ইসলামের বৈশিষ্ট্য ও স্বকীয়তা

আমরা লক্ষ করলে দেখব, প্রতিটি বস্তুরই কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্র্য রয়েছে। এগুলো বস্তুটিকে একটি আলাদা পরিচয় দান করে এবং অন্যান্য বস্তু থেকে স্বতন্ত্র ও নিজস্ব সত্তা হিসেবে উপস্থাপন করে।এর আবশ্যিক দাবী হচ্ছে, এই বিষয়গুলো শুধু সেই বস্তুটিতেই পাওয়া যাবে, অন্য কোথাও পাওয়া যাবে না।আমাদের চারপাশে দৃশ্যমান প্রতিটি জিনিষের ক্ষেত্রে একথা সত্য। এমনিভাবে প্রতিটি মানুষ, জাতি, সম্প্রদায়, ধর্ম দর্শন জীবন ব্যবস্থা— সব কিছুরই পরিচয়মূলক কিছু স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র রয়েছে। সেই হিসেবে আমাদের ধর্ম ইসলামেরও একাধিক স্বকীয়তা ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যেগুলো ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম-দর্শন বা জীবন ব্যবস্থায় পাওয়া যায় না। চাই সেই ধর্ম-দর্শন শুরু থেকেই মানবরচিত হোক কিংবা পরবর্তিতে মানুষের হাতে বিকৃত হয়ে থাকুক।

মুসলিম হিসেবে ইসলামের পরিচয়মূলক এই বৈশিষ্ট্য ও স্বকীয়তাগুলো শুদ্ধভাবে জানা থাকা অতীব জরুরী একটি বিষয়। এর একটি কারণ হচ্ছে,

  • এই অবগতির মাধ্যমে আমাদের চর্চিত ইসলামে তার মৌলিক বৈশিষ্ট্য ও স্বকীয়তাগুলো বিদ্যমান আছে কি না, এটি যাচাই করা সম্ভব হবে। এতে করে আমরা শুদ্ধভাবে ইসলামকে ধারণ করতে সক্ষম হব।
  • বিপরীতে, ইসলামের এই স্বকীয়তাগুলো সম্পর্কে জানা না থাকলে, আমাদের চর্চিত ইসলাম এবং কুরআন হাদীসে ইসলামের যে কাঠামো বর্ণনা করা হয়েছে, এদুয়ের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান সৃষ্টি হবে। ফলে ইসলাম পালন করে ইহকালীন ও পরকালীন যে সাফল্য অর্জন করার কথা ছিল তা হয়তো অর্জিত হবে না।
  • তাছাড়া বিভিন্ন সময় ইসলামকে বিকৃত বা ভুলভাবে উপস্থাপন করার যে অপচেষ্টা চলে আসছে, এবিষয়ে সচেতন থাকার একটি মজবুত মাধ্যম আমরা অর্জন করতে পারব।

তবে পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, ইসলামের মৌলিক পরিচয় ও স্বকীয়তা বর্ণনার ক্ষেত্রে অনেক লেখক ও চিন্তক বিভ্রান্তির স্বীকার হয়েছেন। ইসলামের মৌলিক উতসের পরিবর্তে তারা পরিবেশ প্রতিবেশ সমাজ ও বৈশ্বিকপরিমন্ডলে প্রচলিত বিভিন্ন মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ইসলামের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে চেয়েছেন। জগদ্বিখ্যাত পন্ডিত আলেমে দ্বীন আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী রহ-এর মতে, যেহেতু আমরা নবী রাসূলের মাধ্যমেই ইসলাম পেয়েছি, তাই ইসলামের বৈশিষ্ট্য ও স্বকীয়তাও তাঁদের বক্তব্য ও শিক্ষা থেকেই গ্রহণ করতে হবে। আর সর্বশেষ নবী মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষা একমাত্র কুরআন ও হাদীসে সংরক্ষিত রয়েছে। অতএব ইসলামের স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্য কুরআন হাদীসের আলোকেই বুঝা ও উপস্থাপন করা আবশ্যক। (আল আকীদাতু ওয়াল ইবাদাতু ওয়াসসুলুক, পৃঃ ৯)

কুরআন হাদীসের আলোকে ইসলামের পরিচয়মূলক বৈশিষ্ট্য স্বাতন্ত্র ও স্বকীয়তাগুলো কী কী, সংক্ষেপে এর ধারাবাহিক একটি বিবরণ তুলে ধরছি।

  • প্রথম প্রধাণ বৈশিষ্ট্যইসলাম ইসলামি সকল শিক্ষা বিধিবিধান আল্লাহপ্রদত্ত্ব

ইসলামের উৎস আল্লাহ তায়ালা। ইসলামি যত আকীদা বিশ্বাস বিধিবিধান নির্দেশনা ও শিক্ষা রয়েছে এর সবটাই মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ অহী নির্ভর। যে অহী বা প্রত্যাদেশ তিনি সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর পাঠিয়েছেন, এর উপর ভিত্তি করেই ইসলামের সব বিষয় প্রণীত হয়েছে। ইসলামের এই বৈশিষ্ট্যের কথা কুরআন হাদীসের অসংখ্য স্থানে বিষদভাবে বর্ণিত হয়েছে।আল্লাহ তায়ালা বলেন,

হে মানব সম্প্রদায়, আল্লাহর পক্ষ থেকে সত্য নিয়ে তোমাদের নিকট রাসুল তো এসেছেন। (সুরা নিসাঃ ১৭০)

তিনি মনগড়া (নিজের পক্ষ থেকে) কথা বলেন না। এতো কেবলই অহী, যা তাঁর নিকট পাঠানো হয়। (সুরা নাজমঃ আয়াতঃ৩-৪)

কিতাবের অবতরণ জগতসমূহের প্রতিপালকের পক্ষে থেকে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। (সুরা সিজদাঃ আয়াত ২)

ইসলামের সব কিছু আল্লাহ প্রদত্ত্ব হওয়ার বৈশিষ্ট্যটি ইসলাম ব্যতিত অন্য কোনো ধর্ম দর্শন মতবাদ বা জীবনব্যবস্থার ক্ষেত্রে অনুপস্থিত।এর কারণ হচ্ছে, ইসলামের বাইরে যত ধর্ম দর্শন আছে, এগুলো মোটা দাগে দুইভাগে বিভক্ত।

এক—বেশির ভাগ ধর্ম শুরু থেকেই মানব রচিত, মানুষের মস্তিষ্ক ও কল্পনার ফসল। নিজেরা চিন্তা ভাবনা করে বা প্রচলন থেকে গ্রহণ করে নিয়েছে।ফলে এগুলো আল্লাহপ্রদত্ত্ব হওয়ার প্রশ্নই উঠে না।

দুই—কিছু ধর্ম আছে যেগুলো শুরুতে আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ অহী নির্ভর ছিল।যেমন ইহুদী ও খৃষ্ট ধর্ম। কিন্তু খুব দ্রুতই এ ধর্মগুলো বিকৃতির শিকার হয়েছে। এবং এখনো বিকৃত অবস্থায় রয়েছে। ফলে পরিণতির বিচারে মানবরচিত ধর্ম এবং পরবর্তীতে বিকৃত হওয়া ধর্মের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যবধান থাকেনি।

ইসলামের যাবতীয় বিষয় আল্লাহ প্রদত্ত্ব হওয়ার ফলাফল অনেক গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ। এটি একটি দীর্ঘ আলোচ্যবিষয়। এখানে আমরা শুধু তিনটি ফলাফল তুলে ধরছি।

প্রথম ফলাফল—যেহেতু আল্লাহ তায়ালা পুরো বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা, আমাদের দেখা ও অদেখা সবকিছু একমাত্র তাঁরই সৃষ্টি, তিনিই একমাত্র সত্তা যিনি সীমাহীন ও পরিব্যপ্ত জ্ঞানের অধিকারী, তাই এই পৃথিবী ও পৃথিবীর মানুষের জন্য কোন জীবন ব্যবস্থা ও বিধান সবচে উপযোগী ও উপকারী, এটি তিনিই সবচে’ ভালো ও সবচে’ সঠিকভাবে জানেন। কুরআন শরীফে একাধিক আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বিষয়টি বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন,

যিনি (সবকিছু) সৃষ্টি করেছেন, তিনি জানবেন না? অথচ তিনি তো সূক্ষ্ণদর্শী, সম্যকজ্ঞানের অধিকারি। (সুরা মুলকঃ আয়াত ১৪)

আল্লাহ মানুষ সম্পর্কে বলেছেন, আমি তো মানুষকে সৃষ্টি করেছি। আর তার মন যে মন্ত্রণা দেয়, সে সম্পর্কে আমি অবগত। আমি তো তার কন্ঠনালীর চেয়ে নিকটবর্তী। (ক্বাফঃ আয়াত ১৬)

আর আল্লাহর জ্ঞান তো সবকিছুকে বেষ্টন করে আছে। (তালাকঃ আয়াত ১২)

অপরদিকে মানুষ ও তার স্বরূপ কী? কুরআনের ভাষায় “আর মানুষকে তো দুর্বল  হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছে। (সুরা নিসাঃ২৮)

মানুষের দৈহিক শক্তি যেমন দুর্বল, তার চিন্তাশক্তি যুক্তি ও জ্ঞানও দুর্বল। কুরআনের ভাষায়, “আর তোমাদেরকে তো সামান্য জ্ঞানই দেয়া হয়েছে।” (সুরা বনী ইসরাইলঃ৮৫)

একদিকে আল্লাহ তায়ালার সীমাহীন অনন্ত সর্বব্যাপী জ্ঞান, অপরদিকে মানুষের ক্ষুদ্র ও অতি সীমিত জ্ঞান, এদুয়ের মধ্যে যেমন তুলনা চলে না, তেমনিভাবে এই দুই রকম জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে প্রণীত বিধান ও জীবনব্যবস্থার মধ্যেও পার্থক্য আকাশ পাতালের। বরং তার চেয়ে আরো বেশি ও ব্যাপক।

দ্বিতীয় ফলাফল—আল্লাহ তায়ালার একটি পবিত্র সিফাত বা গুণ হচ্ছে তিনি সর্বোচ্চ ন্যায় ও ইনসাফকারী। ফলে তিনি যেকোনো ধরণের যুলুম ও অন্যায় পক্ষপাত থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ও পবিত্র। এমনিভাবে তিনি কোনো কিছুর দ্বারা এতটুকুও প্রভাবিত হোন না।ফলে তাঁর দেয়া বিধান ও শিক্ষাও এসবকিছুর উর্ধ্বে।

অপরদিকে মানুষ যখন কোনো কাজ করে বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, সে শত রকম বিষয় দ্বারা প্রভাবিত হয়। মানুষ প্রভাবিত হয় তার সময় পরিবেশ সমাজ দেশ দ্বারা। কখনো মানুষ নিজের স্বার্থ, তার সম্প্রদায়, বর্ণ বা জাতির স্বার্থের কাছে দুর্বল হয়ে যায়। ফলে সে সত্য ও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে চায় না বা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়। আর একারণে মানুষের সিদ্ধান্ত বা তার তৈরি করা জীবনবিধানে যুলুম অনুপ্রবেশ করে। সুবিচার নিশ্চিত হয় না। আবার একারণে সেই সিদ্ধান্তাবলিও সময়ের সাথে, ভৌগলিক অঞ্চলের সাথে বারবার পরিবর্তণ করতে হয়। একদেশের আইন অন্যদেশে প্রয়োগ করা যায় না। এক সময়ে প্রণিত আইন সংশোধন করে নতুন আইন তৈরি করতে হয়।

অপরদিকে আল্লাহ প্রদত্ত্ব হওয়ার কারণে ইসলামের যাবতীয় বিধান কালজয়ী চিরন্তন এবং সর্বস্থানে প্রযোজ্য। এর বিস্তারিত বিবরণ সামনে আসবে।

তৃতীয় ফলাফল—আল্লাহ প্রদত্ত্ব বিধানের প্রতি বিশ্বাসী মানুষ সমর্পিত হয়ে থাকে। যেহেতু সে আল্লাহকে বিশ্বাস করে, বিশ্বাস করে তাঁর সীমাহীন অনন্ত জ্ঞান ও সর্বব্যাপী ইনসাফকে, ফলে এই বিধানগুলো পালন করার প্রতি তার আন্তরিকতার কোনো কমতি থাকে না। কেউ দেখুক বা না দেখুক, কেউ তাকে বাধ্য করুক বা না করুক; পরম ভক্তি ও শ্রদ্ধার সাথে সে বিধানগুলো পালন করে যায়। একজন প্রকৃত মুমিন কেমন প্রেম ভালোবাসা ও মনোযোগের সাথে নামাজ রোজা বা হজ আদায় করেন, কতটা গুরুত্ব ও সতর্কতার সাথে যাকাত পরিশোধ করেন, এটা সরাসরি না দেখলে কারো পক্ষে কল্পনা করা সম্ভব না।

