আত তিব্ব আননাবাবী বা নববী চিকিৎসা কী? এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। নববী চিকিৎসা বললে আমাদের মাথায় সাধারণত আসে মধু, কালোজিরা, হিজামা ইত্যাদি বিশেষ কিছু বিষয়ের কথা। কিন্তু কুরআন ও হাদীসের চিকিৎসা বিষয়ক বক্তব্যগুলো দেখলে আমরা দেখতে পাই এর পরিসর আরো অনেক বিস্তৃত। আমার যেটা মনে হয়েছে, নববী চিকিৎসা মানে হলো কুরআন ও হাদীসে স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সামগ্রিক নির্দেশনাসমূহ।
এর মাঝে কিছু আছে মানুষের অভিজ্ঞতা ও গবেষণায় আবিস্কৃত বা আবিস্কৃত হতে যাচ্ছে এমন সাধারণ চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে মূল্যায়ন, মন্তব্য, পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা। যেমন, মুসনাদে আহমদের এক হাদীসে আছে—এক বেদুইন সাহাবী এসে জিজ্ঞেস করলেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমরা কি চিকিৎসা গ্রহণ করবো? তিনি বললেন, আল্লাহর বান্দারা, চিকিৎসা নাও। আল্লাহ তাআলা যে রোগই দিয়েছেন, সাথে তার ওষুধও দিয়েছেন। শুধু একটি রোগ ছাড়া। জিজ্ঞেস করা হলো, সে রোগ কোনটি? তিনি বললেন, মৃত্যু। (মুসনাদে আহমদ)
সহীহ মুসলিমের অন্য এক হাদীসে আছে—প্রত্যেক রোগের ওষুধই আল্লাহ তাআলা দুনিয়াতে সৃষ্টি করেছেন। যখন সঠিক অষুধটি উপযু্ক্ত রোগের মধ্যে প্রয়োগ হয়, তখন আল্লাহ তাআলার ইচ্ছায় তা সুস্থ হয়ে উঠে। অন্য শব্দে বলা হয়েছে—তা যে জেনেছে, সে জেনেছে; আর যে জানেনি, সে জানেনি।
এই হাদীসে রোগী ও ডাক্তারকে উৎসাহ ও সাহস প্রদান করা হয়েছে, গবেষকদেরকে নতুন রোগের অষুধ আবিস্কারের জন্য প্রণোদিত করা হয়েছে এবং মানুষকে আবিস্কৃত ভ্যালিড চিকিৎসা-বিজ্ঞানকে সঠিক বিশ্বাসের ভিতর দিয়ে গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ এখানে একটি হাদীস শুধু উল্লেখ করা হলো। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও সে সময়ের গ্রহণযোগ্য চিকিৎসা গ্রহণ করেছেন, সাহাবীগণ করেছেন এবং তিনি নিজে সাহাবাদেরকে ডাক্তারদের কাছে প্রেরণ করেছেন।
যদি ধরেও নেই এই অংশটি বিশেষায়িত অর্থে তিব্বে নববীর অন্তর্ভুক্ত নয়, তবুও একে সামগ্রিকভাবে এর অংশ ধরা জরুরী এ জন্য যে, কেউ কেউ নববী চিকিৎসাকে প্রচলিত চিকিৎসা-বিজ্ঞানের সাথে সাংঘর্ষিক একটি বিকল্প চিকিৎসাপদ্ধতি হিসেবে উপস্থাপন করতে চান। অথচ, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে এভাবে মূল্যায়ন করেননি এবং বিকল্প চিকিৎসাপদ্ধতি হিসেবে পরিপূর্ণ ও সামগ্রিক কোন বিকল্প ব্যবস্থার কথা বলে যাননি।
নবীজির ব্যক্তিত্বের সামগ্রিকায়ন করে পূর্ণতা দেওয়ার জন্য আমাদের সমাজে কারো কারো মধ্যে একটা কথা প্রচলিত আছে—নবীজি একদিকে যেমন শরীয়তের বাহক ছিলেন, অপরদিকে তিনি সেরা বিজ্ঞানী, সেরা চিকিৎসক ইত্যাদিও ছিলেন। এটা সম্পূর্ণ ভুল কথা। তিনি সেরা বিজ্ঞানী ছিলেন না, সেরা চিকিৎসকও ছিলেন না। এটা তার দায়িত্বও ছিল না। এসব না হওয়া তার ব্যক্তিত্বের অপূর্ণতাও নয়।
