ইন্দোনেশিয়া: মুসলিমদের অতীত বর্তমান ও ডাচ উপনিবেশ প্রসঙ্গ ~ আহমদ যারাফি

  • ইন্দোনেশিয়া: মাটি ও মানুষ

ইন্দোনেশিয়ার সাথে আরব মুসলিমদের পরিচয় ঘটে ইসলামের আবির্ভাবের পর। তারা এই অঞ্চলকে মিহরাজ বা জাভী দীপপুঞ্জ নামে ডাকতেন। খ্রিস্টানদের ভৌগলিক আবিষ্কারের সময় অঞ্চলটি পরিচিত হয় ‘পুর্ব ভারতীয় দীপপুঞ্জ’ নামে। তাছাড়া উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে বর্তমান ইন্দোনেশিয়া’ নামটি প্রসিদ্ধ হওয়ার আগে অঞ্চলটির আরো কয়েকটি নাম পাওয়া যায়।

‘ইন্দোনেশিয়া’ শব্দে দুটি অংশ রয়েছে। ‘ইন্দো’, যার অর্থ হিন্দ তথা ভারত। ‘নেসিয়া’ বলতে দীপপুঞ্জকে বুঝায়। ফলে ‘ইন্দোনেশিয়া’ শব্দটির অর্থ দাঁড়ায়— ভারতের দীপপুঞ্জ। দেশটির অবস্থান দক্ষিন পুর্ব এশিয়ায়। এটি ১৩৬৭৭ টি দীপ নিয়ে গঠিত। এর মধ্যে মানুষের বসবাস রয়েছে ৬০৪৪ টি দীপে। দীপগুলো বিষুব রেখা বরাবর প্রশান্ত মহাসাগর ও ভারত মহাসাগর পৃষ্ঠে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। দেশটির মোট আয়াতন প্রায় দুই মিলিয়ন (বিশ লাখ) বর্গ কিলোমিটার।

মুসলিম বিশ্বের মধ্যে ইন্দোনেশিয়া হচ্ছে বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশ। বর্তমানে দেশটির জনসংখ্যা প্রায় ২৭০ মিলিয়ন (২৭ কোটি)। এদের মধ্যে ৮৬% মুসলিম, ১০% খ্রিস্টান ( প্রোটেস্টেন্ট ও ক্যাথলিক), ২% হিন্দু, যারা প্রধানত ‘বালি’ দীপে বসবাস করে। বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা ১%। বাকীরা মূর্তিপূজক। সেখানে কিছু সংখ্যক আরবও বসবাস করে। এরা প্রধানত হাজরামি আরব। কিছু সংখ্যক ইউরোপিয়ানও রয়েছে, বিশেষত জাভায়।

ইন্দোনেশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ দীপ:

জাভা:
দীপটির আয়াতন ১,৩১,৫০০ বর্গ কিলোমিটার। মোট জনসংখ্যার ৬৫% মানুষ এখানে বসবাস করে। অনিন্দ্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের সমাহার ঘটেছে এই ভূমিতে। এখানকার মাটি খুবই উর্বর, রয়েছে বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ। জাভা দীপের প্রধান শহরগুলি হচ্ছে, জাকার্তা (রাজধানী), সুরাবায়া, বান্দুঞ্জ, কুকাজাকার্তা (কুকাজা), সামারাংগ প্রভৃতি।

সুমাত্রা:
এই দীপের আয়াতন ৪,৩০,০০০ বর্গ কিলোমিটার। জনসংখ্যার বিচারে এটি ইন্দোনেশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম দীপ। তবে আয়াতন হিসেবে এর জনসংখ্যা তুলনামূলক কম। এখানেই ‘আচেহ সাম্রাজ্য’ (Aceh Saltanate) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যারা জিহাদ ও বীরত্বের কারণে ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছে। প্রখ্যাত পর্যটক ইবনে বাতুতা আত তানজি হিজরী অষ্টম শতকে এখানে এসেছিলেন। ‘আচেহ’ প্রদেশটি এখনো তার ঐতিহ্য ও স্বকীয়তা ধরে রেখেছে।

বর্তমানে এটি ইন্দোনেশিয়ায় মুসলমানদের সবচে বড় কেন্দ্র। যদিও এখানকার মানুষ ইন্দোনেশিয়া থেকে আলাদা হওয়ার দাবী করে আসছে। সুমাত্রা দীপের উল্লেখযোগ্য শহর হচ্ছে, মায়দান, বালামবাংগ ও বাদাংগ।

বোর্নিও দীপ (কালিমান্তান)
এটি এই দীপাঞ্চলের সবচে বড় দীপ, যার মোট আয়াতন হচ্ছে, ৭,৪৬,০০০ বর্গ কিলোমিটার। বোর্নিও মূলত তিনটি অংশে বিভক্ত। এর মধ্যে ইন্দোনেশিয়া অংশের আয়াতন ৫,৩২,০০০ বর্গ কিলোমিটার।

সুলাবেসি (Sulawesi):
দীপটির আয়াতন ১,৮৫,০০০ বর্গ কিলোমিটার।

ইন্দোনেশিয়ার অধিবাসীরা জাতিগতভাবে মালয়। ইন্দোনেশিয়া ছাড়াও এজাতির গোষ্ঠির মানুষ ফিলিপাইন মালয়সহ আশপাশের অনেক দেশেই বসবাস করে। এমনকি আফ্রিকার পূর্ব দক্ষিণাঞ্চলের দেশ মাদাগাস্কারে তাদের বসবাস রয়েছে। স্বভাবজাত ভদ্রতা, বিনয় সূক্ষ্ম, অনুভূতি, পরিচ্ছন্নতা ও কঠোর পরিশ্রম মালয় জাতিগোষ্ঠির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। পৃথিবীতে সবচে বেশি মুসলিম মালয় জাতি। ইসলামের প্রতি ভালোবাসা ও আবেগেও তারা অনন্য। ইন্দোনেশিয়ার অধিবাসিরা প্রায় ৩০০ আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে। তবে বর্তমানে সেখানকার অফিসিয়াল ভাষা হচ্ছে ‘ভাষা ইন্দোনেশিয়া)। এটি মালয় ভাষারই একটি শাখা। এতে প্রচুর আরবী শব্দ রয়েছে।

ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপগুলোর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এখানে প্রচুর বৃষ্টি হয়, আর্দ্রতা অনেক বেশি, আবহাওয়া উষ্ণ আর মাটি অনেক উর্বর। রয়েছে বিপুল সংখ্যক নদ নদী, বনজঙ্গল, পাহাড়-পর্বত ও অগ্নিগিরি। ভূমিকম্পও হয় ঘনঘন।

বিপুল ও বিচিত্র প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ দেশ ইন্দোনেশিয়া। এখানে উতপন্ন হয় রাবার, চা, চিনি, কফি, সয়াবিন, নারিকেল, সয়া, তোলা, সবরকমের মশলা, সুগন্ধি ও হাজারো ধরণের ফলফ্রুট। এজন্য দেশটির উপর থেকে ইউরোপিয় উপনিবেশিকদের লোলুপ দৃষ্টি কখনো সরেনি। আগেও না, এখন না। ইন্দোনেশিয়া নিয়ে পর্তুগীজ ইস্পেন হল্যাণ্ড ও ব্রিটেনের মধ্যে তুমুল লড়াই ছিল। কিন্তু এক সময় হল্যাণ্ড এককভাবে এই মূল্যবান ‘শিকার’ দখল করে নেয়। উল্লেখ্য, হল্যাণ্ডের আয়াতন ইন্দোনেশিয়ার পঞ্চাশ ভাগের এক ভাগ। আর তাদের জনসংখ্যা ইন্দোনেশিয়ার জনসংখ্যার চার ভাগের চেয়েও কম।

  • ইন্দোনেশিয়ায় ইসলাম


ইন্দোনেশিয়ায় কবে ইসলামের বিস্তার ঘটে, এব্যাপারে সুনিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায় না।
ইন্দোনেশিয়ায় ইসলাম পৌঁছার ব্যাপারে কয়েকটি ধারণা পাওয়া যায়। এর মাঝে  সঠিক বলে যে মতটিকে মনেহয় তা হলো,হিজরি প্রথম শতাব্দীতে সুমাত্রার উপকূলীয় অঞ্চলে ইসলামের আগমন ঘটে। দ্বীপটি ছিলো সেকালে ভারত,পারস্য,জাযিরাতুল আরব ও চিনের বানিজ্যপথের মিলন কেন্দ্র। উমাবি শাসনামলে এখানে আরব মুসলিমদের বানিজ্যিক জাহাজগুলো ভিড়তো।


চিনাদের সাথে ছিলো তাদের বানিজ্যিক সম্পর্ক। একটি আরব মুসলিম অভিবাসী গোত্র কান্তুন অঞ্চলে বসবাস করতো। সেসময় তাদের সংখ্যা ছিলো এক লক্ষ। সেখান থেকে দ্বীপটির অন্যান্য অঞ্চলে ইসলাম প্রসারিত হতে থাকে। সেখানকার লোকদের ধর্ম ছিলো প্রবলভাবে হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদ দ্বারা প্রভাবিত। মুসলিমরা তাদের মাঝে ইসলামের বাণী ছড়িয়ে দিয়েছে উত্তম উপদেশ,সুন্দর আচরণ, এবং প্রজ্ঞাপূর্ণ আর্থ-সামাজিক সম্পর্কের মাধ্যমে। এভাবেই তৃতীয় শতাব্দীর প্রথমারর্ধে ইন্দোনেশিয়ায়, বরং পুরো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রথম ইসলামি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তা হচ্ছে উত্তর সুমাত্রার “বিরলাক” সাম্রাজ্য। হিজরি সপ্তম শতাব্দীর শুরুর দিকে সুমাত্রার উত্তরাঞ্চলে আচেহ সাম্রাজ্যটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এর প্রথম রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন সুলতান জিহান শাহ। তিনি মূলত আচেহ এর তীরবর্তী অঞ্চলে ইসলামের একজন প্রচারক হিসেবে এসেছিলেন। তারপর বিপুল সংখ্যক অধিবাসী তার দাওয়াত কবুল করে ইসলাম গ্রহণ করে। এবং তারা তাকে প্রভূত সম্মান প্রদর্শন করে। তিনি সেখানকার এক আমিরের মেয়েকে বিয়ে করেন। পরবর্তীতে তারা তাকে তাদের রাজা হিসেবে মনোনীত করে,এবং তিনি শ্রী বাদূকা অথবা বাদুহা সুলতান উপাধি ধারণ করেন।

এই সাম্রাজ্যের কল্যাণে ইসলাম ও এর পাশাপাশি আরবি ভাষা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এভবেই সুমাত্রা দ্বীপের অনেক অঞ্চলে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৫১১ সালে পর্তুগীজদের হাতে মালকা পতনের পর এ অঞ্চলটি মুসলিমদের সুদৃঢ় দূর্গে পরিণত হয়। ষোল শতাব্দীতে মিনানজাকাবু সাম্রাজ্য আত্মপ্রকাশ করে। এবং দ্বীপটির কিছু অংশে আধিপত্য বিস্তার করে। যদিও এখানকার গোত্রগুলো হিন্দু ধর্মের নিরাপদ দূর্গ হিসেবে বিবেচিত হতো,তবুও এখানকার অনেক মানুষই ইসলামের দাওয়াতকে সাদরে গ্রহণ করে নেয়।


