদের পোশাক পরিহার করা। যারা আল্লাহ, রাসুল, ইসলাম ও মুসলমানদের শত্রু তাদের পোশাক পরিধান করা লজ্জার কথা এবং স্বকীয়তা বিরোধী। তাদের সাদৃশ্যতা অবলম্বনের ব্যাপারে হাদিসে কঠোর নিষেধ এসেছে:

 عَنِ ابْنِ عُمَرَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏ “‏ مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ ‏”‏ ‏.‏

আব্দুল্লাহ ইবন উমার (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি কোন কাওমের (সম্পদ্রয়ের) অনুসরণ-অনুকরন করবে, সে তাদের দলভুক্ত হবে।

অপর এক বর্ণনায় এসেছে,

عَنْ اِبْنِ عُمَرَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ ﷺ خَالِفُوا الْمُشْرِكِين أَحْفُوا الشَّوَارِبَ وَأَوْفُوا اللِّحَى

আব্দুল্লাহ বিন উমার (রা.) কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা মুশরিকদের অন্যথাচরণ কর। তোমরা মোছ ছেঁটে ফেল এবং দাড়ি ছেড়ে দাও।

তবে এক্ষেত্রে বিবেচনার মূল বিষয় হচ্ছে, বিজাতিদের ধর্মীয় পোশাক না হওয়া বা এমন পোশাক না হওয়া যেটা ভিন্ন কোনো ধর্মের মানুষকে নির্দেশ করে। যে পোশাক বিশেষ কোনো ধর্মের নিদর্শন বহন করে না, তাদের বিশেষ সংস্কৃতিকেও নির্দেশ করে না তা পরতে অসুবিধা নেই। কেননা এতে নিষিদ্ধ সাদৃশ্য পাওয়া যায় না।

তিন.

দম্ভ ও অহংকার প্রকাশ পায় এমন পোশাক না হওয়া। অহংকার ইসলামে হারাম। সুতরাং দম্ভ সৃষ্টিকারী যে কোনো পোষাক ইসলামে হারাম। অহংকার যেমন মূল্যবান ধুতি কাপড়ে হতে পারে তেমনি ছালার চট গায়ে দিয়েও হতে পারে। কেননা অহংকার মূলত অন্তরের বিষয়। তবে পোশাকের কিছু দিক আছে যা অহংকারকে নির্দেশ করে। যেমন টাখনুর নিচে কাপড় পরিধান করা বা টাখনু ঢেকে রাখা অহংকারের নিদর্শন। জাহিলি যুগে মানুষ অহংকারবশত টাখনুর নিচে কাপড় ঝুলিয়ে রাখতো। দিওয়ানুল হামাসায় কবির একটি পংক্তিতে যা ফুটে উঠেছে।

اذا ما اصطبحت خط  مئزري 

চারটি প্রভাত পানপাত্র সাবাড় করে ফেলে যখন আমি বের হই তখন আমার চাদর মাটিতে গড়াগড়ি খেতে থাকে ।

বস্তুত ইসলাম জাহিলিয়াতের মেরুদন্ডে আঘাত করেছে। জাহিলিয়াতের অন্যান্য অসভ্যতার মতো এই অসভ্যতাও মিটিয়ে দিয়েছে। হাদিসে এসেছে :

من زر ثوبه خيلاء لم ينظر الله اليه يوم القيامه  

যে অহংকার করে কাপড় ঝুলিয়ে পরবে আল্লাহ তাআলা কেয়ামতের দিন তার দিকে তাকাবেন না।

আরেকটি হাদিসও আছে এ ব্যাপারে 

لا ينظر الله يوم القيامه الى من جر ازاره بطرا. متفق عليه

আল্লাহ কেয়ামতের দিন ঐ ব্যক্তির দিকে দৃষ্টি ফেরাবেন না যে অহংকার করে লুঙ্গি (টাখনুর নীচে)ঝুলিয়ে চলে।

চার.

তাছাড়া পুরুষের জন্য নারীদের পোশাক পরিধান করা যেমন হারাম নারীদের জন্য পুরুষের পোশাক পরিধান করা হারাম ।

لعن اللهُ المتشبهين بالنساءِ من الرجالِ والمتشبهاتِ من النساءِ بالرجالِ.

নারীদের সাজে সজ্জিত পুরুষ এবং পুরুষের সাজে সজ্জিত নারী উভয় প্রকারের উপর আল্লাহ লানত করেছেন।

পাঁচ.

পুরুষের জন্য লাল জাফরানি এবং রেশমি পোশাক পরিধান করা হারাম। ওমর (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

,لاَ تَلْبَسُوا الْحَرِيْرَ فَإِنَّهُ مَنْ لَبِسَهُ فِى الدُّنْيَا لَمْ يَلْبَسْهُ فِى الآخِرَةِ-

 ‘তোমরা রেশম পরিধান করো না। যে ব্যক্তি দুনিয়ায় রেশম পরিধান করবে, সে আখিরাতে তা পরিধান করতে পারবে না’।

এই নীতিমালার পাশাপাশি ইসলাম সবসময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর পোশাক পরিধান করতে উদ্বুদ্ধ করে। সুন্দর পোশাক সুস্থ ও সুন্দর হৃদয়ের পরিচায়ক। পোশাকের মাধ্যমে মানুষের সৌন্দর্য প্রকাশ পায় ব্যক্তিত্ব ফুটে ওঠে। তাই পোশাক হবে দৃষ্টিনন্দন। অপরিচ্ছন্ন ঘৃণার উদ্রেককারী যে কোনো পোশাক ইসলামের নীতি বহির্ভূত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

ان الله يحب ان يراء اثر نعمته على عبده رواه الترمذي

আল্লাহ তাআলা তার বান্দার উপর নেয়ামতের প্রকাশ দেখতে চান।

ان الله جميل يحب الجمال في كل شيء رواه مسلم

আল্লাহ তাআলা তো সুন্দর। প্রতিটি জিনিসেই সৌন্দর্য পছন্দ করেন। (সহীহ মুসলিম)

আমরা কোন ধরনের পোশাক পরিধান করবো?

