মাকাসিদে শরীয়া: প্রাথমিক ধারণা

মানবজাতির উপর যে গুরুভার ও শৃংখল ছিল তা থেকে তাদেরকে মুক্ত করা ইসলামী শরীয়তের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। (সূরা আরাফ:১৫৭) ন্যায় ও সদাচার প্রতিষ্ঠা করাও শরীয়ার অন্যতম লক্ষ্য। (সূরা নাহল:৯০) এবং এই শরীয়তের বাহক হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সৃষ্টিকূলের জন্য রহমত ও অনুগ্রহ স্বরূপ প্রেরণ করা হয়েছে। (সূরা আম্বিয়া:১০৭)

ফলে শরীয়ার কোন বিধান হেকমত-প্রজ্ঞা ও কল্যাণ (مصلحة) বর্জিত বা বিরোধী হবে, এটা অসম্ভব ব্যপার। এজন্য আমরা যখন পৃথিবীর অন্যান্য ধর্ম-মতবাদের সাথে ইসলামের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করি, তখন ইসলামী শরীয়ার প্রজ্ঞা ও কল্যাণ বারবার আমাদের হৃদয়কে নাড়া দেয়। ঈমানকে করে সতেজ ও মজবুত।

বস্তুত: শরীয়ার এই রুচি ও মেজাজ সম্পর্কে সে সকল আয়াত থেকে ধারণা পাওয়া যায়, যেখানে ঐশী বিধানাবলী বর্ণনা করার পর এর হেকমত ও কল্যাণের দিকগুলোও আলোচিত হয়েছে। কিসাসের বিধান দেয়ার পর একথাও স্পষ্ট করে বর্ণনা করা হয়েছে, বাহ্যত যদিও এটি দ্বিতীয় আরেকটি হত্যাকাণ্ড, কিন্তু এর মধ্যে মানবজাতির জীবন ও বেঁচে থাকা নিহিত রয়েছে। পবিত্র কোরআনের ভাষায়, “আর কেসাসে রয়েছে তোমাদের জন্য জীবন” (সূরা বাকারা:১৭৯) মদ ও জোয়ার নিষিদ্ধতা যেখানে আলোচিত হয়েছে সেখানে বলা হয়েছে, একদিকে এসব তোমাদের নিজেদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করে, অপরদিকে নামাজ ও আল্লাহ পাকের স্মরণ থেকে তোমাদের উদাসীন করে রাখে। (সূরা মায়েদা:৯১) এমনিভাবে যদি কারো পক্ষে  অজু বা গোসল করা কষ্টকর হয়, সে ক্ষেত্রে তাকে তায়াম্মুমের অনুমতি দেয়া হয়েছে। কেননা মূল উদ্দেশ্য হলো পবিত্রতা অর্জন করা, অসুবিধা ও কষ্টে ফেলা কাম্য নয়। “আল্লাহ তোমাদের উপর অসুবিধা আরোপ করতে চান না। তিনি চান তোমাদের পবিত্র করতে এবং তোমাদের উপর তার অনুগ্রহ পূর্ণ করতে”। (সূরা মায়েদা:৬৫)

কল্যাণ (مصلحة) নির্ধারণ: ইসলামী ও বস্তুবাদী মানদন্ড

তবে এক্ষেত্রে আমাদের একটি মৌলিক বিষয় যত্নের সাথে স্মরণ রাখতে হবে। মানুষের জন্য কোন বিধান ও কাজটি কল্যাণকর, এটা নির্ধারণ করার মানদন্ড কী হবে? এ ব্যাপারে ইসলাম এবং নিছক বস্তুবাদী ধ্যান-ধারণা ও মতবাদগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ ভিন্ন।

বস্তুবাদী ধারণা মতে মতে, যে বস্তুই সাময়িক প্রশান্তি ও আনন্দ সৃষ্টি করবে, সেটি “কল্যাণ” (مصلحة) হিসেবে গৃহীত হবে। পরিনাম ও ফলাফলের বিচারে চাই তাতে যত অকল্যাণ ও ক্ষতিই থাকুক। উদাহরণ হিসেবে নেশাজাত দ্রব্যের কথা বলা যায়। যে ব্যক্তি নেশা গ্রহণ করে সন্দেহ নেই, এই নেশা তাকে সুখ ও প্রশান্তি দেয়। কিন্তু মানব স্বাস্থ্যে এটি কত ভয়ানক নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবুও এই নেশাজাত দ্রব্যকে “কল্যাণ” বিরোধী বা অকল্যাণ (مفسدة) হিসেবে আখ্যায়িত করা হবে না। কেননা সবকিছুর পরেও এটি আয়েশ ও প্রশান্তির উপকরন। বস্তুবাদী ধারণায় ধর্ম ও পরকাল চিন্তা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত।