ইবনুল কাইয়ুম রহ. বলেন :
“আমরা এখানে এই চিকিৎসা বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো না। সামান্য ইঙ্গিত করব শুধু। কারণ, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পাঠানো হয়েছে পথপ্রদর্শক হিসেবে, আল্লাহর পথে জান্নাতের পথে আহ্বানকারী হিসেবে, আল্লাহ তাআলার পরিচয় প্রদান করা, মানুষের সামনে তাঁর সন্তুষ্টির কারণগুলো বর্ণনা করে সে সবের ব্যাপারে নির্দেশ দেওয়া এবং অসন্তুষ্টির জায়গাগুলো দেখিয়ে তা থেকে বিরত থাকতে বলা…… পক্ষান্তরে শারিরিক চিকিৎসার বিষয়টি হলো তার শরীয়তের পূর্ণতা এবং অমৌলিক উদ্দেশ, এই অর্থে যে, প্রয়োজনের সময় একে গ্রহণ করা হবে।…”
এখানে দুইটি নোট মনে রাখা যেতে পারে
এক হলো—নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চিকিৎসার ব্যাপারে যে বিভিন্ন পদ্ধতির কথা বলে গেছেন, তা সব মিলিয়ে পূর্ণাঙ্গ একটি ব্যবস্থা না হলেও তার নির্দেশনা ও পদ্ধতির পরিমাণ কম নয়। অনেক অনেক রোগের চিকিৎসার কথা তিনি বাতলে দিয়েছেন। ইবনুল কাইয়ুম রহ. এর বিখ্যাত যাদুল মাআদ গ্রন্থটির পূর্ণ একটি খণ্ড রয়েছে একে নিয়ে। সেখানে তিনি এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। ধর্মীয় ও প্রায়োগিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের আলোকে বর্ণনা ও বিশ্লেষণ। এ ছাড়া ‘তিব্বে নববী’ নামে স্বতন্ত্র অনেক গ্রন্থও রচিত হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। এ ছাড়া হাদীসের গ্রন্থগুলোতে রয়েছে এ সংক্রান্ত অসংখ্য হাদীস। নববী চিকিৎসা স্বয়ংসম্পূর্ণ কোন ব্যবস্থা না হলেও এর মধ্যে গবেষণা করে চিকিৎসা বিজ্ঞান প্রভুত উন্নতি করতে পারে, সে সুযোগ রয়েছে।
যেহেতু নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, এবং তিনি মহান প্রভুর পক্ষ থেকে সত্য সংবাদদাতা। তবে, আমাদেরকে সতর্ক থাকতে হবে, যে পদ্ধতিটিকে আমি নববী চিকিৎসা হিসেবে বলছি, তা যেন সত্যিই তিনি বলে থাকেন। এসব ক্ষেত্রে কাজ করতে গিয়ে অনেকে অগ্রহণযোগ্য দুর্বল হাদীস ও অনেক সময় জাল হাদীস গ্রহণ করে বসে থাকেন।
দুই. নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেহেতু সরাসরি আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে ওহী প্রাপ্ত হতেন, তাই তার বিভিন্ন উক্তি ও নির্দেশনায় নানা বৈজ্ঞানিক বা চিকিৎসা বিষয়ক সূত্র ও থিউরি উপস্থিত থাকবে এবং সেখান থেকে অনেক সূত্র আবিস্কার করা যাবে, একে কেউ না করছে না। কিন্তু তাকে স্বয়ংসম্পূর্ণ সেরা চিকিৎসক ও সেরা বিজ্ঞানী হিসেবে উপস্থাপন করা অসংগত ও ভুল কর্ম।