অপরদিকে বিধানগুলো যখন প্রণিত হয় তার মতই কিছু মানুষের হাতে, যাদের জ্ঞান বুদ্ধির উপর তার বিশেষ আস্থা নেই, যাদের ব্যাপারে তার প্রবল ধারণা হচ্ছে, তারা নিজেদের নানারকম স্বার্থের সামনে অতিদুর্বল, তখন সেই বিধানগুলো পালন করার ব্যাপারে তার মধ্যে তৈরি হয় দোদুল্যমানতা বরং পিছুটান। আইনি ফাঁকফোকর বের করে তা থেকে বাঁচার সীমাহীন প্রচেষ্টা। (আধুনিককালের ইনকাম ট্যাক্স বা ভ্যাটের কথা এখানে একটু স্মরণ করুন!) ফলে এই আইনগুলোর বাস্তবায়ন বলতে গেলে পুরোটাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর কঠোর পরিশ্রমের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকে। আর কোনো কারণে যদি আইনি কঠোরতা শিথীল হয়ে যায় তাহলে মানবরচিত আইনগুলোর কোনো মূল্যই থাকে না। এটা শুধু কথার কথা নয়, এই আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায়ও এর নজীর কম নয়।

  • দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যআকীদা বিশ্বাসের স্থান সব কিছুর উর্ধ্বে

ইসলাম মানুষকে সুনির্দিষ্ট কিছু আকীদা বিশ্বাস নিজের অন্তরে ধারণ ও লালন করার নির্দেশ দিয়েছে। এই বিশ্বাসগুলো চিরন্তন। আদম আলাইহিস সালাম থেকে শুরু করে শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রত্যেকেই এর দাওয়াত দিয়েছেন। যেমন, আল্লাহ তাআলাকে সত্তাগতভাবে ও গুণাবলির দিক থেকে এক ও অদ্বিতীয় বিশ্বাস করা।ফেরেশতা, পরকাল,  নবীরাসূল ও তাঁদের প্রতি অবতীর্ণ কিতাবসমূহের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা প্রভৃতি। ইসলামে এই আকীদা বিশ্বাসের স্থান সবকিছুর উর্ধ্বে। কোনো কিছুই এর বিকল্প হতে পারেনা। এর কোনো একটিও যদি ছুটে যায় তাহলে সবকিছু বাতিল ও প্রত্যাখ্যাত বলে গণ্য হবে। ফলে যদি এমন হয় কোনো ব্যক্তি নামাজ রোজা হজ সব কিছুই করছে, কিন্তু আকীদা বিশ্বাস নেই, কিংবা সঠিকভাবে নেই, তাহলে তার সব আমলই বেকার ও মূল্যহীন হয়ে যাবে। এমনিভাবে উত্তম আখলাক, জনকল্যাণমুলক কাজ, “সফল” ও সুন্দর মানুষ, “শান্তিপূর্ণ” সুখী  সমাজ, সমৃদ্ধ উন্নত রাষ্ট্র, অভূতপূর্ব বিপ্লব ও জাগরণ—এসবকিছু তুচ্ছ ও মূল্যহীন হয়ে যাবে যদি এগুলোর সাথে সেই আকীদা বিশ্বাস বিদ্যমান না থাকে।

এই বিষয়টি নবী রাসূূলদের ইসলাম এবং অন্যান্য রাজনৈতিক নেতা, জাতীয়তাবাদী লীডার বা বিপ্লববাদীদের কর্মপন্থার মাঝে পার্থক্য রেখা টেনে দিয়েছে। আমরা এ শ্রেণির নেতাদের মধ্যে খুব সাধারণভাবে যে চর্চাটা দেখি তাহলো একজন মানুষ যদি তাদের দেয়া নির্দিষ্ট এজেন্ডা ও মিশনের অধীনে কাজ করে, তাহলে অন্তরে যে বিশ্বাসই লালন করুক, এটি অসুবিধা নয়। মূল হচ্ছে নির্দিষ্ট এজেন্ডা ও দলের মিশন বাস্তবায়ন করা।ফলে অন্তরে সেই কাজ ও মিশনের প্রতি এতটুকু বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা নেই, শুধু নিজের কোন বিশেষ স্বার্থ চরিতার্থ করতে কাজ করছে, এমন মানুষের সংখ্যা সেখানে অগণিত।মৌলিকভাবে একে অসুবিধা হিসেবে দেখা হয় না। কিন্তু ইসলামে এর বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। বরং এমন আচরণকে মুনাফেকি বা কপটতা হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়, যা স্পষ্ট কুফুরির চেয়েও ভয়াবহ।

যাহোক, ইসলামে আকীদা বিশ্বাস যে সর্বোচ্চগুরুত্বপূর্ণ, এবং এর পরিবর্তে বিকল্প হিসেবে কোন কিছুই গ্রহণযোগ্য হয় না, বিষয়টি কুরআন হাদীসে বারবার আলোচিত হয়েছে।এ প্রসঙ্গে দুটি ঘটনা বর্ণনা করছি।

  • নবীজি ও তাঁর সাহাবীদের উপর সীমাহীন নিপীড়ণ করেও যখন মক্কার কাফেররা কিছুই করতে পারল না। বরং একদিকে ঈমানদারদের মিছিল দীর্ঘ হচ্ছিল দিনদিন, তাঁদের ঈমান ও ইসলামে অবিচলতা আরো বেড়েই চলছিল, আবার কাফেরদের যাবতীয় চক্রান্ত ও কুটকৌশল একের পর এক ব্যর্থ প্রমাণিত হচ্ছিল, তখন কাফেররা নবীজির কাছে প্রস্তাব রাখল, “আচ্ছা, তাহলে আপনারা এক বছর আমাদের দেবদেবীর পূজা করবেন, আমরা একবছর এক আল্লাহর ইবাদত করব।” এই প্রস্তাবকে মুমিনদের জন্য বাহ্যত উপযোগী হিসেবে দেখার সুযোগ ছিল। একে গ্রহণ করে নিলে মাত্রাহীন নীপিড়ণ ও নির্যাতন বন্ধ হয়ে যেত, মুমিনরা কিছুটা স্বস্তি পেতেন, অনেক মুশরিকও হয়তো ইসলামের অনেক বিধিবিধান গ্রহণ করে নিত! কিন্তু না, আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে কাফের মুশরিকদের এমনতর প্রস্তাবকে কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা সুরা ফীল অবতীর্ণ করে জানিয়ে দিলেন,

(হে নবী!) আপনি বলুন, হে কাফেররা, আমি সেই সব বস্তুর ইবাদত করি না, যাদের ইবাদত তোমরা কর। এবং আমি যাঁর ইবাদত করি তোমরাও তাঁর ইবাদতকারী নও। আমি (ভবিষ্যতে) তার ইবাদতকারী নই, তোমরা যার ইবাদত করছ। আর তোমরাও তার ইবাদত করবে না, আমি যাঁর ইবাদত করি। তোমাদের ধর্ম তোমাদের, আমার ধর্ম আমার। (সুরা কাফিরুনঃ আয়াত-১-৬)

এই সুরার মূল কথাটাই হল, ঈমান ও তাওহীদ আর কুফর ও শিরক, এগুলো সম্পূর্ণ বিপরীত জিনিস। কোনো অবস্থাতেই এ দুয়ের মধ্যে সমঝোতা বা মীমাংসা হতে পারে না। যদিও এই মীমাংসার কারণের অনেক বাহ্যিক কল্যাণ ও মুমিনদের আপাতঃ কিছু স্বার্থ রক্ষা হয়। আকীদা বিশ্বাসের স্থান সবকিছুর উর্ধ্বে, এর পরিবর্তে কোনো কিছুই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না, সুরাটি ইসলামের বুনিয়াদি এই দর্শনকে জোরালোভাবে উপস্থাপন করছে।

  • ইসলামের ইতিহাস ও নবীজির পবিত্র সীরাত সম্পর্কে অবগত ব্যক্তি মাত্রই জানেন, নবীজির চাচা আবু তালিব শুরু থেকেই তাঁর প্রতি অতিযত্নবান ছিলেন। কিশোর বয়সের প্রতিপালন থেকে নিয়ে নবুওয়ত প্রাপ্তির পর, যতদিন তিনি বেঁচে ছিলেন নবীজির পাশে ছিলেন, সাহায্য-সমর্থনে সর্বাত্নক চেষ্টা করে গেছেন। কাফেরদের নীপিড়ন ও নির্যাতনের সামনে মজবুত প্রাচীরের মত দাঁড়িয়েছিলেন। ফলে তাদের নির্যাতনের মাত্রায় ভাটা পড়েছে। বহু ষড়যন্ত্র ও অনিষ্ট সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হয়েছে তাদের। মোটকথা, আবু তালিব নবীজির জন্য অনেক কিছু করেছেন। এজন্য নবীজিও মনে প্রাণে খুব চাইতেন, আবু তালিব যেন মূর্তিপূজা ছেড়ে দিয়ে একত্ববাদ গ্রহণ করে মুমিন হয়ে যান। আবু তালিবের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নবীজি সর্বাত্নক চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন। মুসলিম শরীফের বর্ণনা অনুযায়ী, আবু তালিব যখন মৃত্যুশয্যায় শায়িত, তার কাছে আবু জেহেল উতবা শায়বারা উপস্থিত ছিল। নবীজিও তার নিকট হাজির হন। তিনি (আকুলতার সাথে) চাচাকে বলেন, আপনি বলুন, আল্লাহ ব্যতিত কোন উপাস্য নেই, এই কথাটি বলুন, কিয়ামতের দিন এর সাহায্যে আমি আপনার পক্ষে সাক্ষ্য দিব।” কিন্তু আবু তালিব তা বলেননি। তিনি বললেন, মৃত্যু ভয়ে একথা বলে ফেলেছে—কুরাইশ আমাকে এই বলে লজ্জা দিবে। না হয় তুমি যা বলতে বলেছ, আমি তা বলে তোমার চোখ শীতল করতাম।

আবু তালিব চরম সংকট ও ভয়াবহ বিপদের দিনে নবীজিকে সর্বাত্নক সাহায্য করার বিরল সৌভাগ্য অর্জন করেছেন, কিন্তু নবীজির আনিত আকীদা বিশ্বাসকে কবুল করতে অস্বীকার করেছেন। একারণে তার এত অবদান ও নবীজির সুমহান সেবা তাকে মুক্তি দিতে পারেনি। আল্লাহ তায়ালা আয়াত অবতীর্ণ করে জানিয়ে দিলেন, “নিশ্চয় আপনি যাকে পছন্দ করেন তাকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারেন না। তবে আল্লাহ যাকে চান তাকে সঠিক পথে পরিচালিত করেন।” (ক্বাসাসঃ আয়াত ৫৬) নবীজিও জানিয়েছেন, জাহান্নামবাসীদের মধ্যে সবচে হালকা শাস্তি হবে আবু তালিবের। তার দুই পায়ে আগুনের দুটি চপ্পল পরানো থাকবে। যার কারণে তার মস্তিষ্ক টগবগ করবে। (সহিহ মুসলিমঃ২১২)

তৃতীয় বৈশিষ্ট্যআল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই ইসলামে সর্বোচ্চ চূড়ান্ত লক্ষ্য

ইসলামের দৃষ্টিতে একজন মুসলিমের সর্বোচ্চ ও চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে মহান আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন করা। সকল নবী রাসূল আলাইহিমুস সালাম দাওয়াত ও দ্বীন প্রচারের জন্য যে কষ্ট ক্লেশ সহ্য করেছেন, জিহাদ করেছেন, এসব কিছুর একমাত্র লক্ষ্য ছিল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। কুরআন ও হাদীসে বারবার এই চূড়ান্ত টার্গেটের কথা বিভিন্ন শব্দে ও আঙ্গিকে বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ মুমিন নর ও মুমিন নারীদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এমন উদ্যানরাজির, যার তলদেশে নহর বহমান থাকবে। তাতে তারা সর্বদা থাকবে এবং এমন উৎকৃষ্ট বাসস্থানের, যা রয়েছে সতত সজীব জান্নাতে। আর আল্লাহর সন্তুষ্টিই সর্বশ্রেষ্ঠ, (যা জান্নাতবাসীগণ লাভ করবে) । এটাই মহা সাফল্য। (সূরা তাওবা, আয়াতঃ ৭২)