অপরদিকে ইসলামি শরীয়া মতে কল্যাণের বিষয়টি আল্লাহপাক ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস এবং প্রতিপালকের সন্তুষ্টি লাভের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।


মূলতঃ এজন্য ইসলামী শরীয়ায় এমন বহু বিধান রয়েছে যেগুলোতে ধর্মীয় ও নৈতিক কল্যাণ রক্ষার্থে পার্থিব ও বস্তুবাদী কল্যাণকে সাময়িকভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে। যেমন হজ্ব ফরজ করা হয়েছে। এটি পালন করতে সফরের কষ্ট ক্লান্তি সহ্য করতে হয়, বিপুল টাকা-পয়সা ব্যয় হয়। আবার কনকনে শীতের রাতেও অজু এবং গোসলের বিধান দেয়া হয়েছে। বড় বড় কিছু অপরাধের জন্য দৃষ্টান্তমূলক কঠোর শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে। সন্দেহ নেই এই প্রতিটি কাজেই ব্যক্তির সামান্য হলেও বস্তুগত ক্ষতি ও অকল্যাণ রয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি হল, এসবের আত্মিক এবং নৈতিক-চারিত্রিক কল্যাণ ও উপকারিতা অকল্যাণ ও ক্ষতি থেকে বহুগুণ বেশি।

মাকাসিদে শরীয়াহ (مقاصد الشريعة)

মূলতঃ এ কারণে ইসলামী আইনজ্ঞগণ কল্যাণ (مصلحة)  সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করার প্রয়াস পেয়েছেন। এক্ষেত্রে তারা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, শরীয়তের মাকাসিদ (مقاصد الشريعة) বা উদ্দেশ্যসমূহ মোট পাঁচটি।
১. দীন সংরক্ষণ (حفظ الدين)
২. প্রাণ সংরক্ষন (حفظ النفس)
৩. মস্তিষ্ক সংরক্ষণ (حفظ العقل)
৪. বংশধারা সংরক্ষণ (حفظ النسل)
৫. সম্পদ সংরক্ষণ (حفظ المال)

ইসলামের মহান ফকীহ, ইমাম ও মুজতাহিদগণ শরীয়তের সমস্ত বিধানাবলি পূর্ণরূপে পর্যালোচনা ও অনুসন্ধান (استقراء) করে দেখেছেন যে, শরীয়তের প্রত্যেকটি বিধান এই পাঁচ মাকাসিদ মাকাসিদ বা উদ্দেশ্যের কোন একটির অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে। এই অনুসন্ধানের ভিত্তিতে এটা স্থির হয়, শরীয়তের মাকাসিদ বা উদ্দেশ্যগুলো হচ্ছে উল্লেখিত পাঁচটি জিনিস সংরক্ষণ করা।

এই বিশ্লেষণের আলোকে ফকীহ ও ইমামগণ শরয়ী দৃষ্টিকোন থেকে কল্যাণ (مصلحة) ও অকল্যাণ (مفسدة) নির্ধারণের মাপকাঠি সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। যার সারসংক্ষেপ হচ্ছে, প্রত্যেক এমন বস্তু যা উল্লেখিত পাঁচটি বিষয়কে সংরক্ষন করে বা এর পূর্ণতা বিধান করে—শরীয়তের দৃষ্টিতে সেটাই কল্যাণ (مصلحة) হিসেবে বিবেচিত হবে। অপরদিকে যে বস্তু উক্ত পাঁচটি বা এর কোন এর কোন একটিকে ব্যহত করবে, শরীয়তের দৃষ্টিতে সেটাই অকল্যাণ (مفسدة) বলে গৃহীত হবে।

