কুরআনের আলোকে ‘তাকওয়া’ অর্জনের পাঁচ মাধ্যম

যেকোনো মুসলিমের কাছে ঈমান ইসলাম আকীদা আমলের মত ‘তাকওয়া’ শব্দটিও অতিপরিচিত। তাকওয়ার মূল কথা হলো, আল্লাহর প্রতি ঈমান এবং আখেরাতের প্রতি বিশ্বাস রেখে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এবং পরকালের আযাব থেকে বাঁচার আশায় আল্লাহ পাকের যাবতীয় আদেশ নিষেধ মেনে চলা এবং সতর্ক ও সুচিন্তিত জীবন যাপন করা।


একজন মুসলিমের জন্য তাকওয়া অর্জন করার কেন জরুরী এবং তাকওয়া অর্জনের প্রতিদান কী? কুরআন ও হাদীসের বিশাল অংশজুড়ে এ সম্পর্কে আলোচনা রয়েছে। তবে এ লেখায় আলোচনা করব, একজন মুসলিম তার জীবনে কিভাবে তাকওয়া অর্জন করে পারেন? কুরআনে কারীমে তাকওয়া অর্জন করার পথে সহায়ক মাধ্যম ও উপায় হিসেবে কোন বিষয়গুলোর প্রতি গুরুত্ব দিয়েছে? কয়েকটি আয়াতকে সামনে রেখে আমরা  এখানে পাঁচটি উপায় ও মাধ্যমের বিবরণ তুলে ধরছি।

  • পরকালের প্রতি মজবুত ও জাগ্রত বিশ্বাস এবং সর্বদা পরকালের সচেতন স্মরণ

পরকালের প্রতি বিশ্বাস একজন মুসলিমের জীবনে বিরাট প্রভাব রাখে। আল্লাহ তায়ালার সামনে দাঁড়ানো, সমস্ত কাজ কর্মের হিসেব দেয়া এবং এর ভিত্তিতে ভালো বা মন্দ ফলাফল বরণ করা, এই বিশ্বাস ও উপলব্ধি যার ভেতরে যতটা গভীরভাবে ক্রিয়াশীল থাকবে তার যাপিত সমগ্র জীবন ততটা স্বচ্ছ, সুন্দর ও সাবলীল হবে। এজন্য আমরা দেখি, কুরআনে কারীম অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোন আদেশ বা নিষেধ বর্ণনা করার পর পরকালের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। পরকালের এই বিশ্বাস একজন মুমিনের জীবনে চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। মূলত একারণে  তাকওয়া অর্জনের জন্য সহায়ক যে বিষয়গুলোর কথা কুরআনে কারীম বিশেষভাবে  বর্ণনা করেছে, আখেরাত বা পরকালের বিশ্বাস এর মধ্যে অন্যতম। কিয়ামত, মৃত্যু পরবর্তী জীবন, হাশর-নাশর, আল্লাহ পাকের সামনে দাঁড়ানো, তাঁর কাছে জবাবদিহিতা, এবিষয়গুলো যার মধ্যে যত বেশি পরিমাণে জাগ্রত থাকবে, তাকে তাড়িত করবে, আচ্ছন্ন করবে, সে তত সহজে তাকওয়া অর্জন করতে সক্ষম হবে।

এপ্রসংগে দুটি আয়াত পাঠ করুন—
হে মু’মিনগণ! তোমরা আল্লাহ্কে ভয় কর; প্রত্যেকেই ভেবে দেখুক আগামীকালের জন্যে সে কী অগ্রিম পাঠিয়েছে। আর তোমরা আল্লাহ্কে ভয় কর; তোমরা যা কর আল্লাহ্ সে সম্পর্কে অবহিত।     —আল হাশ্‌র – ১৮
হে মানব জাতি! তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর এবং ভয় কর এমন এক দিবসকে, যখন পিতা পুত্রের কোন কাজে আসবে না এবং পুত্রও তার পিতার কোন উপকার করতে পারবে না। লুকমান:৩৩
এই চারটি আয়াতে আল্লাহ তায়াল মুমিনদের তাকওয়া অর্জনের নির্দেশ দিয়েছেন। তারপর এই তাকওয়া অর্জনের পথে সহায়ক হিসেবে আখেরাত বা পরকালের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন৷