বিশেষায়িত অর্থে তিব্বে নববী মানে হলো কুরআনুল কারীম ও নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বাস্থ্য বিষয়ক সরাসরি যে নির্দেশনা ও কর্মগুলো করে গেছেন, সেগুলো। এর মধ্যে দুটি ভাগ রয়েছে। কিছু আছে স্বাস্থের সুরক্ষা ও রোগের প্রাক-প্রতিরোধ। আরবিতে একে বলা হয়ে—আল হিময়াহ। যেমন, মহামারী দেখা দিলে অন্য কোথাও না যাওয়া, ঘরে অবস্থান করা, রাতের বেলা খাবারের পাত্রগুলো ঢেকে রাখা, পানপাত্রে নিঃশ্বাস না ফেলা, রাতের বেলা দ্রুত ঘুমিয়ে যাওয়া, খুব ভোরে জাগ্রত হওয়া ও না ঘুমানো, শরীর চর্চা করা, খাবার কম খাওয়া, উদরের তিনভাগের এক ভাগ পরিমাণ খাওয়া, কুকুরের মুখ দেওয়া পাত্র মাটি দিয়ে মেজে ধুয়ে ফেলা ইত্যাদি। রাতের বেলা দ্রুত ঘুমিয়ে পড়া ও সকালে খুব ভোরে জাগ্রত হওয়ার ধর্মীয় অন্যান্য দিক তো আছেই, শারিরিক উপকারীতার বিষয়েও একে আমরা গ্রহণ করতে পারি। এবং সামগ্রিকভাবে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাতলে দেওয়া সুন্নাহসম্মত জীবনপদ্ধতি মৌলিকভাবে পরকালীন উপকারীতার জন্য হলেও লক্ষ্য করে দেখা গেছে এর পাশাপাশি এ নিয়মের সবটাই স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও সুস্থতা-বান্ধব। এবং এর বেশিরভাগই হলো এ পর্যায়ের—আত্মরক্ষামূলক।
দ্বিতীয় অংশটি হলো—রোগ হওয়ার পর তার চিকিৎসা। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে চিকিৎসাগুলো করেছেন, ইবনুল কাইয়িম রহ. জাদুল মাআদ গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে তিব্বে নববী পরিচ্ছেদে একে তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন :
এক. প্রাকৃতিক ঔষধ দ্বারা।
দুই. আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ পথ্য দ্বারা।
তিন. উভয়টার সম্মিলনে। এরপর তিনি এ সবের ব্যাখ্যা ও বিস্তারিত নমুনা উপস্থাপন করেছেন।
সংক্ষেপ করার উদ্দেশ্যে আমি এখানে শুধু উদাহরণ স্বরূপ একটি করে নমুনা উল্লেখ করছি।
প্রাকৃতিক ঔষধ :
যেমন, জ্বরের চিকিৎসা হিসেবে তিনি বলেছেন রোগীর শরীরে পানি দেওয়ার কথা। বুখারী ও মুসলিম রহ. বর্ণনা করেছেন, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : জ্বর বা জ্বরের প্রচণ্ডতা হলো জাহান্নামের উত্তাপ। একে তোমরা পানি দিয়ে ঠাণ্ডা করো।
এ পর্যায়ের নববী চিকিৎসার ব্যাপারে ইবনে খালদুন মন্তব্য করেছেন—
আরবের কাছে অনেক চিকিৎসাপদ্ধতি ছিল, যার বেশিরভাগই হলো কিছু মানুষের উপর প্রয়োগকৃত অসম্পূর্ণ পরীক্ষার আলোকে। এগুলো তারা পরম্পরাসূত্রে গোত্রের বৃদ্ধ ও বয়স্ক লোকদের থেকে লাভ করেছে। এর মধ্যে কিছু কিছু হয়তো সঠিক হতো। কিন্তু এগুলো চিকিৎসা বিজ্ঞানের সূত্র ও মানুষের প্রকৃতি অনুযায়ী ছিল না।… শরীয়তে চিকিৎসাপদ্ধতি সংক্রান্ত বর্ণনাগুলোও এ ধরণের। এগুলো ওহীর অন্তর্ভুক্ত নয়। এর পক্ষে তিনি পরাগায়নের ঘটনাটি এনেছেন দলীল হিসেবে। (মুকাদ্দামা ইবনে খালদুন—ইলমুল ইলাহিয়্যাত পরিচ্ছেদ)