মাকাসিদের এই পাঁচ বিষয় সংরক্ষণের কয়েকটি মাধ্যম রয়েছে। গুরুত্বের বিচারে মাধ্যমগুলো তিনটি স্তরে বিভক্ত। উসূলে ফিকহের ইমামদের পরিভাষায় এগুলোকে বলা হয়—
১. জরুরিয়াত (الضروريات)
২. হাজিয়াত (الحاجيات)
৩. তাহসীনিয়াত (التحسينيات)

জরুরিয়াত (الضروريات)
জরুরিয়াত হচ্ছে এমন বিষয়াবলী যেগুলোর ওপর দীন, প্রাণ, মস্তিষ্ক, বংশধারা ও সম্পদ সংরক্ষন সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল। এসব ছাড়া এই পাঁচটি জিনিস সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়। জরুরিয়াতের কাজ হচ্ছে, এই পাঁচ জিনিসের রোকন ও ভিত্তিসমূহ প্রতিষ্ঠিত করা এবং এগুলোর উপর আরোপিত বা ভবিষ্যতে আসতে পারে এমন সমস্যাগুলো দূর করা।

দীন সংরক্ষণ (حفظ الدين)


দীন সংরক্ষণ করার উদ্দেশ্যে প্রথমে এর রুকনের প্রতি জোর দেয়া হয়েছে দেয়া হয়েছে। ঈমান আনা এবং মুখে দুই শাহাদাহ উচ্চারণ করাকে আবশ্যক করা হয়েছে। এর পাশাপাশি দীনের অন্যান্য রুকন প্রণয়ন করা হয়েছে। দীনের উপর আরোপিত বা ভবিষ্যতে আরোপ হতে পারে, এমন ক্ষতি থেকে রক্ষা করার জন্য জিহাদের বিধান দেয়া হয়েছে। মুসলিম সমাজে বিদআত প্রচারকারী ব্যক্তির জন্য শাস্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

প্রাণ সংরক্ষণ (حفظ النفس)
এই উদ্দেশ্যে পানাহার বৈধ করা হয়েছে। কাউকে হত্যা করার অপরাধে কিসাস ও দিয়তের বিধান প্রণয়ন করা হয়েছে।

বংশধারা সংরক্ষণ (حفظ النسل)
এজন্য প্রণয়ন করা হয়েছে বিবাহ, সন্তান প্রতিপালন ও খোরপোষের বিধান। অপরদিকে যিনাকে অবৈধ করা হয়েছে। তাছাড়া এই অপরাধের জন্য শাস্তির বিধান দেয়া হয়েছে।

মস্তিষ্ক সংরক্ষণ (حفظ العقل)
মস্তিষ্ক সুস্থ ও সচল রাখার জন্য খাবার গ্রহণের বিধান দেয়া হয়েছে। আবার নেশাজাত দ্রব্য গ্রহণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এবং কেউ গ্রহণ করলে তাকে শাস্তি ভোগ করতে হবে।

সম্পদ সংরক্ষণ (حفظ المال)
সম্পদ সংরক্ষণের লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রকার লেনদেন বৈধ করা হয়েছে। অপরদিকে চুরি নিষিদ্ধ করার পর চুরির শাস্তি নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে।

হাজিয়াত (الحاجيات)
হাজিয়াত হচ্ছে সে সকল বিধান যেগুলোর উপর উপর উক্ত পাঁচ মাকাসিদ যদিও নির্ভরশীল নয়, কিন্তু যদি এগুলোর অনুমোদন না দেয়া হয় তাহলে মাকাসিদ পাঁচটি অর্জন করতে অসুবিধা ও সংকীর্ণতা দেখা দিবে। এসকল ক্ষেত্রে অসুবিধা দূর করা এবং সহজতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে যে সকল বিধান দেয়া হয় সেগুলোকে বলে হাজিয়াত।

দীন সংরক্ষণের ক্ষেত্রে হাজিয়াতের উদাহরণ হল শরীয়ত কর্তৃক প্রদত্ত বিভিন্ন রুখসতসমূহ। যেমন কোনো ঘাতকের হাত থেকে বাঁচার জন্য কুফরি বাক্য মুখে উচ্চারণ করা। সফর বা অসুস্থতার কারণে রোজা না রাখা ইত্যাদি।

প্রাণ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে উদাহরণ হচ্ছে, মানুষের মৌলিক খাদ্যের বাইরে উত্তম ও  সুস্বাদু খাবার গ্রহণ ও শিকার করা বৈধ হওয়ার বিধান।