  • আল্লাহ তায়ালার বিভিন্ন গুণাবলি স্মরণ করা


আল্লাহ তায়ালার পরিচয় অর্জন করা, তাঁর সুউচ্চ গুণাবলি সম্পর্কে জানা মানব জীবনের অন্যতম লক্ষ্য। বহু আয়াতে কুরআনে কারীম মানুষকে এবিষয়ে সজাগ করেছে। কুরআনে কারীমের একজন অনুসন্ধানী পাঠক সহজেই লক্ষ করবেন, তাকওয়া অর্জনের সাথে আল্লাহ তায়ালার গুণাবলির একটি মজবুত সম্পর্ক রয়েছে। কুরআনে কারীম মহান রবের সুউচ্চ গুণাবলি সম্পর্কে জানা ও এনিয়ে চিন্তা ফিকির করাকে তাকওয়া অর্জনের পথ আখ্যায়িত করেছে। আল্লাহ পাকের গুণাবলি যখন একজন মুমিনের সামনে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে, তিনি মহান রবের প্রকৃত পরিচয় অর্জন করবেন, তখন তার জন্য তাকওয়া হাসিল করা সহজ হয়ে যাবে। নিচের কয়েকটি আয়াত পাঠ করুন।
আল্লাহকে ভয় কর। আর জেনে রাখো আল্লাহ সর্ববিষয়ে সম্যক অবগত। বাকারা-২৩১
আল্লাহকে ভয় কর, আর জেনে রাখো, তোমরা যা কর আল্লাহ সে সম্পর্কে সম্যক দ্রষ্টা। বাকারা-২৩৩
আল্লাহকে ভয় কর, আর জেনে রাখো, আল্লাহ শাস্তিদানে কঠোর। বাকারা-১৯৬


এ তিনটি আয়াতেই আল্লাহ তায়ালা প্রথমে তাকওয়া অবলম্বন করার নির্দেশ দিয়েছেন, তারপর আল্লাহর কিছু সিফাত ও গুণাবলি সম্পর্কে মনোযোগী হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।

  • যবানের হেফাজত করা


কথার মাধ্যমে আমরা মনের নানারকম ভাব মর্ম ও উদ্দেশ্য অন্যের কাছে প্রকাশ করতে পারি। আল্লাহ পাকের অসংখ্য অনুগ্রহের মধ্যে এই ভাবপ্রকাশ করা অন্যতম বিশেষ নেয়ামত। অন্যান্য নেয়ামতের মত এই নেয়ামতের মূল্যায়ন করা আমাদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। মূল্যায়নের পদ্ধতি হল, যবানকে আল্লাহর নির্দেশিত পথে ব্যবহার করা। যবান দ্বারা আল্লাহর কোন বিধানের লংঘন না করা, মিথ্যা, গীবত, গালাগাল ইত্যাদি থেকে বিরত থাকা।

যবানের সঠিক ব্যবহার যেমন মানুষের জন্য নেয়ামত, ঠিকএকই ভাবে যবানের অন্যায় ব্যবহার মানুষের ধংসের কারণ হয়ে থাকে। মুয়াজ ইবনে জাবাল রা. বর্ণিত একটি দীর্ঘ হাদীসে এসেছে, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  তাঁর জিহ্বা ধরে বললেন, এটিকে সংযত রাখ। মুয়াজ বললেন, হে আল্লাহ্‌র নবী, আমরা যে কথাবর্তা বলি সেই কারণেও কি আমাদের পাকড়াও করা হবে? তিনি বললেনঃ তোমার মা তোমাকে হারিয়ে ফেলুক, হে মু’আয! লোকদের অধঃমুখে জাহান্নামে নিক্ষেপ্ত হওয়ার জন্য এই যবানের কামাই ছাড়া আর কি কিছু আছে নাকি?
ইবনু মাজাহ ৩৯৭৩

কুরআনে কারীম পাঠ করলে আমরা দেখব, যবানের সংযত ও সঠিক ব্যবহারের সাথে তাকওয়ার একটি গভীর সংযোগ রয়েছে। কুরআনের ভাষ্য হল, যে সঠিক কথা বলে, সবরকম অন্যায় কথা বলা থেকে বিরত থাকে, তার পক্ষে তাকওয়া অর্জন করা সহজ হয়ে থাকে। এ আয়াতটি পাঠ করুন।


হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, আর সঠিক কথা বল। এতে আল্লাহ তোমাদের আমলসমূহ সংশোধন করবেন, আর তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করবেন। আহযাব-৭০-৭১

আয়াতে প্রথমে তাকওয়া অবলম্বনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, পরে এর জন্য একটি পথ বলে দেয়া হয়েছে, সঠিক সত্য ও ন্যায্য কথা বল। এর ফলাফল হল, তোমাদের অন্যান্য আমল সুন্দর ও সঠিক হবে। এবং এভাবে আল্লাহ তায়ালা তোমাদের পাপ মোচন করবেন। (মায়ারিফুল কুরআন: সূরা আহযাব:৭০-৭১)

  • পূণ্যবান ও উত্তম ব্যক্তির সাহচর্য গ্রহণ করা


মানুষের চিন্তা কর্ম ও আচরণ  যেসকল বিষয় দ্বারা প্রভাবিত হয়, এর মধ্যে অন্যতম একটি বিষয় হল— তার সাহচর্য। অর্থাৎ একজন মানুষ যাদের সাথে উঠাবসা, চলাফেরা করে, বিভিন্ন ভাবে সম্পৃক্ত হয়, তাদের দ্বারা সে ব্যপকভাবে প্রভাবিত হয়। ফলে সে যদি ভালো ও উতকৃষ্ট মানুষের সাথে চলাফেরা করে, তার আচরণ স্বভাব ও কাজ কর্মও উতকৃষ্ট হবে। যাদের সাথে সে উঠাবসা করে তাদের স্বভাব ও কর্ম যদি মন্দ হয়, তাহলে এর প্রভাবও তার কাজে কর্মে আচরণে প্রকাশ পাবে। কুরআনে কারিমে মন্দলোক থেকে দূরে থাকার নির্দেশনা দেয়ার সাথে সাথে পূণ্যবান লোকদের সাহচর্য গ্রহণ করতে ব্যপকভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে। শুধু কুরআন হাদীসের জ্ঞান অর্জন, আকীদা বিশ্বাস ও বিধি বিধান সম্পর্কে জানা থাকাই যথেষ্ট নয়, নেককার পরহেজগার মুমিনের সাহচর্য গ্রহণও প্রয়োজনীয় ও আবশ্যক। এই সৎ সাহচর্য তাকে তাকওয়া অর্জনের পথেও বিরাট সাহায্য করবে। কুরআন কারীম বলছে,