ইসলাম কোনো জাতির উপর নির্দিষ্ট কোনো পোশাক চাপিয়ে দেয়নি। এটা ইসলামের উদারতা। ইসলাম পোশাকের ক্ষেত্রে এমন মৌলিক কিছু নীতি বলে দিয়েছে যেগুলো মেনে যেকোনো অঞ্চলের মানুষ তাদের সুবিধামতো পোশাক পরিধান করতে পারবে। এটা ইসলামের সহজাত বিধান। ইসলামের মৌলিক পোশাক নীতি ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।

তবে ইসলামের রয়েছে স্বতন্ত্র সভ্যতা ও সংস্কৃতি। ইসলামের সভ্যতা ও সংস্কৃতি সেটাই যা যুগ যুগ ধরে ইসলামের প্রতিনিধিত্ব করে আসছে। যে পোশাক পরিধানে করেছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। যে পোশাক পরিধান করেছেন সাহাবায়ে কেরাম। এবং যুগ যুগ ধরে ইসলামের আদর্শ লালনকারী সুমহান ব্যক্তিবর্গ যে পোশাক পরিধান করে আসছেন সেই পাগড়ি টুপি জুব্বা পাঞ্জাবিই ইসলামের নিদর্শন বহনকারী পোশাক। অন্য অনেক পোশাক ইসলামের নীতির আলোকে বৈধ হলেও সেগুলো ইসলামী পোশাক নয়। যে পোশাক গায়ে জড়ালে মুসলিম অমুসলিম পার্থক্য করা যায় না। যে পোশাকের কাউকে ইমামতিতে পাঠাতে ইতস্তত বোধ হয় সে পোশাক ইসলাম সম্মত বৈধ পোশাক হতে পারে কিন্তু তা ইসলামের পোশাক নয়।

অনেকেই আমাদের ওপর আপত্তি তোলে, আমরা কেন বাঙালি হয়েও চৌদ্দশ বছর পূর্বের সেকেলে সভ্যতা সংস্কৃতি লালন করি কিংবা দূর আরবের এক ব্যক্তির পোশাক কেনো নিজেদের উপর চাপিয়েছি? 

আমরা বলি,আমাদের একজন আদর্শ আছেন। যাঁর প্রতিটি কথায় প্রতিটি কাজে প্রতিটি পদক্ষেপে রয়েছে আমাদের জন্য উত্তম আদর্শ। আল্লাহ তাআলা বলেন,

 لقد كان لكم في رسول الله اسوة حسنة لمن كان يرجو الله واليوم الآخر وذكر الله ذكرا كثيرا — الاحزاب 21

আল্লাহর রাসূলের মাঝে তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ,যারা আল্লাহ এবং আখেরাতের আশা রাখে এবং বেশি বেশি আল্লাহর স্মরণ করে।

জীবনের প্রতিটি কর্মে প্রতিটি কাজে প্রতিটি পদক্ষেপে আমরা যার অনুসরণ করি। আমাদের ধর্মের এবং ইসলামের স্বতন্ত্র সভ্যতা ও সংস্কৃতিই আমরা  লালন করি, সে সভ্যতায় সজ্জিত হই। আমরা যেমন আমাদের প্রাণ থেকেও আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এবং ইসলামকে বেশি ভালোবাসি তেমনি আমাদের পোশাক ও সভ্যতার ক্ষেত্রেও আমরা আমাদের দেশীয় ও জাতীয় সভ্যতা সংস্কৃতি থেকে আমাদের নবীজি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ ও ইসলামের সভ্যতা সংস্কৃতি বেশি ভালোবাসি এবং বেশি লালন করি। আমাদের প্রাণপ্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ ব্যতীত অন্য কোন আদর্শই আমাদের কাঙ্ক্ষিত নয়। 

হযরত উসমান রা. এর ঘটনা :

হযরত ওসমান রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু সন্ধি চুক্তির লক্ষ্যে মক্কার কাফের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করতে যাচ্ছেন। ইতিহাসে যা পরিচিত ‘হুদাইবিয়ার সন্ধি’ নামে। সঙ্গে ছিলেন। তার চাচাতো ভাইও তিনি হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুকে বললেন, আপনার পরিধেয় পোশাক গোড়ালির উপরে আর মক্কার মানুষ এ ধরনের পোশাক যারা পরিধান করে তাদেরকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখে।একটু নামিয়ে নিন; তাহলে অবজ্ঞার চোখে দেখার অবকাশ তাদের থাকবে না। তখন হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বললেন, 

لا هكذا ازالة  صاحبنا رسول الله صلى الله عليه وسلم 

এমন করেননি আমাদের সঙ্গী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

(তোমার কথা শুনবো না। আমি টাখনুর নিচে কাপড় নামাবো না। কারণ আমি দেখেছি আমার প্রিয়তম রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবেই কাপড় পরিধান করেছেন)।  মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা।

ওসমান রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু কুরাইশদের সভ্যতা সংস্কৃতির কোন পরোয়া করলেন না। তিনি হযরত রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শের উপর অটল থাকলেন।  এবং আমাদের জন্য আদর্শ রেখে গেলেন, পৃথিবীর কোন সভ্যতা সংস্কৃতির কাছে সামান্য সম্মানের বিনিময়ে বা সামান্য সম্মান লাভের আশায় আমরা যেনো আমাদের প্রিয়তম নবীর আদর্শ থেকে বিচ্যুত না হই।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে ধরনের পোশাক পরতেন এবং যে ধরনের পোশাক পছন্দ করতেন সে ধরনের পোশাক পরিধান করা সুন্নত।সাদা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পছন্দের পোশাক ছিল। কালো সবুজ এবং লাল ডোরাকাটা কাপড়ও পরিধান করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাগড়ী টুপি জুব্বা পরিধান করতেন। যুগ যুগ ধরে এ পোশাকি ইসলামের প্রতিনিধিত্ব করে আসছে। এ পোশাক যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদর্শ তেমনি ইসলামের চিরন্তন সভ্যতা।