ইসলাম এক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরণের চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করেছে। একপর্যায়ে এই গোত্রগুলোর অন্তরে ইসলাম শক্তির সাথে জায়গা করে নিয়েছে। মূলত একারণেই তারা যখন ঔপনিবেশিক শক্তি ও মিশনারিদের প্রতিরোধ  করেছিলো তখন সে প্রতিরোধ ছিলো ভয়ঙ্কর রক্তক্ষয়ী ও ভয়ঙ্কর।

সুমাত্রা থেকে জাভায় ইসলাম পৌঁছায় তেরো শতাব্দিতে, ‘আল্লাহর নয়জন ওলি’ নামে প্রসিদ্ধ ইসলাম প্রচারকদের হাত ধরে। শুরুতে তারা ‘দিমাক’ শহরে অবস্থান করছিলেন। এই ইসলামপ্রচারকগন অনেকগুলো মসজিদ নির্মাণের মধ্য দিয়ে তাদের দাওয়াতি কাজ শুরু করেছিলেন। ‘মসজিদে দিমাক’ হচ্ছে সেই ধারাবাহিকতার প্রথম মসজিদ, যা এখনো বিদ্যমান রয়েছে। এ শহরেই জাভার প্রথম ‘এরাবিয়ান সালতানাত’ (সালাতানাত দিমাক) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।  যার প্রথম বাদশা ছিলেন ‘রাদিন বাতাহ’ (আব্দুল ফাত্তাহ)। ষোড়শ শতাব্দিতে জাভায় ইসলামের বিকাশ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। তীরবর্তি শহরগুলোর সুলতানগন ‘মাজায়াহিত’ সাম্রাজ্যকে নির্মূল করতে জোট বদ্ধ হন। ১৫২৬ সালে একে সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করা হয়। সে সাম্রাজ্যের অনেক আমীর ইসলামগ্রহণ করেছিলেন। তার স্থানে গড়ে উঠে বেশ কয়েকটি ইসলামি সালতানাত। এর মধ্যে সবচে প্রসিদ্ধ হচ্ছে মধ্য জাভার ‘মাতারাম সালতানাত’ ও পশ্চিমে অবস্থিত ‘বানতাম সালতানাত’। এভাবে (তাসাউফ দ্বারা প্রভাবিত) ইসলাম সুমাত্রা ও জাভায় বিস্তৃতি লাভ করে। মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষের হৃদয়ে এর শিক্ষা ও চেতনা বদ্ধমূল হয়। জাভা ও সুমাত্রা এ দুই দ্বীপ থেকে ইন্দোনেশিয়ার অন্যান্য দ্বীপে ইসলাম পৌঁছে যায়। এক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের বড় ভূমিকা রয়েছে। বিশেষত ইয়েমেনের হাদরামাওত অঞ্চলের লোকদের। বিভিন্ন ইসলামি রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর ইসলাম প্রসারে জিহাদেরও অবদান ছিল। যেমন ‘বুরনিও’ ‘সুলাবিযি’ সহ বহু দ্বীপে অনেকগুলো স্বাধীন সালতানাত প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে অবশ্য ডাচরা এসব সালতানাতগুলোর রাজনৈতিক প্রভাব খতম করে দেয়।

  • ইন্দোনেশিয়ায় হল্যান্ডের আধিপত্য বিস্তার

পশ্চিম ইউরোপে অবস্থিত একটি ক্ষুদ্র দেশ হচ্ছে হল্যান্ড। এর মোট আয়াতন ৪১,৫০০ বর্গ কিলোমিটার। এক সময় দেশটি স্পেনীয় সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। ষোড়শ শতাব্দীতে ইউরোপে যখন ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন শুরু হয় তখন হল্যান্ডের অধিবাসীগন (ডাচ) ক্যালভিনপন্থি প্রোট্যাস্টান মতবাদ গ্রহণ করে। তারপর তারা ক্যাথলিক স্পেনীয়দের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ১৫৮১ সনে হল্যান্ডের স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্য দিয়ে এই বিদ্রোহের চূড়ান্ত সফলতা অর্জিত হয়।

এরপর থেকে ক্যাথলিক (স্পেনীশ-পর্তুগিজ) ও প্রোট্যাস্টানদের (ইংরেজ-ডাচ) মধ্যে ক্রমাগত নৌ যুদ্ধ চলমান ছিল। ১৫৮৮ সনে ইংরেজরা হল্যান্ডের নৌবাহিনীর সহায়তায় স্পেনের বিখ্যাত নৌবহর “আরমাদা” ধংস করতে সক্ষম হয়৷ এতে ডাচ নৌবহরের সামনে উন্মুক্ত হয়ে যায় মুসলিম বিশ্বের দক্ষিন ও পূর্ব সমুদ্রাঞ্চল। ফলে ১৫৯৬ সনে ডাচরা জাভার উপকূলীয় অঞ্চলে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। ডাচ বণিকদের তীব্র আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে ১৬০৫ সনে উপনিবেশবাদী “পূর্বভারতীয় ডাচ কোম্পানি” প্রতিষ্ঠিত হয়।  