কিন্তু মুফতি তাকি উসমানি বলেছেন, এ উক্তি সঠিক নয়। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে পদ্ধতিগুলোর কথা দৃঢ়তার সাথে বলে গেছেন, সেগুলো অবশ্যই সঠিক। হয় আল্লাহ তাআলা তাঁকে ওহীর মাধ্যমে জানিয়েছেন, অথবা তিনি অভিজ্ঞতার আলোকেই বলেছেন। যেগুলো ওহীর মাধ্যমে হয়েছে, সেগুলোর ব্যাপারে তো সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। আর, যেগুলো অভিজ্ঞতার আলোকে বলেছেন, সেগুলোও সত্য ও বাস্তব সম্মত, মানুষের জ্ঞান সে পর্যন্ত পৌঁছুক বা না পৌঁছুক।
কেননা, একটা কথা তিনি দৃঢ়তার সাথে বলবেন, কিন্তু বাস্তবতার উল্টো হবে, তা সম্ভব নয়। আর, পরাগায়নের ঘটনাটি দৃঢ়ভাবে বলা কিছু ছিল না। অসঠিক প্রমাণিত হওয়ার পর নবীজি স্পষ্ট করে বলেছেন : আমি ধারণা করে একটা পরামর্শ দিয়েছি। এমন সাধারণ ধারণামূলক কথা দিয়ে আমাকে ধরো না। তবে, আমি যখন আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে কিছু বলবো, তা গ্রহণ করো। কারণ, আমি আল্লাহ তাআলার উপর মিথ্য বলি না। (সারসংক্ষেপ : তাকমিলা ফাতহুল মুলহিম—২৯৩/৪)
আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ পথ্য ও উভয়ের সম্মিলনে চিকিৎসা :
নানা রোগের চিকিৎসায় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন দোয়া শিখিয়েছেন, অনেক সময় বিভিন্ন দোয়া পড়ে রুকইয়া বা ঝাড়ফুক করেছেন। অনেক সময় রুকইয়া করতে গিয়ে বিভিন্ন বস্তুও ব্যবহার করেছেন। যেমন, থুথু, মাটি, পানি। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। যেমন, তিনি বলেছেন : চোখ লাগা সত্য। এর চিকিৎসা হিসেবে তিনি তিনি কিছু দোয়া শিখিয়েছেন। যেমন, أعوذ بكلمات الله التامات من شر ما خلق. বা أعوذُ بكلماتِ اللهِ التامَّةِ، مِن كُلِّ شيطانٍ وهامَّةٍ، ومِن كُلِّ عَيْنٍ لامَّةٍ ইত্যাদি।
কোন কিছুতে কারো চোখ যেন না লাগে, এ জন্য তিনি চোখের মালিককে শিখিয়েছেন বিশেষ দোয়া। যেমন ما شاء الله لا قوة الا بالله. বা اللهم بارك عليه. এমনিভাবে যার চোখ লেগেছে বিশেষ পদ্ধতিতে তার শরীর ধোয়া পানি দিয়ে আক্রান্ত ব্যক্তির গা ধুয়ে দেওয়ার কথা সহীহ মুসলিম শরীফের হাদীসে এসেছে।
ঝাঁড়ফুকের বিষয়টি নিয়ে আমাদের সমাজে নানা রকমের ভুল ও বিভ্রান্তি রয়েছে। কেউ কেউ আছেন ঝাঁড়ফুকের নাম শুনলেই কপাল কুঁচকে ফেলেন। যেন এসব খুবই লজ্জার কথা। অবৈজ্ঞানিক ও কুসংস্কার। এর বিপরীতে অনেকে এসব করতে গিয়ে হালাল হারাম ও জায়েজ নাজায়েজের পরোয়া করেন না। সুতরাং এ নিয়ে একটু লম্বা কথা বলা দরকার।
শুরুতেই দুটো কথা পরিস্কার করি