ব্যক্তিজীবনে ইসলামী পোশাকের প্রভাব:

পোশাক নিছক কোনো কাপড় নয়।  মানুষের উপর পোশাকের রয়েছে বিস্তর প্রভাব।  ভালো পোশাক মানুষকে ভালো বানায়। মানুষের মাঝে বিনয় নম্রতা শালীনতা ও দায়িত্ববোধ জাগ্রত করে। মানুষকে ভালো কাজ ও ভালো ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করে। 

মন্দ পোশাক মানুষকে মন্দ কাজে উদ্বুদ্ধ করে। মানুষকে অন্যায় অনাচার এবং অশ্লীলতার দিকে ধাবিত করে। পোশাকে ফুটে উঠে মানুষের চিন্তা চেতনা আদর্শ ও সংস্কৃতি। ইসলামী পোশাক স্রষ্টার প্রতি বান্দার আনুগত্যের নিদর্শনও বটে। বিজাতিদের রীতিনীতি ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন উপেক্ষা করে মানুষ যখন তার রবের নির্দেশিত পোশাক পরিধান করে তখন ইসলামের চির বিজয়ী আদর্শ জ্বলজ্বল করে তার বদনে। ব্যক্তি জীবনে ইসলামী পোশাকের কয়েকটি দিক এখানে আলোচনা করছি।

  • আত্মসম্মানবোধ: 

ইসলামী পোশাক মানুষের ব্যক্তিত্ব ও আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত করে। এই পোশাক পরিধান করে মানুষ এমন কোন কাজ করতে পারেনা যা তার আত্মসম্মানবোধকে নষ্ট করে দেয়। 

  • আত্মনিয়ন্ত্রণ:

ইসলামী পোশাক মানুষের চিন্তা চেতনা মন ও মনন নিয়ন্ত্রণ করে। এর মাধ্যমে ব্যক্তি লাভ করে আত্মনিয়ন্ত্রণ। ফলে পাপ কাজ থেকে বিরত থাকে। প্রকাশ্য গুনাহে লিপ্ত হওয়ার চিন্তাও করে না। ইসলামী পোশাক সাদাসিধা ও আড়ম্বরহীন হওয়ায় মানব হৃদয়ে জাগ্রত করে বিনয় ও নম্রতা।

  • রক্ষাকবচ:

ইসলামী পোশাক মানুষকে আল্লাহর নাফরমানি থেকে রক্ষা করে। পরস্পর প্রতিহিংসার আগুন থেকে বাঁচিয়ে একে অন্যের প্রতি তৈরি করে সৌহার্দ্য সম্প্রীতি ও ভালোবাসা। ইসলামী পোশাক পরিহিতদের সবাই সম্মান এবং শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখে। এটি বাঁচায় অহংকার ও আত্মম্ভরিতা। অন্যায় চুরি ডাকাতি খুন লুট ধোঁকাবাজি মিথ্যাসহ নানান খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে ব্যক্তিকে।

নারীরা ইসলামী পোশাকেই সুরক্ষিত। ইসলামী পোশাক নারীদের রক্ষা করে সকল শ্যেন দৃষ্টি থেকে। নারীদের মান-সম্মান সবকিছুই সুরক্ষিত ইসলামী পোশাকে। ইসলাম নারীদের পোশাকে কোন আবেদন বা আকর্ষণ রাখেনি। এটি নারীদের মূল্যবোধ ধরে রাখার শক্তিশালী মাধ্যম। শুধু তার দেহের আচ্ছাদন নয় বরং এটি নারীকে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চাপ থেকে রক্ষা করে। রক্ষা করে মানসিক ও আত্মিক চাপ থেকেও।

  • আল্লাহ তাআলার প্রতি ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ জাগ্রত করে:

ইসলামী পোশাক আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলার অন্যতম বহিঃপ্রকাশ। এটা মুমিনদের আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের প্রতীক। ইসলামী পোশাক আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের পোশাক হওয়ায় আল্লাহর প্রতি ভীষণ ভালোবাসা জাগ্রত হয়। মানুষের মনে জাগ্রত করে দায়িত্ববোধ। ঈমানী দায়িত্বের কথাও স্মরণ হয়। মানবিক দায়িত্বের কথাও মনে পড়ে। যিনি এই পোষাক গ্রহণ করেন সাধারণত তিনি নামাজ পড়েন, রোজা রাখেন, সালাম দেন। ইসলামী পোশাক নানাভাবে অন্তরের কলুষতা দূর করে এবং হৃদয়কে করে শুভ্র ও পরিশুদ্ধ।ইসলামী পোশাক ও ব্যক্তি জীবনে তার প্রভাব

ইসলামে রয়েছে একটি সুন্দর জীবন ব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ রূপ। মানুষের রাষ্ট্রীয় জীবন সামাজিক জীবন পারিবারিক জীবন এবং ব্যক্তি জীবনের খুঁটিনাটি বিষয়েরও দিকনির্দেশনা রয়েছে ইসলামে। ইসলাম সর্বকালের ধর্ম। ইসলাম সব যুগেই প্রাসঙ্গিক। ইসলাম সেকালের ধর্ম ছিলো যেমন তেমনই প্রযুক্তির উৎকর্ষতার যুগ আধুনিকতার শ্রেষ্ঠ সময় একবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ-সত্য এবং একমাত্র ধর্মও ইসলাম। ইসলাম আধুনিকতার সর্বোচ্চ শিখরে উন্নিত অনন্য অনুপম এক আদর্শের নাম।