প্রখ্যাত ইসলামি পণ্ডিত আল্লামা শিব্বির আহমদ উসমানি লিখেছেন, অর্থাৎ দুনিয়া ও আখেরাতের সমস্ত নেয়ামতের চেয়ে বড় হচ্ছে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি। জান্নাতও এ জন্যই কাম্য যে, তা আল্লাহর সন্তুষ্টির স্থান। আল্লাহ তাআলা জান্নাতে মুমিনদের সব রকম বাহ্যিক ও আত্মিক নে’য়ামত ও আনন্দ-সামগ্রী দান করবেন। কিন্তু সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামত হবে পরম প্রিয়তমের শাশ্বত সন্তুষ্টি। সহীহ হাদীসে আছে, আল্লাহ তাআলা জান্নাতবাসীদের ডাকবেন, তাঁরা ‘লাব্বাইক’ বলবেন। তিনি জিজ্ঞাসা করবেন, এখন কি তোমরা সন্তুষ্ট হয়েছ? তাঁরা উত্তরে বলবেন, ‘পরওয়ারদেগার! সন্তুষ্ট না হওয়ার কী কারণ থাকতে পারে, যখন আপনি আমাদের অফুরন্ত নেয়ামত দান করেছেন! আল্লাহ বলবেন, আমি তোমাদেরকে তার চেয়ে উত্তম জিনিস দান করব! জান্নাতিরা জিজ্ঞাসা করবেন, ‘হে প্রতিপালক! এর চেয়ে উত্তম আর কী জিনিস হবে?’ তখন আল্লাহ তাআলা বলবেন, ‘আমার শাশ্বত সন্তুষ্টি ও প্রসন্নতা তোমাদের প্রতি অবতীর্ণ করছি, যার পর আর কখনো তোমাদের প্রতি আমার অসন্তুষ্টি ও ক্রোধ হবে না।“ (সহিহ বুখারি, হাদীসঃ ৬৫৪৯, সহিহ মুসলিমঃ ২৮২৯) (তাফসিরে উসমানি, সুরা তাওবা, আয়াতঃ ৭২)

লক্ষ করলে দেখব, সকল নেক কাজ যেন শুধু আল্লাহর আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই সম্পাদন করা হয়, এবিষয়ে বারবার তাকীদ করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ কয়েকটি আয়াত পাঠ করুন—

আর মানুষের মধ্যে এমন ব্যক্তিও আছে যে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজ প্রাণ বিক্রি করে দেয়। (সুরা বাকারা, আয়াতঃ ২০৭)

মুমিন ও মুশরিকদের পারষ্পরিক সম্পর্ক প্রসঙ্গে এক আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, তোমরা যদি বের হয়ে থাক, আমার পথে জিহাদ করার জন্য ও আমার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে (তাহলে মুশরিকদের বন্ধুরূপে কিভাবে গ্রহণ করছ?) (সুরা মুমতাহিনা, আয়াতঃ ০১)

কল্যাণকাজে সম্পদ ব্যয় করার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, তোমরা কেবলই আল্লাহর সন্তুষ্টির লাভের জন্য ব্যয় করবে। (সুরা বাকারা, আয়াতঃ ২৭২)

আরো বলা হয়েছে, তারা যে গোপন শলা পরামর্শ করে এর বেশির ভাগে কল্যাণ নেই, তবে যে আদেশ করে সদকা, কল্যাণকর্ম বা মানুষের মধ্যে শান্তি স্থাপনের জন্য, তার কথা ভিন্ন। এবং যে ব্যক্তি আমার সন্তুষ্টি লাভের আশায় এসব করবে, তাকে আমি মহা প্রতিদান দিব। (সুরা নিসা, আয়াতঃ ১১৪)

এই বৈশিষ্ট্যটিও ইসলামকে অন্যান্য মতবাদ, আন্দোলন, সংগ্রাম, বিপ্লব, দর্শন ইত্যাদি থেকে স্বকীয় করেছে। ফলে, পার্থিব জীবনে সুখি সমৃদ্ধ জীবন যাপন করা, ভোগ বিলাসিতা, রাজত্ব প্রতিষ্ঠা, সাম্রাজ্য বিস্তার, দম্ভ ও ক্ষমতা প্রদর্শন, জাত্যাভিমান, কোন জাতি সম্প্রদায় বা শ্রেণি থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ, কোন জাতি বা গোত্র, দেশ বা ভূখন্ডের পক্ষে প্রতিরোধ গড়ে তোলা, এসবের কোনটাই ইসলামে চূড়ান্ত ও সর্বোচ্চ লক্ষ্যের মর্যাদা পায়নি। যদিও উল্লেখিত কোন কোন বিষয় ইসলামের দৃষ্টিতে ভালো বা মন্দ নয়। যেমন দুনিয়াতে সুখি সমৃদ্ধ জীবন যাপন করা। কিন্তু এর কোনটাই ইসলামের মূল প্রেরণা নয়।

এজন্য আমরা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শে ও সীরাতে দেখি, তিনি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে নিজ গোত্রের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন। মাতৃভূমি মক্কা মুকাররামা থেকে হিজরত করে স্থায়ীভাবে বসবাস করেছেন মদীনা শরীফে । নবীজির এই কর্মপন্থাকে ধারণ করে একই লক্ষ্যে তাঁর মহান সাহাবীগণও এ পথ ধরেই হেঁটেছেন। শত হাজার বছর ধরে চলে আসা, পরম্পরা সূত্রে পালিত নিজ গোত্রীয় রীতি নীতি বাদ দিয়েছেন আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের তাড়নায়।

আবার হযরত নূহ আলাইহিস সালাম, যিনি তাঁর জাতিকে দীর্ঘ সাড়ে নয়শত বছর আল্লাহর দীনের পথে ডেকেছেন। (দ্রষ্টব্য, সুরা আনকাবুত, আয়াতঃ ১৪ ) তিনি বলেছেন, হে আমার রব, আমি আমার সম্প্রদায়কে রাত-দিন (সত্যের দিকে) ডেকেছি। কিন্তু আমার আহ্বান তাদের পলায়নপরতাই বৃদ্ধি করেছে। আমি যখনই তাদেরকে দাওয়াত দিয়েছি, যাতে আপনি তাদের ক্ষমা করেন, তখন তারা তাদের কানে আঙ্গুল রেখেছে, নিজেদের বস্ত্রাবৃত করেছে, জেদ বজায় রেখেছে, এবং শুধু অহমিকাই প্রকাশ করেছে। অতঃপর আমি তাদের জোর কন্ঠে দাওয়াত দিয়েছি। তারপর আম্মি প্রকাশ্যেও তাদের সাথে কথা বলেছি এবং গোপনে গোপনেও তাদের বুঝিয়েছি। (সুরা নূহ, আয়াতঃ ৫-৯)

কিন্তু ফলাফল কী হয়েছিল? কুরআন আমাদের জানাচ্ছে, তাঁর সাথে ঈমান এনেছিল খুব কম মানুষই। (সুরা হুদ, আয়াতঃ ৪০) তাদের সঠিক সংখ্যা আল্লাহই ভালো জানেন। বিভিন্ন তাফসীরে সাত থেকে সর্বোচ্চ আশি পর্যন্ত সংখ্যা বর্ণিত হয়েছে।

তার মানে, হজরত নূহ আঃ এর দ্বারা শক্তিশালী কোনো দল গঠন করা সম্ভব হয়নি। তিনি রাজত্ব বা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাও অর্জন করেননি। তাই বলে নূহ আঃ এর সুদীর্ঘ দাওয়াতি কাজ ও তাবলীগে দীন সামান্যতম বিফল বা ব্যর্থ হয়ে যায়নি। নাউযুবিল্লাহ। তাঁর কাজে সর্বোচ্চ সফল এজন্য হযরত নূহ আঃ এর প্রতি কোন ধরণের ভর্ৎসনা তো করা হয়ই নি, বরং কুরআনে কারীমে তাঁর বৃত্তান্ত, দ্বীনের জন্য তাঁর সীমাহীন মেহনত ও কুরবানির কথা বারবার আলোচনা করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বারবার তাঁর প্রসংশা করেছেন। তাঁকে আদর্শ ও অনুরসরণীয় হিসেবে গ্রহণ করার তাকীদ করেছেন। এটা এজন্যই যে তিনি একমাত্র আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভের জন্য সর্বোচ্চ সাধনা করেছেন। আর এটাই ইসলামের মূল ও চূড়ান্ত লক্ষ্য। নূহ আঃ সম্পর্কে সুরা সাফফাতে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, নূহ আমাকে ডেকেছে। আর আমি কত উত্তম সাড়াদানকারী। আমি তাঁকে ও তাঁর পরিবারবর্গকে রক্ষা করেছি মহা বিপদ থেকে। আর আমি তাঁর বংশধরকেই (পৃথিবীতে) অবশিষ্ট রেখেছি। (সুরা সাফফাতঃ৭৫-৭৭)

তার মানে কি এই, ইসলাম শক্তি ও কর্তৃত্ব অর্জনের বিরোধিতা করে এবং ইসলামে ক্ষমতা ও রাষ্ট্রীয় শক্তি লাভ করা কাঙ্খিত নয়? কিংবা এসব কিছু অদরকারি ও গুরুত্বহীন? আসলে তা নয়। ক্ষমতা ও রাষ্ট্রীয় শক্তি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ—

  • ইসলামের বহু সংখ্যক বিধানের প্রকৃতিই এমন যা রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বাইরে পালন করা সম্ভব নয়। যেমন ইসলামি আদালত ও বিচারিক ব্যবস্থা কার্যকর করা, জিহাদের বড় একটি অংশ, অন্যায় কাজে বাধা দেয়ার বিভিন্ন ক্ষেত্র, দণ্ডবিধি ও কিসাস কার্যকর ইত্যাদি। এগুলো ইসলামে অবশ্যপালনীয় বিধান। সুষ্ঠভাবে এসব পালন করা যখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার উপর নির্ভরশীল তখন “সহায়ক উপকরণ” হিসেবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অর্জনও আবশ্যকীয়। কারণ ইসলামে স্বীকৃত মূলনীতি হচ্ছে, “যে বিষয়ের উপর শরীয়তের কোন আবশ্যক বিধান নির্ভরশীল হয়ে থাকে, সেই বিষয়টাও আবশ্যক হিসেবে গণ্য হয়।” (ما لا يتم الواجب إلا به فهو واجب ومقدمة الواجب واجبة

তাছাড়া নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনা শরীফে হিজরত করার পর ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরবর্তিতে তাঁর সাহাবীগণও নবীজির নির্দেশনাকে সামনে রেখে “খেলাফত” ব্যবস্থা জারি রাখাকে জরুরি মনে করেছেন। এভাবে ইসলামি ইতিহাসের দীর্ঘ তেরোশত বছর পর্যন্ত খেলাফত (শাসন) ব্যবস্থা জরুরি বিধান হিসাবে কার্যকর ছিল।

  • কুফুরি শক্তি ও তাদের দ্বারা পরিচালিত বিভিন্ন পক্ষ ইসলাম পালনে যে সকল বাধা তৈরি করে রেখেছে, চাই তা চিন্তা চেতনা শিক্ষা ও আদর্শগত বাধা হোক বা ব্যবস্থাপনাগত অন্তরায় হোক, এসব দূর করা এবং পূর্ণাঙ্গভাবে ইসলাম পালনের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা, রাষ্ট্রীয় শক্তি ও ক্ষমতা ছাড়া সম্ভব নয়।

এমন আরো অনেক কারণে ইসলামে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অর্জন কাঙ্খিতই নয় শুধু বরং জরুরী। তবে এই ক্ষমতা ও শক্তির অবস্থান কোন মৌলিক লক্ষ্য বা চূড়ান্ত টার্গেট হিসেবে নয়। এটা শুধু উল্লেখিত বিষয়সহ আরো অনেক উত্তম বিষয়ের  উপকরণ ও মাধ্যম হিসেবে গণ্য হবে। ফলে একজন মুসলিম তার দীন পালন ও দীনি দাওয়াতের মূল প্রেরণা হিসেবে কিছুতেই ক্ষমতা অর্জনকে সামনে রাখতে পারেন না। এটা কুরআনেরও শিক্ষা না, নবীজির বাস্তব জীবন আদর্শ থেকে প্রমাণিত বিষয়ও নয়। এসম্পর্কে কুরআন মাজীদের এই আয়াতটি পাঠ করুন। আল্লাহ তায়ালা বলেন,

তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে ও সতকর্ম করেছে, আল্লাহ তাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে তিনি অবশ্যই তাদের জমীনের স্থলাভিষিক্ত বানাবেন। যেভাবে তাদের পূর্ববর্তীদেরকে স্থলাভিষিক্ত করেছিলেন। তিনি তাদের পছন্দনীয় ধর্মকে তাদের জন্য প্রতিষ্ঠিত করবনে, তাদের ভয়ের পর বিনিময়ে নিরাপত্তা দান করবেন। তারা আমার ইবাদত করবে, আর আমার সাথে কাউকে শরীক করবে না। (সুরা নূর, আয়াতঃ ৫৫)

লক্ষ করুন, আয়াতের শুরু ও শেষে ঈমান, নেক আমল ও ইবাদতের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব লাভ করার আগেও তারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সঠিকভাবে ঈমানকে ধারণ করে, ইবাদত করে, শক্তি ও ক্ষমতা পাওয়ার পরও তারা এই উদ্দেশ্যে অটল অবিচল থাকে। সর্বাবস্থায় ঈমান আমল ও ইবাদতে মনোযোগী হয়। কারণ এটিই আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের একক মাধ্যম।

চতুর্থ বৈশিষ্ট্যইসলামের অংশ হিসেবে প্রমাণিত আকীদা বিধিবিধানের উপর অটল অনড় অবিচলতা