এক. কারো কারো ধারণা হলো ঝাড়ফুক শুধুমাত্র জিনে ধরা বা বিপদাপদ কাটানোর জন্যই করা যেতে পারে। কিন্তু শারিরিক সমস্যার সমাধান ঝাড়ফুক দিয়ে নয়; ডাক্তারের কাছে গিয়ে চিকিৎসা নিতে হবে। এমনিভাবে অনেকে ঝাঁড়ফুককে ডাক্তারি চিকিৎসার বিপরীত ও প্রতিবন্ধক হিসেবে বিবেচনা করেন। এটা ভুল চিন্তা। ঝাঁড়ফুক সব কিছুর জন্যই হতে পারে। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শারিরিক ব্যথা বেদনার জন্যও ঝাঁড়ফুক করেছেন।
সাহাবায়ে কেরাম সর্পদংশনের চিকিৎসা হিসেবেও রুকইয়া করেছেন। নবীজি তা শুনে খুশি হয়েছেন। এবং এর সাথে সাধারণ ডাক্তারি চিকিৎসার কোন বিরোধ নেই। আগেই বলা হয়েছে, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাধারণ চিকিৎসা গ্রহণের জন্য উৎসাহিত করেছেন। আপনি উভয়টিই করতে পারেন। সমাজের সাধারণ মানুষ যদি ঝাঁড়ফুকে আকৃষ্ট হয়ে প্রয়োজনীয় সাধারণ চিকিৎসাকে এড়িয়ে চলে, তাহলে তাদেরকে সে ব্যাপারে সতর্ক করতে হবে। একটার জন্য অপরটাকে খাটো করা বা প্রতিবন্ধক মনে করা আপনার চিন্তাগত সমস্যা।
দুই. সমাজে ঝাঁড়ফুকের নামে অনেক কুসংস্কার ও নাজায়েজ কর্মকাণ্ড প্রচলিত আছে। এগুলোতে লিপ্ত হওয়া যাবে না, এসবকে উৎসাহিতও করা যাবে না। বরং, চিহ্নিত করে করে এসবের মূলোৎপাটন করতে হবে। এর জন্য আগে প্রয়োজন হলো শরয়ী রুকইয়া ও তাবিজের বিধানটি জেনে রাখা।
ঝাড়ফুক ও তাবিজের বিধান :
শরীয়তের অনেক বিধান আছে এমন, যেগুলোর ব্যাপারে শরীয়ত শুধুমাত্র একটি বক্তব্যই দেয় নি; বরং বিভিন্নভাবে নানাদিক থেকে এর উপর আলোকপাত করে হুকুমটিকে স্পষ্ট করেছে। এ হুকুমটির ব্যাপারে সমস্ত কথা একটি আয়াতে বা একটি হাদীসে থাকতে হবে এমন কোন নিয়ম নেই। এ জন্য বিষয়টির ব্যাপারে শরীয়তের মূল সিদ্ধান্তটি বের করতে হলে খুঁজে খুঁজে এ সংকক্রান্ত সবগুলো বক্তব্যকে হাজির করে সবগুলোর সমন্বয়ে মূল সিদ্ধান্তটি বের করতে হবে।
জাহেলী যুগে আরব জনগোষ্ঠি নানান কুসংস্কারে বিশ্বাসী ছিল। এর মধ্যে অন্যতম একটি ছিলো শিরকি আকিদা বিশ্বাসের সাথে ঝাঁড়-ফুক করা ও নানা রকমের তাবিজ ব্যবহার করা। মানুষের ক্ষেত্রে যেমন ব্যবহার করতো, তেমনি জন্তু জানোয়ারের বেলায়ও করতো।
অথচ সকল ক্ষমতার মালিক হলেন একমাত্র আল্লাহ তাআলা। তিনিই রোগ দেন। তিনিই রোগ থেকে আরোগ্য দান করেন। কোন কিছুতেই তাঁর কোন শরীক বা সমকক্ষ নেই। ইসলাম এসে এ শিরকি কাজটিকে নিষেধ করে দিয়েছে। হাদীসে আছে-
إن الرقى والتمائم والتولة شرك
অর্থ : নিশ্চয়ই ঝাঁড়-ফুক, তাবিজ ও তিওয়ালা (এক ধরণের যাদু) শিরক। (সুনানে আবু দাউদ : তাবিজ ঝোলানো অধ্যায় : ৩৩৮) একবার একদল লোক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এলে তিনি তাদের ৯জন থেকে বাইয়াত নিলেন একজন থেকে নিলেন না। তারা বললো : ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনি নয়জন থেকে নিলেন, একজন থেকে নিলেন না! তখন তিনি বললেন : তার শরীরে তাবিজ ঝোলানো। অতঃপর হাত ঢুকিয়ে তাবিজ ছিড়ে ফেললেন এবং বললেন : যে ব্যক্তি তাবিজ ঝোলালো সে কুফরি করলো। ( মুসনাদে আহমদ : ১৭৪২২)