ইসলাম মানব জীবনের প্রতিটি শাখার যথোপযুক্ত নীতিমালা এবং রূপরেখা দিয়েছে। ইসলাম এমন অনেক বিষয়ের নীতি নির্ধারণ করেছে, পথ ও পন্থা বলে দিয়েছে যার ছিটেফোঁটাও অন্য কোনো ধর্মাদর্শে পাওয়া মুশকিল। চলাফেরা উঠাবসা কথাবার্তা আচার আচরণ আহার নিদ্রা পোশাক পরিচ্ছদ লেনদেন ব্যবসা বাণিজ্য বিয়ে শাদি এমনকি হাসিরও সুন্দর নীতি রয়েছে ইসলামে।

মানব জীবনের অন্যান্য বিষয়ের মতো পোশাকের ক্ষেত্রেও রয়েছে ইসলামের দিকনির্দেশনা। মানুষের পোশাক নারী-পুরুষের পোশাক ঘরের পোশাক বাইরের পোশাক সাধারণ মানুষের পোশাক বিশেষ মানুষের পোশাক বিশেষ দিনের পোশাক সব পোশাকের সুন্দর সহজতম ও উন্নত নীতি রয়েছে ইসলামে। 

পোশাক মানুষের মৌলিক প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোর অন্যতম। আল্লাহ তায়ালা মানুষকে লজ্জা এবং আত্মমর্যাদা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। তাই সতর ঢেকে রাখা এবং পরিপাটি থাকা মানুষের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। মানুষের মান সম্মান মর্যাদা অক্ষুন্ন থাকে পোশাকেই। মানুষের মান ক্ষুণ্ন করতে মানুষকে লাঞ্ছিত অপদস্থ করতে মানব সৃষ্টির শুরু থেকেই কর্ম তৎপর মানুষের চির শত্রু শয়তান।

ইসলাম মানুষের ফিতরত বা প্রকৃতির ধর্ম। মানুষের ওপর সাধ্যাতীত কিছুই চাপিয়ে দেয়নি। ইসলামেই রয়েছে মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতা। কিন্তু মানুষ বড় বোকা। শয়তানের ধোঁকায় পড়ে ইসলামের উদারনীতি থেকে বেরিয়ে পশ্চিমাদের তৈরি সংকীর্ণ পোশাকে আবদ্ধ হয়ে নিজেদের স্বাধীনতাবিসর্জন দিতে ব্যাকুল। ইসলামী পোশাক এবং ব্যক্তি জীবনে তার প্রভাব এ আলোচনায় আসার আগে পোশাক সম্পর্কে কিঞ্চিত আলোচনা সঙ্গত হবে।

পোশাক:

পোশাক শরীরের কৃত্রিম আচ্ছাদনকে বলে। যে কাপড় মানুষের সতর আবৃত করে ইসলামের দৃষ্টিতে তাকেই পোশাক বলে। আল্লাহ তাআলা বলেন,          

یٰبَنِیۡۤ اٰدَمَ قَدۡ اَنۡزَلۡنَا عَلَیۡکُمۡ لِبَاسًا یُّوَارِیۡ سَوۡاٰتِکُمۡ وَرِیۡشًا ؕ وَلِبَاسُ التَّقۡوٰی ۙ ذٰلِکَ خَیۡرٌ ؕ ذٰلِکَ مِنۡ اٰیٰتِ اللّٰہِ لَعَلَّہُمۡ یَذَّکَّرُوۡنَ 

হে আদমের সন্তান-সন্ততি! আমি তোমাদের জন্য পোশাকের ব্যবস্থা করেছি, যা তোমাদের দেহের যে অংশ প্রকাশ করা দূষণীয় তা আবৃত করে এবং তা শোভাস্বরূপ। বস্তুত তাকওয়ার যে পোশাক, সেটাই সর্বোত্তম।  এসব আল্লাহর নিদর্শনাবলীর অন্যতম, যাতে মানুষ উপদেশ গ্রহণ করে। 

 —আল আ’রাফ – ২৬

পোশাক দিয়ে মানুষ সতর ঢাকে, আব্রু হেফাজত করে। আবহাওয়ার বৈরিতা থেকে বাঁচতে কিংবা যুদ্ধে আত্মরক্ষার জন্যও মানুষ পোশাক পরিধান করে। আল্লাহ তায়ালা বলেন,

وَاللّٰہُ جَعَلَ لَکُمۡ مِّمَّا خَلَقَ ظِلٰلًا وَّجَعَلَ لَکُمۡ مِّنَ الۡجِبَالِ اَکۡنَانًا وَّجَعَلَ لَکُمۡ سَرَابِیۡلَ تَقِیۡکُمُ الۡحَرَّ وَسَرَابِیۡلَ تَقِیۡکُمۡ بَاۡسَکُمۡ ؕ کَذٰلِکَ یُتِمُّ نِعۡمَتَہٗ عَلَیۡکُمۡ لَعَلَّکُمۡ تُسۡلِمُوۡنَ 

এবং আল্লাহই নিজ সৃষ্ট বস্তুসমূহ হতে তোমাদের জন্য ছায়ার ব্যবস্থা করেছেন, পাহাড়-পর্বতে তোমাদের জন্য আশ্রয়স্থল বানিয়েছেন, আর তোমাদের জন্য বানিয়েছেন এমন পোশাক, যা তোমাদেরকে তাপ থেকে রক্ষা করে এবং এমন পোশাক, যা যুদ্ধকালে তোমাদেরকে রক্ষা করে। এভাবে তিনি তোমাদের প্রতি নিজ অনুগ্রহ পূর্ণ করেন, যাতে তোমরা অনুগত হয়ে যাও। —আন নাহ্‌ল – ৮১