“কোম্পানি’ শব্দটির কারণে পাঠক যেন ধোকায় না পড়েন। কেননা (নামে কোম্পানি হলেও) প্রকৃতপক্ষে এটি ছিল একটি অস্ত্র সজ্জিত যোদ্ধা বাহিনী। যাদের প্রধান কাজ হচ্ছে লুট-তরাজ ও ছিনতাই করা।” হল্যান্ড সরকার এই কোম্পানিকে বিপুল ক্ষমতা ও অধিকার দিয়েছিল। যেমন, রাজা-বাদশা ও সুলতানদের সাথে চুক্তি সম্পাদন করা, যুদ্ধ ও শান্তি চুক্তি, দূর্গ নির্মাণ, অপরাধীদের উপর শাস্তি প্রয়োগ, গভর্নর, সেনাপতি ও বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা নিয়োগ করা প্রভৃতি। ফলকথা কোম্পানিটির পরিচালনা পরিষদ একটি রাষ্ট্রের যোগ্যতা ও ক্ষমতা ধারণ করত।

এই অঞ্চলে ডাচরা এসেছিল পর্তুগিজদের আগমনের প্রায় নব্বই বছর পর। পর্তুগিজরা এই সময়ের মধ্যে অঞ্চলটিতে অপরাধ ও জুলুমের সকল সীমারেখা অতিক্রম করেছিল। বিশেষত মুসলিমদের সাথে এমন আচরণ করতে তাদের প্ররোচিত করেছিল ক্রুসেডিয় বিদ্বেষ। ফলে পর্তুগিজদের ব্যপারে মানুষ বিরক্ত হয়ে উঠেছিল। তারা মুসলিমদের নিজেদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলেছিল। ফলে ওলন্দাজরা যখন এ অঞ্চলে আগমন করল তারা এই সুযোগটির পূর্ণ ব্যবহার করল। অঞ্চল্টির মানুষকে পর্তুগিজদের নিপীড়ন থেকে ত্রাণকর্তা হিসেবে তারা অবতীর্ণ হল। তারা পর্তুগিজদের সাথে লড়াই করে তাদের পরাজিত করল। অবশেষে ওলন্দাজরা এদেশের মানুষের সহযোগিতায় পর্তুগিজদের পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ থেকে বের করতে এবং তাদের দূর্গগুলো দখল করতে সক্ষম হয়। পরে এককভাবে করায়ত্ব করে নিল মূল্যবান এই শিকার। তারপর ইস্ট ইন্ডিয়ান ওলন্দাজ কোম্পানিটি ইন্দোনেশিয়ার সম্পদ ছিন্তাই ও লুন্ঠন করতে শুরু করে দিল। জমি মালিকানা নিল। দূর্গ নির্মাণ করল। ব্যবসার নামে সেনাবাহিনী ও নৌবহর তৈরি করল। অবশেষে ১৮০০ সালে হল্যাণ্ড সরকার নিজেই সকল নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে নেয়।

তবে যখন থেকে পর্তুগিজ এবং পরবর্তিতে ওলান্দাজরা ইন্দোনেশিয়ায় আক্রমণ করতে এসেছে তারা মুসলিমদের পক্ষ থেকে তীব্র প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়েছে। ১৫১১ সালে পর্তুগিজরা ‘মালকা ইসলামি সালতানাতে’র পতন ঘটায়। তখন সুমাত্রার ‘আতেশিয়া’ সালতানাত তাদের বিরুদ্ধে জিহাদার ঝাণ্ডা উচু করে। ওলন্দাজদের সাথেও তাদের জিহাদে অবতীর্ণ হয়েছিল এবং অনেকবার তাদের পিছু হটিয়ে দিয়েছে। তবে শেষপর্যন্ত ওলন্দাজরা ইন্দোনেশিয়ার সবগুলো ইসলামি সালতানাতে একের পর এক নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়। কখনো অস্ত্র ও শক্তির জোরে, কখনো বা ছলছাতুরি ও কূটকৌশল অবলম্বন করে। আবার অনেক সময় এক সালতানাতকে আরেক সালতানাতের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত করে উভয়ের শক্তি খর্ব করেছে। তাছাড়া কিছু সালতানাতের সাথে ‘বন্ধুত্ব’র চুক্তি করেছে, যার সমাপ্তি হতো সে সালতানাত দখল করার মধ্য দিয়ে।

তারপর ওলন্দাজ উপনিবেশের বিরুদ্ধে অনেকগুলো বিদ্রোহ হয়েছে, যার নেতৃত্বে ছিলেন সুন্নি আলেমগন। এর মধ্যে সবচে প্রসিদ্ধ হচ্ছে জাভায় ১৬৭৬ সালে শায়খ তুরুনু জুউইর বিদ্রোহ। এটি ওলন্দাজ ও বিশ্বাসঘাতক সুলতান মাতারাম মানকুরাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছিল। জাভাতেই ১৮২৫ সালে শায়েখ দিবুনজুরুর নেতৃত্বে আরেকটি বিদ্রোহ হয়, যা তাদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি ঘটিয়েছিল এবং ১৮৩০ সালের আগে একে তারা দমন করতে পারেনি।  তাও শায়েখকে তারা দ্বিপাক্ষিক সংলাপ চলাকালীন (?) গ্রেপ্তার করে। এ সময়ের আগে পরে আরেকটি বিদ্রোহ হচ্ছিল সুমাত্রায়। এটি হল বাদরি গোত্রের (জমিয়তে বাইদা) বিদ্রোহ, যার নেতৃত্বে ছিলেন শায়েখ মুস্তাফা সাহহাব। বিদ্রোহটির সূচনা ১৯২১ সালে এবং সমাপ্তি ঘটে ১৮৩৭ সালে। এই বিদ্রোহ শেষ হতে না হতেই ‘আতেশিয়া সালতানাত’ ওলন্দাজদের বিরুদ্ধে নতুন করে জিহাদ শুরু করে। নেতৃত্বে ছিলেন ইবরাহীম মানসুর। ১৮৭৪ সাল পর্যন্ত এই জিহাদ চলমান ছিল। তারপর জিহাদের ঝাণ্ডা উত্তোলন করলেন টেঙ্কু উমর। তিনি ১৮৯৯ সালে নিহত হলেন। তবে প্রতিরোধ সংগ্রাম ১৯০৪ সাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। পরে ‘আতেশিয়া’ও ওলন্দাজদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। আর তখনই পুরো ইন্দোনেশিয়ান দ্বীপপুঞ্জে ওলন্দাজদের কর্তৃত্ব পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়।