বংশধারা সংরক্ষণের ক্ষেত্রে মোহর ও তালাকের বিধান হাজিয়াতের  দৃষ্টান্ত।

সম্পদ সংরক্ষণে এর দৃষ্টান্ত হচ্ছে, বিভিন্ন প্রকার লেনদেন যেমন—কিরাজ (قراض) সালাম (سلم) বর্গাচুক্তির (مزارعة ومساقاة) বৈধতা। শরীয়তের সাধারণ মূলনীতির আলোকে এসব লেনদেন বৈধ না হওয়ার কথা। কিন্তু মানুষের অসুবিধা ও সমস্যার দিকটি বিবেচনা করে শরীয়তে এগুলোকে বৈধ করা হয়েছে।

তাহসীনিয়াত (التحسينيات)


তাহসীনিয়াত হচ্ছে সে সকল বিধান— শরীয়ত যদি এগুলোর অনুমোদন না দিত তাহলে মানুষের জীবনে উল্লেখযোগ্য কোনো অসুবিধা (حرج) ও সংকট তৈরি হতো না না। তবে এ বিষয়গুলো উত্তম আখলাক (مكارم الأخلاق) , সুন্দর ও প্রশংসনীয় অভ্যাসাবলীর (محاسن العادات) অন্তর্ভুক্ত।

পাক নাপাকির বিধান, সতর ঢেকে রাখা এবং এ শ্রেণির অন্যান্য বিধানগুলো দীনি ক্ষেত্রে তাহসীনিয়াতের উদাহরণ। প্রাণ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে এর দৃষ্টান্ত হল, পানাহারের আদব-কায়দা এবং খাবার গ্রহণে সীমালংঘন ও অতি সংকীর্ণতার পথ থেকে বেঁচে থাকা।


সম্পদ সংরক্ষণে তাহসীনিয়াতের উদাহরণ হচ্ছে নাপাক বস্তু, উদ্ধৃত পানি ও ঘাস বিক্রি নিষিদ্ধ হওয়ার বিধান। বিবাহের ক্ষেত্রে কুফু বা সমতার বিধান এবং তাদের বৈবাহিক জীবনে শিষ্টাচারগুলো (آداب المعاشرة) হচ্ছে বংশধারা সংরক্ষনের তাহসীনিয়াত।

তাহসীনিয়াতের ক্ষেত্রে একটি বিষয় বিশেষভাবে মনে রাখা আবশ্যক। তা হল, এ শ্রেণির কিছু বিধান রয়েছে যেগুলো সম্পাদন করা শরীয়তে উত্তম ও মুস্তাহাব পর্যায়ের। যেমন পানাহারের আদবসমুহ। আরেক শ্রেণির তাহসীনিয়াত রয়েছে যা পালন করা ফরজ ও আবশ্যক। যেমন সতর ঢেকে রাখা, পবিত্রতা অর্জন করা ইত্যাদি। কেননা কোন বিধান তাহসীনিয়াতের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার অর্থ হচ্ছে, এ বিধান বর্জন করলে পার্থিব জীবনে মানুষ বিশেষ কোন অসুবিধার সম্মুখীন হবে না। কিন্তু আদাব-শিষ্টাচার ও আত্মিক অনেক বিবেচনার কারণে এই তাহসীনি বিধানকে শরীয়তে মানুষের জন্য আবশ্যক ও জরুরী আখ্যায়িত করা হয়।

মাকাসিদে শরীয়ার স্তর বিন্যাস

পূর্বে আমরা যে পাঁচটি মাকাসিদের আলোচনা করেছি এগুলোর মধ্যে গুরুত্বের বিচারে একটি স্তর বিন্যাস (مراتب) রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাকসাদ হচ্ছে দীন সংরক্ষণ (حفظ الدين) । তারপর প্রাণ সংরক্ষণ (حفظ النفس) । অতঃপর মস্তিষ্ক সংরক্ষন (حفظ العقل) । গুরুত্বের বিচারে এর পরের স্থান হল বংশধারা সংরক্ষনের (حفظ النسل) । সবার শেষে আসে সম্পদ সংরক্ষণ (حفظ المال) ।