মানুষ সৃষ্টির শুরু থেকেই পোশাকের সূচনা। হযরত আদম আলাইহিস সালাম এবং হযরত হাওয়া আলাইহাস সালাম জান্নাতে আবৃত ছিলেন। শয়তানের ধোকায় পড়ে যাক্কুম ফল খেলে অনাবৃত হন এবং সঙ্গে সঙ্গে জান্নাতের পত্রপল্লবে শরীর ঢাকতে শুরু করেন। কোরআনের ভাষ্য:

 فَأَكَلَا مِنْهَا فَبَدَتْ لَهُمَا سَوْءَٰتُهُمَا وَطَفِقَا يَخْصِفَانِ عَلَيْهِمَا مِن وَرَقِ ٱلْجَنَّةِ ۚ 

অতঃপর তারা সেখান থেকে খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের সতর অনাবৃত হয়ে গেল। এবং তাঁরা তাঁদের গায়ে জান্নাতের (গাছের) পাতা জড়াতে লাগলেন।

ইসলামী পোশাক:

যে বস্ত্রে মানুষের সতর আবৃত হয় ইসলামের পরিভাষায় তাই পোশাক। মানুষের প্রয়োজনীয় সকল জিনিসের মতো পোশাকের ক্ষেত্রেও রয়েছে ইসলামের অনুপম আদর্শ। ইসলাম পোশাকের এমন এক রূপরেখা দিয়েছে যা মানুষের স্বভাবজাত চাহিদা পূরণ করে। ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে তোলে। ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রাখে। মানুষকে ভালো কাজের দিকে ধাবিত করে এবং ব্যক্তিগত ও সামাজিক বহু অন্যায়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ইসলামী পোশাক বলতে বুঝায় যে পোশাক ইসলামের প্রতিনিধিত্ব করে। যে পোশাক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরিধান করেছেন এবং যে পোশাক পরিধানের অনুমোদন দিয়েছেন। ইসলাম সব বিষয়ের মতো পোশাকের ক্ষেত্রেও দিয়েছে এমন নীতি যা সব যুগেই প্রাসঙ্গিক। দেশ জাতি রুচি অবস্থা ও মৌসুমের ভিন্নতায় ইসলামের নীতি মেনে যে কোনো পোশাক পরিধানকে ইসলাম সমর্থন করে।

পোশাকের ক্ষেত্রে ইসলামের মৌলিক নীতিমালা:

এক.

পোশাকটি এমন হবে যা সতর আবৃত করে। যে পোশাকে সতরাবৃত হবেনা তা ইসলামের দৃষ্টিতে পোশাকই নয়। মানুষের উপর সতর ঢাকা ফরজ এবং সতর উন্মুক্ত রাখা হারাম। পুরুষের সতর নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত হলেও নারীর সতর ক্ষেত্রবিশেষ পুরো শরীর।

এই মূলনীতির কারণে তিন ধরনের পোশাক এমন আছে যেগুলো পরিধান করেও ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ পোশাকহীন বা উলঙ্গ হিসেবে গণ্য হবে।

১. কাপড় যদি এত ছোট বা সংক্ষিপ্ত হয় যা দিয়ে সতর আবৃত হয় না।

২. কাপড় যদি এতোই পাতলা হয় যার উপর দিয়ে সতর বুঝা যায় ।

৩. কাপড় যদি এতটাই আঁটোসাঁটো হয় যার উপর দিয়েও সতর বুঝা যায়। হাদিসে এসেছে, 

عَنْ ضَمْرَةَ بْنِ ثَعْلَبَةَ أَنَّهُ أَتَى النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم وَعَلَيْهِ حُلَّتَانِ مِنْ حُلَلِ الْيَمَنِ فَقَالَ يَا ضَمْرَةُ أَتَرَى ثَوْبَيْكَ هَذَيْنِ مُدْخِلِيكَ الْجَنَّةَ. فَقَالَ لَئِنِ اسْتَغْفَرْتَ لِىْ يَا رَسُولَ اللهِ لاَ أَقْعُدُ حَتَّى أَنْزِعَهُمَا عَنِّى. فَقَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِضَمْرَةَ بْنِ ثَعْلَبَةَ. فَانْطَلَقَ سَرِيْعاً حَتَّى نَزَعَهُمَا عَنْهُ.

যামরাহ ইবনু ছালাবাহ (রা.) বলেন, তিনি এক জোড়া ইয়ামানী কাপড় পরিধান করে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নিকট আগমন করেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, হে যামরাহ! তুমি কি মনে কর যে তোমার এই কাপড় দু’টি তোমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে? যামরাহ বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি যদি আমার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন, তবে আমি বসার আগেই (এখনি) কাপড় দু’টি খুলে ফেলব। তখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে আল্লাহ! আপনি যামরাকে ক্ষমা করে দিন। তখন যামরাহ দ্রুত গিয়ে তার কাপড় দু’টি খুলে ফেলেন।

অন্য হাদীসে এসেছে,

صِنْفَانِ مِنْ أَهْلِ النَّارِ لَمْ أَرَهُمَا قَوْمٌ مَعَهُمْ سِيَاطٌ كَأَذْنَابِ الْبَقَرِ يَضْرِبُوْنَ بِهَا النَّاسَ وَنِسَاءٌ كَاسِيَاتٌ عَارِيَاتٌ مُمِيلاَتٌ مَائِلاَتٌ رُءُوسُهُنَّ كَأَسْنِمَةِ الْبُخْتِ الْمَائِلَةِ لاَ يَدْخُلْنَ الْجَنَّةَ وَلاَ يَجِدْنَ رِيْحَهَا وَإِنَّ رِيْحَهَا لَيُوجَدُ مِنْ مَسِيْرَةِ كَذَا وَكَذَا-

‘দু’শ্রেণীর জাহান্নামীকে আমি দেখিনি। প্রথম শ্রেণী-যাদের হাতে থাকবে গরুর লেজের ন্যায় ছড়ি, তা দ্বারা তারা লোকদেরকে প্রহার করবে। দ্বিতীয় শ্রেণী- ঐ সকল নারী, যারা কাপড় পরিধান করেও নগ্ন, পুরুষদেরকে নিজেদের প্রতি আকৃষ্টকারিণী এবং নিজেরাও পুরুষদের প্রতি আকৃষ্ট। তাদের মাথা হবে লম্বা গ্রীবাবিশিষ্ট উটের চুঁটির ন্যায়। তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না এবং তার সুগন্ধও পাবে না। অথচ জান্নাতের সুগন্ধি এত এত দূর থেকেও পাওয়া যাবে’।

দুই.