  • ইন্দোনেশিয়ায় ওলন্দাজ উপনিবেশবাদি রাজনীতি

ইন্দোনেশিয়ায় ওলন্দাজ আক্রমণ শুধুমাত্র সেখানকার ধন-সম্পদ লুন্ঠন করার উদ্দেশ্যে ছিল না। ধন সম্পদ লুন্ঠনের পাশাপাশি এটি ছিল একটি ক্রোসেড যুদ্ধও। যার টার্গেট ইন্দোনেশিয়ান মুসলিমদের খ্রিস্টান বানানো। এজন্য ইন্দোনেশিয়ায় ওলন্দাজ উপনিবেশবাদি রাজনীতি নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করে—

  • অর্থনৈতিক লুন্ঠন ও কর্তৃত্ববাদি রাজনীতি

ইন্দোনেশিয়ার বিপুল ধনসম্পদ লুন্ঠনে ওলন্দাজরা প্রথমেই মনোনিবেশ করেছে। ইউরোপের প্রয়োজন এমন শষ্য-ফসল, যেমন, কফি, রাবার, চা, দারুচিনি, এসব চাষ করার জন্য তারা ক্ষেত খামার তৈরি করল। স্থানীয় বাসিন্দাদের জোর পূর্বক সেখানে কাজ করতে বাধ্য করতো। ওলন্দাজরা তাদের পশুর মত দেখত। ‘খাঁটো’ বলে ডাকতো, তাচ্ছিল্য করে। অর্থনৈতিক বিধ্বংসী পলিসির কারণে অনেকগুলো দূর্ভিক্ষ সৃষ্টি হয়েছে। শুধু ‘সিমারাঞ্জে’ই এক দূর্ভিক্ষে ১৮৪৯ থেকে ১৮৫০ সালে মারা গেছে এক লক্ষ মানুষ।

ইন্দোনেশিয়ার মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষের রক্ত ক্ষুধা ও কষ্টের উপর হল্যাণ্ড তৈরি করেছে তার জাতির জন্য আয়েশী জীবনের ইমারত, যাদের সংখ্যা দুই মিলিয়নও ছিল না। এভাবে আমস্টারড্যাম ও নটরড্যাম ১৬০০ থেকে ১৮০০ সালে ইউরোপের সবচে সুন্দর, সবচে ধনী অঞ্চল হিসেবে গণ্য হতো।

দখলদার ওলন্দাজরা জাভায় সর্বশক্তি দিয়ে কাজ করেছে। জাভায় সবচে বেশি মানুষের বসবাস। এটিই প্রতিরোধশক্তিতে উজ্জীবিত ইসলামি শক্তির কেন্দ্র। সেখানে ১৬১৯ সালে ‘বাতাফিয়া’ দূর্গকে হল্যাণ্ড নিজেদের কেন্দ্র হিসেবে গ্রহণ করল। আর অন্যান্য দ্বীপগুলো আঞ্চলিক সুলতানদের অধীনে রেখে দিল, যাদের সাথে তাদের বিভিন্ন চুক্তি ছিল। ওলন্দাজরা সকল ইসলামি সরকারের সাথে মুসলিমদের সম্পর্ক ছিন্ন করে দিয়েছিল।

ইন্দোনেশিয়ায় নিজেদের অবস্থান মজবুত করার জন্য উপনিবেশ শক্তি নির্ভর করেছিল বিভিন্ন সংখ্যালঘুদের উপর, যেমন, হিন্দু বৌদ্ধ মূর্তিপূজারি ও বাতেনী সম্প্রদায়। তাদের গ্রহণ করেছিল বন্ধু ও সহযোগি হিসেবে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা প্রতিরোধকারি শক্তিগুলোকে দমন করার লক্ষ্যে ওলন্দাজরা এই সংখ্যালঘুদের দিয়ে একটি বাহিনী গড়ে তুলে। ফলে ইন্দোনেশিয়ায় এমন একটি গোষ্ঠি তৈরি হয়ে গেল যারা উপনিবেশকে আপন মনে করে ধারণ করল, তাদের ভাষা গ্রহণ করে নিল, নিজেদের সন্তানদের নামও ওলন্দাজদের মত রাখল। মোটকথা নিজেদেরকে একেবারে ওলন্দাজদের ছাঁচে ঢেলে সাজাল।