ইসলামে স্বীকৃত উপায়ে দলীল প্রমাণের আলোকে যখন কোনো আকীদা বিশ্বাস বা বিধিবিধান প্রমাণিত হয়ে যাবে, তখন তাতে কাটছাট, রদবদল বা বিকৃত করার কোন সুযোগ নেই। বরং প্রমাণিত আকীদা বিশ্বাস ও বিধিবিধানের উপর থাকতে হবে অটল অবিচল ও অনড়। প্রতিষ্ঠিত বিষয়কে পরিবর্তন করার পেছনে যত যুক্তি ও কল্যাণই দেখানো হোক না কেন, তাতে হস্তক্ষেপের অধিকার কারো নেই। এমনকি নবী রাসুলদেরও এ অধিকার দেয়া হয়নি। কুরআনে কারীম ইসলামের অন্যতম স্বকীয়তাটির বিবরণ দিয়েছে এইভাবে,

যারা (পরকালে) আমার সাথে মিলিত হওয়ার আশা রাখে না, তাদের সামনে যখন আমার আয়াতসমূহ সুস্পষ্টরূপে পাঠ করা হয় তারা বলে, তুমি এ ছাড়া অন্য কুরআন নিয়ে আসো অথবা একে পরিবর্তন করে ফেলে। আপনি বলে দিন, আমার এ অধিকার নেই যে নিজের পক্ষ থেকে তা পরিবর্তন করে ফেলব। আমি তো কেবল অনুসরণ করি ওহির, যা আমার কাছে প্রেরণ করা হয়। আর যদি আমার প্রতিপালকের অবাধ্যতা করে ফেলি তাহলে এক মহা দিবসের শাস্তির ভয় করি। (সুরা ইউনুসঃ ১৫)

ফলে এটা অনেক সময়ই হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে, কিছু মানুষ ইসলামের প্রতিষ্ঠিত আকীদা বিশ্বাস বা বিধানের মধ্যে রদবদল করার আবদার করবে। এরপেছনে অনেক যুক্তিও পেশ করা যাবে। যেমন—

  • কিছুটা পরিমার্জন বা রদবদল করা হলে যুগের চাহিদার সাথে খাপ খাবে। ফলে বেশি সংখ্যক মানুষ একে গ্রহণ করবে।
  • এই ভূখন্ড বা ঐ সংস্কৃতির মানুষজন একে সহজে কবুল করবে।
  • দ্বীনি কাজের ব্যাপক প্রসার ঘটবে। দ্বীন বিজয়ী হবে।
  • আবার বিরোধীদের বিরোধিতার ক্ষিপ্রতা কমবে। এতে অনেকটা স্বস্তি পাওয়া যাবে।

কিন্তু যত যৌক্তিক আর কল্যাণকর দিকের কথাই বলা হোক না কেন, কোরআন ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত বিশ্বাস ও বিধানে ইচ্ছামত পরিবর্তন করা বা শিথীলতা করার সুযোগ নেই। এটি মূলনীতি ও তত্ত্ব হিসেবে যেমন স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, এমনিভাবে নবীজি এই শিক্ষা ও তত্ত্বটি কার্যতভাবে বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছেন।

ইবনে কাসির রহঃ ইবনে ইসহাকের সূত্রে লিখেছেন, নবম হিজরির রমজান মাসে তায়েফ অঞ্চলের প্রসিদ্ধ গোত্র বনু সাকীফ নবীজির দরবারে একটি প্রতিনিধি দল পাঠায়। তারা নবীজির কাছে ইসলাম গ্রহণের জন্য বেশ কিছু শর্ত দেয়। এর মধ্যে একটি শর্ত ছিল তাদের মূর্তিটি তিন বছর পর্যন্ত রেখে দেয়া হবে। (ভাঙ্গা হবে না।) নবীজি তাদের এ শর্ত প্রত্যাখ্যান করেন। তারা পরে দুই বছরের সময় চায়, এরপর এক বছরের এমনকি শুধু একমাসের জন্যও অবকাশ প্রার্থণা করে। যাতে তাদের মধ্যে নির্বোধ লোকেরা অভ্যস্ত হয়ে উঠে। কিন্তু নবীজি তাদের কোনো দাবীই গ্রহণ করেননি। বরং আবু সুফিয়ান ইবনে হারব ও মুগিরা ইবনে শু’বা রাঃকে পাঠিয়েছিলেন মূর্তিটি ভাঙ্গার জন্য। তারা আরো দাবী উত্থাপন করেছিল, মূর্তিটি তারা নিজ হাতে ভাঙ্গবে না এবং নামাজাও আদায় করবে না। নবিজি নিজ হাতে মূর্তি না ভাঙ্গা গ্রহণ করে নেন। কিন্তু নামাজ মাফ করার দাবি কবুল করেন নি। তিনি ইরশাদ করেন, যে ধর্মে নামাজ নেই তাতে কোন কল্যাণ নেই। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়াঃ ৫\৩৬, শামেলা সংস্করণ)

শিরক ও শিরকের উপকরণ সবই ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। ফলে এক্ষেত্রে নবীজি বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে রাজী হন নি। এমনভাবে নামাজ ইসলামের প্রধাণতম রুকন-ভিত্তিস্তম্ভ। এক্ষেত্রেও রদবদল বা কমবেশি করার অনুমতি দেন নি।

সহিহ বুখারি বর্ণিত আরেকটি ঘটনা পাঠ করুন। কুরাইশ গোত্রের বনু মাখযুম শাখার এক মহিলা একবার চুরি করল। এই চুরি ঘটনাটি প্রমাণিত হয়ে যাওয়ায় হদ বা দণ্ডবিধি হিসেবে তার হাত কাটা হবে। কিন্তু কুরাইশের লোকদের কাছে এটি ভারি মনে হল। কোনভাবে এ থেকে তাকে রেহাই দেয়া যায় কি না এনিয়ে তারা পেরেশান হয়ে গেল। এবিষয়ে নবীজির সাথে কে কথা বলবে? নবীজির প্রিয়ভাজন উসামা ইবনে যায়েদ ছাড়া আর কেউ সাহস করবে না। তারা উসামা রাঃকে বলে রাজি করাল। তিনি নবীজির কাছে সুপারিশ করলেন। এতে নবীজি খুবই রাগান্বিত হলেন। বললেন, “আল্লাহর নির্ধারন করা হদ-দণ্ডবিধির ক্ষেত্রে তুমি সুপারিশ করছ?” এরপর তিনি উঠে চলেন গেলন এবং সাহাবীদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা করলেন, হে মানুষসকল, শুন রেখো, আগেকার লোকেরা ধ্বংস হয়েছে একারণেই যে, তাদের মধ্যকার সম্ভ্রান্ত কেউ যখন চুরি করত, তারা তার উপর দণ্ডবিধি প্রয়োগ করত না। কিন্তু দুর্বল কেউ চুরি করলে তাকে শাস্তি দিত। আল্লাহর কসম! মুহাম্মদের মেয়ে ফাতেমাও যদি চুরি করে তাহলে মুহাম্মদ তার হাত কর্তন করবে। (সহিহ বুখারি : ৬৭৮৮)

নবীজির ঐতিহাসিক উক্তিটি একথাই প্রমাণ করে, ইসলামের প্রতিষ্ঠিত কোন বিধানে শীথিলতা পরিবর্তন পরিমার্জন বা কোন প্রকারের হস্তক্ষেপ করার অধিকার কারো নেই।

কিন্তু গত দুই শতকে আমরা মুসলিম জাহানে একটি ভিন্ন চিত্র দেখেছি। যা একই সাথে অসংগত প্রত্যাখ্যাত আবার আক্ষেপ ও আফসোস উদ্রেককারী। কী দেখা গেল? ইউরোপের শিল্পবিপ্লবের পর নানা কৌশল করে পশ্চিমারা যখন মুসলিম দেশগুলোতে নিজেদের কলোনি গড়ে তুলল তারপর পুরো দমে বিস্তীর্ণ মুসলিম বিশ্বের একচ্ছত্র শাসক বনে গেল, তখন মুসলিমদের মধ্য থেকে একটি বিশেষ শ্রেণি তৈরি হল। তারা পশ্চিমাদের সামরিক শক্তি প্রগতি বিজ্ঞান দর্শন ও সংস্কৃতির সামনে ভড়কে গেল এবং মানসিক ও চিন্তাগতভাবে নিজেদের পরাজয় এবং পশ্চিমাদের বিজয় মেনে নিল। তারপর এই পরাজিত শ্রেণিটি নিজেদের ধর্ম ইসলামের স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্রকে একপাশে রেখে ইসলামকে পশ্চিমা চিন্তা দর্শন ও মূল্যবোধ দিয়ে বিচার করতে থাকল। পশ্চিমা মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হয় না, ইসলামের এমন বিশ্বাস ও বিধানে ইচ্ছামত রদবদল ও বিকৃতির প্রয়াস চালাল। যখনই পশ্চিম থেকে নতুন কোন মতবাদ দর্শন বা মূল্যবোধ আসতো সেই অনুযায়ি সাথে সাথে ইসলামি শিক্ষার বিকৃতি করতে প্রস্তুত হয়ে যেত। চার্লস ডারউইন “বিবর্তন তত্ত্ব” নিয়ে হাজির হলেন। তো এদিকে কিছু লেখক বুদ্ধিজীবী কুরআন থেকেই বিবর্তনের “প্রমাণ” পেশ করা শুরু করলেন। একে একে পশ্চিম থেকে লিবারেলিজম, সেকুলারিজম, কমিউনিজম, ফেমিনিজম ইত্যাদি আমদানি হল, আর পরাজিত “মুসলিম” বুদ্ধিজীবীরা এগুলো চোখ বুঁজে গ্রহণ করলেন, মুসলিম জনসাধারণকে এসব “মূল্যবান ও বিশুদ্ধ” মতবাদ অনুযায়ী আমল করার জোরালো নির্দেশ জারি করলেন। এবং এই অনুসরণের মধ্যেই তারা দেখলেন চূড়ান্ত সফলতা। একাজ করতে গিয়ে ইসলামের অনেক বিধানকে অস্বীকার করা হল, অনেক আয়াত ও হাদীসের মর্মকে বিকৃত করা হল।

অথচ এই অধিকার আল্লাহ তায়ালা গবেষক পণ্ডিত দার্শনিক তো দূরের কথা, কোন নবী রাসূলকে পর্যন্ত দেননি। সবচে’ বড় কথা, যে দীন ও শরীয়ত মানুষকে পরিশুদ্ধ করার জন্য এসেছে, যে শিক্ষা ও নির্দেশনা আল্লাহ তায়ালা দিয়েছেন, মানুষকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে, সেখানেই যদি ইচ্ছা মত পরিবর্তন ও কাটছাট করা হয়, তাহলে এগুলো কিভাবে মানুষকে সঠিক পথ দেখাবে, তার হৃদয় জগতকে আলোকিত করবে?!

ইসলামের এই বৈশিষ্ট্য তাকে অন্যান্য দর্শন ও মতবাদ থেকে স্বকীয় করেছে। যেখানে সাময়ীক স্বার্থ বা কল্যানের কথা বিবেচনায় নিয়ে কোন ধরণের রদবদল কাটছাট বা হস্তক্ষেপ করার এতটুকু সুযোগ নেই।

পঞ্চম বৈশিষ্ট্য: পূর্ণাঙ্গতা ব্যাপকতা

ইসলামের এই বৈশিষ্ট্যটি কুরআনে কারীমের নিম্নোক্ত আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেন,  

الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا

“আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্নাঙ্গ করে দিলাম। তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করে দিলাম। এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম।” (সুরা মায়েদা, আয়াতঃ ০৩)

আয়াতটি একটি ঐতিহাসিক মুহূর্তে অবতীর্ণ হয়েছিল। দশম হিজরির ৯-ই যিলহজ, জুমাবার বিকেলে, যখন নবীজি বিদায় হজের সময় আরাফায় অবস্থান করছিলেন। আল্লামা ইবনে কাছির রহঃ লিখেছেন, এই উম্মতের জন্য তাদের দীনকে আল্লাহ তায়ালা পূর্ণ করে দিয়েছেন, এটি তাদের উপর সবচে’ বড় নেয়ামত। এখন আর তাদের অন্য কোনো ধর্মের প্রয়োজন নেই। তাদের নবীর পর অন্য কোনো নবীর আগমনও অপ্রয়োজনীয়। একারণে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে সর্বশেষ নবী হিসেবে পাঠিয়েছেন এবং মানব ও জিনদের প্রতি প্রেরণ করেছেন। ফলে নবীজি যাকে হালাল ঘোষণা করেছেন, সেটাই হালাল। যাকে হারাম ঘোষণা করেছেন, সেটাই হারাম। (তাফসিরে ইবনে কাসির, সুরা মায়েদা, আয়াতঃ ০৩)

তাফসিরে মাআরিফুল কুরআনে মুফতি মুহাম্মদ শফি রহ. লিখেছেন, আয়াতে যেন বলা হচ্ছে, হযরত আদম আঃ এর সময় থেকে যে দ্বীন ও খোদায়ি নেয়ামতের ধারা চালু হয়েছিল, এবং মানব জাতিকে কাল ও স্থানের বিবেচনায় যে নেয়ামত দেয়া হচ্ছিল, আজ সেই দ্বীন ও খোদায়ী নেয়ামত পূর্ণভাবে সর্বশেষ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর উম্মতকে দেয়া হলো।