পোশাকের ক্ষেত্রে বিজাতিদের অনুসরণ না করা। বিজাতিদের পোশাক পরিধান করা ইসলামের পোশাক নীতিকে প্রত্যাখ্যান করার নামান্তর। মুসলমানদের ঈমান এবং আত্মমর্যাদার দাবিও বিজাতিদের পোশাক পরিহার করা। যারা আল্লাহ, রাসুল, ইসলাম ও মুসলমানদের শত্রু তাদের পোশাক পরিধান করা লজ্জার কথা এবং স্বকীয়তা বিরোধী। তাদের সাদৃশ্যতা অবলম্বনের ব্যাপারে হাদিসে কঠোর নিষেধ এসেছে:

 عَنِ ابْنِ عُمَرَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏ “‏ مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ ‏”‏ ‏.‏

আব্দুল্লাহ ইবন উমার (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি কোন কাওমের (সম্পদ্রয়ের) অনুসরণ-অনুকরন করবে, সে তাদের দলভুক্ত হবে।

অপর এক বর্ণনায় এসেছে,

عَنْ اِبْنِ عُمَرَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ ﷺ خَالِفُوا الْمُشْرِكِين أَحْفُوا الشَّوَارِبَ وَأَوْفُوا اللِّحَى

আব্দুল্লাহ বিন উমার (রা.) কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা মুশরিকদের অন্যথাচরণ কর। তোমরা মোছ ছেঁটে ফেল এবং দাড়ি ছেড়ে দাও।

তবে এক্ষেত্রে বিবেচনার মূল বিষয় হচ্ছে, বিজাতিদের ধর্মীয় পোশাক না হওয়া বা এমন পোশাক না হওয়া যেটা ভিন্ন কোনো ধর্মের মানুষকে নির্দেশ করে। যে পোশাক বিশেষ কোনো ধর্মের নিদর্শন বহন করে না, তাদের বিশেষ সংস্কৃতিকেও নির্দেশ করে না তা পরতে অসুবিধা নেই। কেননা এতে নিষিদ্ধ সাদৃশ্য পাওয়া যায় না।

তিন.

দম্ভ ও অহংকার প্রকাশ পায় এমন পোশাক না হওয়া। অহংকার ইসলামে হারাম। সুতরাং দম্ভ সৃষ্টিকারী যে কোনো পোষাক ইসলামে হারাম। অহংকার যেমন মূল্যবান ধুতি কাপড়ে হতে পারে তেমনি ছালার চট গায়ে দিয়েও হতে পারে। কেননা অহংকার মূলত অন্তরের বিষয়। তবে পোশাকের কিছু দিক আছে যা অহংকারকে নির্দেশ করে। যেমন টাখনুর নিচে কাপড় পরিধান করা বা টাখনু ঢেকে রাখা অহংকারের নিদর্শন। জাহিলি যুগে মানুষ অহংকারবশত টাখনুর নিচে কাপড় ঝুলিয়ে রাখতো। দিওয়ানুল হামাসায় কবির একটি পংক্তিতে যা ফুটে উঠেছে।

اذا ما اصطبحت خط  مئزري 

চারটি প্রভাত পানপাত্র সাবাড় করে ফেলে যখন আমি বের হই তখন আমার চাদর মাটিতে গড়াগড়ি খেতে থাকে ।

বস্তুত ইসলাম জাহিলিয়াতের মেরুদন্ডে আঘাত করেছে। জাহিলিয়াতের অন্যান্য অসভ্যতার মতো এই অসভ্যতাও মিটিয়ে দিয়েছে। হাদিসে এসেছে :

من زر ثوبه خيلاء لم ينظر الله اليه يوم القيامه  

যে অহংকার করে কাপড় ঝুলিয়ে পরবে আল্লাহ তাআলা কেয়ামতের দিন তার দিকে তাকাবেন না।

আরেকটি হাদিসও আছে এ ব্যাপারে 

لا ينظر الله يوم القيامه الى من جر ازاره بطرا. متفق عليه

আল্লাহ কেয়ামতের দিন ঐ ব্যক্তির দিকে দৃষ্টি ফেরাবেন না যে অহংকার করে লুঙ্গি (টাখনুর নীচে)ঝুলিয়ে চলে।

চার.

তাছাড়া পুরুষের জন্য নারীদের পোশাক পরিধান করা যেমন হারাম নারীদের জন্য পুরুষের পোশাক পরিধান করা হারাম ।

لعن اللهُ المتشبهين بالنساءِ من الرجالِ والمتشبهاتِ من النساءِ بالرجالِ.

নারীদের সাজে সজ্জিত পুরুষ এবং পুরুষের সাজে সজ্জিত নারী উভয় প্রকারের উপর আল্লাহ লানত করেছেন।

পাঁচ.