‘বিভেদ করো, শাসন করো’ (Divide and Role) মূলনীতিকে ব্যবহার করে ইন্দোনেশিয়ার বিভিন্ন গোত্রের মাঝে সাম্প্রদায়িকতার আগুন জ্বালিয়েছে উপনিবেশিকরা। এই সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল। এমনকি হাদারামাউত থেকে আসা লোকদের মধ্যেও এটি ছড়িয়ে পড়ে। তারা নানা রকম দলে বিভক্ত হয়ে যায়, শ্রেণি, গোত্র ও অঞ্চলভিত্তিক। এমনকি শত্রুতা বশতঃ একে অন্যের ক্ষতি করার জন্য দখলদারকে সাহায্য পর্যন্ত করতে শুরু করে দেয়। বিভিন্ন দল তৈরি হওয়ার পর দখলদার শক্তি হলাণ্ড কমিউনিস্ট ও ধর্মনিরপেক্ষদের জন্য সুযোগ করে দেয়, যেন তারা ছাত্র ও শ্রমিক সমাজের সাথে যোগাযোগ তৈরি করতে পারে। অপরদিকে মুসলিম নেতৃবৃন্দদের আটক করে জেল দেয়া হয়। এভাবে কমিউনিস্ট ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদিরা ইন্দোনেশিয়ার রাজনীতিতে আবির্ভূত হয় প্রধান শক্তি হিসেবে। স্বাধীনতাকামী সরল মানুষদের তারা অনেক প্রতিশ্রুতি দিতে থাকে, তাদের কাছে বিক্রি করে অলীক স্বপ্ন ও কল্পনা।

  • বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই ও সাংস্কৃতিক সন্ত্রাস

ইন্দোনেশিয়ানদের উপর হলাণ্ড তার সংস্কৃতি ও ভাষা চাপিয়ে দেয়। ১৬১৭ সালে ইন্দোনেশিয়ায় প্রথম ওলান্দাজ স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয় এবং হলাণ্ড থেকে এখানে অভিবাসি হওয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়। এভাবে তাদের ভাষাটি ইন্দোনেশিয়ার প্রধান ভাষায় পরিণত হয়। নার্সারি থেকে ইউনোভার্সিটি, সর্বত্র পাঠদানের ভাষা হিসেবে গৃহীত হয় ওলন্দাজ  ভাষা। তা স্বত্ত্বেও সরকারি শিক্ষা উচ্চশ্রেণি ও উপনিবেশ চাটুকারদের সন্তানের সীমাবদ্ধ ছিল। যাতে করে, তাদের মগজধোলাই ও ওলন্দাজ সংস্কৃতিকে পূর্ণভাবে গ্রহণ করার পর সরকারি চাকুরীজীবি হতে পারে।

ওলন্দাজরা যখন এদেশে আসে তখন দেশীয় নিজস্ব শিক্ষাব্যবস্থা বেশ সমৃদ্ধ ছিল, অধিকাংশ মানুষ পড়তে ও লিখতে পারত। কিন্তু তারা বেশির ভাগ দেশীয় বিদ্যালয় বন্ধ করে দিল। বাকীগুলোর সিলেবাসে আনলো ব্যাপক পরিবর্তন। ইন্দোনেশিয়ান ভাষার মূল লিপিকে আরবী থেকে ল্যাটিন লিপি দ্বারা পরিবর্তন করে দিল।

শিক্ষা ক্ষেত্রে ওলন্দাজদের একটি পলিসি এটাও ছিল, হল্যাণ্ডের ইউনোভার্সিটিগুলোতে তারা ইন্দোনেশিয়া থেকে শিক্ষার্থীদের পাঠাতো, চেতনা ও আদর্শে এবং বাহ্যিক বেশভূষায় যাতে তাদের পশ্চিমা ধাঁচে গড়ে তোলা যায়। যেন পরবর্তিতে তারা নিজ দেশস পশ্চিমা চিন্তার ফেরি করে এবং ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা পালন করে।

আর এখান থেকেই বিদেশি সভ্যতা-সংস্কৃতি ও ওলন্দাজ ভাষা ইন্দোনেশিয়ায় প্রতিষ্ঠা লাভ করে। মুসলিমদের এমন একটি প্রজন্ম গড়ে উঠে যাদের বেশির ভাগের অবস্থা হল, তারা নিজেদের আইডেন্টিটি বা মূল পরিচয় সম্পর্কে অজ্ঞ। নতুন প্রজন্মকে নিজ ধর্ম থেকে দূরে সরানোর জন্য বিশেষ প্ল্যানও গ্রহণ করে ওলন্দাজরা। আঞ্চলিক বিভিন্ন বাকরীতিকেও নতুন করে প্রাণ সঞ্চারিত করে, জাতির এক অংশকে অন্য অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করার উদ্দেশ্যে। ওলন্দাজ সরকারি স্কুল ও খ্রিষ্টান মিশনারি স্কুলগুলোর মধ্যে একটা মেলবন্ধন ও সাযুজ্য ছিল। প্রথম প্রকারের স্কুলগুলো এমন প্রজন্ম তৈরি করতো যারা তাদের ধর্ম সম্পর্কে কিছুই জানতো না। আবার মিশনারি স্কুলগুলো কাজ করতো ছাত্রদের খ্রিস্টান বানাতে।

অপরদিকে বাতেনি সংগঠনগুলোকে অবাধ বিচরণের সুযোগ করে দেয় হল্যাণ্ড। তারা হিন্দু বৌদ্ধ ও পৌত্তলিকদের বিলীন হয়ে যাওয়া আচার-সংস্কৃতি পূনর্জীবিত করতে শুরু করল। ‘বিদআত আশ্রিত তাসাউফ’ও ওলন্দাজদের আনুকল্য অর্জন করেছিল। এই তাসাউফ চর্চাকারিরা জিহাদকে সে সময় জরুরী মনে করতো না। উলটো উপনিবেশিক ক্রোসেডারদের ক্ষমতা সুসংহত করার আহবানও জানাতো। তাদের যুক্তি ছিল, উপনিবেশ এখন অনস্বীকার্য বাস্তবতা হয়ে গেছে।উপনিবেশ সরকারের উপদেষ্টা ওলন্দাজ ক্রোসেডীয় প্রাচ্যবিদ হুরগ্রোনিয়া (১৮৫৭-১৯৩৬) এক্ষেত্রে নিকৃষ্ট ভূমিকা পালন করেছেন।