তিনি আরো লিখেছেন, এ আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, আজ দ্বীনকে পূর্ণ করা হয়েছে, এর মানে এই নয়, পূর্বে নবী রাসূলদের শরীয়ত অপূর্ণ ছিল। বরং আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে নবী ও রাসূলদেরকে যে বিধিবিধানই দেয়া হয়েছিল, তা সেই সময় ও সেই সময়কার লোকদের জন্য পূর্ণাঙ্গ ছিল। তবে আল্লাহ তায়ালার জানা আছে, যে বিধিবিধান এই সময়ে ও এই লোকদের দেয়া হচ্ছে, তা পরবর্তি সময় ও লোকদের জন্য পূর্ণাঙ্গ হিসেবে গণ্য হবে না। তাই আগের বিধিবিধান রহিত করে নতুন বিধিবিধান দেয়া হবে। কিন্তু নবীজিকে যে বিধিবিধান ও শরীয়ত দেয়া হয়েছে তা সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। সবশেষে অবতীর্ণ করে এটাই বুঝানো হচ্ছে, এই শরীয়ত সকল বিচারে পরিপূর্ণ। ফলে এটি কোন নির্দিষ্ট কাল, অঞ্চল দেশ বা কোন সম্প্রদায়ের সাথে বিশেষিত নয়। বরং কেয়ামত পর্যন্ত সর্বকালের জন্য, সমগ্র জাতিগোষ্ঠির জন্য, সকল ভূখন্ডের জন্য এই শরীয়ত কামেল বা পূর্ণাঙ্গ ও পরিপূর্ণ। (মাআরিফুল কুরআনঃ সুরা মায়েদা, আয়াতঃ ০৩)

ইসলামের এই পূর্ণাঙ্গতাকে আমরা বিভিন্ন দিক থেকে বিশ্লেষণ করতে পারি। যেমন—

  • ইসলাম একদিকে আখেরাত (পরকাল) সম্পর্কে স্পষ্ট বক্তব্য দিয়েছে, অপরদিকে দুনিয়া (ইহকাল) সম্পর্কেও পূর্ণাঙ্গ নির্দেশনা পেশ করেছে। অর্থাৎ, পরকাল কী? মৃত্যু পরবর্তি জীবনটা কেমন? কী কী ধাপ একজন মানুষকে সেখানে অতিক্রম করতে হবে? সেই জগতে একজন মানুষ কিভাবে সফল হতে পারে আবার কী কী কারণে সে ধ্বংস ও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে?  মানব মনের এইসকল গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক জিজ্ঞাসার সুনির্দিষ্ট জবাব ও বর্ণনা ইসলামে রয়েছে।

অপরদিকে বর্তমান জগৎ, যেখানে আমরা বসবাস করছি, এই জগতে আমরা কেন এসেছি? আমাদের দায়িত্বগুলো কী কী? কী করব, কী করব না? কোনটা ভালো কোনটা মন্দ, এম মানদণ্ড কী? সার্বিকভাবে, আমাদের জীবনটাকে আমরা কিভাবে পরিচালনা করবো? এর পূর্ণাঙ্গ গাইড বা পথনির্দেশনা ইসলাম মানবজাতির সামনে তুলে ধরেছে।

  • অন্যভাবে বললে, ইসলাম আমাদের শিখিয়েছে, নিজের সাথে আমার সম্পর্ক কেমন হবে। জীবন ও জগতের সাথে, সমাজ,পরিবার ও অন্যান্য মানুষের সাথে আমাদের সম্পর্ক কেমন হবে। এবং সবচে গুরুত্বের সাথে শিখিয়েছে, আল্লাহ তাআলার সাথে আমাদের সম্পর্ক কেমন হবে।

এই যে মানুষের নিজের সাথে তার সম্পর্কের কথা বলা হল, এটি তার পূর্ণাঙ্গ অস্তিত্ব অর্থাৎ তার রুহ,মস্তিষ্ক ও দেহের সমষ্টিকে বুঝাচ্ছে। মস্তিষ্কের কোন চিন্তাটা গ্রহণ করবো, মনের কোন ইচ্ছাটা গ্রহণ করবো, কোনটা বর্জন করবো ইসলাম আমাদের তা শিখিয়েছে। দেহের প্রতিটি অঙ্গের ব্যবহার ও তার ক্ষেত্র সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।

এই মানুষের আবার বিভিন্ন ধাপ ও বয়সের স্তর বিন্যাস রয়েছে। সদ্যভূমিষ্ঠ দুধের শিশু থেকে যার জীবন সফর শুরু হয়, কিশোর যুবক প্রৌড়ের জীবন অতিক্রম করে একসময় বার্ধক্যের কোলে ঢলে পড়ে। এরপর মৃত্যু এসে তার দুনিয়ার জীবনের ইতি টানে। খেয়াল করলে দেখব, মানুষের জীবনের এই বিভিন্ন ধাপ সম্পর্কেও ইসলাম স্বতন্ত্র বক্তব্য ও নির্দশনা দিয়েছে। যেগুলো তার জীবনকে সহজ সুন্দর ও সুশৃঙ্খল করে।

  • অপরদিকে আমাদের মহান ইমাম ও তাত্ত্বিকগণ ইসলামের এই পূর্ণাঙ্গতাকে পাঁচটি শিরোনামে বিশ্লেষণ করেছেন। যথা,

১। ঈমান আকীদা-বিশ্বাস। যার প্রধান সম্পর্ক অন্তরের সাথে। যেমন, আল্লাহর একত্ববাদ, তাঁর পবিত্র গুণাবলি, পরকালে বিশ্বাস, জান্নাত জাহান্নাম, নবুওত ও রিসালাত, ফেরেশতায় বিশ্বাস করা ইত্যাদি।

২।  ইবাদত বন্দেগী। যেমন, নামাজ, রোজা, যাকাত, হজ্ব, কুরবানি, যিকির কুরআন তেলাওয়াত ইত্যাদি।

৩। মুয়ামালাত অর্থাৎ পারষ্পরিক লেনদেন সংক্রান্ত বিধান। যেমন কেনা বেচার নানা ধরণ, ভাড়া, বিয়ে-শাদি তালাক, ইত্যাদি।

৪। মুয়াশারাত অর্থাৎ সামাজিক সম্পর্ক। বিয়ে শাদি, আত্মীয়তা ও মানুষের পারষ্পরিক সম্পর্ক।

৫। আখলাকে হাসানা বা উত্তম চরিত্র, আত্মিক পরিশুদ্ধি ও পবিত্রতা অর্জন।

পূর্ণাঙ্গতা ও ব্যাপকতা ইসলামের বৈশিষ্ট্য হওয়ার অর্থ হচ্ছে, এটি ইসলাম ছাড়া অন্যকোন দর্শন, মতবাদ বা অন্যকোন ধর্ম ও জীবনব্যবস্থায় মধ্যে পাওয়া যাবে না। আমরা খেয়াল করলে দেখবো—

  • ধর্মনিরপেক্ষ ও বস্তুবাদী সম্প্রদায়ের আলাপ আলোচনা চিন্তা ও দর্শন সবকিছুই দুনিয়াবি বা ইহকালীন জীবনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়ে থাকে। ফলে তাদের আইনকানুন, মূল্যবোধ ও জীবন দর্শনে পরকাল-চিন্তার কোন উপস্থিতি নেই। শুধু তাই নয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা পরকাল-চিন্তার ঘোর বিরোধি এবং আক্রমনাত্মক।
  • অপরদিকে অন্যান্য ধর্ম কিছু ক্ষেত্রে পরকাল সম্পর্কে অপূর্ণাঙ্গ ও অস্পষ্ট ধারণা দিয়েছে। কিন্তু দুনিয়ার এই সুবিস্তৃত জীবন মানুষ কিভাবে পরিচালনা করবে,  এসম্পর্কে নির্দেশনা পাওয়া যায় না। কোন ধর্ম দিয়ে থাকলেও সেটা অতি সীমিত খণ্ডিত ও অপর্যাপ্ত। 

ইসলামের এই পূর্ণাঙ্গতা ও ব্যাপকতাকে বস্তুবাদী ও ধর্মনিরপেক্ষ সম্প্রদায় কিছুতেই মেনে নিতে চায় না। তারা ইসলামকে শুধু বাহ্যিক কিছু অনুষ্ঠান, ইবাদত বন্দেগি ও আধ্যাত্মিকতার মতো বিষয়ে সীমিত হিসেবে দেখতে ও দেখাতে চায়। এই মনোভাবের একটি কারণ তো হচ্ছে, তাদের জীবনদর্শনে পূর্ণাঙ্গতা না থাকা। আরেকটি কারণ হল, যদি অর্থনীতি রাজনীতি সমাজব্যবস্থা বিচারব্যবস্থা প্রভৃতি বিষয়ে ইসলাম তার নিজস্ব বক্তব্য ও দর্শন নিয়ে উপস্থিত থাকে, তাহলে এটা তাদের চিন্তা ও মূল্যবোধের অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জ করবে।  এভাবে তাদের প্রতিদ্বন্দি ও প্রতিযোগী তৈরি হবে, স্বাভাবিকভাবেই।

এজন্য তারা প্রোপাগাণ্ডা ছড়িয়েছে, মিডিয়া থেকে শুরু করে বই পত্র পাঠ্যপুস্তক এনজিও রাজনৈতিক মঞ্চ সবকিছুকে একাজে ব্যবহার করেছে। আবার কোন ক্ষেত্রে কুরআন হাদীসের খণ্ডিত বক্তব্য তুলে ধরে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। এভাবে মুসলিম সমাজের বিশাল অংশ, কুরআন হাদীস ও ইসলাম সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না থাকার কারণে, এই প্রোপাগাণ্ডার শিকারে পরিণত হয়েগেছে। যা অত্যন্ত দুঃখজনক ও ভয়াবহ।

আমরা বলেছি, সেক্যুলার ও বস্তুবাদী সম্প্রদায় ইসলামের পরিধিকে সীমিত করে, অর্থনীতি রাজনীতি বিচারব্যবস্থা সংস্কৃতি ও অন্যান্য ইহাজাগতিক ক্ষেত্র থেকে ইসলামি দর্শন ও নির্দেশনাকে বাদ দেয়ার অসার ও অবান্তর একটি দাবি করে থাকে। এটি বুঝার জন্য আমরা এখানে তিনটি দিক সংক্ষেপে বর্ণনা করছি।

প্রথমত, কুরআন হাদীস ফিকহ ও ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান রাখেন এমন ব্যক্তি মাত্রই এই উক্ত দাবীটি কতটা অবাস্তব ও ভিত্তিহীন তা ধরতে সক্ষম হবেন। কয়েকটি পয়েন্ট খেয়াল করুন—

  • কুরআনে কারীমে নামাজ রোজা ও অন্যান্য ইবাদতের বাইরে বিপুল সংখ্যক আয়াত রয়েছে যেখানে অর্থনৈতিক লেনদেন, সাক্ষ্যপ্রদান, যুদ্ধনীতি, শান্তি চুক্তি ও পররাষ্ট্র নীতি, পারিবারিক আইন ইত্যাদি বিষয় আলোচিত হয়েছে। এমনকি কুরআনে কারীমের সবচে’ বড় আয়াত, সুরা বাকারার ২৮২ নাম্বার আয়াতে ঋন গ্রহণ, ঋন প্রদানসহ অর্থনৈতিক লেনদেনের খুঁটিনাটি বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। অর্থাৎ, কোরআনের সর্ববৃহৎ আয়াতটিও মানুষের অর্থনৈতিক বিষয় সংশ্লিষ্ট।
  • হাদিসের সমৃদ্ধ যে কোনো কিতাব, যেমন সহিহ বুখারি, সহিহ মুসলিম, সুনানে তিরমিযী বা এজাতীয় অন্যান্য কিতাবের বিষয়সূচি পাঠ করলেও দেখা যাবে শুরুতে আকীদা ঈমান ইবাদত বন্দেগীর পর্যাপ্ত আলোচনা যেমন রয়েছে, তারপর অধ্যায়ের পর অধ্যায়ে বিস্তৃতভাবে আলোচিত হয়েছে বৈষয়িক বিষয়, ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন, সমাজ ব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে।
  • ফিকহের অন্যতম প্রসিদ্ধ কিতাব “হেদায়া”র আলোচ্য বিষয় ও কলেবর থেকে এই বাস্তবতাটি উপলব্ধি করা সম্ভব। এর প্রথম খণ্ডে রয়েছে ইবাদত—পবিত্রতা নামাজ রোজা যাকাত হজ সম্পর্কিত আলোচনা। বাকি তিন খন্ডেই স্থান পেয়েছে বৈষয়িক বিষয়আশয়। তবে মনে রাখতে হবে, এসবের দ্বারা এটা প্রমাণ হয় না, বা প্রমাণ করা উদ্দেশ্য নয় যে,  ইসলামে বৈষয়িক বিষয়ের গুরুত্ব সবচে বেশি। বরং আগের আলোচনা থেকে গুরুত্ব ও মর্যাদার একটি স্তরবিন্যাসের আমরা জেনেছি। সে হিসেবে সবচে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ঈমান আকীদা বিশ্বাস। তারপর ইবাদত বন্দেগী। তারপর ধারাবাহিকভাবে অন্যান্য বিষয়।
  • তাছাড়া ইসলামের সুদীর্ঘ ইতিহাসও একথা প্রমাণ করে ইসলাম শুধু কিছু বিষয়ের মধ্যে সীমিত নয়, যেমনটি সেক্যুলার সম্প্রদায় দাবী করে থাকে। ইসলামের দীর্ঘ ইতিহাস আছে, যেখানে খলীফা, সুলতান, রাজা বাদশা ও তাদের নিয়োগ দেয়া বিচারকগণ কুরআন হাদীসের আলোকে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। যদিও তাদের কেউ কেউ প্রবৃত্তির তাড়নায় কখনো জুলুমও করেছেন, কুরআন হাদীসের বাইরে চলেছেন। কিন্তু নীতিগত ও আইনিভাবে কুরআন হাদীস মানতে বাধ্য ছিলেন।