তামিমাহ অর্থ তাবিজ। এর বহুবচন তামাইম। প্রথম হাদীসে শব্দটি বহুবচনে এসেছে। পরের হাদীসে এসেছে এক বচনে। এখানে তাবিজ দ্বারা যে জাহেলী জামানায় প্রচলিত তাবিজ উদ্দেশ্য এ ব্যাপারে মুহাদ্দিসীনে কেরাম ও হাদীসের ব্যাখ্যাকারগণ পরিস্কার ভাষায় বলে গেছেন।
সহীহ বুখারীর ভাষ্যকার হাদীস শাস্ত্রের ইমাম ইবনে হাজার র. তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ফাতহুল বারীতে বলেন :
তামায়েম শব্দটি তামীমা শব্দের বহুবচন। যা পুঁতি বা মালা সাদৃশ্য। মাথায় লটকানো হয়। জাহেলী যুগে বিশ্বাস করা হতো যে, এর দ্বারা বিপদমুক্ত হওয়া যায়, মহিলারা এসব ব্যবহার করতো স্বামীর মোহাব্বত অর্জন করতে। এটি জাদুরই একটি প্রকার। এটি শিরকের অন্তুর্ভূক্ত। কেননা এর দ্বারা আল্লাহ ছাড়া অন্যের থেকে বিপদমুক্ত হওয়া ও উপকার অর্জন করা উদ্দেশ্য হয়ে থাকে। কিন্তু এ শিরকের অন্তুর্ভূক্ত হবে না যেসব তাবীজ কবচে আল্লাহর নাম বা কালাম থাকে। {ফাতহুল বারী-১/১৬৬, ঝারফুক অধ্যায়}
হাদীসের আরেক বিখ্যাত ব্যাখ্যাকার মোল্লা আলী কারী রহ. বলেন-
সারমর্ম হলো : শিরকি ঝাঁড়-ফুক দ্বারা উদ্দেশ্য হলো এমন ঝাঁড়-ফুক যার মধ্যে মুর্তি বা শয়তানের নাম আছে, বা কুফরি কথা আছে অথবা এমন কোন কথা আছে যা শরীয়ত সমর্থিত নয়। শরীয়ত অসমর্থিতগুলোর একটি হলো এমন কোন কথা থাকা যার অর্থ বোধগম্য নয়। আর তামিমা মানে তাবিজ যা শিশুর গলায় ঝোলানো হয়। ইমাম তিবি কোন শর্ত ছাড়া সাধারণভাবেই একে ব্যাখ্যা করেছেন। তবে উচিত হলো হলো শর্ত লাগিয়ে এভাবে বলা-শিরকি তাবিজ হলো ঐ তাবিজ যার মধ্যে আল্লাহ তাআলার নাম বা কুরআনুল কারীমের আয়াত বা কুরআন হাদীসে বর্ণিত দোয়া উল্লেখ নাই।
কেউ কেউ ‘তামিমা’ শব্দের ব্যাখ্যায় বলেছেন- তামিমা বলা হয় এমন মালা যা জাহেলী যুগে আরবরা তাদের ধারণা অনুযায়ী বদনজর থেকে বাঁচানোর জন্য শিশুর শরীরে লটকে দিতো। এটা বাতিল ও নিষিদ্ধ। অতঃপর তারা ব্যবহারগতভাবে এ অর্থের মধ্যে ব্যাপকতা এনে প্রত্যেক ঐ বস্তুকে তামিমা বলতে লাগলো যা ব্যবহার করে বিপদাপদ থেকে আশ্রয় চাওয়া হয়। তাদের এ ব্যাখ্যাটি খুবই সুন্দর। (মিশকাত শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘মিরকাতুল মাফাতিহ’- এর চিকিৎসা অধ্যায়।)
আরো লক্ষ্য করি-
যে হাদীস দিয়ে তাবিজের ব্যাপারে আপত্তি তোলা হয় সে হাদীসে ঝাড়-ফুককেও শিরকি কাজ বলা হয়েছে। কিন্তু ঝাঁড়-ফুকের ব্যাপারে বলা হয় এখানে বিশেষভাবে শুধু জাহেলী যুগের শিরকি ঝাঁড়-ফুককে বোঝানো হয়েছে। প্রশ্ন হলো, তাবিজের ব্যাপারেও একই কথা না বলে ব্যাপকভাবে সমস্ত তাবিজকে নাকচ করা হয় কেন? এটা ইনসাফের কথা নয়।
জাবের রা. থেকে বর্ণিত, আরেকটি হাদীসে তিনি বলেন : নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হলো নুশরা করা কেমন? তিনি বললেন : এটি শয়তানি কাজ। (সুনানে আবু দাউদ : ৪৫৫৩ : তিব্ব অধ্যায়)