  • খ্রিস্টান বানানোর আগ্রাসী আক্রমণ

ইন্দোনেশিয়ায় ওলন্দাজ উপনিবেশিকরা প্রথম গির্জাটি নির্মাণ করে ১৬২৪ সালে। তারপর খ্রিস্টান মিশনারীরা যেন স্বাধীনভাবে মুসলিম ও অমুসলিমদের খ্রিস্টান বানাতে পারে এর সমূহ ব্যবস্থা করে দেয়। তারা এদেরকে আর্থিক ও প্রাশাসনিক সমর্থন যোগায়। এই মিশনগুলোতে কাজ করত পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত অগনিত পাদ্রীরা। তারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। 

মিশনারীগুলো মূর্তিপূজক ও আদিম সমাজকে (primitive society) খ্রিস্টান বানানোর চে’ মুসলমানদের ধর্মান্তরিত করার প্রতি বেশি মনোযোগী হয়। এভাবে দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে তারা তাদের স্বকীয় জাতীয় পরিচয় মুছে দিতে সচেষ্ট হয়। ধর্মান্তরিত করার এই তৎপরতায় ক্যাথলিক ও প্রটেস্টেন মিশনারীদের মধ্যে চরম প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করা যেত।

এক্ষেত্রে তাদেরকে সহযোগিতা করেছিল মালায়ন মুসলিমদের উদারতা। মিশনারীগুলো এই উদারতাকে জঘন্যভাবে কাজে লাগিয়েছিল। ফলে তারা মুসলিম বসতি পূর্ণ অঞ্চল সমূহে ক্রমাগত নির্মাণ করে যাচ্ছিল বিশালাকার গির্জা, আশ্রয়কেন্দ্র, এতিমখানা ও বৃদ্ধাশ্রম।

এভাবে দেশের নানা অঞ্চলে মিশনারী স্কুলগুলো ছড়িয়ে পড়ে। এবং এসব প্রতিষ্ঠান দারিদ্র পীড়িত ইন্দোনেশিয়ান যুবকদের জন্য দরজা উন্মুক্ত করে দেয়। ফলে বিপুল সংখ্যক তরুণকে তাদের দলে ভেড়াতে সক্ষম হয়। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, রাষ্ট্র পর্যাপ্ত বিদ্যালয় বানাতে সক্ষম ছিল না। কারণ হল্যাণ্ড ইচ্ছাকৃতভাবে এ অঞ্চলকে দারিদ্রগ্রস্থ করে রেখেছিল। তার আগে শাসক শ্রেণি সবকিছু কুক্ষিগত করে রাখত। উপরন্তু মিশনারি স্কুলগুলো হল্যাণ্ড ছাড়াও অন্যান্য পশ্চিমা দেশ থেকে সাহায্য পেত। যেমন কানাডা ফ্রান্স ভ্যাটিকান আমেরিক ও জার্মানি। এসব কারণে মিশনারিরা মুসলিম অধ্যূষিত অঞ্চলে অবস্থিত জমি ক্রয় করার জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় করত। তারপর সেখানে নির্মাণ করত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও মিশনারি কেন্দ্র। ফলে যে ইন্দোনেশিয়া বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্ম ছুড়ে ফেলেছিল কালের পরিক্রমায় সে দেশই মিশনারিদের ভয়াল স্রোতের মুখে পড়ে গেল! মিশনারিরা উদ্ভূত পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে মানুষের অন্তর জগতে অভিযান পরিচালনা করতে সক্ষম হল এবং দুর্বল চিত্তের মানুষদের কিনে ফেলল!

জাতীয় আন্দোলন ও স্বাধীনতা অর্জন

বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ইন্দোনেশিয়ায় বেশ কিছু ইসলামি সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে। এর মধ্যে শারিকা ইসলামী, জমিয়াত আল খায়ের, সর্বমুসলিম আন্দোলন অন্যতম। মুসলিমদের জাগরণ এবং ডাচদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগ্রাম পরিচালনা করা ছিল তাদের মূল লক্ষ্য।

এই ইসলামী সংগঠনগুলোকে প্রতিহত করার লক্ষ্যে ডাচরা দুই ধারার আন্দোলন দাঁড় করিয়েছিল। এক. জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, দুই. মার্ক্সবাদী আন্দোলন। ফলে এ জাতীয় অনেকগুলো সংগঠন দৃশ্যপটে হাজির হয়। যেমন বাতেনী মতাদর্শে বিশ্বাসী আহমদ সুকারনাবী (১৯০১-১৯৭০) প্রতিষ্ঠিত জাতীয়তাবাদি দল, মার্ক্সবাদী সমাজতান্ত্রিক দল, গণতান্ত্রিক সোশালিস্ট দল প্রভৃতি। দলগুলোর প্রধান কাজ ছিল মুসলমানদের ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাংখা ও ইচ্ছাকে মূলোৎপাটন করা। হবু রাষ্ট্রের পরিচয় কী হবে, বিষয়টি পর্যালোচনা করার জন্য ১৯৪৫ সালে যখন ‘স্বাধীনতা কমিটি’ গঠিত হয়

ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের কাছে অন্য কোন ধর্মের দাওয়াত দেয়া যাবে না, এই মর্মে তার সরকার একটি প্রজ্ঞাপন জারী করেছিল। পরবর্তীতে দেখা গেল, এই প্রজ্ঞাপনের পেছনে মূল লক্ষ ছিল দাওয়াতি কাজ থেকে মুসলমানদের নিবৃত করা। কেননা এই প্রজ্ঞাপনের পর থেকেই খ্রিষ্ট ধর্মে দীক্ষিত করার তৎপরতা পুরো ইন্দোনেশিয়া জুড়ে ভয়ানক আকার ধারণ করেছিল।
আমেরিকার মিত্র, জেনারেল সুহারতাউ’র শাসনামলে (১৯৬৭-১৯৯৮) দেশে খ্রিস্টানদের প্রভাব বেড়ে যায়। তারা গণমাধ্যম ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন সেক্টরে জেঁকে বসেছিল। অপরদিকে আমেরিকা অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে প্রোট্যাস্টান ও ক্যথলিক মিশনারী সংস্থা আসতে থাকে। খ্রিস্ট ধর্ম প্রচার করার জন্য প্রতিটি গ্রুপের ছিল নিজস্ব অফিস ও বেতার কেন্দ্র ও হেলিকপ্টার, যা মিশনারীর লোকদের এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে স্থানান্তরিত করত। আর ছিল অগনিত মিডিয়া ও প্রচার মাধ্যম।

১৯৭৫ সনে জাকার্তায় অতি গুরুত্বপূর্ণ  একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এতে তিন হাজার খ্রিস্টান পাদ্রী অংশ গ্রহণ করে। একে কেন্দ্র খ্রিস্টানদের হার হুর হুর করে বেড়ে যায়। ১৯৩৩ সনে তাদের সংখ্যা যেখানে ছিল মোট জনসংখ্যার ৩%,  ১৯৮১ সনে সেটা ৯% এ উত্তীর্ণ হয়। অবশেষে ইন্দোনেশিয়ায় খ্রিস্টান মিশনারীদের বিরামহীন তৎপরতার ফল হিসেবে ১৯৯৯ সনে তারা পূর্ব তৈয়মুরকে বিচ্ছিন্ন করে নেয়।
১৯৭৯ সালে “শিয়া বিপ্লবের” পর ইন্দোনেশিয়া হয়ে উঠেছিল এই বিপ্লব আমদানির গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। প্রতিবছর ইরান থেকে হাজার হাজার ইন্দোনেশিয়ান ছাত্র শিক্ষা সমাপন করে নিজ দেশে ফিরে যায়। তাছাড়া এদেশে রয়েছে শিয়াদের বিশ্ববিদ্যালয় ও বহু মিডিয়া।

ইন্দোনেশিয়ার উত্তম এই মুসলিম জাতিকে এখন পর্যন্ত পরিকল্পিতভাবে দরিদ্র করে রাখার প্রচেষ্টা চলমান। বরং উপনিবেশ আমলের চেয়ে বর্তমান সময়ে এটি আরো ভয়াবহ রুপ ধারণ করেছে। ইন্দোনেশিয়ার অর্থনীতি ভেংগে দেয়া হয়েছে। ১৯৯৬ সনে সেখানকার “শিল্প জাগরণ”কে আঘাত করা হয়েছে। দেশের ৭০%  অর্থনীতি চীনাদের দখলে রয়েছে। আর সেখানকার মোট ৪২ টি অর্থনৈতিক ইউনিয়নের মধ্যে ৬৫% এর মালিকানা অমুসলিমদের হাতে। অপরদিকে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে রয়েছে খ্রিস্টান হিন্দু বৌদ্ধ শিয়া বাতেনী সম্প্রদায় ইহুদী ও সেক্যুলারদের ক্রমাগত আক্রমণ। তাছাড়া খোদ ইসলামের নামেও মাজারপন্থি সূফিদের অপতৎপরতা চোখে পড়ার মত।

(আহমদ যারাফির এই লেখাটি ‘মাজাল্লাতুল বায়ানে’ প্রকাশিত হয়েছে। আরবী থেকে অনুবাদ করেছেন আনাস চৌধুরী। ‘মাসিক নেয়ামতে’র সৌজন্যে ‘রিওয়ায়াহ’ প্রকাশ করছে।)

Picture of আনাস চৌধুরী
আনাস চৌধুরী
আনাস চৌধুরীর জন্ম নব্বইয়ের শেষ দিকে, হবিগঞ্জ সদরে। পড়াশোনা করেছেন ঢাকার জামিয়াতুল উলুমিল ইসলামিয়াতে। পরবর্তিতে দারুল উলুম দেওবন্দেও অধ্যয়ন করেছেন এক বছর। পেশায় তিনি একজন শিক্ষক, হবিগঞ্জের দারুল ইরশাদ বহুলা মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করছেন। লেখালেখি, অনুবাদ ও দ্বীনি আলোচনাতেও তার অংশগ্রহণ রয়েছে। বাংলা ও আরবীতে অনুবাদ করেছেন বেশ কিছু বই। ইতিমধ্যে কয়েকটি প্রকাশিত হয়েছে।
লেখকের অন্যান্য লেখা

সূচিপত্র

সর্বাধিক পঠিত
উত্তম আখলাক: অনন্য ছয়টি মর্যাদা
হাদিস শাস্ত্রের প্রাচ্যবাদী বয়ান এবং মুসলিম সমাজে এর প্রভাব
নকল মূদ্রা: শব্দের খোলসে মতাদর্শ ~ আব্দুল্লাহ আন্দালুসি
দ্যা ফোরটি রুলস অফ লাভ: সুফিবাদের ইউটোপিয়া
ইয়াহইয়া সিনওয়ার: শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত লড়ে গেছেন যিনি
পরামর্শ বা মাশওয়ারা: ইসলামের অনুপম এক নির্দেশনা