দ্বিতীয়ত, বস্তুবাদী ও সেকুলারদের দর্শন মানুষ ও তার জীবনকে দুভাগে ভাগ করে ফেলে। একভাগ হচ্ছে মানুষের মন ও হৃদয় জগত। একে ধর্ম শাসন করবে বা এই অংশ দিয়ে মানুষ ধর্ম চর্চা করবে। আরেকভাগ হচ্ছে মানুষের বাহ্য, দেহ ও শারিরিক কাজ কর্ম। এটা নিয়ন্ত্রণ করবে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় আইন, যা কোন ধর্মীয় অনুশাসন মানবে না।

বস্তুত তাদের এই দর্শনটি ইসলামের মৌলিক আকীদা পরিপন্থি। ইসলামি বিশ্বাস মতে মানুষের মধ্যে এমন বিভাজন করার কোন সুযোগ নেই। মানুষ, তার রূহ, মস্তিষ্ক, দেহ, বরং এই পৃথিবীতে দেখা অদেখা সবকিছুর প্রকৃত ও একক মালিকানা আল্লাহ তায়ালার। আল্লাহর এই মালিকানায় কোন রাষ্ট্র দেশ রাজা বাদশা বা শাসকের এতটুকু মালিকানা নেই। কুরআনে কারীম বারবার মানবজাতিকে এই সত্যটি স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।

“জেনে রেখ, আসমানসমূহ আর যমীনে যা কিছু আছে সবই আল্লাহর। (সুরা ইউনুস, আয়াতঃ ৬৬)

“আকাশসমূহে যা আছে, জমিনে যা আছে, এই এতদুভয়ের মাঝে যা আছে আর যা আছে ভূগর্ভে সব তাঁরই।“ (সুরা ত্বহা, আয়াতঃ ৬)

ফলে এই বদ্ধমূল বিশ্বাসের কারণে একজন মুসলিম শুধু তার অন্তরকে আল্লাহর কাছে অর্পন করবেন, আর দৈহিক কাজ কর্ম ও যাবতীয় বৈষয়িক বিষয় অন্য কারো কাছে সঁপে দিবেন, তা কোন অবস্থাতেই বৈধ সংগত ও যৌক্তিক হতে পারে না।

তৃতীয়ত, মানুষের জীবন একটি অবিভাজ্য একক বিষয়। ফলে এখানে অর্থনীতি থেকে কেউ নৈতিকতাকে আলাদা করতে পারবে না। আইন প্রণয়ন ও দণ্ডবিধিকে বিশ্বাস থেকে আলাদা করা সম্ভব নয়। ব্যক্তিকে যেমন পরিবার থেকে আলাদাভাবে দেখার সুযোগ নেয়, সমাজকে যেমন রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন করা অসম্ভব, তেমনি দেহ ও অন্তরের মধ্যে বিভাজন করা, বিশ্বাসকে কাজকর্ম থেকে সম্পর্কহীন করার সুযোগ নেই। কেননা সব কিছু একক ও অবিভাজ্য। হয়তো কাগজে কলমে, জোর করে বিভাজন করার ফরমান জারি করা যাবে, কিন্তু বাস্তবে নয়।

ষষ্ঠ বৈশিষ্ট্যঃ ইসলাম কেয়ামত পর্যন্ত সর্বদা সংরক্ষিত অবিকৃত থাকবে

ইসলামের একটি বড় বৈশিষ্ট্য এটিও যে এই ধর্মের উৎস কুরআন ও হাদীস যেমন পরিপূর্ণরূপে সংরক্ষিত ও অবিকৃত থাকবে, এমনিভাবে ইসলামের আকীদা বিশ্বাস বিধিবিধান নীতিমালা আদর্শ ও চেতনার কোন কিছুকেই বিকৃতি স্পর্শ করতে পারবে না। আল্লাহ তায়ালা যেভাবে অবতীর্ণ করেছেন, নবীজি সাহাবীদের যেভাবে ইসলাম শিখিয়েছেন, হুবহু সেভাবেই থাকবে, কালের কোনো বাঁকে এসে বিকৃতির শিকার হবে না। এমনিভাবে মুসলিমজাতিও সামষ্টিকভাবে কখনো পথহারা বা গোমরাহ হবে না।

তবে এটা সত্য, বিভিন্ন কালে ইসলামকে বা ইসলামের বিধিবিধানে বিকৃতি ঘটানোর অপচেষ্টা অনেকেই করবে। বিভিন্ন স্বার্থে নামধারী কিছু মুসলিম ও অমুসলিমদের পক্ষ থেকে এটা অব্যাহত থাকবে। তবে বিকৃতির এই অপচেষ্টা কখনোই চূড়ান্ত সাফাল্য অর্জন করবে না। বরং আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে দ্বীন ইসলাম ও তার সামগ্রিক শিক্ষাকে সংরক্ষণ করার লক্ষ্যে বিভিন্ন স্তর ও শাখার পণ্ডিত নিবেদিত প্রাণ আলেম ও ইমাম তৈরি করবেন। যারা নিজের সময় সম্পদ ও জীবন দিয়ে দ্বীনকে সংরক্ষণ করবেন। নবীজি বলেন, “দ্বীনের এই ইলম বা জ্ঞান পরবর্তী প্রত্যেক প্রজন্মের নিষ্ঠাবানরা বহন করবে, তারা সীমালঙ্ঘনকারীদের বিকৃতি থেকে, বাতিলপন্থীদের জালিয়াতি থেকে এবং মুর্খদের অপব্যাখ্যা থেকে দ্বীনের এই ইলমকে রক্ষা করবে।“ (মুসনাদে বাযযার ১৬/২৪৭, আস সুনানুল কুবরা, ইমাম বাইহাকী, হা:২০৯১১-১২)

স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা ইসলামকে বিকৃতি থেকে হেফাজত করার দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনি ঘোষনা করেছেন,

“নিশ্চয় আমিই নাযিল করেছি এই উপদেশবানি (কুরআন) আর অবশ্যই আমি তার সংরক্ষক।“ (সুরা হিজর, আয়াতঃ ৯)

কুরআন সংরক্ষিত থাকার অর্থ হলো এর অক্ষর শব্দ ও বাক্যগুলো যেমন অবিকৃত থাকবে, ঠিক তেমনি তার মর্ম ব্যখ্যা ও বিশ্লেষণও সংরক্ষিত থাকবে।  শুধু শব্দ ও বাক্যই তো কুরআন নয়, শব্দ বাক্য ও তার অর্থের সমষ্টি মিলেই কুরআন। তাছাড়া বিষয়টি স্পষ্টভাবে আল্লাহ তায়ালা বর্ণনাও করেছেন। তিনি ইরশাদ করেন,  “এর সংরক্ষণ ও পড়ানোর দায়িত্ব আমারই। কাজেই আমি যখন তা পাঠ করি, তখন তুমি সে পাঠের অনুসরণ কর। অতঃপর তা বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা আমারই দায়িত্ব।“ (সুরা কিয়ামাহ, আয়াতঃ ১৭-১৯)

এখানে কুরআনের ব্যাখ্যাকে আল্লাহ তায়ালা নিজের দিকে সম্পৃক্ত করেছেন। অন্য আয়াতে এই ব্যাখ্যা করার দায়িত্ব নবীজিকে দিয়েছেন।  “আমি তোমার উপর উপদেশবাণী অবতীর্ণ করেছি, যাতে করে তুমি মানুষের কাছে বিষদভাবে বর্ণনা করতে পার, যা তাদের জন্য নাজিল করা হয়েছে।” (সুরা , আয়াতঃ )

নবীজি কুরআনের ব্যাখ্যা হাদীস ও তার কর্মপন্থা-সুন্নাহ দ্বারা সম্পন্ন করেছেন। কুরআন যেমন মানতে হবে, এর ব্যখ্যা হাদীসও অনুসরণ করতে হবে। এমনিভাবে কুরআন যেমন সংরক্ষিত থাকবে, এর ব্যাখ্যা হাদীসও সংরক্ষিত থাকবে। কারণ এদুটি পরষ্পরের সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত।

ইসলামের এই বৈশিষ্ট্যের কথা নবীজির এ দুটি হাদীসেও এসেছে। তিনি বলেন, কোনো গোমরাহি বা ভ্রষ্টতার ব্যাপারে আমার উম্মত সামগ্রিকভাবে একমত হবেনা। (ইবনে মাজাহঃ ৩৯৫০)

অপর হাদীসে বলেছেন,আমার উম্মতের একটি দল লোক সর্বদাই হকের উপর প্রতিষ্ঠিত (অবিচল) থাকবে। তাদের সঙ্গ ত্যাগ করে কেউ তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। এমন কি এভাবে আল্লাহর আদেশ (অর্থাৎ কিয়ামত) এসে পড়বে আর তারা যে অবস্থায় ছিল সেভাবেই থাকবে। (তিরমিযী, হাদীসঃ২২২৯ )

অর্থাৎ ইসলামের সঠিক রূপরেখা ও শিক্ষা থেকে অনেকেই সরে যাবে, বিকৃতি ও ভ্রষ্টতার শিকার হয়ে যাবে, কিন্তু একটি দল সব সময় কেয়ামত পর্যন্ত সঠিকভাবে ইসলামকে চর্চা করবে।

অপরদিকে অন্যান্য ধর্মে অবিকৃত ও সংরক্ষিত থাকার কোন প্রতিশ্রুতিও নেই  এবং  কালের আবর্তে এগুলো বাস্তবে বিকৃতও হয়েছে। খৃষ্টধর্ম তো খুব দ্রুত সময়ের ভেতর বিকৃতির শিকার হয়েগেছে। আর এজন্য আল্লাহ তায়ালা কুরআনের শুরতেই তাদেরকে “পথভ্রষ্ট” বলে আখ্যায়িত করেছেন।

যেহেতু এটি ইসলামের একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য তাই কোন ব্যক্তি যদি দাবী করেন, ইসলামের এই বিষয়টি বা কুরআনের এই আয়াতটি শুধুমাত্র তিনিই বুঝেছেন, অতীতের ইমামগণ বুঝেননি, বা সবাই সম্মিলিতভাবে ভুল করেছেন, তাহলে উল্লেখিত আয়াত ও হাদীসের দাবী অনুযায়ি তার চিন্তাটি ভ্রান্ত ও প্রত্যাখ্যাত হিসেবে গণ্য হবে। বুঝাই যাচ্ছে, কেউ যদি পুরো ইসলামের ব্যাপারে এমন দাবী করে বসেন, তাহলে তার দাবীটি কী জঘন্য ও ভয়াবহ হবে! মাওলানা মওদুদী মরহুমের সাথে আহলে হক আলেমগণ ভীষণভাবে দ্বিমত করার অন্যতম কারণ এটাও যে তিনি ইসলামের এমন ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন, যা টিকাতে গিয়ে এপথেই তাকে হাঁটতে হয়েছে।হাল আমলের হিজবুত তাওহীদও এই প্রত্যাখ্যাত চিন্তার উপর তাঁদের দলীয় দর্শন নির্মাণ করেছে আরো কট্টরভাবে। এবং যেসকল লামাজহাবি ব্যক্তিগণ দাবী করেছেন, মাযহাব অনুসরণ করে মুসলিম জাতি শতকের পর শতক ভুল পথে চলে এসেছে, এবং মাযহাব অনুসরণ বাদ দিয়ে দিতে হবে, তাদের বক্তব্যও একই কারণে অগ্রহণযোগ্য।