শরীয়তের বিধানাবলী পর্যালোচনা ও অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, কোন ক্ষেত্রে এই মাকাসিদগুলোর মধ্যে যদি পরস্পর সংঘর্ষ দেখা দেয়, তাহলে উক্ত ধারাবাহিকতা অনুসারে তুলনামূলক গুরুত্বপূর্ণ মাকসাদ কে প্রাধান্য দেয়া হয়। যেমন, কাফেরদের বিরুদ্ধে জিহাদ করলে মানুষের প্রাণহানি হতে পারে। অপরদিকে জিহাদ না করলে দীনের হেফাজত সম্ভব নয়। তাই এখানে দীন রক্ষার (حفظ الدين) মাকসাদকে প্রাণ রক্ষার (حفظ النفس) মাকসাদের উপর প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। আবার কেউ যদি তীব্র ক্ষুধার সম্মুখীন হয় এবং মদ ব্যতীত খাবার মত অন্য কিছু না পায়, সেক্ষেত্রে শরীয়ত তাকে প্রয়োজন পরিমাণ মদ গ্রহণ করার অনুমতি দিয়েছে। যদিও মদপান মানুষের মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা নষ্ট করে, তবুও প্রাণ রক্ষার (حفظ النفس) স্বার্থে মস্তিষ্ক সংরক্ষণের (حفظ العقل) মাকসাদকে এখানে বর্জন করা হয়েছে।

মনে রাখতে হবে, গুরুত্বের বিচারে মাকাসিদে শরীয়ার এই বিন্যাস ও ধারাক্রম তখনই বিবেচ্য হবে যখন প্রত্যেকটি মাকাসিদ একই স্তর ও শ্রেণীভুক্ত হবে। অর্থাৎ প্রত্যেকটি হয়তো জরুরীয়াত পর্যায়ের হবে কিংবা হাজিয়াত বা তাহসীনিয়াতের  অন্তর্ভুক্ত হবে।

এর ব্যতিক্রম হলে অর্থাৎ একটি মাকসাদ জরুরিয়াত পর্যায়ের, অন্যটি হাজিয়াত বা তাহসীনিয়াত পর্যায়ের, তাহলে প্রাধান্যের ক্ষেত্রে এগুলোর মধ্যে নিম্নোক্ত ধারাক্রম অনুসরণ হবে। সর্বপ্রথম প্রাধান্য পাবে জরুরিয়াত। তারপর হাজিয়াত এবং সব শেষে তাহসীনিয়াত।

একটি উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি আমরা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারি। শরীয়তে সতর ঢাকা ফরজ। কিন্তু চিকিৎসার প্রয়োজনে জরুরত পরিমাণ সতর উন্মোচন করা বৈধ রয়েছে। কেননা সতর ঢাকার বিধান তাহসীনি পর্যায়ের। অপরদিকে প্রাণ রক্ষার জন্য চিকিৎসা করা জরুরিয়াত পর্যায়ের মাকসাদ। তাই শরীয়ত জরুরি (ضروري) কে তাহসীনি (تحسيني) বিধানের উপর প্রাধান্য দিয়েছে। আবার বিভিন্ন ইবাদত সম্পাদন করতে মানুষের কম বেশি কষ্ট হয়ে থাকে। কিন্তু এই কষ্ট হওয়া সত্ত্বেও শরীয়ত ইবাদতের বিধান দিয়েছে। কেননা দীন সংরক্ষণের জন্য ইবাদত সম্পাদন করা  জরুরি (ضروري) মাকসাদ।

মাকাসিদে শরীয়ার চূড়ান্ত লক্ষ্য কী?

মাকাসিদে শরীয়া সম্পর্কে একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বর্ণনা করে এই আলোচনার ইতি টানব। সংক্ষেপে এর বিবরণ হচ্ছে, পূর্বে যে পাঁচটি মাকাসিদ এবং এগুলো অর্জনের তিনটি স্তর সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে, মূলতঃ এসব কিছুই সর্বোচ্চ একটি মৌলিক ও কেন্দ্রিয় লক্ষ্য অর্জনের মাধ্যম ও উপকরণ। সেই সর্বোচ্চ লক্ষ্যটি হচ্ছে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পরিচয় লাভ করা, একনিষ্ঠ মনে তাঁর গোলামি ও বন্দেগীতে নিয়োজিত থাকা, যার সাহায্যে বান্দা তাঁর সন্তুষ্টি লাভ করবে  এবং জান্নাতের চিরস্থায়ী বাসিন্দা হবে। বস্তুতঃ এটি দুনিয়ার সাথে পরকালীন জীবনের যোগসুত্র ও বন্ধন।