এ হাদীসের ব্যাখ্যায় মোল্লা আলী কারী রহ. বলেন : তাবীজকেও নুশরা বলা হয়। এমন প্রকার তাবিজ যা জাহেলী যুগের মানুষেরা ব্যবহার করতো এবং এটিই মানুষকে সুস্থ করে দেয় বলে বিশ্বাস রাখতো। ( এটি নাজায়েজ ও শয়তানী কাজ) পক্ষান্তরে যে তাবিজে কুরআনুল কারীমের আয়াত লেখা বা আল্লাহ তাআলার নাম বা গুণবাচক নাম লেখা অথবা হাদীসে বর্ণিত দোয়া লেখা তাতে কোন সমস্যা নেই। বরং মুস্তাহাব। চাই এটি তাবিজ আকারে ব্যবহার করা হোক বা ঝাঁড়-ফুক হিসেবে ব্যবহার করা হোক। (মিশকাত শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘মিরকাতুল মাফাতীহ’-এর চিকিৎসা অধ্যায়।)
সুতরাং :
১. জহেলী যুগে প্রচলিত শিরকি আকিদাযুক্ত তাবিজ বা ঝাঁড়-ফুক ব্যবহার করা হারাম।
২. যেগুলোর অর্থ দুর্বোধ্য সেগুলোর মধ্যে শিরকি কথা থাকার আশংকা থাকায় সেগুলো ব্যবহার করাও নাজায়েজ।
৩. জাহেলী যুগে প্রচলিত ঝাঁড়-ফুক-তাবিজ আর কুরআন সুন্নাহ সমর্থিত ঝাঁড়-ফুক-তাবিজ এক নয়। উভয়টার হুকুমও এক নয়।
দেখা যাচ্ছে, কুরআন সুন্নাহ সমর্থিতগুলো ব্যবহার করা শুধু জায়েজই নয়; বরং মুস্তাহাব। এ বিষয়টি আরো পরিস্কার করার জন্য নীচে আমরা আরো কিছু হাদীস উল্লেখ করলাম।
লম্বা একটি হাদীসের সারমর্ম : এক সফরে এক সাহাবী এক বেদুইন গোত্রের সর্দারকে এক পাল বকরির বিনিময়ে সূরা ফাতেহা দিয়ে ঝাঁড়-ফুক করলেন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শোনার পর বললেন তোমাদেরকে কে বললো এ দিয়ে ঝাঁড়-ফুক করা যায়! বেশ ভালো করেছো। বকরি থেকে আমাকেও একটা ভাগ দিও। (সুনানে আবু দাউদ : ঝাঁড়-ফুক করার নিয়ম অধ্যায় : ৩৪০১) এখানে থেকে বুঝা যাচ্ছে কুরআনের আয়াত দিয়ে ঝাড়-ফুক করা যাবে।
আরেকটি হাদীসের মূল অংশ : মানুষ অসুস্থ হলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তর্জনী মাটিতে ছুঁইয়ে উপরে উঠাতেন এরপর এই দোয়া পড়তেন- باسم الله تربة أرضنا بريقة بعضنا ليشفى به سقيمنا بإذن ربنا (সহীহ মুসলিম : বদ নজর… থেকে ঝাঁড়-ফুক করা মুস্তাহাব হওয়া প্রসঙ্গে : ৪০৬৯)
কোন হাদীসে আছে ফু দেওয়ার সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রুগির ব্যাথার স্থানে হাত রেখে দোওয়া পড়তেন। এছাড়া এ সংক্রান্ত আরো অনেক হাদীস আছে।
এখান থেকে বুঝা যাচ্ছে, হাদীসে বর্ণিত দোয়াগুলো দ্বারা ঝাঁড়-ফুক করা যাবে। এটি শুধু এ হাদীস নয়, এ ব্যাপারে অসংখ্য হাদীস আছে, রোগ হলে কুরআন হাদীসে বর্ণিত বিভিন্ন দোয়া পড়ে ঝাঁড়ফুক করা অত্যন্ত উপকারী একটি আমল। সকল যুগেই মুসলমানগণ তা পালন করে এসেছেন।