৭ম বৈশিষ্ট্যঃ ইসলাম সকল জাতিগোষ্ঠী ভূখণ্ডের ধর্মএটি বৈশ্বিক

ইসলামের বিধিবিধান যেমন ব্যাপক ও পূর্ণাঙ্গ এমনিভাবে ইসলামের পরিধিও বৈশ্বিক। ফলে,

  • এই ধর্ম কোনো বিশেষ অঞ্চল ভূখণ্ড বা দেশের মধ্যে সীমিত থাকবে না।
  • ইসলাম নির্দিষ্ট কোন জাতি বা গোষ্ঠির ধর্ম নয়। যেমন আরব পারসিক বা অন্য কোন জাতির জন্য বিশেষিত নয়। পৃথিবীর সকল জাতিগোষ্ঠিকে সঠিক পথ দেখানো ও আলোকিত করার জন্য ইসলামের আগমন হয়েছে।
  • এমনিভাবে একটি সমাজে যত শ্রেণি পেশা ও স্তরের মানুষ রয়েছে, ইসলাম সবার জন্য। ধনী গরিব, নারী পুরুষ, শিক্ষিত নিরক্ষর কারো জন্য এই ধর্ম বিশেষিত নয়। সবার জন্য এর দরজা উন্মুক্ত। বরং সবাইকে এখান থেকেই সঠিক জীবন দর্শন গ্রহণ করতে হবে।

ইসলামের এই বৈশিষ্ট্যের বিবরণ একাধিক আয়াত ও হাদীসে এসেছে। 

আল্লাহ তায়ালা বলেন, আমি তোমাকে বিশ্ববাসীর জন্য পাঠিয়েছি কেবল রহমত হিসেবে। (সূরা আম্বিয়া, আয়াতঃ ১০৭) অন্যত্র ইরশাদ করেছেন, বল, হে মানবজাতি! আমি তোমাদের সকলের জন্য আল্লাহর রাসূল। (সূরা আম্বিয়া, আয়াতঃ ১৫৮)

সুরা সাবায় বলেছেন, আমি তো তোমাকে কেবল সকল মানুষের জন্য পাঠিয়েছি, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারি হিসেবে। (সুরা সাবা, আয়াতঃ ২৮)

তাছাড়া হযরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রাঃ বর্ণিত একটি হাদীসে নবীজি নিজেও বলেছেন,

আমাকে এমন পাঁচটি বিষয় দান করা হয়েছে, যা আমার পুর্বে কাউকেও দান করা হয়নি। এর মধ্যে পঞ্চম বিষয়টি হচ্ছে, সমস্ত নবী প্রেরিত হতেন কেবল তাঁদের সম্প্রদায়ের জন্য, আর আমাকে প্রেরণ করা হয়েছে সমগ্র মানব জাতির জন্য। (সহিহ বুখারী, হাদিসঃ ৩৩৫)

এটা ইসলামের বৈশিষ্ট্য। এজন্য অন্যান্য ধর্ম ও দর্শন-মতবাদে এটি অনুপস্থিত। যেমন—

  • খ্রিষ্টধর্মকে যদিও খ্রিষ্টান পাদ্রীরা বৈশ্বিক ধর্ম হিসেবে প্রচার করছে, মিশনারির মাধ্যমে পুরো পৃথিবীতে বিশেষত মুসলিম দেশগুলোতে বিশেষভাবে ছড়িয়ে দেয়ার অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে, তবে তাদের বাইবেল কিন্তু এই কাজকে সমর্থন করে না। মথির ইঞ্জিলে ঈসা (আঃ) বলছেন, আমি শুধু বনী ইসরাইলের হারানো ভেড়ার পালের কাছে প্রেরিত হয়েছি। (মথিঃ  ২৪\১৫) শুধু তাই নয়, নিজ শিষ্যদেরকে অইহুদীদের কাছে যেতে নিষেধ করে বলেছেন, বরং তোমরা বনি ইসরাঈলের হারানো ভেড়াদের কাছে যাও। (মথিঃ ১০\৬)
  • ইহুদী ধর্মের মূল ধারার বক্তব্যও এমনই। ইহুদী নয় এমন কেউ ইহুদী ধর্ম গ্রহণ করতে পারবে না। তবে হাল আমলে রাজনৈতিক সার্থে লিবারাল ও বামপন্থি কিছু ইহুদী ভিন্ন মত পোষণ করা শুরু করেছেন, যেমন আনাদুল মিডিয়া প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
  • হিন্দু ধর্মের জাতপাত ও বিভাজনের বিষয়টি তো কমবেশি সবারই জানা রয়েছে।
  • অপরদিকে সমাজতন্ত্রের মূল ফোকাস কেবল শ্রমিক ও দরিদ্র শ্রেণির উপর। এবং অনেক ক্ষেত্রে তারা ধণিদেরকে মানবসমাজের শত্রু মনে করে এবং সে মাফিক আচরণও করেছে।
  • বিপরীতে পুঁজিবাদী দর্শনের মূল ফোকাস সমাজের বিত্তশালী ও ধণিকশ্রেণির উপর। তাদের স্বার্থ কিভাবে নিশ্চিত করা যায় এটাই তাদের কাজের মূল ক্ষেত্র। ফলে তাদের হাতে সমাজের গরীব ও দুর্বল শ্রেণির মানুষ ভয়াবহভাবে নিগৃহীত হচ্ছে হরহামেশা। মিডিয়া, আইন ও রাষ্ট্রীয় শক্তি ব্যবহার করে তাদের অধিকার হরণ করা খুবই সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু ইসলাম এসেছে সব শ্রেণী স্তর ও পেশার মানুষের মুক্তি ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার জন্য। এখানে কোন পক্ষপাত নেই। এখানে ধনীগরীব শ্রমিক মজদুর মহাজন সবাই ইনসাফ মাফিক তার অধিকার পাবে।

ইসলাম বৈশ্বিক হওয়া ধর্ম হওয়ার মর্যাদা লাভ করেছে এর পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, এই ধর্ম স্বয়ং জগতের সৃষ্টিকর্তা সর্বজ্ঞানী মহান আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক প্রণিত প্রেরিত সংরক্ষিত এবং সর্ব শেষ ও চূড়ান্ত মনোনীত ধর্ম হিসেবে ঘোষিত। ফলে বৈশ্বিক হওয়ার জন্য যে সকল উপাদান ও বৈশিষ্ট্য থাকা আবশ্যক ইসলামে এসব কিছু পূর্ণভাবে বিদ্যমান রয়েছে। এর অংশ হিসেবে কুরআন হাদীসে মূলনীতি হিসেবে অনেক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, আবার তা থেকে এমন সব শরয়ী মূলনীতি আহরণ করা হয়েছে, যেগুলোর আলোকে যুগজিজ্ঞাসার যেকোন সমাধান দেয়া সম্ভব এবং কার্যত শত শত বছর যাবত দেয়া হচ্ছে। পৃথিবী যতই উন্নতি ও অগ্রগতি লাভ করুক, ইসলাম মানবজাতিকে সঠিক পথপ্রদর্শন করতে সক্ষম এবং নিষ্ঠাবান সত্যসন্ধানি মানুষ এই সময়েও ইসলাম থেকেই জীবন চলার পাথেয় ও আলো গ্রহণ করছে।

এখানে আমাদের মনে রাখতে হবে, ইউরোপ আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী শক্তি নিজেদের বস্তুবাদী চিন্তা দর্শন সংস্কৃতি ও শিক্ষাকে পুরো বিশ্বের উপর জোরপূর্বক চাপিয়ে দিচ্ছে। আর একাজ সহজভাবে করার জন্য নিজ অঞ্চলের সংস্কৃতি ও মূল্যবোধকে “ইউনিভার্সাল বা বৈশ্বিক” আখ্যা দিয়ে থাকে। অথচ এগুলো তাদের নিজ ধর্ম সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রভাব বা “প্রতিক্রিয়ায়” জন্ম নিয়েছে, যা অন্যদের উপর চাপিয়ে দেয়ার কোন বৈধতা নেই। কিন্তু তারা জাতিসংঘসহ এমন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাহায্যে এই এজেণ্ডাগুলো বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। যার পেছনে তাদের সাম্রাজ্যবাদি ও পূজিবাদি স্বার্থই ক্রিয়াশীল রয়েছে, সচেতন পাঠক মাত্রই তা উপলব্ধি করেন।

৮ম বৈশিষ্ট্যইসলাম সর্বশেষ চূড়ান্ত ধর্ম, যা পূর্বের সকল ধর্মকে রহিত করেছে

হযরত আদম আঃ এর সময় থেকে মানবজাতিকে সঠিক পথ প্রদর্শনের জন্য আল্লাহ তায়ালা যত বিধিবিধান ও শরীয়ত পাঠিয়েছিলেন, তার মধ্যে সর্বশেষ শরীয়ত হচ্ছে যা তিনি হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর অবতীর্ণ করেছেন। ফলে নবীজির শরীয়তই চূড়ান্ত এবং এই শরীয়ত পূর্বের অবতীর্ণ হওয়া সমস্ত শরীয়ত ও বিধিবিধানকে রহিত ও নাকচ করে দিয়েছে। এখন আর পূর্বের কোন নবীর বিধান ও শরীয়ত মেনে চলার বৈধতা নেই। এক দিকে সেগুলো মানুষ বিকৃত করে ফেলেছে, যেমন কুরআন হাদীসে যার বিবরণ রয়েছে, অন্যদিকে কেউ যদি অবিকৃত হওয়ার দাবী করেও তবুও আগের কোন শরীয়ত মেনে চলা বৈধ হবে না। কেননা চূড়ান্ত শরীয়ত প্রেরণের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা সেগুলোকে অকার্যকর ঘোষণা করেছেন। তাহলে আল্লাহকে পেতে হলে এখন একমাত্র পথ হচ্ছে চূড়ান্ত শরীয়ত যে নবী নিয়ে এসেছেন তাঁর উপর ঈমান আনা, কেবল তাঁরই অনুসরণ করা। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, “বলে দাও, ‘যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তবে আমার অনুসরণ করো, আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের গুনাহসকল ক্ষমা করবেন, বস্তুতঃ আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। বলে দাও, তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করো। আর যদি পৃষ্ঠপ্রদর্শন কর তাহলে তো আল্লাহ কাফেরদের পছন্দ করেন না।“ (সূরা আলে ইমরান,৩১-৩২)

এজন্য অন্যান্য মানুষের সাথে আল্লাহ তায়ালা ইহুদী খ্রিষ্টানদেরকে, যারা হজরত মুসা আঃ ও হজরত ঈসা আঃকে অনুসরণ করার দাবীদার, সবাইকে নবীজির উপর ঈমান আনার নির্দেশ দিয়েছেন। যারা ঈমান আনেনি বা আনবে না তাদেরকে কাফের আখ্যায়িত করেছেন। কুরআনে কারীমে একাধিক আয়াতে বিষয়টি বারবার আলোচিত হয়েছে।

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তাঁর আনীত শরীয়ত চূড়ান্ত হওয়ার কথা বিভিন্ন হাদীসে তুলে ধরেছেন। সহিহ মুসলিমে বর্ণিত একটি হাদীসে বলেছেন, সেই সত্তার শপথ যার হাতে মুহাম্মদের প্রাণ! এই উম্মতের যে কেউ, চাই সে ইহুদী হোক বা খৃস্টান হোক, আমার (আগমনের) কথা শুনল, তারপর আমি যা নিয়ে প্রেরিত হয়েছি, তার প্রতি ঈমান না এনে মৃত্যুবরণ করল, সে অবশ্যই জাহান্নামবাসী হবে। (সহিহ মুসলিম, হাদীসঃ ১৫৩)

শুধু ইহুদী খৃষ্টান নয়, আগের যুগের কোনো নবীও যদি এই যুগে থাকতেন, তাহলে তাঁকেও হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ করতে হত। সুরা আলে ইমরানের ৮১-৮২ নাম্বার আয়াতে বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে। এবং নবীজিও এক হাদীসে বলেছেন, আমার ভাই মুসা যদি জীবিত থাকতেন তাহলে তাঁকেও আমার অনুসরণ করতে হত। (সাহাবি হজরত জাবের রাঃ এর সূত্রে শরহে সুন্নাহ, হাদীস নংঃ ১২৬)

এবং একারণেই শেষ যামানায় কেয়ামতের আগে যখন হজরত ঈসা আঃ আগমন করবেন তখন তিনি নবীজির শরীয়ত মেনে চলবেন। তাঁরই অনুসরণ করবেন।

নবীজির উপর অবতীর্ণ বিধিবিধান ও শরীয়ত চূড়ান্ত হওয়ার সাথে আমরা আরেকটি মৌলিক আকীদার স্পষ্ট সম্পর্ক দেখতে পাই। তা হলো খতমে নবুওয়তের আকীদা। নবীজির শরীয়তই চূড়ান্ত ও সর্বশেষ তাই নবীজিও সর্বশেষ নবী ও রাসূল, তাঁর আগমনের পর আর কোন নবী বা রাসূল আবির্ভাব হবে না এবং এর প্রয়োজনও নেই। কুরআন ও হাদীসে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে এ আকীদা বর্ণনা করা হয়েছে। সুরা আহযাবে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, মুহাম্মদ তোমাদের পুরুষদের কারো পিতা নন। তবে তিনি আল্লাহর রাসূল ও নবীদের সমাপ্তকারি। (সুরা আহযাব, আয়াতঃ ৪০)