পুরুষের জন্য লাল জাফরানি এবং রেশমি পোশাক পরিধান করা হারাম। ওমর (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

,لاَ تَلْبَسُوا الْحَرِيْرَ فَإِنَّهُ مَنْ لَبِسَهُ فِى الدُّنْيَا لَمْ يَلْبَسْهُ فِى الآخِرَةِ-

 ‘তোমরা রেশম পরিধান করো না। যে ব্যক্তি দুনিয়ায় রেশম পরিধান করবে, সে আখিরাতে তা পরিধান করতে পারবে না’।

এই নীতিমালার পাশাপাশি ইসলাম সবসময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর পোশাক পরিধান করতে উদ্বুদ্ধ করে। সুন্দর পোশাক সুস্থ ও সুন্দর হৃদয়ের পরিচায়ক। পোশাকের মাধ্যমে মানুষের সৌন্দর্য প্রকাশ পায় ব্যক্তিত্ব ফুটে ওঠে। তাই পোশাক হবে দৃষ্টিনন্দন। অপরিচ্ছন্ন ঘৃণার উদ্রেককারী যে কোনো পোশাক ইসলামের নীতি বহির্ভূত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

ان الله يحب ان يراء اثر نعمته على عبده رواه الترمذي

আল্লাহ তাআলা তার বান্দার উপর নেয়ামতের প্রকাশ দেখতে চান।

ان الله جميل يحب الجمال في كل شيء رواه مسلم

আল্লাহ তাআলা তো সুন্দর। প্রতিটি জিনিসেই সৌন্দর্য পছন্দ করেন। (সহীহ মুসলিম)

আমরা কোন ধরনের পোশাক পরিধান করবো?

ইসলাম কোনো জাতির উপর নির্দিষ্ট কোনো পোশাক চাপিয়ে দেয়নি। এটা ইসলামের উদারতা। ইসলাম পোশাকের ক্ষেত্রে এমন মৌলিক কিছু নীতি বলে দিয়েছে যেগুলো মেনে যেকোনো অঞ্চলের মানুষ তাদের সুবিধামতো পোশাক পরিধান করতে পারবে। এটা ইসলামের সহজাত বিধান। ইসলামের মৌলিক পোশাক নীতি ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।

তবে ইসলামের রয়েছে স্বতন্ত্র সভ্যতা ও সংস্কৃতি। ইসলামের সভ্যতা ও সংস্কৃতি সেটাই যা যুগ যুগ ধরে ইসলামের প্রতিনিধিত্ব করে আসছে। যে পোশাক পরিধানে করেছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। যে পোশাক পরিধান করেছেন সাহাবায়ে কেরাম। এবং যুগ যুগ ধরে ইসলামের আদর্শ লালনকারী সুমহান ব্যক্তিবর্গ যে পোশাক পরিধান করে আসছেন সেই পাগড়ি টুপি জুব্বা পাঞ্জাবিই ইসলামের নিদর্শন বহনকারী পোশাক। অন্য অনেক পোশাক ইসলামের নীতির আলোকে বৈধ হলেও সেগুলো ইসলামী পোশাক নয়। যে পোশাক গায়ে জড়ালে মুসলিম অমুসলিম পার্থক্য করা যায় না। যে পোশাকের কাউকে ইমামতিতে পাঠাতে ইতস্তত বোধ হয় সে পোশাক ইসলাম সম্মত বৈধ পোশাক হতে পারে কিন্তু তা ইসলামের পোশাক নয়।

অনেকেই আমাদের ওপর আপত্তি তোলে, আমরা কেন বাঙালি হয়েও চৌদ্দশ বছর পূর্বের সেকেলে সভ্যতা সংস্কৃতি লালন করি কিংবা দূর আরবের এক ব্যক্তির পোশাক কেনো নিজেদের উপর চাপিয়েছি? 

আমরা বলি,আমাদের একজন আদর্শ আছেন। যাঁর প্রতিটি কথায় প্রতিটি কাজে প্রতিটি পদক্ষেপে রয়েছে আমাদের জন্য উত্তম আদর্শ। আল্লাহ তাআলা বলেন,

 لقد كان لكم في رسول الله اسوة حسنة لمن كان يرجو الله واليوم الآخر وذكر الله ذكرا كثيرا — الاحزاب 21

আল্লাহর রাসূলের মাঝে তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ,যারা আল্লাহ এবং আখেরাতের আশা রাখে এবং বেশি বেশি আল্লাহর স্মরণ করে।

জীবনের প্রতিটি কর্মে প্রতিটি কাজে প্রতিটি পদক্ষেপে আমরা যার অনুসরণ করি। আমাদের ধর্মের এবং ইসলামের স্বতন্ত্র সভ্যতা ও সংস্কৃতিই আমরা  লালন করি, সে সভ্যতায় সজ্জিত হই। আমরা যেমন আমাদের প্রাণ থেকেও আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এবং ইসলামকে বেশি ভালোবাসি তেমনি আমাদের পোশাক ও সভ্যতার ক্ষেত্রেও আমরা আমাদের দেশীয় ও জাতীয় সভ্যতা সংস্কৃতি থেকে আমাদের নবীজি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ ও ইসলামের সভ্যতা সংস্কৃতি বেশি ভালোবাসি এবং বেশি লালন করি। আমাদের প্রাণপ্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ ব্যতীত অন্য কোন আদর্শই আমাদের কাঙ্ক্ষিত নয়। 

হযরত উসমান রা. এর ঘটনা :

হযরত ওসমান রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু সন্ধি চুক্তির লক্ষ্যে মক্কার কাফের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করতে যাচ্ছেন। ইতিহাসে যা পরিচিত ‘হুদাইবিয়ার সন্ধি’ নামে। সঙ্গে ছিলেন। তার চাচাতো ভাইও তিনি হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুকে বললেন, আপনার পরিধেয় পোশাক গোড়ালির উপরে আর মক্কার মানুষ এ ধরনের পোশাক যারা পরিধান করে তাদেরকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখে।একটু নামিয়ে নিন; তাহলে অবজ্ঞার চোখে দেখার অবকাশ তাদের থাকবে না। তখন হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বললেন, 

لا هكذا ازالة  صاحبنا رسول الله صلى الله عليه وسلم 

এমন করেননি আমাদের সঙ্গী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

(তোমার কথা শুনবো না। আমি টাখনুর নিচে কাপড় নামাবো না। কারণ আমি দেখেছি আমার প্রিয়তম রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবেই কাপড় পরিধান করেছেন)।  মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা।