এক সাহাবী জিজ্ঞেস করলেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমরা জাহেলী জামানায় ঝাঁড়-ফুক করতাম। এখন এ ব্যাপারে আপনি কী বলেন? বললেন : ঝাঁড়-ফুক করার কথাগুলো আমাকে দেখাও। শিরকি কিছু না থাকলে ঝাঁড়-ফুক করতে কোন সমস্যা নেই। (সহীহ মুসলিম : ৪০৭৯) এ হাদীস দ্বারা এটা একদম পরিস্কার যে, ঝাঁড়-ফুক করতে হলে কুরআনের আয়াত বা হাদীসে বর্ণিত দোয়া হতে হবে এমন কোন কথা নেই; বরং শিরকি কথা না থাকলে অন্য কোন ভালো কথা দ্বারা এ তাদবীর করা যাবে।
আরেকটি হাদীস লক্ষ্য করুন- এক সাহাবী বলেন : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভয় ও বিপদের সময় পড়ার জন্য তাদেরকে কিছু কথা শিখিয়েছেন। কথাগুলো হলো এই- أعوذ بكلمات الله التامة من غضبه وشر عباده ومن همزات الشياطين وأن يحضرون
আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা. কথাগুলো তাঁর ছেলেদের মধ্য থেকে যে বুঝমান তাকে শিখিয়ে দিতেন আর যারা বুঝমান ছিলো না কথাগুলো লিখে তার শরীরে বেঁধে দিতেন। (সুনানে আবু দাউদ : ৩৩৯৫)
বিখ্যাত হাদীসের কিতাব মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবাতে গ্রন্থকার সাঈদ ইবনে মুসাইয়্যিব, আতা, মুজাহিদ, আবু জাফর, মুহাম্মদ ইবনে সীরীন, উবাইদুল্লাহ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে উমর, যাহ্হাক প্রমুখ থেকে তাবিজ ব্যবহার করা জায়েজ হওয়ার ব্যাপারে বক্তব্য নকল করেছেন। (তাকমিলাতু ফাতহিল মুলহিম : ৪র্থ খণ্ড, ২৭৭ পৃ. কিতাবুত তিব্ব)
এখান থেকে আমরা বুঝলাম ঝাঁড়-ফুকের মত শরীয়ত সমর্থিত বক্তব্য লিখে তাবিজও ব্যবহার করা যাবে।
পেছনে আমরা দেখে এসেছি যে, হাদীসে তাবিজের ব্যাপারে যে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে তা দ্বারা উদ্দেশ্য হলো জাহেলী যুগের শিরকি তাবিজ। শরীয়ত সমর্থিত তাবিজের নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে একটি হাদীসও নাই। এবং এ সংক্রান্ত হাদীসগুলো পাঠ করলে বুঝা যায় যে এ ধরণের তাবিজকে নিষেধ করার কোন কারণও নাই। পাশাপাশি অনেক সাহাবী, তাবেয়ী, তাবে তাবেয়ী থেকে নিয়ে বর্তমান সময় পর্যন্ত হক্কানী ইমামগণ ও উলামায়ে কেরাম তাবিজ ব্যবহার করে এসেছেন, মানুষকে তাবিজ লিখে দিয়েছেন এবং এর জায়েজ হওয়ার ব্যাপারে স্পষ্ট ভাষায় বক্তব্য দিয়েছেন। পেছনে এর কিছু উদ্বৃতিও দেওয়া হয়েছে।
আল্লামা ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন : আক্রান্ত বা অন্য যে কোন রুগির জন্য কুরআনুল কারীম থেকে ও তার স্মরণ থেকে জায়েজ কালি দ্বারা কিছু লিখে দেওয়া এবং তা ধুয়ে পান করানো জায়েজ আছে। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল অন্যান্য ইমামগণ এ ব্যাপারে স্পষ্টভাবে জায়েজ হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। প্রমাণ স্বরূপ ইবনে তাইমিয়া রহ. তাবিজ জায়েজ হওয়ার ব্যাপারে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে আসার উল্লেখ করেছেন। (মাজমুআতুল ফাতাওয়া : ১৯/৬৪), (তাকমিলাতু ফাতহিল মুলহিম : ৪র্থ খণ্ড, ২৭৭ পৃ. কিতাবুত তিব্ব।