নবীজিও বিভিন্ন প্রসঙ্গে এই মৌলিক আকীদা তুলে ধরেছেন। বলেছেন, আমি নবীদের ধারার সমাপ্তকারী। (সহিহ বুখারি, হাদীসঃ ৩৫৩৫)

৯ম বৈশিষ্ট্যইসলামে পূর্ববর্তী সকল নবীদের মৌলিক শিক্ষা বিদ্যমান

এটিও ইসলামের একটি বৈশিষ্ট্য। পূর্ববর্তী সকল নবী রাসূল যে মৌলিক আকীদা বিশ্বাস ও শিক্ষা নিয়ে এসেছিলেন, তাদের যে আদর্শ ছিল, এগুলো নবীজির শিক্ষায়ও রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা কুরাআন ও হাদীসের মাধ্যমে সেগুলো বিশুদ্ধভাবে সংরক্ষণ করেছেন। যদিও পূর্ববর্তী লোকেরা তাদের নবীদের শিক্ষা বিকৃত ও রদবদল করেছিল।

আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, আর আমি তোমার উপর সত্যসহ কিতাব অবতীর্ণ করেছি, যা তার পূর্ববর্তি কিতাবের সত্যায়নকারি ও সংরক্ষক। (সুরা মায়েদা, আয়াতঃ ৪৮)

তাফসিরে উসমানিতে আল্লামা শিব্বির আহমদ উসমানি লিখেছেন, আল্লাহ তায়ালার যে আমানত তাওরাত ইঞ্জিল ইত্যাদি আসমানি কিতাবে গচ্ছিত ছিল তা আরো বেশি বিষয় সহ কুরআনে কারীমে রক্ষিত আছে। তাতে কোনো খেয়ানত হয় নি। আর সেই কিতাবগুলোর যেসব শাখাগত বিষয় কেবল তখনকার লোকদের অবস্থার উপযোগি ছিল তা কুরআনুল কারীম মানসুখ বা রহিত করে দিয়েছে। এবং যেসব বিষয় অপূর্ণ ছিল সেসবে পূর্ণতা দিয়েছে। (সুরা মায়েদা, আয়াতঃ ৪৮)

সুরা আনআমে নবী রাসুলদের আলোচনার পর বলা হয়েছে, এঁরাই তাঁরা, আল্লাহ যাঁদের সঠিক পথে পরিচালিত করেছেন। অতএব আপনি তাঁদের পথের অনুসরণ করুন। (সুরা আনআম, আয়াতঃ ৯০)

আল্লামা উসমানি লিখেছেন, আকীদা-বিশ্বাস, দীনের উসূল (বা মৌলিকবিষয়াদি) ও বুনিয়াদি উদ্দেশ্যের ক্ষেত্রে সমগ্র নবী আলাইহিমুস সালাম এক ও অভিন্ন। সকলেরই বুনিয়াদী দস্তুর এক, প্রত্যেক নবীকে তার উপর চলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আপনিও এ সুদৃঢ় সরলপথে চলতে থাকার জন্য আদিষ্ট হয়েছেন। সারকথা, বর্তমান আয়াতে এ বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে যে, মৌলিকভাবে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পথ পূর্ববর্তী নবীগণের পথ থেকে ভিন্ন নয়। আর শাখাগত ব্যাপারে যে (এখতেলাফ বা) ভিন্নতা রয়েছে, তা প্রত্যেক জমানার অবস্থা ও যোগ্যতা অনুযায়ী পূর্বেও ছিল, সুতরাং এখনো তা থাকলে কোন ক্ষতি নেই। (তাফসীরে উসমানি, সুরা আনআম, আয়াতঃ ৯০)

কিন্তু এই বৈশিষ্ট্য অন্যান্য ধর্মে অনুপস্থিত। যেখানে তারা যে নবীদের অনুসরণের দাবীদার, তাদের শিক্ষাই সংরক্ষণ করতে ব্যার্থ হয়েছে, সেখানে সকল নবীদের শিক্ষার সঠিক বিবরণ পাওয়া তো অনেক দূরবর্তি ব্যাপার।

যে ইবরাহীম আঃ এর অনুসরণের দাবী সকল ধর্মের অনুসারিরা করে থাকে, সেই ইবরাহীম আঃ এর শিক্ষাও শুধু ইসলাম ধর্মে সঠিকভাবে সংরক্ষিত রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, তুমি বলে দাও, আমার প্রতিপালক আমাকে সরল পথে পরিচালিত করেছেন। যা সরল ধর্ম, ইবরাহীমের ধর্মাদর্শ। যিনি একনিষ্ঠ ছিলেন এবং অংশীবাদীদের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন না। (সুরা আনআম, আয়াতঃ ১৬১)

১০মমধ্যপন্থা ভারসাম্য ইসলামের অন্যতম বৈশিষ্ট্য, এখানে প্রান্তিকতা বা বাড়াবাড়ি শিথিলতার স্থান নেই

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানবজাতির সামনে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে যে শিক্ষা পেশ করেছেন এর বিশেষ একটি বৈশিষ্ট্য হল এই ভারসাম্য। ইসলামের সকল বিধান ও শিক্ষায় এর উপস্থিতি রয়েছে। কোন বিধান বা বক্তব্যে কোন প্রান্তিকতা বাড়াবাড়ি বা শিথিলতা নেই। আল্লাহ তায়ালা মুসলিম জাতিকে সম্বোধন করে বলেছেন, আর এভাবেই আমি তোমাদের মধ্যপন্থী উম্মত বানিয়েছি। (সুরা আনআম, আয়াতঃ ১৬১)

নবীজি বলেছেন, আমাকে সরল সহজ ধর্ম দিয়ে প্রেরণ করা হয়েছে। ( ইবনে হাজার আসকালানি কৃত কাশফুস সিতর, হাদীস নংঃ ৩৭)

ইসলামের এই ভারসাম্য আকীদা বিশ্বাস, ইবাদত বন্দেগী থেকে শুরু করে সব মানব জীবনের সর্বক্ষেত্রে বিদ্যমান রয়েছে। দুনিয়ার জীবন ও পরকালের মধ্যে ভারসাম্য শেখানো হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তোমাকে যা দিয়েছেন তার মাধ্যমে পরকালের নিবাস লাভের চেষ্টা কর। এবং দুনিয়া হতেও নিস্যা অগ্রাহ্য করো না।  (সুরা ক্বাসাস, আয়াতঃ ৭৭) অর্থাৎ আখেরাতের নিবাস অনুসন্ধানের মানে এই নয় যে দুনিয়ার প্রয়োজনসমূহ বিলকুল অগ্রাহ্য করা হবে। দুনিয়ার প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ ও তা রাখাতে দোষের কিছু নেই। হ্যাঁ, দুনিয়ার কামাই রোজগারে এভাবে নিমজ্জিত হয়ো না যদ্দরুণ আখেরাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। (মুফতি তাকী উসমানি কৃত, তাওজিহুল কুরআন) ফলে ইসলামে জগত জীবন থেকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হয়ে বৈরাগ্যব্রত গ্রহণের সুযোগ নেই। যেমনটি অনেক ধর্মে রয়েছে।

এমনিভাবে আল্লাহর অধিকার (হুকুকুল্লাহ) ও মানুষের অধিকার (হুকুকুল ইবাদ) সম্পর্কে ভারসাম্যপূর্ণ ও সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছে। নবীজি তাঁর সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাঃকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আমার কাছে তো তোমার সম্পর্কে খবর পৌঁছেছে, তুমি সারা রাত নামাজ পড় আর দিনের বেলা রোজা রাখ, তা কি সত্য? উত্তরে তিনি বললেন, জ্বি, সত্য। তখন নবীজি ইরশাদ করলেন, তুমি এমনটা কিছুতেই করবে না। বরং রাতে ঘুমাও এবং নামাজ পড়। দিনে রোজা রাখো আবার রোজা রাখা থেকে বিরতও থাকো। কারন তোমার উপর তোমার চোখের হক আছে। শরীরেরও অধিকার আছে। তোমার স্ত্রীরও তোমার উপর অধিকার আছে। মেহমান ও বন্ধুরও অধিকার আছে। (সহিহ বুখারি, হাদীস নং ১৯৭২, সুনানে নাসাঈ, হাদীস নং ২৩৯১) নবীজির সাহাবীগণও তাঁর থেকে ভারসাম্যের এই সবক উত্তমভাবে গ্রহণ করেছিলেন। হজরত সালমান ফারসি রাঃ তাঁর সঙ্গী সাহাবী আবু দারদা রাঃ কে এক প্রসঙ্গে বলেছিলেন, তোমার উপর তোমার প্রতিপালকের অধিকার রয়েছে। তোমার নিজেরও অধিকার রয়েছে। স্ত্রীও তোমার কাছে নায্য অধিকার পায়। এতএব সবাইকে তার প্রাপ্য অধিকার দাও।“ আবু দারদা রাঃ নবীজির কাছে সালমান রাঃ এর এই বক্তব্য উদ্ধৃত করলে নবীজি সমর্থন করে বললেন, “সালমান সত্য বলেছে।“ (সহিহ বুখারি, হাদীস নংঃ ৬১৩৯)

অথচ বর্তমান সময়ে পুরো পৃথিবীতে অধিকারের যত বয়ান ও দর্শন চালু রয়েছে, সেখানে এই ভারসাম্য নেই। আছে ভয়াবহ প্রান্তিকতা। অধিকারের পুরো ধারণাটিই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মানুষ ও তার চারপাশকে ঘিরে। এতে মানুষের সৃষ্টিকর্তা ও তাঁর প্রেরিত নবী রাসূল কুরআন কিতাবের কোন অধিকারের আলোচনা নেই। ফলে এই অধিকারের বয়ান অপূর্ণ। শুধু তাই নয় বরং একপেশে অধিকারের বয়ানের কারণে পুরো পৃথিবীতে বিস্তর সংঘাত ও অস্থিরতা তৈরি হয়েছে এবং হতে থাকবে। কারণ পৃথিবীর বিপুল সংখ্যক বিশ্বাসীমানুষ তাদের বিশ্বাসকে বাদ দিয়ে অধিকারের বয়ান মেনে নিবে না।

যাহোক ইসলামের মধ্যপন্থা ও ভারসাম্যের শিক্ষা ও দর্শনটি ছোট থেকে ছোট সব ক্ষেত্রে রয়েছে। এমন একটি উদাহরণ দিয়ে এই প্রসঙ্গের ইতি টানছি। মানুষ অর্থ উপার্জন করে কিভাবে ব্যায় করবে, এ বিষয়ে কুরআন মানুষকে মধ্যপন্থা অবলম্বনের নির্দেশনা দিয়ে বলছে, (কৃপণতাবশে) নিজের হাত ঘাড়ের সাথে বেঁধে রেখো না এবং (অপব্যয়ী হয়ে) তা সম্পূর্ণরূপে উন্মুক্তও করে দিয়ো না। অন্যথায় তুমি তিরস্কৃত, নিঃস্ব হয়ে পড়বে। (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াতঃ ২৯)

ইসলামের এমন আরো বৈশিষ্ট্য ও স্বকীয়তা রয়েছে, যা দীর্ঘ আলোচনার দাবী রাখে। আমাদের চর্চিত ইসলামে যেন তার বৈশিষ্ট্য ও স্বকীয়তাগুলো প্রতিফলিত হয়, আল্লাহ তায়ালার কাছে এই মোনাজাত করি।

Picture of আনাস চৌধুরী
আনাস চৌধুরী
আনাস চৌধুরীর জন্ম নব্বইয়ের শেষ দিকে, হবিগঞ্জ সদরে। পড়াশোনা করেছেন ঢাকার জামিয়াতুল উলুমিল ইসলামিয়াতে। পরবর্তিতে দারুল উলুম দেওবন্দেও অধ্যয়ন করেছেন এক বছর। পেশায় তিনি একজন শিক্ষক, হবিগঞ্জের দারুল ইরশাদ বহুলা মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করছেন। লেখালেখি, অনুবাদ ও দ্বীনি আলোচনাতেও তার অংশগ্রহণ রয়েছে। বাংলা ও আরবীতে অনুবাদ করেছেন বেশ কিছু বই। ইতিমধ্যে কয়েকটি প্রকাশিত হয়েছে।
লেখকের অন্যান্য লেখা

সূচিপত্র

সর্বাধিক পঠিত
উত্তম আখলাক: অনন্য ছয়টি মর্যাদা
নকল মূদ্রা: শব্দের খোলসে মতাদর্শ ~ আব্দুল্লাহ আন্দালুসি
হাদিস শাস্ত্রের প্রাচ্যবাদী বয়ান এবং মুসলিম সমাজে এর প্রভাব
দ্যা ফোরটি রুলস অফ লাভ: সুফিবাদের ইউটোপিয়া
ইয়াহইয়া সিনওয়ার: শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত লড়ে গেছেন যিনি
পরামর্শ বা মাশওয়ারা: ইসলামের অনুপম এক নির্দেশনা