ওসমান রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু কুরাইশদের সভ্যতা সংস্কৃতির কোন পরোয়া করলেন না। তিনি হযরত রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শের উপর অটল থাকলেন।  এবং আমাদের জন্য আদর্শ রেখে গেলেন, পৃথিবীর কোন সভ্যতা সংস্কৃতির কাছে সামান্য সম্মানের বিনিময়ে বা সামান্য সম্মান লাভের আশায় আমরা যেনো আমাদের প্রিয়তম নবীর আদর্শ থেকে বিচ্যুত না হই।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে ধরনের পোশাক পরতেন এবং যে ধরনের পোশাক পছন্দ করতেন সে ধরনের পোশাক পরিধান করা সুন্নত।সাদা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পছন্দের পোশাক ছিল। কালো সবুজ এবং লাল ডোরাকাটা কাপড়ও পরিধান করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাগড়ী টুপি জুব্বা পরিধান করতেন। যুগ যুগ ধরে এ পোশাকি ইসলামের প্রতিনিধিত্ব করে আসছে। এ পোশাক যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদর্শ তেমনি ইসলামের চিরন্তন সভ্যতা।

ব্যক্তিজীবনে ইসলামী পোশাকের প্রভাব:

পোশাক নিছক কোনো কাপড় নয়।  মানুষের উপর পোশাকের রয়েছে বিস্তর প্রভাব।  ভালো পোশাক মানুষকে ভালো বানায়। মানুষের মাঝে বিনয় নম্রতা শালীনতা ও দায়িত্ববোধ জাগ্রত করে। মানুষকে ভালো কাজ ও ভালো ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করে। 

মন্দ পোশাক মানুষকে মন্দ কাজে উদ্বুদ্ধ করে। মানুষকে অন্যায় অনাচার এবং অশ্লীলতার দিকে ধাবিত করে। পোশাকে ফুটে উঠে মানুষের চিন্তা চেতনা আদর্শ ও সংস্কৃতি। ইসলামী পোশাক স্রষ্টার প্রতি বান্দার আনুগত্যের নিদর্শনও বটে। বিজাতিদের রীতিনীতি ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন উপেক্ষা করে মানুষ যখন তার রবের নির্দেশিত পোশাক পরিধান করে তখন ইসলামের চির বিজয়ী আদর্শ জ্বলজ্বল করে তার বদনে। ব্যক্তি জীবনে ইসলামী পোশাকের কয়েকটি দিক এখানে আলোচনা করছি।

  • আত্মসম্মানবোধ: 

ইসলামী পোশাক মানুষের ব্যক্তিত্ব ও আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত করে। এই পোশাক পরিধান করে মানুষ এমন কোন কাজ করতে পারেনা যা তার আত্মসম্মানবোধকে নষ্ট করে দেয়। 

  • আত্মনিয়ন্ত্রণ:

ইসলামী পোশাক মানুষের চিন্তা চেতনা মন ও মনন নিয়ন্ত্রণ করে। এর মাধ্যমে ব্যক্তি লাভ করে আত্মনিয়ন্ত্রণ। ফলে পাপ কাজ থেকে বিরত থাকে। প্রকাশ্য গুনাহে লিপ্ত হওয়ার চিন্তাও করে না। ইসলামী পোশাক সাদাসিধা ও আড়ম্বরহীন হওয়ায় মানব হৃদয়ে জাগ্রত করে বিনয় ও নম্রতা।

  • রক্ষাকবচ:

ইসলামী পোশাক মানুষকে আল্লাহর নাফরমানি থেকে রক্ষা করে। পরস্পর প্রতিহিংসার আগুন থেকে বাঁচিয়ে একে অন্যের প্রতি তৈরি করে সৌহার্দ্য সম্প্রীতি ও ভালোবাসা। ইসলামী পোশাক পরিহিতদের সবাই সম্মান এবং শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখে। এটি বাঁচায় অহংকার ও আত্মম্ভরিতা। অন্যায় চুরি ডাকাতি খুন লুট ধোঁকাবাজি মিথ্যাসহ নানান খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে ব্যক্তিকে।

নারীরা ইসলামী পোশাকেই সুরক্ষিত। ইসলামী পোশাক নারীদের রক্ষা করে সকল শ্যেন দৃষ্টি থেকে। নারীদের মান-সম্মান সবকিছুই সুরক্ষিত ইসলামী পোশাকে। ইসলাম নারীদের পোশাকে কোন আবেদন বা আকর্ষণ রাখেনি। এটি নারীদের মূল্যবোধ ধরে রাখার শক্তিশালী মাধ্যম। শুধু তার দেহের আচ্ছাদন নয় বরং এটি নারীকে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চাপ থেকে রক্ষা করে। রক্ষা করে মানসিক ও আত্মিক চাপ থেকেও।

  • আল্লাহ তাআলার প্রতি ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ জাগ্রত করে:

ইসলামী পোশাক আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলার অন্যতম বহিঃপ্রকাশ। এটা মুমিনদের আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের প্রতীক। ইসলামী পোশাক আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের পোশাক হওয়ায় আল্লাহর প্রতি ভীষণ ভালোবাসা জাগ্রত হয়। মানুষের মনে জাগ্রত করে দায়িত্ববোধ। ঈমানী দায়িত্বের কথাও স্মরণ হয়। মানবিক দায়িত্বের কথাও মনে পড়ে। যিনি এই পোষাক গ্রহণ করেন সাধারণত তিনি নামাজ পড়েন, রোজা রাখেন, সালাম দেন। ইসলামী পোশাক নানাভাবে অন্তরের কলুষতা দূর করে এবং হৃদয়কে করে শুভ্র ও পরিশুদ্ধ।