এ ব্যাপারে কোরআন ও হাদিসে প্রচুর দলিল প্রমাণ রয়েছে। কোরআনুল কারীমে আল্লাহপাক বলেন, আমি জিন ও মানুষকে সৃষ্টি করেছি এইজন্য যে, তারা আমারই ইবাদত করবে। (সূরা যারিয়াত:৫৬)
হাদীস শরীফে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, বান্দাদের উপর আল্লাহ পাকের হক হচ্ছে, তারা একমাত্র তাঁর ইবাদত করবে এবং তাঁর সাথে অন্য কাউকে অংশীদার করবে না। (সহি মুসলিম ) তিনি আরেকটি হাদিসে বলেছেন, দুনিয়া হল নিন্দিত, নিন্দিত দুনিয়াতে যা কিছু রয়েছে। তবে ব্যতিক্রম হল, আল্লাহ পাকের জিকির ও এর মত অন্যান্য বিষয় এবং আলেম ও জ্ঞান অন্বেষী ব্যক্তি। (তারা নিন্দিত নয়,বরং উত্তম ও প্রশংসনীয়) —সুনানে তিরমিজি।

সারকথা, সৃষ্টির মূল লক্ষ্য হল, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পরিচয় লাভ এবং একমাত্র তাঁর ইবাদত বন্দেগী করা। অপরদিকে এই পাঁচ মাকাসিদের কাজ হলো মানুষের জীবনকে সুবিন্যস্ত করা। সুখ ও সৌভাগ্য নিশ্চিত করা। ফলে যে ব্যক্তি এই মাকাসিদগুলোকে ব্যবহার করবে, যে উদ্দেশ্য ও দায়িত্বের জন্য তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে তা সম্পাদন করার জন্য, সে হবে আল্লাহ পাকের কৃতজ্ঞ বান্দা। কিন্তু কেউ যদি এগুলোকে অন্য উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে তাহলে কেয়ামতের দিন সে লজ্জিত হবে। পরিতাপ করে বলবে, “আফসোস! আমার এ জীবনের জন্য আমি যদি কিছু অগ্রিম পাঠাতাম?!” (সূরা ফাজর:২৪)

তথ্যসূত্র ~


قاموس الفقه لخالد سيف الله رحماني
ضوابط المصلحة في الشريعة الإسلامية لسعيد رمضان البوطي
الوجيز في أصول الفقه لعبد الكريم زيدان
المدخل الفقهي العام لمصطفى أحمد الزرقا.  

Picture of আনাস চৌধুরী
আনাস চৌধুরী
আনাস চৌধুরীর জন্ম নব্বইয়ের শেষ দিকে, হবিগঞ্জ সদরে। পড়াশোনা করেছেন ঢাকার জামিয়াতুল উলুমিল ইসলামিয়াতে। পরবর্তিতে দারুল উলুম দেওবন্দেও অধ্যয়ন করেছেন এক বছর। পেশায় তিনি একজন শিক্ষক, হবিগঞ্জের দারুল ইরশাদ বহুলা মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করছেন। লেখালেখি, অনুবাদ ও দ্বীনি আলোচনাতেও তার অংশগ্রহণ রয়েছে। বাংলা ও আরবীতে অনুবাদ করেছেন বেশ কিছু বই। ইতিমধ্যে কয়েকটি প্রকাশিত হয়েছে।
লেখকের অন্যান্য লেখা

সূচিপত্র

সর্বাধিক পঠিত
উত্তম আখলাক: অনন্য ছয়টি মর্যাদা
হাদিস শাস্ত্রের প্রাচ্যবাদী বয়ান এবং মুসলিম সমাজে এর প্রভাব
নকল মূদ্রা: শব্দের খোলসে মতাদর্শ ~ আব্দুল্লাহ আন্দালুসি
পরামর্শ বা মাশওয়ারা: ইসলামের অনুপম এক নির্দেশনা
ইয়াহইয়া সিনওয়ার: শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত লড়ে গেছেন যিনি
দ্যা ফোরটি রুলস অফ লাভ: সুফিবাদের ইউটোপিয়া