হে মুমিনগণ, আল্লাহকে ভয় কর, আর সত্যবাদীদের সাথে থাকো। তাওবা-১১৯


আয়াতটিতে তাকওয়া অবলম্বন করার আদেশ করা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, কিভাবে তাকওয়া অর্জন করব? পরের অংশেই বলে দেয়া হয়েছে, সত্যবাদী লোকদের সাথে থাকো। তাদের পথে চলো, তাদের সাথে চলো।

  • তাক্বওয়ার ফলাফল সম্পর্কে চিন্তা ফিকির করা


একটা জিনিস কতটা গুরুত্বপূর্ণ, মূল্যবান বা কাংখিত এটা নির্ভর করে তার ফলাফলের উপর। কোন জিনিসের ফলাফল মূল্যবান ও দামী হলে সে জিনিসের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়বে, মানুষ  যেকোন মূল্যে সেটা অর্জন করতে চাইবে।

কুরআনে কারীম তাকওয়ার ক্ষেত্রে এই পদ্ধতিটি অবলম্বন করেছে। এমনিতে বিপুল সংখ্যক আয়াতে তাকওয়ার অভাবনীয় অতুলনীয় ফলাফল ও সম্মানজনক পরিণতি তুলে ধরেছে। যেন মানুষ এই ফলাফলের কথা ভেবে নিজেদের জীবনে তাকওয়াকে ধারণ করে। তবে বিশেষ ভাবে তাকওয়ার নির্দেশ দেয়ার সাথেসাথে বেশ কিছু ফলাফল বর্ণনা করেছে, যা কুরআনের  সচেতন পাঠককে নাড়া দেয়, তাকওয়া অর্জনের প্রতি তার হৃদয় জগতে তীব্র আগ্রহ ও অদম্য আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি করে। নিচের আয়াতটি পাঠ করুন—


অবশ্যই যে নিজের অঙ্গীকার পূর্ণ করে এবং তাকওয়া অবলম্বন করে, আল্লাহ এমন মুত্তাকীদের ভালোবাসেন। (সূরা আলে ইমরান ৩/৭৬)

এতে তাকওয়ার ফলাফল হিসেবে বলা হয়েছে, আল্লাহ তায়ালা তাকওয়া অর্জনকারিদের ভালোবাসেন। যে তাকওয়া অর্জন করে একজন ক্ষুদ্র দুর্বল মানুষ মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তায়ালার ভালোবাসা অর্জন করে নেয়, সেই তাকওয়া অবলম্বন করার জন্য সব কিছু বিসর্জন করাই যুক্তি ও বিবেকের দাবী!

আল্লাহ তায়ালা আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে  তাকওয়া অবলম্বন করার তাওফিক দান করুন।

শেয়ার করুন

image_print
Picture of আনাস চৌধুরী
আনাস চৌধুরী
আনাস চৌধুরীর জন্ম নব্বইয়ের শেষ দিকে, হবিগঞ্জ সদরে। পড়াশোনা করেছেন ঢাকার জামিয়াতুল উলুমিল ইসলামিয়াতে। পরবর্তিতে দারুল উলুম দেওবন্দেও অধ্যয়ন করেছেন এক বছর। পেশায় তিনি একজন শিক্ষক, হবিগঞ্জের দারুল ইরশাদ বহুলা মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করছেন। লেখালেখি, অনুবাদ ও দ্বীনি আলোচনাতেও তার অংশগ্রহণ রয়েছে। বাংলা ও আরবীতে অনুবাদ করেছেন বেশ কিছু বই। ইতিমধ্যে কয়েকটি প্রকাশিত হয়েছে।
লেখকের অন্যান্য লেখা

সূচিপত্র

সর্বাধিক পঠিত
উত্তম আখলাক: অনন্য ছয়টি মর্যাদা
হাদিস শাস্ত্রের প্রাচ্যবাদী বয়ান এবং মুসলিম সমাজে এর প্রভাব
নকল মূদ্রা: শব্দের খোলসে মতাদর্শ ~ আব্দুল্লাহ আন্দালুসি
পরামর্শ বা মাশওয়ারা: ইসলামের অনুপম এক নির্দেশনা
ইয়াহইয়া সিনওয়ার: শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত লড়ে গেছেন যিনি
দ্যা ফোরটি রুলস অফ লাভ: সুফিবাদের ইউটোপিয়া